বইয়ের হাট ব্লগ
শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
ছোটগল্প
লোকসভা বিধানসভা
দিব্যেন্দু পালিত
পড়ার সময় ৫ মিনিট
লেকের জলে এক ডুব দিয়ে উঠে মাথা ঝাড়তে ঝাড়তে পরী দেখল অল্প দূরে গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে তার চান করা দেখছে এক বাবু৷ প্যান্ট শার্ট পরা, লম্বাও নয়, বেঁটেও নয়, মাথাভর্তি চুল, গায়ের রঙ তারই মতো ময়লা, কিন্তু কেমন ছোকরা-ছোকরা চেহারা৷ চোখাচোখি হতে মুখ ফিরিয়ে নিল৷ দূর থেকে মাথায় গাঁটরি নিয়ে এগিয়ে আসছে একটা মেয়েমানুষ, তার পিছনে একটা সাইকেল৷ কিছুই জানে না এমন ভঙ্গি করে এখন এ সবই দেখছে৷
আর একটা ডুব দেবার আগে লোকটাকে খুঁটিয়ে দেখল পরী এবং ভাবল, তাকেই দেখছিল এটা সে বুঝল কী করে৷ আশপাশে চান করছে রেললাইনের ওপারের বস্তি থেকে আসা আরও তিন-চারজন মেয়েমানুষ৷ তবে ওদের কেউই তার মতো জোয়ান নয়৷ খানিকটা তফাতে গামছা পরে গায়ে জল থাবড়াচ্ছে একটা রিকশাওলা৷ আরও দূরে মাটি শুঁকতে শুঁকতে ঘোরাফেরা করছে দু-তিনটে ছাগল, মুখে কী যেন কামড়ে ধরে একটা নেড়ি হেঁটে গেল ছাগলগুলোর পাশ দিয়ে৷ সে যখন চান করতে নামে তখন লোকটা ছিল বলে মনে পড়ছে না৷ তারপর হঠাৎ-ই৷ এই ভোটের দিনে, যখন চারদিক শুনশান, মেয়েমদ্দরা কখনও জোড়ে, কখনও দল বেঁধে ছুটছে ইস্কুলবাড়িতে ভোটের লাইন দিতে, তখন কাজকম্ম ফেলে এই লোকটা নিশ্চয়ই ওই বুড়ি মেয়েমানুষগুলোকে, রিকশাওলাকে কি ছাগলগুলোকে দেখতে লেকের পাড়ে হঠাৎই দাঁড়িয়ে পড়েনি! যৈবন আলাদা জিনিস৷
ঘন্টি বাজাতে বাজাতে চলে গেল সাইকেলের লোকটা৷ পিছনে পিছনে মাথায় শুকনো ডালপালার গাঁটরি নিয়ে মেয়েমানুষটাও৷ লোকটা আবার মুখ ফিরিয়েছে এদিকে৷ তার সঙ্গে চোখাচুখি হতে সিগারেটে টান দিয়ে জল দেখতে লাগল৷ পরী দাঁড়িয়েই থাকল৷ কোমরজলে নেমে একটা বড় ডুব দেবার পর সাপটানো শাড়ির তলায় জলে ভিজে বিজবিজ করছে বুক৷ পাড়ে রাখা আছে আর একটি শাড়ি আর বেলাউজ৷ এই কাপড়ের জল নিংড়ে, গা মুছে, শুকনো জামাকাপড় পরে ঝুপড়িতে ফিরবে সে৷ ভিজে শাড়িটা শুকলে মা আসবে চান করতে৷ যা গরম! মনে হয় মেয়েছেলে না হলে গা উদোম করে ঘুরে বেড়াতে পারত৷
আজকের দিনটা খারাপ৷ সকালে দুটো পাউরুটি আর গোটাতিনেক আধপচা পেয়ারা ভাগাভাগি করে খেয়েছে পাঁচজনে, এক প্রস্থ ভাঁড়ের চা খেয়েছে সে আর তার মা শকুন্তলা, দেখতে দেখতে বেলা গড়িয়ে গেল৷ সকাল থেকে চল্লিশ পয়সার বেশি ভিক্ষে না জোটায় গুলেকে কাঁখে তুলে বাজারে তরকারি কুড়োতে গেছে মা৷ যাবার আগে লেকে চান করতে পাঠাল তাকে৷ বলল বিষ্টুদার দোকান ঘুরে যেতে৷ এ সব ধান্দা দিব্যি বোঝে পরী, শকুন্তলা তাকে রোজগারে পাঠাল৷ ফেরার আগে দু-পাঁচ টাকা হাতে পেয়ে গেলে ভাল হত৷ অন্তত চালটা ডালটা কেনা যেত তাতে৷ কিন্তু এই শুনশানের বাজারে দেবে কে টাকাটা?
লোকটাকে কি অস্থির লাগছে একটু? তা না হলে যে-সিগারেটটা ফুঁকছিল সেটা জলে ছুঁড়ে দিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে পকেট থেকে প্যাকেট বের করে আর একটা ধরাল কেন? কী মনে করে বসে পড়ল বেঞ্চিতে?
ফেলে দেওয়া সিগারেটের টুকরোটা এদিক ওদিক ভাসতে ভাসতে এখন এগিয়ে আসছে তারই দিকে৷ সেটাকে আর লোকটাকে লক্ষ্য করতে করতে আর ডুব দিল না পরী৷ দুহাতে জল সরিয়ে জায়গামতো সরে এসে হাওয়া লাগতে দিল বুকে৷ দেখতে চাইলে দেখুক৷ মনে হচ্ছে ঠিকই ভেবেছে৷ মতলব না থাকলে কেউ এদিকে এসে এভাবে তিত্থির কাকের মতো বসে থাকে৷ অন্যদিন এ সময় এদিকটা এমন চুপচাপ থাকে না৷ চান করতে নামে আরও বেশি পুরুষ মেয়েমানুষ৷ উল্টোদিকের পাড়ে কাপড় কাচে ধোপারা৷ এদিক ওদিক করে ছুটকো ছাটকা লোকজন, সাইকেল৷ আর গাছের ছায়ায় বসে ঢলাঢলি জুমাচুমা করবার জন্যে বগলদাবা করে ছুকরি নিয়ে আসে দু-একটা ছোঁড়া৷ আজ একেবারে শুনশান৷ বিষ্টুদা বলেছিল বলেই জানে আজ মে মাসের কুড়ি তারিখ, সোমবার৷ সকাল থেকে আকাশ মেঘলা, একটু আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে গুঁড়িগুঁড়ি৷ সেজন্যে নয়৷ সব ভোটের জন্যে৷ ও বাবু, তোমার ভোট নাই নিকি গো! প্যাঁট প্যাঁট করে দেখছ কি!
পেটের ভিতর খিদে পাবার জায়গাটা খলবল করে উঠল রঙ্গ-তামাশায়৷ সামান্য হাসিতে কেঁপে উঠল ঠোঁটদুটো৷ ভিক্ষে করতে করতে একসময় হাত পাতলেই বুঝতে পারত কোন মানুষটা ভিক্ষে দেবে, কে দেবে না৷ নিজেকে মেয়েমানুষ হিসেবে চিনতে পারার পর থেকে শিকারও চিনতে শুরু করেছে পরী৷ মুখচোরা, হাবভাব, হাঁটাচলার ভঙ্গি দেখেই বুঝতে পারে কোন পুরুষটার মতলব কি৷ কখনও এ পাড়ায় কখনও ও পাড়ায়, ফুটপাথে আর ঝুপড়িতে থাকতে থাকতে আস্তে আস্তে শিখে গেছে সব৷ ইজের-পরা বয়স থেকে ফ্রক-পরা বয়সে পৌঁছনো পর্যন্ত এ ফুটপাথ থেকে ও ফুটপাথে দৌড়োদৌড়ি করে ট্রাফিকে দাঁড়ানো গাড়ির বাবুদের কাছে হাত পেতে ঘ্যানঘেনে গলায় দিব্যি ভিক্ষে চাইত সে৷ শাড়ি ধরার পর শকুন্তলা আর তাকে করতে দেয় না ওসব৷ তার বদলে এখন সে কর্পোরেশনের ছাইগাদায় গিয়ে ময়লা কাগজ, টিনের কৌটো, শিশি-বোতল আর পাঁশ কুড়োয়৷ বস্তা বোঝাই করে সেসব বিক্রি করে আসে বিষ্টুদার রদ্দির দোকানে৷ এখন গাড়ি ধরে ভিক্ষে চায় বোন সুন্দরী৷ দাদা আঁটুল মোটর গ্যারেজে কাজ পাবার পরেও কিছুদিন আসত, তারপর একদিন টাকাপয়সা নিয়ে মার সঙ্গে চিল্লাচিল্লি হল খুব৷ আঁটুল মাকে ‘খানকি’ বলল, শুনে ছাই ঘাঁটার লোহা হাতে তেড়ে গেল মা, ‘ওরে খানকির বাচ্চা— আয়— আজ খুন করব তোকে—’ বলল এই সব৷ সেই থেকে আঁটুল নাপাত্তা৷ আর দুভাই বাঁটুল, শাঁটুল এখনও ছোট, যখন যেমন পায় ভিক্ষে করে, খবরের কাগজ কুড়োয়, রাস্তার দেওয়াল থেকে পোস্টার ছিঁড়ে জড়ো করার জন্যে তক্কে তক্কে থাকে৷ ভালমন্দ খাবার ইচ্ছে হলে বাজারের হোটেলের সামনে কাঁদুনি গেয়ে ঝোলটা, আলুটা, মাছের কাঁটাটা নিয়ে আসে অ্যালুমিনিয়ামের পুরনো বাটিতে৷ দেড় দু-বছর আগে ফুটপাথে শুয়েই পাংচার সারানো গাড়ির চাকায় হাওয়া ফোলার মতো আবার পেট ফুলতে শুরু করল মার, দেখতে দেখতে বেরিয়ে এল গুলে৷ মানুষের বাচ্চা তো নয়, যেন ওল্টানো আরশোলা৷ আকাশ-চাওয়া হয়ে কখনও হাসে, কখনও কাঁদে৷
পরী জানে না তার বাপ কে, কে-ই জন্ম দিল সুন্দরী, বাঁটুল, শাঁটুলকে৷ আগে বুঝত না, এখন বোঝে ফুটপাথে গাদাগাদি করে শুয়ে এমনি এমনিই পেট ফোলে না মা-র৷ গুলের জন্মের আগে কিছুদিন রিকশাওলা গঙ্গারামের সঙ্গে খুব মাখামাখি হয়েছিল শকুন্তলার, নীল পাড়ের কোরা শাড়ি পেয়ে এমন ভাব দেখাত যেন গববে পা পড়ে না মাটিতে৷ সিঁদুরও পরত কিছুদিন৷ গঙ্গারাম একদিন তাদের রিকশায় চড়িয়ে ঘোরাল এক চক্কর৷ ফুটপাথ থেকে তাকেও ফ্রক কিনে দিয়েছিল একটা৷ লোকটাকে খারাপ লাগত না৷ গুলের জন্মের পরেও বেশ আদিখ্যেতা ছিল মার সঙ্গে৷ তো একদিন রাতে গঙ্গারাম তার ওপর চড়াও হবার পর সে চিল্লাচিল্লি শুরু করতে ঘুম ভেঙে ব্যাপারটা টের পেয়ে শকুন্তলাও গেল খেপে৷ গঙ্গারামকে তাড়াল, তাকেও শাড়ি ধরাল৷ হা রে বুদ্ধি! শাড়ি ধরালেই বুঝি রক্ষে পায় ফুটপাথের মেয়েমানুষ! তার পেট নেই? হোক ছেঁড়া, গা-গতর ঢাকবার জন্যে মাঝেমধ্যে শাড়ি বেলাউজের দরকার নেই? আর শুধু গঙ্গারামেরই বুঝি দোষ! ওই যে একদিন ফুটপাথ সাফাইয়ের নামে হললা গাড়িতে তুলে নিয়ে গিয়েছিল তাদের— শকুন্তলাকে ছাড়লেও তাকে ছাড়ল না সহজে, সে কি এমনি-এমনি নাকি! তারপর এই যে সেদিন বিষ্টুদার দোকানে দশ টাকা ধার চাইতে গিয়েছিল শকুন্তলা, বিষ্টুদা নাকি বলল, এখন যা, দুপুরে পরীকে পাঠাস— তো তাকেই পাঠাল শকুন্তলা, আর তাকে দোকানের আলমারির পিছনে নিয়ে গিয়ে আদর করল বিষ্টুদা, জুমাচুমা করল, তারপর লোক আসায় হাতে দশ টাকা গুঁজে দিয়ে বিদেয় করে দিল, এসব কি এমনি-এমনি নাকি! ছিয়া যা, ছিয়া যা৷ পরী জানে, সেও শকুন্তলার মতো খানকি হয়ে যাচ্ছে৷ শকুন্তলাও জানে, না হলে বিষ্টুদার দোকান ঘুরে চান করতে যেতে বলবে কেন! তা বিষ্টুদাও থাকলে তো! গিয়ে দেখল দোকানের ঝাঁপ ফেলা৷ আশপাশও কানা৷ চটপট একটা ডুব দিয়ে পরী ভাবল, আর চান করে কাজ নেই৷ লোকটা গরম থাকতে থাকতেই একটা কিছু করে ফেলা দরকার৷ কেটে গেলেই ফক্কা৷ মনে হচ্ছে এ বাবুটারও ভোট নেই তাদের মতো, কিন্তু খিদে আছে শরীরে৷
এতক্ষণ মজা পাচ্ছিল, জল ঠেলে পাড়ের দিকে এগোতে এগোতে শরীরে রাগ টের পেল পরী৷ ভোটের জন্যেই নাকি আজ সব ছুটি৷ আর এমনই ছুটি যে দোকানপাট সব বন্ধ, রাস্তায় বাস মিনিবাস নেই বললেই হয়, ট্রাম চলছে অনেকক্ষণ পরে পরে৷ তাও ফাঁকা ফক্কা৷ আর রাস্তায় মোটর আর ট্যাক্সি এতই কম যে হুসহাস করে বেরিয়ে যাচ্ছে সব৷ জ্যাম হচ্ছে না কোথাও৷ সকাল থেকে গাড়ি ধরার জন্যে অনেকবার ছুটোছুটি করেছে সুন্দরী— একবার তো চাপা পড়তে পড়তে বেঁচে গেল, কিন্তু একটাও গাড়ি দাঁড়ায়নি৷ দশটা নয়া পয়সা পর্যন্ত ভিক্ষে দেয়নি কেউ৷ দিন তিন-চার হল বাঁটুল শাঁটুলেরও পোস্টার ছেঁড়া বন্ধ৷ কদিন আগে সিনেমার পোস্টার ছিঁড়তে ছিঁড়তে একটা ভোটের পোস্টারও ছিঁড়ে ফেলেছিল বাঁটুল, সঙ্গে সঙ্গে হইহই কাণ্ড, তিন-চারজন দৌড়ে এসে চড়চাপড় মারল বাঁটুলকে৷ সেই থেকে ভয়ে আর কোনও পোস্টারেই হাত দেয়নি ওরা৷ কাজকাম নেই, এখন ফুটপাথে ইটের টুকরো ছুঁড়ে ছুঁড়ে কংগ্রেস-বি জে পি- ছি পি এম-গঙ্গারাম-লোকসভা-বিধানসভা খেলে৷ তবে আজ বিকেল পাঁচটায় ভোট শেষ হয়ে যাবার পর আর কেউই পোস্টার, ঝোলানো কাগজের লম্বা দড়ি নিয়ে মাথা ঘামাবে না৷ কদিন খুব চিল্লাচিল্লি করেছে সব, মিছিল করেছে, মিটিং করেছে, ভোট ফিরি করেছে বাড়ি বাড়ি গিয়ে৷ রাতের দিকে বোমা-টোমাও ফাটিয়েছে দু-একটা৷ আজ সব ক্লান্ত, হাল-বেহাল, গা-ছাড়া হয়ে থাকবে৷ তখনই সুযোগ৷ বিষ্টুদা বলেছে আগে থেকেই ভোটের কাগজ কুড়নোর জন্যে তৈরি থাকতে, ইস্কুলবাড়িতে ভোটের গেট বন্ধ হলেই ঝাঁপিয়ে পড়তে৷ বলেছে, ‘আশপাশের রাস্তায় যত যা আছে কুড়িয়ে বস্তা বোঝাই করবি৷ কাল নিয়ে আসবি এখানে, ওজন করে দাম দিয়ে দেব৷ লোকসভা বিধানসভা মিলিয়ে এবার তো এলাহি কাণ্ড রে! ভোটে তোদেরই বরাত খুলে গেল দেখছি!’
বিষ্টুদা বললেও পরী জানে কাজটা সহজ হবে না৷ আশপাশে তাদের মতো খানকির বাচ্চা কম নেই৷ আছে পাড়া, বে-পাড়া৷ ধান্দাটা সকলেই জানে৷ এই তো গেল বছর— নাকি তার আগের বছর? — ভোটের শেষে একটা কাগজ ঝোলানো ইয়া লম্বা দড়ির দখলদারি নিয়ে বে-পাড়ার কয়েকটা কাগজ-কুড়ুনের সঙ্গে তাদের দলের রক্তারক্তি লেগে গিয়েছিল আর কি! তাছাড়াও আছে খচড়া৷ পোস্টারে এমন এঁটেল লেই মারে আজকাল যে ছিঁড়তে গেলে দেওয়াল ছাড়ে না, ছিঁড়ে যায়৷ ছেঁড়া কাগজের দামও কমে যায়৷ এত সব খচড়া সামলে কতটা কী বস্তায় উঠবে শেষপর্যন্ত তা কে জানে! পরী নিঃশ্বাস চাপল৷ ঝটপট গা মুছে ভিজে শাড়ি ছেড়ে গায়ে জড়াল শুকনোটা, বেলাউজটাও৷ না, লোকটা নড়েনি৷ আড়ে তাকিয়ে দেখল, আবডালে চোখ রেখেছে তার ওপর৷ মুখ ফিরিয়ে নিল৷ লোকটা একা নয়৷ দেখছে ওই রিকশাওলাটাও৷ শালা আর একটা গঙ্গারাম যেন৷ এতক্ষণ জলের থাবড়া মারছিল গায়ে, এইবার জলে নামল৷ ভিজে শাড়িটা নিংড়োতে নিংড়োতে খর চোখে বেঞ্চিতে বসে থাকা লোকটাকে দেখল পরী৷ তারপর আশপাশে কে আছে না আছে দেখে নিয়ে এগিয়ে গিয়ে লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল৷
‘ও বাবু গো, একা কেন! ভোট নাই নাকি?’
লোকটা ঘাবড়ে গেল কেমন৷ হাতে সিগারেট ছিল তখনও, সেটা ফুঁকবে না ফেলে দেবে ভাবতে ভাবতে বলল, ‘কী চাই?’
পরী হাসল৷ তার আবার লজ্জা কিসের! আরও একটু এগিয়ে এসে বলল, ‘চল, ওদিকে গাছের তলায় বসবে৷ দশ টাকা দিও৷’
‘যাও, ভাগো এখান থেকে—৷’ লোকটা খেপে গেল এবার, ‘বদমাইশি করতে হলে অন্য জায়গায় যাও—’
‘ভাগব কেন! এটা তোমার জায়গা নাকি!’
‘ওহ! যত্ত সব—!’
লোকটা উঠে দাঁড়াতে এবং তারপর জায়গা ছেড়ে হাঁটা দিতে মুহূর্তের জন্যে থমকে গেল পরী৷ বোধহয় লোক চিনতে ভুল করেছিল সে৷ বোধহয় এমনিই এসে বসেছিল লোকটা, চোখ আছে বলে তাকিয়ে ছিল, ওই করতে গিয়ে তার চান করাও দেখেছে৷ কিন্তু এই লোকটা কেটে গেলে শূন্য হাতে ফিরতে হবে তাকে৷ বিষ্টুরও ঝাঁপ বন্ধ, বিকেলের আগে খুলবে মনে হয় না৷ আদৌ খুলবে কিনা কে জানে!
পরী মরিয়া হয়ে উঠল৷ লোকটা চলে যাচ্ছে, যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখান থেকেই দেখল দূরে একটা লোক এগিয়ে আসছে এদিকে, হয়ত আর কেউও এসে যাবে এর মধ্যে৷ তখনই ফন্দি এঁটে দৌড়ে গিয়ে পিছন থেকে লোকটার হাত টেনে ধরল সে৷
লোকটা দাঁড়িয়ে পড়ল৷ থমকানো ভাব, কথা ফুটল না মুখে৷
হাতটা ছেড়ে দিল পরী৷
‘ঠিক আছে, পাঁচ টাকা দিয়ে যাও৷ মায়ের দিব্যি, সারাদিন খাওয়া হয়নি, বাবু—’
‘ফাজলামি!’ লোকটা আবার এগিয়ে গেল, ‘এক পয়সাও দেব না৷’
‘না দিলে চিল্লাব৷’ আবার লোকটার গায়ে গায়ে এঁটে এল পরী, যেভাবে আগে ভিক্ষে চাইতে মোটরগাড়ির সঙ্গে সঙ্গে হাঁটত৷ বলল, ‘ওই দ্যাখ, লোক আসছে৷ বলব খারাপ লোক, গায়ে হাত দিয়েছিল—’
লোকটা আবার দাঁড়িয়ে পড়ল৷ মুখ ফ্যাকাশে৷ খুব ভয় পেয়ে গেছে যেন৷ তারপর হঠাৎই মুখ ঝুঁকিয়ে বুক পকেট হাতড়ে একটা দু টাকার নোট বের করে ছুঁড়ে দিল ওর মুখের ওপর৷ তারপরেই হাঁটতে শুরু করল হনহন করে৷
টাকাটা খামচে ধরে পরী ভাবল আবারও পিছু ধরে৷ তারপর ভাবল, থাক, তবু ভয় পেয়ে দুটাকা দিল৷ বাবুটা তো সত্যিই খারাপ কিছু করেনি৷ দেখল, দূর থেকে আরও দূরে যেতে যেতে লোকটা পিছন ফিরে তাকাল একবার৷ তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল অন্য রাস্তার বাঁকে৷
পরী ফিরতে লাগল৷ দুটাকায় আর কিছু না হোক, মুড়ি খেয়ে কাটানো যাবে দুপুরটা৷ শকুন্তলাও হয়ত কিছু জোগাড় করে আনবে এর মধ্যে৷ ভোট কি আর রোজই হচ্ছে! আর ভোট না হলেই বা কী! খানকির বাচ্চারা যেন মানুষের বাচ্চার মতো রোজই দুবেলা পেট ভরে খেতে পাচ্ছে!
এসব ভেবে মেঘলা আকাশের দিকে তাকাল পরী৷ কাঁধের ওপর জল নিংড়ানো শাড়ি, হাতের মুঠোয় টাকা৷ সামান্য জ্বালা করে উঠল চোখদুটো৷