সাক্ষাৎকার
দেবজ্যোতি দত্ত
প্রকাশন সৌষ্ঠব যেমন আছে, তেমনই পাঠকের রুচি তৈরি করার গুরুদায়িত্বও আছে।
চিত্রিতা চক্রবর্তী: বাংলা প্রকাশনার জগতে ‘সাহিত্য সংসদ’, ‘শিশু সাহিত্য সংসদ’ সুপরিচিত নাম। মহেন্দ্রনাথ দত্ত থেকে দেবজ্যোতি দত্ত— এই দীর্ঘ অভিযাত্রার কথা যদি কিছু বলেন?
দেবজ্যোতি দত্ত: শিশু সাহিত্য সংসদের প্রতিষ্ঠাতা আমার বাবা স্বর্গত মহেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি কিন্তু প্রধানত একজন মুদ্রাকর ছিলেন। সরস্বতী প্রেস তাঁরই হাতে তৈরি। এই সরস্বতী প্রেস একসময় সারা ভারতে বিশেষ স্থান লাভ করেছিল। বর্তমানে তা সরকার পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠান। বিপ্লবী মনোভাব নিয়েই সরস্বতী প্রেসের পরিকল্পনা করেছিলেন মহেন্দ্রনাথ দত্ত। পরাধীন ভারতে জাতীয়তাবাদী সাহিত্যকে প্রোমোট করার উদ্দেশ্যেই তার প্রথম পথচলা। ১৯২৩ সালে সরস্বতী প্রেসের জন্ম। স্বাধীনতার পরে যখন প্রেস একটু ভাল অবস্থায় এসেছে, তখন বাবার মনে ভাবনা জাগে, বাংলায় ছোটদের জন্য তেমন ভাল কোনও বইপত্র নেই। সুন্দর চিত্র-সংবলিত গ্রন্থ নেই, যেটা ইংরেজি ভাষায় বহু আগে থেকেই ছিল। সেইসব বইপত্র বাইরে থেকে এদেশে আসত। কিন্তু এদেশে তেমন কোনও উদ্যোগ তখনও পর্যন্ত দেখা যায়নি। বাবার মাথায় এই ভাবনাটা অনেকদিন ধরেই ঘুরছিল। ১৯৪৯ সালে সরস্বতী প্রেসে প্রথম অফসেট প্রিন্টিং মেশিন আসে। অফসেট মেশিন আসার পরেই ওঁর ভাবনা একটা অভিমুখ পায়— তিনি ভাবেন, এবার বাচ্চাদের জন্য অন্যরকমভাবে বইপত্র করা যেতে পারে। এই ভাবনার প্রথম সার্থক রূপায়ণ— ছড়ার ছবি ১ এবং ছড়ার ছবি ২। সেটা ছিল সারা ভারতের মধ্যে অফসেটে ছাপা প্রথম ছবির বই। তার আগে বাচ্চাদের বই এইভাবে ছবি ছেপে, বিশেষ ফরম্যাটে বিন্যস্ত করে কেউ প্রকাশ করেননি। প্রথম প্রকাশেই বইগুলি বাচ্চাদের পাশাপাশি বড়দের কাছেও অত্যন্ত সমাদর পেল। তখনই পৃথক একটি প্রকাশনা সংস্থা প্রতিষ্ঠার বাসনা জেগেছিল বাবার মনে। ১৯৫১ সালের ১ অগস্ট প্রতিষ্ঠিত হল শিশু সাহিত্য সংসদ প্রাইভেট লিমিটেড। সেই থেকে শুরু। সিগনেট প্রেসের প্রতিষ্ঠাতা ডি কে গুপ্তর (দিলীপকুমার গুপ্ত) কথা এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে। তিনি একসময় ডি জে কিমার কোম্পানির পরিচালনায় ছিলেন। ওঁর সঙ্গে বাবার খুব ভাল পরিচয় ছিল। সরস্বতী প্রেসে তিনিও কাজ করতেন। সেইসময় ডি কে গুপ্ত বলেছিলেন, এইরকম বই ভারতে আগে কখনও বেরোয়নি। তাঁর এই উৎসাহব্যঞ্জক মন্তব্য বাবাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। তারপর থেকেই নানা ধরনের বইয়ের পরিকল্পনা করতে থাকেন বাবা। সুকুমার রায়ের বড়বোন সুখলতা রাও যেচে বাবাকে চিঠি লিখেছিলেন যে, আপনারা বাচ্চাদের জন্য এত বই করছেন, আমাকে কাজে লাগান। উনিও শিশুসাহিত্যিক ছিলেন। সেই সূত্র ধরেই প্রকাশিত হল সুখলতা রাওয়ের নিজে পড় এবং নিজে শেখ। বাংলা শিশুসাহিত্যের ইতিহাসে সেটা ছিল বৈপ্লবিক এক পদক্ষেপ। ‘অ’ লিখতে গেলে আগে ‘ত’ লিখতে হয়, ‘ক’ লিখতে গেলে আগে ‘ব’ লিখতে হয়— এই যে স্ট্রাকচারাল সিস্টেম, এটা কিন্তু শিশু সাহিত্য সংসদই শুরু করেছিল। বলা যায়, বাংলা শিশুসাহিত্যের জগতে এই প্রকাশনা সংস্থা পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছিল। এই যে এখন কমিক স্ট্রিপের এত জনপ্রিয়তা, ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, ভারতের প্রথম কমিকস আমরাই ছেপেছিলাম— পূর্ণচন্দ্র চক্রবর্তীর আঁকা ছবিতে রামায়ণ (১৯৫৬), ছবিতে মহাভারত (১৯৬০)।
প্র: সে তো এক অসাধারণ কাজ! সকলের ঘরেই বোধ হয় একটা করে কপি রয়েছে।
উ: ১৯৫০ সালের আগে কেউ এভাবে ভাবেননি। পরবর্তীকালে অরণ্যদেব, অমর চিত্রকথা প্রভৃতি বই হয়েছে। কিন্তু অফসেট মেশিনে, এইভাবে ছোটদের বই রঙিন
ছবি-সহযোগে ছেপে প্রকাশ করার প্রথম কৃতিত্ব শিশু সাহিত্য সংসদের। প্রকাশনা যে শিশুসাহিত্য দিয়েও করা যায়, তা কিন্তু হাতেনাতে প্রমাণ করেছিলেন আমার বাবা। অন্যান্য অনেক প্রকাশনা সংস্থা বড়দের বইয়ের পাশাপাশি ছোটদের বইপত্র প্রকাশ করত, কিন্তু প্রধানত শিশুসাহিত্য নিয়েই কাজ করা এবং সেটাকে সফলতাপূর্বক এগিয়ে নিয়ে চলা— এটা আমার পিতৃদেবই প্রথম করলেন।
প্র: তার মানে শিশু সাহিত্য সংসদ হিসেবেই যাত্রা শুরু...
উ: হ্যাঁ, মনে রাখতে হবে ‘সাহিত্য সংসদ’ কিন্তু শিশু সাহিত্য সংসদের একটি বিভাগ। শিশু সাহিত্য সংসদের ইমপ্রিন্ট লাইন। বড়দের বই প্রকাশ করার সময় ‘শিশু’ শব্দটি বাদ পড়ল। হল সাহিত্য সংসদ। সেখানে প্রথম সাফল্য এসেছিল ১৯৫৫ সালে বঙ্কিম রচনাবলী-র হাত ধরে।প্রথমে দু’খণ্ডে বইটি প্রকাশিত হয়— প্রথম খণ্ডে উপন্যাস এবং দ্বিতীয় খণ্ডে তাঁর অন্যান্য রচনা। তৃতীয় খণ্ডটি প্রকাশিত হয়েছিল অনেক পরে।সেখানে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সমস্ত ইংরেজি রচনা অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। তখন কেউ ভাবতে পারেননি, এক খণ্ডে বঙ্কিমের সমগ্র উপন্যাস ওইরকম পাঠযোগ্য অবস্থায় হাতে ধরে পড়া যাবে। এটাও কিন্তু রচনাবলি প্রকাশনার ক্ষেত্রে নতুন এক পদক্ষেপ ছিল। এ ছাড়াও যেটা বিশেষভাবে বলার, রচনাবলির ক্ষেত্রে যথাযথ এডিটোরিয়াল ইনপুট, যা এর আগে ছিল না। বঙ্কিম রচনাবলী-র ক্ষেত্রে যোগেশচন্দ্র বাগলের সম্পাদকীয় সংযোজন একটা অ্যাসেট। বঙ্কিমের সামগ্রিক জীবন ও সাহিত্যের আলোচনার নিরিখে তিনি প্রতিটি উপন্যাসকে বিচার করেছেন।পরবর্তীকালে রচনাবলির ক্ষেত্রে, এই এডিটোরিয়াল ইনপুট আবশ্যিক হয়ে গেছে। এইভাবে বিভিন্নরকম কাজের মধ্য দিয়ে, বাবার চিন্তাভাবনার মধ্য দিয়ে শিশু সাহিত্য সংসদ এবং সাহিত্য সংসদ বাঙালি পাঠকের কাছে একটা স্থায়ী আবেদন তৈরি করল। এই বঙ্কিম রচনাবলী প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। বাইবেল পেপারে ছেপে বঙ্কিম রচনাবলী বেরিয়েছিল ১৯৫৪ সালে। ১৯৫৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় বাবাকে ডেকে পাঠালেন। তিনি বাবাকে বললেন, সাধারণ মানুষের জন্য সরকার সস্তায় রবীন্দ্র রচনাবলি প্রকাশ করতে চায়। বাবা ওঁকে আশ্বস্ত করলেন। রবীন্দ্র রচনাবলির সাইজ়টা কীরকম হবে বিধান রায় জানতে চেয়েছিলেন। বাবা তাঁকে বাইবেল পেপারে ছাপা ডিমাই সাইজ়ের বঙ্কিম রচনাবলী-র একটা কপি দেখান। তারপর ১৯৬১ সালে বেরোল ডিমাই সাইজ়ের রবীন্দ্র রচনাবলি। পরবর্তীকালে যেসব রবীন্দ্র রচনাবলি বেরিয়েছে, সবই রয়্যাল সাইজ়ের। এই সূত্রে আর-একটা মজার ঘটনা উল্লেখ করি। রবীন্দ্র রচনাবলি ছাপার কাগজ আসার কথা ছিল নোবেল ফাউন্ডেশন থেকে। কিন্তু যেটা দেখা গেল, নোবেল ফাউন্ডেশন কাগজ পাঠায়নি, পাঠিয়েছিল জাহাজ ভর্তি পাল্প!
প্র: আপনার কাছে কীভাবে এই প্রকাশনা জগতের দ্বার উদ্ঘাটিত হল?
উ: আমার কিন্তু এখানে আসার কথা ছিল না। আমি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক হয়েছি। তখন আমি অন্য ধরনের কাজকর্ম করছি। সরস্বতী প্রেসেও আমি কাজ শিখেছি, করেছি। ঠিক চাকরি হিসেবে নয়, কাজ শেখার জন্য। সেই সময় এই প্রকাশনা সংস্থার দেখাশোনার ভার ছিল আমার দাদার ওপর। দাদা হঠাৎ স্থির করলেন, তিনি ব্যবসা করতে পারবেন না। তখন স্বাভাবিকভাবেই আমার ডাক পড়ল। কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সূত্রে প্রিন্টিং প্রেসের কাজকর্ম আমি খানিক রপ্ত করেছিলাম। বাইরের দেশেও কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করার পরে অনেকেই অ্যাডভান্স প্রেসে কাজ করে। কেননা, অফসেট প্রিন্টিংয়ের বেসিক প্রিন্সিপল দাঁড়িয়ে আছে কেমিস্ট্রির ওপর। পরবর্তীকালে প্রিন্টিং ইঞ্জিনিয়ারিং পৃথক বিভাগ হিসেবে মর্যাদা পেয়েছে। তবে আগে কেমিক্যাল ই়ঞ্জিনিয়ারিং থেকে অনেকেই প্রিন্টিংয়ে যেত। প্রেসে থাকাকালীন কাগজ সম্পর্কেও আমি একটু পড়াশোনা করেছিলাম। ফলত, আমার পিতৃদেব আমাকেই এই প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব দিলেন। ব্যবসা খুব-একটা বড় ছিল না, কিন্তু পাঠকের কাছে এর সমাদর ছিল আকাশছোঁয়া। দীর্ঘদিনের এই প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে, সেটা বাবা মেনে নিতে পারছিলেন না। তাই আমিও রাজি হয়ে গেলাম। প্রকাশনার তিনটে ইনপুট আছে— প্রিন্টিং ইনপুট, এডিটোরিয়াল ইনপুট এবং পেপার ইনপুট। এই তিনটে খুবই জরুরি বিষয় প্রকাশনার ক্ষেত্রে। এর মধ্যে এডিটোরিয়াল ইনপুটটা হচ্ছে বেসিক।বলতে দ্বিধা নেই, বাঙালি প্রকাশনার জগতে এই এডিটোরিয়াল ইনপুটের বড়ই অভাব। অধিকাংশ প্রকাশনা সংস্থার সমস্ত কিছুই লেখককেন্দ্রিক। প্রকাশনা সংস্থার এডিটোরিয়াল ইনপুট নিয়ে এখানে খুব-একটা ভাবনাচিন্তা নেই। অথচ ইংরেজি প্রকাশনার ক্ষেত্রে দেখি, যত বড় লেখকই হোক না কেন, সম্পাদনার শাসন এড়িয়ে কোনও বই প্রকাশিত হয় না। লেখকরা কিন্তু সেটা মেনেও নেন। তাঁদের জানিয়েই সমস্তটা হচ্ছে। বাংলা প্রকাশনা জগতে সেটা একেবারেই নেই। সে যাই হোক, প্রকাশনার তিনটে গুরুত্বপূর্ণ ইনপুটের মধ্যে প্রিন্টিং এবং পেপার ইনপুটটা আমি জানতাম। বাকি রইল এডিটোরিয়াল ইনপুট। ভাবলাম, সেটা কাজ করতে করতে রপ্ত করে নেওয়া যাবে। প্রয়োজন হলে অন্যের সহায়তাও নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু অন্য দু’টি বিষয় সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান না থাকলে, কাজ করা খুব মুশকিল। ফলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। সেটা ছিল ১৯৭৫ সাল।
প্র: নতুন কার্যভার গ্রহণ করার পরের সময়টা কেমন ছিল?
উ: আমি শিশু সাহিত্য সংসদে যোগ দেওয়ার পরে, সেবার শুরু হল কলকাতা বইমেলা। গিল্ড শুরু করল। গিল্ড হয়েছিল ১৯৭৫ সালে।১৯৭৬ সালের মার্চ মাসে বইমেলা শুরু হল। তাতে শিশু সাহিত্য সংসদ যোগদান করল। আমার বাবার একটা মেম্বারশিপ ছিল গিল্ড-এ।অনেক প্রবীণ প্রকাশক তখন বইমেলাকে একটু হেলাফেলা করতেন— খোলা মাঠে বই সাজিয়ে একটা মেলা বসবে, সেটা আবার কীরকম হবে! প্রথমবার বইমেলায় ভিড় তেমন হয়নি। কিন্তু আমি এর গুরুত্বটা অনুভব করলাম। তাই আমিও এর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করলাম। তখন যেহেতু শিশু সাহিত্য সংসদের দায়িত্বে এসেছি, ফলে আমি যুক্ত হয়ে পড়লাম। ১৯৭৭ সাল থেকেই আমি গিল্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়লাম। বাবা তখন গিল্ডের সদস্যপদ ছেড়ে দিলেন, আমি মেম্বার হয়ে গেলাম। সেই সময় বাংলা প্রকাশনা জগতে বিক্রিবাটা একটু কম হচ্ছিল। এই বইমেলা একটা রাস্তা খুলে দিল। এর আগে পাঠক হয় বিজ্ঞাপন দেখতেন, নয়তো কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় এসে দেখতেন নতুন কী বই বেরিয়েছে। কিন্তু বইমেলায় একই জায়গায় বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থার বই দেখতে পাওয়ার সুযোগ পেলেন পাঠক। এই সুযোগটা প্রকাশনা জগৎকেও অনেকটা এগিয়ে দিল। আগে বই বেরোত অক্ষয় তৃতীয়া আর পয়লা বৈশাখে। এখনও বেরোয়। কিন্তু তার সিংহভাগটা বেরোয় বইমেলার প্রাক্কালে।বইমেলার সঙ্গে শিশু সাহিত্য সংসদ প্রথম থেকে জড়িয়ে পড়েছিল বলে তাদেরও কিন্তু বিশেষ লাভ হয়েছিল। আমি শিশু সাহিত্য সংসদে আসার পরে প্রিন্টিংয়ে স্পেশ্যাল স্ক্রিনের ব্যবহার শুরু করলাম, যেটা তার আগে খুব-একটা ছিল না। তাতে দুটো কালারের বইকেই আরও দৃষ্টিনন্দন করে তোলা সম্ভব হল। হোয়াইট স্পেস ওপেনিংয়ের মধ্যেই কালারের ভেরিয়েশন হত। যার ফলে অনেক অন্যরকমভাবে বইপত্র প্রকাশ করা গেল। সেটা আমাদের বিক্রিবাটা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। ওইসময় থেকে আমরা প্রাইমারি লেভেলের বইয়ের দিকে, বেসিক বইয়ের দিকে ঝুঁকেছিলাম। কারণ, আস্তে আস্তে দেখছি যে, শিশুসাহিত্যের লেখক আর তৈরি হচ্ছেন না। শিশুসাহিত্য বলতে আমরা যেটা বুঝি— বারো বছর বয়স অবধি বাচ্চাদের জন্য সাহিত্য— সেটার অভাব বোধ হচ্ছে। টিনএজারদের জন্য লেখা হচ্ছে... ভূতের গল্প, অ্যাডভেঞ্চার ইত্যাদি... কিন্তু একদম ছোটদের লেখা কিন্তু সুনির্মল বসু, লীলা মজুমদার পর্যন্ত এসে হারিয়ে গেল। কয়েকজন লিখছেন, কিন্তু ধারাবাহিকভাবে লিখছেন না। ফলে তিন বছর থেকে আঠারো-উনিশ বছর পর্যন্ত সবটাই ছোটদের লেখা হয়ে দাঁড়াল। কিন্তু সেটা তো ঠিক নয়। একটা শিশুসাহিত্য, একটা কিশোরসাহিত্য। দুটোর মধ্যে অনেকটা ফারাক। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, লীলা মজুমদার, যোগীন্দ্রনাথ সরকার, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ছোটদের গল্পগুলো বাচ্চাদের কাছে খুব প্রিয়, সুখশ্রাব্য... সেই বয়সে তারা তো পড়তে শেখে না। বাবা-মা কিংবা ঠাকুরমা-ঠাকুরদার কাছে সেইসব গল্প শুনত ছোটরা। দু’পক্ষই আনন্দ লাভ করতেন। তখন তো আর সব মায়েরা কাজে বেরোতেন না... এত ফোনের উপদ্রব ছিল না, টেলিভিশনের রমরমাও ছিল না। আজকালকার শিশুরা এটার অভাব বোধ করে। সেইসময় কল্পনার জগৎটা অনেক অন্যরকম ছিল। এখন টিভি-র দৌলতে কল্পনার জগৎ চোখের সামনে এসে পড়ায়, ছোটরা অন্যরকম চিন্তাভাবনা করতে পারছে না। আইকিউ ভাল হচ্ছে, সবই ভাল হচ্ছে এখনকার বাচ্চাদের, কিন্তু কল্পনার জগৎটা হারিয়ে যাচ্ছে। অবসর সময়ে বাংলা বই পাঠ করব— এই ভাবনাটাও প্রায় নেই। কাজের চাপে বাবা-মায়েরাও তো আজকাল বাচ্চাদের সঙ্গে খুব-একটা সময় কাটাতে পারছেন না। ফলে এই দিকগুলো ঠিকমতো বিকশিত হচ্ছে না।
প্র: শিশুসাহিত্য লেখকের যেমন অভাব বোধ হচ্ছে, তেমন শিশুপাঠকের সংখ্যাও তো ক্রমহ্রাসমান!
উ: শিশুপাঠক তো নেই! স্কুলের পড়াশোনা করতে করতে তারা অন্য কোনও কিছু করার সময় পাচ্ছে কোথায়? খেলারই সময় পায় না ছোটরা।যেটুকু যা পাওয়া যায়, সেটাও ক্রিকেট কিংবা টেনিস কোচিংয়ে কেটে যায়। কেননা, এগুলো অর্থকরী। সেটা ভাবা যে খারাপ কিছু তা বলব না, কিন্তু প্রতিভাজাত বিষয়গুলো ইদানীং আর দেখা যাচ্ছে না।
প্র: এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। শিশু সাহিত্য সংসদ ছোটদের প্রচুর সুচিত্রিত রঙিন বই উপহার দিয়েছে। এইসব বইয়ের ইলাস্ট্রেশন দেখে চোখ ফেরানো দায়! সে-প্রসঙ্গে যদি কিছু বলেন...
উ: ছোটদের বইয়ের ছবি আঁকতেন যাঁরা, তাঁদের বাদ দিয়ে শিশু সাহিত্য সংসদের কথা ভাবাই যায় না। বুক ইলাস্ট্রেশনের কাজে বাবার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন পূর্ণচন্দ্র চক্রবর্তী, প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেন্দ্রনাথ দত্ত, সূর্য রায়, সমর দে। পরবর্তীকালে তাপস দত্ত, সুদীপ্ত বসু, দেবব্রত ঘোষ, অলয় ঘোষাল, গৌতম চট্টোপাধ্যায় উল্লেখযোগ্য। এঁরা ছোটদের জন্যই ছবি আঁকতেন। এঁদের সান্নিধ্য পাওয়ার ফলে বাবা অনেক এক্সপেরিমেন্টাল কাজকর্ম করতে পেরেছেন। ছবিতে পৃথিবী নামে একটা বই বেরিয়েছিল ১৯৫৮ সালে। বইটির দু’টি ভাগে পৃথিবী কীভাবে সৃষ্টি হল এবং কীভাবে মানুষের উদ্ভব হল, তা এত সুন্দরভাবে পিক্টোরিয়ালি প্রেজ়েন্ট করা হয়েছিল! বাংলা প্রকাশনার জগতে এই ধরনের বই চার কালারে সেইসময় ছিল না। ছবিতে পৃথিবী (প্রস্তর যুগ) সুন্দর ছাপা এবং প্রকাশনার জন্য ভারত সরকারের পুরস্কার পেয়েছিল। এ ছাড়াও আমাদের অন্য অনেক বই পুরস্কৃত হয়েছে নানা সময়ে। প্রসঙ্গত বলি, ছোটদের বই দৃষ্টিনন্দন করে তোলার নেপথ্য-শিল্পী যাঁরা, সেই ইলাস্ট্রেটরদের বাবা অত্যন্ত সম্মান করতেন। এবং বাবা-ই প্রথম, যিনি লেখকের সঙ্গে আর্টিস্টকে রয়্যালটি দেওয়া শুরু করলেন। আজও আমাদের সংস্থা আর্টিস্টদের রয়্যালটি দেয়।
প্র: এবার একটু সাহিত্য সংসদের কথায় আসি। সাহিত্য সংসদ বলতেই প্রথমে মাথায় আসে অভিধানের কথা। সংসদ বাংলা অভিধান, ইংরেজি-বাংলা অভিধান, চরিতাভিধান, সমার্থ শব্দকোষ— বাংলা সাহিত্যচর্চায় এইসব অভিধানগ্রন্থের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বিশেষ করে বলতে হয় সংসদ বাংলা অভিধানের কথা...
উ: সাহিত্য সংসদের অভিধান প্রকাশিত হওয়ার আগে বহু অভিধান প্রকাশিত হয়েছিল। যেমন, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস, চারুচন্দ্র গুহর অভিধান সে সময় বাজারে প্রচলিত ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাবা দেখলেন, এগুলো সবই যেহেতু ব্যক্তিমানুষের সৃষ্টি, তার কপিরাইটের ব্যাপার থাকে। তাই পরবর্তীকালে কে পরিমার্জনা করবেন সেটা নিয়ে একটা সমস্যা তৈরি হয়।
প্র: এই পরিমার্জনার অভাবেই বোধ করি, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিধান খানিক প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে।
উ: হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিধানের মূল জায়গাটা ব্যাকরণগত। আর জ্ঞানেন্দ্রমোহনের অভিধানে শব্দের ব্যবহারিক দিকটি গুরুত্ব পেয়েছে।দুটো সম্পূর্ণ আলাদা। যে-কারণে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিধানে ‘অভিধান’ শব্দটি নেই— বঙ্গীয় শব্দকোষ। অন্যদিকে জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের বইটির নাম বাঙ্গালা ভাষার অভিধান। তো যাই হোক, বাবা ঠিক করলেন অভিধান করবেন, লোককে দিয়ে করাবেন ঠিকই কিন্তু সংসদের নামে প্রকাশিত হবে। যার ফলে, সংসদ উইল টেক কেয়ার অফ দ্য রিভিশন। এটা হয়ে আসছে বলেই আমাদের ডিকশনারিগুলো পাঠকের কাছে এত গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। রাজশেখর বসুর চলন্তিকা-ও তো ছিল। কিন্তু রাজশেখর বসুর প্রয়াণের পর সেটার কোনও পরিমার্জনা হয়নি।কারণ, ওই প্রজ্ঞা কারও নেই। এই যে প্রজ্ঞার অধোগতি, এটাও কিন্তু বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে দুশ্চিন্তার কারণ। অভিধান কিন্তু লিটারারি পার্সনদের দিয়ে লেখানো খুব মুশকিল। অভিধান নির্মাণে যুক্তির একটা বড় অবদান থাকে। রাজশেখর বসু ছিলেন একজন সায়েন্টিস্ট। তাঁর যুক্তিবাদী সত্তা অভিধান রচনার সময় প্রখর ছিল। যে-কারণেই চলন্তিকা-র মতো একটা অভিধান তৈরি করতে পেরেছেন। সংসদের অভিধানের যিনি সংকলক, শৈলেন্দ্র বিশ্বাস, তিনিও কিন্তু ওই একই মানসিকতা থেকেই কাজটা করেছিলেন। অভিধান রচনার একটা শৈলী আছে। লেক্সিকোগ্রাফি হচ্ছে অভিধানের মূল কথা। লেক্সিকোগ্রাফার না থাকলে ডিকশনারি করা খুব মুশকিল। শৈলেনবাবু ছিলেন একজন লেক্সিকোগ্রাফার। নির্দিষ্ট শব্দের ব্যাখ্যায় সঠিক শব্দচয়ন, ভাষাব্যবহার এবং পরিমিত বিন্যাস— এই জায়গাগুলো সম্পর্কে শৈলেনবাবু অত্যন্ত সচেতন ছিলেন।
প্র: ঠিক তাই... অভিধান বিষয়টা হয়তো খানিক নীরস, কিন্তু সেটাকে যুগোপযোগী করে তোলাও তো একটা কঠিন কাজ!
উ: হ্যাঁ, একেবারেই তাই। সংসদের অভিধানকে পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার অন্যতম কান্ডারি ছিলেন শৈলেনবাবু। সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত এবং শশিভূষণ দাশগুপ্ত বিভিন্ন জায়গায় শৈলেন্দ্র বিশ্বাসের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। এক স্মৃতিচারণে সুবোধবাবু লিখছেন, ‘কম্পোজিটর, ম্যানেজার, শিশুসাহিত্যে নতুন পথের উদ্ভাবক মহেন্দ্রনাথ দত্ত অনেক কাজ করিয়াছেন, কিন্তু তাঁহার সবচেয়ে বড় আবিষ্কার শৈলেন্দ্র বিশ্বাস। এই বিচিত্রবুদ্ধি খেয়ালী লোকটি অল্পবয়সে কিছু লেখাপড়া করিয়া দেশসেবায় রত হইয়াছিলেন, ফরোয়ার্ড ব্লকে যোগদান করিয়াছিলেন, পরে অনার্স সহ বি.এ. ও এম.এ. পাশ করিয়াছিলেন। মিলিটারিতে কাজ লইয়াছিলেন এবং অন্যান্য অনেক কাজের মধ্যে এক সময় একটা প্রকাশনা সংস্থায় কাজ করিয়াছিলেন যাহারা অভিধান প্রকাশ করে। আমাদের দেশে ইংরেজির বহুল প্রচলন আছে, কিন্তু অধিকাংশ অভিধানই ওয়ার্ডবুক। আমাদের আমলে স্কুলে ব্যাকরণের সঙ্গে ওয়ার্ডবুকও পাঠ্য হইত। শৈলেন্দ্র বিশ্বাস খেয়ালী লোক, কিন্তু তাঁহার মধ্যে প্রকৃত আভিধানিক চেতনা ছিল। ইংরেজি সাহিত্য খুব সম্পদশালী ও প্রগতিশীল এবং নানা দেশে ইহা ব্যবহৃত হয় বলিয়া এই ভাষার শব্দসমূহের প্রয়োগবৈচিত্র্য আয়ত্তে আনা খুব শ্রমসাধ্য ব্যাপার। এই শ্রমও সেই লোকের পক্ষেই সম্ভব শব্দের অর্থবৈচিত্র্যের প্রতি যাঁহার সহজাত অন্তর্দৃষ্টি আছে। শৈলেন্দ্র বিশ্বাসের এই সহজাত শক্তি ছিল এবং মহেন্দ্রনাথ দত্তও সহজাত অন্তর্দৃষ্টির বলেই ইহা আবিষ্কার করেন।’ বাবা এইসব প্রাজ্ঞ ব্যক্তির সাহচর্য পেয়েছিলেন বলেই অভিধান প্রকাশ করতে পারলেন।
প্র: সংসদের আরও একটি প্রকাশনার কথা বলতেই হয়— সমার্থ শব্দকোষ (১৯৮৭)। এটাও তো একটা উল্লেখযোগ্য সংযোজন।
উ: এই ধরনের বই এর আগে বাংলা অভিধানজগতে ছিল না। অশোক মুখোপাধ্যায় একজন ইঞ্জিনিয়ার। আমি আগেই বলেছি, সাহিত্যিকদের দিয়ে অভিধান হয় না। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির অভিধানও খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিনিও কিন্তু সাহিত্যের লোক ছিলেন না। এই যে যুক্তি দিয়ে বিচার করা, কোনটা কখন বলব, কীভাবে বলব— কেউ কিছু মনে করবেন কি না জানি না— সাহিত্যিকদের চেয়ে এঁরা কিন্তু ভাল বুঝতে পারেন। সমস্ত কিছুর মধ্যেই একটা পরিধির ব্যাপার থাকে। একজন সাহিত্যিকের প্রবণতাই থাকে অনেকখানি এক্সপ্লেন করা। কিন্তু কত সংক্ষেপে কতখানি বলা যায়, সেটাই হচ্ছে অভিধানকারকের কৌশল। এই সমার্থ শব্দকোষ এক যুগান্তকারী কাজ। এই ধরনের কাজ পরবর্তীকালে আর কেউ করতে পারবে বলে আমার মনে হয় না। অশোক মুখোপাধ্যায় যখন সমার্থ শব্দকোষ প্রকাশের উদ্দেশ্যে আমার কাছে আসেন, সেটা ১৯৮৩ সাল। আমার কাছেও সেটা একটা পরীক্ষা ছিল। আমি কিন্তু আমার পিতৃদেবকে বিষয়টা জানাইনি। এই কাজটা যখন করছি... বেশ কিছুদিন পরে ১৯৮৫ সালে একটি ছেলে আমার কাছে আসে। ছেলেটি জানায়, সে ফোটোটাইপ সেটিং আরম্ভ করেছে। যেটা আনন্দবাজারে তখন চালু। তার মাঝখানে এই সমার্থ শব্দকোষ প্রায় পাঁচ-ছয় ফর্মা ছাপা হয়ে গিয়েছিল লাইনোটাইপে। আমি ছেলেটিকে একটা ফর্মা কম্পোজ় করতে বললাম। দেখলাম, ফোটোটাইপ সেটিং-এ ষোলো পাতায় দেড় পাতা কমে গেল। তখন আমি স্থির করলাম এই বইটাকে ফোটোটাইপ সেটিংয়ে করব। তখন কিন্তু পেজ মেকআপের কোনও সুযোগ ছিল না। সবই স্ট্রিপে বেরোত। মনে পড়ে, প্রথম সংস্করণের চারশো কুড়ি পাতা আমি পেস্ট করেছিলাম। বাংলা প্রকাশনা জগতে ফোটোটাইপ সেটিংয়ে করা এটি প্রথম বই। এবং আরও একটা বিষয় উল্লেখযোগ্য, বইটির ইনডেক্স ছিল পাঁচ কলামের। এটাও একটা ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত। সে কারণেই চারশো কুড়ি পাতার মধ্যে বইটি করা সম্ভব হয়েছিল। বইটি ছাপা হয়েছিল সুপার প্রিন্ট কাগজে। এই কাগজ সে সময় বাজারে নতুন এসেছে। আর্ট পেপারের পরেই স্থান ছিল সুপার প্রিন্ট পেপারের। তখন অনেকেই জিজ্ঞেস করেছিলেন, এই বইটা করলেন, এটা চলবে? পাঁচ হাজার কপি ছাপিয়েছিলাম বইটা। সেটা অনেককেই বিস্মিত করেছিল।বইটা যখন প্রথম হাতে এল, আমি বাবার কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। উনি উলটেপালটে দেখে একটা কথাই বলেছিলেন, মনে হয় বইটা চলবে।এটা আমার কাছে এক পরম প্রাপ্তি ছিল। তারপরেই পাঁচ মাসে পাঁচ হাজার কপি বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। এই বই আমি রিপ্রিন্ট করিনি তখন।আমার কাছে অনেক চিঠি এল নানা ত্রুটি-বিচ্যুতির উল্লেখ করে। আমি অশোকবাবুকে জানালাম। জানতে চাইলাম, কতদিনের মধ্যে উনি পরিমার্জনার কাজ সম্পন্ন করে দিতে পারবেন। অশোক মুখোপাধ্যায় জানালেন, বছর দু’য়েক লাগবে। তেমনটাই হল। ১৯৮৭ সালে বইটা বেরিয়েছিল। ঠিক তার দু’বছর পরে, ১৯৮৯ সালে বেরোল পরিমার্জিত সংস্করণ। একশো পাতা বেড়ে গেল। দ্বিতীয় সংস্করণ অনেকদিন পর্যন্ত চলেছে। তৃতীয় সংস্করণ এই বছর দুয়েক আগে বেরিয়েছে। যতদিন বাংলা ভাষা চর্চা থাকবে, এই বইটার প্রয়োজনীয়তা থাকবে।
প্র: সংসদ তো বেশ কিছু বিষয়ে অভিধান, পরিভাষা অভিধান প্রকাশ করেছে...
উ: হ্যাঁ, বিষয় অভিধান প্রকাশের ক্ষেত্রেও সংসদের একটা বড় সাফল্য আছে। ব্যাকরণ অভিধান, বাগ্ধারা অভিধান, বিজ্ঞান অভিধান, অর্থবিদ্যা অভিধান, যুক্তিবিজ্ঞান অভিধানের মতো এত রকমের অভিধান কিন্তু আর কোনও প্রকাশনা সংস্থা প্রকাশ করেনি। এর সঙ্গে আছে নানা পরিভাষা অভিধান— বিজ্ঞান পরিভাষা, উদ্ভিদবিজ্ঞানের পরিভাষা, কৃষিবিজ্ঞানের পরিভাষা, রসায়নবিজ্ঞানের পরিভাষা প্রভৃতি। এইসব অভিধান রূপ পেয়েছে রমাপ্রসাদ দাস, ধীরেশ ভট্টাচার্য, হীরেন রায়ের মতো প্রাজ্ঞ ব্যক্তির সান্নিধ্যে।
প্র: এই প্রসঙ্গে জানতে চাইব, আপনাদের অভিধানগুলি তো পরিমার্জিত, পরিবর্ধিত হয়েছে নানা সময়ে। তা এই পরিমার্জনার কাজটি কতটা কঠিন?
উ: ভীষণই কঠিন। যোগ্য লোক পাওয়া যায় না। এর জন্য যে-নিষ্ঠা দরকার, সেই নিষ্ঠার এখন বড় অভাব। কারেকশন করার লোকের অভাব নেই, সেটা একটা আলাদা বিষয়। কিন্তু সংকলনের কাজ করা সহজ কথা নয়। এর জন্য গভীর প্রজ্ঞা এবং নিরলস নিষ্ঠা প্রয়োজন। এখনও আমি কিছু মানুষের সান্নিধ্যে রয়েছি, যাঁরা অভিধানের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। যেমন, সুভাষ ভট্টাচার্য, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়, আশীষ লাহিড়ী, প্রবীর গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো মানুষ এখনও এই কাজ নিষ্ঠার সঙ্গে করছেন। ভবিষ্যতে কতটা কী করতে পারব জানি না। এই যে মানুষগুলো, এঁদের নাম উল্লেখ করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। এঁরা প্রকাশনার ক্ষেত্রে ভীষণভাবে যুক্তিগ্রাহ্য। এঁদের সহযোগিতা ব্যতীত প্রকাশনা জগতের উন্নতি সম্ভব নয়। প্রকাশক নিজে কিছু করেন না। তাঁর কাজ, বিভিন্ন মানুষকে একটা জায়গায় নিয়ে এসে, তাঁদের কাছ থেকে সবচেয়ে ভাল জিনিসটি বের করে পাঠকের সামনে পরিবেশন করা। যদি কেউ মনে করেন যে, সাহিত্য সংসদ কিংবা শিশু সাহিত্য সংসদ প্রকাশনার জগতে নিজের একটা জায়গা করে নিতে পেরেছে, তার কৃতিত্বের সিংহভাগ কিন্তু এই নেপথ্যে থাকা মানুষগুলির প্রাপ্য। আমার কাজ তো ক্যাটালিস্টের।
প্র: একজন প্রকাশক বাণিজ্যের দিকটি যেমন দেখবেন, তেমনই পাঠকের আগ্রহ এবং রুচি অনুযায়ী উৎকৃষ্ট বইয়ের সন্ধানও দেবেন। এই দুইয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলাটা সবসময় সহজ হয় না। আপনার অভিজ্ঞতা কী বলে?
উ: ইদানীং প্রকাশকরা একটু বেশি-ই বাণিজ্যমুখী। আগে প্রকাশনা সংস্থার একটা ‘ক্রিয়েটিভ মাইন্ড’ ছিল। এখন সেই ‘ক্রিয়েটিভনেস’ তেমন পাওয়া যায় না। বাজারে কোনটা চলবে সেটাই বড় হয়ে ওঠে। অধিকাংশ বইয়ের কোনও সার নেই... লোকে চাইছে, তাই চলছে। বলা ভাল, পাঠকের চাহিদাটাকে সেইরকম জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে প্রকাশনা সংস্থাগুলি। পরিশীলিত কিছু আমরা দিতে পারছি না। এখন পুজোসংখ্যা বেশি চলে না। একসময় পুজোসংখ্যা গোগ্রাসে গিলত লোকে! এখন পড়ে না।
প্র: প্রকাশনা সংস্থাগুলিকে বাণিজ্যের খাতিরে পাঠকের রুচির ওপর নির্ভর করে বইপত্রের কথা ভাবতে হচ্ছে আজকাল। সেক্ষেত্রে প্রকাশককে অনেক সময়ই তো আপস করতে হয়...
উ: না, আমি এটা মনে করি না। প্রকাশকের কাজ হচ্ছে পাঠকের রুচি তৈরি করা। সংসদ সেটা করতে পেরেছে বলেই আমি মনে করি। যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছবিতে রামায়ণ, ছবিতে মহাভারত। যেটা অন্যান্য প্রকাশনা সংস্থা আরও অনেক পরে ভেবেছে, সংসদ সেটা বহু আগেই রূপায়িত করেছিল। আমার পিতৃদেব পঁচিশ বছর পরে কী হবে তা চিন্তা করতে পারতেন। এই যেমন বলা যায় আমার শৈশব বইটির কথা। এটা আসলে ছিল একটা অ্যালবাম। ছোটদের জন্ম থেকে নানা মুহূর্তকে ধরে রাখার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। এটাও কিন্তু বাবার পরিকল্পনা ছিল। সমর দে-কে দিয়ে বাবা ছবি আঁকিয়েছিলেন। সে সময় বাংলা বইয়ের জগতে এমনটা কেউ ভাবতেই পারেননি। কাজেই রুচি তৈরি করা কিন্তু প্রকাশকের কাজ।
প্র: প্রকাশনায় যত্ন এবং নিষ্ঠার অভাবে বাংলা বাজারে বহু প্রকাশনা সংস্থা নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে। প্রভূত গ্রন্থ প্রকাশ করছে তারা, কিন্তু কোনওটাই পাঠককে তেমন স্পর্শ করছে না। প্রকাশনায় অযত্নের ছাপ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খুব স্পষ্ট। মুদ্রণপ্রমাদের কথাই ধরুন...
উ: মুদ্রণপ্রমাদের আসল কারণটা হচ্ছে, ভাল প্রুফ-রিডার নেই। নতুন প্রজন্মের যাঁরা প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের মধ্যে ক’জন দ্য শিকাগো ম্যানুয়াল অফ স্টাইল বইটার কথা জানেন? দিস ইজ় দ্য বাইবেল অফ পাবলিশিং। প্রকাশনার সঙ্গে সম্পৃক্ত সবক’টি বিষয় এই বইয়ে ধরা আছে। এই বইয়ের কথা তো বেশির ভাগ মানুষই জানেন না। বাংলাতে এরকম কোনও বই হল না। বই এমন একটা জায়গা যেখানে সৃজনশীলতার প্রচুর সুযোগ আছে। কিন্তু কোথাও হয়তো আমরা সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারছি না। তাই অগ্রগতি থমকে যাচ্ছে। কিছু খামতি থেকে যাচ্ছে।...
সূত্রঃ ‘বইয়ের দেশ’ এপ্রিল-মে ২০১৮ সংখ্যা।
সম্পূর্ণ সাক্ষাত্কারটি পড়ার জন্য Click করুন Read Or Download.