Ticker

6/recent/ticker-posts

পাঠক - ম্যাক্সিম গোর্কি (ছোটগল্প)

পাঠক - ম্যাক্সিম গোর্কি (ছোটগল্প)

তখন রাত হয়ে গেছে। আমি যে বাড়িতে কিছু ঘনিষ্ঠ লোকের কাছে আমার একটা সদ্য প্রকাশিত গল্প পড়ে শোনাচ্ছিলাম, সেখান থেকে বেরিয়ে এলাম। তারা আমার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। আমি নির্জন রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছি—বেঁচে থাকার এরকম আনন্দ আগে কখনো অনুভব করিনি।
ফেব্রুয়ারি মাসের পরিষ্কার রাত। আর মেঘমুক্ত তারকাখচিত আকাশ পৃথিবীতে ঝরেপড়া তুষারের মনোরম রাজমুকুটের ওপর প্রাণজুড়ানো শীতল নিঃশ্বাস ফেলছে। রাস্তার ধারে বেড়ার ওপর ঝুঁকে থাকা গাছের ঝোপ-ঝাড়ে আমার পথের ওপর আপন খেয়ালে ছায়ার আলপনা আঁকা এবং চাঁদের কোমল নীল আলোর আভায় তুষার কণাগুলো আনন্দে ঝিকমিক করে উঠছে। কোথাও কোনো প্রাণের আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। কেবল আমার পায়ের নিচে বরফ গুঁড়ো হওয়ার শব্দ। এই একমাত্র শব্দ যা ভাবগম্ভীর, স্মরণীয় এই রাত্রির নীরবতাকে ভেঙে খানখান করে দিচ্ছে।
আমার মনে হলো, হ্যাঁ এই পৃথিবীতে উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠা, নিজের লোকজনের মাঝে বিশিষ্ট হয়ে ওঠা খুবই সুখকর।
এবং আমার কল্পনায় আমার ভবিষ্যৎ... এর চিত্র আঁকতে গিয়ে কোনো উজ্জ্বল রঙের পোঁচই বাকি রইলো না।
‘সত্যি, আপনার ছোট্ট গল্পটা খুবই আনন্দদায়ক। আপনাকে স্বাগত জানাই’, পেছন থেকে একটি ভাবগম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।
চমকে ঘুরে তাকালাম।
পেছন থেকে, কালো পোশাকে ঢাকা একটা খুদে লোক কিছুটা এগিয়ে আমার পায়ে পায়ে হাঁটতে হাঁটতে বুদ্ধিদীপ্ত হাসির অভ্যর্থনায় আমার মুখের দিকে তাকালো। লোকটার সবকিছুই ধারালো : চোখের দৃষ্টি, গালের হাড়, সামান্য ঝুলে থাকা দাড়ি সম্বলিত থুতনি; তার ফিটফাট চেহারার মধ্যে চোখধাঁধানো চমক রয়েছে। লোকটা এমন নিঃশব্দে চলছে, যেন বরফের ওপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে। ঘরে শ্রোতাদের মধ্যে লোকটাকে দেখিনি, তাই এ গল্পের মন্তব্যে খুবই বিস্মিত হলাম। ও কে? কোত্থেকেই বা উদয় হলো?
‘আপনি কি... আপনিও কি ওখানে ছিলেন?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘হ্যাঁ, আমিও সেই আনন্দেরই অংশীদার।’
গায়কি ঢঙে সে কথা বললো। লোকটার ঠোঁটজোড়া পাতলা এবং ছোট কালো গোঁফজোড়া ঠোঁটের হাসিকে আড়াল করে না। তাই নিরবচ্ছিন্ন হাসি অস্বস্তি সৃষ্টি করে। মনে হলো এর মধ্যে এমন একটা ব্যঙ্গ লুকিয়ে আছে যা আমার কাছে আদৌ সুখকর হয়ে উঠবে না। কিন্তু মেজাজটা আমার এতই ভালো আছে যে এই নতুন সঙ্গীটির এ বিষয়টার বেশি সময় নষ্ট করতে ইচ্ছে করছে না। আর নিজের আত্মতৃপ্তির উজ্জ্বল আলোয় এইসব ভাবনা ছায়ার মতো মুছে গেল। পাশে পাশে চলছি আর ভাবছি সে কি বলবে এবং মনে মনে আশা করছি ওর বলার মধ্যে সন্ধ্যায় অনুভূত সুখদায়ক মুহূর্তগুলো আরও ঘন হয়ে উঠবে। স্বভাবতই মানুষ লোভী, কারণ ভাগ্যদেবী সচরাচর তার ওপর সদয় হাসি বর্ষণ করেন না।
‘প্রত্যেকেই নিজেকে অন্যের চেয়ে বিশিষ্ট ভাবতে ভালোবাসে, তাই না?’ সঙ্গীটি প্রশ্ন করলো।
এ মন্তব্যে আপত্তিকর কিছুই পেলাম না, তাড়াতাড়ি সায় দিলাম।
‘টি-হি-হি!’ খিক্‌খিক্‌ করে হেসে টানটান আঙ্গুলগুলো নিয়ে সে তার ছোট্ট হাত দুটো এলোমেলো ঘষতে লাগলো।
তার হাসির খোঁচা খেয়ে নীরস মন্তব্য করলাম, ‘আপনি দেখছি খুব আমুদে লোক!’
মাথাটা হেলিয়ে, হেসে সে আমাকে সমর্থন করে বললো, ‘হ্যাঁ, আমি আমুদে লোক। আবার আমার জানবার ইচ্ছাও খুব বেশি...। সব সময়ই—জানতে চাই—সবকিছুই জানতে চাই। আমার এই জানার ইচ্ছাটা চিরকালের। এই ইচ্ছার তাড়নায় সর্বদা চালিত হয়ে আসছি। এখন যা জানতে চাই সেটা হলো—এই সাফল্যের জন্য আপনাকে জীবনে কি মূল্য দিতে হয়েছে?’
আমি তাকিয়ে নিস্পৃহভাবে উত্তর দিলাম :
‘প্রায় এক মাস... বা একটু বেশিই হয়তো লেগেছে।’
সে চটপট উত্তর দিল, ‘আঃ! অল্পসল্প পরিশ্রম, দৈনন্দিন জীবনের ছোট ছোট অভিজ্ঞতার সবসময়ই কিছু মূল্য আছে...। তবুও আসি বলবো, এই যে আপনি ভাবছেন যে এই মুহূর্তে কয়েক হাজার লোক আপনার চিন্তার অংশীদার হচ্ছে, লেখা পড়ছে,—তার তুলনায় এই মূল্য খুব একটা বেশি কিছু নয়। এবং এর পরেই আসে এই আকাঙ্ক্ষা যে সম্ভবত, কালক্রমে... হাঃ—হাঃ! আর যখন আপনি মরে যাবেন... হাঃ—হা—হাঃ।... কারণ আপনার আরও বেশি কিছু দেবার ইচ্ছা জাগবে, আপনি আমাদের ইতিমধ্যে যা দিয়েছেন তার চেয়ে সামান্য কিছু বেশি। তাই নয় কি?’
সে তীক্ষ্ন কালো ধূর্ত চোখে আমাকে নিরীক্ষণ করে খিক্‌খিক্‌ বিদ্রূপের হাসিতে ফেটে পড়লো। আমিও তাকে নিরীক্ষণ করলাম এবং তারপর গম্ভীর, আহতস্বরে জিজ্ঞেস করলাম,
‘মাফ করবেন...। আমি কার সাথে কথা বলছি জানতে পারি কি?’
‘আমি কে জানতে চাইছেন? বুঝতে পারছেন না? বেশ, তাহলে আপাতত বলছি না আমি কে। কোনো ব্যক্তির বক্তব্যের চেয়ে তার নাম জানাটাকে নিশ্চয়ই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন না?’
‘না, তা অবশ্য নয়...। তবুও ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত লাগছে,’ আমি উত্তর দিলাম।
কেন জানি না সে আমার কোটের হাতাটা ধরে নীরবে মুচকি মুচকি হেসে বললো, ‘বেশ তো, অদ্ভুত লাগুক না! দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার বাইরে, মাঝে মাঝে নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে যে কোনো লোকের রাজি হওয়া উচিত।... আর আপনার যদি কোনো আপত্তি না থাকে, তবে আসুন আমরা মন খুলে কথা বলি। ধরুন, আমি একজন পাঠক—একজন অচেনা পাঠক। ধরুন, এমন একজন পাঠক যে খুব উৎসুক হয়ে জানতে চায় যে ঠিক কেন ও কিভাবে বই লেখা হয়—এই ধরুন, আপনার যে বইটা লেখা হলো, তার বিষয়ে আমরা কিছু আলোচনা করি।’
আমি বললাম, ‘আরে, এ তো খুবই আনন্দের কথা... রোজ তো আর এরকম লোকের সাক্ষাৎ ও কথাবার্তা বলার সুযোগ পায় না...।’ কিন্তু মিথ্যা বললাম। আসলে পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে খুব খারাপ লাগছে। লোকটা চায় কি? একটা সম্পূর্ণ অজানা অচেনা লোকের সাথে এই মামুলি কথাবার্তাকে বিতর্কের মধ্য দিয়ে যেতে দেব কেন?
একইভাবে আমি তার পাশাপাশি ধীর পদক্ষেপে হেঁটে চলেছি আর বিনম্র মনোযোগের ভাব আনবার চেষ্টা করছি। এ ভাব আনতে খুব কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু যেহেতু আমার মেজাজ এখনো বেশ ভালো আছে, এবং যেহেতু তার সাথে কথা না বলে তাকে অপমানিত করতে চাই না, আমি নিজেকে সংযত রাখবারই মনস্থির করলাম।
চাঁদটা আমাদের পেছনে চলে গেছে। ফলে পথে পড়েছে আমাদের ছায়া, ছায়াযুগল মিলেমিশে কালো আঁধারের টুকরো হয়ে আগে আগে বরফের ওপর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে চলছে এবং সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হলো, আমার ভেতরেও এমন একটা কিছু জন্মাতে শুরু করেছে, যা এই ছায়ার মতোই অন্ধকারাচ্ছন্ন, মোহ সৃষ্টিকারী এবং আমার সামনে সামনে চলছে।
মিনিট খানেক আমার সঙ্গীটি চুপ থেকে এমন একজন আত্মপ্রত্যয়সম্পন্ন লোকের স্বরে কথা বলে উঠলো যে আপন চিন্তাকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
‘মানব-প্রকৃতির গতিবিধির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও চ্তিাকর্ষক জিনিস পৃথিবীতে আর কিছুই নেই... তাই নয় কি?’
আমি মাথা নাড়লাম।
‘আপনি মানছেন!... তবে আসুন আমরা মন খুলে আলোচনা করি— এই যুবক বয়সে কখনো মন খুলে আলোচনা করার সুযোগ নষ্ট করবেন না!’
কি অদ্ভুত লোক রে বাবা, আমি ভাবি; হঠাৎ উৎসাহভরে বক্র হেসে প্রশ্ন করলাম, ‘কিন্তু কি নিয়ে আলোচনা করবো?’
লোকটা মুহূর্তের জন্য আমার দিকে তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে তাকালো, তারপর অতি পরিচিত পুরনো বন্ধুর মতো চেনাসুরে বিস্ময় প্রকাশ করে বলে উঠলো, ‘আমরা সাহিত্যের উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনা করবো!’
‘ঠিক আছে, কিন্তু—বেশ রাত হয়ে গেছে না কি?’
‘খুব দেরি! না—আপনার কাছে এটা খুব বেশি রাত নয়!’
কথাক’টা আমাকে থামিয়ে দিল। সে এখন আন্তরিক আশ্বাসের সুরে কথাক’টা বললো, যা এমন রূপকধর্মী যে আমি তাকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করার জন্য থেমে গেলাম। কিন্তু সে আমার হাত মৃদু আকর্ষণ করে আমাকে এগিয়ে নিতে লাগলো।
‘দাঁড়াবেন না। বেশ ভালো রাস্তা দিয়েই যাচ্ছি...। যা হোক, অনেক আলাপ পরিচয় হলো! এখন বলুন, সাহিত্যের উদ্দেশ্য কি?... আপনি সাহিত্যচর্চা করেন, সুতরাং আপনার এটা জানা উচিত।’
আমি ক্রমশ এত বিস্মিত হয়ে পড়ছি যে নিজেকে স্থির রাখতে পারছি না। কি চায় লোকটা আমার কাছে? কে ও?
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ শুনুন, আপনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে এই সমস্ত...।’
‘একটা সত্যিকারের ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে করা হচ্ছে, বিশ্বাস করুন। ভালো উদ্দেশ ছাড়া এ পৃথিবীতে কোনো কিছুই ঘটে না...। সুতরাং চলুন একটু জোরে পা চালাই, না না সামনে নয়, ভেতরের দিকে।’
এভাবে কথার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়াটা নিশ্চয়ই খুব মজার ব্যাপার, কিন্তু লোকটার কথায় আমি বিরক্ত হলাম। এগিয়ে যাবার জন্য পুনরায় অধৈর্য হয়ে উঠলাম। কিন্তু সে শান্তভাবে কথা বলতে বলতে আমার পিছু নিল।
‘আমি বেশ বুঝতে পারছি। এই মুহূর্তে আপনার পক্ষে সাহিত্যের উদ্দেশ্যের কোনো সংজ্ঞা দেওয়া কঠিন। আমি নিজেই একটা সংজ্ঞা দেওয়ার চেষ্টা করছি।’
সে একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে, হেসে আমার মুখের দিকে তাকালো।
‘আপনি নিশ্চয়ই আমার সাথে একমত হবেন যদি আমি বলি, মানুষ যাতে নিজেকে বুঝতে পারে, যাতে তার নিজের ওপর বিশ্বাস বাড়ে এবং যাতে তার সত্য সন্ধানের ইচ্ছা জাগ্রত হয়; যাতে তার নীচতা ও ক্ষুদ্রতা দূর হয়, শুভবুদ্ধির উদয় হয়, তার মনে লজ্জা, ক্রোধ ও সাহসের অনুভূতি জাগ্রত হয়, সাহিত্যের উদ্দেশ্য হচ্ছে সে বিষয়ে মানুষকে সাহায্য করা। এমন কিছু করা যাতে সে মহানরূপে শক্ত ও সমর্থ হয়ে উঠে নিজের জীবনকে সুন্দরের প্রতি উদ্দীপনায় ভরপুর করে তুলতে পারে। এ হলো আমার সংজ্ঞা; অবশ্য এটা একটা মোটামুটি সংজ্ঞা হলো...। জীবনকে অনুপ্রাণিত করার মতো বা কিছু আছে এর সাথে যোগ করে দেবেন। এখন বলুন—আপনি কি এই সংজ্ঞার সাথে একমত?’
আমি বললাম, ‘ঠিকই বলেছেন। প্রায় যথার্থই হয়েছে। সাধারণভাবে এটাই ধরে নেওয়া হয় যে, সাহিত্যের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানবজাতিকে মহৎ করে তোলা।’
‘তা হলে কি মহান কর্তব্যই না আপনি পালন করছেন।’ লোকটা বেশ মিষ্টি করে কথাটা বললো—এবং আবার পরিচিত ব্যঙ্গের হাসি হাসল।
‘কিন্তু এসব কথা বলছেন কেন?’ প্রশ্ন করলাম—ভাবখানা এমন যে তার হাসি যেন আমি গায়েই মাখিনি।
‘ভাবছেন কেন?’
কয়েকটি কড়া মন্তব্য মনে করার ব্যর্থ চেষ্টার পর বললাম, ‘সত্যি কথা বলতে কি...।’ সত্যি কথা বলা বলতে কি বোঝায়? লোকটি বোকা নয়, সে নিশ্চয়ই জানে মানুষের এই সত্যি কথা বলার সীমানা কত ক্ষুদ্র এবং আত্মসম্মানের ঘেরাটোপে কি কঠিন গণ্ডিতে বাঁধা। সঙ্গীটির দিকে তাকাতেই দেখি সে হাসছে; আমি ভীষণ মর্মাহত হলাম—এই হাসিতে রয়েছে প্রচণ্ড বিদ্রূপ ও ঘৃণা। আমার ভয় করতে শুরু করলো; এমন ভয় যে এখুনি পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।
‘শুভরাত্রি’, টুপিটা তুলে ধরে হঠাৎ বলে ফেললাম।
‘কেন?’ লোকটা নম্রভাবে বিস্ময় প্রকাশ করলো।
‘এমন ঠাট্টা আমার ভালো লাগে না যা শেষ পর্যন্ত মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।’
‘ও, তাই আপনি চলে যাচ্ছেন?... ভালো কথা, যা ইচ্ছা করুন। কিন্তু মনে রাখবেন যদি এখন চলে যান তবে আমাদের আর কখনই সাক্ষাৎ হবে না।’
লোকটি ‘কখনই’ শব্দটার ওপর জোর দিল এবং কবরখানার ঘণ্টার মতো তা আমার কানে বেজে উঠলো। আমি এই শব্দটাকেই সর্বদা ভয় ও ঘৃণা করে এসেছি। এটা যেন মানুষের আশাকে নস্যাৎ করার জন্য বিশাল হাতুড়ির মতো ভারী, শীতল একটা কিছু। এই শব্দটাই আমাকে থামিয়ে দিল।
‘আপনি কি চান চলুন তো?’ করুণ ও ঘৃণার সুরে আমি কথাটা জিজ্ঞেস করলাম।
সে ফের হেসে বললো, ‘আসুন, বসি’ এবং শক্ত থাবায় হাতটা ধরে আমাকে টেনে বসালো।
এখন আমরা মিউনিসিপ্যালিটির বাগানে একটা রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছি—রাস্তার ওপরে লোকাস্ট ও লিলাক গাছের বরফ-ঢাকা নিশ্চল ডালপালা ঝুলে রয়েছে। চাঁদের আলোয় ঝিকমিকিয়ে ডালপালাগুলো আমার মাথার উপরে দুলছে এবং মনে হচ্ছে বরফ ও কুয়াশায় ঢাকা এই শক্ত ডালগুলো আমার বুক ভেদ করে হৃৎপিণ্ডের গভীরে আঘাত করছে।
সঙ্গীটির ব্যবহারে বিস্মিত ও হতবিহ্বল হয়ে নীরবে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
ভাবলাম, লোকটার নিশ্চয়ই একটা কিছু গণ্ডগোল আছে—মানে লোকটার এই ব্যবহারের একটি সুবিধাজনক ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করলাম আর কি। কিন্তু সে যেন আমার মনের কথা বুঝতে পারলো।
‘আপনি ভাবছেন আমি অপ্রকৃতিস্থ? ওসব কথা বাদ দিন। এটা খুবই সস্তা ও বাজে ধারণা! প্রায়ই আমরা এইসব কথা বলে কিভাবেই না একজন মানুষকে বুঝতে অস্বীকার করি, অথচ সে হয়তো আমাদের চেয়েও বেশি মৌলিক চিন্তা করে। আর কি ভীষণভাবেই না এই ধারণা আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে এক দুঃখজনক কৃত্রিমতা চিরস্থায়ী করে ও বাড়িয়ে তোলে!’
‘হ্যাঁ, সত্যিই...’, লোকটির উপস্থিতিতে আরও বেশি বেশি করে বিব্রত বোধ করে আমি বলি। ‘কিন্তু যদি অনুমতি দেন, মানে আমাকে যেতেই হবে...। আমার যাবার সময় হয়ে গেছে।’
সে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে ওঠে, ‘ঠিক আছে, যান। যান... তবে মনে রাখবেন এই তাড়াহুড়ো করে আপনি নিজের প্রকৃত স্বরূপটিই ক্ষুণ্ন করছেন।’ সে আমার হাতটা ছেড়ে দিল, আমি হাঁটা লাগালাম।
ভলগার তীরে কোনো একটি পাহাড়ের উপরে পার্কের ভেতর তাকে ফেলে রেখে চলে এলাম—তুষারে ঢাকা পাহাড়টায় পায়ে-চলা-পথের কালো ফিতের আঁকিবুঁকি আঁকা। তার সামনে, নদীর ওপারে রয়েছে নিঃশব্দ বিষণ্ন সমতলভূমির একটি বিস্তীর্ণ দৃশ্যপট। একটি বেঞ্চে বসে দূর দিগন্তের দিকে সে তাকিয়ে রইলো, আর আমি পথ ধরে নিচের দিকে হাঁটতে লাগলাম। লোকটা যে আমার মনে কোনো রেখাপাতই করেনি এটা দেখানোর জন্য আমি কি জোরে হাঁটবো, না আস্তে?
শুনতে পেলাম লোকটা শিস দিয়ে একটা চেনা সুর ভাঁজতে শুরু করেছে...। গানটা সেই অন্ধ মানুষকে নিয়ে একটা ছোট্ট করুণ ও কৌতুক গান যে আর একটা অন্ধ মানুষকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কেন সে এই বিশেষ গানটা বেছে নিল ভাবছি।
আর তখনই অনুভব করলাম যে এই লোকটার সাথে সাক্ষাতের সময় থেকেই আমি একটা অদ্ভুত ও সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত অনুভূতির অন্ধকার চকের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়েছি। আমার সাম্প্রতিক ভাবগম্ভীর, আত্মসুখী মানসিকতা এক ধরনের অশুভ অনুভূতির দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে।
কি করে সে-পথ দেখাবে গো নেতা,
যে-পথের তুমি জান না বারতা?
লোকটা শিস দিয়ে যে গানটা ভাঁজছিল, তার কথাগুলো আমার মনে পড়ে গেল।
আমি ঘুরে পেছনের দিকে তাকালাম। সে তার হাঁটুর উপরে কনুই ঠেকিয়ে তালুতে চিবুক রেখে আমাকে দেখছে আর শিস দিচ্ছে। তার মুখের ওপর চাঁদের আলো পড়ায় চকচক করছে, আর নাচছে তার কালো গোঁফজোড়া। ভয়ঙ্কর কোনো এক অশুভ পরিণতির আশঙ্কায় আমি ফিরে যাবার জন্য মনস্থির করলাম। ফিরে গিয়ে তার পাশে বসে শান্ত, আগ্রহভরে বললাম, ‘ঠিক আছে, আসুন আমরা সরল মনেই কথা বলি...।’
সে মাথা নেড়ে বললো, ‘আমাদের সকলেরই সরল হওয়া দরকার।’
‘আমার ধারণা, আমাকে প্রভাবিত করার মতো ক্ষমতা আপনার আছে এবং আমাকে বলার মতো আপনার নিশ্চয়ই কিছু কথাও আছে...। তাই নয় কি?’
‘যাক, শেষ পর্যন্ত শোনবার মতো সাহসটুকু অর্জন করলেন।’ সে সহাস্যে বিস্ময় প্রকাশ করলো। কিন্তু এখন তার হাসিটা আগের চেয়ে ভদ্র এবং এই হাসির মধ্যে আনন্দের ছোট ছোট ঢেউয়ের মতো কিছু একটা আছে বলে মনে হলো।
আমি বললাম, ‘বেশ ভালো কথা, এবার বলুন। আর আপনার ঐ অদ্ভুত ভাবভঙ্গিগুলো বাদ দিয়ে যদি আপনি...।’
‘খুব ভালো কথা! কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই মানবেন, ঐ অদ্ভুত ভাবভঙ্গিগুলো আপনার মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্যই প্রয়োজন ছিল। যা কিছু স্পষ্ট ও সাধারণ, সেগুলোর প্রতি আমাদের আগ্রহকে ভোঁতা করে দিয়েছে এই আধুনিক জীবন; এ জীবন আমাদের কাছে খুবই কঠিন ও শীতল। আর কোনো কিছু উষ্ণ ও নরম করার ক্ষমতাই আমরা হারিয়ে ফেলেছি, কারণ আমরা নিজেরাই যে শীতল ও শান্ত হয়ে পড়েছি। মনে হয়, আমাদের আবার ভৌতিক মায়াকল্প, উদ্ভট কল্পনা, স্বপ্ন ও অভূত সব জিনিসের প্রয়োজন। আমরা যে জীবন গড়ে তুলেছি তার কোনো রঙ নেই—একঘেয়ে ও নীরস। আমরা যে এক সময় নতুন কিছু করবার জন্য এত ব্যগ্র ছিলাম, এই সত্যই আমাদের ধ্বংস ও হত্যা করেছে...। আমাদের কি করার আছে? যা হোক, আসুন চেষ্টা করে দেখি। সম্ভবত আবিষ্কার ও কল্পনা ক্ষমতা মানুষকে ক্ষণিকের জন্য এই পৃথিবী থেকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে এবং পুনরায় তার হৃদস্থান চিনে নিতে সাহায্য করবে। কারণ তা হারিয়ে গেছে, তাই নয় কি? মানুষ আর এই পৃথিবীর প্রভু নয়। সে জীবনের ক্রীতদাসে পরিণত হয়ে গেছে; সত্য ঘটনার কাছে মাথা নত করার তার প্রধান অবলম্বন সেই গর্বকেই হারিয়ে ফেলেছে। তাই নয় কি? তার নিজেরই সৃষ্ট ঘটনা থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে সে বলে যে, এটা একটা দুর্লঙ্ঘ নিয়ম! এবং নিয়মের প্রতি আনুগত্যের ফলেই যে সে স্বাধীন সৃজনশীলতার পথে বাধা সৃষ্টি করেছে, একথা সে বুঝতে অক্ষম। সে দেখে না যে, সৃষ্টির জন্য ধ্বংস করার অধিকারের সংগ্রামের ক্ষেত্রেও সে নিজেকে সংকুচিত করে ফেলেছে। এমনকি সে এখন কোনো সংগ্রামই করছে না, কেবল মানিয়ে চলছে...। সংগ্রাম করার বিষয় তার আর কি আছে? কোথায় সেই আদর্শ, যার জন্য সে শৌর্যবীর্যের প্রকাশ ঘটাবে? সে কারণেই জীবন এত ক্ষুদ্র ও ভোঁতা, সে কারণেই মানুষের সৃজনশীল ক্ষমতা বাঁধা পড়ে গেছে...। কেউ কেউ অন্ধভাবে সেই জিনিস পেতে চায় যা তার মনে ডানা লাগিয়ে দেবে এবং তার নিজের মধ্যে মানুষের বিশ্বাস ফিরিয়ে আনবে। বেশিরভাগ সময়েই তারা সেখানে যায় না, যেখানে রয়েছে শাশ্বত বিষয়সমূহ, যা মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে, যেখানে ঈশ্বরের বাস...। সত্যের সন্ধানে যারা পথ হারিয়ে ফেলে, তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ধ্বংস হোক তারা, আমরা তাদের বাধা দেব না, বা তাদের প্রতি করুণাও প্রকাশ করবো না—পৃথিবীতে আরও অনেক অনেক মানুষ আছে! এখন প্রয়োজন উদ্দীপনার, ঈশ্বরকে পাবার কামনা, এবং ঈশ্বরকে পাবার কামনায় ভরপুর মানুষদের সাথেই তিনি থাকেন ও তাদের জীবনে পূর্ণতা এনে দেন। কারণ তিনিই হলেন পূর্ণতার জন্য শাশ্বত প্রচেষ্টার স্বরূপ...। তাই নয় কি?’
‘হ্যাঁ, তাই,’ আমি বললাম।
‘আপনি দেখছি খুব সহজেই একমত হয়ে যান।’
সঙ্গীটি পুনরায় বিদ্রূপের হাসি হেসে কথাটা বললো, এবং তারপরই দূরে দৃষ্টি মেলে চুপ করে গেল। সে অনেকক্ষণ চুপ করে রয়েছে, এবং আমি অধৈর্যে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। সুদূরেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে, আমার দিকে না তাকিয়ে সে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনার ঈশ্বর কে?’
এই প্রশ্নটার পূর্বমুহূর্তেও সে শান্ত ও নম্র সুরে কথা বলছিল এবং তার কথা শুনতেও বেশ ভালো লাগছিল; সমস্ত চিন্তাশীল মনীষীর মতো এই লোকটিও কিঞ্চিৎ বিষণ্ন এবং এটাই তাকে আমার আরও কাছে টেনে এনেছে। মনে করছিলাম তাকে আমি রুখতে পারছি এবং আমার বিব্রত ভাবটাও দূর হতে শুরু করেছিল। হঠাৎ এই লোকটা এমন একটা কঠিন প্রশ্ন ছুড়ে দিল যে, আমাদের সময়কার যে কোনো মানুষের পক্ষে এর উত্তর দেওয়া খুব কঠিন, অবশ্য যদি সে নিজের কাছে সৎ হয়। আমার ঈশ্বর কে? যদি আমি তা-ই জানতাম!
এই প্রশ্নের কাছে আমি পরাজিত হয়ে গেলাম। কে-ই বা হবে না? আমার মতো অবস্থায় পড়লে কার বুদ্ধি ঠিক থাকতো? সে তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো, হাসলো এবং আমার উত্তরের অপেক্ষায় রইলো।
‘উত্তর দিতে সক্ষম ও আগ্রহী লোকের তুলনায় আমি অনেক বেশি সময় চুপ করে আছেন। মনে হচ্ছে, যদি প্রশ্নটাকে এইভাবে রাখি তবে হয়তো আপনি আমাকে কিছু উত্তর দিতে পারেন; আপনি একজন লেখক, হাজার হাজার লোক আপনার লেখা পড়ে; তাদের কি বাণী দেন আপনি? আর কখনো কি ভেবে দেখেছেন আপনার শিক্ষা দেবার কোনো অধিকার আছে কি না?’
এর আগে কখনো আমি মনের গভীরে চিন্তারাশির দিকে এত ঘনিষ্ঠভাবে তাকানোর জন্য পীড়িত হইনি। কেউ যেন মনে না করেন, মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্যই আমি বিনয় প্রকাশ করছি বা নিজেকে অপমান করছি—ভিক্ষুকের কাছে ভিক্ষা চাইবার কোনো অর্থ হয় না। আমি নিজের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ সময় অনুভূতি ও কামনা, যথেষ্ট পরিমাণে, যাকে চলতি কথায় বলে, মঙ্গল-এর সন্ধান পেয়েছি, কিন্তু আমার মধ্যে সে অনুভূতি খুঁজে পাইনি যা এই সবকিছুকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে, আর পাইনি এমন কোনো স্বচ্ছ ও সুসংবদ্ধ চিন্তা বা জীবনের সমস্ত কার্যকারণকে বিজড়িত করতে পারে। আমার অন্তরে প্রভূত ঘৃণা রয়েছে, সেই ঘৃণা সর্বদা জমাট বাঁধছে এবং কখনো সখনো ক্রোধের সুস্পষ্ট অগ্নিশিখায় ফেটে বেরুচ্ছে; কিন্তু অন্তরে সন্দেহ রয়েছে আরও অনেক বেশি। মাঝে মাঝে তা মন ও প্রাণের কাছে এমন বোঝা হয়ে দাঁড়ায় যে, ভেতরে ভেতরে আমি ক্লান্তিতে একেবারে শেষ হয়ে যাই...। কোনো কিছুই আমাকে আর স্বাভাবিক করে তুলতে পারে না, হৃৎপিণ্ড মৃত ব্যক্তির মতো শীতল হয়ে যায়, মন ঘুমিয়ে পড়ে, কল্পনাগুলো দুঃস্বপ্নের দ্বারা তাড়িত হতে থাকে। এই অবস্থা, এই অন্ধ বধির এবং মূক পরিণতি বেশ কয়েক দিন ও রাত ধরে চলে—তখন আমার কোনো কামনা, কোনো বোধশক্তি থাকে না; এ পর্যায়ে মনে হয় আমি যেন একটা মৃতদেহ, কোনো অজ্ঞাত কারণে আমাকে কবর দেওয়া হচ্ছে না। বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতার ফলে এই ধরনের একটি অস্তিত্বের ভয়ংকরতা আরও বৃদ্ধি পায়; কারণ মৃত্যুর মধ্যে অর্থবহতা রয়েছে অনেক কম আর অন্ধকার অনেক বেশি... সম্ভবত, ঘৃণা করার বিলাসিতাকেও তা কেড়ে নিয়ে গেছে।
তাহলে, প্রকৃত অর্থে কি আমার বাণী? কি শিক্ষা দিই বলে দাবি করি? যে আমি প্রকৃত আমি? এবং জনগণকে বলবার আমায় কী-ই বা আছে? বহু আগেই মানুষকে যা বলা হয়ে গেছে, সর্বদা তাদের যা বলা হয়, তা-ই? যা মানুষকে শোনানো হয়, অথচ যাতে তাদের কোনো উন্নতি হয় না, তাই? কিন্তু যে আমি তাদের অবলম্বন করে গড়ে উঠে তাদেরই নির্দেশের বিপরীত কর্ম করি, সেই আমার কি অধিকার আছে তাদের এইসব ধ্যান-ধারণার শিক্ষা দেবার? আর সে কাজ করলেও কি তাদের ওপর আমার বিশ্বাস আমার প্রকৃত ‘আমির’ ভিত্তিভূমির ওপর দৃঢ়ভাবে প্রোথিত একটি আন্তরিক বিশ্বাস হয়ে উঠতো? পাশে বসে থাকা এই লোকটিকে আমি কি বলবো? কিন্তু সে আমার উত্তরের অপেক্ষায় থেকে ক্লান্ত হয়ে আবার কথা বলে উঠলো।
‘যদি আমি না দেখতাম যে উচ্চাশা এখনো আপনার সম্মানকে ধ্বংস করেনি তবে আপনাকে এই প্রশ্ন করতাম না। আমার কথা শোনবার মতো সাহস আপনার আছে...। এ থেকেই আমি ধরে নিয়েছি, আপনার নিজের প্রতি সত্যিকারের ভালোবাসা রয়েছে, কারণ তা জোরদার করার জন্য নির্যাতনের মুখেও আপনি নিজেকে গুটিয়ে নেননি। সে কারণেই আমার সাথে এই সংঘর্ষের যন্ত্রণা থেকে আমি আপনাকে মুক্তি দেব। আপনি ভুল করেছেন কিন্তু দাগী আসামি নন ধরে নিয়ে, আপনার সাথে কথা বলবো।’
‘কোনো একসময়ে মহান পণ্ডিত ব্যক্তিরা, জীবন ও মানবাত্মার নিগূঢ় পর্যবেক্ষকরা, জীবনকে নির্মল করে তোলার অদম্য উদ্দীপনায় উদ্বুদ্ধ মানুষের ওপর গভীর বিশ্বাসের দ্বারা অনুপ্রাণিত ব্যক্তিরা আমাদের মধ্যে বাস করতেন। তাঁরা যেসব বই লিখেছেন তা কখনো বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাবে না; কারণ তাতে রয়েছে শাশ্বত সত্যসমূহ, সেসব বইয়ের পাতা চিরস্থায়ী সৌন্দর্য বিকিরণ করছে। তাদের ভাবমূর্তি জীবন্ত, প্রেরণায় শক্তিতে প্রাণবন্ত। এসব বইতে সাহস আছে, জ্বলন্ত ক্রোধও আছে; সেগুলো আন্তরিক ও স্বেচ্ছা-প্রেমের সুরে বাঁধা, তার মধ্যে একটি অবান্তর শব্দও নেই। আমি জানি এই সমস্ত বই-ই আপনার আম্মাকে পুষ্ট করেছিল...। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি বলবো, আপনার আত্মার অপুষ্টি রয়ে গেছে, কেননা সত্য ও প্রেম সম্পর্কে আপনি যা লেখেন তা মিথ্যা শোনায়, মনে হয় আরোপিত, যেন জোর করে এসব বলছেন। আপনি চাঁদেরই মতো প্রতিফলিত আলোয় উজ্জ্বল; আর আপনার আলো ভীষণ ম্যাটমেটে, কেবল ছায়াই বাড়িয়ে চলে, সে মৃদু আলোয় উষ্ণতা লাভ করে না কেউ। আপনি এতই সারশূন্য যে, মানুষকে সত্য মূল্যের কোনো কিছু দেওয়া আপনার পক্ষে সম্ভব নয়। আর আপনি যা দেন তা মনন ও শব্দের সৌন্দর্য দিয়ে জীবনকে সমৃদ্ধ করে তোলার চরম আনন্দদানের জন্য দেন না; বরং তা দেন নিজের পেশাগত অস্তিত্বের এই আকস্মিক ঘটনাটিকে মানুষের প্রয়োজনীয় একটি বিশেষ ঘটনা হিসাবে তুলে ধরার জন্য। জীবন ও মানুষের কাছ থেকে আরও বেশি করে নেবার জন্যই আপনি দেন। উপহার দেবার ক্ষমতা আপনার নেই, আপনি নিছকই একজন তেজারতির কারবারি : সুদে নিজ অভিজ্ঞতার অংশমাত্র দেন, আর সেই সুদ মেটাতে হয় আপনার প্রতি মনোযোগ নিবেশ করে। আপনার কলম কদাচিৎ বাস্তবতার দাগ কাটে, সুকৌশলে জীবনের অতি মামুলি জিনিস নিয়ে নাড়াচড়া করে। গতানুগতিক মানুষের একঘেয়ে অনুভূতিগুলো বর্ণনা করতে গিয়ে আপনি হয়তো মানুষের কাছে অতি নিচুমানের ঘটনাবলি তুলে ধরেন। কিন্তু আপনি কি তাদের মনে এমন কোনো ক্ষুদ্র মোহ সৃষ্টি করতে পারেন, যা তাদের আত্মার বিকাশ ঘটায়?... না! আপনি দৃঢ় বিশ্বাস করেন গতানুগতিকতার জঞ্জাল খুঁড়ে তার মধ্যে থেকে সেইসব করুণ ক্ষুদ্র ঘটনাবলী খুঁজে বার করা প্রয়োজন, যা বলে মানুষ নিছকই শয়তান প্রকৃতির, স্থূলবুদ্ধি ও অসৎ। সে সর্বদা স্বভাবে বাহ্যিক অবস্থাসমূহের ওপরই নির্ভরশীল। সে বীর্যহীন, হতভাগ ও একাকিত্বের মাঝে বিচ্ছিন্ন। আর ইতিমধ্যে আপনি জেনে গেছেন যে সেও হয়তো এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল হারে গেছে। কারণ তার আত্মা নিষ্প্রাণ, বুদ্ধি স্থূল...। আর এছাড়া কী-ই বা হবে! বইতে যেভাবে তার চিত্র আঁকা হয়, সেভাবেই সে সবকিছু দেখে কারণ সেই চিত্রে রয়েছে সম্মোহনী প্রভাব—বিশেষ করে, তা যদি সেরকম দক্ষ হাতে লেখা হয় যা প্রায়ই প্রতিভার প্রকাশ বলে ভুল হয়ে যায়। আপনি যেভাবে কোনো মানুষের চিত্র আঁকেন, নিজেকে সে ঠিক সেভাবেই দেখতে থাকে। আর যখন সে দেখে কত খারাপ, ভালো হয়ে ওঠার কোনো সম্ভাবনা সে আর দেখতে পায় না। আপনি কি তাকে সেই সম্ভাবনা দেখাতে পারেন? আপনি কি সেই গুণ অর্জন করতে পারেন যখন আপনি নিজে... না আমি আপনাকে ছেড়ে দিচ্ছি; কারণ আমার ধারণা, আমার কথা শুনতে শুনতে আপনি নিজের কাজের সাফাই গাওয়ার ও আমার বক্তব্যকে খণ্ডন করার কথা চিন্তা করছিলেন না। শিক্ষক সৎ হলে তাকে অবশ্যই একজন মনোযোগী ছাত্র হতে হবে। আপনারা, আজকের শিক্ষকেরা, যা দেন তার চেয়ে অনেক বেশি নেন মানুষের কাছ থেকে; কারণ যা নেই কেবল তার সম্বন্ধেই আপনারা কথা বলে যান বেশি, আর যা নেই তা-ই কেবল দেখেন আপনারা। কিন্তু মানুষেরও বুদ্ধি আছে; ঠিক যেমন আপনারও নিজের কিছু বুদ্ধি আছে—তাই না? এবং আপনারা নিজেদেরকে শিক্ষক ভেবে নিয়ে, শুভের জয়ের পক্ষে অশুভের নিন্দাকারী ভেবে নিয়ে, কিভাবে সেই সব সাধারণ, ছাপোষা মানুষ থেকে নিজেদের পৃথক করলেন, যাদের চিত্র আপনারা এতো নির্দয় ও বিস্তারিতভাবে আঁকেন? কিন্তু আপনারা কি লক্ষ করেছেন যে, শুভ ও অশুভ কেবলই জটা পাকিয়ে যাচ্ছে, যেভাবে দুটো সাদা ও কালো সুতোর গুটি পাশাপাশি থেকে একে অপরের গায়ে রং ঘষাঘষি করে ধূসর বর্ণ হয়ে ওঠে? অবশ্য শুভ ও অশুভের সংজ্ঞা দেবার যে চেষ্টা আপনারা করেছেন, তার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। না, আপনারা ঈশ্বর-প্রেরিত নন...। তিনি আপনাদের চেয়েও ক্ষমতাশালী ব্যক্তি তৈরি করতেন। তিনি তাদের হৃদয়, জীবন, সত্য, মানুষের প্রতি উষ্ণ ভালোবাসা দিয়ে ভরে দিতে পারতেন। যাতে তারা অন্ধকারের মাঝে তাঁরই শক্তি ও গৌরবের উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা হয়ে আমাদের আলো দিতে পারেন...। কিন্তু আপনি শয়তানের বিজয়-মশালের মতো ধোঁয়া ছড়িয়ে জ্বলেন। আপনার ধোঁয়া মানুষের মনে ও প্রাণে প্রবেশ করে আত্ম-অবিশ্বাসের বিষে তাদের বিষাক্ত করে তুলছে। সুতরাং বলুন : আপনি কি বাণী প্রচার করেন?’
আমি গালে লোকটার গরম নিঃশ্বাস অনুভব করছি। তার চোখে যাতে আমার চোখ না পড়ে, সেজন্য অন্যদিকে তাকিয়ে আছি। আগুনের ফোঁটার মতো তার কথাগুলো আমার মস্তিষ্কে জ্বলছে, নিদারুণ জ্বালা বোধ করছি...।
তার সহজ প্রশ্নটির উত্তর দেওয়া কত কঠিন বুঝে আমি আতঙ্কিত, তাই কোনো উত্তর দিলাম না।
‘সুতরাং আপনি ও আপনার মতো অন্যান্য লেখকেরা বা কিছু লিখেছেন, তার একান্ত উৎসাহী পাঠক হিসেবে আমার প্রশ্ন : আপনারা কি উদ্দেশ্যে লেখেন? আর আপনারা প্রচুর লেখেন। আপনারা কি মানুষের মনে সদয় ভাব জাগাতে চান? না, শীতল ও বীর্যহীন শব্দ ব্যবহার করে কখনই তা করতে পারবেন না। এবং আপনারা মানুষকে নতুন কিছু তো দিতে পারেনই না। পুরনো জিনিসকেও আপনারা দুমড়ে মুচড়ে আকারহীন রূপে উপস্থাপিত করেন। আপনাদের লেখা পড়ে আমরা কিছু শিখিও না, কোনো কিছু সম্পর্কে লজ্জাও বোধ করি না—যেটুকু লজ্জা বোধ করি তা কেবল আপনাদেরই জন্য। সবকিছুই মামুলি—মামুলি লোকজন, মামুলি চিন্তা, ঘটনা...। কবে মানুষের নির্যাতিত মনের ও তার নবজন্মের প্রয়োজনের কথা বলা হবে? সৃষ্টির আহ্বান কোথায়? সাহসের শিক্ষা কোথায়? কোথায় সেই আশার বাণী বা হৃদয়কে জাগ্রত করে?
‘আপনি হয়তো উত্তরে বলতে পারেন জীবন সম্পর্কে আপনারা যা কিছু লিখছেন, তা ভিন্ন অন্য কোনো চিত্র জীবনে পাওয়া যায় না। কিন্তু তা বলবেন না। কারণ যে মানুষ কথা বলার মতো সৌভাগ্যের অধিকারী, তার পক্ষে স্বীকার করা অত্যন্ত লজ্জা ও অপমানের যে, জীবনের কাছে সে পরাজিত এবং তার ঊর্ধ্বে সে উঠতে অক্ষম। আর যদি আপনারা জীবনের স্তরেই দাঁড়িয়ে থাকেন, যদি কল্পনা-শক্তি দিয়ে এমন আঙ্গিক সৃষ্টি করতে না পারেন, বাস্তব জীবনে যার এখনো দেখা পাওয়া যায়নি অথচ জীবনের নির্দেশক হিসেবে যার প্রয়োজন আছে, তাহলে আপনাদের সৃষ্টি আর কি কাজে লাগবে? কিভাবে আপনারা নিজেদের পেশাকে যুক্তিযুক্ত করবেন? ভেবে দেখুন, মানুষের মনে তাদের একঘেয়ে জীবনের আজেবাজে চিত্রের হুবহু ছাপ ফেলে আপনারা কি ক্ষতিই না করছেন। কারণ নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে, আপনারা জীবনের এমন চিত্র আঁকতে অক্ষম, যে চিত্র মানুষের মনে প্রতিশোধমূলক লজ্জা ও ভিন্নভাবে বাঁচার জন্য আকুল কামনার জন্ম দেয়। আপনারা কি জীবনের নাড়ির স্পন্দন দ্রুততর করতে পানে? আপনারা কি অন্যদের মতো করে জীবনকে উদ্দীপনায় অনুপ্রাণিত করতে পারেন?’
আমার এই অচেনা সঙ্গীটি একটু দম নিল এবং আমি নীরবে তার কথাগুলো ভাবতে লাগলাম।
‘চারদিকে অনেক বুদ্ধিমান লোক দেখতে পাই। অথচ তাদের মধ্যে খুব কম লোকই মহৎপ্রাণ। আর যাদের এইসব অনুভূতি রয়েছে তারাও ভগ্নহৃদয়, মানসিকভাবে অসুস্থ। এছাড়া আমি সব সময়ই একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি, কোনো ব্যক্তি যত ভালো, মন তার যত পবিত্র ও সৎ, কোনো না কোনো কারণে তার উদ্দীপনা তত কম, তার বেঁচে থাকা তত বেদনাদায়ক ও কষ্টকর। এইসব ব্যক্তির কপালে আছে একাকিত্ব ও দুঃখ। কোনো ভালো কাজ করার যতই আকাঙ্ক্ষা থাকুক না কেন, তা করাবার শক্তি তাদের নেই। সময়মতো জাগরণী কথা দিয়ে সাহায্য করা হয়নি বলেই কি তারা এরকম অবদমিত ও অসহায় নন?’
অচেনা সঙ্গীটি বলে যেতে লাগলো, ‘আর তাছাড়াও, আপনারা কি এমন আনন্দোচ্ছল হাসি হাসাতে পারেন বা মনকে পরিষ্কার করে? চারদিকে তাকিয়ে দেখুন, মানুষ ভালোভাবে হাসতে ভুলে গেছে। তারা হাসে তিক্ততায় বিদ্বেষে প্রায়ই চোখের জল ফেলতে ফেলতে। কিন্তু কখনো আপনি তাদের আনন্দের হাসি, আন্তরিক হাসি শুনতে পারেন না। আপনি এমন আন্তরিক হাসি শুনতে পাবেন না যা মাঝে মাঝ পূর্ণবয়স্ক মানুষের মধ্য থেকে আসা উচিত, কারণ ভালো হাসি আত্মাকে পরিপুষ্ট করে তোলে...। মানুষকে অবশ্যই হাসতে হবে, কারণ পশুদের চেয়ে যে সামান্য কটা বেশি সুবিধা সে ভোগ করে, হাসি তার মধ্যে একটা। আপনি কি মানুষের মনে এমন হাসি জাগাতে পারেন যা নিন্দার হাসি নয়, যা আপনার প্রতি, হাস্যকরভাবে বিধ্বস্ত মানুষের প্রতি কটাক্ষপূর্ণ নয়? বুঝতে চেষ্টা করুন, আপনার শিক্ষা দেবার অধিকারের যথেষ্ট ভিত্তি থাকতে হবে। আন্তরিক অনুভূতি জাগ্রত করার ক্ষেত্রে আপনার ক্ষমতাই হচ্ছে সেই ভিত্তি, প্রেরণা ও ক্ষমতাসম্পন্ন এমন আন্তরিক অনুভূতি বা এক ধরনের জীবনকে ধ্বংস করে অন্য ধরনের জীবন, অপেক্ষাকৃত স্বাধীন এক জীবন সৃষ্টি করতে পারে। ক্রোধ, ঘৃণা, সাহস, লজ্জা ও অনুভূতির আকস্মিক পরিবর্তন বা ভয়ঙ্কর বেপরোয়া ভাব—এগুলোই হচ্ছে হাতিয়ার যা দিয়ে পৃথিবীর সবকিছু ধ্বংস করা যায়। আপনারা কি এই সব হাতিয়ার তৈরি করতে পারেন? সেগুলোকে কি সক্রিয় করে তুলতে পারেন? মানুষকে উপদেশ দেবার অধিকার অর্জন করতে হলে আপনাদের মনে, হয় তাদের ত্রুটির জন্য প্রচণ্ড ঘৃণা, না হয় তাদের দুঃখে তাদের প্রতি বিরাট ভালোবাসা পোষণ করতে হবে; আর যদি আপনাদের প্রাণে এই রকম কোনো অনুভূতি না থাকে, তাহলে আরেকবার যথেষ্ট বিনয়ের সাথে ভেবে দেখুন তাদের বিষয়ে কিছু বলবেন কি না।’
দিনের আলো ফুটছে, কিন্তু আমার মনে ক্রমেই বেশি বেশি অন্ধকার জমা হচ্ছে এবং এই যে লোকটি, যার কাছে কিছুই গোপন নয়, সে কথা বলেই যাচ্ছে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে, ‘লোকটা কি মানুষ?’
কিন্তু আমি লোকটার কথায় এমন আচ্ছন্ন আছি যে এই তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ভাববার কোনো সময় পেলাম না—তার আগেই আবার তার কথা সুঁচের মতো আমার মস্তিষ্কে খোঁচা মারতে আরম্ভ করলো।
‘জীবন আরো বেশি সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠছে, নতুন নতুন দিকে তার বিস্তার ঘটছে, আরো গভীরে সে আঘাত হানছে, যদিও প্রক্রিয়াটি খুব ধীর-গতিসম্পন্ন কারণ তাকে ত্বরান্বিত করবার শক্তিও নেই, দক্ষতাও নেই আমাদের। হ্যাঁ, জীবন বেশি বেশি করে সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠছে এবং প্রতি দিন মানুষ প্রশ্ন করতে শিখছে। কে উত্তর দেবে? উত্তর দেওয়া উচিত আপনাদের—আপনারা যারা স্বয়ং-নিযুক্ত দূত। কিন্তু অন্যকে বোঝাবার মতো যথেষ্ট ভালো করে কি আপনারা জীবনকে বোঝেন? আপনারা কি আমাদের যুগের দাবিগুলো বোঝেন? ভবিষ্যৎ পরিণতিকে অনুধাবন করার ক্ষমতা কি আপনাদের আছে? এবং যে লোক জীবনের আস্তাকুঁড়ে বাস করে কলুষিত হয়ে গেছে, যে বিধ্বস্ত ও হতোদ্যম তাকে জাগ্রত করার জন্য আপনি কি বলতে পারেন? মানুষ হতোদ্যম, জীবনে তার উৎসাহ খুব কম, সসম্মানে বেঁচে থাকার কামনা আজ প্রায় শেষ।
সে যেন-তেন-ভাবে শুয়োরের মতো বাঁচতে চায় এবং—শুনছেন?— ‘আদর্শ’ শব্দটা শুনলেই সে গোঁয়াড়ের মতো হেসে ওঠে; মাংস ও মোটা চামড়ার আবরণে মানুষ একটা হাড়ের ঢিবিতে পরিণত হচ্ছে, এই অসৎ ঢিবিটা আর প্রেরণার দ্বারা চালিত হচ্ছে না, হচ্ছে লালসার দ্বারা। মানুষের প্রতি নজর দেওয়া দরকার। চটপট করুন! সে মানুষ থাকতে থাকতেই তাকে বাঁচতে সাহায‍্য করুন! কিন্তু যখন আপনারাই গোঙান, আর্তনাদ করেন ও দীর্ঘশ্বাস ফেলেন অথবা নিষ্প্রাণ উদাসীনতা নিয়ে যখন আপনারাই তাদের বিভেদের ব্যাখ্যা করেন, তখন তাদের বেঁচে থাকবার কামনা জাগাবার জন্য আপনাদের কী-ই বা করার আছে? জীবন অবক্ষয়ের দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে; ভীরুতা ও গোলামিতে হৃদয় সম্পৃক্ত; আলস্যের কোমল বাঁধনে মন ও হাত বাঁধা...। এইসব দুর্নীতির বিশৃঙ্খলার মধ্যে আপনি কোন্‌ জিনিস প্রবেশ করাতে চান? আপনি কত নগণ্য, কত অসহায়। আপনাদের মতো আর ক’জনই বা আছে। ওঃ, যদি জ্বলন্ত হৃদয় ও শক্তিশালী সর্ব-ব্যাপ্ত মানসিকতা নিয়ে একজন কঠোর, প্রিয় ব্যক্তি আসতেন! লজ্জাকর নীরবতার এই দূষিত পরিবেশ যদি ভবিষ্যদ্বাণীতে মুখরিত হয়ে উঠতো, যদি তা ঘণ্টাধ্বনির মতো বাজতো, তবেই এই জীবন্মৃতদের ঘৃণ্য আত্মাগুলোকে কর্মচঞ্চল করে তোলা যেত...।’
এই কথাগুলো বলে সে দীর্ঘক্ষণ নীরব হয়ে রইলো। আমি আর তার দিকে তাকালাম না। এখন ঠিক মনে করতে পারছি না কোনটা বেশি অনুভব করছি—লজ্জা না ভয়।
‘আমাকে আপনার কি বলার আছে?’ একটি নিরপেক্ষ প্রশ্ন এলো।
‘কিছু বলার নেই।’ আমি উত্তর দিলাম।
আবার নীরবতা নেমে এলো।
‘তাহলে আপনি এখন বাঁচবেন কিভাবে?’
‘জানি না।’ উত্তর দিলাম।
‘আপনি কি বলবেন?’
আমি চুপ করে রইলাম।
‘নীরবতার চেয়ে অধিক জ্ঞানের আর কিছু নেই।’




এই কথাগুলো ও তার পরবর্তী হাসির মধ্যে সময়ের যে ফাঁকটুকু রয়েছে, তাতে গা জ্বলে যায়। সে খুশিভরে এমনভাবে হেসে উঠলো যেন বহুক্ষণ সে এতো খোলা মনে ও আনন্দের সাথে হাসবার সুযোগ পায়নি। কিন্তু সে জঘন্য হাসি আমার হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে দিল।
‘হাঃ, হাঃ! আর আপনিই হচ্ছেন কিনা জীবনের অন্যতম শিক্ষক, যে আপনি এতো সহজেই বিভ্রান্ত হয়ে যান? হাঃ, হাঃ, হাঃ... এবং যুবকবৃন্দ, আপনারা যারা জন্ম-বৃদ্ধ, আপনারা প্রত্যেকেই যদি আমার সাথে কথা বলতে রাজি হন, তাহলে একইভাবে বিভ্রান্ত হয়ে পড়বেন। যে মিথ্যা, গোঁয়ার্তুমি ও লজ্জাহীনতার বর্মে নিজেকে ঢেকে ফেলেছে, কেবল সে-ই তার নিজের বিবেকের বিচারের কাছে অবিচরিত থাকবে। সুতরাং এই হচ্ছে আপনাদের শক্তি—একটি মাত্র ধাক্কাতেই পতন। কি হলো, কিছু বলুন, আত্মরক্ষার জন্য কিছু বলুন; আমার কথা খণ্ডন করুন! লজ্জা ও অনুশোচনা থেকে নিজের মনকে মুক্ত করুন। ক্ষণিকের জন্য হলেও নিজের কিছু শক্তি ও আত্মপ্রত্যয়ের পরিচয় দিন, তা হলেই আমি আপনার মুখের উপরে যেসব কথা ছুড়ে দিয়েছিলাম সেসব ফিরিয়ে নেব। আমি আপনার কাছে মাথা নত করব। আপনি প্রমাণ করুন যে আপনার মধ্যে এমন একটা কিছু আছে, যার দ্বারা আমি আপনাকে শিক্ষক হিসাবে মেনে নিতে পারি। আমিও একজন শিক্ষক চাই, কারণ আমিও মানুষ; আমি জীবনের অন্ধকারে পথ হারিয়ে ফেলেছি। আলো, সত্য, সুন্দর ও নতুন জীবনের পথ খুঁজছি—পথ দেখান! আমিও একজন মানুষ। আমাকে মারুন, ঘৃণা করুন; কিন্তু জীবনের প্রতি এই উদাসীনতার পিচ্ছিল মাটি থেকে টেনে বার করে নিয়ে যান! আমি যা আছি তার থেকে ভালো হতে চাই। কি করে তা করা যায়? শিখিয়ে দিন কিভাবে সম্ভব!’
আমি ভাবি : এই লোকটা যেভাবে আমাকে তার দাবি পূরণ করতে বলছে, যথাযথভাবে কি তা আমি করতে পারি? আমি কি তা করতে পারবো? জীবন সম্পূর্ণরূপে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে, মানুষের মন ক্রমবর্ধমান সন্দেহে ছেয়ে গেছে। একটা রাস্তা খুঁজে বার করতেই হবে। কোথায় সেই রাস্তা? আমি শুধু এটুকুই জানি কেবল সুখের জন্যই কারো সচেষ্ট হলে চলবে না। কেন শুধু সুখের জন্য সচেষ্ট হওয়া? এর মধ্যে জীবনের উদ্দেশ্য নিহিত নেই এবং কম্পিত-আত্মতৃপ্তির দ্বারা মানুষ কখনই সন্তুষ্ট হবে না। অন্তত সে এর ঊর্ধ্বে। সুন্দর ও সাফল্যের শক্তির মধ্যেই জীবনের ধর্ম বিদ্যমান, আর আমাদের অস্তিত্বের প্রতিটি মুহূর্তেই থাকবে উচ্চ লক্ষ্য। তা হওয়া সম্ভব। কিন্তু জীবনের পুরাতন চৌহদ্দির মধ্যে নয়, কারণ তা এতোই সংকীর্ণ যে সেখানে সকলের সংকুলান হবে না, সেখানে মানবাত্মার কোনো স্বাধীনতা নেই...।
সে আবার হাসছে, কিন্তু এখন মৃদুভাবে; এ হাসি এমন একজন লোকের হাসি যার হৃদয় চিন্তায় ক্ষতবিক্ষত।
‘এ পৃথিবীতে কত লোক জন্মেছেন, অথচ মনে রাখবার মতো কোনো অবদান রেখে গেছেন এমন লোকের সংখ্যা কত কম! কেন এমন হলো? তবুও আসুন আমরা অতীতের জয়গান গাই—অতীত কতই না ঈর্ষা জাগ্রত করে। মৃত্যুর পরেও চিহ্ন রেখে যাবার মতো কেউ নেই। মানুষ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন—কেউ তাকে জাগাতে চায় না। ঘুমিয়ে থাকতে থাকতে সে পশুতে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। এখন দরকার চাবুক মারা এবং তারপর চাবুক রেখে উদ্দাম ভালোবাসা দেওয়া। তাকে আঘাত করতে ভয় পাবেন না; যদি ভালোবাসা দিয়ে আঘাত করেন সেও আপনার আঘাত বুঝতে পারবে এবং সেই আঘাতকে নিজের প্রাপ্য হিসাবেই নেবে। এবং যখন সে নিজের লজ্জা ও যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠবে, তখন তার প্রতি আন্তরিক যত্ন নিতে হবে, আর তখনই ঘটবে তার পুনর্জন্ম...। জনগণ? মাঝে মাঝে তাদের অপকর্ম ও চিন্তার বিকৃতির দ্বারা আমাদের বিস্মিত করলেও তারা এখনো শিশু। সর্বদাই তাদের ভালোবাসার, তাদের আত্মার জন্য সজীব ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যের জোগান দেওয়া প্রয়োজন...। আপনি কি মানুষকে ভালোবাসতে পারেন?’
‘মানুষকে ভালোবাসা?’ আমি সন্দেহভরে কথাটার পুনরুচ্চারণ করলাম, কারণ সত্যিই জানি না আমি তাদের ভালোবাসি কিনা। আর এখন একনিষ্ঠ হতে হবে—না, আমি জানি না। কে নিজের হয়ে বলতে পারে : আমি মানুষকে ভালোবাসি। যে কোনো লোক, যে নিজেকে সঠিকভাবে লক্ষ্য করে, এই প্রশ্নের উত্তরে হ্যাঁ বলতে গিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করবে। আমরা সকলেই জানি আমাদের আত্মীয়-স্বজনেরা প্রত্যেকের কাছ থেকে কত দূরে।
‘আপনি চুপ করে আছেন? কিন্তু যদিও আপনার বলার কিছুই নেই, আমি আপনাকে বুঝতে পারছি...। আর এখন আমি আপনার কাছ থেকে বিদায় নেব।’
‘এর মধ্যেই?’ আমি নম্রভাবে জিজ্ঞেস করলাম, কারণ তাকে ভয় পেলেও নিজেকে ভয় পাচ্ছি আরো অনেক বেশি।
‘হ্যাঁ, এখন আপনার কাছ থেকে বিদায় নেব...। আমি আবার আসবো এবং শুধু যে একবারই আসবো তা নয় কিন্তু। অপেক্ষা করুন!’
সে চলে গেল।
কিভাবে সে গেল? তাকে দেখতে পেলাম না। ছায়ার মতো দ্রুত, নিঃশব্দে মিলিয়ে গেল...। আমি বহুক্ষণ পার্কের বেঞ্চে বসে রইলাম। ঠাণ্ডার কথা খেয়াল নেই। সূর্য উঠেছে, গাছের বরফ-ঢাকা ডালপালার ওপর যে আলো ঝলমল করছে এই ঘটনার দিকেও খেয়াল নেই। এই পরিষ্কার দিনটি দেখে, আগের মতোই সূর্যের এই উদাসীন আলোর ছটা দেখে এবং সূর্যের আলোয় অসহনীয় ঝলমলে তুষারের কম্বলে ঢাকা এই প্রাচীন যন্ত্রণাক্লিষ্ট পৃথিবীকে দেখে আমার অচেনা লাগছে।