Ticker

6/recent/ticker-posts

কাঁহা গেলে তোমা পাই - জয়দেব মুখোপাধ্যায়

amarboi কাঁহা গেলে তোমা পাই
জয়দেব মুখোপাধ্যায়

ভুমিকা: কেউ বলেন নীলাচলে গিয়ে শ্রীমহাপ্রভু তাঁর সন্ন্যাসলীলা শেষ করে বিলীন হয়ে গেছেন জগন্নাথ মন্দিরের জগবন্ধুর শ্রীমূর্তির ভেতরে, কেউ বা তোটা গোপীনাথের জঙ্ঘাদেশের সোনালী চিড়টুকু দেখিয়ে বলেন - ঐ চিড়ের ফাঁক দিয়েই গৌরাঙ্গসুন্দর মিলিয়ে গেছেন গোপীনাথের মূর্তির ভেতরে, কেউ বা সবজান্তার সুরে গুরুগম্ভীরভাবে বর্ণনা করেছেন এক পূর্ণিমা রাত্রে শ্রীচৈতন্যদেবের বঙ্গোপসাগরে ঝাঁপ দিয়ে আত্মবিসর্জনের প্রচলিত কাহিনী। আবার দুই একজন গুচিণ্ডা বাড়িতে মহাপ্রভুর অন্তর্ধান হওয়ার কাহিনীও শোনান।
কিন্তু সে সব কিংবদন্তীর কোনটাতেই অন্তরে আঘাত লাগার মত কোন কথা ছিল না, ছিল না রক্তাক্ত বীভৎসতার কোন প্রচ্ছন্ন ইশারা বা ইঙ্গিত। বরং ঐ সব কিংবদন্তীর মধ্যেই ছিল মন প্লাবিত করা নতুন রসের জোয়ার। কারণ, ঐ কিংবদন্তীগুলোতে রয়েছে দেবকল্প এক মহাপুরুষের অলৌকিক অন্তর্ধানের ভক্তিরস সৃষ্টিকারী কিছু শ্রুতিসুখকর রহস্যের বিস্তার।
কিন্তু অনিন্দ্যসুন্দর প্রেমাবতার শ্রীগৌরাঙ্গ যিনি জীবনের পরম বসন্ত লগ্নে গৃহত্যাগী হয়েছিলেন অনন্যরূপসী ভার্যা আর স্নেহময়ী মাতৃদেবীকে পিছনে ফেলে, কেবলমাত্র দুঃখী-তাপীর জ্বালা মেটাতে আর নিপীড়িত অবহেলিত অজস্রকে বিবেকবর্জিত বিত্তবানের অত্যাচারের খড়্গ থেকে রক্ষা করতে। যিনি অজস্র নরাধম পাপী-তাপীকেও তাঁর হৃদয়ের অকুন্ঠ প্রেমের বন্যায় প্লাবিত করে তাদের সকলকে আশ্রয় দান করেছিলেন নিজ স্নেহ স্নিগ্ধ অমৃতময় ক্রোড়ে। সেই লক্ষ ভক্তের পরম ভালোবাসার ধন শ্রীচৈতন্যকে হত্যা করেছিল কোন সে শয়তান নির্দয়ের কৃপাণ ? এ প্রসঙ্গে ডঃ নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেন - "কিভাবে তাঁর দেহাবসান ঘটেছিল সে সম্বন্ধে আমার কিছু যুক্তি নির্ভর ধারণা আছে। কিন্তু সেই ধারণাটি আমি প্রকাশ্যে বলতে বা ছাপার অক্ষরে লিখতে পারব না ; যদি বলি বা লিখি, তা'হলে বঙ্গদেশে প্রাণ নিয়ে বাঁচতে পারব না।"
কী তাঁর সেই যুক্তি নির্ভর ধারণা ? কোন পৈশাচিক পরিবেশে সর্বজীবে সমদর্শী প্রেমের পূজারী এক সর্বত্যাগী নিরস্ত্র সন্ন্যাসীর বৈরাগ্যব্যাপ্ত জীবনে নেমে এসেছিল অকাল মৃত্যুর যবনিকা ? মাত্র সাতচল্লিশ বছর বয়সে কারা হত্যা করেছিল তাঁকে ? কেনই বা করেছিল ? কেন ? কেন ? কেন ?
শ্রীচৈতন্যের রহস্যময় অন্তর্ধান সম্পর্কে অনেক পণ্ডিত মোহান্তের কাছে প্রশ্ন করলে উত্তর পাওয়া যায় - চৈতন্যদেব স্বয়ং ভগবান ছিলেন। তাঁর জীবনের আবার আরম্ভ আর শেষ আছে নাকি ? কিন্তু ভগবান তো তিনি তাঁর হৃদয়বত্তায় অন্তর-সত্তায়। তাঁর বাইরের যে দেহ, তার তো আরম্ভের দৃশ্য ইতিহাস আমাদের সামনে - তাঁর জন্মলগ্নের সেই অপূর্ব বর্ণনা। তবে তাঁর বহির্সত্তা অর্থাৎ তাঁর পঞ্চভূতে তৈরি শরীরের শেষ মুহূর্তের ইতিহাসটুকুই বা আমরা জানতে পারব না কেন ?
শ্রীগৌরাঙ্গের আকস্মিক অন্তর্ধান রহস্যটি উদ্‌ঘাটন করে এতদিনের চলে আসা ইতিহাসের নামে অনৈতিহাসিক অবিশ্বাস্য উদ্ভট সব কল্পনার অবসান ঘটানো ; মিথ্যা কল্পনাশ্রয়ী ইতিহাসকে সত্যের অভিমুখে ঘুরিয়ে দেওয়া, প্রায় সাড়ে চারশো বছর পূর্বে ঘটে যাওয়া একটা নৃশংস ঘটনার সত্যতার স্বপক্ষে বহু প্রাচীন গবেষকদের গবেষণালব্ধ প্রামান্য তথ্য সমৃদ্ধ গ্রন্থ ডঃ জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের "কাঁহা গেলে তোমা পাই"।
কিন্তু দুঃখের বিষয় এটাই যে, লেখক যে সত্যের সন্ধানে তাঁর এই প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন তা এই গ্রন্থের মধ্যে দিয়ে শেষ করতে পারেন নি। শেষ করেছিলেন এই গ্রন্থেরই দ্বিতীয় খণ্ডের মধ্য দিয়ে যা আশ্চর্যজনকভাবে আজও অপ্রকাশিত। এবং গভীর বেদনার ব্যাপার তাঁর এই সত্যানুসন্ধানের জন্য তাঁকে প্রাণ পর্যন্ত দিতে হয়েছিল। সেই পুরীতেই একদিন তিনি রহস্যজনকভাবে খুন হয়ে যান।

Download and Comments/Join our Facebook Group