Ticker

6/recent/ticker-posts

বিদ্রোহী রণক্লান্ত নজরুল-জীবনী গোলাম মুরশিদ

বিদ্রোহী রণক্লান্ত নজরুল-জীবনী গোলাম মুরশিদ
আমার নজরুল-জীবনী
‘বিদ্রোহী রণক্লান্ত’
গোলাম মুরশিদ
‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশিত হওয়ার পর কবি অনেকের কাছ থেকেই ‘কাফের’, ‘নমরুদ’, ‘শয়তান’ ইত্যাদি উপাধি পেয়েছিলেন। বহু বছর ধরে নিন্দার সেই ঢেউটা ফিরে ফিরে তাঁকে আঘাত করেছে। গোলাম মোস্তফা তখন ‘বিদ্রোহী’ কবিকে ‘সংযত’ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে কবিতা লিখেছিলেন। তারপর, কিমাশ্চর্যম! যখন দেশ বিভাগ হলো, তখন সেই কাফের নজরুলকে নিয়েই পূর্ব পাকিস্তানে গর্ব করার, তাঁকে রবীন্দ্রনাথের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর একটা প্রবণতা দেখা দিল। এমনকি সেই পরিবেশে গোলাম মোস্তফা আগের অবস্থান থেকে সরে এসে নতুন করে বিবেচনা করলেন যে নজরুল পুরোপুরি কাফের নন, তিনি হাফ-মুসলমান। অতএব তাঁর রচনাগুলো সংস্কার করে—‘ভগবান’কে ‘রহমান’ করে, ‘মহাশ্মশান’কে ‘গোরস্থান’ করে, দরকার হলে কোনো কোনো অংশ পুরোপুরি বর্জন করে—তাঁকে মুসলিম দেশে পাঠোপযোগী করা যেতে পারে। কাহিনিটা এখানেই শেষ নয়, তার কয়েক দশক পরে স্বাধীন বাংলাদেশের একজন বিচারপতি নজরুলকে ‘পাক্কা মুসলমান’ বলে আখ্যায়িত করেন। ওদিকে নজরুল যেমন ছিলেন, তেমনই থাকলেন—নীরব, নিশ্চুপ। কেবল আমরা তাঁকে বিভিন্ন সময়ে দেখেছি, এখনো দেখছি নানাভাবে—অন্ধের হাতি দেখার মতো। নজরুল কবি হিসেবে বিখ্যাত হওয়ার পর প্রায় এক শ বছর হয়ে গেল, আজও তাঁর সফলতা, সীমাবদ্ধতা, স্ববিরোধিতার সত্যিকার মূল্যায়ন হলো না!

একজন মানুষের কবে কোথায় জন্ম আর কবে কোথায় মৃত্যু—এই তথ্য অথবা এ রকমের আরও কতগুলো তথ্যের সমাহারকে জীবনী বলা যায় না। জীবনী তথ্য এবং তারিখের ফিরিস্তি নয়। জীবনীর লক্ষ্য পাঠকের কাছে একজন মানুষের সামগ্রিক ব্যক্তিত্বকে ফুটিয়ে তোলা। সেদিক দিয়ে বিচার করলে প্রশান্ত পালের রবি-জীবনী রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে দীর্ঘ জীবনী হলেও, আদৌ জীবনী কি না, সন্দেহ আছে। অন্য পক্ষে, গোলাম মোস্তফার ‘ভায়া লাফ দেয় তিন হাত/ হেসে গান গায় দিন রাত’ নজরুল ইসলামের সংক্ষিপ্ততম জীবনী। সে জন্যই, আমার ধারণা, নজরুল ইসলামকে নিয়ে রাশি রাশি ছোট-বড় জীবনী লেখা হলেও এবং তাতে অনেক মূল্যবান তথ্য থাকলেও, সত্যিকার নির্ভরযোগ্য এবং পূর্ণাঙ্গ জীবনী আজও লেখা হয়নি।

এযাবৎ যেসব নজরুল-জীবনী প্রকাশিত হয়েছে, এক কথায় সেগুলোকে বলা যায়, শোনা-কথা-নির্ভর, বীরপূজামূলক। বিভিন্নজন নজরুল সম্পর্কে যেসব অতিরঞ্জিত গালগল্প লিখেছেন, কোনো রকম যাচাই-বাছাই না করে সেসব বানানো-ফেনানো-রাঙানো গল্প একত্র করে লেখা হয়েছে বেশির ভাগ নজরুল-জীবনী বলতে পারছি না—লেখা হয়েছে নজরুল-জীবনপঞ্জি। লেখকেরা খোলা মন নিয়ে নজরুলকে আবিষ্কার করতে চেষ্টা করেননি। বরং তাঁরা নজরুল নামক কিংবদন্তিকেই আরও পাকাপোক্ত করে নির্মাণ করতে চেষ্টা করেছেন। যে কবি একদিন লাথি মেরে অবরোধের তালা ভাঙার আহ্বান জানিয়েছিলেন, সেই মুক্ত জীবনানন্দকেই ভক্ত লেখকেরা বন্দী করতে চেষ্টা করেছেন নিজেদের সংস্কারে লালিত অচলায়তনে।

আমি যে নজরুলের কথা লিখছি, কোনো মার্কা মেরে তাঁকে চিহ্নিত করা যায় না। তিনি হিন্দু নন, মুসলমান নন, মুসলিম-জাতীয়তাবাদের প্রতীক নন। বৈষ্ণব নন, শাক্ত নন, তিনি মানুষ। কোনো ধর্ম দিয়ে যাঁকে চিহ্নিত করা যায় না। যিনি লিখেছেন, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান। মানুষকে যিনি ধর্মগ্রন্থ ও উপাসনালয়ের থেকে শ্রেষ্ঠ বলেছেন। জাতীয় কবি বলে যিনি বিখ্যাত নন, কার্যত মরে যাওয়ার পরে যিনি জাতীয় কবি হন। জাতীয় কবির দায়ভার আরোপ করা যাঁর ওপর তাই অন্যায্য।

যাঁর জন্ম অত্যন্ত দরিদ্র ও স্বল্প শিক্ষিত একটি পরিবারে; যিনি বড় হয়েছেন প্রচণ্ড প্রতিকূল পরিবেশে; প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যাঁর অসম্পূর্ণ, তিনি কী করে অত বড় কবি এবং সংগীতকার হলেন—আমার জীবনীতে সবার আগে আমি এই কঠিন প্রশ্নটার উত্তর দিতে চেষ্টা করেছি।

সেনাবাহিনী থেকে যিনি কলকাতায় ফিরেছিলেন একজন মুসলিম গল্পলেখক হিসেবে, যাঁর অঙ্কিত চরিত্রগুলো সব মুসলমান, যাঁর ভাষা মুসলমানি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ, যাঁর গল্পগুলো প্রকাশিত হয়েছিল মুসলিম-প্রকাশিত পত্রপত্রিকায়, সেই ‘অতি সাধারণ’ ছাপ-মারা গল্পলেখক এক বছর নয় মাসের মাথায় কী করে ‘খোদার আসন আরশ ছেদিয়া’ রচনা করলেন ‘বিদ্রোহী’র মতো ধর্মনিরপেক্ষ কবিতা, সব্যসাচীর মতো তিনি কী করে সমান দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করলেন হিন্দু-পুরাণ আর মুসলিম ঐতিহ্যের কথা? এ শক্তি কি তিনি স্বপ্নে পেয়েছিলেন, না কি ধীরে ধীরে অর্জন করেছিলেন?—দু নম্বরে উত্তর দিতে চেষ্টা করেছি, এই প্রশ্নের।

নজরুলের জন্ম মুসলিম পরিবারে। কবি হয়ে তিনি অনেকগুলো ইসলামি গানও লিখেছিলেন। কিন্তু ইসলামি গান লেখার আগে তিনি লিখেছিলেন কীর্তন এবং ভজনসহ বৈষ্ণবদের গান। ওদিকে বৈষ্ণবদের সঙ্গে শাক্তদের বিরোধ সাপে-নেউলের বিরোধের মতো। তা সত্ত্বেও তিনি ‘শ্যামা মায়ের কোলে চড়ে’ শ্যামের নাম জপ করেছেন। কখনো তিনি মসজিদের পাশে কবর দেওয়ার বাসনা প্রকাশ করেছেন, আবার কখনো গজলের মাতাল সুরে প্রকাশ করেছেন নিজের লাশ লাল পানি দিয়ে ধোওয়ানোর ইচ্ছা।—এসব পরস্পরবিরোধী উক্তি কি নিতান্তই ফরমাশি প্রলাপ, নাকি এসব আপাতবিরোধী উক্তির মধ্যে কোনো ঐক্যসূত্র লুকিয়ে আছে? আমি তার ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করেছি।

বাজারে যেসব নজরুল-জীবনী মেলে, সেগুলোতে কবির জীবনের সঙ্গে তাঁর সাহিত্যকর্মের হিসাবে মেলে না, তাঁর সাহিত্য থেকে লম্বা লম্বা উদ্ধৃতি মিললেও। আমি তাঁর সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর জীবনের প্রধান ঘটনাগুলোর যোগসূত্র দেখাতে চেষ্টা করেছি।

সর্বোপরি, দৈবক্রমে, আমি এমন একটা পাড়ায় বাস করি, যেখান থেকে আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক বিশাল ব্রিটিশ লাইব্রেরির দূরত্ব খুব বেশি নয়। অন্তত, সেখানে বিমানে করে যেতে হয় না। সেই গ্রন্থাগার এবং দলিলাগারে নজরুল সম্পর্কে খুব বেশি না হলেও এমন কিছু তথ্য আবিষ্কার করেছি, আগেকার জীবনীলেখকরা যার হদিস পাননি।

নজরুল জন্মেছিলেন সমাজের এমন একটা তলায়, যেখানে জন্ম-মৃত্যু-বিবাহের মতো মৌল তথ্যাদিও লিখে রাখার রেওয়াজ সেকালে তো ছিলই না, একালেও নেই। কাজেই নজরুল সম্পর্কে তথ্য নিয়ে বড়াই করা অর্থহীন, প্রায় ফাঁকাওয়াজের মতো। সত্যিকার নজরুলকে দেখার জন্য সবার আগে প্রয়োজন মুক্ত মন। জীবনীলেখকদের মধ্যে সেই মনেরই অভাব দেখতে পাই সবচেয়ে বেশি। মনে আছে, বছর বিশেক আগে আমার লেখা মাইকেল-জীবনী—আশার ছলনে ভুলি—প্রকাশিত হওয়ার পর যখন ঢাকায় গিয়েছিলাম, তখন এক পার্টিতে আমাকে একজন জিজ্ঞেস করেছিলেন, মাইকেলকে আমি কি বড় করতে চেয়েছি, নাকি ছোট করতে চেয়েছি? প্রশ্নটা শুনে আমি একেবারে আকাশ থেকে পড়েছিলাম। যাঁর জীবনী লিখছি, তাঁকে বড় করা জীবনীলেখকের কাজ নয়, ছোট করা তো নয়ই। জীবনীলেখককে হতে হবে নিরাসক্ত ও সত্যদ্রষ্টা। শতকরা এক শ ভাগ নিরাসক্ত হওয়া বোধ হয় অসম্ভব। তবু পাহাড়ের চূড়া থেকে নদীর বাঁক দেখার মতো খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে একটি নিরাসক্ত নজরুল-জীবনী লেখা আমাদের জন্য অত্যাবশ্যক। অত্যাবশ্যক কারণ, নজরুলের নামটা এখন নানাজন ব্যবহার করছেন তাঁদের নিজেদের কাজে। তাঁর নাম ভাঙিয়ে ফয়দা লুটছেন। যে নজরুল ছিলেন আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক, তাঁর দোহাই দিয়ে আজ সাম্প্রদায়িকতাও প্রচার করা হচ্ছে। কবির প্রতি এর থেকে অবিচার আর কিছু হতে পারে না।