আড্ডা
বুদ্ধদেব বসু
পণ্ডিত নই, কথাটার উৎপত্তি জানি না। আওয়াজটা অ-সংস্কৃত, মুসলমানি। যদি ওকে হিন্দু ক'রে বলি সভা, তাহলে ওর কিছুই থাকে না। যদি ইংরেজি ক'রে বলি পার্টি, তাহলে ও প্ৰাণে মরে। মিটিঙের কাপড় খাকি কিংবা খাদি; পার্টির কাপড় ফ্যাশন-দুরস্ত কিন্তু ইন্ত্রি বড়ো কড়া; সভা শুভ্ৰ, শোভন ও আরামহীন। ফরাশি সালর অস্তিত্ব এখনাে আছে কিনা জানি না, বর্ণনা পড়ে বডড বেশি জমকালো মনে হয়। আড্ডার ঠিক প্রতিশব্দটি পৃথিবীর অন্য কোনাে ভাষাতেই আছে কি? ভাষাবিদ না-হয়েও বলতে পারি নেই; কারণ আড্ডার মেজাজ নেই অন্য কোনো দেশে, কিংবা মেজাজ থাকলেও যথােচিত পরিবেশ নেই। অন্যান্য দেশের লোক বক্তৃতা দেয়, রসিকতা করে, তর্ক চালায়, ফুর্তি ক’রে রাত কাটিয়ে দেয়, কিন্তু আডডা দেয় না। অত্যন্ত হাসি পায় যখন শুভানুধ্যায়ী ইংরেজ আমাদের করুণা করে বলে—আহা বেচারা, ক্লাব কাকে বলে ওরা জানে না। আড্ডা যাদের আছে, ক্লাব দিয়ে তারা করবে কী? আমাদের ক্লাবের প্রচেষ্টা কলের পুতুলের হাত-পা নাড়ার মতো, ওতে আবয়বিক সম্পূর্ণতা আছে, প্ৰাণের স্পন্দন নেই। যারা আড্ডাদেনেওলা জাত, তারা যে ঘর ভাড়া নিয়ে, চিঠির কাগজ ছাপিয়ে, চাকরদের চাপরাশ পরিয়ে ক্লাবের পত্তন করে, এর চেয়ে হাস্যকর এবং শোচনীয় আর কিছু আছে কিনা জানি না।
আড্ডা জিনিশটা সৰ্বভারতীয়, কিন্তু বাংলাদেশের সজল বাতাসেই তার পূর্ণবিকাশ। আমাদের ঋতুগুলি যেমন কবিতা জাগায়, তেমিন আড্ডাও জমায়। আমাদের চৈত্রসন্ধ্যা, বর্ষার সন্ধ্যা, শরতের জ্যোৎস্না-ঢালা রাত্রি, শীতের মধুর উজ্জ্বল সকাল—সবই আডডার নীরব ঘণ্টা বাজিয়ে যায়, কেউ শুনতে পায়, কেউ পায় না। যে-সব দেশে শীত-গ্ৰীষ্ম দুই অতি তীব্ৰ, বা বছরের ছ-মাস জুড়েই শীতকাল রাজত্ব করে, সেগুলো আডডার পক্ষে ঠিক অনুকুল নয়। বাংলার কমনীয় আবহাওয়ায় যেমন গাছপালার ঘনতা, তেমনি আড্ডার উচ্ছাসও স্বাভাবিক। ছেলেবেলা থেকে এই আডডার প্ৰেমে আমি মাজে আছি। সভায় যেতে আমার বুক কাঁপে, পাটির নামে দৌড়ে পালাই, কিন্তু আডডা। ও না-হ’লে আমি বাঁচি না। বলতে গেলে ওরই হাতে আমি মানুষ। বই পড়ে যা শিখেছি তার চেয়ে বেশি শিখেছি আড্ডা দিয়ে। বিশ্ববিদ্যাবৃক্ষের উচ্চশাখা থেকে আপাতরমণীয় ফলগুলি একটু সহজেই পেড়েছিলুম—সেটা আডারই উপহার। আমার সাহিত্যরচনায় প্রধান নির্ভর রূপেও আড্ডাকে বরণ করি। ছেলেবেলায় গুরুজনেরা আশঙ্কা করেছিলেন যে আড্ডায় আমার সর্বনাশ হবে, এখন দেখছি ওতে আমার সর্বলাভ হ’লো। তাই শুধু উপাসক হয়ে আমার তৃপ্তি নেই, পুরোহিত হয়ে তার মহিমা প্রচার করতে বসেছি।
যে কাপড় আমি ভালোবাসি আড্ডার ঠিক সেই কাপড়। ফর্শা, কিন্তু অত্যন্ত বেশি ফর্শা নয়, অনেকটা ঢোলা, প্রয়োজন পার হয়েও খানিকটা বাহুল্য আছে, স্পৰ্শকোমল, নমনীয়। গায়ে কোথাও কড়কড় করে না, হাত-পা ছড়াতে হ’লে বাধা দেয় না, লম্বা হয়ে শুয়ে পড়তে চাইলে তাতেও মানা নেই। অথচ তা মলিন নয়, তাতে মাছের ঝোল কিংবা পানের পিক লাগে নি; কিংবা দাওয়ায় বসে গাখোলা জটলার বেআৰু শৈথিল্য তাকে কুঁচকে দেয় নি। তাতে আরাম আছে, অযত্ন নেই; তার স্বাচ্ছন্দ্য ছন্দােহীনতার নামান্তর নয় ।
শুনতে মনে হয় যে ইচ্ছে করলেই আডডা দেয়া যায়। কিন্তু তার আত্মা বড়ো কোমল, বড়ো খামখেয়ালি তার মেজাজ, অতি সূক্ষ্ম কারণেই উপকরণের অবয়ব ত্যাগ করে সে এমন অলক্ষ্যে উবে যায় যে অনেকক্ষণ পর্যন্ত কিছু বোঝাই যায় না। আড্ডা দিতে গিয়ে প্রায়ই আমরা পরবিদ্যার মানে পড়া বিদ্যার আসর জমাই, আর নয়তো পরিচর্চার চণ্ডীমণ্ডপ গড়ে তুলি। হয়তো স্থির করলুম যে সপ্তাহে একদিন কি মাসে দু-দিন সাহিত্যসভা ডাকবো, তাতে জ্ঞানী-গুণীরা আসবেন, এবং নানা রকম সদালাপ হবে। পরিকল্পনাটি মনোরম তাতে সন্দেহ নেই; প্রথম কয়েকটি অধিবেশন এমন জমলো যে নিজেরাই অবাক হয়ে গেলাম, কিন্তু কিছুদিন পরেই দেখা গেলো যে সেটি আডার স্বর্গ থেকে চুত্যুত হয়ে কর্তব্যপালনের বন্ধ্যা জমিতে পতিত হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ে কর্মস্থলে যাওয়ার মতো নির্দিষ্ট দিনে যেখানে যেতে হয়, তাকে, আর যা-ই হােক, আড্ডা বলা যায় না। কেননা আডার প্রথম নিয়ম এই যে তার কোনো নিয়মই নেই; সেটা যে অনিয়মিত, অসাময়িক, অনায়োজিত, সে-বিষয়ে সচেতন হ’লেও চলবে না। ও যেন বেড়াতে যাবার জায়গা নয়, ও যেন বাড়ি; কাজের শেষে সেখানেই ফিরবো, এবং কাজ-ফালিয়ে যখনতখন এসে পড়লেও কেউ কোনো প্রশ্ন করবে না।
তাই বলে এমন নয় যে এলোমেলোভাবেই আডডা গড়ে ওঠে। নিজে অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে তার পিছনে কোনো-একজনের প্রচ্ছন্ন কিন্তু প্রখর রচনাশক্তি চাই। অনেকগুলি শর্ত পূরণ হ’লে তবে কতিপয় ব্যক্তির সমাবেশ হয়ে ওঠে। সত্যিকার আড্ডা-ক্লাব নয়, পার্টি নয়, সভা কিংবা সমিতি নয়। একে-একে সেগুলি পেশ করছি। আড্ডায় সকলেরই মর্যাদা সমান হওয়া চাই। ব্যবহারিক জীবনে মানুষে-মানুষে নানা রকম প্ৰভেদ অনিবাৰ্য, কিন্তু সেই ভেদবুদ্ধি আপিশের কাপড়ের সঙ্গে-সঙ্গেই যারা ঝেড়ে ফেলতে না জানে, আড্ডার স্বাদ তারা কোনোদিন পাবে না। যদি এমন কেউ থাকেন যিনি এতই বড়ো যে তাঁর মহিমা কখনো ভুলে থাকা যায় না, তাঁর পায়ের কাছে আমরা ভক্তের মতো বসবো, কিন্তু আমাদের আনন্দে তার নিমন্ত্রণ নেই, কেননা তার দৃষ্টিপাতেই আডার ঝর্নধারা তুষার হয়ে জমে যাবে। আবার অন্যদের তুলনায় অনেকখানি নিচুতে যার মনের স্তর, তাকেও বাইরে না-রাখলে কোনো পক্ষেই সুবিচার হবে না। আড্ডায় লোকসংখ্যার একটা স্বাভাবিক সীমা আছে; উর্ধ্বসংখ্যা দশ কি বারো নিম্নতম তিন। দশ-বারোজনের বেশি হ’লে অ্যালবার্ট হল হয়ে ওঠে, কিংবা বিয়েবাড়িও হতে পারে; আর যদি হয় ঠিক দু'জন তাহলে তার সঙ্গে কুজনই মিলবেপদ্যেও, জীবনেও। উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে স্বভাবের উপর-তলায় বৈচিত্র্য থাকা চাই, কিন্তু নিচের তলায় মিল না-থাকলে পদে-পদে ছন্দপতন ঘটবে। অনুরাগ এবং পারস্পরিক জ্ঞাতিত্ববােধ স্বতই যাদের কাছে টানে, আড্ডা তাদেরই জন্য, এবং তাদেরই মধ্যে আবদ্ধ থাকা উচিত; চেষ্টা ক’রে সংখ্যা বাড়াতে গেলে আড্ডার প্রাণপাখি। কখন উড়ে পালাবে কেউ জানতেও পারে না।
কিন্তু এমনও নয় যে ঐ ক-জন এক-সুরে-বাঁধা মানুষ একত্ৰ হ’লেই আড্ডা জমে উঠবে। জায়গাটিও অনুকূল হওয়া চাই। আডার জন্য ঘর ভাড়া করা আর শোক করার জন্য কাঁদুনে ভাড়া করা একই কথা। অধিগম্য বাড়িগুলির মধ্যে যেটির আবহাওয়া সবচেয়ে অনুকূল, সেই বাড়িই হবে আডার প্রধান পীঠস্থান। সেই সঙ্গে একটি-দুটি পারিপার্শ্বিক তীর্থ থাকাও ভালো, মাঝে-মাঝে জায়গা-বদল করাটা মনের ফলকে শান দেয়ার শামিল; ঋতুর বৈচিত্র্য এবং চাঁদের ভাঙা-গড়া অনুসারে ঘর থেকে বারান্দায়, বারান্দা থেকে ছাতে, এবং ছাত থেকে খোলা মাঠে বদলি হ’লে সেই সম্পূর্ণতা লাভ করা যায়, যা প্রকৃতিরই আপন হাতের সৃষ্টি। কিন্তু কোনাে কারণেই, কোনাে প্রলোভনেই ভুল জায়গায় যেন যাওয়া না হয়। ভুল জায়গায় মানুষগুলোকেও ভুল মনে হয়, ঠিক সুরটি কিছুতেই লাগে না।
আড্ডা জায়গাটিতে আরাম থাকবে পুরোপুরি, আড়ম্বর থাকবে না। আসবাব হবে নিচু, নরম, অত্যন্ত বেশি ঝকঝকে নয়; মরজি-মতো অযথাস্থানে সরিয়ে নেবার আন্দাজ হালকা হ’লে তো কথাই নেই। চেয়ার-টেবিলের কাছাকাছি একটা ফরাশ গোছেরও কিছু থাকা ভালো—যদি রাত বেড়ে যায়, কিংবা কেউ ক্লান্ত বোধ করে, তাহলে শুয়ে পড়ার জন্য কারো অনুমতি নিতে হবে না। পানীয় থাকবে কাচের গেলাশে ঠাণ্ডা জল, আর পাৎলা শাদা পেয়ালায় সোনালি সুগন্ধি চা; আর খাদ্য যদি কিছু থাকে তা হবে স্বাদু, স্বল্প এবং শুকনো, যেন ইচ্ছেমতো মাঝে-মাঝে তুলে নিয়ে খাওয়া যায়, আর খাবার পরে হাত-মুখ ধোবার জন্য উঠতেও হয় না। বাসনগুলো হবে পরিচ্ছন্ন-জমকালো নয়; এবং ভৃত্যদের ছুটি দিয়ে গৃহকত্রী নিজেই যদি খাদ্যপানীয় নিয়ে আসেন এবং বিতরণ করেন তাহলেই আড্ডার যথার্থ মানরক্ষা হয়।
কথাবার্তা চলবে মসৃণ, স্বচ্ছন্দ স্রোতে, তার জন্য কোনাে চেষ্টা কি চিন্তা থাকবে না; যে-সব ভাবনা ও খেয়াল, সংশয় ও প্রশ্ন মনের মধ্যে সব সময় উঠছে পড়ছে—কেজো দিনের শাসনের তলায় যা চাপা পড়ে থাকে, এবং যার অনেকটা অংশই হয়তো আকস্মিক কিন্তু তাই বলে অর্থহীন নয়, তারই মুক্তি-পাওয়া ছলছলানি যেন কথাগুলো। এখানে সংকোচ নেই, বিষয়-বুদ্ধি নেই, দায়িত্ববোধ নেই। ভালো কথা বলার দায় নেই এখানে। ভালো কথা না আসে, এমনি কথাই বলবো; এমনি কথারও যদি খেই হারিয়ে যায়, মাঝে-মাঝে চুপ ক’রে থাকতে ভয় কিসের। মুহুর্তের জন্যও চুপ ক’রে থাকাকে যাঁরা বুদ্ধির পরাভব কিংবা সৌজন্যের ক্রটি ব’লে মনে করেন, আড্ডা জিনিশটা তাঁরা বোঝেন না। তার্কিক এবং পেশাদার হাস্যরসিক, আড্ডায় এই দুই শ্রেণীর মানুষের প্ৰবেশ নিষেধ। যাঁরা প্রাজ্ঞজন, কিংবা যাঁরা লোকহিতে বদ্ধপরিকর, তাঁদেরও সসম্মানে বাইরে রাখতে হবে। কেননা আড্ডার ইডেন থেকে যে-সূক্ষ্ম সৰ্প বার-বার আমাদের ভ্ৰষ্ট করে, তারই নাম উদ্দেশ্য। যত মহৎই হােক, কিংবা যত তুচ্ছই হােক, কোনো উদ্দেশ্যকে ভ্রমক্ৰমেও কখনো ঢুকতে দিতে নেই। আড্ডার মধ্যে তাসপাশার আমদানি যেমন মারাত্মক, তেমনি ক্ষতিকর তার দ্বারা কোনো জ্ঞানলাভের সচেতন চেষ্টা। ধ’রে নিতে হবে যে আডডা কোনো উদ্দেশ্যসাধনের উপায় নয়, তা থেকে কোনো কাজ হবে না, নিজের কিংবা অন্যের কিছুমাত্র উপকার হবে না। আড্ডা বিশুদ্ধ ও নিষ্কাম, আপনাতে আপনি সম্পূর্ণ। তা যদি নিজেরই জন্য আনন্দদায়ক না-হতে পারে তাহলে তার অস্তিত্বেরই অর্থ নেই।
শুধু পুরুষদের নিয়ে, কিংবা শুধু মেয়েদের নিয়ে, আড্ডা জমে না। শুধু পুরুষরা একত্ৰ হ’লে কথার গাড়ি শেষ পর্যন্ত কাজের লাইন ধরেই চলবে; আবার কখনো লাইন থেকে চ্যুত হ’লে গড়াতে-গড়াতে সুরুচির সীমাও পেরিয়ে যাবে হয়তো। শুধু মেয়েরা একত্ৰ হ’লে ঘরকন্না, ছেলেপুলে, শাড়ি-গয়নার কথা কেউ ঠেকাতে পারবে না। আড্ডার উন্মীলন স্ত্রী-পুরুষের মিশ্রণে। মেয়েরা কাছে থাকলে পুরুষের, এবং পুরুষ কাছে থাকলে মেয়েদের রসনা মার্জিত হয়, কণ্ঠস্বর নিচু পর্দায় থাকে, অঙ্গভঙ্গি শ্ৰীহীন হতে পারে না। মেয়েরা দেন তাঁদের স্নেহ ও লাবণ্য, নৃত্যুনতম অনুষ্ঠানের সূক্ষ্মতম বন্ধন; পুরুষ আনে তার ঘরছাড়া মনের দূরকল্পনা। বিচ্ছিন্নভাবে মেয়েদের দ্বারা এবং পুরুষের দ্বারা পৃথিবীতে অনেক ছােটাে-বড়ো কাজ হয়ে থাকে; ছন্দ হয় দুয়ের মিলনে।
আড্ডা স্থিতিশীল নয়, নদীর স্রোতের মতো প্রবাহমান। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার রূপের বদল হয়। মন যখন যা চায়, তা-ই পাওয়া যায় তাতে। কখনো কৌতুকে সরস, কখনাে আলোচনায় উৎসুক, কখনাে প্রীতির দ্বারা সুস্নিগ্ধ। বন্ধুতা ও অন্তবীক্ষণ, হৃদয়বৃত্তি ও বুদ্ধির চর্চা, উদ্দীপনা ও বিশ্রাম—সব একসঙ্গে শুধু আডডাই আমাদের দিতে পারে, যদি সত্যি তা ঐ নামের যোগ্য হয়। বিশ্বসভায় অখ্যাতির কোণে আমরা নির্বাসিত; যারা ব্যস্ত এবং মস্ত জাত, যাদের কৃপাকটাক্ষ প্রতি মুহুর্তে আমাদের বুকে এসে বিধছে, তারা এখনাে জানে না যে পৃথিবীর সভ্যতায় আডডা আমাদের অতুলনীয় দান। হয়তাে একদিন নব-যুগের দুয়ার খুলে আমরা বেরিয়ে পড়বো, অস্ত্র নিয়ে নয়, মানদণ্ড নিয়ে নয়, ধর্মগ্রন্থ নিয়েও নয়, বেরিয়ে পড়বো বিশুদ্ধ বেঁচে থাকার মন্ত্র নিয়ে, আনন্দের উদ্দেশ্যহীন ব্ৰত নিয়ে, আড্ডার দ্বারা পৃথিবী জয় করবাে। আমরা, জয় করবাে। কিন্তু ধ’রে রাখবাে না;— কেননা আমরা জানি যে ধ’রে রাখতে গেলেই হারাতে হয়, ছেড়ে দিলেই পাওয়া যায়। পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি বলে, কাড়ো; আমাদের আডডা-নীতি বলে, ছাড়ো।
১৯৪৪
উত্তরতিরিশ
বুদ্ধদেব বসু
পণ্ডিত নই, কথাটার উৎপত্তি জানি না। আওয়াজটা অ-সংস্কৃত, মুসলমানি। যদি ওকে হিন্দু ক'রে বলি সভা, তাহলে ওর কিছুই থাকে না। যদি ইংরেজি ক'রে বলি পার্টি, তাহলে ও প্ৰাণে মরে। মিটিঙের কাপড় খাকি কিংবা খাদি; পার্টির কাপড় ফ্যাশন-দুরস্ত কিন্তু ইন্ত্রি বড়ো কড়া; সভা শুভ্ৰ, শোভন ও আরামহীন। ফরাশি সালর অস্তিত্ব এখনাে আছে কিনা জানি না, বর্ণনা পড়ে বডড বেশি জমকালো মনে হয়। আড্ডার ঠিক প্রতিশব্দটি পৃথিবীর অন্য কোনাে ভাষাতেই আছে কি? ভাষাবিদ না-হয়েও বলতে পারি নেই; কারণ আড্ডার মেজাজ নেই অন্য কোনো দেশে, কিংবা মেজাজ থাকলেও যথােচিত পরিবেশ নেই। অন্যান্য দেশের লোক বক্তৃতা দেয়, রসিকতা করে, তর্ক চালায়, ফুর্তি ক’রে রাত কাটিয়ে দেয়, কিন্তু আডডা দেয় না। অত্যন্ত হাসি পায় যখন শুভানুধ্যায়ী ইংরেজ আমাদের করুণা করে বলে—আহা বেচারা, ক্লাব কাকে বলে ওরা জানে না। আড্ডা যাদের আছে, ক্লাব দিয়ে তারা করবে কী? আমাদের ক্লাবের প্রচেষ্টা কলের পুতুলের হাত-পা নাড়ার মতো, ওতে আবয়বিক সম্পূর্ণতা আছে, প্ৰাণের স্পন্দন নেই। যারা আড্ডাদেনেওলা জাত, তারা যে ঘর ভাড়া নিয়ে, চিঠির কাগজ ছাপিয়ে, চাকরদের চাপরাশ পরিয়ে ক্লাবের পত্তন করে, এর চেয়ে হাস্যকর এবং শোচনীয় আর কিছু আছে কিনা জানি না।
আড্ডা জিনিশটা সৰ্বভারতীয়, কিন্তু বাংলাদেশের সজল বাতাসেই তার পূর্ণবিকাশ। আমাদের ঋতুগুলি যেমন কবিতা জাগায়, তেমিন আড্ডাও জমায়। আমাদের চৈত্রসন্ধ্যা, বর্ষার সন্ধ্যা, শরতের জ্যোৎস্না-ঢালা রাত্রি, শীতের মধুর উজ্জ্বল সকাল—সবই আডডার নীরব ঘণ্টা বাজিয়ে যায়, কেউ শুনতে পায়, কেউ পায় না। যে-সব দেশে শীত-গ্ৰীষ্ম দুই অতি তীব্ৰ, বা বছরের ছ-মাস জুড়েই শীতকাল রাজত্ব করে, সেগুলো আডডার পক্ষে ঠিক অনুকুল নয়। বাংলার কমনীয় আবহাওয়ায় যেমন গাছপালার ঘনতা, তেমনি আড্ডার উচ্ছাসও স্বাভাবিক। ছেলেবেলা থেকে এই আডডার প্ৰেমে আমি মাজে আছি। সভায় যেতে আমার বুক কাঁপে, পাটির নামে দৌড়ে পালাই, কিন্তু আডডা। ও না-হ’লে আমি বাঁচি না। বলতে গেলে ওরই হাতে আমি মানুষ। বই পড়ে যা শিখেছি তার চেয়ে বেশি শিখেছি আড্ডা দিয়ে। বিশ্ববিদ্যাবৃক্ষের উচ্চশাখা থেকে আপাতরমণীয় ফলগুলি একটু সহজেই পেড়েছিলুম—সেটা আডারই উপহার। আমার সাহিত্যরচনায় প্রধান নির্ভর রূপেও আড্ডাকে বরণ করি। ছেলেবেলায় গুরুজনেরা আশঙ্কা করেছিলেন যে আড্ডায় আমার সর্বনাশ হবে, এখন দেখছি ওতে আমার সর্বলাভ হ’লো। তাই শুধু উপাসক হয়ে আমার তৃপ্তি নেই, পুরোহিত হয়ে তার মহিমা প্রচার করতে বসেছি।
যে কাপড় আমি ভালোবাসি আড্ডার ঠিক সেই কাপড়। ফর্শা, কিন্তু অত্যন্ত বেশি ফর্শা নয়, অনেকটা ঢোলা, প্রয়োজন পার হয়েও খানিকটা বাহুল্য আছে, স্পৰ্শকোমল, নমনীয়। গায়ে কোথাও কড়কড় করে না, হাত-পা ছড়াতে হ’লে বাধা দেয় না, লম্বা হয়ে শুয়ে পড়তে চাইলে তাতেও মানা নেই। অথচ তা মলিন নয়, তাতে মাছের ঝোল কিংবা পানের পিক লাগে নি; কিংবা দাওয়ায় বসে গাখোলা জটলার বেআৰু শৈথিল্য তাকে কুঁচকে দেয় নি। তাতে আরাম আছে, অযত্ন নেই; তার স্বাচ্ছন্দ্য ছন্দােহীনতার নামান্তর নয় ।
শুনতে মনে হয় যে ইচ্ছে করলেই আডডা দেয়া যায়। কিন্তু তার আত্মা বড়ো কোমল, বড়ো খামখেয়ালি তার মেজাজ, অতি সূক্ষ্ম কারণেই উপকরণের অবয়ব ত্যাগ করে সে এমন অলক্ষ্যে উবে যায় যে অনেকক্ষণ পর্যন্ত কিছু বোঝাই যায় না। আড্ডা দিতে গিয়ে প্রায়ই আমরা পরবিদ্যার মানে পড়া বিদ্যার আসর জমাই, আর নয়তো পরিচর্চার চণ্ডীমণ্ডপ গড়ে তুলি। হয়তো স্থির করলুম যে সপ্তাহে একদিন কি মাসে দু-দিন সাহিত্যসভা ডাকবো, তাতে জ্ঞানী-গুণীরা আসবেন, এবং নানা রকম সদালাপ হবে। পরিকল্পনাটি মনোরম তাতে সন্দেহ নেই; প্রথম কয়েকটি অধিবেশন এমন জমলো যে নিজেরাই অবাক হয়ে গেলাম, কিন্তু কিছুদিন পরেই দেখা গেলো যে সেটি আডার স্বর্গ থেকে চুত্যুত হয়ে কর্তব্যপালনের বন্ধ্যা জমিতে পতিত হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ে কর্মস্থলে যাওয়ার মতো নির্দিষ্ট দিনে যেখানে যেতে হয়, তাকে, আর যা-ই হােক, আড্ডা বলা যায় না। কেননা আডার প্রথম নিয়ম এই যে তার কোনো নিয়মই নেই; সেটা যে অনিয়মিত, অসাময়িক, অনায়োজিত, সে-বিষয়ে সচেতন হ’লেও চলবে না। ও যেন বেড়াতে যাবার জায়গা নয়, ও যেন বাড়ি; কাজের শেষে সেখানেই ফিরবো, এবং কাজ-ফালিয়ে যখনতখন এসে পড়লেও কেউ কোনো প্রশ্ন করবে না।
তাই বলে এমন নয় যে এলোমেলোভাবেই আডডা গড়ে ওঠে। নিজে অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে তার পিছনে কোনো-একজনের প্রচ্ছন্ন কিন্তু প্রখর রচনাশক্তি চাই। অনেকগুলি শর্ত পূরণ হ’লে তবে কতিপয় ব্যক্তির সমাবেশ হয়ে ওঠে। সত্যিকার আড্ডা-ক্লাব নয়, পার্টি নয়, সভা কিংবা সমিতি নয়। একে-একে সেগুলি পেশ করছি। আড্ডায় সকলেরই মর্যাদা সমান হওয়া চাই। ব্যবহারিক জীবনে মানুষে-মানুষে নানা রকম প্ৰভেদ অনিবাৰ্য, কিন্তু সেই ভেদবুদ্ধি আপিশের কাপড়ের সঙ্গে-সঙ্গেই যারা ঝেড়ে ফেলতে না জানে, আড্ডার স্বাদ তারা কোনোদিন পাবে না। যদি এমন কেউ থাকেন যিনি এতই বড়ো যে তাঁর মহিমা কখনো ভুলে থাকা যায় না, তাঁর পায়ের কাছে আমরা ভক্তের মতো বসবো, কিন্তু আমাদের আনন্দে তার নিমন্ত্রণ নেই, কেননা তার দৃষ্টিপাতেই আডার ঝর্নধারা তুষার হয়ে জমে যাবে। আবার অন্যদের তুলনায় অনেকখানি নিচুতে যার মনের স্তর, তাকেও বাইরে না-রাখলে কোনো পক্ষেই সুবিচার হবে না। আড্ডায় লোকসংখ্যার একটা স্বাভাবিক সীমা আছে; উর্ধ্বসংখ্যা দশ কি বারো নিম্নতম তিন। দশ-বারোজনের বেশি হ’লে অ্যালবার্ট হল হয়ে ওঠে, কিংবা বিয়েবাড়িও হতে পারে; আর যদি হয় ঠিক দু'জন তাহলে তার সঙ্গে কুজনই মিলবেপদ্যেও, জীবনেও। উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে স্বভাবের উপর-তলায় বৈচিত্র্য থাকা চাই, কিন্তু নিচের তলায় মিল না-থাকলে পদে-পদে ছন্দপতন ঘটবে। অনুরাগ এবং পারস্পরিক জ্ঞাতিত্ববােধ স্বতই যাদের কাছে টানে, আড্ডা তাদেরই জন্য, এবং তাদেরই মধ্যে আবদ্ধ থাকা উচিত; চেষ্টা ক’রে সংখ্যা বাড়াতে গেলে আড্ডার প্রাণপাখি। কখন উড়ে পালাবে কেউ জানতেও পারে না।
কিন্তু এমনও নয় যে ঐ ক-জন এক-সুরে-বাঁধা মানুষ একত্ৰ হ’লেই আড্ডা জমে উঠবে। জায়গাটিও অনুকূল হওয়া চাই। আডার জন্য ঘর ভাড়া করা আর শোক করার জন্য কাঁদুনে ভাড়া করা একই কথা। অধিগম্য বাড়িগুলির মধ্যে যেটির আবহাওয়া সবচেয়ে অনুকূল, সেই বাড়িই হবে আডার প্রধান পীঠস্থান। সেই সঙ্গে একটি-দুটি পারিপার্শ্বিক তীর্থ থাকাও ভালো, মাঝে-মাঝে জায়গা-বদল করাটা মনের ফলকে শান দেয়ার শামিল; ঋতুর বৈচিত্র্য এবং চাঁদের ভাঙা-গড়া অনুসারে ঘর থেকে বারান্দায়, বারান্দা থেকে ছাতে, এবং ছাত থেকে খোলা মাঠে বদলি হ’লে সেই সম্পূর্ণতা লাভ করা যায়, যা প্রকৃতিরই আপন হাতের সৃষ্টি। কিন্তু কোনাে কারণেই, কোনাে প্রলোভনেই ভুল জায়গায় যেন যাওয়া না হয়। ভুল জায়গায় মানুষগুলোকেও ভুল মনে হয়, ঠিক সুরটি কিছুতেই লাগে না।
আড্ডা জায়গাটিতে আরাম থাকবে পুরোপুরি, আড়ম্বর থাকবে না। আসবাব হবে নিচু, নরম, অত্যন্ত বেশি ঝকঝকে নয়; মরজি-মতো অযথাস্থানে সরিয়ে নেবার আন্দাজ হালকা হ’লে তো কথাই নেই। চেয়ার-টেবিলের কাছাকাছি একটা ফরাশ গোছেরও কিছু থাকা ভালো—যদি রাত বেড়ে যায়, কিংবা কেউ ক্লান্ত বোধ করে, তাহলে শুয়ে পড়ার জন্য কারো অনুমতি নিতে হবে না। পানীয় থাকবে কাচের গেলাশে ঠাণ্ডা জল, আর পাৎলা শাদা পেয়ালায় সোনালি সুগন্ধি চা; আর খাদ্য যদি কিছু থাকে তা হবে স্বাদু, স্বল্প এবং শুকনো, যেন ইচ্ছেমতো মাঝে-মাঝে তুলে নিয়ে খাওয়া যায়, আর খাবার পরে হাত-মুখ ধোবার জন্য উঠতেও হয় না। বাসনগুলো হবে পরিচ্ছন্ন-জমকালো নয়; এবং ভৃত্যদের ছুটি দিয়ে গৃহকত্রী নিজেই যদি খাদ্যপানীয় নিয়ে আসেন এবং বিতরণ করেন তাহলেই আড্ডার যথার্থ মানরক্ষা হয়।
কথাবার্তা চলবে মসৃণ, স্বচ্ছন্দ স্রোতে, তার জন্য কোনাে চেষ্টা কি চিন্তা থাকবে না; যে-সব ভাবনা ও খেয়াল, সংশয় ও প্রশ্ন মনের মধ্যে সব সময় উঠছে পড়ছে—কেজো দিনের শাসনের তলায় যা চাপা পড়ে থাকে, এবং যার অনেকটা অংশই হয়তো আকস্মিক কিন্তু তাই বলে অর্থহীন নয়, তারই মুক্তি-পাওয়া ছলছলানি যেন কথাগুলো। এখানে সংকোচ নেই, বিষয়-বুদ্ধি নেই, দায়িত্ববোধ নেই। ভালো কথা বলার দায় নেই এখানে। ভালো কথা না আসে, এমনি কথাই বলবো; এমনি কথারও যদি খেই হারিয়ে যায়, মাঝে-মাঝে চুপ ক’রে থাকতে ভয় কিসের। মুহুর্তের জন্যও চুপ ক’রে থাকাকে যাঁরা বুদ্ধির পরাভব কিংবা সৌজন্যের ক্রটি ব’লে মনে করেন, আড্ডা জিনিশটা তাঁরা বোঝেন না। তার্কিক এবং পেশাদার হাস্যরসিক, আড্ডায় এই দুই শ্রেণীর মানুষের প্ৰবেশ নিষেধ। যাঁরা প্রাজ্ঞজন, কিংবা যাঁরা লোকহিতে বদ্ধপরিকর, তাঁদেরও সসম্মানে বাইরে রাখতে হবে। কেননা আড্ডার ইডেন থেকে যে-সূক্ষ্ম সৰ্প বার-বার আমাদের ভ্ৰষ্ট করে, তারই নাম উদ্দেশ্য। যত মহৎই হােক, কিংবা যত তুচ্ছই হােক, কোনো উদ্দেশ্যকে ভ্রমক্ৰমেও কখনো ঢুকতে দিতে নেই। আড্ডার মধ্যে তাসপাশার আমদানি যেমন মারাত্মক, তেমনি ক্ষতিকর তার দ্বারা কোনো জ্ঞানলাভের সচেতন চেষ্টা। ধ’রে নিতে হবে যে আডডা কোনো উদ্দেশ্যসাধনের উপায় নয়, তা থেকে কোনো কাজ হবে না, নিজের কিংবা অন্যের কিছুমাত্র উপকার হবে না। আড্ডা বিশুদ্ধ ও নিষ্কাম, আপনাতে আপনি সম্পূর্ণ। তা যদি নিজেরই জন্য আনন্দদায়ক না-হতে পারে তাহলে তার অস্তিত্বেরই অর্থ নেই।
শুধু পুরুষদের নিয়ে, কিংবা শুধু মেয়েদের নিয়ে, আড্ডা জমে না। শুধু পুরুষরা একত্ৰ হ’লে কথার গাড়ি শেষ পর্যন্ত কাজের লাইন ধরেই চলবে; আবার কখনো লাইন থেকে চ্যুত হ’লে গড়াতে-গড়াতে সুরুচির সীমাও পেরিয়ে যাবে হয়তো। শুধু মেয়েরা একত্ৰ হ’লে ঘরকন্না, ছেলেপুলে, শাড়ি-গয়নার কথা কেউ ঠেকাতে পারবে না। আড্ডার উন্মীলন স্ত্রী-পুরুষের মিশ্রণে। মেয়েরা কাছে থাকলে পুরুষের, এবং পুরুষ কাছে থাকলে মেয়েদের রসনা মার্জিত হয়, কণ্ঠস্বর নিচু পর্দায় থাকে, অঙ্গভঙ্গি শ্ৰীহীন হতে পারে না। মেয়েরা দেন তাঁদের স্নেহ ও লাবণ্য, নৃত্যুনতম অনুষ্ঠানের সূক্ষ্মতম বন্ধন; পুরুষ আনে তার ঘরছাড়া মনের দূরকল্পনা। বিচ্ছিন্নভাবে মেয়েদের দ্বারা এবং পুরুষের দ্বারা পৃথিবীতে অনেক ছােটাে-বড়ো কাজ হয়ে থাকে; ছন্দ হয় দুয়ের মিলনে।
আড্ডা স্থিতিশীল নয়, নদীর স্রোতের মতো প্রবাহমান। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার রূপের বদল হয়। মন যখন যা চায়, তা-ই পাওয়া যায় তাতে। কখনো কৌতুকে সরস, কখনাে আলোচনায় উৎসুক, কখনাে প্রীতির দ্বারা সুস্নিগ্ধ। বন্ধুতা ও অন্তবীক্ষণ, হৃদয়বৃত্তি ও বুদ্ধির চর্চা, উদ্দীপনা ও বিশ্রাম—সব একসঙ্গে শুধু আডডাই আমাদের দিতে পারে, যদি সত্যি তা ঐ নামের যোগ্য হয়। বিশ্বসভায় অখ্যাতির কোণে আমরা নির্বাসিত; যারা ব্যস্ত এবং মস্ত জাত, যাদের কৃপাকটাক্ষ প্রতি মুহুর্তে আমাদের বুকে এসে বিধছে, তারা এখনাে জানে না যে পৃথিবীর সভ্যতায় আডডা আমাদের অতুলনীয় দান। হয়তাে একদিন নব-যুগের দুয়ার খুলে আমরা বেরিয়ে পড়বো, অস্ত্র নিয়ে নয়, মানদণ্ড নিয়ে নয়, ধর্মগ্রন্থ নিয়েও নয়, বেরিয়ে পড়বো বিশুদ্ধ বেঁচে থাকার মন্ত্র নিয়ে, আনন্দের উদ্দেশ্যহীন ব্ৰত নিয়ে, আড্ডার দ্বারা পৃথিবী জয় করবাে। আমরা, জয় করবাে। কিন্তু ধ’রে রাখবাে না;— কেননা আমরা জানি যে ধ’রে রাখতে গেলেই হারাতে হয়, ছেড়ে দিলেই পাওয়া যায়। পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি বলে, কাড়ো; আমাদের আডডা-নীতি বলে, ছাড়ো।
১৯৪৪
উত্তরতিরিশ