আমার জীবনবোধ
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
মানবজীবনে এমন অজস্র চাহিদা থাকতে পারে, থাকেও, যা না মেটালেও দিব্যি চলে যায়, জীবনধারণে কোনো অসুবিধা হয় না। আবার এমন কিছু চাহিদা আছে, যা না মেটালেই নয়। যেমন পেটের ভাত চাই, পরনের কাপড় চাই, মাথার উপরে একটা ছাত চাই, অক্ষর জ্ঞানটা হওয়া চাই, যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থান হওয়া চাই, আর হ্যাঁ, জন্মেছি যখন, তখন মরতেও যে হবে, তা কি আর আমরা জানি না। তবে কিনা বিনা চিকিৎসায় মরাটা যেহেতু কোনো স্বাধীন দেশের নাগরিককে মানায় না, তাই মরার আগে যৎসামান্য হলেও একটু চিকিৎসিত হওয়া চাই।
চাই তো, কিন্তু পাই কজন? দেশ স্বাধীন হয়েছে তা প্রায় ষাট বছর পূর্ণ হতে চলল, কিন্তু এই স্বাধীন দেশের যাঁরা নাগরিক, তাঁদের একটা মস্ত অংশেরই এই নূ্যনতম চাহিদাগুলিও আজ পর্যন্ত মেটেনি। যাকে পভার্টি লাইন বা দারিদ্র্যরেখা বলা হয়, এখনো কোটি কোটি মানুষ তার তলায় পড়ে আছেন। নিত্যদিন তাঁদের পেটের ভাত জোটে না, ছেঁড়া কাপড় পরে তাঁদের লজ্জা নিবারণ করতে হয়। আর মাথার উপরে ছাতের কথায় বলি, হাজার হাজার মানুষের ঘরবাড়ি ভেঙে আজ যদি তাঁদের মানিকতলার খালপাড় থেকে উচ্ছিন্ন করা হচ্ছে, তো কাল খেদানো হচ্ছে টালিগঞ্জের খালপাড় থেকে। তাঁরা অ-আ-ক-খ শেখেননি, তাঁদের অনেকেই ভিক্ষাজীবী, এবং তাঁদের নব্বই শতাংশই সম্ভবত অসুখবিসুখ হলে জলপড়া তেলপড়া ছাড়া অন্য কোনো চিকিৎসার কথা ভাবতে পারেন না।
আপনারা আমার জীবনবোধের কথা জিজ্ঞেস করেছেন। ওটা অনেক বড়ো ব্যাপার, আমার বোধবুদ্ধি ওর নাগাল পায় না। আমি জ্ঞানী মানুষ নই, ইংরেজিতে যাকে কমন-সেন্স বলে, আমার একমাত্র সম্বল সেই কাণ্ডজ্ঞান। আর হ্যাঁ, চোখ দুটো যখন আছে, তখন খোলা চোখে চারদিকে তাকিয়ে সব দেখি। দেখি আকাশ, দেখি গাছপালা, দেখি রাস্তাঘাট আর ঘরগৃহস্থি। একটু আগে যাঁদের কথা বলেছি, দেখি তাঁদেরও।
দেখতে দেখতে আমাদেরই এক প্রাজ্ঞ সাহিত্যকর্তার একটি সতর্কবাণী নিত্য মনে পড়ে: নগর পুড়িলে কি দেবালয় এড়ায়? না, তা এড়ায় না, আগুনের আঁচ লাগে তার গায়েও। তাই ভাবি যে, এত এত মানুষের নূ্যনতম চাহিদাটুকু যদি আজও না মিটে থাকে, তা হলে আমাদের, অর্থাৎ নূ্যনতম চাহিদার উপরে আরো বেশ কিছু চাহিদা যাদের মিটেছে, তারাই কি খুব নিশ্চিন্ত জীবন যাপন করতে পারবে? পারা সম্ভব?
একে আমার জীবনবোধ বলতে পারেন, কিংবা জীবন জিজ্ঞাসাও।
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
মানবজীবনে এমন অজস্র চাহিদা থাকতে পারে, থাকেও, যা না মেটালেও দিব্যি চলে যায়, জীবনধারণে কোনো অসুবিধা হয় না। আবার এমন কিছু চাহিদা আছে, যা না মেটালেই নয়। যেমন পেটের ভাত চাই, পরনের কাপড় চাই, মাথার উপরে একটা ছাত চাই, অক্ষর জ্ঞানটা হওয়া চাই, যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থান হওয়া চাই, আর হ্যাঁ, জন্মেছি যখন, তখন মরতেও যে হবে, তা কি আর আমরা জানি না। তবে কিনা বিনা চিকিৎসায় মরাটা যেহেতু কোনো স্বাধীন দেশের নাগরিককে মানায় না, তাই মরার আগে যৎসামান্য হলেও একটু চিকিৎসিত হওয়া চাই।
চাই তো, কিন্তু পাই কজন? দেশ স্বাধীন হয়েছে তা প্রায় ষাট বছর পূর্ণ হতে চলল, কিন্তু এই স্বাধীন দেশের যাঁরা নাগরিক, তাঁদের একটা মস্ত অংশেরই এই নূ্যনতম চাহিদাগুলিও আজ পর্যন্ত মেটেনি। যাকে পভার্টি লাইন বা দারিদ্র্যরেখা বলা হয়, এখনো কোটি কোটি মানুষ তার তলায় পড়ে আছেন। নিত্যদিন তাঁদের পেটের ভাত জোটে না, ছেঁড়া কাপড় পরে তাঁদের লজ্জা নিবারণ করতে হয়। আর মাথার উপরে ছাতের কথায় বলি, হাজার হাজার মানুষের ঘরবাড়ি ভেঙে আজ যদি তাঁদের মানিকতলার খালপাড় থেকে উচ্ছিন্ন করা হচ্ছে, তো কাল খেদানো হচ্ছে টালিগঞ্জের খালপাড় থেকে। তাঁরা অ-আ-ক-খ শেখেননি, তাঁদের অনেকেই ভিক্ষাজীবী, এবং তাঁদের নব্বই শতাংশই সম্ভবত অসুখবিসুখ হলে জলপড়া তেলপড়া ছাড়া অন্য কোনো চিকিৎসার কথা ভাবতে পারেন না।
আপনারা আমার জীবনবোধের কথা জিজ্ঞেস করেছেন। ওটা অনেক বড়ো ব্যাপার, আমার বোধবুদ্ধি ওর নাগাল পায় না। আমি জ্ঞানী মানুষ নই, ইংরেজিতে যাকে কমন-সেন্স বলে, আমার একমাত্র সম্বল সেই কাণ্ডজ্ঞান। আর হ্যাঁ, চোখ দুটো যখন আছে, তখন খোলা চোখে চারদিকে তাকিয়ে সব দেখি। দেখি আকাশ, দেখি গাছপালা, দেখি রাস্তাঘাট আর ঘরগৃহস্থি। একটু আগে যাঁদের কথা বলেছি, দেখি তাঁদেরও।
দেখতে দেখতে আমাদেরই এক প্রাজ্ঞ সাহিত্যকর্তার একটি সতর্কবাণী নিত্য মনে পড়ে: নগর পুড়িলে কি দেবালয় এড়ায়? না, তা এড়ায় না, আগুনের আঁচ লাগে তার গায়েও। তাই ভাবি যে, এত এত মানুষের নূ্যনতম চাহিদাটুকু যদি আজও না মিটে থাকে, তা হলে আমাদের, অর্থাৎ নূ্যনতম চাহিদার উপরে আরো বেশ কিছু চাহিদা যাদের মিটেছে, তারাই কি খুব নিশ্চিন্ত জীবন যাপন করতে পারবে? পারা সম্ভব?
একে আমার জীবনবোধ বলতে পারেন, কিংবা জীবন জিজ্ঞাসাও।