Ticker

6/recent/ticker-posts

শঙ্খ ঘোষের কলমে...

amarboi
বইয়ের হাট ব্লগ
শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
শঙ্খ ঘোষ

চালু হয়েছে বইয়ের হাট ব্লগ। এখন থেকে এখানে প্রকাশিত হবে বাংলা সাহিত্যের নানা অনুষঙ্গের বাছাইকৃত অংশবিশেষ। দীর্ঘ লেখা নয়, মাত্র ৫ থেকে ১০ মিনিটে পড়ে ফেলা যায় এমন সব লেখা নিয়ে সাজানো হবে বইয়ের হাটের ব্লগ। লেখাগুলো আশাকরি পাঠকের পাঠাভ্যাস ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে। আপনাদের সহযোগিতায় আমরা এগিয়ে চলেছি। পাশে থাকুন, আমাদের সমৃদ্ধ করুন, নিজেকে আলোকিত করুন। ধন্যবাদ

'ছন্দের বারান্দা'র শেষ প্রুফটা দিতে গিয়েছি বিকাশবাবুর হাতে, সিগনেটের দোকানে, দেখেই হাসিমুখে বলে উঠলেন উনি: 'এই-যে ভাই, একটা কাজ করে দিতে হবে কিন্তু৷'
'কাজ! কী কাজ?'
'সতীনাথ ভাদুড়ীর সমস্ত লেখা একত্র করে ছাপব আমরা, ভাবছি৷ আমরা মানে, অরুণা প্রকাশনী থেকে৷ কয়েক খণ্ড হবে হয়তো৷ সেটার ভার নিতে হবে ভাই আপনাকে৷'
'ভার মানে!'
'সম্পাদনা করা৷ সম্পাদনা করে দিতে হবে আপনাকে৷'
'আমাকে? সে কী? হঠাৎ আমি? না না, এ আমি পারব না৷'
'না বললে শুনছি না৷ এ আমরা ঠিক করে ফেলেছি৷'
'বাঃ, আপনারা ঠিক করে ফেলেছেন বলেই আমাকে করতে হবে? এ-বিষয়ে আমার কোনো অধিকারই নেই৷'
'তা বললে শুনছি না৷ করতেই হবে৷ সঙ্গে নির্মাল্যও থাকবে৷ নির্মাল্যকেও বলেছি৷ ও বলেছে আপনি থাকলে ও থাকবে, নইলে নয়৷'
'নির্মাল্যকেই বলুন৷ আমি পারব না৷'
'আরে ভয় নেই৷ আমরা টাকাপয়সা কিছু দেব না৷'
এবারে একটু থমকে যাই৷ লিখে বা সম্পাদনা করে টাকাপয়সা যে বিশেষ কিছু পাওয়া যায় না, সে-রকম অভিজ্ঞতা ততদিনে ঘটে গেছে৷ কিন্তু টাকাপয়সা দেব না বলা যে একটা অভয়বাণীও হতে পারে, এতটা ধারণা ছিল না৷ এই অভয়বাণীর পর অবশ্য 'না' বলাও মুশকিল, কেননা তাহলে মানে দাঁড়াবে যে অর্থপ্রাপ্তি নেই বলেই করছি না কাজটা৷
সত্যি বলতে কী, এই বিকাশ বাগচী নামের মানুষটি এতই সজ্জন, এতই নিরীহ, এতই বন্ধুবৎসল যে তাঁকে প্রতিহত করা খুব শক্ত৷ যে-কাজ কোনোদিন করব বলে ভাবিনি কখনো, তেমনই একটা কাজের দায়িত্ব নিতে হলো তাই৷ হাত দিতে হলো সম্পাদনায়৷
তাহলে তো প্রথমেই সতীনাথের দাদার কাছে যাওয়া দরকার? তাঁরই কাছে তো অনুমতি নিতে হবে প্রথমে? বছর সাতেক আগে সতীনাথের মৃত্যু হয়েছে বলেই নয়, তারও আগে থেকে ওঁর লেখাপত্রের জন্য প্রকাশকদের যোগ রাখতে হতো দাদা ভূতনাথের সঙ্গেই৷ সামনের পথ দিয়ে চলে যাচ্ছেন দেখে সতীনাথকে একদিন দোকানে ধরে এনেছিলেন শচীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়৷ বলেছিলেন: 'একটু বসুন, আপনার কিছু টাকা পাওনা আছে৷' সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান সতীনাথ, বলেন: 'সেসব কথা দাদার সঙ্গে বলবেন', আর বলেই ত্বরিত পায়ে চলে যান দোকান ছেড়ে৷
'হ্যাঁ, সে তো ঠিকই৷ অনুমতির জন্য ভূতনাথবাবুর কাছে তো যেতেই হবে একবার৷ আপনিও যাবেন তো?'
'না গেলে আর চলবে কেন? আমাকে তো যেতে হবে নিশ্চয় অনেকবার৷ জানতে তো হবে কিছু৷'
সকালবেলায় একদিন তাই হাজির হই ওঁদের বাঙুর অ্যাভিনিউর বাড়িতে৷ প্রস্তাব শুনে খুশি হন ওঁরা৷ সতীনাথের বৌদি এসে তাঁর প্রয়াত দেবর বিষয়ে যে-ভাষায় যে-গলায় কথা বলতে থাকেন স্নেহমমতায় মাখানো, তাতে তাঁকে প্রায় শরৎচন্দ্রের হাতে তৈরি চরিত্র বলে মনে হতে থাকে৷ চিরকুমার সতীনাথ কীভাবে তাঁর একক জীবন কাটাতেন তার একটা ছবি জেগে উঠতে থাকে ওই দম্পতির গল্পগুজব থেকে, মনে মনে উপকৃত হতে থাকি আমি৷
ঘরে রাখা ছিল ছোটো দুটো বইয়ের আলমারি, কাচের পাল্লা দেওয়া, প্রায় গায়ে গায়ে লাগানো৷ কিন্তু দুটোই ফাঁকা৷ একটি-দুটি যে বই পড়ে আছে, তার দিকে নজর করে দেখছি যখন, ভূতনাথ বলেন: 'ওর তো বেশির ভাগই ছিল ফরাসি বই, সেসব দিয়ে দেওয়া হয়েছে চন্দননগরের লাইব্রেরিতে৷ এখানে তো কিছুই আর নেই৷'
আলতোভাবে জিজ্ঞেস করি একবার: 'আচ্ছা, উনি কি কখনো ডায়েরি লিখতেন?'
'না, ডায়েরি লেখার কোনো অভ্যাস ওর ছিল না৷'
বৌদি আপ্যায়ন করছেন আমাকে, বিকাশবাবু বৈষয়িক কথা সাঙ্গ করছেন ভূতনাথ ভাদুড়ীর সঙ্গে৷ ভূতনাথবাবু বলছেন: 'সতীনাথের বই কিন্তু বেশি বিক্রি হয় না৷'
অকুতোভয় বিকাশবাবু বলেন: 'দাদা, সে-ভাবনা আমার৷'
'না, সেইজন্য আমার শর্তের কথাটা আগে জেনে নিন৷ আমি কিন্তু বিক্রির উপর রয়্যালটির হিসেবে টাকা নেব না৷ আপনার কী বিক্রি হলো না হলো সে আমি জানতেও চাইব না৷ আমাকে দিতে হবে থোক টাকা, অগ্রিম, বাৎসরিক হিসেবে৷'
সে যে কত টাকা, তাও জানিয়ে দেন তিনি৷ আমার চমক লাগে শুনে যে মুহূর্তমধ্যে বিকাশবাবু মেনে নেন সেটা৷ তাঁর ক্ষীণ সামর্থ্য সত্ত্বেও কিছুমাত্র ইতস্তত করেন না তিনি৷
উঠে আসবার অল্প আগে শূন্যপ্রায় আলমারির নীচের তাকে দাঁড় করানো একইরকম কয়েকখানা বই দেখে, ভূতনাথবাবুকে জিজ্ঞেস করি: 'ওগুলো কী বই?'
'বই নয়, ওগুলি কয়েকটা ডায়েরি৷'
'কার?'
'সতীনাথেরই৷ সুর-ডায়েরি থেকে বছর বছর পাঠাত ওকে৷'
'তবে যে বললেন, উনি ডায়েরি লিখতেন না?'
'না না, ডায়েরি লেখা বলতে যা বোঝায়, ওগুলি তেমন কিছু নয়৷ একলা থাকত তো৷ তাই ওই বাজারের হিসেব, ধোপার হিসেব— এইসব টুকিটাকি আছে ওখানে৷'
'একটু কি আমি দেখতে পারি?'
'দেখবেন? হ্যাঁ, দেখুন৷' বলে আলমারি খুলে দিলেন উনি৷ নিজেই বার করে দিলেন এক এক করে ন খানা ডায়েরি৷ দু-চার পাতা উলটে দেখছি যখন, উনি বলছেন: 'আমি আর নাড়াচাড়া করিনি৷'
'দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে বাজারহিসেবের চেয়ে একটু হয়তো বেশিই আছে এখানে৷ আচ্ছা, এগুলো কি আমি কয়েকদিনের জন্য নিয়ে যেতে পারি? আমাদের কাজে হয়তো কিছু সাহায্যও হতে পারে৷'
'নিশ্চয় নিতে পারেন৷ দাঁড়ান, আমি একটু বেঁধে দেওয়ার ব্যবস্থা করি৷ সাবধানে রাখবেন কিন্তু৷'
'সে তো অবশ্যই৷'
বাঁধানোর আয়োজন করছেন উনি, লোভাতুর চোখে আমি তাকিয়ে আছি ওই আলমারি দুটিরই দিকে৷ হঠাৎ মনে হলো দুই আলমারির মধ্যবর্তী শীর্ণ ফাঁকটায় কিছু যেন গুঁজে রাখা আছে৷ ভূতনাথবাবুকে সেটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করি: 'ওটা কী বলুন তো?'
'ও একটা পুরোনো ব্যাগ৷ সতীনাথই ব্যবহার করত৷ এখন আর কাজে লাগে না৷ পড়ে আছে৷'
সসংকোচে বলি: 'দেখব একটু?'
'ওটা? ওটার কী দেখবেন?'
'কিছুই না৷ তবু একটু দেখতে পেতাম যদি৷'
'বেশ, দেখুন৷'
নিচু হয়ে টেনে বার করি একটা ছেঁড়া ক্যাম্বিসের ব্যাগ৷ হাঁ হাঁ করে ওঠেন ভূতনাথবাবু: 'আরে আরে করেন কী৷ ধুলোবালিতে ভর্তি, হাত দেওয়া হয়নি কতকাল, দাঁড়ান একটু ঝেড়েঝুড়ে দিক আগে৷'
কিন্তু পরিচ্ছন্নতার অপেক্ষায় না থেকে আমি খুলে ফেলি সে-ব্যাগের মুখ, আর দেখি অনেক টুকরো টুকরো ছেঁড়া কাগজ জমে আছে তার মধ্যে৷
'যদি আপনার কোনো আপত্তি না থাকে, এটাও তবে নেব৷'
'এটা? কতগুলো ছেঁড়া কাগজের টুকরো দিয়ে কী করবেন!'
'ছেঁড়া, তা সত্যি৷ ব্যাগটাও তো ছেঁড়া৷ তবু৷ এখানে বসে তো ঠিকমতো দেখা হলো না৷ বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ভালো করে একটু দেখতে চাই৷ সময়মতো ফেরত দিয়ে দেব আবার৷'
'না না, ওটা ফেরত নিয়ে কী করব৷ নিয়ে যান আপনি, শখ যদি হয়৷ কিন্তু তার আগে, ওরে, একটু সাফ করে দিয়ে যা তো এগুলো, ওঁরা নিয়ে যাবেন বলছেন—'

দুই হাতে দুই বান্ডিল নিয়ে বেরিয়ে আসি আমরা৷ পথে নেমেই এক পানের দোকানের সামনে প্রায় নাচের ভঙ্গিতে বিকাশবাবু বলেন: 'আঃ, কী যে আনন্দ হচ্ছে আজ৷ কী বিরাট একটা কাজ হলো৷ দাঁড়ান, আগে একটু পান খেয়ে নিই৷'
'এত আনন্দ হচ্ছে আপনার? আমার তো ভয় হচ্ছে শুধু আপনার কথা ভেবে৷'
'কেন?'
'ও-রকম একটা শর্তে রাজি হয়ে গেলেন? বই যে বিক্রি হবে না, সত্যি সত্যি সেটা জানেন তো? তখন কী হবে?'
সুপ্রসন্ন মুখে বিকাশবাবু বলেন: 'তা না হোক৷ একটা ভালো কাজ তো হবে ভাই৷ কী বলেন, কাজটা ভালো হবে না?'

বাড়িতে ফিরেই ডায়েরিগুলি খুলে বসি৷ হ্যাঁ, বাজারহিসেব, ধোপার হিসেব আছে ঠিকই অল্পস্বল্প, কিন্তু পাতায় পাতায় তারও চেয়ে অনেক বেশি যা আছে তা হলো ওঁর লেখার ভিতকল্পনা৷ তার উৎস, তার পূর্বাভাস, তার সম্ভাব্য বুনুনি, এর সব কিছুই ধরা আছে এর পাতায় পাতায়, আর সেইসঙ্গে আছে অন্তর্লীন নানা সময়ে লেখা প্রগাঢ় কোনো অনুভবের কথা, আছে বইপড়া থেকে পাওয়া কোনো ভাবনার সারাৎসার বা মূল উদ্ধৃতি, আছে পড়াশোনার অনেক অতীত বা ভাবী ইশারা৷ কী আশ্চর্য, কেন তবে ভূতনাথ ভাদুড়ী বলেছিলেন যে ডায়েরি লেখার কোনো অভ্যাসই ছিল না সতীনাথের?
আর সেই ময়লা ছেঁড়া ব্যাগ? সে হয়ে উঠল এক রত্নভাণ্ডার৷ অনেকটা সেখানে ছিঁড়ে ফেলা চিঠিপত্র, আস্তও যে দু-একটি ছিল না তা নয়৷ ব্যক্তিগত নয়, সবই লেখকগত চিঠি৷ কোনোটায় সম্পাদকের তাড়া, কোনোটায় প্রকাশকের হিসেব, কোনোটায় সভাসমিতিতে আহ্বান, কোনোটায়-বা এই খবর যে 'গণনায়ক' বইটির জন্য প্রথম নাম ভাবছিলেন তিনি 'ওয়ার কোয়ালিটি', আর শেষ পর্যন্ত সেটা পালটে নেন মনোজ বসুর পরামর্শে৷ এসব কাগজপত্র থেকেই ধরা গেল যে 'জাগরী'র প্রকাশকাল পূর্বপ্রচারমতো ১৯৪৬ নয়, ১৯৪৫ সালের চৌঠা অক্টোবর, আর তা ছাপা হয়েছিল ৬৫০ কপি! এসব কাগজপত্রের সূত্র ধরেই সুব্রত রুদ্রকে সঙ্গে নিয়ে একদিন হানা দিতে হলো কৃষ্ণনগরের 'হোমশিখা' দপ্তরে, জানা গেল যে 'সতীনাথ-বিচিত্রা'য় 'গোপাল জাগো জাগো' নামের কবিতাটির লেখকপ্রদত্ত নাম ছিল 'দিবাস্বপ্ন'৷
বলা যায়, ওই ডায়েরি আর ছেঁড়া ক্যাম্বিসের ব্যাগটাই খবর জুগিয়ে জুগিয়ে আমাদের উৎসাহ বাড়িয়ে দিল অনেকখানি, বছর দুয়েক বেশ তৃপ্তিভরেই করা গেল বিকাশবাবুর কাজটা৷
একটাই শুধু সমস্যা হলো৷ সুমুদ্রিত সুশোভন চার খণ্ডে 'সতীনাথ গ্রন্থাবলী'র প্রথমটি যখন বেরোল, কলেজ স্ট্রিটের দোকানে দোকানে যখন তা গছিয়ে দিতে চাইছেন বিকাশবাবু, কোনো কোনো শুভার্থী দোকানি তখন বলেছিলেন তাঁকে: 'ধুর মশাই, এ আপনি কী করলেন? এঁরও গ্রন্থাবলী? না-হয় ইনি গাইতে পারেন ভালো, তাই বলে এঁর বইও ছাপবেন? ছিঃ! কিনবে কে?'