বগলার বঙ্গদর্শন - ঋত্বিককুমার ঘটক
ভূমিকা
ঋত্বিক ঘটকের অন্য ছবিগুলির সঙ্গে বগলার বঙ্গদর্শন’-এর কোনো মিল নেই। তবু এই নিখাদ বাঙালি মধ্যবিত্ত রূপকথার মধ্যে ঋত্বিকের যেন অন্য একটি সত্তার পরিচয় উঠে আসে। সেই সত্তা সিনেমার কল্পনায় ততটা মগ্ন নয় যতটা রসে-পরিহাসে-কৌতুকে বাংলা-বাঙালি একটা গল্প লেখা/বলার আগ্রহে প্রাণিত। তাই ছবিটি শেষ পর্যন্ত সম্পূৰ্ণ তৈরি না হয়ে উঠলেও এমন সুসম্পূর্ণ ও রমণীয় পাঠ্য চিত্ৰনাট্য লিখতেই যেন তিনি তার পরিপূর্ণ আনন্দ পেয়ে গেছেন—তাঁর পুরোনো ছােটাে গল্পেরই যেন উত্তরণ ঘটেছে। এই চিত্রনাট্যে যেখানে সিনেমায় কমেডির পরম্পরার পরিচিত একাধিক উপকরণ, এমনকী তার নিজের ছবিতে ব্যবহৃত প্রসঙ্গসূত্রও অবলীলায় এই চিত্রনাট্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়- আদি নির্বাক চলচ্চিত্রের সেই দুষ্টু ছেলের কাহিনি যে জলের পাইপ পা দিয়ে চেপে ধরে বিহবল মালিকে জলের তোড়ে সম্পূর্ণ ভিজিয়ে দেয়, তারই অনুষঙ্গে ভোরের কলকাতায় করপোরেশনের জল দেওয়ার ছবিটি সিনেমার পরম্পরার স্পর্শ পায়। আবার খবরের কাগজের বিশ্বব্যাপিতার অভিঘাত মধ্যবিত্ত গৃহস্থজীবনের অপরিসর পরিসরে যেভাবে সামান্য ধাক্কা দিয়েই আবার যেন অবাস্তর হয়ে যায়, তার নাটকীয়তা সিনেমারই ভাষায় ধরা পড়ে এক স্বয়ংসম্পূর্ণ দৃশ্যবিন্যাসে যার সূচনা বগলার মুখের উপর ছিটকে পড়া কাগজের হকার-এর ছুড়ে দেওয়া সকালের খবরের কাগজ, তারপর সেদিনকার চমকপ্ৰদ খবরের উন্মোচন- বড়ো হরফে ‘গাগারিনের আকাশ বিজয়’-আর দৃশ্য পরস্পরার অমোঘ পরিণতি, বাড়ি থেকে বগলার বেরোবার মুখে “পায়ে কী যেন ঠেকে খবরের কাগজখানা। ওটা তুলে নিয়ে গাগারিনের ছবিসমেত কাগজটাকে বারতিনেক মাথায় বুকে ঠেকায়। তারপর লক্ষ্মীর কুলুঙ্গির নীচে ওটাকে রেখে দেয়। গাগারিন লক্ষ্মীর দিকে তাকিয়ে হাসছে।” গাগারিনের মহাকাশযাত্রা, পাঠকের মনে পড়বে, ঋত্বিকবাবুর অন্য ছবিতেও ওই একই বৈপরীত্য-দূরত্বের দ্যোতনা বহন করে আনে। একটা বিরাট মুক্তি তথা ব্যাপ্তির পাশে কুষ্ঠিত, অবরুদ্ধ, খিন্ন মধ্যবিত্ত জীবনের বাস্তব ! অন্যত্র যা গ্লানিবিদ্ধ, এখানে তা অবশ্য কমেডির মেজাজে রসিকতা।
“বগলার বঙ্গদর্শন” কতটা সিনেমার ভাষায় সাহিত্য, আর কতটা সাহিত্যের ভাষায় সিনেমা, নাকি সাহিত্য ও সিনেমার অবিরাম মিথস্ক্রিয়া, সে-বিচার চলতেই পারে। সিনেমা কমেডির চালে এক-একটি জটিলতা বা বিরোধ-সংঘর্ষ সৃষ্টি করেই তার সহজ নিরসন বারবারই যে অপ্রত্যাশিত স্বস্তির মজা আনে, তাতে সচেতনভাবেই বাস্তবের যুক্তিসংগতি পরিহার করে কমেডির অবাস্তবকেই এই কাহিনির প্রাণধর্মীরূপে চিহ্নিত করা হয়। সিনেমার তথা চলচ্ছবির মধ্যে গতি ও সময় নিয়ে খেলার একটা প্রবণতা নিহিত আছে। সিনেমা অবলীলায় এক স্থান বা এক মুহূর্ত থেকে অন্য স্থান বা অন্য মুহূর্তে লাফ দিয়ে পৌছে যেতে পারে বলেই বারবারই তার মধ্যে স্থাপিত হয় ‘দৌড়ের’ বা বহু বাধা-ব্যাঘাত-বিপত্তি পেরিয়ে নির্দিষ্ট ক্ষণে কোথায়ও পৌঁছবার প্রাণান্ত দায়ে প্রাণপণ এক যাত্রা। গজেনের বাস-এর বেহিসেবি যাত্রায় সিনেমার সেই স্বভাবোচিত তাড়নায় গামছা ফেলে আসার অছিলায় বাড়িতে বাস ফিরিয়ে এনে পুত্রলাভের শুভ সংবাদ লাভ ও পরিণামে যাত্রীদের ক্ষমাসুন্দর উদযাপন যতটা সিনেমা তার চেয়ে বেশি সাহিত্য। এখানে সাহিত্য বলতে রূপকথা- যার প্রথম দ্যুতি এক ঝলকে উদভাসিত হয়ে ওঠে মেয়েটির আত্মপরিচয়দানে-নাম কাঞ্চনমালা, বাস নয়নসুখ গ্রামে, বড়ো নদী পড়বে পথে— অঞ্জনাতারই ধারে।”
যে-জটিলতাগুলো তৈরি হয় এবং যেভাবে তাদের নিম্পত্তি হয়, তার কোনোটাই বাস্তবসম্মত নয়। এসবই যেন ঋত্বিকবাবুর সেই বড়োই প্রিয় সুবচনীর হাঁসের জগতের ব্যাপার। কাঞ্চনমালার বাবা-দাদু-দিদিমার চরিত্রের একরোখা একমাত্রিকতার বিরোধে আবার সেই সিনেমা কমেডিরই সহজাত বিবাদী মানসিকতার টঙ্কারবাজি! শহরগ্রামের মধ্যে অপরিচয়ের দূরত্ব থেকে একটা রোম্যান্টিকতার- তার সঙ্গে আবার খানিকটা চাল-চালিয়াতিরও— খেলার মধ্যে সামান্য একটু প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গ আছে- বিশেষত বগলার ‘মেঘনা নদীর ডাকের উপাখ্যানে।
বাংলায় কমেডি ছবির দৈন্যের মধ্যে ‘বগলার বঙ্গদর্শন’ হয়তো দিকচিহ্নই হত। হল না আমাদের হাতে রয়ে গেল। এই চিত্ৰনাট্য- আর কয়েকটি দৃশ্যমাত্র ও দুটি গান— যা ঋতবান সম্পাদনা করে জোড়া লাগিয়েছেন।
এই অনুনিবন্ধটি যখন সম্পূর্ণ করে এনেছি তখনই ঋতবান খবর দিলেন, ‘বগলার বঙ্গদর্শনের’ উৎস নিহিত আছে একটি ইতালীয় ছবির মধ্যে- ১৯৪২ সালে নির্মিত আলেসান্দ্ৰো ব্লাসেত্তির ‘কাত্রো পাসসি ফ্রা
লে নুভোলে’ (‘মেঘের মধ্যে চার পা হাঁটাহাঁটি”)। এ ছবিতেও ছিল ট্র্যাভেলিং সেলসম্যানের গ্রামদেশে গিয়ে একটি ঘর পালানো মেয়েকে বাড়িতে ফিরিয়ে দেবার গল্প। দেখিনি এ ছবি। তাই এই যোগাযোগ নিয়ে কিছু বলব না। বিশেষত যখন জানি, ব্লাসেত্তি ছিলেন ফ্যাশিস্ত-শাসিত ইতালির সবচেয়ে সরকারমান্য ও সরকারি মদতপুষ্ট চিত্রপরিচালক। র্তার “দি ওলড় গার্ড’ (১৯৩৫) ফ্যাশিস্ত চলচ্চিত্রের কীর্তি বলেই গণ্য, তার ছবির গুণগ্ৰাহী ভক্তদের মধ্যে স্বয়ং হিটলারের অবস্থান প্রমাণিত। “জনপ্রিয়’ সিনেমা কীভাবে ফ্যাশিবাদের বাহন হয়, তা নিয়ে জেমস হের (দ্র, ‘পপুলার ফিলম কালচার ইন ফ্যাশিস্ট ইটালি', ব্লমিংটন/ইনডিয়ানাপলিস ১৯৮৭) চর্চা ও গবেষণার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বরং ভাবব, ঋত্বিকবাবুর লক্ষ্য ছিল অন্য কোনোখানে।
ভূমিকা
ঋত্বিক ঘটকের অন্য ছবিগুলির সঙ্গে বগলার বঙ্গদর্শন’-এর কোনো মিল নেই। তবু এই নিখাদ বাঙালি মধ্যবিত্ত রূপকথার মধ্যে ঋত্বিকের যেন অন্য একটি সত্তার পরিচয় উঠে আসে। সেই সত্তা সিনেমার কল্পনায় ততটা মগ্ন নয় যতটা রসে-পরিহাসে-কৌতুকে বাংলা-বাঙালি একটা গল্প লেখা/বলার আগ্রহে প্রাণিত। তাই ছবিটি শেষ পর্যন্ত সম্পূৰ্ণ তৈরি না হয়ে উঠলেও এমন সুসম্পূর্ণ ও রমণীয় পাঠ্য চিত্ৰনাট্য লিখতেই যেন তিনি তার পরিপূর্ণ আনন্দ পেয়ে গেছেন—তাঁর পুরোনো ছােটাে গল্পেরই যেন উত্তরণ ঘটেছে। এই চিত্রনাট্যে যেখানে সিনেমায় কমেডির পরম্পরার পরিচিত একাধিক উপকরণ, এমনকী তার নিজের ছবিতে ব্যবহৃত প্রসঙ্গসূত্রও অবলীলায় এই চিত্রনাট্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়- আদি নির্বাক চলচ্চিত্রের সেই দুষ্টু ছেলের কাহিনি যে জলের পাইপ পা দিয়ে চেপে ধরে বিহবল মালিকে জলের তোড়ে সম্পূর্ণ ভিজিয়ে দেয়, তারই অনুষঙ্গে ভোরের কলকাতায় করপোরেশনের জল দেওয়ার ছবিটি সিনেমার পরম্পরার স্পর্শ পায়। আবার খবরের কাগজের বিশ্বব্যাপিতার অভিঘাত মধ্যবিত্ত গৃহস্থজীবনের অপরিসর পরিসরে যেভাবে সামান্য ধাক্কা দিয়েই আবার যেন অবাস্তর হয়ে যায়, তার নাটকীয়তা সিনেমারই ভাষায় ধরা পড়ে এক স্বয়ংসম্পূর্ণ দৃশ্যবিন্যাসে যার সূচনা বগলার মুখের উপর ছিটকে পড়া কাগজের হকার-এর ছুড়ে দেওয়া সকালের খবরের কাগজ, তারপর সেদিনকার চমকপ্ৰদ খবরের উন্মোচন- বড়ো হরফে ‘গাগারিনের আকাশ বিজয়’-আর দৃশ্য পরস্পরার অমোঘ পরিণতি, বাড়ি থেকে বগলার বেরোবার মুখে “পায়ে কী যেন ঠেকে খবরের কাগজখানা। ওটা তুলে নিয়ে গাগারিনের ছবিসমেত কাগজটাকে বারতিনেক মাথায় বুকে ঠেকায়। তারপর লক্ষ্মীর কুলুঙ্গির নীচে ওটাকে রেখে দেয়। গাগারিন লক্ষ্মীর দিকে তাকিয়ে হাসছে।” গাগারিনের মহাকাশযাত্রা, পাঠকের মনে পড়বে, ঋত্বিকবাবুর অন্য ছবিতেও ওই একই বৈপরীত্য-দূরত্বের দ্যোতনা বহন করে আনে। একটা বিরাট মুক্তি তথা ব্যাপ্তির পাশে কুষ্ঠিত, অবরুদ্ধ, খিন্ন মধ্যবিত্ত জীবনের বাস্তব ! অন্যত্র যা গ্লানিবিদ্ধ, এখানে তা অবশ্য কমেডির মেজাজে রসিকতা।
“বগলার বঙ্গদর্শন” কতটা সিনেমার ভাষায় সাহিত্য, আর কতটা সাহিত্যের ভাষায় সিনেমা, নাকি সাহিত্য ও সিনেমার অবিরাম মিথস্ক্রিয়া, সে-বিচার চলতেই পারে। সিনেমা কমেডির চালে এক-একটি জটিলতা বা বিরোধ-সংঘর্ষ সৃষ্টি করেই তার সহজ নিরসন বারবারই যে অপ্রত্যাশিত স্বস্তির মজা আনে, তাতে সচেতনভাবেই বাস্তবের যুক্তিসংগতি পরিহার করে কমেডির অবাস্তবকেই এই কাহিনির প্রাণধর্মীরূপে চিহ্নিত করা হয়। সিনেমার তথা চলচ্ছবির মধ্যে গতি ও সময় নিয়ে খেলার একটা প্রবণতা নিহিত আছে। সিনেমা অবলীলায় এক স্থান বা এক মুহূর্ত থেকে অন্য স্থান বা অন্য মুহূর্তে লাফ দিয়ে পৌছে যেতে পারে বলেই বারবারই তার মধ্যে স্থাপিত হয় ‘দৌড়ের’ বা বহু বাধা-ব্যাঘাত-বিপত্তি পেরিয়ে নির্দিষ্ট ক্ষণে কোথায়ও পৌঁছবার প্রাণান্ত দায়ে প্রাণপণ এক যাত্রা। গজেনের বাস-এর বেহিসেবি যাত্রায় সিনেমার সেই স্বভাবোচিত তাড়নায় গামছা ফেলে আসার অছিলায় বাড়িতে বাস ফিরিয়ে এনে পুত্রলাভের শুভ সংবাদ লাভ ও পরিণামে যাত্রীদের ক্ষমাসুন্দর উদযাপন যতটা সিনেমা তার চেয়ে বেশি সাহিত্য। এখানে সাহিত্য বলতে রূপকথা- যার প্রথম দ্যুতি এক ঝলকে উদভাসিত হয়ে ওঠে মেয়েটির আত্মপরিচয়দানে-নাম কাঞ্চনমালা, বাস নয়নসুখ গ্রামে, বড়ো নদী পড়বে পথে— অঞ্জনাতারই ধারে।”
যে-জটিলতাগুলো তৈরি হয় এবং যেভাবে তাদের নিম্পত্তি হয়, তার কোনোটাই বাস্তবসম্মত নয়। এসবই যেন ঋত্বিকবাবুর সেই বড়োই প্রিয় সুবচনীর হাঁসের জগতের ব্যাপার। কাঞ্চনমালার বাবা-দাদু-দিদিমার চরিত্রের একরোখা একমাত্রিকতার বিরোধে আবার সেই সিনেমা কমেডিরই সহজাত বিবাদী মানসিকতার টঙ্কারবাজি! শহরগ্রামের মধ্যে অপরিচয়ের দূরত্ব থেকে একটা রোম্যান্টিকতার- তার সঙ্গে আবার খানিকটা চাল-চালিয়াতিরও— খেলার মধ্যে সামান্য একটু প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গ আছে- বিশেষত বগলার ‘মেঘনা নদীর ডাকের উপাখ্যানে।
বাংলায় কমেডি ছবির দৈন্যের মধ্যে ‘বগলার বঙ্গদর্শন’ হয়তো দিকচিহ্নই হত। হল না আমাদের হাতে রয়ে গেল। এই চিত্ৰনাট্য- আর কয়েকটি দৃশ্যমাত্র ও দুটি গান— যা ঋতবান সম্পাদনা করে জোড়া লাগিয়েছেন।
এই অনুনিবন্ধটি যখন সম্পূর্ণ করে এনেছি তখনই ঋতবান খবর দিলেন, ‘বগলার বঙ্গদর্শনের’ উৎস নিহিত আছে একটি ইতালীয় ছবির মধ্যে- ১৯৪২ সালে নির্মিত আলেসান্দ্ৰো ব্লাসেত্তির ‘কাত্রো পাসসি ফ্রা
লে নুভোলে’ (‘মেঘের মধ্যে চার পা হাঁটাহাঁটি”)। এ ছবিতেও ছিল ট্র্যাভেলিং সেলসম্যানের গ্রামদেশে গিয়ে একটি ঘর পালানো মেয়েকে বাড়িতে ফিরিয়ে দেবার গল্প। দেখিনি এ ছবি। তাই এই যোগাযোগ নিয়ে কিছু বলব না। বিশেষত যখন জানি, ব্লাসেত্তি ছিলেন ফ্যাশিস্ত-শাসিত ইতালির সবচেয়ে সরকারমান্য ও সরকারি মদতপুষ্ট চিত্রপরিচালক। র্তার “দি ওলড় গার্ড’ (১৯৩৫) ফ্যাশিস্ত চলচ্চিত্রের কীর্তি বলেই গণ্য, তার ছবির গুণগ্ৰাহী ভক্তদের মধ্যে স্বয়ং হিটলারের অবস্থান প্রমাণিত। “জনপ্রিয়’ সিনেমা কীভাবে ফ্যাশিবাদের বাহন হয়, তা নিয়ে জেমস হের (দ্র, ‘পপুলার ফিলম কালচার ইন ফ্যাশিস্ট ইটালি', ব্লমিংটন/ইনডিয়ানাপলিস ১৯৮৭) চর্চা ও গবেষণার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বরং ভাবব, ঋত্বিকবাবুর লক্ষ্য ছিল অন্য কোনোখানে।