Ticker

6/recent/ticker-posts

পথের কবি - কিশলয় ঠাকুর

amarboi
পথের কবি
কিশলয় ঠাকুর

এই বই নিয়ে
ভূমিকা ? যদি হয়, তবে এটা একটা অদ্ভূত ভূমিকা। এমন ভূমিকা, যার ভূমিই নেই। না থাক, তবু দৃশ্য আছে, রৌদ্র, রূপ, গন্ধ, রস— সব আছে। বইয়ের নাম “পথের কবি” । কবির নাম বিভূতিভূষণ ।
“পথের কবি”—এই কথাটা শব্দ দিয়ে কাছাকাছিই যিনি গাঁথেন (যিনি কবি তিনিই তো সাথী, এই অর্থে), সেই রবীন্দ্ৰনাথ নিজেকে কিন্তু এই নামটা কখনও দেননি। বরং তাঁকে বারংবার নমস্কার জানিয়েছেন । আজ হঠাৎ মনে হল, সেই কবি বিভূতিভূষণও তো হতে পারেন। রবীন্দ্রনাথ কোনও স্ৰষ্টাকে নিশ্চয় প্ৰণতি জানিয়েছেন, তবু যিনি আসেননি, অথচ ধ্রুব আসবেন, তাঁর প্রতি তাঁর নমস্কার কখন যেন তাঁরই অজানিতে সবে যিনি এলেন, তাঁরই প্ৰতি নিবেদিত হয়ে গেছে ।
না হয়ে উপায় ছিল না । মহৎ মহৎকেই চিহ্ন দেখে চিনে নেয় । অতএব তাঁর জীবনের ক্লান্ত ঘণ্টায় যে পাঁচালীকার এলেন, তাঁকে সুস্বাগত না জানিয়ে পিতৃপ্রতিম কবির উপায় ছিল না। কারণ নিজে সমস্ত জীবন ধরে ভাঙা পথের রাঙা ধুলো যে অবিরত উড়িয়েছেন ! স্থিত থেকেও অস্থিত। শুধু গান “নিশীথে কী কয়ে গেল মনে” ? কে কাকে কী বলে যায় ? “বলে মোরে, চলো দূরে” ।
এই চলো-চলো-চলো চলে যাই সত্যের ছন্দে, কিংবা চরৈবেতি মন্ত্রটি তাঁর নিজের জীবনে যেমন, বিভূতিভূষণের রচনা এবং পথ-পরিক্রমার মধ্যে অবশ্যই আভাসিত হয়েছে, তিনি দেখে থাকবেন । আজ এই কথা স্পষ্ট করে বলার সময় এসেছে যে, রবীন্দ্রনাথের সগোত্র, তাঁরই ধারার অনুসারী আর একটি লেখকের কথা যদি লিখিত হয়, তবে একমাত্র নামটি বিভূতিভূষণ ।
কোথায় যেন মিল । এই প্রাত্যহিকতার ধূলিমলিন জীবনের বাইরে, অনেক উপরে শিল্পকে স্থাপন করার কীর্তি (কয়েকজন কবিকে বাদ দিলে) খালি বিভূতিবাবুর। এখানে তিনি তাঁর পূর্বসূরীর সঙ্গী, এখানে রবীন্দ্রনাথ আর বিভূতিভূষণ পাশাপাশি ।
হয়তো পরবর্তী বলেই গল্পগুচ্ছের, ছিন্নপত্রের আর চৈতালির কবি যতদূর গিয়েছিলেন, বিভূতিভূষণ তার চেয়েও অনেক দূর এগিয়ে গেলেন। শিলাইদহ, পতিসর, সাজাদপুর এবং যশোর চব্বিশ পরগনা নদীয়ার মধ্যে ভৌগোলিক দূরত্ব সামান্যই। ভূ-প্রকৃতিও এক । আর মানুষ ? তাদের কষ্ট, তাদের দারিদ্র্য, এক— এক— এক। সেই মানুষদেরও হাজির করেছেন বিভূতিভূষণ । অনাহার চিরকালের শিল্পের আহার বা আহরণ হয়ে গেছে। প্রেম, অপ্ৰেম, সবই । দুজনেই যা সুন্দর, যা শোভমান, তাকে খুব উপরে, সব ছাপিয়ে জায়গা দিতেন। সেই জন্যে দুঃখের একটা মেঘে-ছাওয়া আকাশ চােখে পড়ে। তবে তার বিকৃত বীভৎস আকার তেমন আবির্ভূত হয় না। অথচ তাদের বোঝা যায়, ছোঁয়া যায়। কিন্তু উত্তরণ ? সেটা পূর্বসূরীর মতো উত্তরসূরী বিভূতিভূষণেরও নিজস্ব ।
কিন্তু ওই যে বলেছিলাম না, তিনি এগিয়ে গেছেন ? যেভাবে একটা মশাল থেকে আর একটা মশাল জ্বলিয়ে কেউ অগ্রসর হয়— এ! সেই অগ্ৰগামিতা । উৎসের স্রোতকে সমতলের ধারাতে শুধু অব্যাহত রাখা নয়, যেন আরও বিস্তীর্ণ আরও উদার করে দেওয়া ।
বিভূতিভূষণ নইলে আমরা কালকাসুন্দি, ঘেটু, পুই, মুথা ঘাস, কাশ, শরবন, শালুক, শ্যাওলা, ডুমুর, চালতা, গোলঞ্চ, হেলেঞ্চা, কলমি প্রভৃতির সবুজে যে এত রঙ, এত মনোরম সুবাস, তা কোনও দিন জানতে পেতাম কি ? মহাকবি তো “নাম-না-জানা তৃণকুসুম” বলেই ক্ষান্তি দেন। তাদের নামে নামে চিহ্নিত করলেন বিভূতিবাবু। রঙ আর গন্ধকে শব্দে শব্দে, বর্ণে বর্ণে চোখের সমুখে উপস্থিত করলেন । সেই শব্দ রূপবান হল । তারা অকাতর বাসও বিলোতে থাকিল । শব্দেরও যে ঘ্রাণ আছে, আমরা জানলাম, পেলাম, বুক ভরে নিলাম ।
আর অরণ্য ? বিভূতিভূষণের অরণ্য কোনও শৌখিন সাফারির আলতো ভালো লাগা নয়। এই নীল অরণ্য দূর হতে শিহরে না। একেবারে কাছে আসে, তার পত্রপ্রচ্ছায়, তার ভয়ংকর সত্তা দিয়ে আমাদের আবৃত করে, আমাদের মধ্যে মিশে যায় । তাঁর বন বড়ো ঘন, বড়ো ভীষণ এবং বড়োই সত্য ।
বাউলের স্বভাব তাঁর। পথের কবি হিসেবে তিনি শুধু দেখেছেন । না, ভুল হল । মাখামাখি হয়ে গেছেন। জগতে যত প্ৰাণ উদ্ভিজ্জ এবং স্থাণু যত প্ৰাণ সঞ্চরণশীল এবং সরব, তাদের সমবেত সঙ্গীত শুনিয়েছেন তিনি। অস্থির অথচ সরল, স্থিত। কিন্তু সন্ধানী, এমন কোনও শিল্পীর নিদর্শন বঙ্গসাহিত্যে যদি থাকে, তবে তিনি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। এখানে, অন্তত আমাদের কাছে হেমিংওয়ে তুলনীয় তো বটেনই, উপরন্তু বিদেশী ওই মহৎ লেখকও যেন বিভূতিভূষণের কাছে ঈষৎ সুদূর ধূসর হয়ে যান ।
নিসর্গের সঙ্গে সৃষ্টির যা অন্যতম প্রধান উপাদান, সেই নারীকেও তিনি অবহেলা করেননি। সন্ধান, শুধু সন্ধান। প্ৰাপ্তি আর বঞ্চনার ফিরিস্তি দিতে গেলে তাঁর সত্তাকে ছোট করা হবে । তবু জিজ্ঞাসা থাকে। বিশেষ বিশেষ রমণী-কমনী, কে, কে, আর কে ? তাঁদের প্রভা যেন সব ঢেকে দেয়, কেউ কেউ রেণু হয়ে ঝিকমিক করে। অবশেষে একটি কল্যাণীহস্ত সব-কিছুর আধার। আর আবরণ হয়।
এই গ্রন্থে সমস্তই আছে। উদার প্রাস্তর, গহন বন আর তুচ্ছতিতুচ্ছ শস্য-শস্প-কুসুমাদি। আর তাঁর জীবনের সমুদয় অন্বেষণাও । নারী, প্রকৃতি । রূপ-রসের সঙ্গে সঙ্গে গন্ধ আর মােহ মিলিয়ে এক-একজন শিল্পী যেভাবে সম্পূর্ণ হয়ে ওঠেন, তারই কাহিনী । অকালে প্রয়াত হয়েও তিনি সম্পূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন বলেই তো আমাদের আজও পূর্ণ করে দিচ্ছেন। সারা জীবন তিল তিল অক্লান্ত আহরণ করে যিনি তিলোত্তম, “পথের কবি” তারই পরিশ্রমী আলেখ্য । একটি শিল্পীর জন-জীবন আর মনোজীবনের এমন মরমী পরিচয় খুব বেশি জীবন-বৃত্তান্তে পাইনি। লেখককে আমার ঈষা, লেখককে আমার অভিনন্দন ।

আনন্দবাজার পত্রিকা কার্যালয়
কলকাতা
সন্তোষকুমার ঘোষ
২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৩৮৫