Ticker

6/recent/ticker-posts

আবুল হাসান রচনাসমগ্র

আবুল হাসান রচনাসমগ্র
আবুল হাসান রচনাসমগ্র

“আবুল হাসান মাত্র ২৯ বছর বয়সে মারা যান। তাঁর মৃত্যু আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ক্ষীণায়ু জন কীটস্ এবং সুকান্ত ভট্টাচার্যের কথা। জানি না, কত বছর বয়সে তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেন। তাঁর কবিজীবন দীর্ঘ নয়। তাঁর সংক্ষিপ্ত কাব্যচর্চা আমাদের উপহার দিয়েছে ‘রাজা যায় রাজা আসে’, ‘যে তুমি হরণ করাে এবং ‘পৃথক পালঙ্ক’-এর মতাে তিনটি উজ্জ্বল কাব্যগ্রন্থ। তাছাড়া তাঁর অগ্রন্থিত কবিতার সংখ্যাও কম নয়।”
এই রকম একটি ভূমিকা লিখেছেন কবি শামসুর রহমান। আসুন ভূমিকাটি পড়ি। সাথে বইয়ের লিঙ্কটিও দেওয়া রইলো।

ভূমিকা

পঞ্চাশের দশকের কয়েকজন কবি বাংলাদেশের কবিতার নতুন জমি তৈরি করলেন, আবাদ করলেন সেই জমি মেধা ও শ্রমে। এই জমিতে পা রেখেই ষাটের দশকের সিকদার আমিনুল হক, রফিক আজাদ এবং আবদুল মান্নান সৈয়দ বিশিষ্টতা অর্জন করেন। তাঁদের আবির্ভাবের পরই সানাউল হক খান, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা এবং অকালপ্রয়াত আবুল হাসানের কাব্যশস্য হিলহিলিয়ে ওঠে। সর্বপ্রথম আবুল হাসানের কবিতা পড়ি ‘সংবাদ’-এর সাহিত্য সাময়িকীতে। সেই বৈশিষ্ট্যহীন কবিতার লেখকের নাম ছিল আবুল হােসেন। তখন আবুল হাসান আবুল হােসেন নাম লিখতেন। বােধহয় সেটাই ছিল তাঁর পিতৃদত্ত নাম। অল্প দিনের মধ্যেই হাসানের মনে পড়ে যায় যে, চল্লিশের দশকের একজন বিখ্যাত কবির নামও আবুল হােসেন। তাই তিনি হােসেন থেকে হাসান-এ রূপান্তরিত হলেন। এই নাম পরিবর্তনের পর তাঁর কবিতাও বদলে যেতে লাগলাে। একজন খাটি কবির জন্ম হলাে। এই কবির জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কবিতায় ভরপুর ছিল। যেন হাওয়ায়, ধূলােয়, গাছের পাতায়, পাখির ডানায়, নদীর জলে, দিনের কোলাহলে, রাত্রির নিস্তব্ধতায় তিনি কবিতা পেয়ে যেতেন অবলীলায়। যিনি সর্বক্ষণ কবিতার ধ্যানে মগ্ন নন তার পক্ষে অসম্ভব এই কবিতা-আহরণ।

আবুল হাসান মাত্র ২৯ বছর বয়সে মারা যান। তাঁর মৃত্যু আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ক্ষীণায়ু জন কীটস্ এবং সুকান্ত ভট্টাচার্যের কথা। জানি না, কত বছর বয়সে তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেন। তাঁর কবিজীবন দীর্ঘ নয়। তাঁর সংক্ষিপ্ত কাব্যচর্চা আমাদের উপহার দিয়েছে ‘রাজা যায় রাজা আসে’, ‘যে তুমি হরণ করাে এবং ‘পৃথক পালঙ্ক’-এর মতাে তিনটি উজ্জ্বল কাব্যগ্রন্থ। তাছাড়া তাঁর অগ্রন্থিত কবিতার সংখ্যাও কম নয়। আবুল হাসান যেসব কবিতা গ্রন্থভুক্ত করেন নি সেগুলােতেও হাসানীয় বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান।

আবুল হাসান বরিশালে জন্মগ্রহণ করে। তাঁর শৈশব কেটেছে বরিশালের মনােমুগ্ধকর নৈসর্গিক পরিবেশে। সেখানকার গাছগাছালি, নদীনালাকে তিনি উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেছেন তাঁর কবিতায়, যেমন করেছেন ঢাকা বাসের অভিজ্ঞতাকে । গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনের মিলিত অভিজ্ঞতা তাঁর কবিতাকে বর্ণাঢ্য, সমৃদ্ধ করেছে। তাঁর কবিতা সহজেই পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করে। গােড়ার দিকে তাঁর কবিতায় জীবনানন্দ দাশ এবং আরাে কোনাে কোনাে কবির ছায়া লক্ষ করা গেছে। অনুজ কবির উপর অগ্রজ কবির প্রভাব পড়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারণ কোনাে কবিই ভুইফোড় কিছু নন। একটি ধারাবাহিকতার অন্তর্গত তিনি; অতীতের কাব্যকৃতি একজন নতুন কবিকে তার শিল্পসৃষ্টির পক্ষে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। নতুন কবি তার নিজস্ব এলাকা সৃষ্টি করেন পূর্বসূরীদের অর্জনকে কাজে লাগিয়ে, তাঁদের কাব্যকলার কাঠামােয় বন্দী হয়ে নয়। নিজের কণ্ঠস্বর খুঁজে পেতে হয় তাকে। আবুল হাসান তার নিজের কণ্ঠস্বর খুঁজে পান প্রাথমিক অনুশীলনের প্রক্রিয়ার মধ্য থেকেই।

আবুল হাসান মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত কবি, কবি ছাড়া আর কিছুই নন। তাঁর প্রতিটি নিঃশ্বাসে বয়ে গেছে কবিতা। তাঁর এলােমেলাে জীবনের ছাপ পড়েছে তার কবিতাতেও। এই এলােমেলােমি তাঁর কবিতার দুর্বলতা এবং শক্তি। আবুল হাসানের কবিতার আপাত-অসংলগ্নতা এমনই হৃদয়গ্রাহী যে পাঠক অভিভূত হয়ে পড়েন। তাই, তরুণ কবিদের কাছে তিনি এত প্রিয়। যখন কোনাে কোনাে তরুণ কবির রচনায় আবুল হাসানের পংক্তিমালার ছায়া দেখতে পাই, তখন বিস্মিত হই না। তিনি যৌবনের বিষন্নতা, নৈঃসঙ্গ্য এবং দীর্ঘশ্বাসের কবি। তাঁর শিল্প-সৌন্দর্য বােধ যেমন তীক্ষ্ণ তেমনি তীব্র মানুষের প্রতি তাঁর মমতা, জীবনের প্রতি ভালােবাসা। কবি-সমালােচক আবু হেনা মােস্তফা কামাল যথার্থই বলেছেন, “চূড়ান্ত ব্যবচ্ছেদ করলে তাঁর (আবুল হাসানের) ভেতরে মায়া ও মমতা, মানুষের জন্যে দুঃখবােধ ছাড়া আর কিছু পাওয়া যাবে না।” একজন সত্যিকারের কবিই তাে যীশু খৃষ্টের মতাে সকল মানুষের হয়ে দুঃখ পান।

আবুল হাসান তাঁর একটি কবিতায় বলেছেন, “শিল্প তাে নিরাশ্রয় করে না। কাউকে দুঃখ দেয় না।” সেই একই কবিতায় তিনি লেখেন,
“শিল্প তাে স্বাতীর বুকে মানবিক হৃৎপিণ্ড,
তাই আমি তার হৃৎপিণ্ডে যাই চিরকাল রক্তে আমি
শান্তি আর শিল্পের মানুষ।”

হ্যা, তিনি শান্তি আর শিল্পের মানুষ, সর্বোপরি মানবপ্রেমী প্রকৃত কবি । এজন্যেই তাঁর রচনা সমগ্র আমাদের অবশ্যপাঠ্য। একজন কবির মূল্যায়নের জন্যে তাঁর প্রধান এবং গৌণ সকল রচনাই পড়া প্রয়ােজন। কখনাে কখনাে গৌণ রচনাতেও কবির কোনাে বিশেষ দিক প্রতিফলিত, যা তাঁর পাঠকদের জানা খুবই জরুরি। বাংলাদেশের কাব্যমানচিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকার অধিকারী আবুল হাসান তার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও। আমরা যারা তাঁর কবিতার গুণমুগ্ধ পাঠক তারা জানি, তিনি ক্রমশ পরিণতির দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। এই পরিণতির স্বাক্ষর বহন করছে আবুল হাসানের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘পৃথক পালঙ্ক’। এই ‘পৃথক পালঙ্ক’ তাঁর কবিতার স্বাতন্ত্রের পরিচায়ক। তিনি চিরদিন ‘পৃথক পালঙ্ক’-এ-সমাসীন থাকবেন।

বিদ্যাপ্রকাশ এই অকালমৃত কবির রচনা সমগ্র প্রকাশ করে পাঠক সমাজের কৃতজ্ঞতা ভাজন হয়েছেন। আমরা বিদ্যাপ্রকাশের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। আমার এই ক্ষুদ্র রচনা আবুল হাসানের কবিকৃতির প্রতি সুবিচার করতে পারে নি। এখানে আমি একজন সতীর্থ হিসেবে তাঁর কবিতার প্রতি আমার অনুরাগ প্রকাশ করেছি মাত্র, এর বেশি কিছু নয়। কবি বিষয়ে আলােচনা পাঠের চেয়ে তাঁর কবিতাবলী নিবিষ্ট চিত্তে পাঠ করাই বেশি জরুরি। বাংলাদেশের কবিগােষ্ঠীর যাঁদের কবিতা আমৃত্যু বার বার পড়বাে, আবুল হাসান নিঃসন্দেহে তাঁদের অন্যতম।

তারিখ ২৬.০১.৯৪
শামসুর রাহমান