Ticker

6/recent/ticker-posts

প্রথম শহিদ মিনার ও পিয়ারু সরদার

প্রথম শহিদ মিনার ও পিয়ারু সরদার
প্রথম শহিদ মিনার ও পিয়ারু সরদার
সম্পাদনাঃ আনিসুজ্জামান
বাংলা একাডেমি।

পিয়ারু সরদার না থাকলে আমাদের রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের প্রথম শহিদ মিনার গড়ে উঠত না। সে-মিনার অবশ্য আজ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে নেই, কেননা গড়ে-ওঠার পরই প্রতিক্রিয়ার শক্তি পাশবিকতার পরিচয় দিয়ে সে-মিনার চূর্ণ করে দিয়েছিল। তবে এদেশের মানুষের মনে সে-মিনার আজো অজার-অমর-অক্ষয় হয়ে আছে। যে-শহিদ মিনারে আজ আমরা পুষ্পের অর্ঘ্য নিবেদন করি, সে-মিনারও ধরে রেখেছে প্ৰথম শহিদ মিনারের স্মৃতি। ফুল দিয়ে অশ্রু দিয়ে ভালোবাসা দিয়ে তৈরি শহিদ মিনার, ইট বালি-সিমেন্ট দিয়ে তৈরি তো অবশ্যই সেসব উপকরণ এসেছিল পিয়ারু সরদারেরই কাছ থেকে আর শ্রদ্ধার উপটৌকন উৎসারিত হয়েছিল অগণিত মানুষের হৃদয় থেকে।
১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের অনেক অংশগ্রহণকারী একযোগে পিয়ারু সরদার সম্পর্কে এই বইটিতে লিখেছেন। তা থেকে সে-সময়কার একটি ছবি আজকের পাঠক খুঁজে পাবেন এবং জানবেন, একটা মুহূর্ত কীভাবে একজন ব্যক্তির জীবনকে পরিবর্তিত করে দেয় এবং পরিণামে জাতির জীবনে কত মূল্যবান হয়ে ওঠে।

বইটি থেকে বদরুদ্দীন উমর সাহেবের লেখাটি তুলে দেওয়া হলো।

ভাষা-আন্দোলন ও পিয়ারু সরদার
বদরুদ্দীন উমর
ভাষা-আন্দোলনের সঙ্গে সঠিক পরিচয় ও সে-বিষয়ে সঠিক ধারণা খুব অল্প মানুষের মধ্যেই দেখা যায়, যদিও নানা ঘটনা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেন এবং এ নিয়ে উচ্ছাস ও আবেগ প্রকাশ এক সাধারণ ব্যাপার। প্রথমদিকে প্রায় সকলেই মনে করত, ভাষা-আন্দোলন শুধু ছাত্র ও কিছু শিক্ষিত লোকের আন্দোলন। এখনও অধিকাংশ লোকের ধারণা তাই। ১৯৪৭-৪৮ সালে ভাষা-আন্দোলন মুষ্টিমেয় ছাত্র, শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীর দ্বারা শুরু হলেও ১৯৪৮ সালে এতে সাধারণ মানুষ ও রেল শ্রমিকদের কিছু অংশগ্রহণ ছিল। তবে ওই প্রাথমিক পর্যায়ে ঢাকার স্থানীয় জনগণের বিশেষ কোনো সমর্থন ভাষা-আন্দোলনের প্রতি ছিল না। উপরন্তু তার প্রতি তাদের ছিল এক ধরনের বিরূপ মনোভাব। তাঁরা তখন মুসলিম লীগের রাজনীতির দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। এ জন্য ১৯৪৮ সালের ভাষা-আন্দোলনের সময় ছাত্ররা সাধারণভাবে নবাবপুর রেল ক্রসিংয়ের ওপারে যেতেন না। স্থানীয় লোকদের দ্বারা আন্দোলনকারী ছাত্রদের লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনাও কিছু কিছু ঘটেছিল। এর কারণ পাকিস্তান আন্দোলনের সময় মুসলিম লীগ মুসলমানদের রাষ্ট্র পাকিস্তান সম্পর্কে যে ব্যাপক প্রচারণা করেছিল তার প্রভাব তখনও পর্যন্ত সারা পূর্ব পাকিস্তানে ছিল। পুরাণ ঢাকার জনগনও সেই প্রচারণার দ্বারা
তখনও পর্যন্ত মোহগ্ৰস্ত ছিলেন। তারা মনে করতেন, ভাষার দাবি পাকিস্তান ও মুসলমানদের স্বার্থবিরোধী। এদিক দিয়ে ১৯৪৮ এবং ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলনের আকাশ-পাতাল পার্থক্য। আন্দোলনের এই দ্বিতীয় পর্যায়ে তা পরিণত হয়েছিল এক বিরাট গণঅভু্যখানে। সেই পরিস্থিতিতে পুরান ঢাকার জনগণের মধ্যে ভাষাআন্দােলনের প্রতি কোনাে বিরূপতা তো ছিলই না, উপরন্তু ব্যাপকভাবে তাঁরা সে আন্দোলনে এগিয়ে এসেছিলেন ও সাহায্য করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ করলে এ বিষয়ে ধারণা পরিষ্কার হবে। ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণের পর ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ বাস রুটসহ অন্যান্য রুটে পরিবহন শ্রমিকরা ধর্মঘট করেন। সেই অবস্থায় ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কোরেশী ২৩শে ফেব্রুয়ারি জেলা আদালত ভবনে অবস্থিত তাঁর অফিসে ঢাকার পরিবহন মালিকদের এক বৈঠক আহবান করেন। ওই বৈঠকে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত থাকেন এন এ লস্কর, আবদুল আওয়াল ভূইয়া ও মতি সরদার। বৈঠকের সময় ম্যাজিস্ট্রেট কোরেশী রাস্তায় বাস-ট্যাক্সি চালু করে ধর্মঘটের অবসান ঘটাতে নির্দেশ দেন। সেটা না করলে তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার হুমকিও তিনি দেন। কিন্তু পরিবহন মালিকরা তার নির্দেশ মতো বাস-ট্যাক্সি চালু করতে রাজি না থাকায় তাঁরা পরস্পরের প্রতি মুখ চাওয়াচাওয়ি করছিলেন। এভাবে কিছুক্ষণ থাকার পর অবশেষে মতি সরদার তার স্থানীয় ভাষায় বলেন, “এতদিন তো আমরা জবানের লড়াইয়ের মধ্যে আছিলাম না। কিন্তু এহন যাহন দেশেই আমরা বিদেশি হইছি তহন কী আর করা।” কোরেশী বাংলা জানতেন। এ কথা শুনে তিনি রাগান্বিতভাবে মতি সরদারকে জিজ্ঞেস করেন, “দেশে বিদেশি হইছি। এ কথার মানে কী” এর জবাবে মতি সরদার বলেন, “আপনিই বুইঝা দেহেন।” ঢাকায় আগের দুতিন দিনের ঘটনাবলি দেখে তাঁর ধারণা জন্মেছিল যে, পাঞ্জাবিরাই সবকিছু অঘটনের জন্য দায়ী। কোরোশীর কথায় তারা বাস-ট্যাক্সি ধর্মঘট প্রত্যাহার করতে রাজি হননি (বদরুদ্দীন উমর : পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি। তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ২৯৭-৯৮ । সুবর্ণ)।
১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলন জনগণের ওপর ব্যাপক ও গভীর প্রভাব বিস্তার করে। তাদের আলোড়িত করার কারণ নিহিত ছিল ১৯৪৭-৪৮ সাল থেকে মুসলিম লীগ সরকার জনগণের ওপর যে শোষণ-নির্যাতন চালিয়েছিল তার মধ্যে পাকিস্তান আন্দোলনের সময় মুসলিম লীগ জনগণকে যে স্বপ্ন দেখিয়েছিল সে স্বপ্ন তাদের ভঙ্গ হয়েছিল অল্পদিনের মধ্যে । মতি সরদার ম্যাজিস্ট্রেট কোরেশীকে নিজ দেশে পরিবাসী হয়ে থাকার যে কথা বলেছিলেন তার মধ্যে এই স্বপ্নভঙ্গের কথাই ছিল। ১৯৪৭ সাল থেকে দেশের পরিস্থিতির মধ্যে এই পরিবর্তন যদি না ঘটত, তাহলে ১৯৪৮ এবং ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলনের মধ্যে যে পার্থক্য দাঁড়িয়েছিল সেটা দেখা যেত না। মুসলিম লীগের দ্বারা প্রতারিত হওয়ার প্রতিশোধাই জনগণ ১৯৫২ সালের ভাষাআন্দোলনের সময় ও পরে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের সময় নিয়েছিলেন।
১৯৫২ সালে পিয়ারু সরদার যেভাবে ভাষা-আন্দোলনের সময় সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলেন, যেভাবে তিনি অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে আন্দোলনকারী ছাত্রদের ওপর আস্থা রেখেছিলেন, তার তাৎপৰ্য বোঝার জন্য ১৯৪৭-৪৮ থেকে ১৯৫২ সালের মধ্যে মুসলিমলীগ শাসন জনগনের জীবন যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল, তাদের স্বপ্নের জগৎকে বিধ্বস্ত করেছিল, সেদিকে তাকানো দরকার। সেটা না করে যদি একজন পিয়ারু সরদার কর্তৃক শহিদ মিনার নির্মাণের সময় শুধু সিমেন্ট, বালু, ইট দেওয়ার কথা বলা হয়, তাহলে এর দ্বারা শুধু তার বদ্যান্যতাই বোঝাবে। সেই বদ্যান্যতার পেছনে তাঁর মতো মানুষদের চিন্তাক্ষেত্রে যে পরিবর্তন ঘটেছিল তার হিসাব বা হদিস পাওয়া যাবে না।
পিয়ারু সরদার তাঁর পিতা মনু সরদারের মৃত্যুর পর তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। সেই হিসেবে তিনি ছিলেন ঢাকার ২২ পঞ্চায়েত প্রধানের একজন। তিনি ঠিকাদারি ব্যবসা করতেন এবং ১৯৫২ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ সম্প্রসারণ কাজের ঠিকাদার ছিলেন। সে কারণে সে সময় তিনি মেডিকেল কলেজ হােস্টেল এলাকায় প্রচুর ইট, বালু ইত্যাদি এনে রেখেছিলেন। তাঁর অস্থায়ী গুদাম-ঘরে ছিল সিমেন্ট। ২১শে ফেব্রুয়ারি গুলির পর শহিদদের স্মৃতি রক্ষার জন্য মেডিকেল কলেজ কম্পাউন্ডেই একটি শহিদ মিনার নির্মাণ কাজের জন্য প্রয়োজন ছিল ইট, বালু, রড, সিমেন্ট ইত্যাদি। পিয়ারু সরদার তার ঠিকাদারি কাজের জন্য যে ইট, বালু এনে রেখেছিলেন, সেগুলো খোলা জায়গাতেই ছিল। কিন্তু সিমেন্ট ছিল গুদামে তালাবদ্ধ। সিমেন্ট ছাড়া কোনো কাজ হওয়ার উপায় ছিল না। কাজেই গুদামে রাখা সিমেন্টের জন্য এবং সেই সঙ্গে ইট, বালু ইত্যাদি ব্যবহারের জন্য ছাত্ররা পিয়ারু সরদারের সঙ্গে দেখা করে তার সাহায্য চান। তিনি ছিলেন বকশীবাজার, উর্দু রোড, হােসেনী দালান এলাকার সরদার। তার বাসা এবং অফিস ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী এলাকা হোসেনী দালানে। ছাত্ররা তার কাছে সিমেন্টের জন্য অনুরোধ করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাদের হাতে গুদামের চাবি দিয়ে বলেন, সিমেন্টসহ সবকিছু প্রয়োজনমতো ব্যবহার করতে এবং কাজ হলে চাবি তাকে ফেরত দিতে। জিনিসপত্র খোয়া যাওয়া থেকে নিয়ে সরকারের রোষানলে পড়ার আশংকার কোনো হিসেব না করেই তিনি ‘শহিদ মিনার’ নির্মাণের জন্য হাত বাড়িয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে শহিদ মিনার একাধিকবার ভাংচুর হলেও ২৩শে ফেব্রুয়ারি নির্মিত সেই শহিদ মিনারই ছিল শহিদদের স্মৃতি জাগরূক রাখার প্রথম প্ৰয়াস। পিয়ারু সরদারের সাহায্য ছাড়া তা নির্মাণ করা সম্ভব ছিল না।
ঢাকার জনগণ, বিশেষত পুরান ঢাকার জনগণ যেভাবে ভাষা-আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। জনগণের মনে মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে যে প্রতিক্রিয়া তাদের ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত কাৰ্যকলাপের বিরুদ্ধে হয়েছিল পুরাণ ঢাকার জনগনের ও তাদের প্রতিনিধিদের প্রতিক্রিয়া ছিল তারই ব্যারোমিটার। প্রত্যেক বছর ফেব্রুয়ারি মাস ও একুশে ফেব্রুয়ারি এলে নিজের কীর্তিকলাপ নিয়ে স্মৃতিচারণের নামে টেড়ি পেটাবার লোকের অভাব হয় না। তিলকে তাল করতে তাদের কোনো বিবেক দংশন হয় না। কিন্তু পুরান ঢাকার বাসিন্দারা যেভাবে ব্যাপক আকারে ভাষা-আন্দোলনের পক্ষে দাড়িয়েছিলেন ও সাহায্য করেছিলেন তার উল্লেখ ও স্বীকৃতি তাদের মধ্যে বিশেষ দেখা যায় না।

ভাষাসংগ্ৰামী