Ticker

6/recent/ticker-posts

সকল গৃহ হারালো যার - তসলিমা নাসরিন

সকল গৃহ হারালো যার - তসলিমা নাসরিন
সকল গৃহ হারালো যার - তসলিমা নাসরিন

কলাম সমগ্র তসলিমা নাসরিনের। নাম তার ‘সকল গৃহ হারালো যার’- কবিতার মতো, চুল খোলা শোকের মতো; শোক তার দীর্ঘ চুল খোলে, বিছিয়ে দেয় পূর্ণিমায় নীরবতা, অমাবশ্যায় আর্তনাদ।

গ্রন্থের নামকরণ, সকল গৃহ হারালো যার, এখানে ক্রিয়ার সমাপিকা-অসমাপিকা অনুপস্থিত অথচ রয়েছে বিস্তারিত প্রকাশ অথবা অজস্র সূচি মুখ। বড় অপরাধী হয়ে দেখি জেনানা ফাটক। হয়তো আপে, মনস্তাপ, দুঃখ-শোক, হাহাকার রুদ্ধমান হয়ে রয়েছে তবু শব্দের পরপর স্থাপনা ছোবল দিয়ে ওঠে; উষ্মা ও ক্রোধের বরফ ঠাণ্ডা প্রলেপে প্রতিফলিত তার কলমে।

তখন ছিল আশির দশক – অসহ-বিসহ এক সময় এসেছিল আমাদের জীবনে। ক্যান্টনমেন্ট থেকে গণতন্ত্র শিক্ষা দেয়ার, জনগণকে অধ্যয়নে নিযুক্ত করার যে অপরিষ্কার সংস্কৃতি রক্ত ও অনলে, মৃত্যু ও স্তব্ধতার মধ্য দিয়ে ইত্যবসরে জারী হয়েছিল সম্প্রসারিত আরেক পর্বে উর্দিঅলা স্বৈরতন্ত্রে। বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে তখন এই দেশ।

সেই অকালে বোধন হয়েছিল নতুন গতিতে আরেক সশস্ত্র সুন্দর ভাষিক কলরোল, জন জাগানিয়া এবং চৈতন্য নির্ঘোষিত রাজনৈতিক কলাম নামে মুখরিত সেই এক প্রত্যাঘাত লিপি।

আমরা মনে করতে পারব হুমায়ুন আজাদ, শফিক রেহমান, মিনার মাহমুদ, তসলিমা নাসরিন প্রমুখদের। এখন অনেকে কার্টুন হয়ে গেছে, নাম তোলা রইল আবার কারো নাম দাগানো থাকল কিন্তু তার মধ্যে শেষ তক লড়ে যাচ্ছেন তসলিমা; মৃত্যু আলিঙ্গন করেছে মিনার মাহমুদকে আর স্বাধীন কথা প্রকাশের দায়ে ১৯৭১-এর ১৪ ডিসেম্বরের পর শহীদ হয়েছিলেন হুমায়ুন আজাদ।

হঠকারীতা পূর্ণ খুনীর দলের প্রতিনিধি বংশ বিস্তার করে বহাল তবিয়তে দেশে বিচরণশীল, তাদের নানা তকমা ও জার্সি অথচ মূল সুর একমাত্র, আদি ও অকৃত্রিম, এমন কি অদ্বিতীয় নির্মূলকরণ অভিপ্রায়ে হত্যা পুজিত রক্তোৎসব।

হায়! আক্রমণকারীরা সগৌরবে অস্তিত্ববান আর জ্যামিতিক হারে বর্ধিত ও সংস্কারপ্রাপ্ত। স্বাধীন কথা প্রকাশের দায়ে নিহত ও গৃহচ্যূত মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে এখন কোথাও দেখি না তাদের পাই না অন্য ঘরে অন্য স্বর রচিত করার ক্ষণকাল বরং পাই নিরাপদ তন্দ্রামগ্ন অথচ জন্মদানকারী মানুষময় মানচিত্র। উদ্বৃত্ব জনগণও কম নয় এই মরার দেশে।

জঙ্গী আসছে, যাচ্ছে; দশ ট্রাক অস্ত্র আসছে; আর্জেস গ্রেনেড আসছে কিন্তু তার চেয়েও বিপজ্জনক বুঝি বা স্বাধীনতা ও স্বাধীন চিন্তা, কথা বলা ও সমাজ চিকিৎসা, অবিচারের সমীক্ষা, মিলিত কণ্ঠের বজ্রে ঘোষিত বাঁশী।

উপরন্তু নারী বলে কথা। দুই উরুর মাঝে তার অবস্থান অথচ সেই নাকি এক নারী ছিল যে কিনা দুই উরুর মধ্যবর্তী পুরুষকার নিয়ে বিদ্রুপে ধ্বনিত এবং প্রশ্নপত্র ফাঁসের চেয়েও ভয়ঙ্করভাবে আবার কিনা ফাঁস করে দিচ্ছে পুরুষকার এবং তজ্জনিত মন্ত্র-তন্ত্রের জারিজুরি, হক্কিকত- লুঙ্গি খুলে নিয়ে মাথায় গামছা পরিয়ে দিয়ে গেল।

কাকে কান নিয়ে গেছে। সকলে দৌঁড়াচ্ছে। কার কান, কী কান, কোন কান? দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে উত্তর জানার সময় নাই। কী যে করেছে, কে মেরেছে, কে বকেছে – হুশ নাই, মান + হুশের- এমনি বিপন্নতা তাদের মধ্যে চাড়িয়ে দেয়া হয়েছে যে, পাকস্থলি ও মল ভাণ্ডার পরিপূর্ণ করাসহ সংযোজিত উত্তম কাজটি হলো, যেন কান টানলে মাথা আসবে বলে এই এখন ‘তুমি আসবে বলে’ কান মর্দন করতে করতে কাকের পেছনে দৌঁড়। যে শহর কাকহারা, – খবর নাই, চোখে দেখা যায় না তবু নিত্য কাকের উৎপাদন ও কান পাকড়ানোর দৌঁড়, হৃদয়ে কখন যেন কাউয়া বসবাস করে তাদের- প্রকৃতির চাঁদ কাকে যেন কাঁচকলা দেখিয়ে দুটো হয়ে গেছে যথা, সাঈদীর চাঁদ আর অপরটা আদি চাঁদ। না, আদি মরণ চাঁদ নয়, এক নম্বর খাটি চাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বি চাঁদ মামা যে কত প্রকার ও কী কী ভাবে স্বাধীন মত প্রকাশের গাছপালা হয়েও দিব্যি হলি আর্টিজান পর্যন্ত নিষ্পন্ন করে বাচ্চা ভূত-ডিম ভূত থেকে ভূতের দাম্পত্য ও যৌনতার, মৌনতার ও সরবতায়, রক্ত-ঝরনার স্বপ্ন নিয়ে Fly to heaven হয়ে বসে পড়েছে।

স্বৈরাচারের দিনগুলোতে কবিতার অর যেমন প্রতিবাদে ভাস্বর ছিল তেমনি সাহিত্যিক-সাংবাদিকরা প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে পেয়েছিলেন রাজনৈতিক কলামে এবং ঘটে গেল যেন মুক্তির পিপাসায় অগ্নির জল।

অপরাপরসহ তসলিমা নাসরিনকেও স্বৈরাচার বিরোধী সাক্ষাতে নয় বরং যেখানে অন্ধত্ব ও আস্ফালন- আনাচে কানাচে যে কোনও অপ্রিয়তায় ও প্রিয়কে ভালোবাসায়।

আবার বুঝিবা বাংলার প্রান্তর থেকে রৌদ্র উধাও হয়ে যাচ্ছে- শকুনের ডানায় অন্ধকার পিশাচী হয়ে উঠেছে- সময়ের নতুন যোদ্ধাদের সঙ্গে সেই প্রাচীনা আগুন তাতানো কলমে ঝলকিত ও বর্ষিত থাকল পেট্রল দিয়ে আগুন নেভানোর শিল্প।

তার লেখা, এই রাজনৈতিক কলাম নবোদ্যমে বাংলাদেশের স্থানীয় কাগজে ছাপা হয়েছে। সেখান থেকে নির্বাচিত কলাম নিয়ে এই গ্রন্থিত রূপঃ সকল গৃহ হারালো যার।

আরও হতবাক করেছে যে, সম্মানের সঙ্গে হুজুর ডাকে সমাজে যাদের অবস্থান, অনেকেই গ্রন্থ প্রকাশের পর হতে মেলায় শ্রাবণ স্টলে ভীড় করে বইটির পাতা উল্টেছেন; কিনেছেন অনেকে, শ্রাবণের থেকে অতিরিক্ত মূল্য ছাড়ও তাদের অভিনন্দিত করেছে। তারা খোশ হয়েছেন।

উপন্যাস লিখেছিলেন। নামটি মনে আসছে না তবে সেই বিশেষ রচনাটিকে কেন্দ্র করে নানা ইন্ধন ও ইত্যকার কূটচালে তাকে নির্বাসন দণ্ড প্রদানের একটি পথ তৈরি হয়েছিল। এখন যেসব সংঘটিত হচ্ছে, তসলিমা তা আগে-ভাগেই তার কাহিনীতে সেই উপন্যাসে বিন্যস্ত করেছিলেন বলেই তাকে নিজভূমে নির্বাসন থেকে অগত্যা জগতময় হওয়ার প্রেতি সৃষ্টি হয়ে গেল। অথচ এ কথা তো কারচুপি করেও অপ্রকাশিত রাখা যাচ্ছে না যে, এই দেশে একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর ১০% এই দেশের মোট জনসংখ্যা হতে অদৃশ্য হয়ে গেছে। দেশান্তরী হতে বাধ্য হয়েছেন। কী কারণে এমন ঘটেছিল- এখনও সেই প্রক্রিয়া চলমান- তা সুজন-দুর্জন কারো অজানা নয়।

তসলিমা এবং সকল সুবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষও যে আশ্চর্যভাবে সংখ্যালঘু হয়ে যাচ্ছে তথাকথিত ধর্ম অনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে- তা আজ অশেষ সত্য। ফলে সংখ্যালঘু আরেক মানুষ শুধুমাত্র উচিৎ বৃত্তান্ত রচনার জন্য বিভীষিকা মাথায় করে নিজ বাসভূমি হতে বহিস্কৃত হয়েছিলেন। তখন রোধ করা গেলে এবং তসলিমাকে রাষ্ট্র না দাবড়ালে বাংলাদেশের মাটিতে এই যে ২০১৪ থেকে আজ পর্যন্ত সংঘটিত দুষ্ক্রীতি থাকত না।

তবে ফলাফল সাধু, তসলিমার জন্য, এই কারণে যে, তিনি বৃহত্তর পরিসরে তার চিন্তা ও মননশীলতাকে উপস্থাপন করতে পেরেছেন।

তিনি কেবল সমাজ ও রাষ্ট্রকে চিকিৎসাও শুশ্রুষার ব্রত অবলম্বন করেন নাই তখন বরং অত্যন্ত মেধাবী শিক্ষার্থী তিনি চিকিৎসা শাস্ত্রের ডিগ্রী গ্রহণ করেছিলেন। তাকে স্বদেশচ্যূত করার মধ্য দিয়ে গরীব মানুষকে চিকিৎসা সেবাদানের সুযোগ এবং দেশের মানুষের জন্য চিকিৎসিত হওয়ার অবকাশটুকুও লুঠ করা হয়েছে।

দেশের গরীর-দু:খী মানুষের টাকায় একজন চিকিৎসক তৈরি হয় ফলে সেই সব মানুষের পক্ষে চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার যেমন থাকে তেমনি স্বদেশের মাটিতে তার চিকিৎসা সেবা প্রদানের সাংবিধানিক নায্যতাকেও দৃঢ় স্থিত। তোয়াক্কা করা হয় নাই এসব। হচ্ছেও না।

এই প্রসঙ্গ উল্লে­খযোগ্য, কারণ, তার সরকারি চাকুরে হিসেবে ভারত ভ্রমণ অপরাধ হয়ে উঠেছিল তখন। তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত এবং তিনিও বাধ্য হয়ে সরকারী দায়িত্ব হতে নিজেকে প্রত্যাহার করেন। তিনি চাকরি পরিত্যাগ করে সরকারের ইচ্ছাকে স্বস্তি না দিয়ে বিকল্প চোখের সামনে দৃশ্যমান পান নাই। পাওয়া সম্ভব ছিল না।

সূত্রঃ সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ
Channeli Online