হুমায়ুন আজাদ
সম্পাদিত
আধুনিক বাঙলা কবিতা
ভূমিকা
বিশশতকের বাঙালির প্রতিভার মহত্তম সৃষ্টি আধুনিক বাঙলা কবিতা। শুধু বিশশতকের নয়, হাজার বছরের বাঙলা কবিতা মূল্যায়ন করলেও বোধ করি যে আধুনিক বাঙলা কবিতার থেকে অভিনব ও উৎকৃষ্ট কবিতা লেখা হয় নি আর কোনাে শতকে। মাত্র সাড়ে ছ-দশকে আধুনিক কবিতার যে-উৎপাদন ঘটে, রবীন্দ্রনাথকে মনে রেখেও বলছি, উৎকর্ষে ও পরিমাণে তার তুলনা দুর্লভ। আধুনিক বাঙলা কবিতা বিশ্বের অন্যান্য ভাষার আধুনিক কবিতার মতোই অভিনব ও বিস্ময়কর, এবং বিপর্যয়করও; তবে বিস্ময়ের মাত্রা বাঙলায় অনেক বেশি। আধুনিক বাঙলা কবিতার সাথে জড়িত একটি বিস্ময় হচ্ছে একই দশকে পাঁচজন মহৎ কবির আবির্ভাব, আগে যা কখনো ঘটে নি; বাঙলা কবিতাকে একজন মহৎ/প্রধান কবির জন্যে অপেক্ষা করতে হয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী, তাই এক দশকে পাঁচজন মহৎ কবির আবির্ভাব যারপরনাই বিস্ময়কর। বাঙলার মহৎ/প্রধান কবিদের তালিকাটি হবে এমন : বড়ু চণ্ডীদাস, চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, জ্ঞানদাস, গোবিন্দ দাস-পদাবলির পাঁচজন; মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, বিজয় গুপ্ত, ভারতচন্দ্র রায়-মঙ্গলকাব্যের তিনজন; মাইকেল মধুসূদন দত্ত—মহাকাব্যের একজন; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-রোম্যান্টিক কবিতার একজন; এবং জীবনানন্দ দাশ, অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে-আধুনিক কবিতার পাঁচজন। বাঙলা কবিতার শ্রেষ্ঠ পনেরোজন কবির পাঁচজনই আধুনিক ধারার, এটা অত্যন্ত বিস্ময়কর এজন্যেও যে পদাবলির পাঁচজনের জন্যে দরকার হয়েছে চার শতাব্দী, মঙ্গলকাব্যের তিনজনের জন্যে তিন শতাব্দী; অতিসৃষ্টিশীল রোম্যান্টিক ধারায় তিন-চারজন প্রধান কবির জন্ম স্বাভাবিক ছিলো, সে-স্বাভাবিক ঘটনাটি বাঙলায় ঘটে নি বাঙলার বিলম্বিত রোম্যান্টিকতার জন্যে, জন্মেছেন একজন, যদিও তিনি একলাই দু-তিনজনের কাজ চমৎকারভাবে সম্পন্ন ক'রে গেছেন; আর ১৮৯৯-১৯০৯ অব্দের মধ্যে ভূমিষ্ঠ হন। আধুনিক কবিতাধারায় পাঁচজন, যাঁরা বিশশতকের তৃতীয় দশকে দেখা দেন কবিরূপে। তাঁদের মহত্ত্ব সম্পর্কে আর সন্দেহ পোষণের কারণ দেখি না, যদিও আমাদের সমকালীন বলে তাঁদের মহত্ত্ব স্বীকার করতে দীর্ঘকাল ধরে আমরা দেখিয়েছি বাঙালিসূলভ কৃষ্ঠা। তাঁরা ছাড়াও আধুনিক কবিতাধারায় আবির্ভূত হন গুরুত্বপূর্ণ ও কিছু-কম-গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকজন কবি, এবং আধুনিক কবিতা অর্জন করে বাঙলা কবিতার শ্ৰেষ্ঠ শস্য বলে গণ্য হওয়ার যোগ্যতা। প্রথাগত বিষয়গুলোকেই আজো আমরা বড়ো মনে করি, অতীতের তুচ্ছ অর্জনগুলোকেও দেখি অতিশায়িত করে, বর্তমানের অর্জনকে গুরুত্ব দিতে চাই না, তাই আধুনিক বাঙলা কবিতার মহিমা আজো আমরা বুঝে উঠতে পারি নি। এ-কবিতা উপলব্ধি ও শিল্পিতায় উৎকৃষ্ট মধ্যযুগের যে-কোনো ধারার কবিতার থেকে, আর মধুসূদন ও রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত সাফল্য সত্ত্বেও বাঙলা মহাকাব্যিক ও রোম্যান্টিক কবিতার থেকে অনেক উন্নত আধুনিক বাঙলা কবিতা। আধুনিক কবিতাপূর্ব বাঙলা কবিতা মৰ্মত অপ্রাপ্তবয়স্কতার কবিতা, আধুনিক বাঙলা কবিতায়ই প্রথম বাঙলা কবিতা হয়ে ওঠে প্রাপ্তবয়স্কতার কবিতা । এ-কবিতা বিশশতকের কবিতা, এ-কবিতায়ই প্ৰকাশ পেয়েছে বিশশতকের সংবেদনশীলতা, এতেই পাই বিশশতকের আপনি শিল্পকলা। তবে আধুনিক বাঙলা কবিতা শুধু বিশশতকেই সীমাবদ্ধ নয়, এর এক বড়ো অংশ চিরকালীনতা দাবি করতে পারে।
যে-সংবেদনশীলতা পরিচিত আধুনিকতা নামে, তার অবসান ঘটেছে বা ঘটতে যাচ্ছে; এখন হিশেবে ক’রে দেখতে পারি কী ফসল ফলেছে গত সাড়ে ছ-দশকে। আমাদের সাংস্কৃতিক মান বেশ নিম্ন, এবং ক্রমশ আমরা এগিয়ে যাচ্ছি নিম্নতর সংস্কৃতির দিকে, তাই আধুনিক কবিতার সুফল ফ'লে যাওয়ার পরও আধুনিক কবিতাকে আমরা সাদরে গ্রহণ করতে পারি নি, বা উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারি নি আধুনিক বাঙলা কবিতার সংস্কৃতির। আমাদের রাজনীতি, শিক্ষা, অর্থনীতি, জীবনরীতি দায়ী এর জন্যে। আমাদের বিদ্যালয়গুলোর কথা ছেড়ে দিচ্ছি, বিদ্যালয়গুলোতে কোমলমতি বালকবালিকাদের নিকৃষ্ট গদ্য পড়ানোই রীতি; আমাদের মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও আধুনিক কবিতাবিরূপতা প্ৰকট; -ওখানে রঙ্গলাল, ঈশ্বরগুপ্ত, কায়কোবাদ, সৈয়দ এমদাদ আলি, বেগম রোকেয়া, বন্দে আলি মিয়া, সুফিয়া কামালকেও কবি ব’লে স্বীকার করা হয়, তাঁদের নিম্নপদ্য সংকলিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ী সংকলনে, পাঠ্যও হয়; কিন্তু আধুনিক কবিতা স্বাগত হয় না, অধিকাংশ আধুনিক কবি --অসংকলিত থাকেন, বা সংকলিত হন ধান্দাবাদী সমকালীন অকবিরা। আধুনিক কবিতা সংকলনের সম্পাদকেরাও পরিচয় দিয়ে থাকেন দ্বিধা আর ভীরুতার; অন্যাধুনিক প্রথাগত কবিতাও তাঁরা নেন। আধুনিক কবিতার সংগ্রহে, সৃষ্টি করেন বিভ্রান্তি; আধুনিক কবিতা যে একটি স্বতন্ত্র কবিতাধারা, তা বুঝতে দেন না পাঠকদের; যেমন বুদ্ধদেব বসুর সম্পাদিত আধুনিক বাংলা কবিতা (১৯৫৪), যেটি সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী সংকলন আধুনিক বাঙলা কবিতার। এটি আধুনিক কবিতাকে পৌঁছে দিয়েছে পাঠকদের কাছে, আবার কাজ করেছে আধুনিক কবিতার বিরুদ্ধেও। এটি শুরু হয়েছে রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে, যা এক বড়ো ভ্ৰান্তি; রবীন্দ্রনাথ মহৎ কবি সন্দেহ নেই, আর এতেও সন্দেহ নেই যে তিনি আধুনিক নন, রোম্যান্টিক; তাই স্থান পেতে পারেন না আধুনিক বাঙলা কবিতার সংগ্রহে। রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও এ-সংকলনে রয়েছেন প্রমথ চৌধুরী, অবনীন্দ্রনাথ, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, সুকুমার রায়, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, মোহিতলল মজুমদার, নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীনের মতো অনেকে, যাঁরা আধুনিক নন যদিও কবিতা লিখেছেন বিশশতকে;-সংকলনটিতে পাঠকেরা নানা রকম কবিতা পড়ার সুযোগ পেয়েছেন, কিন্তু আধুনিক কবিতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পান নি। এ-সংকলনের শুরুতে রবীন্দ্রনাথ ও নানা অনাধুনিকের উপস্থিতি আধুনিক কবিতাকে স্বাধীন স্বতন্ত্র ধারার কবিতারূপে প্রতিষ্ঠিত হ’তে দেয় নি; পাঠকেরা বুঝে উঠতে পারেন নি আধুনিক কবিতার মহিমা। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, সুধীন্দ্রনাথ, জসীমউদদীন যদি আধুনিক হন, একই সাথে, তাহলে আধুনিকতা হয়ে ওঠে হাস্যকর ব্যাপার, যদিও আধুনিক কবিতা এমন কোনো কৌতুককর খিচুড়ি নয়।
আধুনিক বাঙলা কবিতা এক আন্তর্জাতিক প্রপঞ্চের বঙ্গীয় রূপ, ওই প্ৰপঞ্চের নাম আধুনিকতা বা আধুনিকতাবাদ, যার উদ্ভব ঘটে পশ্চিমে, এবং ছড়িয়ে পড়ে সারা পৃথিবীতে। আমাদের ভাগ্য যে বাঙলা কবিতা ওই প্রপঞ্চের বাইরে থাকে নি, বরং থেকেছে অত্যন্ত ভেতরে, এবং সুফল ফলিয়েছে কবিতার। রোম্যান্টিক আন্দোলনের পর সবচেয়ে ব্যাপক ও সফল সাহিত্যশিল্পান্দােলন আধুনিকতা বা আধুনিকতাবাদ, যা গ্ৰহ জুড়ে সৃষ্টি করেছে অভিনব অসামান্য সাহিত্য ও শিল্পকলা; তার অবসান ঘটে গেছে দু-তিন দশক আগে, তবে রোম্যান্টিকতাকে যেমন আমরা সম্পূর্ণ মুছে ফেলতে পারি নি, তেমনি এখনো আমরা বাস করছি আধুনিক সাহিত্যের মধ্যেই। আধুনিকতাবাদ এক বহুমাত্রিক শিল্পসাহিত্যান্দোলন, যার বিকাশ ঘটেছে নানা রূপে, নানা রীতিতে।
পশ্চিমে আধুনিকতাবাদের কাল ব'লে অনেকে ধরেন ১৮৯০-১৯৩০ পর্বকে, অনেকে বিশশতকের প্রথম পাঁচশ বছরকে গণ্য করেন আধুনিকতাবাদের কাল ব’লে, আবার কেউ মনে করেন ১৯১০-১৯২৫ হচ্ছে এর স্বর্ণযুগ। আধুনিকতাবাদের চারিত্র হচ্ছে সাহিত্যসংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রথাগত রাষ্ট্রসীমা ভেঙে ফেলা, এর স্বভাব আন্তর্জাতিকতা। প্রত্যেক কালেরই থাকে নিজস্ব স্বভাব ও সংবেদনশীলতা, তখনই আমরা একটি ভিন্ন কালে পৌছি। যখন বদল ঘটে ওই স্বভাব ও সংবেদনশীলতার। এমন বদল নিয়মিত ঘ’টে চলছে সাহিত্য, শিল্পকলা, চিন্তার ইতিহাসে। কয়েক দশক পরপর-সাহিত্য, শিল্পকলা, চিন্তার এলাকায়-ঘটে সংবেদনশীলতার পরিবর্তন, আর আমরা এক শিল্প, সাহিত্য, চিন্তা থেকে পৌছি আরেক শিল্প, সাহিত্য, চিন্তায়। তবে এ-পরিবর্তনগুলো একই মাত্রার নয়, সংবেদনশীলতা বদলের তিনটি মাত্ৰা চোখে পড়ে। প্রত্যেক দশকে প্রত্যেক প্রজন্ম একধরনের বদল নিয়ে আসে সংবেদনশীলতার, নিয়ে আসে প্রজন্মের দশকি ফ্যাশন; তা প্রজন্মের সাথে আসে আর তারই সাথে চ'লে যায়, এক দশক তার আয়ু। এ-বদল কোনো মৌল বদল নয়। এর চেয়ে বড়ো মাত্রার বদল ঘটে কয়েক প্রজন্ম, সাধারণত এক শতাব্দী, ধ’রে, যাতে ঘটে সংবেদনশীলতা ও রীতির গভীরতর ও ব্যাপক বদল, যা স্থায়ী হয় দীর্ঘ কাল ধ’রে। এ-বদল বেশ বড়ো মাত্রার; এটা সংবেদনশীলতার শতকি পরিবর্তন। কখনো কখনো সংবেদনশীলতার ঘটে এর থেকেও অনেক বড়ো মাত্রার বদল, বিশাল বাদল, সহস্রকে দু-একবার; ঘটে সংস্কৃতির ভয়াবহ ভাঙাগড়া, যার ফলে মহৎ চিরস্থায়ী ব’লে গণ্য কীর্তিগুলোও হঠাৎ ধ’সে পড়ে, অতীত পরিণত হয় ধ্বংসস্তুপে, মহৎ সমাধিক্ষেত্রে। এমন বিশাল মাত্রার বদল এতোদিনের সভ্যতাসংস্কৃতি সম্বন্ধে প্রশ্ন তুলে ধরে, তাকে আর গ্রহণযোগ্য মনে করে না; তাকে বাদ দিয়ে নিজে সৃষ্টি করতে থাকে সম্পূর্ণ অভিনবকে, যা আগে কখনাে ভাবনায় আসে নি। আধুনিকতাবাদ এ-তৃতীয় মাত্রার বিশাল বদল ঘটায় সংবেদনশীলতার, সৃষ্টি করে এক অভিনব শিল্পকলা, যার মুখোমুখি অসহায় বোধ করে প্রথাভ্যস্ত শিল্পকলানুরাগীরা। আধুনিকতাবাদ শুধু অভিনবভাবে আসে নি, এসেছিলো বিপর্যয় সৃষ্টি ক’রেও। আধুনিকতাবাদের আগে, পশ্চিমে, শিল্পকলার জগতে বিপ্লব ঘটেছে প্রত্যেক শতকেই, বদলও ঘটেছে সংবেদনশীলতার, কিন্তু তা কোনাে বিপর্যয় সৃষ্টি করে নি, ওই বদল ঘটে স্বাভাবিকভাবে; আধুনিকতাবাদ আসে এক মহাবিপ্লবরূপে, যা আগের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে সম্পূর্ণরূপে। এর স্বভাব বিপর্যয়কর।
আধুনিকতাবাদী শিল্পসাহিত্য পূর্ববর্তী সাহিত্যশিল্পকলার ধারাবাহিক পরিণতি নয়, তা হঠাৎ সম্পর্ক ছিন্ন করে ঐতিহ্যের সাথে। আধুনিকতাবাদী শিল্পকলা খোলাখুলিভাবে বর্জন করে ইউরোপের পাঁচ শতাব্দীর উদ্যোগকে; তাই আধুনিকবাদ হচ্ছে পশ্চিমের ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো বিভাজনরেখা;-অন্ধকার যুগ ও মধ্যযুগের, আর মধ্যযুগ ও রেনেসাঁসের মধ্যে যে-পার্থক্য তার চেয়ে বেশি পার্থক্য আধুনিকতাবাদী ও তার পূর্ববর্তী যুগের। আর কোনাে যুগ এমন শিল্পকলা সৃষ্টি করে নি, যা ওই যুগে গণ্য হয়েছে ভয়ংকর বিহ্বলকরভাবে অভিনব ব’লে, যেমন ভয়ংকর বিহ্বলকরভাবে অভিনব শিল্পকলা সৃষ্টি হয়েছে আধুনিকতাবাদী পর্বে। প্রত্যেক কালই রচনা করে তার নতুন কবিতা, আধুনিক কবিতাও নতুন; তবে প্রত্যেক কালের নতুন কবিতার থেকে এ-কবিতার পার্থক্য হচ্ছে আধুনিক কবিতা নতুন মাত্রায় নতুন, অভিনবভাবে অভিনব । পশ্চিমে পূর্ববর্তী শিল্পকলা ও আধুনিক শিল্পকলার বিভাজন ঘটতে শুরু করে ১৮৫০-এর দিকে, যখন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে ধ্রুপদীরীতির লেখা। আগের শিল্পকলা ও আধুনিক শিল্পকলার মধ্যে যে ঘটে গেছে মহাবিভাজন, এতে কারো দ্বিমত নেই; তবে আধুনিক পরিস্থিতির প্রকৃতি, এবং শিল্পকলার স্বভাব ও আঙ্গিকের ওপর ওই পরিস্থিতির ফল সম্পর্কে দ্বিমত রয়েছে। আধুনিকতাবাদের চারিত্র সম্পর্কে বিভিন্ন মত থাকলেও নাম নিয়ে মতভেদ নেই, পশ্চিমে মডার্ন’ বা তার কোনো সাধিত রূপ দিয়ে এ-শিল্পকলাকে নির্দেশ করা হয়; পাওয়া যায় আধুনিক আন্দােলন, আধুনিক ঐতিহ্য, আধুনিক যুগ, আধুনিক শতাব্দী, আধুনিক মেজাজ, আধুনিকতাবাদ, বা শুধুই আধুনিক প্রভৃতি অভিধা। ইংরেজি “মডান” আর বাঙলা “আধুনিক” শব্দ দুটি আর্থগতিশীল, তা বিশেষ কোনো স্থির কাল নির্দেশ না ক’রে যে-কালই আসে, নির্দেশ করে তাকেই; ‘অধুনা’ থেকে গঠিত ‘আধুনিক’ বোঝায় ‘এখনকার, সাম্প্রতিক’, তবে ‘আধুনিকতাবাদ’ প্রত্যেক সাম্প্রতিক কালের বৈশিষ্ট্য নয়, বিশশতকের বিশেষ সময়ে যে-প্ৰপঞ্চ দেখা দিয়েছিলো, তাই আধুনিকতা বা আধুনিকতাবাদ। আধুনিকতা বা আধুনিকতাবাদ নাম নিয়ে দ্বিমত নেই; তবে আধুনিকতাবাদের কী, কেনো, কখন, কোথায় সম্পর্কে মতের শেষ নেই। অন্যান্য কালের স্বভাব রীতির এককতা, আর আধুনিকতার স্বভাব রীতির বৈচিত্র্য; তার কারণ আধুনিকতাবাদ একক আন্দােলন নয়, একরাশ আন্দােলনের-ইমপ্রেশনিজম, অভিব্যক্তিবাদ, কিউবিজম, ভবিষ্যদ্বাদ, প্রতীকবাদ, চিত্ৰকল্পবাদ, ভর্টিসিজম, দাদাবাদ, পরাবাস্তবতাবাদ ও আরো নানা শিল্পকলাবাদের-সমষ্টি । এ-সব বাদের মধ্যে মিল রয়েছে এখানে যে প্রতিটি আন্দোলনই বাস্তবতাবাদ ও রোম্যান্টিকতাবিরোধী, ও বিমূর্ত৷তামুখি; এ ছাড়া এগুলোর মধ্যে মিলের থেকে অমিল বেশি, এবং অনেকগুলো পরস্পরবিরোধী ।
শিল্পকলার ইতিহাসে আধুনিকতাবাদই আয়ত্ত করতে চেয়েছে সবচেয়ে উন্নত । নান্দনিক আত্মচেতনা, এটা করতে গিয়ে বাদ দিয়েছে অবিকল উপস্থাপনরীতি, যা সৃষ্টি করেছে বিপৰ্যয়। প্রথাগত সমস্ত শিল্পকলার লক্ষ্য অবিকল উপস্থাপন, বাস্তবের অনুকরণ; এমনকি রোম্যান্টিকেরা যদিও বাস্তবের অনুকরণ বাদ দিয়ে জ্ব’লে উঠতে চেয়েছিলেন দীপশিখার মতো, দর্পণের বদলে হ’তে চেয়েছিলেন প্ৰদীপ, তাঁরাও বেশি দূরে যান নি। আধুনিকতাবাদী শিল্পকলা জীবনের গভীরে প্রবেশ করার জন্যেই দূরে স’রে যায় বাস্তবতা ও মানবিক উপস্থাপনা থেকে, এগিয়ে যায় রীতি, কৌশল, ও স্থানিক রূপের দিকে। এতে ঘটে নান্দনিক পরিশীলন, ঘটে শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ; শিল্পকলা থেকে ক্রমিকভাবে বাদ দেয়া হয় মানবিক উপাদান। আধুনিকতাবাদের আগে আর এখনো অধিকাংশ সাহিত্যউপভোগী শিল্পের নামে উপভোগ করেন মানবিক উপাদান, তার প্ররোচনায় তাঁরা হাসেন কাঁদেন, শিল্পকলা উপভোগ করেন না। আধুনিকতাবাদ চেয়েছে মানবিক উপাদানের বদলে শিল্পকলা উপভোগ করাতে। “বিমানবিকীকরণ” সম্পর্কে ভুল ধারণা রয়েছে অনেকের, তাঁরা মনে করেন এর অর্থ ‘অমানবিক’; বিমানবিক অমানবিক নয়, বিমানবিক হচ্ছে মানবিক উপাদানের অভাব। আধুনিকতা আঙ্গিকের চরম বদল ঘটিয়ে তাকে কোলাহলের কাছাকাছি নিয়ে এসেছে কখনাে কখনাে; অর্থাৎ আধুনিকতাবাদ শিল্পকলার নতুন রীতিই শুধু নয়, রীতির মহৎ বিপর্যয়ও । এর পরীক্ষানিরীক্ষা শুধু পরিশীলন, দুরূহতা, অভিনবত্ব সৃষ্টি করে নি, সৃষ্টি করেছে। অন্ধকার, বিচ্ছিন্নতা, বিনষ্টি। শিল্পকলায় যে-সংস্কৃতিসংকট রোম্যান্টিকতার কাল থেকে চ’লে আসছিলো, তা চরম পরিণতি লাভ করে আধুনিকতাবাদে। তবে আধুনিকতাবাদ বিশশতকের শিল্পকলা, কেননা তা সাড়া দিয়েছে বিশশতকের কোলাহলের ডাকে। যে-সব আন্দোলনের সমষ্টি আধুনিকতাবাদ, সেগুলো আবির্ভূত হ’তে শুরু করেছিলো। উনিশশতকের মাঝভাগ থেকে, ফরাশিদেশে; ১৮৮০কে মনে করা হয় আধুনিকতার সূচনাকাল ব’লে, যখন দেখা দেন প্রথম আধুনিকেরা-মালার্মে, ভিলিয়ের দ্য লিজল-আঁদ, উ্যসম্য, লোত্রেআমেী, যাঁরা ঋণী ফ্লবেয়ার, গতিয়ে, বদলেয়ারের কাছে। এর পর দশকে দশকে দেখা দেন। আধুনিক কবি, ঔপন্যাসিক, সঙ্গীতস্রষ্টা, চিত্রকরেরা। পশ্চিমে এ-সময়, উনিশশতকের দ্বিতীয় ভাগে, ঈশ্বর একটা বাজে কথায় পরিণত, ধর্মীয় মূল্যবােধের বদলে সেখানে দরকার পড়ে নতুন মূল্যবােধ, আর ওই মূল্যবােধ সৃষ্টি করেছিলেন মহৎ আধুনিক লেখকেরা। তাঁরা শিল্পকলাকেই ক'রে তুলেছিলেন নতুন ধর্ম। ভলতেয়ার, ডারউইন নষ্ট ক’রে দিয়েছিলেন অনেক প্রথাগত বিশ্বাস, আর ফ্রয়েড আবিষ্কার করেন মনের রহস্যময় গভীরতা, যেখানে যুক্তি নিস্ক্রিয়, যেখানে রাজত্ব করে পুরাণ আর প্রতীক। সেখানে দার্শনিক বা বিজ্ঞানী সাহায্য করতে পারেন না, হয়তো পারেন। কবি আর ঔপন্যাসিক। তাঁরা সমালোচনা করেন বুর্জোয়া সমাজের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের; এবং সমাজ থেকে দূরে স’রে যান, এগিয়ে যান বিশুদ্ধ শিল্পকলার দিকে, কল্পনার ব্যক্তিগত ভুবনের দিকে, কেননা চারপাশের সমাজ তাঁদের মনে শুধু বমনের উদ্রেক করে। তাঁরা আশ্রয় নেন। কলাকৈবল্যবাদে, শিল্পের জন্যে শিল্পে, ঘেন্না করেন। প্রথাগত সামাজিক নৈতিক বিন্যাসকে, যার সাহায্যে বেঁচে আছে ঘৃণ্য সভ্যতা। তাঁরা শুরু থেকেই ছিলেন বিদ্রোহী, শ্ৰদ্ধেয় ছিলেন না, তাঁদের লেখা অর্জন করে কেলেঙ্কারির ও শিল্পকলার সাফল্য। শিল্পকলাবাদী বাস্তবতাবিমুখ বিচিত্র আন্দোলন, যেগুলোর নাম আগেই উল্লেখ করেছি, একটা সমন্বিত রূপ নেয়। ১৯১০ থেকে ১৯২৫ অব্দের মধ্যে, এবং এ-সময়টাকে মনে করা হয় আধুনিকতাবাদের শ্ৰেষ্ঠ সময়। এ-সময়ে বিশশতক দগ্ধ হয় অপব্যয়ী অক্লান্ত আগুনে, প্রথম মহাযুদ্ধে, মেতে ওঠে রক্তপাতে; যুদ্ধের পর অসীম অবিশ্বাস আর হতাশা থেকে জন্ম নেয় বিশশতকের অসামান্য শিল্পকলা, যার মধ্যে আধুনিক কবিতা প্রধানতম। আধুনিকতার নিজের বছর ব’লে চিহ্নিত করা হয় ১৯২২কে, যে-বছর বেরোয় এলিঅটের পোড়োজামি, রিলকের অফিফুসের প্রতি সনেটগুচ্ছ, জয়েসের ইউলিসিস, লরেন্সের অ্যারন্স রড প্রভৃতি।
বাঙলায় ১৯২৫ আধুনিকতাবাদের সূচনাবছর; আর কয়েক বছর পরই বেরোয় পরিপূর্ণ আধুনিক চেতনাসম্পন্ন কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ : বুদ্ধদেব বসুর বন্দীর বন্দন (১৯৩০), বিষ্ণু দের উর্বশী ও আর্টেমিস (১৯৩৩), সুধীন্দ্রনাথ দত্তের অর্কেস্ট্রা (১৯৩৫), জীবনানন্দ দাশের ধূসর পাণ্ডুলিপি (১৯৩৬), অমিয় চক্রবর্তীর খসড়া (১৯৩৮)। বাঙলা কবিতায় রোম্যান্টিকতা দেখা দিতে লেগেছিলো প্রায়-একশতক, কিন্তু আধুনিকতাবাদ দেখা দেয় পশ্চিমের সাথে একই দশকে, প্রায়-অবিলম্বে। আধুনিকতাবাদের জন্যে পশ্চিমে আধশতক ধ’রে যে-প্ৰস্তৃতি চলেছিলো, বাঙলায় তেমন কোনাে প্রস্তুতি চলে নি; তাই বাঙলার আধুনিকতাবাদ পশ্চিমের থেকেও বেশি আকস্মিক ও বিপর্যয়কর। বাঙলার নিজস্ব পরিস্থিতির জন্যেই আমাদের প্রথম আধুনিকেরা প্রথম কাব্যে চলেন প্রথাগত পথে, ওইটুকুই তাঁদের প্রস্তুতিপর্ব; দ্বিতীয় কাব্যেই তাঁরা প্রথা বর্জন ক’রে সৃষ্টি করেন বিস্ময়কর কবিতা। বিশের দশকে বাঙলা ভাষায় সূচনা ঘটে আধুনিক কবিতার, তিরিশের দশকে ফলে ওই কবিতার অতুলনীয় শস্য। পশ্চিমে আধুনিকতাবাদ যেমন সৃষ্টি করে অভিনব শিল্পকলা, অভিনবত্ব সঞ্চার করে শিল্পকলার সমস্ত শাখায়, বাঙলায় তা ঘটে নি; ঘটেছে প্রধানত বা একলা আধুনিক কবিতায়;-আমাদের কবিরাই শুধু আয়ত্ত করতে পেরেছেন নতুন সংবেদনশীলতা, সৃষ্টি করতে পেরেছেন নতুন শিল্পকলা। জীবনানন্দ বা সুধীন্দ্রনাথের পাশে তারাশঙ্কর বা বিভূতিভূষণ বেদনাদায়কভাবে প্রথাগত; আর আধুনিক কবিরাও যখন উপন্যাস লিখেছেন, তখন তাঁরাও থেকেছেন প্রথাগত। পশ্চিমের মতো বাঙলা আধুনিক কবিতাও ভয়ংকর বদল ঘটায় সংবেদনশীলতার; এ-কবিতা রাবীন্দ্ৰিক কবিতার স্বাভাবিক পরিণতি তো নয়ই, বরং এতো ভিন্ন যে আজো এ-কবিতার অভিঘাত আমরা কাটিয়ে উঠতে পারি নি; তাই আজো আধুনিক কবিতা এড়িয়ে প্রথাগত কবিতায়ই আমরা স্বস্তি খুজি। আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, ও জীবন যেহেতু প্রথাগত, মধ্যযুগীয়, তাই রোম্যান্টিক ও প্রথাগত কবিতার মহিমায়ই আমরা আজো মুগ্ধ হয়ে আছি। একটি মধ্যযুগীয় সংস্কৃতিতে আধুনিকতাবাদের বিকাশ এক বড়ো বিপর্যয় সন্দেহ নেই। প্রথাবাদী এ—অঞ্চলে আধুনিক কবিতায়ই প্রথম দেখি প্ৰথা থেকে স’রে আসা, অতীতের সাথে সম্পর্কছেদ, অসম্ভব এক শিল্পসৃষ্টির অভিলাষ। আধুনিক বাঙলা কবিতা বাঙালির সংবেদনশীলতা বদলে দিতে চেয়েছে; তবে বাঙালি বদলায় নি, এমন অচল গোত্রকে শিল্পকলার সাহায্যে বদলানাে অসম্ভব। আধুনিকতাপূর্ব বাঙলা কবিতা সরল আবেগের কবিতা, কৈশোর বা প্রথম যৌবনের আবেগ, স্বপ্ন, কাতরতাই বিষয় প্রথাগত বাঙলা কবিতার; আর ওই কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে যে,-অভিজ্ঞতা, তা সর্বজনীন অভিজ্ঞতা, তা শুধু কবির নয়, পাঠকেরও অভিজ্ঞতা। আধুনিক বাঙলা কবিতা সর্বজনীন সাধারণ অভিজ্ঞতার বদলে প্রকাশ করে কবির অনন্য ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, যা অধিকাংশ সময়ই মানসিক; আর আধুনিক কবিরা তা প্রকাশ করেছেন অভিনব ভাষায় ও অলঙ্কারে।
বিশের দশকে সূচনা ঘটে যে-কবিতার, আর ষাটের দশকে ঘটে যে-ধারার কবিদের শেষ উন্মেষ, সে-কবিতা অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এ—ধারার প্রথম পাঁচজনই-জীবনানন্দ দাশ, অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে-এ-ধারার শ্রেষ্ঠ কবি; এর পর গুরুত্বপূর্ণ বহু কবি জন্ম নিয়েছেন, কিন্তু প্রথম পাঁচজনের স্তর আয়ত্ত করতে পারেন নি। আমাদের প্রথম আধুনিকেরাই আধুনিকতম; তাঁদের উপলব্ধি, স্বপ্ন, মানস অভিজ্ঞতা যেমন ব্যাপক ছিলো, তেমনি তাঁরা নিয়ন্ত্রণ করেছেন বাঙলা ভাষাকে, তাঁরা গোত্রের ভাষাকে পরিস্রুত ক’রে গেছেন। তাঁদের বাদ দিয়ে অন্যদের বিচার করলে এখন চোখে পড়ে বহু ভুল মূল্যায়ন: একদা যাঁদের বড়ো ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছিলো, তাঁদের অনেককে আজ মনে হয় খুব গৌণ। যেমন প্রেমেন্দ্র মিত্রের ছিলো বড়ো কবির ভাবমূর্তি, আজ তাঁর সমগ্র কবিতা ঘেটে দু-তিনটির বেশি কবিতা পাই না, তাও সম্পূর্ণ আধুনিক নয়; বা সমর সেন, যাঁকে নিয়ে মত্ততা গেছে এক সময়, তাঁকেও মনে হয় খুব গৌণ। চল্লিশের দশকটা গৌণ কবিদের দশক; ভালো কবিরা আবার দেখা দেন পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে। বাঙলাদেশে, স্পষ্ট ক’রে বলি, বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে আধুনিক চেতনা দেখা দিতে সময় লেগেছিলো, তার কারণ বাঙালি মুসলমান অনেক পিছিয়ে ছিলো সামাজিকভাবে। আধুনিক চেতনার জন্যে যে-শিক্ষা ও সামাজিক অবস্থান ছিলো অপরিহার্য, তা বাঙালি মুসলমান পায় নি পঞ্চাশের দশকের আগে; এর আগে বাঙালি মুসলমানের কাব্যচর্চা ছিলো স্বল্পশিক্ষিতের স্বভাবকবিত্বের সাধনা। বাঙালি মুসলমান পেয়েছিলো এক বড়ো প্রথাগত পদ্যকার নজরুল ইসলামকে, যাঁকে নিয়ে আজো তাঁরা অন্ধ হয়ে আছে, এবং বাঙালি মুসলমান কবি যশোপ্রার্থীরা মনে করেছিলেন নজরুলকে নকল করলেই কবি হওয়া যাবে। চল্লিশের দশকে তাঁদের গ্রাস করে রুগ্ন পাকিস্থানবাদ, শোচনীয় পদ্যে তাঁরা ভ’রে তোলেন পাকিস্থান। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে বাঙলা ভাষার দু-অঞ্চলে ঘটে দু-রকম ঘটনা : পূর্বাঞ্চলে প্রথমবারের মতো দেখা দেয় ব্যাপক আধুনিকতা, যা প্রধানত বিকশিত হয় বাহ্যজীবন আশ্রয় ক’রে, আর পশ্চিমাঞ্চলে বাহ্যজীবনকে উপেক্ষা ক’রে কবিরা চর্চা করতে থাকেন ব্যক্তিতা ও অন্তর্জগতের, যা তাঁদের পৌঁছে দেয় প্রায়-পাগলামোর পর্যায়ে। ওখানকার পঞ্চাশ-ষাটের কবিদের রচনায় চোখে পড়ে বিভিন্ন মাত্রার উন্মত্ততা; উন্মত্ততা কখনো কখনো কবিতা হ’তে পারে, তবে কবিতা উন্মত্ততা নয়। পশ্চিম বাঙলার কবিতায় বানানো উন্মত্ততাও চোখের আড়ালে থাকে না, যাতে ঝিলিকের অভাব থাকলেও রয়েছে প্ৰলাপপ্রাচুর্য। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে বাঙলা কবিতার উৎকৃষ্টতর অংশ রচিত হয় বাঙলাদেশে, যা বাহ্য ও আন্তর অভিজ্ঞতার গুরুত্বপূর্ণ উৎসারণ।
এ-সংকলনের উদ্দেশ্য প্রথাগত কবিতা থেকে আধুনিক কবিতা, এবং অকবিতা থেকে উৎকৃষ্ট কবিতা শনাক্ত করা। আধুনিক বাঙলা কবিতার প্রতিটি সংকলন দুটি ক্রটি বহন ক’রে থাকে; বুদ্ধদেব বসুর সংকলনটির মতো মিশ্রণ ঘটায় আধুনিক ও প্রথাগত কবিতার, বা এমন অনেকের কবিতা সংকলন করে, যাঁরা কবি নন। এটি আধুনিক এবং শুধুই আধুনিক কবিতার সংকলন, এবং এটি আধুনিক বাঙলা কবিতার ইতিহাস নয়, সমালোচনা। বিশ থেকে ষাট দশকের কবিদের বিপুল পরিমাণ কবিতা আবার আমি আনন্দের সাথে পড়েছি, পীড়িতও বোধ করেছি। বহু বিখ্যাত ও অখ্যাতর লেখা অকবিতা প’ড়ে; সংকলন করেছি। শুধু তাঁদেরই কবিতা, আমার বিবেচনায় যাঁরা কবি, এবং সংকলন করতে চেষ্টা করেছি। প্রত্যেকের শ্রেষ্ঠ কবিতাটি বা কবিতাগুচ্ছ। কবিদের মান অনুসারে নিয়েছে বেশি বা কম কবিতা; সবচেয়ে বেশি সংখ্যক কবিতা নিয়েছি জীবনানন্দ দাশের, আর যিনি সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পৃষ্ঠা দখল করেছেন তিনি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। পাঁচ মহৎ আধুনিকের আরো বেশি কবিতা নিতে পারলে আমি তৃপ্তি পেতাম, কিন্তু বইয়ের আকৃতির ভয়ে তাঁদের আরো কবিতা নিই নি। তাঁরা ছাড়া অন্য প্রায়-প্রত্যেক কবি সম্পর্কেই আমি প্রচারিত ধারণা থেকে ভিন্ন ধারণা পোষণ করি; তাই বড়ো ভাবমূৰ্তিসম্পন্ন অনেকেই এ-সংকলনে ক্ষুদ্র আকার ধারণ করেছেন। যেমন প্রেমেন্দ্র মিত্র, বা অচিন্ত্যকুমার খুব গৌণ হয়ে উঠেছেন, তাঁদের কবিতা নাও নেয়া যেতো; বুদ্ধদেব বসু যেখানে সমর সেনের কবিতা নিয়েছেন তেরোটি, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের থেকে পটটি বেশি, সেখানে আমি সমর সেনের নিয়েছি পাঁচটি কবিতা, এবং তাঁর থেকে বেশি কবিতা নিয়েছি অনেকের। পশ্চিম বাঙলার অতিপ্রচারিত পঞ্চাশ-ষাটের কবিদের কবিতাও এ-কারণেই কম নিয়েছি। প্রকৃত কবি এমন কাউকেই বাদ দিতে চাই নি, তবে পশ্চিম বাঙলার কেউ কেউ, তাঁদের কাব্যগ্রন্থের দুষ্প্রাপ্যতার জন্যে, বাদ প’ড়ে থাকতে পারেন; বাঙলাদেশের কবিদের বেলা এমন ঘটে নি। এখানে সক্রিয় অজস্র কবিযশোপ্ৰার্থীর মধ্যে তাঁদেরই নিয়েছি, যাঁরা কবি; তবে কয়েকজনকে নিই নি, সেটা আমাদের সময়ের শোচনীয় দুর্ভাগ্য-সৈয়দ আলী আহসান, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দীন, ও আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতা নিই নি, আমি নিতে পারি না, কেননা তাঁরা সামরিক একনায়কত্ব ও মৌলবাদে দীক্ষা গ্ৰহণ ক’রে মানুষ ও কবিতা ও আধুনিকতার বিপক্ষে চ’লে গেছেন। এ-সংকলনটিকে আমি ভবিষ্যতের জন্যে রেখে যেতে চাই, এক শতক পর আমার মতো কেউ এটি বিচার করবেন। আধুনিক কবি ও কবিতা শনাক্তিতে আমি কতোটা ব্যর্থ হয়েছি।
২৭ অগ্রহায়ণ ১৪০০, ১১ ডিসেম্বর ১৯৯৩
১৪ই ফুলার রোড, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকা ঢাকা, বাঙলাদেশ
হুমায়ুন আজাদ
সম্পাদিত
আধুনিক বাঙলা কবিতা
ভূমিকা
বিশশতকের বাঙালির প্রতিভার মহত্তম সৃষ্টি আধুনিক বাঙলা কবিতা। শুধু বিশশতকের নয়, হাজার বছরের বাঙলা কবিতা মূল্যায়ন করলেও বোধ করি যে আধুনিক বাঙলা কবিতার থেকে অভিনব ও উৎকৃষ্ট কবিতা লেখা হয় নি আর কোনাে শতকে। মাত্র সাড়ে ছ-দশকে আধুনিক কবিতার যে-উৎপাদন ঘটে, রবীন্দ্রনাথকে মনে রেখেও বলছি, উৎকর্ষে ও পরিমাণে তার তুলনা দুর্লভ। আধুনিক বাঙলা কবিতা বিশ্বের অন্যান্য ভাষার আধুনিক কবিতার মতোই অভিনব ও বিস্ময়কর, এবং বিপর্যয়করও; তবে বিস্ময়ের মাত্রা বাঙলায় অনেক বেশি। আধুনিক বাঙলা কবিতার সাথে জড়িত একটি বিস্ময় হচ্ছে একই দশকে পাঁচজন মহৎ কবির আবির্ভাব, আগে যা কখনো ঘটে নি; বাঙলা কবিতাকে একজন মহৎ/প্রধান কবির জন্যে অপেক্ষা করতে হয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী, তাই এক দশকে পাঁচজন মহৎ কবির আবির্ভাব যারপরনাই বিস্ময়কর। বাঙলার মহৎ/প্রধান কবিদের তালিকাটি হবে এমন : বড়ু চণ্ডীদাস, চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, জ্ঞানদাস, গোবিন্দ দাস-পদাবলির পাঁচজন; মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, বিজয় গুপ্ত, ভারতচন্দ্র রায়-মঙ্গলকাব্যের তিনজন; মাইকেল মধুসূদন দত্ত—মহাকাব্যের একজন; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-রোম্যান্টিক কবিতার একজন; এবং জীবনানন্দ দাশ, অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে-আধুনিক কবিতার পাঁচজন। বাঙলা কবিতার শ্রেষ্ঠ পনেরোজন কবির পাঁচজনই আধুনিক ধারার, এটা অত্যন্ত বিস্ময়কর এজন্যেও যে পদাবলির পাঁচজনের জন্যে দরকার হয়েছে চার শতাব্দী, মঙ্গলকাব্যের তিনজনের জন্যে তিন শতাব্দী; অতিসৃষ্টিশীল রোম্যান্টিক ধারায় তিন-চারজন প্রধান কবির জন্ম স্বাভাবিক ছিলো, সে-স্বাভাবিক ঘটনাটি বাঙলায় ঘটে নি বাঙলার বিলম্বিত রোম্যান্টিকতার জন্যে, জন্মেছেন একজন, যদিও তিনি একলাই দু-তিনজনের কাজ চমৎকারভাবে সম্পন্ন ক'রে গেছেন; আর ১৮৯৯-১৯০৯ অব্দের মধ্যে ভূমিষ্ঠ হন। আধুনিক কবিতাধারায় পাঁচজন, যাঁরা বিশশতকের তৃতীয় দশকে দেখা দেন কবিরূপে। তাঁদের মহত্ত্ব সম্পর্কে আর সন্দেহ পোষণের কারণ দেখি না, যদিও আমাদের সমকালীন বলে তাঁদের মহত্ত্ব স্বীকার করতে দীর্ঘকাল ধরে আমরা দেখিয়েছি বাঙালিসূলভ কৃষ্ঠা। তাঁরা ছাড়াও আধুনিক কবিতাধারায় আবির্ভূত হন গুরুত্বপূর্ণ ও কিছু-কম-গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকজন কবি, এবং আধুনিক কবিতা অর্জন করে বাঙলা কবিতার শ্ৰেষ্ঠ শস্য বলে গণ্য হওয়ার যোগ্যতা। প্রথাগত বিষয়গুলোকেই আজো আমরা বড়ো মনে করি, অতীতের তুচ্ছ অর্জনগুলোকেও দেখি অতিশায়িত করে, বর্তমানের অর্জনকে গুরুত্ব দিতে চাই না, তাই আধুনিক বাঙলা কবিতার মহিমা আজো আমরা বুঝে উঠতে পারি নি। এ-কবিতা উপলব্ধি ও শিল্পিতায় উৎকৃষ্ট মধ্যযুগের যে-কোনো ধারার কবিতার থেকে, আর মধুসূদন ও রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত সাফল্য সত্ত্বেও বাঙলা মহাকাব্যিক ও রোম্যান্টিক কবিতার থেকে অনেক উন্নত আধুনিক বাঙলা কবিতা। আধুনিক কবিতাপূর্ব বাঙলা কবিতা মৰ্মত অপ্রাপ্তবয়স্কতার কবিতা, আধুনিক বাঙলা কবিতায়ই প্রথম বাঙলা কবিতা হয়ে ওঠে প্রাপ্তবয়স্কতার কবিতা । এ-কবিতা বিশশতকের কবিতা, এ-কবিতায়ই প্ৰকাশ পেয়েছে বিশশতকের সংবেদনশীলতা, এতেই পাই বিশশতকের আপনি শিল্পকলা। তবে আধুনিক বাঙলা কবিতা শুধু বিশশতকেই সীমাবদ্ধ নয়, এর এক বড়ো অংশ চিরকালীনতা দাবি করতে পারে।
যে-সংবেদনশীলতা পরিচিত আধুনিকতা নামে, তার অবসান ঘটেছে বা ঘটতে যাচ্ছে; এখন হিশেবে ক’রে দেখতে পারি কী ফসল ফলেছে গত সাড়ে ছ-দশকে। আমাদের সাংস্কৃতিক মান বেশ নিম্ন, এবং ক্রমশ আমরা এগিয়ে যাচ্ছি নিম্নতর সংস্কৃতির দিকে, তাই আধুনিক কবিতার সুফল ফ'লে যাওয়ার পরও আধুনিক কবিতাকে আমরা সাদরে গ্রহণ করতে পারি নি, বা উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারি নি আধুনিক বাঙলা কবিতার সংস্কৃতির। আমাদের রাজনীতি, শিক্ষা, অর্থনীতি, জীবনরীতি দায়ী এর জন্যে। আমাদের বিদ্যালয়গুলোর কথা ছেড়ে দিচ্ছি, বিদ্যালয়গুলোতে কোমলমতি বালকবালিকাদের নিকৃষ্ট গদ্য পড়ানোই রীতি; আমাদের মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও আধুনিক কবিতাবিরূপতা প্ৰকট; -ওখানে রঙ্গলাল, ঈশ্বরগুপ্ত, কায়কোবাদ, সৈয়দ এমদাদ আলি, বেগম রোকেয়া, বন্দে আলি মিয়া, সুফিয়া কামালকেও কবি ব’লে স্বীকার করা হয়, তাঁদের নিম্নপদ্য সংকলিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ী সংকলনে, পাঠ্যও হয়; কিন্তু আধুনিক কবিতা স্বাগত হয় না, অধিকাংশ আধুনিক কবি --অসংকলিত থাকেন, বা সংকলিত হন ধান্দাবাদী সমকালীন অকবিরা। আধুনিক কবিতা সংকলনের সম্পাদকেরাও পরিচয় দিয়ে থাকেন দ্বিধা আর ভীরুতার; অন্যাধুনিক প্রথাগত কবিতাও তাঁরা নেন। আধুনিক কবিতার সংগ্রহে, সৃষ্টি করেন বিভ্রান্তি; আধুনিক কবিতা যে একটি স্বতন্ত্র কবিতাধারা, তা বুঝতে দেন না পাঠকদের; যেমন বুদ্ধদেব বসুর সম্পাদিত আধুনিক বাংলা কবিতা (১৯৫৪), যেটি সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী সংকলন আধুনিক বাঙলা কবিতার। এটি আধুনিক কবিতাকে পৌঁছে দিয়েছে পাঠকদের কাছে, আবার কাজ করেছে আধুনিক কবিতার বিরুদ্ধেও। এটি শুরু হয়েছে রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে, যা এক বড়ো ভ্ৰান্তি; রবীন্দ্রনাথ মহৎ কবি সন্দেহ নেই, আর এতেও সন্দেহ নেই যে তিনি আধুনিক নন, রোম্যান্টিক; তাই স্থান পেতে পারেন না আধুনিক বাঙলা কবিতার সংগ্রহে। রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও এ-সংকলনে রয়েছেন প্রমথ চৌধুরী, অবনীন্দ্রনাথ, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, সুকুমার রায়, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, মোহিতলল মজুমদার, নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীনের মতো অনেকে, যাঁরা আধুনিক নন যদিও কবিতা লিখেছেন বিশশতকে;-সংকলনটিতে পাঠকেরা নানা রকম কবিতা পড়ার সুযোগ পেয়েছেন, কিন্তু আধুনিক কবিতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পান নি। এ-সংকলনের শুরুতে রবীন্দ্রনাথ ও নানা অনাধুনিকের উপস্থিতি আধুনিক কবিতাকে স্বাধীন স্বতন্ত্র ধারার কবিতারূপে প্রতিষ্ঠিত হ’তে দেয় নি; পাঠকেরা বুঝে উঠতে পারেন নি আধুনিক কবিতার মহিমা। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, সুধীন্দ্রনাথ, জসীমউদদীন যদি আধুনিক হন, একই সাথে, তাহলে আধুনিকতা হয়ে ওঠে হাস্যকর ব্যাপার, যদিও আধুনিক কবিতা এমন কোনো কৌতুককর খিচুড়ি নয়।
আধুনিক বাঙলা কবিতা এক আন্তর্জাতিক প্রপঞ্চের বঙ্গীয় রূপ, ওই প্ৰপঞ্চের নাম আধুনিকতা বা আধুনিকতাবাদ, যার উদ্ভব ঘটে পশ্চিমে, এবং ছড়িয়ে পড়ে সারা পৃথিবীতে। আমাদের ভাগ্য যে বাঙলা কবিতা ওই প্রপঞ্চের বাইরে থাকে নি, বরং থেকেছে অত্যন্ত ভেতরে, এবং সুফল ফলিয়েছে কবিতার। রোম্যান্টিক আন্দোলনের পর সবচেয়ে ব্যাপক ও সফল সাহিত্যশিল্পান্দােলন আধুনিকতা বা আধুনিকতাবাদ, যা গ্ৰহ জুড়ে সৃষ্টি করেছে অভিনব অসামান্য সাহিত্য ও শিল্পকলা; তার অবসান ঘটে গেছে দু-তিন দশক আগে, তবে রোম্যান্টিকতাকে যেমন আমরা সম্পূর্ণ মুছে ফেলতে পারি নি, তেমনি এখনো আমরা বাস করছি আধুনিক সাহিত্যের মধ্যেই। আধুনিকতাবাদ এক বহুমাত্রিক শিল্পসাহিত্যান্দোলন, যার বিকাশ ঘটেছে নানা রূপে, নানা রীতিতে।
পশ্চিমে আধুনিকতাবাদের কাল ব'লে অনেকে ধরেন ১৮৯০-১৯৩০ পর্বকে, অনেকে বিশশতকের প্রথম পাঁচশ বছরকে গণ্য করেন আধুনিকতাবাদের কাল ব’লে, আবার কেউ মনে করেন ১৯১০-১৯২৫ হচ্ছে এর স্বর্ণযুগ। আধুনিকতাবাদের চারিত্র হচ্ছে সাহিত্যসংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রথাগত রাষ্ট্রসীমা ভেঙে ফেলা, এর স্বভাব আন্তর্জাতিকতা। প্রত্যেক কালেরই থাকে নিজস্ব স্বভাব ও সংবেদনশীলতা, তখনই আমরা একটি ভিন্ন কালে পৌছি। যখন বদল ঘটে ওই স্বভাব ও সংবেদনশীলতার। এমন বদল নিয়মিত ঘ’টে চলছে সাহিত্য, শিল্পকলা, চিন্তার ইতিহাসে। কয়েক দশক পরপর-সাহিত্য, শিল্পকলা, চিন্তার এলাকায়-ঘটে সংবেদনশীলতার পরিবর্তন, আর আমরা এক শিল্প, সাহিত্য, চিন্তা থেকে পৌছি আরেক শিল্প, সাহিত্য, চিন্তায়। তবে এ-পরিবর্তনগুলো একই মাত্রার নয়, সংবেদনশীলতা বদলের তিনটি মাত্ৰা চোখে পড়ে। প্রত্যেক দশকে প্রত্যেক প্রজন্ম একধরনের বদল নিয়ে আসে সংবেদনশীলতার, নিয়ে আসে প্রজন্মের দশকি ফ্যাশন; তা প্রজন্মের সাথে আসে আর তারই সাথে চ'লে যায়, এক দশক তার আয়ু। এ-বদল কোনো মৌল বদল নয়। এর চেয়ে বড়ো মাত্রার বদল ঘটে কয়েক প্রজন্ম, সাধারণত এক শতাব্দী, ধ’রে, যাতে ঘটে সংবেদনশীলতা ও রীতির গভীরতর ও ব্যাপক বদল, যা স্থায়ী হয় দীর্ঘ কাল ধ’রে। এ-বদল বেশ বড়ো মাত্রার; এটা সংবেদনশীলতার শতকি পরিবর্তন। কখনো কখনো সংবেদনশীলতার ঘটে এর থেকেও অনেক বড়ো মাত্রার বদল, বিশাল বাদল, সহস্রকে দু-একবার; ঘটে সংস্কৃতির ভয়াবহ ভাঙাগড়া, যার ফলে মহৎ চিরস্থায়ী ব’লে গণ্য কীর্তিগুলোও হঠাৎ ধ’সে পড়ে, অতীত পরিণত হয় ধ্বংসস্তুপে, মহৎ সমাধিক্ষেত্রে। এমন বিশাল মাত্রার বদল এতোদিনের সভ্যতাসংস্কৃতি সম্বন্ধে প্রশ্ন তুলে ধরে, তাকে আর গ্রহণযোগ্য মনে করে না; তাকে বাদ দিয়ে নিজে সৃষ্টি করতে থাকে সম্পূর্ণ অভিনবকে, যা আগে কখনাে ভাবনায় আসে নি। আধুনিকতাবাদ এ-তৃতীয় মাত্রার বিশাল বদল ঘটায় সংবেদনশীলতার, সৃষ্টি করে এক অভিনব শিল্পকলা, যার মুখোমুখি অসহায় বোধ করে প্রথাভ্যস্ত শিল্পকলানুরাগীরা। আধুনিকতাবাদ শুধু অভিনবভাবে আসে নি, এসেছিলো বিপর্যয় সৃষ্টি ক’রেও। আধুনিকতাবাদের আগে, পশ্চিমে, শিল্পকলার জগতে বিপ্লব ঘটেছে প্রত্যেক শতকেই, বদলও ঘটেছে সংবেদনশীলতার, কিন্তু তা কোনাে বিপর্যয় সৃষ্টি করে নি, ওই বদল ঘটে স্বাভাবিকভাবে; আধুনিকতাবাদ আসে এক মহাবিপ্লবরূপে, যা আগের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে সম্পূর্ণরূপে। এর স্বভাব বিপর্যয়কর।
আধুনিকতাবাদী শিল্পসাহিত্য পূর্ববর্তী সাহিত্যশিল্পকলার ধারাবাহিক পরিণতি নয়, তা হঠাৎ সম্পর্ক ছিন্ন করে ঐতিহ্যের সাথে। আধুনিকতাবাদী শিল্পকলা খোলাখুলিভাবে বর্জন করে ইউরোপের পাঁচ শতাব্দীর উদ্যোগকে; তাই আধুনিকবাদ হচ্ছে পশ্চিমের ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো বিভাজনরেখা;-অন্ধকার যুগ ও মধ্যযুগের, আর মধ্যযুগ ও রেনেসাঁসের মধ্যে যে-পার্থক্য তার চেয়ে বেশি পার্থক্য আধুনিকতাবাদী ও তার পূর্ববর্তী যুগের। আর কোনাে যুগ এমন শিল্পকলা সৃষ্টি করে নি, যা ওই যুগে গণ্য হয়েছে ভয়ংকর বিহ্বলকরভাবে অভিনব ব’লে, যেমন ভয়ংকর বিহ্বলকরভাবে অভিনব শিল্পকলা সৃষ্টি হয়েছে আধুনিকতাবাদী পর্বে। প্রত্যেক কালই রচনা করে তার নতুন কবিতা, আধুনিক কবিতাও নতুন; তবে প্রত্যেক কালের নতুন কবিতার থেকে এ-কবিতার পার্থক্য হচ্ছে আধুনিক কবিতা নতুন মাত্রায় নতুন, অভিনবভাবে অভিনব । পশ্চিমে পূর্ববর্তী শিল্পকলা ও আধুনিক শিল্পকলার বিভাজন ঘটতে শুরু করে ১৮৫০-এর দিকে, যখন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে ধ্রুপদীরীতির লেখা। আগের শিল্পকলা ও আধুনিক শিল্পকলার মধ্যে যে ঘটে গেছে মহাবিভাজন, এতে কারো দ্বিমত নেই; তবে আধুনিক পরিস্থিতির প্রকৃতি, এবং শিল্পকলার স্বভাব ও আঙ্গিকের ওপর ওই পরিস্থিতির ফল সম্পর্কে দ্বিমত রয়েছে। আধুনিকতাবাদের চারিত্র সম্পর্কে বিভিন্ন মত থাকলেও নাম নিয়ে মতভেদ নেই, পশ্চিমে মডার্ন’ বা তার কোনো সাধিত রূপ দিয়ে এ-শিল্পকলাকে নির্দেশ করা হয়; পাওয়া যায় আধুনিক আন্দােলন, আধুনিক ঐতিহ্য, আধুনিক যুগ, আধুনিক শতাব্দী, আধুনিক মেজাজ, আধুনিকতাবাদ, বা শুধুই আধুনিক প্রভৃতি অভিধা। ইংরেজি “মডান” আর বাঙলা “আধুনিক” শব্দ দুটি আর্থগতিশীল, তা বিশেষ কোনো স্থির কাল নির্দেশ না ক’রে যে-কালই আসে, নির্দেশ করে তাকেই; ‘অধুনা’ থেকে গঠিত ‘আধুনিক’ বোঝায় ‘এখনকার, সাম্প্রতিক’, তবে ‘আধুনিকতাবাদ’ প্রত্যেক সাম্প্রতিক কালের বৈশিষ্ট্য নয়, বিশশতকের বিশেষ সময়ে যে-প্ৰপঞ্চ দেখা দিয়েছিলো, তাই আধুনিকতা বা আধুনিকতাবাদ। আধুনিকতা বা আধুনিকতাবাদ নাম নিয়ে দ্বিমত নেই; তবে আধুনিকতাবাদের কী, কেনো, কখন, কোথায় সম্পর্কে মতের শেষ নেই। অন্যান্য কালের স্বভাব রীতির এককতা, আর আধুনিকতার স্বভাব রীতির বৈচিত্র্য; তার কারণ আধুনিকতাবাদ একক আন্দােলন নয়, একরাশ আন্দােলনের-ইমপ্রেশনিজম, অভিব্যক্তিবাদ, কিউবিজম, ভবিষ্যদ্বাদ, প্রতীকবাদ, চিত্ৰকল্পবাদ, ভর্টিসিজম, দাদাবাদ, পরাবাস্তবতাবাদ ও আরো নানা শিল্পকলাবাদের-সমষ্টি । এ-সব বাদের মধ্যে মিল রয়েছে এখানে যে প্রতিটি আন্দোলনই বাস্তবতাবাদ ও রোম্যান্টিকতাবিরোধী, ও বিমূর্ত৷তামুখি; এ ছাড়া এগুলোর মধ্যে মিলের থেকে অমিল বেশি, এবং অনেকগুলো পরস্পরবিরোধী ।
শিল্পকলার ইতিহাসে আধুনিকতাবাদই আয়ত্ত করতে চেয়েছে সবচেয়ে উন্নত । নান্দনিক আত্মচেতনা, এটা করতে গিয়ে বাদ দিয়েছে অবিকল উপস্থাপনরীতি, যা সৃষ্টি করেছে বিপৰ্যয়। প্রথাগত সমস্ত শিল্পকলার লক্ষ্য অবিকল উপস্থাপন, বাস্তবের অনুকরণ; এমনকি রোম্যান্টিকেরা যদিও বাস্তবের অনুকরণ বাদ দিয়ে জ্ব’লে উঠতে চেয়েছিলেন দীপশিখার মতো, দর্পণের বদলে হ’তে চেয়েছিলেন প্ৰদীপ, তাঁরাও বেশি দূরে যান নি। আধুনিকতাবাদী শিল্পকলা জীবনের গভীরে প্রবেশ করার জন্যেই দূরে স’রে যায় বাস্তবতা ও মানবিক উপস্থাপনা থেকে, এগিয়ে যায় রীতি, কৌশল, ও স্থানিক রূপের দিকে। এতে ঘটে নান্দনিক পরিশীলন, ঘটে শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ; শিল্পকলা থেকে ক্রমিকভাবে বাদ দেয়া হয় মানবিক উপাদান। আধুনিকতাবাদের আগে আর এখনো অধিকাংশ সাহিত্যউপভোগী শিল্পের নামে উপভোগ করেন মানবিক উপাদান, তার প্ররোচনায় তাঁরা হাসেন কাঁদেন, শিল্পকলা উপভোগ করেন না। আধুনিকতাবাদ চেয়েছে মানবিক উপাদানের বদলে শিল্পকলা উপভোগ করাতে। “বিমানবিকীকরণ” সম্পর্কে ভুল ধারণা রয়েছে অনেকের, তাঁরা মনে করেন এর অর্থ ‘অমানবিক’; বিমানবিক অমানবিক নয়, বিমানবিক হচ্ছে মানবিক উপাদানের অভাব। আধুনিকতা আঙ্গিকের চরম বদল ঘটিয়ে তাকে কোলাহলের কাছাকাছি নিয়ে এসেছে কখনাে কখনাে; অর্থাৎ আধুনিকতাবাদ শিল্পকলার নতুন রীতিই শুধু নয়, রীতির মহৎ বিপর্যয়ও । এর পরীক্ষানিরীক্ষা শুধু পরিশীলন, দুরূহতা, অভিনবত্ব সৃষ্টি করে নি, সৃষ্টি করেছে। অন্ধকার, বিচ্ছিন্নতা, বিনষ্টি। শিল্পকলায় যে-সংস্কৃতিসংকট রোম্যান্টিকতার কাল থেকে চ’লে আসছিলো, তা চরম পরিণতি লাভ করে আধুনিকতাবাদে। তবে আধুনিকতাবাদ বিশশতকের শিল্পকলা, কেননা তা সাড়া দিয়েছে বিশশতকের কোলাহলের ডাকে। যে-সব আন্দোলনের সমষ্টি আধুনিকতাবাদ, সেগুলো আবির্ভূত হ’তে শুরু করেছিলো। উনিশশতকের মাঝভাগ থেকে, ফরাশিদেশে; ১৮৮০কে মনে করা হয় আধুনিকতার সূচনাকাল ব’লে, যখন দেখা দেন প্রথম আধুনিকেরা-মালার্মে, ভিলিয়ের দ্য লিজল-আঁদ, উ্যসম্য, লোত্রেআমেী, যাঁরা ঋণী ফ্লবেয়ার, গতিয়ে, বদলেয়ারের কাছে। এর পর দশকে দশকে দেখা দেন। আধুনিক কবি, ঔপন্যাসিক, সঙ্গীতস্রষ্টা, চিত্রকরেরা। পশ্চিমে এ-সময়, উনিশশতকের দ্বিতীয় ভাগে, ঈশ্বর একটা বাজে কথায় পরিণত, ধর্মীয় মূল্যবােধের বদলে সেখানে দরকার পড়ে নতুন মূল্যবােধ, আর ওই মূল্যবােধ সৃষ্টি করেছিলেন মহৎ আধুনিক লেখকেরা। তাঁরা শিল্পকলাকেই ক'রে তুলেছিলেন নতুন ধর্ম। ভলতেয়ার, ডারউইন নষ্ট ক’রে দিয়েছিলেন অনেক প্রথাগত বিশ্বাস, আর ফ্রয়েড আবিষ্কার করেন মনের রহস্যময় গভীরতা, যেখানে যুক্তি নিস্ক্রিয়, যেখানে রাজত্ব করে পুরাণ আর প্রতীক। সেখানে দার্শনিক বা বিজ্ঞানী সাহায্য করতে পারেন না, হয়তো পারেন। কবি আর ঔপন্যাসিক। তাঁরা সমালোচনা করেন বুর্জোয়া সমাজের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের; এবং সমাজ থেকে দূরে স’রে যান, এগিয়ে যান বিশুদ্ধ শিল্পকলার দিকে, কল্পনার ব্যক্তিগত ভুবনের দিকে, কেননা চারপাশের সমাজ তাঁদের মনে শুধু বমনের উদ্রেক করে। তাঁরা আশ্রয় নেন। কলাকৈবল্যবাদে, শিল্পের জন্যে শিল্পে, ঘেন্না করেন। প্রথাগত সামাজিক নৈতিক বিন্যাসকে, যার সাহায্যে বেঁচে আছে ঘৃণ্য সভ্যতা। তাঁরা শুরু থেকেই ছিলেন বিদ্রোহী, শ্ৰদ্ধেয় ছিলেন না, তাঁদের লেখা অর্জন করে কেলেঙ্কারির ও শিল্পকলার সাফল্য। শিল্পকলাবাদী বাস্তবতাবিমুখ বিচিত্র আন্দোলন, যেগুলোর নাম আগেই উল্লেখ করেছি, একটা সমন্বিত রূপ নেয়। ১৯১০ থেকে ১৯২৫ অব্দের মধ্যে, এবং এ-সময়টাকে মনে করা হয় আধুনিকতাবাদের শ্ৰেষ্ঠ সময়। এ-সময়ে বিশশতক দগ্ধ হয় অপব্যয়ী অক্লান্ত আগুনে, প্রথম মহাযুদ্ধে, মেতে ওঠে রক্তপাতে; যুদ্ধের পর অসীম অবিশ্বাস আর হতাশা থেকে জন্ম নেয় বিশশতকের অসামান্য শিল্পকলা, যার মধ্যে আধুনিক কবিতা প্রধানতম। আধুনিকতার নিজের বছর ব’লে চিহ্নিত করা হয় ১৯২২কে, যে-বছর বেরোয় এলিঅটের পোড়োজামি, রিলকের অফিফুসের প্রতি সনেটগুচ্ছ, জয়েসের ইউলিসিস, লরেন্সের অ্যারন্স রড প্রভৃতি।
বাঙলায় ১৯২৫ আধুনিকতাবাদের সূচনাবছর; আর কয়েক বছর পরই বেরোয় পরিপূর্ণ আধুনিক চেতনাসম্পন্ন কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ : বুদ্ধদেব বসুর বন্দীর বন্দন (১৯৩০), বিষ্ণু দের উর্বশী ও আর্টেমিস (১৯৩৩), সুধীন্দ্রনাথ দত্তের অর্কেস্ট্রা (১৯৩৫), জীবনানন্দ দাশের ধূসর পাণ্ডুলিপি (১৯৩৬), অমিয় চক্রবর্তীর খসড়া (১৯৩৮)। বাঙলা কবিতায় রোম্যান্টিকতা দেখা দিতে লেগেছিলো প্রায়-একশতক, কিন্তু আধুনিকতাবাদ দেখা দেয় পশ্চিমের সাথে একই দশকে, প্রায়-অবিলম্বে। আধুনিকতাবাদের জন্যে পশ্চিমে আধশতক ধ’রে যে-প্ৰস্তৃতি চলেছিলো, বাঙলায় তেমন কোনাে প্রস্তুতি চলে নি; তাই বাঙলার আধুনিকতাবাদ পশ্চিমের থেকেও বেশি আকস্মিক ও বিপর্যয়কর। বাঙলার নিজস্ব পরিস্থিতির জন্যেই আমাদের প্রথম আধুনিকেরা প্রথম কাব্যে চলেন প্রথাগত পথে, ওইটুকুই তাঁদের প্রস্তুতিপর্ব; দ্বিতীয় কাব্যেই তাঁরা প্রথা বর্জন ক’রে সৃষ্টি করেন বিস্ময়কর কবিতা। বিশের দশকে বাঙলা ভাষায় সূচনা ঘটে আধুনিক কবিতার, তিরিশের দশকে ফলে ওই কবিতার অতুলনীয় শস্য। পশ্চিমে আধুনিকতাবাদ যেমন সৃষ্টি করে অভিনব শিল্পকলা, অভিনবত্ব সঞ্চার করে শিল্পকলার সমস্ত শাখায়, বাঙলায় তা ঘটে নি; ঘটেছে প্রধানত বা একলা আধুনিক কবিতায়;-আমাদের কবিরাই শুধু আয়ত্ত করতে পেরেছেন নতুন সংবেদনশীলতা, সৃষ্টি করতে পেরেছেন নতুন শিল্পকলা। জীবনানন্দ বা সুধীন্দ্রনাথের পাশে তারাশঙ্কর বা বিভূতিভূষণ বেদনাদায়কভাবে প্রথাগত; আর আধুনিক কবিরাও যখন উপন্যাস লিখেছেন, তখন তাঁরাও থেকেছেন প্রথাগত। পশ্চিমের মতো বাঙলা আধুনিক কবিতাও ভয়ংকর বদল ঘটায় সংবেদনশীলতার; এ-কবিতা রাবীন্দ্ৰিক কবিতার স্বাভাবিক পরিণতি তো নয়ই, বরং এতো ভিন্ন যে আজো এ-কবিতার অভিঘাত আমরা কাটিয়ে উঠতে পারি নি; তাই আজো আধুনিক কবিতা এড়িয়ে প্রথাগত কবিতায়ই আমরা স্বস্তি খুজি। আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, ও জীবন যেহেতু প্রথাগত, মধ্যযুগীয়, তাই রোম্যান্টিক ও প্রথাগত কবিতার মহিমায়ই আমরা আজো মুগ্ধ হয়ে আছি। একটি মধ্যযুগীয় সংস্কৃতিতে আধুনিকতাবাদের বিকাশ এক বড়ো বিপর্যয় সন্দেহ নেই। প্রথাবাদী এ—অঞ্চলে আধুনিক কবিতায়ই প্রথম দেখি প্ৰথা থেকে স’রে আসা, অতীতের সাথে সম্পর্কছেদ, অসম্ভব এক শিল্পসৃষ্টির অভিলাষ। আধুনিক বাঙলা কবিতা বাঙালির সংবেদনশীলতা বদলে দিতে চেয়েছে; তবে বাঙালি বদলায় নি, এমন অচল গোত্রকে শিল্পকলার সাহায্যে বদলানাে অসম্ভব। আধুনিকতাপূর্ব বাঙলা কবিতা সরল আবেগের কবিতা, কৈশোর বা প্রথম যৌবনের আবেগ, স্বপ্ন, কাতরতাই বিষয় প্রথাগত বাঙলা কবিতার; আর ওই কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে যে,-অভিজ্ঞতা, তা সর্বজনীন অভিজ্ঞতা, তা শুধু কবির নয়, পাঠকেরও অভিজ্ঞতা। আধুনিক বাঙলা কবিতা সর্বজনীন সাধারণ অভিজ্ঞতার বদলে প্রকাশ করে কবির অনন্য ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, যা অধিকাংশ সময়ই মানসিক; আর আধুনিক কবিরা তা প্রকাশ করেছেন অভিনব ভাষায় ও অলঙ্কারে।
বিশের দশকে সূচনা ঘটে যে-কবিতার, আর ষাটের দশকে ঘটে যে-ধারার কবিদের শেষ উন্মেষ, সে-কবিতা অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এ—ধারার প্রথম পাঁচজনই-জীবনানন্দ দাশ, অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে-এ-ধারার শ্রেষ্ঠ কবি; এর পর গুরুত্বপূর্ণ বহু কবি জন্ম নিয়েছেন, কিন্তু প্রথম পাঁচজনের স্তর আয়ত্ত করতে পারেন নি। আমাদের প্রথম আধুনিকেরাই আধুনিকতম; তাঁদের উপলব্ধি, স্বপ্ন, মানস অভিজ্ঞতা যেমন ব্যাপক ছিলো, তেমনি তাঁরা নিয়ন্ত্রণ করেছেন বাঙলা ভাষাকে, তাঁরা গোত্রের ভাষাকে পরিস্রুত ক’রে গেছেন। তাঁদের বাদ দিয়ে অন্যদের বিচার করলে এখন চোখে পড়ে বহু ভুল মূল্যায়ন: একদা যাঁদের বড়ো ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছিলো, তাঁদের অনেককে আজ মনে হয় খুব গৌণ। যেমন প্রেমেন্দ্র মিত্রের ছিলো বড়ো কবির ভাবমূর্তি, আজ তাঁর সমগ্র কবিতা ঘেটে দু-তিনটির বেশি কবিতা পাই না, তাও সম্পূর্ণ আধুনিক নয়; বা সমর সেন, যাঁকে নিয়ে মত্ততা গেছে এক সময়, তাঁকেও মনে হয় খুব গৌণ। চল্লিশের দশকটা গৌণ কবিদের দশক; ভালো কবিরা আবার দেখা দেন পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে। বাঙলাদেশে, স্পষ্ট ক’রে বলি, বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে আধুনিক চেতনা দেখা দিতে সময় লেগেছিলো, তার কারণ বাঙালি মুসলমান অনেক পিছিয়ে ছিলো সামাজিকভাবে। আধুনিক চেতনার জন্যে যে-শিক্ষা ও সামাজিক অবস্থান ছিলো অপরিহার্য, তা বাঙালি মুসলমান পায় নি পঞ্চাশের দশকের আগে; এর আগে বাঙালি মুসলমানের কাব্যচর্চা ছিলো স্বল্পশিক্ষিতের স্বভাবকবিত্বের সাধনা। বাঙালি মুসলমান পেয়েছিলো এক বড়ো প্রথাগত পদ্যকার নজরুল ইসলামকে, যাঁকে নিয়ে আজো তাঁরা অন্ধ হয়ে আছে, এবং বাঙালি মুসলমান কবি যশোপ্রার্থীরা মনে করেছিলেন নজরুলকে নকল করলেই কবি হওয়া যাবে। চল্লিশের দশকে তাঁদের গ্রাস করে রুগ্ন পাকিস্থানবাদ, শোচনীয় পদ্যে তাঁরা ভ’রে তোলেন পাকিস্থান। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে বাঙলা ভাষার দু-অঞ্চলে ঘটে দু-রকম ঘটনা : পূর্বাঞ্চলে প্রথমবারের মতো দেখা দেয় ব্যাপক আধুনিকতা, যা প্রধানত বিকশিত হয় বাহ্যজীবন আশ্রয় ক’রে, আর পশ্চিমাঞ্চলে বাহ্যজীবনকে উপেক্ষা ক’রে কবিরা চর্চা করতে থাকেন ব্যক্তিতা ও অন্তর্জগতের, যা তাঁদের পৌঁছে দেয় প্রায়-পাগলামোর পর্যায়ে। ওখানকার পঞ্চাশ-ষাটের কবিদের রচনায় চোখে পড়ে বিভিন্ন মাত্রার উন্মত্ততা; উন্মত্ততা কখনো কখনো কবিতা হ’তে পারে, তবে কবিতা উন্মত্ততা নয়। পশ্চিম বাঙলার কবিতায় বানানো উন্মত্ততাও চোখের আড়ালে থাকে না, যাতে ঝিলিকের অভাব থাকলেও রয়েছে প্ৰলাপপ্রাচুর্য। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে বাঙলা কবিতার উৎকৃষ্টতর অংশ রচিত হয় বাঙলাদেশে, যা বাহ্য ও আন্তর অভিজ্ঞতার গুরুত্বপূর্ণ উৎসারণ।
এ-সংকলনের উদ্দেশ্য প্রথাগত কবিতা থেকে আধুনিক কবিতা, এবং অকবিতা থেকে উৎকৃষ্ট কবিতা শনাক্ত করা। আধুনিক বাঙলা কবিতার প্রতিটি সংকলন দুটি ক্রটি বহন ক’রে থাকে; বুদ্ধদেব বসুর সংকলনটির মতো মিশ্রণ ঘটায় আধুনিক ও প্রথাগত কবিতার, বা এমন অনেকের কবিতা সংকলন করে, যাঁরা কবি নন। এটি আধুনিক এবং শুধুই আধুনিক কবিতার সংকলন, এবং এটি আধুনিক বাঙলা কবিতার ইতিহাস নয়, সমালোচনা। বিশ থেকে ষাট দশকের কবিদের বিপুল পরিমাণ কবিতা আবার আমি আনন্দের সাথে পড়েছি, পীড়িতও বোধ করেছি। বহু বিখ্যাত ও অখ্যাতর লেখা অকবিতা প’ড়ে; সংকলন করেছি। শুধু তাঁদেরই কবিতা, আমার বিবেচনায় যাঁরা কবি, এবং সংকলন করতে চেষ্টা করেছি। প্রত্যেকের শ্রেষ্ঠ কবিতাটি বা কবিতাগুচ্ছ। কবিদের মান অনুসারে নিয়েছে বেশি বা কম কবিতা; সবচেয়ে বেশি সংখ্যক কবিতা নিয়েছি জীবনানন্দ দাশের, আর যিনি সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পৃষ্ঠা দখল করেছেন তিনি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। পাঁচ মহৎ আধুনিকের আরো বেশি কবিতা নিতে পারলে আমি তৃপ্তি পেতাম, কিন্তু বইয়ের আকৃতির ভয়ে তাঁদের আরো কবিতা নিই নি। তাঁরা ছাড়া অন্য প্রায়-প্রত্যেক কবি সম্পর্কেই আমি প্রচারিত ধারণা থেকে ভিন্ন ধারণা পোষণ করি; তাই বড়ো ভাবমূৰ্তিসম্পন্ন অনেকেই এ-সংকলনে ক্ষুদ্র আকার ধারণ করেছেন। যেমন প্রেমেন্দ্র মিত্র, বা অচিন্ত্যকুমার খুব গৌণ হয়ে উঠেছেন, তাঁদের কবিতা নাও নেয়া যেতো; বুদ্ধদেব বসু যেখানে সমর সেনের কবিতা নিয়েছেন তেরোটি, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের থেকে পটটি বেশি, সেখানে আমি সমর সেনের নিয়েছি পাঁচটি কবিতা, এবং তাঁর থেকে বেশি কবিতা নিয়েছি অনেকের। পশ্চিম বাঙলার অতিপ্রচারিত পঞ্চাশ-ষাটের কবিদের কবিতাও এ-কারণেই কম নিয়েছি। প্রকৃত কবি এমন কাউকেই বাদ দিতে চাই নি, তবে পশ্চিম বাঙলার কেউ কেউ, তাঁদের কাব্যগ্রন্থের দুষ্প্রাপ্যতার জন্যে, বাদ প’ড়ে থাকতে পারেন; বাঙলাদেশের কবিদের বেলা এমন ঘটে নি। এখানে সক্রিয় অজস্র কবিযশোপ্ৰার্থীর মধ্যে তাঁদেরই নিয়েছি, যাঁরা কবি; তবে কয়েকজনকে নিই নি, সেটা আমাদের সময়ের শোচনীয় দুর্ভাগ্য-সৈয়দ আলী আহসান, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দীন, ও আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতা নিই নি, আমি নিতে পারি না, কেননা তাঁরা সামরিক একনায়কত্ব ও মৌলবাদে দীক্ষা গ্ৰহণ ক’রে মানুষ ও কবিতা ও আধুনিকতার বিপক্ষে চ’লে গেছেন। এ-সংকলনটিকে আমি ভবিষ্যতের জন্যে রেখে যেতে চাই, এক শতক পর আমার মতো কেউ এটি বিচার করবেন। আধুনিক কবি ও কবিতা শনাক্তিতে আমি কতোটা ব্যর্থ হয়েছি।
২৭ অগ্রহায়ণ ১৪০০, ১১ ডিসেম্বর ১৯৯৩
১৪ই ফুলার রোড, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকা ঢাকা, বাঙলাদেশ
হুমায়ুন আজাদ