লক্ষ্মণের নরকদর্শন
নবনীতা দেব সেন
স্বর্গের উদ্যানে বসে বসে গল্পগুজব করছিলেন তিন সখী, ত্রিজটা, শূর্পণখা আর অয়োমুখী৷
— ‘তুই যাই বলিস অয়োমুখী, তাড়কাদিকে মেরে ফেলেই মুক্তি দিয়েছিল ওরা৷ আমার মতো কাননাক কেটে রেখে দিলে আরও খারাপ হত৷’
— ‘খারাপ বলে খারাপ? তোমার তো শুধু নাসাকর্ণ ছেদন করেই তৃপ্ত হয়েছিল৷ বেচারি আমার বেলায়? শুধু তো নাককানই নয়, আমার পাকা আমের মতো স্তন দুটিও দুর্বৃত্ত লক্ষ্মণ তীর মেরে চারটুকরো করে ফেলেছিল৷ এত নির্মমতা হিংস্র মানুষকেই শোভা পায়৷ বনের পশুরা কখনও এমনি আচরণের কথা ভাবতেই পারত? তুমিই বল?’
বহুদর্শিনী ত্রিজটা শুনে বললেন, — ‘যেমন গেছলে তোমরা! বনেবাদাড়ে যেসব শহুরে মানুষগুলো ঘুরে বেড়ায় তাদের কক্ষনো বিশ্বাস করতে আছে? ওই মাথায় ঝুঁটি, পিঠে ধনুক, কোমরে ছোরাছুরি, সব কটা গুন্ডা! তারা নানান ছলাকলা জানে, মিথ্যেবাদীর একশেষ, শরীরে দুর্বুদ্ধি গুলি পাকিয়ে আছে৷ একফোঁটা মায়াদয়া নেই৷ এক যারা বনবাসী, বনেই যাদের ঘরসংসার, সেই বন্যজাতি, আর যাদের গাঁয়েগঞ্জে বসবাস, বৌ-বাচ্চা আছে, তারাই ভাল৷ ওদের তবু মায়াদয়ার প্র্যাকটিস থাকে৷ প্রেমে পড়বি তো পড় তাদের সঙ্গে৷ প্রেম যদি নাও করে, তারা অমন কেটে কুচিয়ে কুটনো কুটে ফেলবে না৷ ছুটে পালিয়ে যাবে৷ বড়জোর বৌ থাকলে ঝ্যাঁটা মেরে বিদেয় করে দিতে আসবে৷ আমাদের তো কোনও ক্ষতি করার ক্ষ্যামতাই তাদের নেই৷ আমরা রাক্ষসিনী, একটা মানুষকে যখন খুশি কুপ করে গিলেই ফেলতে পারি বেশি বেগড়বাঁই করলে৷ জি চাহে তো বাস — কাপুৎ৷ কিন্তু ওই বনেবাদাড়ে বেড়ানো ক্ষত্রিয়গুলো? ওগুলো ভারি বদ৷ কাউকে ভয় পায় না৷ বহোৎ খতরনাক চিজ—’
— ‘আর ওই যে মুনিঋষি, ব্রহ্মচারীরা, ওরাও বড্ড বদ হয় ত্রিজটামাসি,— উনকো খুনমে হি গুসসা হ্যায়৷ ওফ কী রাগ! বামুন না ছাই৷ আসলে চণ্ডাল সব৷ রাগ নাকি চণ্ডাল? তবে তো প্রত্যেকটা তপস্বীই চণ্ডাল৷ শ্মশানের কোনও রিঅ্যাল চণ্ডালকে কেউ দেখেছে শুধু শুধু রাগের চোটে কাউকে ছাই করে দিচ্ছে? যক্ষকে রাক্ষস বানাচ্ছে, দেবতাকে বাঁদর করে দিচ্ছে আর সুন্দরী অপ্সরাকে যমুনা নদীতে পেটমোটা রুইমাছ বানিয়ে ফেলছে? এসব যত রকমের কেচ্ছা-কুকীর্তি সমস্ত ওই বামুনগুলোর কাজ৷ কথায় কথায় শাপশাপান্ত৷’
— ‘আরে দূর, গেছলি কেন তোরা প্রেম করতে? রাক্ষসে মানুষে গাঁট-বন্ধন? ইয়ে তো কভি নহি হোনা চাহিয়ে৷ রাজা রাবণকে দেখলি না, কী সর্বনাশ করলেন?’
—’রাবণকা বাত অলগ হ্যায়— উসকো ভি শাপ থা’, অয়োমুখী তর্ক জুড়ে দেন৷ স্বর্গে এলেই সবায়ের স্বর্গের ভাষা৷ রাষ্ট্রভাষাটা রপ্ত হয়ে যায়৷ ‘কেন ভীমের সঙ্গে কি হিড়িম্বামাসির বিয়ে হয়নি? ভীমমেসোও তো তখন বনেবনেই ঘুরছিলেন৷’
শূর্পণখা ঠোঁট উল্টোল, ‘ঈইশ! বনেবনে ঘুরছিল না আরও কিছু! পাঁচশরিকের বৌটাকে সুদ্ধু ল্যাজে বেঁধে নিয়ে বনেবনে পিকনিক করে বেড়াচ্ছিল মা আর পাঁচ ভাইতে মিলে৷ লক্ষ্মীছেলের মতো আগে মায়ের পারমিশান নিয়ে তবেই না, ভীমমেসো বিয়েটা করল?’
অয়োমুখী ছাড়েন না— ‘কিন্তু মা তো ভীমকে অনুমতি দিয়েছিলেন৷ কুন্তিদিদা তো রামের মতো শিখিয়ে দেননি,— ‘যা বাছা, ওই রাক্ষসদের মেয়েটার নাককানগুলো ঘ্যাঁচঘ্যাঁচ করে কুচিয়ে কেটে আনগে যা! দ্রৌপদীও তো বাপু হিড়িম্বামাসিকে কিছুই গালমন্দ করেনি? অথচ কে না জানে দ্রৌপদীর মুখ? বাব-বা!’
ত্রিজটা এবার দু’পক্ষকে শান্ত করতে বলেন— ‘ওদের কথা ছেড়ে দে৷ ওরা এই ইক্ষাকু বংশীয়দের চেয়ে ঢের ভদ্র৷ দিব্যি যাজ্ঞসেনীটাকে পাঁচ ভাইতে কী সুন্দর ভাগ করে নিলে, বল দিকিনি, কেবল মায়ের একটা কথায়? তবে ওর পেছনেও কাণ্ড আছে৷ বলি শোন! সবাই জানে দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামী তো? আর কুন্তির জীবনে কটা? গুনে দ্যাখ না? ওরও জীবনে পাঁচ পাঁচটা পুরুষ এসেছিল, ঠিক দ্রৌপদীরই মতন, তবে একসঙ্গে নয়, কিউ দিয়ে৷ ওয়ান বাই ওয়ান৷ সূর্য, পাণ্ডু, ধর্ম, পবন, ইন্দ্র৷ সোদর ভাইও নয়, পাঁচ জাতের পুরুষ পাঁচজন৷ একজন গ্রহ, একজন মানুষ, একজন কিছুই নয়, শুধু মানুষের তৈরি করা তত্ত্ব, একজন পঞ্চভূতের একভূত, আর একজন একদিকে যেমন দেবতাদের রাজা, আরেকদিকে ঝড়-বৃষ্টির কন্ট্রোলার৷ পাঁচটি পুরুষের পাঁচমূর্তি বটে৷ মজাটা কিন্তু অন্য জায়গায়৷ বিয়েটা হয়েছে যার সঙ্গে, তার সঙ্গে কুন্তির ছেলেপুলে কিসসু হয়নি৷ আর যাদের সঙ্গে পটাপট একের পর এক ছেলে হয়েছে, তাদের সঙ্গে মোটে বিয়েই হয়নি৷ কুন্তির ব্যাপারটা এক্কেবারে ইস্পেশাল— বহোৎ জবরদস্ত ঔরত থি না? সতীনের ছেলেদুটোকেও ট্যাঁকে গুঁজে রেখেছিল৷ ও তো মত দেবেই৷ না দিলে ভীম কি শুনত? ভীম তো যুধিষ্ঠির য্যায়সা ওইস্যা লড়কা থোড়াই থা! ও অনেকটাই আমাদের মতো৷ যা ট্রাইসেপ!’
অয়োমুখী আর শূর্পণখা হেসে ওঠেন, ‘তা যা বলেছ মাসি— দারুণ মাসল! তবে যুধিষ্ঠিরই বা কী এমন? দ্রৌপদী যদি দ্রৌপদী না হয়ে হিড়িম্বা হত, আমাদের মতো একটু বড়সড় দেখতে, কুলোর মতো কান দুখানা, মূলোর মতো দাঁত আর তালগাছের মতো লম্বা— তা হলে যুধিষ্ঠির কত লক্ষ্মীছেলে হয়ে মায়ের কথা শুনত জানা আছে, হ্যাঁ! দূর, পেঁচো জুয়াড়ি একটা৷ বৌ একবার জেলখানা থেকে ছাড়িয়ে দিল, লজ্জা নেই? তক্ষুনি আবার জুয়ো খেলে বনে গেল৷ যাচ্ছেতাই৷ কেন যে লোকে ওকে ধর্মপুত্তুর বলে?’
— ‘ধর্মের পুত্তুর তাই৷’ অয়োমুখী বলেন, — ‘তবে হ্যাঁ, দ্রৌপদী অত রূপবতী বলেই সবকটা ছেলে সেদিন মাতৃভক্ত হয়ে উঠেছিল৷’
ত্রিজটা হাত নেড়ে বলেন,— ‘আর কুন্তিও কি জানত না ভেবেছিস? কুঁড়েঘরের ফাঁক দিয়ে সব দেখা যায়৷ ইচ্ছে করেই অমন একটা অদ্ভুত কথা বলে দিল— ‘তোমরা পাঁচজনে... ছেলেদের সঙ্গে তুমিও কেন সেদিন ভাগ করে ভিক্ষাদ্রব্যটি খেলে না? ফলমিষ্টি কি হরিণের মাংস হলে তো খেতে?’
— ‘তা যাই বল ত্রিজটামাসি, কুন্তিটা খুব দায়িত্বহীন কাজ করেছিল কিন্তু—’
‘দায়িত্বহীন না ছাই! খুব চালুপুরিয়া ওই কুন্তি৷ উও ভি রাজনীতিকা এক কূটচাল থা— চাল! বুঝলি না? ভায়েভায়ে পাছে অশান্তি হয়, বনেবনে ঘুরছে সব, মনে শান্তি নেই এমনিতেই তায় ওই আগুনের টুকরো মেয়েকে নিয়ে এল ঘরের মধ্যে৷ তাই ওই ব্যবস্থা৷ এককথায় সবাই খুশি, সবাই ঠান্ডা৷ দরজার ফুটো দিয়ে দ্রৌপদীকে দেখেই তো অমন ন্যাকার মতন কথাটি বলেছিল৷ পাঁচছেলে যাতে এককাট্টা থাকবে৷ ঘরে শান্তি থাকবে৷ সবাই ভাগ পাবে৷’
— ‘আর তাছাড়া বৌ-ও বেশ নিজের মতোই পাঁচজন পুরুষের ভোগে লাগবে,— আর তাহলে শাশুড়ির চরিত্র নিয়ে কথা শোনাতে পারবে না৷ সে বুদ্ধিটাও ছিল নিশ্চয় ভিতরে ভিতরে৷ কি বলিস শূর্পণখা?’
— ‘ভোগে লাগবে’ আবার কী কথা অয়োমুখী? রাক্ষসবংশীয়দের মুখে তো এমন মানুষের মতন ইতর কথা মানায় না? ‘ভোগ করবে’ বল! দ্রৌপদীও কুন্তির মতোই পাঁচজন পুরুষকে ভোগ করবে৷ ফলে শাশুড়িকে হিংসে করতে পারবে না৷ এই বলতে চাস তো?’ শূর্পণখার কথা শেষ হওয়ার আগেই দেখা গেল উদ্যানপথে হর্ষিতচরণে লক্ষ্মণ আসছেন৷ যক্ষ-রক্ষ, নর-বানর স্বর্গে তো সকলকেই যেতে হয়৷ সবার সঙ্গে তখন দেখা হয়৷ পুনর্মিলনের উৎসব হয়৷ পুরনো দিনের গল্পগাছা হয়৷ পুরনো ক্রোধ ক্ষোভ সবই স্মরণপথে মুহূর্তের জন্য ভেসে ওঠে, উদয় হয়েই আবার মিলিয়ে যায়৷ আর ওই মুহূর্তটিতে ঘটে সেই ব্যক্তির নরকদর্শন৷ একটিই মোটে মুহূর্ত, — কিন্তু তার মনে হয় বুঝি সহস্র বৎসর— সময় যেন কাটতে চায় না৷
এদিকে লক্ষ্মণকে দেখামাত্রই তো অয়োমুখী ও শূর্পণখা রাগে দাঁত কিড়মিড় করে উঠল৷ স্বর্গে সকলেই কামরূপিণী৷ কি রাক্ষসী কি বান্দরী, সবাই সুন্দরী৷ যার যেমন চেহারা পাওয়ার ইচ্ছে ছিল, সে ঠিক তেমনই দেখতে হয়ে যায়৷ স্বর্গে কেউ বৃদ্ধ, রুগণ, বিকলাঙ্গ, শ্রীহীন থাকে না৷ বৃদ্ধা ত্রিজটা তাঁর যৌবনের রূপ ফিরে পেয়েছেন৷ অয়োমুখী আবার পূর্ণাঙ্গী, পূর্ণস্তনী হয়েছেন৷ শূর্পণখার গজিয়েছে একটি তিলফুল জিনি নাসা৷ আর বোগেনভিলিয়ার ফুলের মতো কানদুটি৷ লক্ষ্মণ ওঁদের দেখে চিনতে পারলেন না, চেনবার কথাও নয়৷ কিন্তু যারা চেনবার তারা লক্ষ্মণকে ঠিকই চিনেছে৷ লক্ষ্মণ তিন সুন্দরীকে দেখে আরেকবার ঘুরে তাকালেন৷ ত্রিজটা বিপদ বুঝে তাড়াতাড়ি বললেন, ‘রাজকুমার, এ পথটুকু দ্রুত পায়ে পেরিয়ে যান৷ পিছনে তাকাবেন না৷ পিছনে তাকালেই বিপদ৷’
লক্ষ্মণ চিরকেলে জেদি৷ তিনি অন্যের কথা শুনবেন কেন? এদিকে রাক্ষসীদের সেই এক মুহূর্তের জিঘাংসা তাদের স্বর্গীয় সৌন্দর্য নষ্ট করে দিয়েছিল— রাগের সময়টুকুর জন্য তারা সেই বিকলাঙ্গ বিকৃত রাক্ষসীরূপ ফিরে পেয়েছিল৷ জ্ঞানবতী, বুদ্ধিমতী, ত্রিজটার বারণ সত্ত্বেও চট করে গোঁয়ার লক্ষ্মণ একবার পিছনে তাকালেন তিন সুন্দরীকে আরেকটিবার দেখতে৷ আর ঠিক যেন দুঃস্বপ্নের মতন লক্ষ্মণ স্পষ্ট দেখতে পেলেন বিশালবপু, বিকটা, বিকৃতদর্শনা নাসিকাকর্ণস্তন ছিন্নভিন্ন, অশ্রু ও রক্তে মাখামাখি দু’জন রাক্ষসী গর্জন করতে করতে হাত বাড়িয়ে প্রচণ্ড মুখব্যাদান করে, হাঁয়ের মধ্যে লকলকে আগুনজিভ ও তীক্ষ্ণ দাঁতের শূল বের করে, তাঁকেই চিবিয়ে খেতে আসছে৷
স্বর্গে কারুর তীরধনুক থাকে না৷ লক্ষ্মণেরও নেই৷ আত্মরক্ষার একটি মাত্রই উপায় আছে, দে ছুট দে ছুট! পাঁই পাঁই করে লক্ষ্মণ দৌড় লাগালেন৷ তাঁর মনেই রইল না যে এটা স্বর্গ৷ এখানে হিংসাদ্বেষ চলে না, এখানে ভয়ভাবনা নেই, এখানে কেউ কাউকে মারতে কাটতে পারে না— তিনি ভুলেই গেলেন যে তিনি অলরেডি মৃত, আবার নতুন করে রাক্ষসের পেটে যাওয়ার বা ভয়ে মরে যাওয়ার কোনও আশঙ্কাই তাঁর নেই৷
তীব্র প্রাণভয়ে আকুল হয়ে লক্ষ্মণ আথালিবিথালি ছুট লাগালেন৷ যেন অনন্তকাল ধরে মৃত্যু তাঁকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে৷ কত গিরিপর্বত, কত অরণ্য, মরুভূমি, কত নদনদী, কত তেপান্তরের মাঠ পার হয়ে প্রলম্বিত হল সেই প্রচণ্ড পলায়ন— শেষে হাঁপাতে হাঁপাতে ক্লান্ত বিধ্বস্ত লক্ষ্মণ ঊর্মিলার পায়ের কাছে এসে ধপাস করে পড়ে গেলেন৷ ঊর্মিলা পারিজাত ফলের বিচি বাদ দিয়ে আচার তৈরি করছিলেন৷ খুব অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন— ‘কী ব্যাপার স্বামী? এত ছুটছেন কেন?’ ‘বাঁচাও, ঊর্মিলা, বাঁচাও সেই সব রাক্কুসীরা আমাকে খেতে আসছে৷’ মহাবীর লক্ষ্মণের মুখে এই বালকোচিত কথা শুনে ঊর্মিলা হেসেই গড়িয়ে পড়লেন৷
— ‘আপনি নিশ্চয়ই দুঃস্বপ্ন দেখেছিলেন আর্যপুত্র— এখানে রাক্কুসী কোথায়? এ তো স্বর্গ! এখানে দেব-দানবে, নর-রাক্ষসে তো তফাত নেই৷ সবাই স্বর্গত আত্মা৷ সবাই অমৃত পান করেছেন, কেউ আপনাকে খেতে আসবেন না৷’
লক্ষ্মণের তখনও তীব্র ভয়ে বুক ধুকপুক করছে, পা টলছে, মাথার মধ্যে টালমাটাল৷ ধীরে ধীরে, শান্ত হয়ে তিনি ব্যাপারটা সম্যক অভিধাবন করতে সক্ষম হলেন৷ — ‘এই তবে আমার নরকদর্শনের পালা চুকে গেল’৷
মাত্র এক লহমার ব্যাপার কিন্তু মনে হয়েছিল বুঝি অন্তহীন পথ, অন্তহীন দৌড়, অন্তহীন মৃত্যুভয়৷ এবার লক্ষ্মণ চিনতে পারলেন— ওরা অয়োমুখী আর শূর্পণখা৷ এতদিনে টের পেলেন যে তিনি মহাপাপ করেছিলেন৷ ছোট ছেলেরা যেমন গঙ্গাফড়িঙের পা ছিঁড়ে দেয়, প্রজাপতির ডানা ছিঁড়ে ফেলে৷ এ তার চেয়েও বেশি৷ উনি একটি স্ত্রীলোকের নাসাকর্ণ ও একজনের নাসাকর্ণ, স্তনযুগল টুকরো করে কেটে ফেলে দিয়েছিলেন৷ ওদের অপরাধ, ওরা লক্ষ্মণকে প্রণয়নিবেদন করেছিল৷ লঘুপাপে গুরুদণ্ড দেওয়া হয়ে গেছে৷ লক্ষ্মণ নিজে নিজেই বুঝতে পারলেন যেখানে ক্ষমাপ্রার্থনা করে প্রত্যাখ্যানই হত যথেষ্ট, সেখানে তিনি তাদের আক্রমণ করে কুরূপা, বিকটা, অঙ্গহীনা করে দিয়েছিলেন৷ এ অন্যায়ের কোনও যুক্তি নেই৷
স্বর্গে গেলে সকলেরই সত্যদৃষ্টি খুলে যায়৷ লক্ষ্মণের সত্যদর্শন হল৷ তিনি তখন ঊর্মিলার সামনে নতজানু হয়ে বসে অয়োমুখী ও শূর্পণখার কাহিনী তাঁকে বলে, নিজের অপরাধ স্বীকার করলেন৷ ঊর্মিলা শুনে যারপরনাই দুঃখিত হয়ে বললেন— ‘যাও, তুমি আবার ওঁদের খুঁজে বের করে মার্জনাভিক্ষা করগে৷’ লক্ষ্মণ বললেন, ‘ঊর্মিলা, আমি এখন কোথায় ওঁদের খুঁজে পাব? স্বর্গ যে বড্ড বেশি বড়— এর সীমা নেই প্রান্ত নেই— বিপুল বিস্তারিত এলাকা৷ কিন্তু আমি খুবই দুঃখিত৷ যদি কখনও অয়োমুখী, শূর্পণখার সঙ্গে আবার দেখা হয়, তবে ওদের নিশ্চয়ই বলব, ‘আমাকে তোমরা ক্ষমা করে দাও৷ আমার মহা অন্যায় হয়েছিল৷’ তখুনি স্বর্গের মৃদুমলয় বায়ু সেই মার্জনাভিক্ষাটি বয়ে নিয়ে গিয়ে অয়োমুখী আর শূর্পণখার কানে কানে পৌঁছে দিল৷ আসলে লক্ষ্মণ তো বেশিদূরে যাননি৷ অয়োমুখীদের ঠিক পাশের কুঞ্জবনটিতেই ঊর্মিলা ফল পাড়ছিলেন৷ নরকদর্শনের উদ্দেশ্যে লক্ষ্মণের ওই ঊর্ধ্বশ্বাস প্রাণভয়ে দীর্ঘ দৌড়টি সম্পূর্ণ মায়ার ঘোরে সৃষ্ট এক লহমার চিত্তবিভ্রম মাত্র৷
লক্ষ্মণকে দেখে রাগত হয়ে, নরকদর্শন হয়ে গিয়েছে রাক্ষসীদেরও৷ মার্জনাভিক্ষা কানে দেহের স্বর্গীয় সৌন্দর্য অন্তরের অক্ষয় সৌন্দর্য হয়ে উঠল৷ তাঁদেরও সত্যদৃষ্টি খুলে গেল৷ ক্ষমামৃতের স্বাদ পেয়ে৷ — ‘এইবার তোদের বিউটিটার পার্মানেন্ট ট্রিটমেন্ট হয়ে গেল৷ শতবার লক্ষ্মণের সঙ্গে দেখা হলেও আর কিন্তু আগের বিকৃত রূপটি তোদের স্পর্শই করতে পারবে না’— বলতে বলতে রূপসী ত্রিজটার মুখখানি আহ্লাদে জ্যোতির্ময় হয়ে যায়৷
ভাগ্যিস স্বর্গে বিউটি কনটেস্ট হয় না, হলে কিন্তু সেই মুহূর্তে তিনজনেই ‘মিস স্বর্গ ফরএভার’ হয়ে যেতেন৷
নবনীতা দেব সেন
স্বর্গের উদ্যানে বসে বসে গল্পগুজব করছিলেন তিন সখী, ত্রিজটা, শূর্পণখা আর অয়োমুখী৷
— ‘তুই যাই বলিস অয়োমুখী, তাড়কাদিকে মেরে ফেলেই মুক্তি দিয়েছিল ওরা৷ আমার মতো কাননাক কেটে রেখে দিলে আরও খারাপ হত৷’
— ‘খারাপ বলে খারাপ? তোমার তো শুধু নাসাকর্ণ ছেদন করেই তৃপ্ত হয়েছিল৷ বেচারি আমার বেলায়? শুধু তো নাককানই নয়, আমার পাকা আমের মতো স্তন দুটিও দুর্বৃত্ত লক্ষ্মণ তীর মেরে চারটুকরো করে ফেলেছিল৷ এত নির্মমতা হিংস্র মানুষকেই শোভা পায়৷ বনের পশুরা কখনও এমনি আচরণের কথা ভাবতেই পারত? তুমিই বল?’
বহুদর্শিনী ত্রিজটা শুনে বললেন, — ‘যেমন গেছলে তোমরা! বনেবাদাড়ে যেসব শহুরে মানুষগুলো ঘুরে বেড়ায় তাদের কক্ষনো বিশ্বাস করতে আছে? ওই মাথায় ঝুঁটি, পিঠে ধনুক, কোমরে ছোরাছুরি, সব কটা গুন্ডা! তারা নানান ছলাকলা জানে, মিথ্যেবাদীর একশেষ, শরীরে দুর্বুদ্ধি গুলি পাকিয়ে আছে৷ একফোঁটা মায়াদয়া নেই৷ এক যারা বনবাসী, বনেই যাদের ঘরসংসার, সেই বন্যজাতি, আর যাদের গাঁয়েগঞ্জে বসবাস, বৌ-বাচ্চা আছে, তারাই ভাল৷ ওদের তবু মায়াদয়ার প্র্যাকটিস থাকে৷ প্রেমে পড়বি তো পড় তাদের সঙ্গে৷ প্রেম যদি নাও করে, তারা অমন কেটে কুচিয়ে কুটনো কুটে ফেলবে না৷ ছুটে পালিয়ে যাবে৷ বড়জোর বৌ থাকলে ঝ্যাঁটা মেরে বিদেয় করে দিতে আসবে৷ আমাদের তো কোনও ক্ষতি করার ক্ষ্যামতাই তাদের নেই৷ আমরা রাক্ষসিনী, একটা মানুষকে যখন খুশি কুপ করে গিলেই ফেলতে পারি বেশি বেগড়বাঁই করলে৷ জি চাহে তো বাস — কাপুৎ৷ কিন্তু ওই বনেবাদাড়ে বেড়ানো ক্ষত্রিয়গুলো? ওগুলো ভারি বদ৷ কাউকে ভয় পায় না৷ বহোৎ খতরনাক চিজ—’
— ‘আর ওই যে মুনিঋষি, ব্রহ্মচারীরা, ওরাও বড্ড বদ হয় ত্রিজটামাসি,— উনকো খুনমে হি গুসসা হ্যায়৷ ওফ কী রাগ! বামুন না ছাই৷ আসলে চণ্ডাল সব৷ রাগ নাকি চণ্ডাল? তবে তো প্রত্যেকটা তপস্বীই চণ্ডাল৷ শ্মশানের কোনও রিঅ্যাল চণ্ডালকে কেউ দেখেছে শুধু শুধু রাগের চোটে কাউকে ছাই করে দিচ্ছে? যক্ষকে রাক্ষস বানাচ্ছে, দেবতাকে বাঁদর করে দিচ্ছে আর সুন্দরী অপ্সরাকে যমুনা নদীতে পেটমোটা রুইমাছ বানিয়ে ফেলছে? এসব যত রকমের কেচ্ছা-কুকীর্তি সমস্ত ওই বামুনগুলোর কাজ৷ কথায় কথায় শাপশাপান্ত৷’
— ‘আরে দূর, গেছলি কেন তোরা প্রেম করতে? রাক্ষসে মানুষে গাঁট-বন্ধন? ইয়ে তো কভি নহি হোনা চাহিয়ে৷ রাজা রাবণকে দেখলি না, কী সর্বনাশ করলেন?’
—’রাবণকা বাত অলগ হ্যায়— উসকো ভি শাপ থা’, অয়োমুখী তর্ক জুড়ে দেন৷ স্বর্গে এলেই সবায়ের স্বর্গের ভাষা৷ রাষ্ট্রভাষাটা রপ্ত হয়ে যায়৷ ‘কেন ভীমের সঙ্গে কি হিড়িম্বামাসির বিয়ে হয়নি? ভীমমেসোও তো তখন বনেবনেই ঘুরছিলেন৷’
শূর্পণখা ঠোঁট উল্টোল, ‘ঈইশ! বনেবনে ঘুরছিল না আরও কিছু! পাঁচশরিকের বৌটাকে সুদ্ধু ল্যাজে বেঁধে নিয়ে বনেবনে পিকনিক করে বেড়াচ্ছিল মা আর পাঁচ ভাইতে মিলে৷ লক্ষ্মীছেলের মতো আগে মায়ের পারমিশান নিয়ে তবেই না, ভীমমেসো বিয়েটা করল?’
অয়োমুখী ছাড়েন না— ‘কিন্তু মা তো ভীমকে অনুমতি দিয়েছিলেন৷ কুন্তিদিদা তো রামের মতো শিখিয়ে দেননি,— ‘যা বাছা, ওই রাক্ষসদের মেয়েটার নাককানগুলো ঘ্যাঁচঘ্যাঁচ করে কুচিয়ে কেটে আনগে যা! দ্রৌপদীও তো বাপু হিড়িম্বামাসিকে কিছুই গালমন্দ করেনি? অথচ কে না জানে দ্রৌপদীর মুখ? বাব-বা!’
ত্রিজটা এবার দু’পক্ষকে শান্ত করতে বলেন— ‘ওদের কথা ছেড়ে দে৷ ওরা এই ইক্ষাকু বংশীয়দের চেয়ে ঢের ভদ্র৷ দিব্যি যাজ্ঞসেনীটাকে পাঁচ ভাইতে কী সুন্দর ভাগ করে নিলে, বল দিকিনি, কেবল মায়ের একটা কথায়? তবে ওর পেছনেও কাণ্ড আছে৷ বলি শোন! সবাই জানে দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামী তো? আর কুন্তির জীবনে কটা? গুনে দ্যাখ না? ওরও জীবনে পাঁচ পাঁচটা পুরুষ এসেছিল, ঠিক দ্রৌপদীরই মতন, তবে একসঙ্গে নয়, কিউ দিয়ে৷ ওয়ান বাই ওয়ান৷ সূর্য, পাণ্ডু, ধর্ম, পবন, ইন্দ্র৷ সোদর ভাইও নয়, পাঁচ জাতের পুরুষ পাঁচজন৷ একজন গ্রহ, একজন মানুষ, একজন কিছুই নয়, শুধু মানুষের তৈরি করা তত্ত্ব, একজন পঞ্চভূতের একভূত, আর একজন একদিকে যেমন দেবতাদের রাজা, আরেকদিকে ঝড়-বৃষ্টির কন্ট্রোলার৷ পাঁচটি পুরুষের পাঁচমূর্তি বটে৷ মজাটা কিন্তু অন্য জায়গায়৷ বিয়েটা হয়েছে যার সঙ্গে, তার সঙ্গে কুন্তির ছেলেপুলে কিসসু হয়নি৷ আর যাদের সঙ্গে পটাপট একের পর এক ছেলে হয়েছে, তাদের সঙ্গে মোটে বিয়েই হয়নি৷ কুন্তির ব্যাপারটা এক্কেবারে ইস্পেশাল— বহোৎ জবরদস্ত ঔরত থি না? সতীনের ছেলেদুটোকেও ট্যাঁকে গুঁজে রেখেছিল৷ ও তো মত দেবেই৷ না দিলে ভীম কি শুনত? ভীম তো যুধিষ্ঠির য্যায়সা ওইস্যা লড়কা থোড়াই থা! ও অনেকটাই আমাদের মতো৷ যা ট্রাইসেপ!’
অয়োমুখী আর শূর্পণখা হেসে ওঠেন, ‘তা যা বলেছ মাসি— দারুণ মাসল! তবে যুধিষ্ঠিরই বা কী এমন? দ্রৌপদী যদি দ্রৌপদী না হয়ে হিড়িম্বা হত, আমাদের মতো একটু বড়সড় দেখতে, কুলোর মতো কান দুখানা, মূলোর মতো দাঁত আর তালগাছের মতো লম্বা— তা হলে যুধিষ্ঠির কত লক্ষ্মীছেলে হয়ে মায়ের কথা শুনত জানা আছে, হ্যাঁ! দূর, পেঁচো জুয়াড়ি একটা৷ বৌ একবার জেলখানা থেকে ছাড়িয়ে দিল, লজ্জা নেই? তক্ষুনি আবার জুয়ো খেলে বনে গেল৷ যাচ্ছেতাই৷ কেন যে লোকে ওকে ধর্মপুত্তুর বলে?’
— ‘ধর্মের পুত্তুর তাই৷’ অয়োমুখী বলেন, — ‘তবে হ্যাঁ, দ্রৌপদী অত রূপবতী বলেই সবকটা ছেলে সেদিন মাতৃভক্ত হয়ে উঠেছিল৷’
ত্রিজটা হাত নেড়ে বলেন,— ‘আর কুন্তিও কি জানত না ভেবেছিস? কুঁড়েঘরের ফাঁক দিয়ে সব দেখা যায়৷ ইচ্ছে করেই অমন একটা অদ্ভুত কথা বলে দিল— ‘তোমরা পাঁচজনে... ছেলেদের সঙ্গে তুমিও কেন সেদিন ভাগ করে ভিক্ষাদ্রব্যটি খেলে না? ফলমিষ্টি কি হরিণের মাংস হলে তো খেতে?’
— ‘তা যাই বল ত্রিজটামাসি, কুন্তিটা খুব দায়িত্বহীন কাজ করেছিল কিন্তু—’
‘দায়িত্বহীন না ছাই! খুব চালুপুরিয়া ওই কুন্তি৷ উও ভি রাজনীতিকা এক কূটচাল থা— চাল! বুঝলি না? ভায়েভায়ে পাছে অশান্তি হয়, বনেবনে ঘুরছে সব, মনে শান্তি নেই এমনিতেই তায় ওই আগুনের টুকরো মেয়েকে নিয়ে এল ঘরের মধ্যে৷ তাই ওই ব্যবস্থা৷ এককথায় সবাই খুশি, সবাই ঠান্ডা৷ দরজার ফুটো দিয়ে দ্রৌপদীকে দেখেই তো অমন ন্যাকার মতন কথাটি বলেছিল৷ পাঁচছেলে যাতে এককাট্টা থাকবে৷ ঘরে শান্তি থাকবে৷ সবাই ভাগ পাবে৷’
— ‘আর তাছাড়া বৌ-ও বেশ নিজের মতোই পাঁচজন পুরুষের ভোগে লাগবে,— আর তাহলে শাশুড়ির চরিত্র নিয়ে কথা শোনাতে পারবে না৷ সে বুদ্ধিটাও ছিল নিশ্চয় ভিতরে ভিতরে৷ কি বলিস শূর্পণখা?’
— ‘ভোগে লাগবে’ আবার কী কথা অয়োমুখী? রাক্ষসবংশীয়দের মুখে তো এমন মানুষের মতন ইতর কথা মানায় না? ‘ভোগ করবে’ বল! দ্রৌপদীও কুন্তির মতোই পাঁচজন পুরুষকে ভোগ করবে৷ ফলে শাশুড়িকে হিংসে করতে পারবে না৷ এই বলতে চাস তো?’ শূর্পণখার কথা শেষ হওয়ার আগেই দেখা গেল উদ্যানপথে হর্ষিতচরণে লক্ষ্মণ আসছেন৷ যক্ষ-রক্ষ, নর-বানর স্বর্গে তো সকলকেই যেতে হয়৷ সবার সঙ্গে তখন দেখা হয়৷ পুনর্মিলনের উৎসব হয়৷ পুরনো দিনের গল্পগাছা হয়৷ পুরনো ক্রোধ ক্ষোভ সবই স্মরণপথে মুহূর্তের জন্য ভেসে ওঠে, উদয় হয়েই আবার মিলিয়ে যায়৷ আর ওই মুহূর্তটিতে ঘটে সেই ব্যক্তির নরকদর্শন৷ একটিই মোটে মুহূর্ত, — কিন্তু তার মনে হয় বুঝি সহস্র বৎসর— সময় যেন কাটতে চায় না৷
এদিকে লক্ষ্মণকে দেখামাত্রই তো অয়োমুখী ও শূর্পণখা রাগে দাঁত কিড়মিড় করে উঠল৷ স্বর্গে সকলেই কামরূপিণী৷ কি রাক্ষসী কি বান্দরী, সবাই সুন্দরী৷ যার যেমন চেহারা পাওয়ার ইচ্ছে ছিল, সে ঠিক তেমনই দেখতে হয়ে যায়৷ স্বর্গে কেউ বৃদ্ধ, রুগণ, বিকলাঙ্গ, শ্রীহীন থাকে না৷ বৃদ্ধা ত্রিজটা তাঁর যৌবনের রূপ ফিরে পেয়েছেন৷ অয়োমুখী আবার পূর্ণাঙ্গী, পূর্ণস্তনী হয়েছেন৷ শূর্পণখার গজিয়েছে একটি তিলফুল জিনি নাসা৷ আর বোগেনভিলিয়ার ফুলের মতো কানদুটি৷ লক্ষ্মণ ওঁদের দেখে চিনতে পারলেন না, চেনবার কথাও নয়৷ কিন্তু যারা চেনবার তারা লক্ষ্মণকে ঠিকই চিনেছে৷ লক্ষ্মণ তিন সুন্দরীকে দেখে আরেকবার ঘুরে তাকালেন৷ ত্রিজটা বিপদ বুঝে তাড়াতাড়ি বললেন, ‘রাজকুমার, এ পথটুকু দ্রুত পায়ে পেরিয়ে যান৷ পিছনে তাকাবেন না৷ পিছনে তাকালেই বিপদ৷’
লক্ষ্মণ চিরকেলে জেদি৷ তিনি অন্যের কথা শুনবেন কেন? এদিকে রাক্ষসীদের সেই এক মুহূর্তের জিঘাংসা তাদের স্বর্গীয় সৌন্দর্য নষ্ট করে দিয়েছিল— রাগের সময়টুকুর জন্য তারা সেই বিকলাঙ্গ বিকৃত রাক্ষসীরূপ ফিরে পেয়েছিল৷ জ্ঞানবতী, বুদ্ধিমতী, ত্রিজটার বারণ সত্ত্বেও চট করে গোঁয়ার লক্ষ্মণ একবার পিছনে তাকালেন তিন সুন্দরীকে আরেকটিবার দেখতে৷ আর ঠিক যেন দুঃস্বপ্নের মতন লক্ষ্মণ স্পষ্ট দেখতে পেলেন বিশালবপু, বিকটা, বিকৃতদর্শনা নাসিকাকর্ণস্তন ছিন্নভিন্ন, অশ্রু ও রক্তে মাখামাখি দু’জন রাক্ষসী গর্জন করতে করতে হাত বাড়িয়ে প্রচণ্ড মুখব্যাদান করে, হাঁয়ের মধ্যে লকলকে আগুনজিভ ও তীক্ষ্ণ দাঁতের শূল বের করে, তাঁকেই চিবিয়ে খেতে আসছে৷
স্বর্গে কারুর তীরধনুক থাকে না৷ লক্ষ্মণেরও নেই৷ আত্মরক্ষার একটি মাত্রই উপায় আছে, দে ছুট দে ছুট! পাঁই পাঁই করে লক্ষ্মণ দৌড় লাগালেন৷ তাঁর মনেই রইল না যে এটা স্বর্গ৷ এখানে হিংসাদ্বেষ চলে না, এখানে ভয়ভাবনা নেই, এখানে কেউ কাউকে মারতে কাটতে পারে না— তিনি ভুলেই গেলেন যে তিনি অলরেডি মৃত, আবার নতুন করে রাক্ষসের পেটে যাওয়ার বা ভয়ে মরে যাওয়ার কোনও আশঙ্কাই তাঁর নেই৷
তীব্র প্রাণভয়ে আকুল হয়ে লক্ষ্মণ আথালিবিথালি ছুট লাগালেন৷ যেন অনন্তকাল ধরে মৃত্যু তাঁকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে৷ কত গিরিপর্বত, কত অরণ্য, মরুভূমি, কত নদনদী, কত তেপান্তরের মাঠ পার হয়ে প্রলম্বিত হল সেই প্রচণ্ড পলায়ন— শেষে হাঁপাতে হাঁপাতে ক্লান্ত বিধ্বস্ত লক্ষ্মণ ঊর্মিলার পায়ের কাছে এসে ধপাস করে পড়ে গেলেন৷ ঊর্মিলা পারিজাত ফলের বিচি বাদ দিয়ে আচার তৈরি করছিলেন৷ খুব অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন— ‘কী ব্যাপার স্বামী? এত ছুটছেন কেন?’ ‘বাঁচাও, ঊর্মিলা, বাঁচাও সেই সব রাক্কুসীরা আমাকে খেতে আসছে৷’ মহাবীর লক্ষ্মণের মুখে এই বালকোচিত কথা শুনে ঊর্মিলা হেসেই গড়িয়ে পড়লেন৷
— ‘আপনি নিশ্চয়ই দুঃস্বপ্ন দেখেছিলেন আর্যপুত্র— এখানে রাক্কুসী কোথায়? এ তো স্বর্গ! এখানে দেব-দানবে, নর-রাক্ষসে তো তফাত নেই৷ সবাই স্বর্গত আত্মা৷ সবাই অমৃত পান করেছেন, কেউ আপনাকে খেতে আসবেন না৷’
লক্ষ্মণের তখনও তীব্র ভয়ে বুক ধুকপুক করছে, পা টলছে, মাথার মধ্যে টালমাটাল৷ ধীরে ধীরে, শান্ত হয়ে তিনি ব্যাপারটা সম্যক অভিধাবন করতে সক্ষম হলেন৷ — ‘এই তবে আমার নরকদর্শনের পালা চুকে গেল’৷
মাত্র এক লহমার ব্যাপার কিন্তু মনে হয়েছিল বুঝি অন্তহীন পথ, অন্তহীন দৌড়, অন্তহীন মৃত্যুভয়৷ এবার লক্ষ্মণ চিনতে পারলেন— ওরা অয়োমুখী আর শূর্পণখা৷ এতদিনে টের পেলেন যে তিনি মহাপাপ করেছিলেন৷ ছোট ছেলেরা যেমন গঙ্গাফড়িঙের পা ছিঁড়ে দেয়, প্রজাপতির ডানা ছিঁড়ে ফেলে৷ এ তার চেয়েও বেশি৷ উনি একটি স্ত্রীলোকের নাসাকর্ণ ও একজনের নাসাকর্ণ, স্তনযুগল টুকরো করে কেটে ফেলে দিয়েছিলেন৷ ওদের অপরাধ, ওরা লক্ষ্মণকে প্রণয়নিবেদন করেছিল৷ লঘুপাপে গুরুদণ্ড দেওয়া হয়ে গেছে৷ লক্ষ্মণ নিজে নিজেই বুঝতে পারলেন যেখানে ক্ষমাপ্রার্থনা করে প্রত্যাখ্যানই হত যথেষ্ট, সেখানে তিনি তাদের আক্রমণ করে কুরূপা, বিকটা, অঙ্গহীনা করে দিয়েছিলেন৷ এ অন্যায়ের কোনও যুক্তি নেই৷
স্বর্গে গেলে সকলেরই সত্যদৃষ্টি খুলে যায়৷ লক্ষ্মণের সত্যদর্শন হল৷ তিনি তখন ঊর্মিলার সামনে নতজানু হয়ে বসে অয়োমুখী ও শূর্পণখার কাহিনী তাঁকে বলে, নিজের অপরাধ স্বীকার করলেন৷ ঊর্মিলা শুনে যারপরনাই দুঃখিত হয়ে বললেন— ‘যাও, তুমি আবার ওঁদের খুঁজে বের করে মার্জনাভিক্ষা করগে৷’ লক্ষ্মণ বললেন, ‘ঊর্মিলা, আমি এখন কোথায় ওঁদের খুঁজে পাব? স্বর্গ যে বড্ড বেশি বড়— এর সীমা নেই প্রান্ত নেই— বিপুল বিস্তারিত এলাকা৷ কিন্তু আমি খুবই দুঃখিত৷ যদি কখনও অয়োমুখী, শূর্পণখার সঙ্গে আবার দেখা হয়, তবে ওদের নিশ্চয়ই বলব, ‘আমাকে তোমরা ক্ষমা করে দাও৷ আমার মহা অন্যায় হয়েছিল৷’ তখুনি স্বর্গের মৃদুমলয় বায়ু সেই মার্জনাভিক্ষাটি বয়ে নিয়ে গিয়ে অয়োমুখী আর শূর্পণখার কানে কানে পৌঁছে দিল৷ আসলে লক্ষ্মণ তো বেশিদূরে যাননি৷ অয়োমুখীদের ঠিক পাশের কুঞ্জবনটিতেই ঊর্মিলা ফল পাড়ছিলেন৷ নরকদর্শনের উদ্দেশ্যে লক্ষ্মণের ওই ঊর্ধ্বশ্বাস প্রাণভয়ে দীর্ঘ দৌড়টি সম্পূর্ণ মায়ার ঘোরে সৃষ্ট এক লহমার চিত্তবিভ্রম মাত্র৷
লক্ষ্মণকে দেখে রাগত হয়ে, নরকদর্শন হয়ে গিয়েছে রাক্ষসীদেরও৷ মার্জনাভিক্ষা কানে দেহের স্বর্গীয় সৌন্দর্য অন্তরের অক্ষয় সৌন্দর্য হয়ে উঠল৷ তাঁদেরও সত্যদৃষ্টি খুলে গেল৷ ক্ষমামৃতের স্বাদ পেয়ে৷ — ‘এইবার তোদের বিউটিটার পার্মানেন্ট ট্রিটমেন্ট হয়ে গেল৷ শতবার লক্ষ্মণের সঙ্গে দেখা হলেও আর কিন্তু আগের বিকৃত রূপটি তোদের স্পর্শই করতে পারবে না’— বলতে বলতে রূপসী ত্রিজটার মুখখানি আহ্লাদে জ্যোতির্ময় হয়ে যায়৷
ভাগ্যিস স্বর্গে বিউটি কনটেস্ট হয় না, হলে কিন্তু সেই মুহূর্তে তিনজনেই ‘মিস স্বর্গ ফরএভার’ হয়ে যেতেন৷