বিষাদগাথা
অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
স্বর্ণাক্ষর প্রকাশনী
দাম ২০০.০০
গ্রামের পুবদিকে চালাঘরের হাসপাতাল, পশ্চিমে মরা নদী ৷ বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে তার ওপর দিয়ে ঝিঙে-চিচিঙ্গা বোঝাই গোরুর গাড়ি চলে, রাস্তা সংক্ষেপ করতে চালের সাইকেল ছোটে ৷ মরা নদীর ওপার থেকে ফুঁসতে ফুঁসতে কালবৈশাখী এসে পুবের গ্রামীণ হাসপাতালের প্রসবকালীন আর্তনাদও উড়িয়ে নিয়ে যায় ৷ মাইলের পর মাইল শূন্য ভূমির ওপর হাওয়ার শব্দ কখনও হা-রে-রে-রে, কখনও হাহাকারের মতো শোনায় ৷ অমরেন্দ্র চক্রবর্তীর লেখা 'বিষাদগাথা' অসাধারণ একটি উপন্যাস যা অনুরাগী পাঠকের কাছে তুলে ধরা হয়েছে ৷
পড়ুন দেবেশ রায়ের এই উপন্যাস নিয়ে আলোচনাঃ
বিরল মৌলিকতার সাহস ও সামর্থ্য
দেবেশ রায়
অমরেন্দ্র চক্রবর্তীর বিষাদগাথা উপন্যাসটি, গল্প-উপন্যাস নিয়ে আমাদের অভ্যাসের, ও অভ্যাস থেকে তৈরি ধারণার, একেবারে বাইরে। উপন্যাস-সিনেমার মতো শিল্প-আকারের পাঠক-দর্শক মিশ্র প্রকৃতির ও সংখ্যায় বেশি। এমন শিল্প-আকারগুলি দেখাপড়ার অভ্যাস সেই পাঠক-দর্শকরাই অনেকটা তৈরি করে দেন। সেই অভ্যাস খানিকটা কিন্তু বিধি হয়েই দাঁড়ায়। সেই বিধি ভাঙা, এমন জনপ্রিয় শিল্প-আকারে, খুব সহজ নয়। বরং, বাংলা কবিতার পাঠক কম থাকায়, কোনও বিধির আভাসও এড়িয়ে যাওয়া, কবিতা যিনি লিখতে চান তাঁর পক্ষে, প্রথম কর্তব্য হয়ে ওঠে। তাঁর কবিতায় যদি অন্য কোনও প্রবীণ কবির কথা তৈরির ধরন পাঠকের কানে ধরা পড়ে যায়, তা হলে সে কবির পাঠক জোটা মুশকিল। বাংলায় কবি অনেক— এমন একটা গুজব আছে। একটু ঠাট্টাও মিশে থাকে সেই গুজবের সঙ্গে। বাংলা ভাষায় যিনি কথা বলেন, তিনি যদি তাঁর সেই কথা বলায় ও শোনায় কবিতার গড়ন খুঁজে পান ও কবিতা লেখেন সেটা তো কোনও দোষ হতে পারে না। পাঠক হিসেবে বরং আমি অবাক হই— প্রত্যেক কবিই তাঁর নিজস্ব স্বরটা তৈরি করে তোলেন কী করে?
গল্প-উপন্যাসে এর উল্টোটা ঘটে। যেন, গল্প-উপন্যাস যাঁরা লেখেন, তাঁদের নিজস্ব কোনও ভাষা তাঁদের রচনার বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যেন, তেমন বাধা তৈরি না করাই বিধেয়। যদিও তাঁদের গল্পের গড়ন, মোচড়, ঘটনা, শেষ— এই সবের দিক থেকে গল্পলেখকদের পার্থক্য ধরা পড়ে। বা, বলা যায়, সে পার্থক্য লুকনো যায় না। এমন হতেও পারে উল্টো ভাবে— গল্প-উপন্যাসের লেখকরা তাঁদের মতো করে আন্দাজ পান, পাঠক তাঁর কাছে গল্পের কোন গড়ন, মোচড়, ঘটনা ও শেষ চায়। এমন আন্দাজ থেকে বাংলায় গল্প-উপন্যাসের লেখকদের আত্মহত্যা সব থেকে বেশি ঘটেছে। বোধহয় এর একমাত্র ব্যতিক্রম শরৎচন্দ্র। কিন্তু শরৎচন্দ্রের জনপ্রিয়তার স্থায়িত্ব বাংলা সাহিত্যেই প্রধান ব্যতিক্রম— সে ব্যতিক্রমের খুব একটা খোঁজাখুঁজি হয়নি।
অমরেন্দ্র চক্রবর্তী তাঁর এই প্রথম উপন্যাস চর্চিত সচেতনতায় গড়ে তুলেছেন, তেমন সচেতনতা বাংলা ঔপন্যাসিকদের মধ্যে বিরল। তাঁর সেই সচেতনতার প্রধান লক্ষণ— প্রায় পৌনে তিনশো পাতার উপন্যাসটি পড়ে কোনও পাঠকের পক্ষে বলা সম্ভবই নয়— উপন্যাসের গল্পটি কী, মানে, প্রধান গল্পটি কী, সেই গল্পের প্রধান চরিত্রের পরিচয় কী?
এমন অনেক ধরনের মানুষ নিয়ে উপন্যাস খুব একটা দুর্লভ নয় কিন্তু সে মানুষগুলির কাজকর্ম, চলাফেরা ও নানা সম্বন্ধের মধ্যে একটা সংযোগ তৈরি করা ও সে-সংযোগটুকুকে সজীব রাখাই লেখকের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায়। অমরেন্দ্রর এই উপন্যাসের মানুষজন গুনে শেষ করা যাবে না। দু-চার লাইনের মধ্যেই তার আসা-যাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছে এমন মানুষটিরও একটি নাম আছে। একটি মানুষও এ উপন্যাসে নামহারা নয়। উপন্যাসটির কাহিনির ঘটনাস্থল যদিও খুব বেশি নয় কিন্তু সেই জায়গাগুলিরও নাম আছে, সেই প্রতিটি জায়গা কোনও না কোনও ঘটনায় চিহ্নিত। যে কোনও পাঠক ইচ্ছে করলেই একটা ম্যাপ এঁকে ফেলতে পারেন। এমন আনুমানিক পাঠকের উপর বরাত না দিয়ে স্বীকার করা ভাল যে আমি এমন একটা ম্যাপ এঁকে নিয়েছিলেম— বইটি পড়তে পড়তে, এইটি বুঝে নিতে যে লেখক তাঁর উপন্যাসের সবচেয়ে স্থাবর চরিত্রগুলিকে— এই জায়গাগুলিকে— কি কোনও পরিকল্পনা অনুযায়ী গতিমান করে তোলেন। স্বীকার করতে ভাল লাগছে যে এই উপন্যাসটির সবথেকে সঙ্গতিপূর্ণ ও স্থায়ী অবস্থান (রেফারেন্স পয়েন্ট) এই স্থানবিন্দুগুলি। এই স্থায়ী ও বারবার ফিরে আসা ছোট ছোট জায়গাগুলিই উপন্যাসের অসংখ্য মানুষকে জুড়ে দিয়েছে, উপন্যাসটির প্রতিটি পাতার নানা স্বয়ংসম্পূর্ণ ঘটনাকে জায়গা দিয়েছে। পড়ার সুবিধের জন্য যদি ম্যাপটা এঁকে না নিতাম, তা হলে এত ঘটনা, এত মানুষ ও এত পরিণতিহীন গতির কোনও কেন্দ্র খুঁজে বার করা কঠিন হত, প্রায় অসম্ভব হত।
কী দরকার ছিল এমন একটি কেন্দ্র খোঁজার— লেখক যদি সে কেন্দ্রটিকে এতটাই নিখোঁজ রাখতে চান। গোপন নয়, নিখোঁজ রাখতে চান।
সেটা আমার সাহিত্যপাঠের বা শিল্পকর্ম অনুসরণের স্বভাবের কারণেই হয়তো। প্রত্যেক শিল্পকর্মের একটা কোনও কেন্দ্র থাকতেই হবে, সে কেন্দ্র বিষয়ের নয়। শিল্পের আকারই তার বিষয়। কী আঁকা হচ্ছে, কী গাওয়া হচ্ছে, কী লেখা হচ্ছে, সেখানে সে কেন্দ্র নেই। ক্যানভাস বা স্বরক্ষেপণ বা লেখার পৃষ্ঠায় সে কেন্দ্র থাকে। এমন যে কখনও হয়নি তা নয় যে, কেন্দ্রটি পাইনি। বা, কেন্দ্রটি অতিচিহ্নিত ঠেকেছে।
এই উপন্যাসটির সেই কেন্দ্রের সংকেত আমি প্রথম কয়েকটি লাইনে, বড়জোর প্রথম ৬৮ লাইনেই শনাক্ত করি নিজের সুবিধের জন্য, উপন্যাসটির অনেকখানি ভিতরে চলে যাওয়ার পর। অর্থাৎ ভিতরে চলে যাওয়ার পর গোড়ায় ফিরে এসে দেখি লেখক পুরো উপন্যাসটির কেন্দ্র ওখানেই ছকে রেখেছেন— ‘বালিসোনা গ্রাম’, ‘বালিসোনা অঞ্চলেই অসীম সবুজ’, ‘পরের চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছরের মধ্যে ক্রমশ উজাড় হয়ে যাবে’, ‘তখন হারানো নদীরও নতুন আখ্যান রচিত হবে’, ও চৌধুরী বাড়ি ও বালিসোনা গ্রামের মানুষজনের অবস্থা: ‘অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হেডমাস্টারের বউ’ থেকে ‘আরও কয়েকজনের আসন্নপ্রসবা স্ত্রী তাদের বরাদ্দ দুধ-পাঁউরুটি ঘর থেকে আসা তাদের ছেলেমেয়েদের কৌটোয় সন্তর্পণে ঢেলে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল’।
এই স্থানকেন্দ্রিকতার বাইরে উপন্যাসটি এক পা-ও বাড়ায়নি। বহু দূরদূরান্তর থেকে, দেশদেশান্তর ও সাগরসাগরান্তর থেকে এ উপন্যাসে অনেকে এসে ভিড়েছে। এসে মারাও গিয়েছে আবার এ উপন্যাসের ভিতর ঢুকে অনেকে, বিশেষ করে প্রাক্তন জমিদার চৌধুরীদের বাড়ির অনেকেই উপন্যাস থেকে বেরিয়ে গিয়েছে, স্বেচ্ছায়— দূরদূরান্তর, দেশদেশান্তর ও সাগরসাগরান্তরে। আবার সেখান থেকে ফিরে এসেছে বালিসোনায়, স্বেচ্ছায়, যেন বালিসোনায় ফিরে আসাতেই ছিল সেই সব দীর্ঘ প্রবাসের পথ।
কিন্তু এ উপন্যাস কোনও ভাবেই রূপকথা নয়; সাবালকদের রূপকথাও নয়। উপন্যাসের বেশির ভাগ ঘটনা সমকালীন। সেই ঘটনাগুলির অনেক বিপরীতমুখ, যেমন আমাদের, বা বইটি যখন তৈরি হচ্ছে তখনকার, সমকালীন। সে সমকালীনতা লেখক এতই দাগিয়ে রাখেন যে পাঠকের চোখে না পড়েই পারে না। কিন্তু লেখক যখন সেই ঘটনাগুলি কী করে ঘটল ও ঘটার প্রতিক্রিয়ায় আরও কী ঘটল, তা নিয়ে একটি কথাও বলেন না, তখন একটা দ্বন্দ্বের শুরু হয়। যেন বালিসোনা গ্রাম বদলাচ্ছে, যেন বালিসোনার লুপ্ত নদীর পুনরুদ্ধার ঘটছে, যেন সেই বদলের ভাগ নিতে নানা স্বার্থের মানুষজন, এমনকী বিদেশি পুঁজি পর্যন্ত, এসে জুটছে ও বালিসোনার ভিতর থেকেও বালিসোনার স্বরূপ সন্ধানের অভিযান চলছে সকালবেলার সমবেত সংগীত মিছিলে, পরীক্ষিৎ-এর ‘বিষাদগাথা’র সাংবাদিক রচনায়, লালকমল-নীলকমলের নানা কাজকর্মে যা প্রায়ই অন্তর্ঘাত বলে সন্দেহ হয়। ভিতর থেকে বালিসোনার স্বরূপ সন্ধানে বালিসোনার অনেক মৃতরাও এসে যোগ দেন বা জীবিতরা মৃতদের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলতে পারে।
যে কোনও শিল্পরচনার কেন্দ্র খোঁজার ব্যক্তিগত বাতিকের কথা এর আগে বলেছি। আর একটি বাতিক সেই শিল্প-রচনার আততি খোঁজা। উপন্যাসটিতে সেই আততি তৈরি হয়েছে— বালিসোনার ভিতরের সমাবেশ ও বাইরের সমাবেশের ভিতর।
অমরেন্দ্র তাঁর এই উপন্যাসটি যে নিবিষ্ট পরিকল্পনায় গড়ে তুলেছেন, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ— তিনি ওই আততির কোনও মীমাংসা করেন না। ঘটনাগত মীমাংসাও করেন না। সেই অমীমাংসায় তাঁর উপন্যাস শেষ হয়ে যায়।
এ উপন্যাসের পাঠক পাওয়া কঠিন। বিশিষ্ট পাঠক পাওয়াও কঠিন। কিন্তু পাঠকের বাহুল্য বা অভাব একটি শিল্পকর্মের তাৎপর্যের নির্ধারক নয়। এমন উপন্যাস, উপন্যাসের শিল্প-আকারকে নতুন গড়ন দেয়। অমরেন্দ্র সেই কাজ করতে পেরেছেন— এটা যেমন তাঁর ব্যক্তিগত শক্তির সামর্থ্যেই ঘটেছে, তেমনই বাংলা উপন্যাসেরও নতুন সামর্থ্যের সম্ভাবনার ফলেও ঘটেছে।
একেবারে শেষে দুটি কথা।
প্রথম কথা— উপন্যাসটিতে বালিসোনার ভিতরের সমাবেশের কিছু ঘটনা রূপক প্রতীক তৈরি করে ফেলছে, বুঝি বা একটু রাবীন্দ্রিক রূপক-প্রতীকই। এ উপন্যাসে কঠিন ও কঠিনতম বাস্তবতা ছাড়া কোনও রূপক-প্রতীকের জায়গা নেই। তেমন রূপক-প্রতীকে ভুল করে রূপকথার কথন এসে যাচ্ছে— যেমন ‘উড়ন্ত সাইকেল’। উপন্যাসের গাম্ভীর্যের ক্ষতি হয়েছে।
দ্বিতীয় কথা— বাংলা বইয়ে মলাটের ভাঁজিতে বা পিছনে লেখক ও লেখাটি নিয়ে বিজ্ঞাপনগন্ধী লেখার একটা রেওয়াজ হয়েছে। আমারই এখনকার একটি বইয়ে প্রকাশকের এমন লেখা পড়ে আমিই চমৎকৃত— কী কী পুরস্কার পাইনি তার এক তালিকা। অমরেন্দ্রর এই এমন নিজস্ব ধরনের উপন্যাসটির ভাঁজিতে ও পিছনে তাঁর ভ্রমণ-সাহিত্য, শিশু-সাহিত্যের উল্লেখ আছে। এ বইয়ে এটা মানায় না। শুধু তাই নয়, পাঠককে ভুল সংকেত দেয়।
অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
স্বর্ণাক্ষর প্রকাশনী
দাম ২০০.০০
গ্রামের পুবদিকে চালাঘরের হাসপাতাল, পশ্চিমে মরা নদী ৷ বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে তার ওপর দিয়ে ঝিঙে-চিচিঙ্গা বোঝাই গোরুর গাড়ি চলে, রাস্তা সংক্ষেপ করতে চালের সাইকেল ছোটে ৷ মরা নদীর ওপার থেকে ফুঁসতে ফুঁসতে কালবৈশাখী এসে পুবের গ্রামীণ হাসপাতালের প্রসবকালীন আর্তনাদও উড়িয়ে নিয়ে যায় ৷ মাইলের পর মাইল শূন্য ভূমির ওপর হাওয়ার শব্দ কখনও হা-রে-রে-রে, কখনও হাহাকারের মতো শোনায় ৷ অমরেন্দ্র চক্রবর্তীর লেখা 'বিষাদগাথা' অসাধারণ একটি উপন্যাস যা অনুরাগী পাঠকের কাছে তুলে ধরা হয়েছে ৷
পড়ুন দেবেশ রায়ের এই উপন্যাস নিয়ে আলোচনাঃ
বিরল মৌলিকতার সাহস ও সামর্থ্য
দেবেশ রায়
অমরেন্দ্র চক্রবর্তীর বিষাদগাথা উপন্যাসটি, গল্প-উপন্যাস নিয়ে আমাদের অভ্যাসের, ও অভ্যাস থেকে তৈরি ধারণার, একেবারে বাইরে। উপন্যাস-সিনেমার মতো শিল্প-আকারের পাঠক-দর্শক মিশ্র প্রকৃতির ও সংখ্যায় বেশি। এমন শিল্প-আকারগুলি দেখাপড়ার অভ্যাস সেই পাঠক-দর্শকরাই অনেকটা তৈরি করে দেন। সেই অভ্যাস খানিকটা কিন্তু বিধি হয়েই দাঁড়ায়। সেই বিধি ভাঙা, এমন জনপ্রিয় শিল্প-আকারে, খুব সহজ নয়। বরং, বাংলা কবিতার পাঠক কম থাকায়, কোনও বিধির আভাসও এড়িয়ে যাওয়া, কবিতা যিনি লিখতে চান তাঁর পক্ষে, প্রথম কর্তব্য হয়ে ওঠে। তাঁর কবিতায় যদি অন্য কোনও প্রবীণ কবির কথা তৈরির ধরন পাঠকের কানে ধরা পড়ে যায়, তা হলে সে কবির পাঠক জোটা মুশকিল। বাংলায় কবি অনেক— এমন একটা গুজব আছে। একটু ঠাট্টাও মিশে থাকে সেই গুজবের সঙ্গে। বাংলা ভাষায় যিনি কথা বলেন, তিনি যদি তাঁর সেই কথা বলায় ও শোনায় কবিতার গড়ন খুঁজে পান ও কবিতা লেখেন সেটা তো কোনও দোষ হতে পারে না। পাঠক হিসেবে বরং আমি অবাক হই— প্রত্যেক কবিই তাঁর নিজস্ব স্বরটা তৈরি করে তোলেন কী করে?
গল্প-উপন্যাসে এর উল্টোটা ঘটে। যেন, গল্প-উপন্যাস যাঁরা লেখেন, তাঁদের নিজস্ব কোনও ভাষা তাঁদের রচনার বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যেন, তেমন বাধা তৈরি না করাই বিধেয়। যদিও তাঁদের গল্পের গড়ন, মোচড়, ঘটনা, শেষ— এই সবের দিক থেকে গল্পলেখকদের পার্থক্য ধরা পড়ে। বা, বলা যায়, সে পার্থক্য লুকনো যায় না। এমন হতেও পারে উল্টো ভাবে— গল্প-উপন্যাসের লেখকরা তাঁদের মতো করে আন্দাজ পান, পাঠক তাঁর কাছে গল্পের কোন গড়ন, মোচড়, ঘটনা ও শেষ চায়। এমন আন্দাজ থেকে বাংলায় গল্প-উপন্যাসের লেখকদের আত্মহত্যা সব থেকে বেশি ঘটেছে। বোধহয় এর একমাত্র ব্যতিক্রম শরৎচন্দ্র। কিন্তু শরৎচন্দ্রের জনপ্রিয়তার স্থায়িত্ব বাংলা সাহিত্যেই প্রধান ব্যতিক্রম— সে ব্যতিক্রমের খুব একটা খোঁজাখুঁজি হয়নি।
অমরেন্দ্র চক্রবর্তী তাঁর এই প্রথম উপন্যাস চর্চিত সচেতনতায় গড়ে তুলেছেন, তেমন সচেতনতা বাংলা ঔপন্যাসিকদের মধ্যে বিরল। তাঁর সেই সচেতনতার প্রধান লক্ষণ— প্রায় পৌনে তিনশো পাতার উপন্যাসটি পড়ে কোনও পাঠকের পক্ষে বলা সম্ভবই নয়— উপন্যাসের গল্পটি কী, মানে, প্রধান গল্পটি কী, সেই গল্পের প্রধান চরিত্রের পরিচয় কী?
এমন অনেক ধরনের মানুষ নিয়ে উপন্যাস খুব একটা দুর্লভ নয় কিন্তু সে মানুষগুলির কাজকর্ম, চলাফেরা ও নানা সম্বন্ধের মধ্যে একটা সংযোগ তৈরি করা ও সে-সংযোগটুকুকে সজীব রাখাই লেখকের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায়। অমরেন্দ্রর এই উপন্যাসের মানুষজন গুনে শেষ করা যাবে না। দু-চার লাইনের মধ্যেই তার আসা-যাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছে এমন মানুষটিরও একটি নাম আছে। একটি মানুষও এ উপন্যাসে নামহারা নয়। উপন্যাসটির কাহিনির ঘটনাস্থল যদিও খুব বেশি নয় কিন্তু সেই জায়গাগুলিরও নাম আছে, সেই প্রতিটি জায়গা কোনও না কোনও ঘটনায় চিহ্নিত। যে কোনও পাঠক ইচ্ছে করলেই একটা ম্যাপ এঁকে ফেলতে পারেন। এমন আনুমানিক পাঠকের উপর বরাত না দিয়ে স্বীকার করা ভাল যে আমি এমন একটা ম্যাপ এঁকে নিয়েছিলেম— বইটি পড়তে পড়তে, এইটি বুঝে নিতে যে লেখক তাঁর উপন্যাসের সবচেয়ে স্থাবর চরিত্রগুলিকে— এই জায়গাগুলিকে— কি কোনও পরিকল্পনা অনুযায়ী গতিমান করে তোলেন। স্বীকার করতে ভাল লাগছে যে এই উপন্যাসটির সবথেকে সঙ্গতিপূর্ণ ও স্থায়ী অবস্থান (রেফারেন্স পয়েন্ট) এই স্থানবিন্দুগুলি। এই স্থায়ী ও বারবার ফিরে আসা ছোট ছোট জায়গাগুলিই উপন্যাসের অসংখ্য মানুষকে জুড়ে দিয়েছে, উপন্যাসটির প্রতিটি পাতার নানা স্বয়ংসম্পূর্ণ ঘটনাকে জায়গা দিয়েছে। পড়ার সুবিধের জন্য যদি ম্যাপটা এঁকে না নিতাম, তা হলে এত ঘটনা, এত মানুষ ও এত পরিণতিহীন গতির কোনও কেন্দ্র খুঁজে বার করা কঠিন হত, প্রায় অসম্ভব হত।
কী দরকার ছিল এমন একটি কেন্দ্র খোঁজার— লেখক যদি সে কেন্দ্রটিকে এতটাই নিখোঁজ রাখতে চান। গোপন নয়, নিখোঁজ রাখতে চান।
সেটা আমার সাহিত্যপাঠের বা শিল্পকর্ম অনুসরণের স্বভাবের কারণেই হয়তো। প্রত্যেক শিল্পকর্মের একটা কোনও কেন্দ্র থাকতেই হবে, সে কেন্দ্র বিষয়ের নয়। শিল্পের আকারই তার বিষয়। কী আঁকা হচ্ছে, কী গাওয়া হচ্ছে, কী লেখা হচ্ছে, সেখানে সে কেন্দ্র নেই। ক্যানভাস বা স্বরক্ষেপণ বা লেখার পৃষ্ঠায় সে কেন্দ্র থাকে। এমন যে কখনও হয়নি তা নয় যে, কেন্দ্রটি পাইনি। বা, কেন্দ্রটি অতিচিহ্নিত ঠেকেছে।
এই উপন্যাসটির সেই কেন্দ্রের সংকেত আমি প্রথম কয়েকটি লাইনে, বড়জোর প্রথম ৬৮ লাইনেই শনাক্ত করি নিজের সুবিধের জন্য, উপন্যাসটির অনেকখানি ভিতরে চলে যাওয়ার পর। অর্থাৎ ভিতরে চলে যাওয়ার পর গোড়ায় ফিরে এসে দেখি লেখক পুরো উপন্যাসটির কেন্দ্র ওখানেই ছকে রেখেছেন— ‘বালিসোনা গ্রাম’, ‘বালিসোনা অঞ্চলেই অসীম সবুজ’, ‘পরের চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছরের মধ্যে ক্রমশ উজাড় হয়ে যাবে’, ‘তখন হারানো নদীরও নতুন আখ্যান রচিত হবে’, ও চৌধুরী বাড়ি ও বালিসোনা গ্রামের মানুষজনের অবস্থা: ‘অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হেডমাস্টারের বউ’ থেকে ‘আরও কয়েকজনের আসন্নপ্রসবা স্ত্রী তাদের বরাদ্দ দুধ-পাঁউরুটি ঘর থেকে আসা তাদের ছেলেমেয়েদের কৌটোয় সন্তর্পণে ঢেলে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল’।
এই স্থানকেন্দ্রিকতার বাইরে উপন্যাসটি এক পা-ও বাড়ায়নি। বহু দূরদূরান্তর থেকে, দেশদেশান্তর ও সাগরসাগরান্তর থেকে এ উপন্যাসে অনেকে এসে ভিড়েছে। এসে মারাও গিয়েছে আবার এ উপন্যাসের ভিতর ঢুকে অনেকে, বিশেষ করে প্রাক্তন জমিদার চৌধুরীদের বাড়ির অনেকেই উপন্যাস থেকে বেরিয়ে গিয়েছে, স্বেচ্ছায়— দূরদূরান্তর, দেশদেশান্তর ও সাগরসাগরান্তরে। আবার সেখান থেকে ফিরে এসেছে বালিসোনায়, স্বেচ্ছায়, যেন বালিসোনায় ফিরে আসাতেই ছিল সেই সব দীর্ঘ প্রবাসের পথ।
কিন্তু এ উপন্যাস কোনও ভাবেই রূপকথা নয়; সাবালকদের রূপকথাও নয়। উপন্যাসের বেশির ভাগ ঘটনা সমকালীন। সেই ঘটনাগুলির অনেক বিপরীতমুখ, যেমন আমাদের, বা বইটি যখন তৈরি হচ্ছে তখনকার, সমকালীন। সে সমকালীনতা লেখক এতই দাগিয়ে রাখেন যে পাঠকের চোখে না পড়েই পারে না। কিন্তু লেখক যখন সেই ঘটনাগুলি কী করে ঘটল ও ঘটার প্রতিক্রিয়ায় আরও কী ঘটল, তা নিয়ে একটি কথাও বলেন না, তখন একটা দ্বন্দ্বের শুরু হয়। যেন বালিসোনা গ্রাম বদলাচ্ছে, যেন বালিসোনার লুপ্ত নদীর পুনরুদ্ধার ঘটছে, যেন সেই বদলের ভাগ নিতে নানা স্বার্থের মানুষজন, এমনকী বিদেশি পুঁজি পর্যন্ত, এসে জুটছে ও বালিসোনার ভিতর থেকেও বালিসোনার স্বরূপ সন্ধানের অভিযান চলছে সকালবেলার সমবেত সংগীত মিছিলে, পরীক্ষিৎ-এর ‘বিষাদগাথা’র সাংবাদিক রচনায়, লালকমল-নীলকমলের নানা কাজকর্মে যা প্রায়ই অন্তর্ঘাত বলে সন্দেহ হয়। ভিতর থেকে বালিসোনার স্বরূপ সন্ধানে বালিসোনার অনেক মৃতরাও এসে যোগ দেন বা জীবিতরা মৃতদের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলতে পারে।
যে কোনও শিল্পরচনার কেন্দ্র খোঁজার ব্যক্তিগত বাতিকের কথা এর আগে বলেছি। আর একটি বাতিক সেই শিল্প-রচনার আততি খোঁজা। উপন্যাসটিতে সেই আততি তৈরি হয়েছে— বালিসোনার ভিতরের সমাবেশ ও বাইরের সমাবেশের ভিতর।
অমরেন্দ্র তাঁর এই উপন্যাসটি যে নিবিষ্ট পরিকল্পনায় গড়ে তুলেছেন, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ— তিনি ওই আততির কোনও মীমাংসা করেন না। ঘটনাগত মীমাংসাও করেন না। সেই অমীমাংসায় তাঁর উপন্যাস শেষ হয়ে যায়।
এ উপন্যাসের পাঠক পাওয়া কঠিন। বিশিষ্ট পাঠক পাওয়াও কঠিন। কিন্তু পাঠকের বাহুল্য বা অভাব একটি শিল্পকর্মের তাৎপর্যের নির্ধারক নয়। এমন উপন্যাস, উপন্যাসের শিল্প-আকারকে নতুন গড়ন দেয়। অমরেন্দ্র সেই কাজ করতে পেরেছেন— এটা যেমন তাঁর ব্যক্তিগত শক্তির সামর্থ্যেই ঘটেছে, তেমনই বাংলা উপন্যাসেরও নতুন সামর্থ্যের সম্ভাবনার ফলেও ঘটেছে।
একেবারে শেষে দুটি কথা।
প্রথম কথা— উপন্যাসটিতে বালিসোনার ভিতরের সমাবেশের কিছু ঘটনা রূপক প্রতীক তৈরি করে ফেলছে, বুঝি বা একটু রাবীন্দ্রিক রূপক-প্রতীকই। এ উপন্যাসে কঠিন ও কঠিনতম বাস্তবতা ছাড়া কোনও রূপক-প্রতীকের জায়গা নেই। তেমন রূপক-প্রতীকে ভুল করে রূপকথার কথন এসে যাচ্ছে— যেমন ‘উড়ন্ত সাইকেল’। উপন্যাসের গাম্ভীর্যের ক্ষতি হয়েছে।
দ্বিতীয় কথা— বাংলা বইয়ে মলাটের ভাঁজিতে বা পিছনে লেখক ও লেখাটি নিয়ে বিজ্ঞাপনগন্ধী লেখার একটা রেওয়াজ হয়েছে। আমারই এখনকার একটি বইয়ে প্রকাশকের এমন লেখা পড়ে আমিই চমৎকৃত— কী কী পুরস্কার পাইনি তার এক তালিকা। অমরেন্দ্রর এই এমন নিজস্ব ধরনের উপন্যাসটির ভাঁজিতে ও পিছনে তাঁর ভ্রমণ-সাহিত্য, শিশু-সাহিত্যের উল্লেখ আছে। এ বইয়ে এটা মানায় না। শুধু তাই নয়, পাঠককে ভুল সংকেত দেয়।