বইয়ের হাট ব্লগ
শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
ম্যাজিক - হুমায়ূন আহমেদ
উনিশশাে পঁয়ষট্টি সন। একটা স্যুটকেস এবং ‘হােল্ডঅল’ নামক বস্তুতে লেপ-তােষক ভরে ঢাকা কলেজের সাউথ হােস্টেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। আজ আমাকে সীট দেয়া হবে। একটু ভয় ভয় লাগছে কারণ শুনতে পাচ্ছি যত ভাল রেজাল্টই হােক সবাইকে সীট দেয়া হবে না। যাদের দুষ্ট প্রকৃতির ছেলে বলে মনে হবে হােস্টেল সুপার তাদের বাতিল করে দেবেন। তাঁর কথাই শেষ কথা। আপীল চলবে না।
আমি দুষ্ট প্রকৃতির ছেলে নই। কিন্তু চেহারায় সেই ব্যাপারটা আছে কি-না বুঝতে পারছি না। চেহারা দেখে যদি আমাকে দুষ্ট প্রকৃতির মনে হয় তাহলে তাে সর্বনাশ! আমি প্রাণপণ চেষ্টা করছি চেহারায় এক ধরনের গােবেচারা ভাব ফুটিয়ে তুলতে।
সুপারের ঘরে ডাক পড়ল।
সুপার একবারাে আমার দিকে না তাকিয়ে বললেন, ২০৬ নম্বর রুম। জানালার কাছের সীট। কোন ফাজলামী বদমায়েশী করা চলবে না। প্রতিদিন সন্ধ্যায় রােল কল হবে। রােল কলের সময় যদি পরপর দুদিন সীটে না পাওয়া যায় তাহলে সীট ক্যানসেল । মনে থাকবে?
‘জ্বি স্যার, থাকবে।’
‘ভাল ভাল ছেলে ঢাকা কলেজে পড়তে আসে। অল্প কিছু ভাল থাকে, বেশির ভাগই বাঁদর হয়ে যায়। কথাটা যেন মনে থাকে।’
‘মনে থাকবে স্যার।’
‘হােস্টেল ফিস দাও। এক মাসের খাবার বাবদ ৩৮ টাকা। সীট ভাড়া পাঁচ টাকা, অন্যান্য ফী পাঁচ টাকা। মােট আটচল্লিশ।’
আমি আটচল্লিশ টাকা দিয়ে ঢাকা কলেজ সাউথ হােস্টেলে ভর্তি হয়ে গেলাম। আতংকে বুক কাঁপছে। মনে হচ্ছে জেলখানা। এর আগে কখনাে বাবা, মা, ভাইবােন ছেড়ে এত দুরে থাকি নি। কাঁদতে ইচ্ছা হচ্ছে। কলেজের ছাত্র, কাঁদলে সবাই হাসাহাসি করবে। চোখের পানি আসি আসি করেও আসছে না।
সেই সময়ে ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন জালালুদ্দিন আহমেদ।
কড়া লােক। তার আইন-কানুন বড়ই কঠিন। তৃতীয় দিনেই তার পরিচয় পেলাম। নর্থ হােস্টেলের এক ছাত্র সেকেণ্ড শাে সিনেমা দেখে হােস্টেলে ফিরছিল। কপালের ফেরে বেচারা প্রিন্সিপ্যাল স্যারের সামনে পড়ে গেল। স্যার শীতল গলায় বললেন, কাল ভাের দশটার আগেই তুমি হােস্টেল ছেড়ে চলে যাবে। তুমি দুষ্ট গরু। দুষ্ট গরু আমি গােয়ালে রাখব না।
দুষ্ট গরুকে পরদিন সকাল ন'টায় কাঁদতে কাঁদতে রিকশায় বেডিংপত্র তুলে চলে যেতে দেখা গেল। তাকে তখন মােটেই দুষ্ট গরু মনে হচ্ছিল না।
আমরা সবাই সাবধান হয়ে গেলাম। নিঃশ্বাস ফেলতেও সাবধানে ফেলি। প্রিন্সিপ্যাল স্যার যদি আবার নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ শুনে ফেলেন। প্রচণ্ড পড়াশােনার চাপ। রাতে রােল কল। মাঝে মাঝে গভীর রাতে চেকিং। ভয়াবহ অবস্থা। এর মধ্যে সপ্তাহটা কোনদিকে যায় বুঝতেই পারি না – সমস্যা হয় ছুটির দিনে। ছুটির দিন আর কাটতে চায় না। ছুটির দিন আইন-কানুন কিছু দুর্বল থাকে। রাত ন'টার সময় প্রিন্সিপ্যাল স্যারের সামনে পড়ে গেলে তিনি শুধু কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করেন – কি নাম? হুজুর বাহাদুরের কি নাম? এই পর্যন্তই। পরদিন সকালে বিছানা-বালিশ নিয়ে চলে যেতে হয় না। ছুটির দিনে হােস্টেলের ছাত্ররা আত্মীয়স্বজনের বাসায় যায়। কেউ কেউ যায় বলাকা সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে। আইয়ুব খানের কল্যাণে তখন ছাত্রদের সিনেমা দেখা খুব সহজ। ছাত্র হলে সরকারী ট্যাক্স দিতে হয় না। টিকিটের দাম অর্ধেক। মুশকিল হচ্ছে ঢাকায় তখন আমার কোন আত্মীয়স্বজন নেই। অর্ধেক দামে সিনেমার টিকিট কেনার মত পয়সাও নেই। সময় কাটানাের জন্যে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানাে শুরু করলাম। সকাল বেলা বেরিয়ে পড়ি। দুপুরের আগে হােস্টেলে ফিরে ভাত খেয়ে আবার বেরিয়ে পড়ি। ফিরি সন্ধ্যা মেলাবার পর।
এরকম ঘুরতে ঘুরতেই মুখলেসুর রহমান নামের একজনের দেখা পেলাম। তার পেশা অদ্ভুত। ম্যাজিক দেখায়। এবং টাকার বিনিময়ে ম্যাজিকের কৌশল বলে দেয়। ম্যাজিকের যন্ত্রপাতি বিক্রি করে। অপূর্ব সব ম্যাজিক। তাকে ঘিরে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যেই সে দেখাচ্ছে চারটা টেক্কা। নিমিষেই চার টেক্কা হয়ে গেল চার বিবি। এখানেই শেষ নয়, ফুঁ দিতেই চার বিবিও অদৃশ্য। বিবির জায়গায় শাদা তাস ! মুখলেসুর রহমান তাস রেখে বিড়ি ধরিয়ে বলল, কেউ যদি এই তাস কিনতে চান পাঁচ টাকা। আর যদি শুধু ম্যাজিক শিখতে চান, তিন টাকা।
খেলার কৌশল না জেনে বাড়ি যাওয়া সম্ভব না। আমার কৌতূহল প্রবল, আমার পায়ে শিকড় গজিয়ে গেছে। আমি নড়তে পারছি না। তিন টাকা দিয়ে কৌশল জানলাম। তবে কৌশল বলার আগে আমাকে তিন পীরের, মা-বাবার এবং ভাতের কসম কাটতে হল – এই কৌশল কাউকে বলা যাবে না। মুখলেসুর রহমান যা বলে আমি তাতেই রাজি। আমাকে জানতেই হবে। না জানলে আমি পাগল হয়ে যাব।
কৌশল জানার পর মনটা ভেঙে গেল। এত বড় ফাঁকি ! মানুষকে ধোকা দেয়ার এত সহজ পদ্ধতি? আমি এমন বােকা! এই সহজ ধোঁকা বুঝতে পারলাম না?
আমার তিনটা টাকা চলে গেল ? তিন টাকায় ছদিন সকালের নাশতা হত। রাগে-দুঃখে আমার চোখে প্রায় পানি এসে গেল। মুখলেসুর রহমান সম্ভবত আমার মনের অবস্থা বুঝল। সে উদাস এবং খানিকটা বিষণ গলায় বলল, তুমি খেলার ফাঁকিটা দেইখা মন খারাপ করলা? ফাঁকির পেছনে বুদ্ধিটা দেখলা না? এই বুদ্ধির দাম হাজার টেকা।
ম্যাজিসিয়ানের দার্শনিক ধরনের কথায়ও আমার মন মানল না। ফাঁকি হচ্ছে ফাঁকি। ফাঁকির পেছনে বুদ্ধি থাকুক আর না থাকুক তাতে কিছু যায় আসে না। মন খারাপ করে হােস্টেলে চলে এলাম ঠিকই কিন্তু আমার নেশা ধরে গেল। ছুটির দিন হলেই আমি খুঁজে খুঁজে মুখলেসুর রহমানকে বের করি। সে সাধারণত বসে গুলিস্তান এলাকায়। মাঝে মাঝে ফার্মগেটের কাছে। পরের বার তার কাছ থেকে শিখলাম দড়ি কাটার কৌশল। দড়ি কেটে দুখণ্ড করা হয়। নিমিষের মধ্যে সেই দড়ি জোড়া লাগিয়ে দেয়া হয়। কৌশল এত সহজ কিন্তু করা হয় অতি নিপুণ ভঙ্গিতে। দড়ি কাটার কৌশল শিখতে আমার পাঁচ টাকা চলে গেল। শিখলাম পয়সা তৈরির কৌশল। চার আনা, আট আনার মুদ্রা বাতাস থেকে তৈরি করে ঝনঝন করে টিনের কৌটায় ফেলা হয়। এই কৌশল শিখতে দশ টাকা চলে গেল। তবে এই খেলা কাউকে দেখাতে পারলাম না। এই খেলা দেখানাের জন্যে পামিং জানা দরকার। পামিং হচ্ছে হাতের তালুতে কোন বস্তু লুকিয়ে রাখার কৌশল। আমার পামিং জানা নেই।
হােস্টেলে থাকার জন্য বাসা থেকে সামান্যই টাকা পাই। সেই সামান্য টাকার বড় অংশই চলে যাচ্ছে ম্যাজিকে। আমাকে মিথ্যা করে চিঠি লিখতে হয় – “বই কিনতে হবে, টাকা দরকার। কলমটা হারিয়ে গেছে, নতুন কলম দরকার।”
দু’বছর পর আমি ঢাকা কলেজ থেকে পাস করে বেরুলাম। বন্ধুমহলে আমি তখন ম্যাজিসিয়ান হুমায়ূন বলে পরিচিত। ভর্তি হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ম্যাজিকের ভূত আমাকে ছাড়ল না। আমি তখন সিন্দাবাদ। ম্যাজিকের ভূত আমার ঘাড়ে বসে আছে। যতবার নামাতে যাই ততবারই সে আরাে জোরে আমার গলা চেপে ধরে।
পুরানাে ঢাকার আওলাদ হােসেন লেনে তখন একজন বৃদ্ধ ওস্তাদের সন্ধান পেয়েছি। বিহারের লােক। পামিং-এর রাজা বলা যায়। হাঁসের প্রকাণ্ড ডিম সে হাতের তালুতে লুকিয়ে ফেলে। তার এক ফুট সামনে বসে থাকা মানুষটিরও বােঝার উপায় নেই যে, সে প্রকাণ্ড একটা ডিম হাতের তালুতে লুকিয়ে রেখেছে। সে শুধু যে হাতের তালুতে ডিম লুকিয়ে রাখছে তাই না, এক হাত থেকে অন্য হাতে সেই ডিম দ্রুত চালান করে দিচ্ছে। চোখের পলকের চেয়েও তার হাতের গতি দ্রুত। তাকে আমি ডাকি ওস্তাদজী। লােকটা মহা ঠগ – আমার কাছ থেকে টাকা নেয় কিন্তু কিছু শেখায় না। বিরসমুখে বলে পামিং শেখানাের কিছু নাই - প্র্যাকটিস কর, প্র্যাকটিস।
সেই প্র্যাকটিস কিভাবে করব তাও বলে দেয় না। অনেক অনুরােধের পর আমার হাতের তালু খানিকক্ষণ টিপেটুপে বলে – তােমার হাত শক্ত। এই হাতে পামিং হবে না। বেহুদা পরিশ্রম। বরং ম্যাজিকের এক গল্প শােন।।
ওস্তাদজী এমিতে বাংলাতেই কথা বলে তবে গল্পের তােড় এসে গেলে বিহারী কথা শুরু হয়, যার এক বর্ণও আমি বুঝি না। এক সময় ওস্তাদজীর স্ত্রী এসে কড়া ধমক লাগায় এবং আমার দিকে উগ্র চোখে তাকিয়ে বলে, নিকালাে আভি নিকালাে। অত্যন্ত অপমানসূচক কথা কিন্তু আমি সেই অপমান গায়ে মাখি না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের মাঝামাঝি সময়ে এক প্রতিভা প্রদর্শনীর আয়ােজন হল। গান-নাচ-আবৃত্তি যে যা জানে। টিএসসিতে বিশাল ব্যবস্থা। আমিও উপস্থিত হলাম আমার ‘ম্যাজিক প্রতিভা’ নিয়ে।
হল ভর্তি ছাত্র-শিক্ষক। বিরাট মঞ্চ। চোখ-ধাঁধানাে আলাে। ভয়ে আমার পা কাঁপছে। মুখ দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না। জিভ সীসার মত ভারী হয়ে গেছে। শুধু তাই না, সাইজেও মনে হয় খানিকটা বড় হয়ে গেছে। মুখ থেকে বেরিয়ে পড়তে চাচ্ছে। অনেক কষ্টে প্রথম আইটেম দেখালাম! ট্রায়াঙ্গুলার বাক্স থেকে কবুতর এবং মুরগি বের করার খেলা। এই বাক্স আমার নিজের না। অন্য এক জাদুকরের কাছ থেকে কুড়ি টাকায় ভাড়া করে এনেছি। প্রথম খেলা খুব জমে গেল। প্রচণ্ড হাততালি। আমার আড়ষ্টতা কেটে গেল। দ্বিতীয় আইটেম ‘এন্টি গ্রেভিটি বটল’! একটা বােতল মধ্যাকর্ষণ শক্তি উপেক্ষা করে শূন্যে ভাসবে। এটিও জমে গেল। আমার মনে হয় ছাত্র-ছাত্রীরা গান শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল – আমার সামান্য ম্যাজিকে যে কারণে তাদের উল্লাসের সীমা রইল ।
সেদিন ‘খেলা’ ভালই দেখিয়েছিলাম। কারণ এক সপ্তাহ না যেতেই টিভি থেকে ডাক পেলাম। তারা একটা প্রােগ্রাম করবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রী নিয়ে অনুষ্ঠান, যেখানে আমার জন্যে পাঁচ মিনিট বরাদ্দ করা আছে। মিনিটে দশ টাকা হিসেবে আমি পাব পঞ্চাশ টাকা। আমার আনন্দ এবং বিস্ময়ের সীমা রইল না। ঠিক করলাম মুদ্রা তৈরির খেলা দেখাব। শূন্য থেকে মুদ্রা তৈরি করে টিনের কৌটায় ফেলা। ঝনঝন শব্দ হতে থাকবে - এক সময় কৌটা মুদ্রায় ভর্তি হয়ে যাবে।
পুরােটাই হাতের কৌশল। খুবই প্র্যাকটিস দরকার। আমি দরজা বন্ধ করে প্র্যাকটিস করি। নিরলস সাধনা যাকে বলে। এর চেয়ে অনেক কম সাধনায় ঈশ্বর ধরা দেন। মহসিন হলের প্রধান হাউস টিউটর তখন অধ্যাপক এমরান। তিনি একদিন জরুরি চিঠি পাঠিয়ে আমাকে ডেকে পাঠালেন। গম্ভীর গলায় বললেন, তােমার বিরুদ্ধে কমপ্লেইন আছে।
‘কি কমপ্লেইন স্যার?'
‘ঘর বন্ধ করে তুমি নাকি সারারাত কি-সব কর। ঝনঝন শব্দ হয়। কেউ ঘুমুতে পারে না। তুমি কি কর?”
‘স্যার, ম্যাজিক শিখি।’
ম্যাজিক শেখার জন্যে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছ ? এটা কি ম্যাজিকের স্কুল ? খবর্দার, আর যেন ঝনঝনানি না শুনি। আর একবার ঝন ঝন হলে সীট ক্যানসেল। মনে থাকে যেন।
আমি বিমর্ষমুখে রুমে ফিরে এলাম। তবে প্র্যাকটিস বন্ধ হল না। কৌটার নিচে তুলা দিয়ে প্রাকটিস চালাতে লাগলাম। যথাসময়ে টিভি অনুষ্ঠান হয়ে গেল। তখন টিভি ছিল ডিআইটি ভবনে। সব প্রগ্রাম হত লাইভ। আমার নিজের অনুষ্ঠান নিজে দেখতে পেলাম না। তাতে আমার আনন্দের কমতি হল না। স্টুডিও থেকে বের হয়ে মনে হল সবাই তাকিয়ে আছে আমার দিকে। বিস্ময়ের সঙ্গে দেখছে তরুণ জাদুকরকে।
আমার কোন নেশা দীর্ঘস্থায়ী হয় না – এটা হয়ে গেল। মানুষকে বিস্মিত করতে পারার আলাদা আনন্দ আছে। সেই আনন্দে বুদ হয়ে রইলাম। কেমিস্ট্রি পড়া চালিয়ে যাচ্ছি -- চালাতে হয় বলেই চালানাে। ডিপার্টমেন্টের স্যাররা প্রায়ই বলেন হুমায়ূন বাসায় জন্মদিনের পার্টি আছে, ম্যাজিক দেখিয়ে যাও। আমি মহা উৎসাহে রিকশায় করে বাক্স-টাক্স নিয়ে রওনা হই। একদিন ঢাকা জুট মিলে ম্যাজিক দেখিয়ে দুশ টাকা পেলাম। একশ’ চলে গেল যন্ত্রপাতির ভাড়ায়। একশ’ লাভ।
মহসিন হলে যে ঘরে আমি থাকি সেখানে খাঁচায় চারটা কবুতর এবং একটা টিয়া পুষি। ম্যাজিকে কবুতর, টিয়া এসব লাগে। আমার একটাই স্বপ্ন - “ইন্টারন্যাশনাল ব্রাদারহুড অব ম্যাজিসিয়ানস”-এর সদস্য হব। এই সদস্যপদের জন্যে আকাক্ষার কারণ হল ঢাকায় দু’জন জার্মান জাদুকর এসেছিলেন। দু’জনই “ইন্টারন্যাশনাল ব্রাদারহুড অব ম্যাজিসিয়ানস”-এর সদস্য। তাঁরা হােটেল শাহবাগে জাদু দেখিয়ে সবাইকে চমৎকৃত করেছেন। আমি নিজে হয়েছি স্তম্ভিত। তখন আর্থিকভাবে খুব অসহায় অবস্থা সত্ত্বেও দুবার তাদের শাে দেখলাম। নেশা লেগে গেল। কঠিন নেশা।
এখন বলি নেশা কি করে কাটল সেই গল্প। নেশা পুরােপুরি কেটে গেল আমার বাসর রাতে। বালিকাবধূকে মুগ্ধ করার জন্য রাত তিনটার দিকে তাকে ম্যাজিক দেখাতে শুরু করলাম। হয়ত খুব সাবধান ছিলাম না কিংবা নবপরিণীতা স্ত্রীর সামনে নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলাম - দড়ি কাটার খেলাটা সে ধরে ফেলল এবং খুব হাসতে লাগল। দ্বিতীয় খেলাটায়ও একই অবস্থা।
মেয়েটি তার স্বামীকে চূড়ান্ত রকমের অপদস্ত করল। সে তা বুঝতেও পারল । আমি তৃতীয় ম্যাজিক দেখাতে যাচ্ছি। সে বলল, রাখুন তাে আপনার ম্যাজিক, এইসব কি শুরু করেছেন ? রাত বাজে তিনটা।
ঐ রাতেই আমার শেষ ম্যাজিক শাে হল। আর কখনাে ম্যাজিক দেখাই নি। বা দেখাতে উৎসাহ বােধ করি নি।
বিয়ের দশ বছর পর গুলতেকিন হঠাৎ করে বলতে শুরু করল - বাসর রাতে আমি খুব বােকামি করেছি। আমার উচিত ছিল বিস্মিত হবার ভান করা। সরি, তােমাকে ঐ রাতে খুব লজ্জা দিয়েছি। বয়স কম ছিল। বুঝতে পারি নি যে তুমি এত আগ্রহ করে আমাকে বিস্মিত করার চেষ্টা করছ। এখন একবার ম্যাজিক দেখাও - দেখ, আমি কি পরিমাণ মুগ্ধ হই। ম্যাজিকের কৌশল ধরার চেষ্টা করব না – চেষ্টা করব বিস্মিত হবার।
বিয়ের পর পনেরাে বছর হয়েছে। পনেরাে বছরে কোন ম্যাজিক দেখাই নি। তার পরেও “কিম আশ্চর্যম!” হঠাৎ ইংল্যাণ্ড থেকে চিঠি এসে উপস্থিত -- আমাকে ইন্টারন্যাশনাল ব্রাদারহুড অব ম্যাজিসিয়ানস এর সদস্যপদ দেয়া হয়েছে। এই অতি আশ্চর্য ঘটনা সম্ভব হয়েছে আমার জাদুকর বন্ধু জুয়েল আইচের কারণে। এই ভালমানুষটি আমাকে বিস্মিত করবার সুন্দর ব্যবস্থাই করে রেখেছিলেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল ব্রাদারহুড অব ম্যাজিসিয়ানের চিঠিটি এসে পৌছল আমার জন্মদিনে। কাকতালীয় ব্যাপার তাে বটেই। মাঝে মাঝে কাকতালীয় ব্যাপার ঘটে বলেই আমাদের এই জীবন এবং এই পৃথিবী এত মজার।
শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
ম্যাজিক - হুমায়ূন আহমেদ
উনিশশাে পঁয়ষট্টি সন। একটা স্যুটকেস এবং ‘হােল্ডঅল’ নামক বস্তুতে লেপ-তােষক ভরে ঢাকা কলেজের সাউথ হােস্টেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। আজ আমাকে সীট দেয়া হবে। একটু ভয় ভয় লাগছে কারণ শুনতে পাচ্ছি যত ভাল রেজাল্টই হােক সবাইকে সীট দেয়া হবে না। যাদের দুষ্ট প্রকৃতির ছেলে বলে মনে হবে হােস্টেল সুপার তাদের বাতিল করে দেবেন। তাঁর কথাই শেষ কথা। আপীল চলবে না।
আমি দুষ্ট প্রকৃতির ছেলে নই। কিন্তু চেহারায় সেই ব্যাপারটা আছে কি-না বুঝতে পারছি না। চেহারা দেখে যদি আমাকে দুষ্ট প্রকৃতির মনে হয় তাহলে তাে সর্বনাশ! আমি প্রাণপণ চেষ্টা করছি চেহারায় এক ধরনের গােবেচারা ভাব ফুটিয়ে তুলতে।
সুপারের ঘরে ডাক পড়ল।
সুপার একবারাে আমার দিকে না তাকিয়ে বললেন, ২০৬ নম্বর রুম। জানালার কাছের সীট। কোন ফাজলামী বদমায়েশী করা চলবে না। প্রতিদিন সন্ধ্যায় রােল কল হবে। রােল কলের সময় যদি পরপর দুদিন সীটে না পাওয়া যায় তাহলে সীট ক্যানসেল । মনে থাকবে?
‘জ্বি স্যার, থাকবে।’
‘ভাল ভাল ছেলে ঢাকা কলেজে পড়তে আসে। অল্প কিছু ভাল থাকে, বেশির ভাগই বাঁদর হয়ে যায়। কথাটা যেন মনে থাকে।’
‘মনে থাকবে স্যার।’
‘হােস্টেল ফিস দাও। এক মাসের খাবার বাবদ ৩৮ টাকা। সীট ভাড়া পাঁচ টাকা, অন্যান্য ফী পাঁচ টাকা। মােট আটচল্লিশ।’
আমি আটচল্লিশ টাকা দিয়ে ঢাকা কলেজ সাউথ হােস্টেলে ভর্তি হয়ে গেলাম। আতংকে বুক কাঁপছে। মনে হচ্ছে জেলখানা। এর আগে কখনাে বাবা, মা, ভাইবােন ছেড়ে এত দুরে থাকি নি। কাঁদতে ইচ্ছা হচ্ছে। কলেজের ছাত্র, কাঁদলে সবাই হাসাহাসি করবে। চোখের পানি আসি আসি করেও আসছে না।
সেই সময়ে ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন জালালুদ্দিন আহমেদ।
কড়া লােক। তার আইন-কানুন বড়ই কঠিন। তৃতীয় দিনেই তার পরিচয় পেলাম। নর্থ হােস্টেলের এক ছাত্র সেকেণ্ড শাে সিনেমা দেখে হােস্টেলে ফিরছিল। কপালের ফেরে বেচারা প্রিন্সিপ্যাল স্যারের সামনে পড়ে গেল। স্যার শীতল গলায় বললেন, কাল ভাের দশটার আগেই তুমি হােস্টেল ছেড়ে চলে যাবে। তুমি দুষ্ট গরু। দুষ্ট গরু আমি গােয়ালে রাখব না।
দুষ্ট গরুকে পরদিন সকাল ন'টায় কাঁদতে কাঁদতে রিকশায় বেডিংপত্র তুলে চলে যেতে দেখা গেল। তাকে তখন মােটেই দুষ্ট গরু মনে হচ্ছিল না।
আমরা সবাই সাবধান হয়ে গেলাম। নিঃশ্বাস ফেলতেও সাবধানে ফেলি। প্রিন্সিপ্যাল স্যার যদি আবার নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ শুনে ফেলেন। প্রচণ্ড পড়াশােনার চাপ। রাতে রােল কল। মাঝে মাঝে গভীর রাতে চেকিং। ভয়াবহ অবস্থা। এর মধ্যে সপ্তাহটা কোনদিকে যায় বুঝতেই পারি না – সমস্যা হয় ছুটির দিনে। ছুটির দিন আর কাটতে চায় না। ছুটির দিন আইন-কানুন কিছু দুর্বল থাকে। রাত ন'টার সময় প্রিন্সিপ্যাল স্যারের সামনে পড়ে গেলে তিনি শুধু কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করেন – কি নাম? হুজুর বাহাদুরের কি নাম? এই পর্যন্তই। পরদিন সকালে বিছানা-বালিশ নিয়ে চলে যেতে হয় না। ছুটির দিনে হােস্টেলের ছাত্ররা আত্মীয়স্বজনের বাসায় যায়। কেউ কেউ যায় বলাকা সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে। আইয়ুব খানের কল্যাণে তখন ছাত্রদের সিনেমা দেখা খুব সহজ। ছাত্র হলে সরকারী ট্যাক্স দিতে হয় না। টিকিটের দাম অর্ধেক। মুশকিল হচ্ছে ঢাকায় তখন আমার কোন আত্মীয়স্বজন নেই। অর্ধেক দামে সিনেমার টিকিট কেনার মত পয়সাও নেই। সময় কাটানাের জন্যে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানাে শুরু করলাম। সকাল বেলা বেরিয়ে পড়ি। দুপুরের আগে হােস্টেলে ফিরে ভাত খেয়ে আবার বেরিয়ে পড়ি। ফিরি সন্ধ্যা মেলাবার পর।
এরকম ঘুরতে ঘুরতেই মুখলেসুর রহমান নামের একজনের দেখা পেলাম। তার পেশা অদ্ভুত। ম্যাজিক দেখায়। এবং টাকার বিনিময়ে ম্যাজিকের কৌশল বলে দেয়। ম্যাজিকের যন্ত্রপাতি বিক্রি করে। অপূর্ব সব ম্যাজিক। তাকে ঘিরে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যেই সে দেখাচ্ছে চারটা টেক্কা। নিমিষেই চার টেক্কা হয়ে গেল চার বিবি। এখানেই শেষ নয়, ফুঁ দিতেই চার বিবিও অদৃশ্য। বিবির জায়গায় শাদা তাস ! মুখলেসুর রহমান তাস রেখে বিড়ি ধরিয়ে বলল, কেউ যদি এই তাস কিনতে চান পাঁচ টাকা। আর যদি শুধু ম্যাজিক শিখতে চান, তিন টাকা।
খেলার কৌশল না জেনে বাড়ি যাওয়া সম্ভব না। আমার কৌতূহল প্রবল, আমার পায়ে শিকড় গজিয়ে গেছে। আমি নড়তে পারছি না। তিন টাকা দিয়ে কৌশল জানলাম। তবে কৌশল বলার আগে আমাকে তিন পীরের, মা-বাবার এবং ভাতের কসম কাটতে হল – এই কৌশল কাউকে বলা যাবে না। মুখলেসুর রহমান যা বলে আমি তাতেই রাজি। আমাকে জানতেই হবে। না জানলে আমি পাগল হয়ে যাব।
কৌশল জানার পর মনটা ভেঙে গেল। এত বড় ফাঁকি ! মানুষকে ধোকা দেয়ার এত সহজ পদ্ধতি? আমি এমন বােকা! এই সহজ ধোঁকা বুঝতে পারলাম না?
আমার তিনটা টাকা চলে গেল ? তিন টাকায় ছদিন সকালের নাশতা হত। রাগে-দুঃখে আমার চোখে প্রায় পানি এসে গেল। মুখলেসুর রহমান সম্ভবত আমার মনের অবস্থা বুঝল। সে উদাস এবং খানিকটা বিষণ গলায় বলল, তুমি খেলার ফাঁকিটা দেইখা মন খারাপ করলা? ফাঁকির পেছনে বুদ্ধিটা দেখলা না? এই বুদ্ধির দাম হাজার টেকা।
ম্যাজিসিয়ানের দার্শনিক ধরনের কথায়ও আমার মন মানল না। ফাঁকি হচ্ছে ফাঁকি। ফাঁকির পেছনে বুদ্ধি থাকুক আর না থাকুক তাতে কিছু যায় আসে না। মন খারাপ করে হােস্টেলে চলে এলাম ঠিকই কিন্তু আমার নেশা ধরে গেল। ছুটির দিন হলেই আমি খুঁজে খুঁজে মুখলেসুর রহমানকে বের করি। সে সাধারণত বসে গুলিস্তান এলাকায়। মাঝে মাঝে ফার্মগেটের কাছে। পরের বার তার কাছ থেকে শিখলাম দড়ি কাটার কৌশল। দড়ি কেটে দুখণ্ড করা হয়। নিমিষের মধ্যে সেই দড়ি জোড়া লাগিয়ে দেয়া হয়। কৌশল এত সহজ কিন্তু করা হয় অতি নিপুণ ভঙ্গিতে। দড়ি কাটার কৌশল শিখতে আমার পাঁচ টাকা চলে গেল। শিখলাম পয়সা তৈরির কৌশল। চার আনা, আট আনার মুদ্রা বাতাস থেকে তৈরি করে ঝনঝন করে টিনের কৌটায় ফেলা হয়। এই কৌশল শিখতে দশ টাকা চলে গেল। তবে এই খেলা কাউকে দেখাতে পারলাম না। এই খেলা দেখানাের জন্যে পামিং জানা দরকার। পামিং হচ্ছে হাতের তালুতে কোন বস্তু লুকিয়ে রাখার কৌশল। আমার পামিং জানা নেই।
হােস্টেলে থাকার জন্য বাসা থেকে সামান্যই টাকা পাই। সেই সামান্য টাকার বড় অংশই চলে যাচ্ছে ম্যাজিকে। আমাকে মিথ্যা করে চিঠি লিখতে হয় – “বই কিনতে হবে, টাকা দরকার। কলমটা হারিয়ে গেছে, নতুন কলম দরকার।”
দু’বছর পর আমি ঢাকা কলেজ থেকে পাস করে বেরুলাম। বন্ধুমহলে আমি তখন ম্যাজিসিয়ান হুমায়ূন বলে পরিচিত। ভর্তি হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ম্যাজিকের ভূত আমাকে ছাড়ল না। আমি তখন সিন্দাবাদ। ম্যাজিকের ভূত আমার ঘাড়ে বসে আছে। যতবার নামাতে যাই ততবারই সে আরাে জোরে আমার গলা চেপে ধরে।
পুরানাে ঢাকার আওলাদ হােসেন লেনে তখন একজন বৃদ্ধ ওস্তাদের সন্ধান পেয়েছি। বিহারের লােক। পামিং-এর রাজা বলা যায়। হাঁসের প্রকাণ্ড ডিম সে হাতের তালুতে লুকিয়ে ফেলে। তার এক ফুট সামনে বসে থাকা মানুষটিরও বােঝার উপায় নেই যে, সে প্রকাণ্ড একটা ডিম হাতের তালুতে লুকিয়ে রেখেছে। সে শুধু যে হাতের তালুতে ডিম লুকিয়ে রাখছে তাই না, এক হাত থেকে অন্য হাতে সেই ডিম দ্রুত চালান করে দিচ্ছে। চোখের পলকের চেয়েও তার হাতের গতি দ্রুত। তাকে আমি ডাকি ওস্তাদজী। লােকটা মহা ঠগ – আমার কাছ থেকে টাকা নেয় কিন্তু কিছু শেখায় না। বিরসমুখে বলে পামিং শেখানাের কিছু নাই - প্র্যাকটিস কর, প্র্যাকটিস।
সেই প্র্যাকটিস কিভাবে করব তাও বলে দেয় না। অনেক অনুরােধের পর আমার হাতের তালু খানিকক্ষণ টিপেটুপে বলে – তােমার হাত শক্ত। এই হাতে পামিং হবে না। বেহুদা পরিশ্রম। বরং ম্যাজিকের এক গল্প শােন।।
ওস্তাদজী এমিতে বাংলাতেই কথা বলে তবে গল্পের তােড় এসে গেলে বিহারী কথা শুরু হয়, যার এক বর্ণও আমি বুঝি না। এক সময় ওস্তাদজীর স্ত্রী এসে কড়া ধমক লাগায় এবং আমার দিকে উগ্র চোখে তাকিয়ে বলে, নিকালাে আভি নিকালাে। অত্যন্ত অপমানসূচক কথা কিন্তু আমি সেই অপমান গায়ে মাখি না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের মাঝামাঝি সময়ে এক প্রতিভা প্রদর্শনীর আয়ােজন হল। গান-নাচ-আবৃত্তি যে যা জানে। টিএসসিতে বিশাল ব্যবস্থা। আমিও উপস্থিত হলাম আমার ‘ম্যাজিক প্রতিভা’ নিয়ে।
হল ভর্তি ছাত্র-শিক্ষক। বিরাট মঞ্চ। চোখ-ধাঁধানাে আলাে। ভয়ে আমার পা কাঁপছে। মুখ দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না। জিভ সীসার মত ভারী হয়ে গেছে। শুধু তাই না, সাইজেও মনে হয় খানিকটা বড় হয়ে গেছে। মুখ থেকে বেরিয়ে পড়তে চাচ্ছে। অনেক কষ্টে প্রথম আইটেম দেখালাম! ট্রায়াঙ্গুলার বাক্স থেকে কবুতর এবং মুরগি বের করার খেলা। এই বাক্স আমার নিজের না। অন্য এক জাদুকরের কাছ থেকে কুড়ি টাকায় ভাড়া করে এনেছি। প্রথম খেলা খুব জমে গেল। প্রচণ্ড হাততালি। আমার আড়ষ্টতা কেটে গেল। দ্বিতীয় আইটেম ‘এন্টি গ্রেভিটি বটল’! একটা বােতল মধ্যাকর্ষণ শক্তি উপেক্ষা করে শূন্যে ভাসবে। এটিও জমে গেল। আমার মনে হয় ছাত্র-ছাত্রীরা গান শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল – আমার সামান্য ম্যাজিকে যে কারণে তাদের উল্লাসের সীমা রইল ।
সেদিন ‘খেলা’ ভালই দেখিয়েছিলাম। কারণ এক সপ্তাহ না যেতেই টিভি থেকে ডাক পেলাম। তারা একটা প্রােগ্রাম করবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রী নিয়ে অনুষ্ঠান, যেখানে আমার জন্যে পাঁচ মিনিট বরাদ্দ করা আছে। মিনিটে দশ টাকা হিসেবে আমি পাব পঞ্চাশ টাকা। আমার আনন্দ এবং বিস্ময়ের সীমা রইল না। ঠিক করলাম মুদ্রা তৈরির খেলা দেখাব। শূন্য থেকে মুদ্রা তৈরি করে টিনের কৌটায় ফেলা। ঝনঝন শব্দ হতে থাকবে - এক সময় কৌটা মুদ্রায় ভর্তি হয়ে যাবে।
পুরােটাই হাতের কৌশল। খুবই প্র্যাকটিস দরকার। আমি দরজা বন্ধ করে প্র্যাকটিস করি। নিরলস সাধনা যাকে বলে। এর চেয়ে অনেক কম সাধনায় ঈশ্বর ধরা দেন। মহসিন হলের প্রধান হাউস টিউটর তখন অধ্যাপক এমরান। তিনি একদিন জরুরি চিঠি পাঠিয়ে আমাকে ডেকে পাঠালেন। গম্ভীর গলায় বললেন, তােমার বিরুদ্ধে কমপ্লেইন আছে।
‘কি কমপ্লেইন স্যার?'
‘ঘর বন্ধ করে তুমি নাকি সারারাত কি-সব কর। ঝনঝন শব্দ হয়। কেউ ঘুমুতে পারে না। তুমি কি কর?”
‘স্যার, ম্যাজিক শিখি।’
ম্যাজিক শেখার জন্যে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছ ? এটা কি ম্যাজিকের স্কুল ? খবর্দার, আর যেন ঝনঝনানি না শুনি। আর একবার ঝন ঝন হলে সীট ক্যানসেল। মনে থাকে যেন।
আমি বিমর্ষমুখে রুমে ফিরে এলাম। তবে প্র্যাকটিস বন্ধ হল না। কৌটার নিচে তুলা দিয়ে প্রাকটিস চালাতে লাগলাম। যথাসময়ে টিভি অনুষ্ঠান হয়ে গেল। তখন টিভি ছিল ডিআইটি ভবনে। সব প্রগ্রাম হত লাইভ। আমার নিজের অনুষ্ঠান নিজে দেখতে পেলাম না। তাতে আমার আনন্দের কমতি হল না। স্টুডিও থেকে বের হয়ে মনে হল সবাই তাকিয়ে আছে আমার দিকে। বিস্ময়ের সঙ্গে দেখছে তরুণ জাদুকরকে।
আমার কোন নেশা দীর্ঘস্থায়ী হয় না – এটা হয়ে গেল। মানুষকে বিস্মিত করতে পারার আলাদা আনন্দ আছে। সেই আনন্দে বুদ হয়ে রইলাম। কেমিস্ট্রি পড়া চালিয়ে যাচ্ছি -- চালাতে হয় বলেই চালানাে। ডিপার্টমেন্টের স্যাররা প্রায়ই বলেন হুমায়ূন বাসায় জন্মদিনের পার্টি আছে, ম্যাজিক দেখিয়ে যাও। আমি মহা উৎসাহে রিকশায় করে বাক্স-টাক্স নিয়ে রওনা হই। একদিন ঢাকা জুট মিলে ম্যাজিক দেখিয়ে দুশ টাকা পেলাম। একশ’ চলে গেল যন্ত্রপাতির ভাড়ায়। একশ’ লাভ।
মহসিন হলে যে ঘরে আমি থাকি সেখানে খাঁচায় চারটা কবুতর এবং একটা টিয়া পুষি। ম্যাজিকে কবুতর, টিয়া এসব লাগে। আমার একটাই স্বপ্ন - “ইন্টারন্যাশনাল ব্রাদারহুড অব ম্যাজিসিয়ানস”-এর সদস্য হব। এই সদস্যপদের জন্যে আকাক্ষার কারণ হল ঢাকায় দু’জন জার্মান জাদুকর এসেছিলেন। দু’জনই “ইন্টারন্যাশনাল ব্রাদারহুড অব ম্যাজিসিয়ানস”-এর সদস্য। তাঁরা হােটেল শাহবাগে জাদু দেখিয়ে সবাইকে চমৎকৃত করেছেন। আমি নিজে হয়েছি স্তম্ভিত। তখন আর্থিকভাবে খুব অসহায় অবস্থা সত্ত্বেও দুবার তাদের শাে দেখলাম। নেশা লেগে গেল। কঠিন নেশা।
এখন বলি নেশা কি করে কাটল সেই গল্প। নেশা পুরােপুরি কেটে গেল আমার বাসর রাতে। বালিকাবধূকে মুগ্ধ করার জন্য রাত তিনটার দিকে তাকে ম্যাজিক দেখাতে শুরু করলাম। হয়ত খুব সাবধান ছিলাম না কিংবা নবপরিণীতা স্ত্রীর সামনে নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলাম - দড়ি কাটার খেলাটা সে ধরে ফেলল এবং খুব হাসতে লাগল। দ্বিতীয় খেলাটায়ও একই অবস্থা।
মেয়েটি তার স্বামীকে চূড়ান্ত রকমের অপদস্ত করল। সে তা বুঝতেও পারল । আমি তৃতীয় ম্যাজিক দেখাতে যাচ্ছি। সে বলল, রাখুন তাে আপনার ম্যাজিক, এইসব কি শুরু করেছেন ? রাত বাজে তিনটা।
ঐ রাতেই আমার শেষ ম্যাজিক শাে হল। আর কখনাে ম্যাজিক দেখাই নি। বা দেখাতে উৎসাহ বােধ করি নি।
বিয়ের দশ বছর পর গুলতেকিন হঠাৎ করে বলতে শুরু করল - বাসর রাতে আমি খুব বােকামি করেছি। আমার উচিত ছিল বিস্মিত হবার ভান করা। সরি, তােমাকে ঐ রাতে খুব লজ্জা দিয়েছি। বয়স কম ছিল। বুঝতে পারি নি যে তুমি এত আগ্রহ করে আমাকে বিস্মিত করার চেষ্টা করছ। এখন একবার ম্যাজিক দেখাও - দেখ, আমি কি পরিমাণ মুগ্ধ হই। ম্যাজিকের কৌশল ধরার চেষ্টা করব না – চেষ্টা করব বিস্মিত হবার।
বিয়ের পর পনেরাে বছর হয়েছে। পনেরাে বছরে কোন ম্যাজিক দেখাই নি। তার পরেও “কিম আশ্চর্যম!” হঠাৎ ইংল্যাণ্ড থেকে চিঠি এসে উপস্থিত -- আমাকে ইন্টারন্যাশনাল ব্রাদারহুড অব ম্যাজিসিয়ানস এর সদস্যপদ দেয়া হয়েছে। এই অতি আশ্চর্য ঘটনা সম্ভব হয়েছে আমার জাদুকর বন্ধু জুয়েল আইচের কারণে। এই ভালমানুষটি আমাকে বিস্মিত করবার সুন্দর ব্যবস্থাই করে রেখেছিলেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল ব্রাদারহুড অব ম্যাজিসিয়ানের চিঠিটি এসে পৌছল আমার জন্মদিনে। কাকতালীয় ব্যাপার তাে বটেই। মাঝে মাঝে কাকতালীয় ব্যাপার ঘটে বলেই আমাদের এই জীবন এবং এই পৃথিবী এত মজার।