শেষ চিঠি
আয়েশা ফয়েজ
আলোচনাটি লিখেছেনঃ ইয়াদিরা আমরান।
“আমার এত আদরের বাচ্চাটি আমাকে ছেড়ে তুমি কোথায় গেলে”─ লেখাটির শুরু এক দেহত্যাগী সন্তানের প্রতি মমতাময়ী মায়ের। এখানে মা আয়েশা ফয়েজ আর সন্তান স্বনামধন্য লেখক হুমায়ূন আহমেদ। একজন মায়ের ছটফটানি, অস্থিরতা, কষ্ট, দুঃখ, যন্ত্রনা, একাকীত্ব, নিঃঙ্গতা─ বিষয়গুলো লেখায় ক্রমে প্রকাশ পেয়েছে। বিষয়বস্তুতে ভাষিক অলংকার, ঘটনার প্লট বা সময়ের গতি কিছুই নেই। সন্তানের অকাল প্রস্থান যেন অবলা এক মাকে থামিয়ে দিয়েছে নিরন্তর। একজন সাদাসিধা মানুষের সরল হৃদয়ের ভাবটুকু কাগজের পাতায় প্রকাশমাত্র।
সন্তান হয়েও হুমায়ূন তাঁর মার কাছে ছিল বন্ধু, ক্ষেত্রবিশেষে অভিভাবক। লেখায় নানা ঘটনার বর্ণনায় তাই উঠে আসে। এক জায়গায় বলছেন─ “জীবনে এই প্রথমবার এবং এই শেষবার তোমার কোনো একটা মতামতে আমার কিছু বলার ছিল না। আমাদের ছোট সুখ-দুঃখের জীবনে আমার সাথে সবসময় সবকিছু নিয়ে কথা হতো। আমি সবসময় তোমার মত মেনে নিতাম, আমার এত বুদ্ধিমান একজন ছেলে, তার মতের বাইরে যাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না।”
বৃদ্ধা মা আয়েশা ফয়েজ নিজ মনে একটি ছবি এঁকে রেখেছিলেন নিজ মৃত্যুর পর তাঁর সন্তানেরা কে কি করতে পারে, হুমায়ূন কী করতে পারে এই সব নিয়ে। তিনি ধারণাই করতে পারেনি তার আদরের সন্তান, মানিক, নদীয়ার চাঁদ হুমায়ূন ফাঁকি দিয়ে তার আগে সবাইকে পর করে চলে যাবেন। সেই ছবিটি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় একটি শিশুসন্তান অভিভাবকের কাছে যেমন করে আক্ষেপ করে, তিনিও মৃত সন্তান হুমায়ূনের কাছে তেমনি করে আক্ষেপ করেছেন।
লেখায় ছেলে হুমায়ূনের প্রতি কয়েকটি জিজ্ঞাসা ছিল। জীবিত অবস্থায় জিজ্ঞাসা করতে পারেন নি এমন ও মৃত্যুর পর কিছু ঘটনাপ্রেক্ষিতে জন্ম নেওয়া জিজ্ঞাসা এমন। কবর দেওয়া নিয়ে মতান্তরের ঘটনায় চলে যাওয়া ছেলেকে প্রশ্ন করেছেন,
“তুমি যখন জীবিত ছিলে, কিংবা যখন মারা গিয়েছ দেশের মানুষ সব সময়েই তোমাকে শ্রদ্ধা করেছেন, ভালোবেসেছে। তুমি নাকি বলেছ তুমি বুদ্ধিজীবীদের কবরস্থান পছন্দ করো না─কিন্তু তুমি নিজেই তো বুদ্ধিজীবী। তুমি নাকি বলেছ তুমি বনানী কবরস্থানও পছন্দ করো না, তুমি যেখানে যাচ্ছ সেখানে তো তুমি ইলেকশান করবে না, গানের জলসা করবে না। আর যাই হোক তোমার শেষ কথাটি তো এক রকম হবে, এটি তিন রকম হলো কেন?”
“আমার এত সৌভাগ্যবান ছেলে তুমি, জীবনের শেষ সময়টিতে কেন এমন হলো? তোমার নিজের নুহাশ পল্লী ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়া জায়গা ছিল, মোহাম্মদপুরে জায়গা ছিল, সেন্ট মার্টিনে বাড়ি ছিল, ধানমন্ডিতে বাসা ছিল, বসুন্ধরায় জায়গা কেনা ছিল, তাহলে তোমার ডেথ সার্টিফিকেটে কেন, তোমার নিজের কোনো একটি জায়গার নাম না লিখে ‘গুলশান’ লেখা হলো? যে নুহাশ পল্লী নিয়ে পরে এত হইচই, সেই নুহাশ পল্লী তখন কোথায় ছিল? তোমার এত কিছু ছিল কিন্তু যখন পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার সময় হলো তখন হঠাৎ করে কেন পুরোপুরি নিঃস্ব মানুষ হয়ে শূন্য হাতে বিদায় নিতে হলো?”
তাঁর বড় সন্তান হুমায়ূনের অকাল প্রয়াণ তাঁর মনোজগতকে বেশ নাড়া দেয়, যার ফলস্বরূপ তার লেখায় মৃত মানুষ─ বাবা-মা, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ স্বামী, মৃত তিন ভাই, হুমায়ূনের প্রথম পুত্র সন্তান রাশেদের প্রসঙ্গ এসেছে বহুবার। তাদের সাথে দেখা করার কথা, কে কি বলল, বাবাকে চেনা গেল কিনা, বাবা হুমায়ূনকে চিনতে পেরেছে কিনা, নানির সাথে দেখা হয়েছে কিনা ঘুরেফিরে এসেছে বারবার।
একজন মায়ের সন্তান বাঁচানোর আকুতি যেন নিয়তির কাছে সমর্পিত। হুমায়ূন-সৃষ্ট চরিত্র বাকের, টুনীদের যেমন হুমায়ূন-সৃষ্ট নিয়তিতেই সমর্পিত হতে হয়েছে অন্যজনদের চাওয়া ছিল গৌণ, তেমনি মা,পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, সাড়া দেশবাসী চাওয়ার পরও হুমায়ূনকে তার নিয়তির কাছে সমর্পিত হতে হয়েছে। এক অসহায় মা নিজ মনকে যেন এই বুঝিয়েই প্রবোধ দিয়েছেন বারবার।