Ticker

6/recent/ticker-posts

কলকাতায় গালিব - শামিম আহমেদ

amarboi
কলকাতায় গালিব
শামিম আহমেদ

কলকত্তে কা জো জিকর কিয়া তু নে হম-নশী;
এক তির মেরে সীনে মে মারা কি হায় হায় ।

কলকাতা আসার ঠিক সাত দিন পর গালিবের ঘড়িটা হারিয়ে গেল।

মির্জা আসাদুল্লাহ খান গালিবকে এই পকেটঘড়ি উপহার দিয়েছিলেন লখনউ-এর রাজা নাসিরুদ্দিন হায়দার। গালিব যখন দিল্লি থেকে ফিরােজপুর ঝিরকা হয়ে লখনউ গিয়েছিলেন, তখন ওই ঘড়িটি তাঁর হস্তগত হয়। তারপর বান্দা-বারাণসী ঘুরে কলকাতা এসেছিলেন ব্রিটিশ সরকার বাহাদুরের কাছে পেনশনের আর্জি নিয়ে। এই পেনশন ছিল গালিবের পিতামহের জায়গিরের বদলে প্রাপ্য বাৎসরিক ক্ষতিপূরণ। তখন ইংরেজ শাসনের রমরমা। কলকাতা সারা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজধানী। লখনউ ও বারাণসীতে রাজা থাকলেও তারা ছিল ইংরেজদের হাতের পুতুল। তামাম হিন্দুস্তানের বাদশা সানি আকবর তখন দিল্লির তখুতে। সানি’ মানে দ্বিতীয়। হজরত নুহ, যিনি প্লাবনের হাত থেকে জীবকুলকে রক্ষা করেন, তাঁকে বলা হয় সানি আদম। সানি আকবরের সঙ্গে আসল আকবরের অনেক তফাত, ঠিক যতটা পার্থক্য হজরত আদম আর নুহ নবির মধ্যে। (পুরাণ মতে, আদম প্রথম মানব ও নবি। নুহ আর একজন আদম-পরবর্তী নবি। প্রলয়কালে তিনি দুনিয়ার প্রাণীকুলদের রক্ষা করেন। নুহকে ‘দ্বিতীয় আদম' বলা হয়। )

দুসরা আকবরের সঙ্গে গালিবের তেমন বনিবনা ছিল না। একে তাে ওই মােগল বাদশারা সুন্নি আর মােগল-গালিবের পরিবার সাফাবিদ-শিয়া। শিয়া-সুন্নির বিবােধ তাে আজকের নয়। তার ওপর গালিব শরাব পান করেন। এখানেই শেষ নয়। গালিব জুয়াও খেলেন। সেই অপরাধে কোতােয়াল তাঁকে হুঁশিয়ারিও দিয়েছে বেশ কয়েকবার। এ ছাড়া রয়েছে তয়াইফদের কাছে তাঁর নিত্য যাতায়াত। এমন সব নানা কারণে মির্জাসাহেব নিজেকে আধা-মুসলমান ঠাওরাতেন। বাদশা আকবর ইংরেজদের তাঁবেদারি করে চলেন। তাঁর তেমন প্রতিপত্তিও নেই যে হামলে পড়ে তাঁর সঙ্গে ভাব জমাবেন। বাদশার মাথার ওপর সব সময় ইংরেজরা ছড়ি ঘােরাচ্ছে।

একবার ধৈর্য হারিয়ে বাদশা আকবর কলকাতার রামমােহন রায়কে বিলেতে পাঠালেন। রামমােহন তালেবর লােক। ফুট ছয়েক লম্বা। বােজ বারাে সের খাঁটি দুধ পান করেন। আস্ত একটা রেওয়াজি খাসি একাই সাবাড় করে দিতে পারেন। তার ওপর রামমােহন দশখানা ভাষা জানেন। বাদশার বিরুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির খবরদারি বন্ধ করার অভিপ্রায়ে রামমােহন গেলেন বিলেত। তাতে কাজের কাজ কিছু হল না। রামমােহন রায় এই সুযােগে দ্বিতীয় আকবরের কাছ থেকে ‘রাজা' উপাধিটি পেয়ে গেলেন।

হিন্দুস্থানে তখন অরাজক অবস্থা। বাংলার অবস্থাও ভালাে নয়। গালিব কোনােদিন চাকরি-বাকরি করেননি। গজল-মসনভি লিখে, কোঠিতে বাইয়ের নাচ দেখে আর সুরাপান করে, জুয়া খেলে তার সময় কেটেছে। কখনও পারিবারিক পেনশন, ঠাকুরদার জমানাে টাকা, কখনও শ্বশুরের পয়সা উড়িয়ে চলেছে তাঁর সুরাপান, জুয়াখেলা, বেশ্যাগমন আর গজল রচনা। কথায় আছে, বসে খেলে রাজার ভাণ্ডারও টুটে যায়, গালিব তাে কোন নস্যি। তিনি ঠিক করলেন, যে পূজার যে ফুল লাগে, তিনি তাই দেবেন। শিয়া মুসলমান হয়েও এত দিন সুন্নি মােগলদের গুণ গেয়ে এসেছেন শুধু ভাতার জন্য। মােগলরা তাঁকে কোনাে বৃত্তি দেয় না, অতএব তিনি ইংরেজ কোম্পানির গুণ গাইবেন, তাতে যদি ঘরে নুন-ভাত জোটে। গালিব অবশ্য শাক-ভাতের থেকে রুটি-গােস্ত বেশি পছন্দ করেন। আর করবেন নাই বা কেন! তাঁর শরীরে যে রক্ত বইছে তা তাে রাজা-বাদশাদের থেকে কোনাে অংশে কমজোরি নয়! বড়াে নীল সেই খুন! তাই তিনি কারও কৃপাপ্রার্থী নন। যেটুকু তাঁর হক, সেটুকুই পেতে চান তিনি।

লখনউ-এর শিয়া রাজা নাসিরুদ্দিন হায়দার যে ঘড়িটি গালিবকে ‘উপহার’ দিয়েছিলেন, তা খুব সাধারণ মানের জিনিস নয়। সােনার পকেটঘড়ি। রাজা-বাদশার কাছে তা অবশ্য খুব মূল্যবান নয়! এই ঘড়িটার মধ্যে গালিব লক্ষ করলেন এক অদ্ভুত জিনিস। তার কাঁটা আগু-পিছু করলেই সর্বনেশে কাণ্ড ঘটে যায়। সে প্রসঙ্গ কিঞ্চিৎ জাদুবাস্তব। পুবদিকে অনেকক্ষণ খুব জোরে দৌড়ােলে ঘড়ির কাঁটা থেমে যায়। আর যদি পশ্চিমদিকে ঘােড়ার পিঠে জোরসে টগবগ করে চলেন, ঘড়ির কাঁটা পিছু হটতে শুরু করে। গালিব বেশ মজা পেলেন। কাউকে কিছু না জানিয়ে তিনি ঘড়িটি অতি সাবধানে তার পুঁটলিতে রেখে দিলেন।

বেশ কিছু কাল হল গালিব বড়াে অর্থকষ্টে ভুগছেন। তাঁর চাই টাকা। বাঁচতে গেলে অর্থ দরকার নেই, এমন মানুষ শহরে পাওয়া যাবে না। মির্জা ভাবেন, এখন শাসক যেহেতু ইংরেজ, তাই শাসকের উচিত কাজ হল, কবিকে উপযুক্ত ভাতা প্রদান করা। তা ছাড়া তিনি খানদানি বংশের মানুষ, তিনি নােকরি করতে যাবেন কোন দুঃখে! হিন্দুস্থানে, মানে রাজধানী দিল্লিতে বাদশার কাছে, বাদশার উমেদারদের কাছে, ইংরেজ তালেবরদের কাছে অনেক আবেদন-নিবেদন করার পর বিফল হয়ে, ব্যর্থ হয়ে গালিব দিল্লি ত্যাগ করলেন। তাঁর বেগমকে আগ্রা পাঠিয়ে দেবেন ভেবেছিলেন, কিন্তু বাপের বাড়িতে তাে কেউ নেই; সব মরেহেজে গিয়েছে। কিন্তু গালিব কবেই-বা তাঁর বিবি উমরাও বেগমের কথা ভেবেছেন! গলি কাসেমের ভাড়াবাড়িতে একমাত্র নােকরানির কাছে। বেগমকে সঁপে দিয়ে তিনি বেরিয়ে এসেছেন। আর আছে কালু মিঞা। বাড়ির বাইরের যা প্রয়ােজন সেই সামলাবে।

হিন্দুস্থান ছেড়ে বাংলায় আসা খুব প্রয়ােজন ছিল গালিবের। অবশ্য দিল্লি ত্যাগ করার প্রধান কারণ হল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজধানী কলকাতায় আসা। তখন দিল্লি থেকে কলকাতা আসা মােটেও সহজ ছিল না। তিনি প্রথমে গেলেন ফিরােজপুর ঝিরকা। লােহারু রাজ্যের নবাব আহমদ বখশ গালিবের শশুর ইলাহি বখশ খানের অগ্রজ, আবার তিনি চাচাজানের শ্যালকও বটে। তাঁর দৌত্যে সাক্ষাৎ করলেন জেনারেল অক্টোরলােনির সঙ্গে। অক্টোরলােনি প্রচণ্ড ধুরন্ধর লােক। গালিব শুনেছেন, গােরারা মানুষ ভালাে হয় না। গরিবের দুঃখ বােঝে না। অক্টোরললানির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কোনাে লাভই হল না। কয়েক দিন নবাবের, মানে শ্বশুরবাড়ির রাজকীয় আতিথেয়তায় থাকলেন ফিরােজপুরে। এর মধ্যে অক্টোরলােনি গেলেন বদলি হয়ে। সেই জায়গায় এলেন জেনারেল মেটকাফ। তাঁর সঙ্গে অনেক আশায় বুক বেঁধে দেখা করলেন মির্জা গালিব। মেটকাফও সেই অক্টোরলােনির মতােই শঠ! অনেক কথা বলা সার হল। কিন্তু মেটাকফের মন গলল না। গালিব জানেন, নিষ্ঠুরের প্রাণেও মায়া-দয়া থাকে। মেটকাফের কাছে আবার গেলেন। পর পর তিন বার। কিন্তু গালিবের কপাল মন্দ, সাহেবরা সম্মত হলেন না। বারবার ব্যর্থ হল ভাতার আবেদন। সব কিছুর মূলে আছেন ওই নবাব আহমদ বখশ খান।

প্রচণ্ড ক্ষোভে-দুঃখে গালিব চলে গেলেন কানপুর। কিন্তু সেখানে গিয়েই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বেচারা কবি তখন লখনউয়ে গিয়ে আশ্রয় নিলেন। অবধের রাজা নাসিরুদ্দিন হায়দার প্রচণ্ড বিলাসী, মদ্যপায়ী ও খামখেয়ালি মানুষ। সব সময় আশঙ্কায় ভােগেন, এই বুঝি তাঁর খাবারে কেউ বিষ মিশিয়ে দিল! গােরা এক নাপিত ছাড়া কাউকে তিনি বিশ্বাস করেন না। রাজা নাসিরুদ্দিন হায়দারের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন গালিব। সাক্ষাৎ তাে করলেনই না, কোনাে সৌজন্যের ধারও ধারলেন না বাদশা। গালিব অপমানিত হয়ে চলে এলেন। এমন ঘটনা পূর্বে কখনও ঘটেনি। অপমানে দীর্ণ হয়ে মির্জা গালিব পুনরায় শয্যাশায়ী হলেন।

রাজা নাসিরুদ্দিন হায়দার গালিবের অসুস্থতার খবর শুনে একটু নরম হলেন। তিনি গােরা নাপিতকে বললেন, ডাকো কবিকে। নাপিত দূত পাঠাল। কিন্তু অভিমানী গালিব সাড়া দিলেন না। দূত বারবার গালিবের কাছে এল। বলল, চলুন! হুজুর ডাকছেন। গালিব বললেন, না। তিনি দেখা করতে যাবেন না। দূত নাছােড়বান্দা। সে বােজ আসে। একদিন বিরক্ত গালিব নাছােড়বান্দা শাহি কাসেদকে বললেন, তিনি রাজা নাসিরুদ্দিনের সঙ্গে কথা বলতে পারেন এক শর্তে।

কী সেই শর্ত? যদি রাজা নাসিরুদ্দিন হায়দার স্বয়ং তাঁর গরিবখানায় আসেন তবেই তিনি তাঁর সঙ্গে বাতচিত করবেন।

এমন শর্ত শুনে নাসিরুদ্দিন রাজা বললেন, কী! এত বড়াে সাহস লােকটার? এই কে আছিস, আমাকে এক পাত্র সুরা এনে দে , তার পর দেখছি ব্যাটাকের পরিচারক সুরা এনে দিলে তিনি বললেন, কোথায় গেল ফিরিঙ্গি নরসুন্দর, তার হাতের পানীয় ছাড়া আমি পান করি না, জানিস না ? কোথায় সে? গােরা নাপিত এল। রাজা বললেন, শুনেছিস ওই কবির কথা। লােকটার ধৃষ্টতা তাে কম নয়!

গােরা নাপিত বলে, কবির কথা বাদ দিন। এই নিন, আপনার জন্য শব-ই-মেহতাব এনেছি, খেয়ে নিন।
রাজা নাসিরুদ্দিন বলেন, কবি বলে কি বাদশার মাথার ওপর দিয়ে হাঁটবে! ডাকো মির্জা গালিবকে। কোথায় কাসেদ ?
সাহেব নাপিত কাসেদকে বলল, আর ডাকতে যাওয়ার দরকার নেই। মির্জা গালিব চুলােয় যাক! চুলােয় যাক তার কবিতা।

রাজা বললেন, তাই যাক। এখন নিয়ে এস মদ! নাচ হােক! মেমবাইদের ডাকো। আমার চুষিকাঠি কোথায় ?
নাপিত চুষিকাঠি এগিয়ে দিলে রাজা সেটা চুষতে চুষতে সিংহাসনে ঢলে পড়েন।

ফিরােজপুরের নবাব আহমদ বখশ অভিজাত ও চতুর শাসক। শােনা গেল, তাঁকে ইংরেজরা হটিয়ে দিয়েছে। একের পর এক রাজ্য কোম্পানি বাহাদুর নিজেদের অধীনে আনতে শুরু করেছে। গালিব লখনউতে বসে ঠিক করলেন, তিনি কলকাতা গিয়ে বডােলাট আমহাস্টের সঙ্গে দেখা করে সব কথা খুলে বলবেন। জায়গিরের বদলে যে টাকা তাদের এবং চাচার পরিবারের পাওয়ার কথা লর্ড লেক ঠিক করে দিয়েছিলেন, তা কেন তিনি পাচ্ছেন না, তার সুবিচার চাইবেন। আর ওই লখনউর হতচ্ছাড়া রাজা নাসিরুদ্দিনের গদি কী করে থাকে, তা-ও তিনি দেখে নেবেন। রাজা নাসিরুদ্দিনকে এক গুপ্তচর এসে জানাল যে মির্জা গালিব লখনউ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।

রাজা জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় যাচ্ছেন তিনি, কোন মুলুকে? কেন যাচ্ছেন?

দূত বলল, হুজুর সে কথা শুধাইনি। তবে আমার মনে হয় কলকাতায়। বডােলাটের সঙ্গে দেখা করতে।
এখন বড়ােলাটসাহেব কে যেন? গােরা নাপিত বলে, লর্ড আমহার্স্ট। তিনি ঘড়ি ভালােবাসেন।

নাসিরুদ্দিনের ছিল ঘড়ির বেজায় শখ। তাঁর সংগ্রহে তখন কয়েক হাজার পকেট ঘড়ি, দেয়ালঘড়ি আর হাতঘড়ি। বিদেশে নতুন কোনাে ঘড়ি তৈরি হলে তিনি সেই খবর পেতেন তাঁর গােরা নাপিতের কাছে। আর সেই সব সংগ্রহ করতে তিনি কালবিলম্ব করতেন না। রাজকোষ ফাঁকা করে ইতালি আর সুইডেন থেকে কিনে আনাতেন নানা কিসিমের ঘড়ি। চারপাশে অনেক ঘড়ি সাজিয়ে তিনি দিবারাত্র মদ্যপান করতেন আর সুন্দরীদের নিয়ে ফুর্তি করতেন। রাজার চুষিকাঠিতেও নাকি একটা ক্ষুদ্র ঘড়ি লাগানাে ছিল! গালিবের বড়াে শখ ছিল ওই দৃশ্য দেখার ও উপভােগ করার। কিন্তু ভাগ্য মন্দ হলে যা হয়!

চরের কাছে গালিবের কলকাতা-যাত্রার কথা শুনে রাজা নাসির বললেন, ওই ব্যাটা কবিকে এই সােনার পকেটঘড়িখান দিয়ে বলিস, ও যেন বড়ােলাটের কাছে সেটা পৌঁছে দিয়ে জানায়, অবধের বাদশা নাসিরুদ্দিন এই ক্ষুদ্র নজরানা লাটসাহেব আমহাস্টের জন্য পাঠিয়েছেন।

গােরা নাপিত তখন হামামখানায় গােসল করছিল।

গুপ্তচর দূত হয়ে সেই ঘড়ি বটুয়ায় ভরে দৌড়ােতে দৌড়ােতে নিয়ে এল মির্জা গালিবের আস্তানায়। কবির ঘরে ঢুকেই সে শুনতে পেল তিনি উদাত্ত কণ্ঠে আবৃত্তি করছেন।

জিন্দেগি আপনি যব ইস শকল্‌ সে গুজরি গালিব।
হম ভি ক্যায়া ইয়াদ করেঙ্গে কি খুদা রাখতে থে

কলকাতায় গালিব
শামিম আহমেদ