Ticker

6/recent/ticker-posts

নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা | অতীশ দীপংকরের পৃথিবী | সন্মাত্রানন্দ | Full Download

নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা
নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা
অতীশ দীপংকরের পৃথিবী
সন্মাত্রানন্দ

‘অতীশ দীপংকরের জীবনের উপর রচিত বাংলাভাষার প্রথম প্রামাণ্য উপন্যাস। হাজার বছরের প্রাচীন ইতিহাসের সঙ্গে আজকের পৃথিবীও জড়িয়ে আছে এ উপন্যাসের আখ্যানভাগে। সময়ের গলিপথে বিভিন্নযুগের চরিত্রদের সাক্ষাৎ হয়েছে আলোয়াঁধারিময় পরিবেশে – অতীশের সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন তিব্বতি চাগ্‌ লোচাবা, আটশো বছর আগেকার রহস্যময়ী কুলবধূ স্বয়ংবিদা, আজকের বাংলাদেশের কৃষক অনঙ্গ দাস ও তাঁর মেয়ে জাহ্নবী, শহর কলকাতার অনুসন্ধিৎসু যুবক অমিতায়ুধ এবং উপন্যাসের কল্পিত লেখক শাওন। তিন যুগের তিন নারীর প্রণয়কথার অনুষঙ্গে এ উপন্যাস এক অনন্য অতীশ-অনুসন্ধানের ইতিবৃত্ত।‘
‘যখন বৃক্ষরাজির ভিতর দিয়ে বহে যাবে সমুষ্ণ বাতাস, নদীর উপর ছায়া ফেলবে গোধূলিকালীন মেঘ...তখন, কেবল তখনই আমি তোমার কাছে আসব’-এই কথা বলে হাজার বছর আগে এক নারী ডুব দিল মৃত্যুর নিঃসীম অন্ধকারে। অন্তিম সেই উচ্চারণের অর্থ খুঁজতে গিয়ে চন্দ্রগর্ভ হয়ে উঠলেন অতীশ, তিব্বতি পর্যটক চাগ্‌ লোচাবা আহিত হলেন আটশো বছর আগেকার কোনো এক বাঙালি কুলবধূর পিপাসার্ত হৃদয়বিদ্যুতে, আর অধুনাতন কালে এক কৃষককন্যার মধ্যে সেসব কথাই গান হয়ে ফিরে আসতে দেখল অমিতায়ুধ। মৃন্ময়ী প্রতিমা, দারুমূর্তি আর ধাতব আইকন খুলে ধরেছে অতীশ-চরিতের বহুবিধ বাতায়ন; তবু শেষ পর্যন্ত কাঠ, পাথর বা ধাতু নয়, দীপংকর এক রক্তমাংসের মানুষ, এক বাৎসল্যকরুণ হৃদয়, জীবনব্যাপী অন্বেষার এক ধ্রুব অর্থ। আর সেই বিশিষ্ট অর্থে প্রত্যেকেই আমরা অতীশ, প্রত্যেকেই দীপংকর।

একবিংশ শতক, সাম্প্রতিক কাল
(বজ্রযােগিনী, বিক্রমপুর, বাংলাদেশ)

নিঝুম রােদ

ফাল্গুনের শেষ। চৈত্র কদিন বাদেই ঢুকবে।
দুপুরবেলায় ভাত খেয়ে দাওয়ায় বসে তামাক টানছে অনঙ্গ। কোন বিহানে সে মাঠে গেছিল, তেমন করে আলাে তখনও ফোটেনি। গামছায় দুটি ভেজা ভাত রােজকার মতাে বেঁধে দিয়েছিল মেয়েটা। হাতের কাজ আটটা নাগাদ বিশ্রাম দিয়ে জলপান করেছিল তারা। সে, বদরু আর আইনদ্দি। দুপুরবেলায় মাথার ওপর রােদটা চড়চড়া উঠলে আর কাজকাম করা যায় না। জমিন ছেড়ে ঘরে ফিরে পুকুরের ঠান্ডা জলে স্নান করে ভাত খেয়েছে। এখন তামাক টানছে! একটু রােদ কমলে আবার মাঠের দিকে যেতে হবে। মেলা কাজ এখন মাঠে।
বসন্তের বাতাস নিঝুম রােদে টলতে টলতে আসে। সে-বাতাসে মিশে থাকে নদীজলের শব্দ। ধলেশ্বরী, মেঘনা আর পদ্মার স্রোতের উছালপাছাল এ বাতাসের সঙ্গে মিশে থাকে। মাঝে মাঝে বাতাস দম ধরে। তারপর শ্বাস ছাড়ার মতাে একটা দমকা ওঠে। সেই সব আলুথালু বাতাসের ভিতর নিঃশব্দ হয়ে বসে আছে অনঙ্গ।
সুখবাসপুর যাবার রাস্তার গায়ে গায়ে তার তিন কানি জমি। আর ঘরের থেকে একটু দূরে দুই কানি। সাকুল্যে এই পাঁচ কানি জমির ফলনে কষ্টে সৃষ্টে দিন কাটে তাদের পরিবারে দুটি মাত্র প্রাণী। সে আর তার মেয়ে জাহ্নবী। জাহ্নবীর মা মরে গেছে দশ বছর হল। এখন সংসারের হাল ধরে আছে ওই মা-মরা মেয়েটাই। মেয়েটা না থাকলে সংসারের কী গতি যে হত অনঙ্গ তামাক খেতে খেতে ভাবে।
আলু উঠেছে সংবৎসরের। তিন কানি জমিতে আমন ধান যা করেছিল, তার থেকে তুলে রেখেছে মরাইতে। ফাল্গুনের শুরুতে ঘরের কাছের জমিতে তঁাড়শ, চালকুমড়াে আর কাকরােল করেছে। এখন সেসব সবজির দেখভাল করা, পােকায় না ধরে, ছায়া যেন পরিমাণ মতাে লাগে। গ্রীষ্মের সবজি লাজুকতা বউয়ের মতাে। একটু বােদ উঠলেই ঝমরে যায়! ওদিকে সুখবাসপুরের রাস্তার ধারের মাঠ এখন শূন্য; রুক্ষ নাড়া হাঁ করে চেয়ে আছে।
কাঠের পিঁড়ি টানার শব্দে অনঙ্গ ঘাড় ঘুরিয়ে দ্যাখে। বাঁশের বেড়া দেওয়া হেঁশেলের মেঝেতে জাহ্নবী খেতে বসেছে। ভেজা চুলের রাশ পিঠের ওপর ছড়ানাে। একটা হাঁটুর ওপর ঘাড় হেলিয়ে বসেছে। কস্তা পাড় ডুরে শাড়ি পরনে। মুক্ত হাতটা দিয়ে হাঁটু জড়িয়ে বসেছে সে। এমনি করে খেতে বসত ওর মা। ঊষা। এমনি করে ঘাড় হেলিয়ে, পিঠের ওপর ভেজা চুলের রাশ ছেড়ে দিয়ে। এই জাহ্নবীর বয়সেই তাকে ঘরে নিয়ে এসেছিল অনঙ্গ। এমনই বছর কুড়ি বয়স তখন তার। সে আজ কত দিন হল।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অনঙ্গ পালানের পশ্চিমপানে গােয়ালঘরটার দিকে তাকায়। গােয়ালের সামনে অনেকক্ষণ ধরে এক আঁটি খড় চিবােচ্ছে বুধি। খুঁটিতে বাঁধা। তারই এক পাশে সােনালি খড়ের ঘন স্তুপ। স্তুপের মাঝে বাঁশটার মাথায় উলটে রাখা মাটির হাঁড়ির গা বেয়ে নেমেছে শ্যাওলার দাগ। সেই দিকে চেয়ে চেয়ে অনঙ্গ অন্যমনস্ক হয়ে যায়। মুন্দিগাছের বেড়ার ওপর জড়িয়ে জড়িয়ে উঠেছে স্বর্ণলতা, বেড়ার ওদিক থেকে আকুল হয়ে ঝাপিয়ে পড়েছে মাধবীফুল, গােবর দিয়ে নিকোনাে পালানের আর-একদিকে তুলসী মঞ্চ, আর-একটু পরেই তার ওপর এসে পড়বে দিনান্তের বােদ। এখনি হয়তাে বেড়ার ওদিক থেকে ডেকে উঠবে আইনদ্দি বা বদরু, “লন, মাডে যাই, বিহাল হইয়া যাইব, লন।” অনঙ্গ গামছা দিয়ে ঘাড় মুখ মােছে।
চৈত্রের হাওয়াটা এবার যেন বেশি তাড়াতাড়ি এসে পড়ছে। একদিকে নতুন পাতা আসে, অন্যদিকে পুরােনাে পাতা ধুলাসমেত ওড়ে। পালানের ওপরও কতকগুলাে হলুদ পাতা এসে পড়েছে। কত আর ঝাট দেবে জাহ্নবী। মেলা পাতাপুতা উড়ে আসে। মেয়েটা কাজ করে সারাদিন। ঘরগেরস্থালির কাজ, রান্নাবান্না, সেলাই ফেঁড়াই, বেবাক কাম।ওর মায়ের ধারাই পেয়েছে। সেও ঘুরত এঘর-ওঘর চরকির মতাে। রঘুরামপুরের মেয়ে। চাচা দাঁড়িয়ে থেকে তাদের বিয়ে দিয়েছিল। ইমতিয়াজ শেখকে চাচা বলত অনঙ্গ। তার বাপ-পিতামাে ওই ইমতিয়াজ শেখের জমিতে মজুর খাটত। অনঙ্গ তাদের বেশি দেখেনি জ্ঞান হবার পর। ইমতিয়াজ শেখ তাকে মানুষ করে নিজের ছেলের মতাে। তাইতেই দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধ, কোনােকিছুর আঁচড়টি লাগেনি তার গায়ে। ইমতিয়াজ ছিল ঝানু প্রভাবশালী লােক, আদ্দেক মুনশিগঞ্জের লােক তার নামে সালাম দিত। এন্তেকাল হবার সময়ে ইমতিয়াজ শেখ তাকে এই পাঁচ কানি জমি আর বসবাস করার জায়গা লিখে দিয়ে যায়। ঘর বানিয়ে ঊষার হাত ধরে এই বাসায় উঠে আসে অনঙ্গ, তা আজ তিরিশ বছর হল। জমিজিরেত বসবাস সবই সে আর ঊষা সাজিয়েছিল মনের মততা, কিন্তু, ওই যে কপাল! বিয়ের তিন বছরের মাথায় সােনার গােরার মতাে খােকা হল, কিন্তু বাঁচল না। পানিবসন্তে ছেলেটা মারা গেল পাঁচ বছর বয়সে। ছেলেটা বাঁচলে কি আজ এই বয়সে এত বােদে খাটতে হয় ? কপালে নেই। তারপর এই জাহ্নবী। তাে, ও মেয়েরও দশ বছর বয়স হতে না-হতেই কী এক জ্বরে ভুগে ওর মা উষা চলে গেল স্বর্গে।
অনঙ্গ ভাবে আর ভাবে। এই এক ভাবনারােগ হয়েছে তার আজকাল। কামাজে ভালােই থাকে, একটু জিরােতে বসলেই ওই মেয়ের ভাবনা ঘিরে ধরে। মেয়ের বিয়ের বয়স তাে হল। আর কদ্দিন? এর মধ্যেই বিয়ের সম্বন্ধ তাে এসেছে, কিন্তু জাহ্নবী চলে গেলে কী করে বাঁচবে সে এই সংসারে ? এই দুইখানা ঘর, একখানায় চাষবাসের লাঙল, কোদাল, হরেক জিনিস, আর-একঘরে বেড়া দিয়ে আলাদা করা দুই কামরা, এক ঘরে জাহ্নবী থাকে, অন্যঘরে সে নিজে। এই দাওয়া, হেঁশেল, গােয়াল, পালান, তুলসীমঞ্চ সব যে খাঁ-খা করবে জাহ্নবী চলে গেলে। তবু মেয়ের বিয়ে দিতেই হবে শিগগির। গাঁয়ে ঘরে কথা উঠছে মেয়েকে নিয়ে এরই মধ্যে। দুষ্ট লোেক খারাপ ইঙ্গিত দেয় পথে ঘাটে । নাহ্, সামনের বছরেই যা করার...
এবার সত্যিই আইনদ্দির গলা শােনা গেল।
ঘটিতে করে জল নিয়ে মুন্দিবেড়ার কাছে মুখ ধুচ্ছিল জাহ্নবী। আইনদ্দির গলার আওয়াজ পেয়ে তাড়াতাড়ি বাপের কাছে সরে এল।
“বেলা হইছে, মাডে যাইবা না? আইনদি ডাকতাছে। হুনছ?” মেয়ের কথায় ঘাের কাটে অনঙ্গর।
‘হ যামু। জল দে। তিয়াস লাগছে।”
এক ঘটি জল জাহ্নবী বাপের দিকে এগিয়ে দেয়। জলটুকু ঢ ঢক্‌ করে খেয়ে অনঙ্গ উঠে দাঁড়ায়। কোমরে কাপড়ের কসি শক্ত করে বাঁধে। তারপর দাওয়া থেকে নেমে হনহনিয়ে অঙ্গন অতিক্রম করে বেরিয়ে পড়ে।
বেলা দুপুর। কোথা থেকে অজানা কোন পাখির ডাক দ্বিপ্রহরের মায়াময়তায় আচ্ছন্ন করে বাতাস। দূরের খেজুরগাছটায় কাঠঠোকরা ঠোট ঠোকে-ঠক্ঠক্ঠক্ঠক। ঘরের মধ্যে ঘূর্ণি বাতাস এসে পাক খায়।
চৌপাইয়ের ওপর বসে কথা বােনে জাহ্নবী। ফুল কথা, নকশি কাঁথা। উঁচ দিয়ে ফুল তােলে। বড়াে বড়াে ফেঁড় দেয়। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে সুতাে কাটে। আবার নতুন করে ছুঁচে সুতাে পরাতে যায়। সুতাে ঢুকছে না। মুখের মধ্যে সুতাে জিভ দিয়ে মিহি করে। ডাগর ডাগর চোখ তুলে জানলা দিয়ে বাইরে তাকায়। উইটিপির গায়ে নিঝুম হয়ে বসে আছে একটা খয়েরি রঙের প্রজাপতি। বুনাে ঝােপঝাড়ে ঘরের পিছনটা ভরে আছে। চারমুখওয়ালা ধানসিদ্ধ করার মাটির উনুনের বুকের ওপর চিড়িক করে লাফ দিয়ে উঠছে কাঠবিড়ালি। দেখতে দেখতে কেন জানি উদাস হয়ে যায় জাহ্নবী। তারপর হঠাৎ কাঁথা সরিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ঘর থেকে বেরিয়ে আসে পায়ে পায়ে।
ঘরের পেছনের দিকে খিড়কি দরজা। খিল খুলে বেরিয়ে আসে সে। এই পায়েচলা পথটা জলজংলার মধ্য দিয়ে চলে গেছে পুকুরঘাটে। আশশ্যাওড়া, সজনে, জারুল গাছের ঝুপসি ছায়া। প্রথম বসন্তের ছোঁয়া পেয়ে জারুল গাছের সারা দেহ জুড়ে বেরিয়ে আসছে তেলাকুচা রঙের পাতা। সজনের ফুল সাদা হয়ে আছে গাছগুলােয়। কোনােটায় উঁটা এসে গেছে। জঙ্গলের ভিতর আলাে করে রেখেছে ভাঁটফুল। পুটুসফুলগুলাের হলুদ মাথা বাতাসে এদিক-সেদিক দুলছে। ছায়াভরা পথ বেয়ে জাহ্নবী আপনমনে হাঁটতে হাঁটতে গুন গুন করে কী একটা গান গায়। রঘুরামপুরে মামার বাড়িতে গিয়েছিল গত বৈশাখ মাসে। যাত্রা দেখেছিল সেবার। সেই যাত্রার গান। সুরটা মনে আছে। কথা সব ভালাে মনে নেই।
খেজুর গাছের মাজা দিয়ে বাঁধানাে পুকুরঘাট। এইখানে এসে বসে জাহ্নবী। পুকুরের জল লাল সরপড়া। কতদিনের পুকুর এটা। সংস্কার হয় না। মজে গেছে। মাঝে মাঝে চঁদা আর সরপুঁটি মাছেরা ঘাই মারে। তা না হলে নিস্তরঙ্গ মেটে রঙের জল। পুকুরের পাড়ে জড়িয়ে মড়িয়ে উঠেছে গাছগুলি। চামল গাছে নতুন বড়াে বড়াে পাতা আসছে, গাছের নীচে শুকনাে পাতা বােঝাই হয়ে আছে। করুইশিরীষ গাছের হলুদ হয়ে যাওয়া লম্বা গােটা ফলগুলাে বাদশার তলােয়ারের খাপের মতাে দোলে, বাতাসে খড়খড় শব্দ ওঠে। চারিদিকের ঝােপঝাড় আর লতাপাতা পড়ে পড়ে পুকুরের জল খারাপ হয়ে গেছে।
হাঁটুর ওপর চিবুক রেখে বসে আছে জাহ্নবী। কপালে কাচপােকার টিকলি, মাঝে মাঝে কানের পাশ থেকে বড়াে বড়াে চুলগুলাে সরাচ্ছে। নাক বিধিয়েছে ছােটোবেলায়, মায়ের তুলে রাখা নাকফুল বেশর নাকের পাটা বেষ্টন করে আছে। বড়াে বড়াে চোখের পাতা ঝপঝপ পড়ে তার, পুকুরের জলের মতাে ভরা ভরা দুই চোখ, কিন্তু মজা পুকুরের জলের মতাে রসস্থ নয়, তার চোখ স্বচ্ছ, যেন মনের তলদেশ অবধি দেখা যায়। ভারী নিশ্বাসে বুক ওঠে পড়ে। ঠোটের ওপর এক চিলতে ঘাম আর্দু শিশিরের মতাে লেগে আছে বলে তাকে এ মুহূর্তে ছােটো মেয়েটির মতাে দেখায়।
জাহ্নবী দূরের দিকে দেখল। পুকুরের ওই পারে গাছেদের আবরণে চোখ চলে না। কতগুলাে পােড়া ইট শুধু সবুজ ঘাসের মধ্যে দাঁত বের করে থাকে। কী জানি কবেকার ইট সব। এই বজ্রযােগিনী গ্রামে যেখানে সেখানে মাটি একটু খুঁড়লেই বেরােয় ইটের পাঁজা। ভারী নগর ছিল নাকি একদিন, সে শুনেছে। কতদিন আগে, জাহ্নবী তা জানে না। পুকুরের লাল জল দু-পাশে সরিয়ে জলসাপ একটা ওপারের দিকে চলে যায়।
মা-কে আবছামতন মনে পড়ে তার এখন। মায়ের মুখ ক্রমশ আবছা হয়ে এসেছে। এই পুকুরঘাটে বাসন মাজতে আসত মা, গা ধুত। খেজুরের মাজা দিয়ে বানানাে ঘাটের ওপর ভেজা পায়ের ছাপ ফেলে ঘরে চলে যেত। মায়ের সঙ্গে সেও কতদিন এই পুকুরে স্নান করতে এসেছে। মা বলত, “তর যহন বিয়া অইব, এই পুখুরেই নাওয়ামু তরে। গায়ে হলুদের সুম নাওয়ায়, জান? চান্দের লাহান পােলার লগে তরবিয়া দিমুনে।”
মা চলে যাওয়ার পর থেকেই তার বাপ বিমনা। খেতে মাঠে কাজকাম করে। বাকিবাদ উদাস হয়ে থাকে। বয়সও হয়েছে। সুখবাসপুরের রাস্তার লাগােয়া জমিনে সারাদিন খাটে। সেই জমিনের গায়ে গায়ে একটা মাটির ঢিপি। এখানকার লােকে বলে নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা। কতদিন আগে সেখানে নাকি এক রাজার ছেলে খুব লেখাপড়া করে দেশ-বিদেশ ছাড়িয়ে কোন উদিসে চলে যায়। সেই ভিটার ওপর বছর দশেক হল কারা জানি এসে একটা দোয়ার মতাে মণ্ডপ বসিয়ে গেছে। সামনে দুটো কেশর ফোলানাে পাথরের সিংহ। মেলা লােক হয়েছিল। কে জানি পণ্ডিতটা! আহা রে, রাজার পােলা কেন যে দেশ গা ছেড়ে উধাও হয়ে গেল! বড়াে দুকখু লাগে জাহ্নবীর।
ওই সুখবাসপুরের জমিন চুইতে গিয়েই তাে গত বছর তার বাপ আর আইনদ্দি বাক্সটা পেল। কাঠের বাক্স। কারুকাজ করা। ওপরে শ্যাওলা ছাতা পড়েছে। উখাে দিয়ে ঘসতেই ভুর ভুর করে চন্দনের গন্ধ বেরােল। একটা জং ধরা কবজায় চাড় দিয়ে খুলেছিল জাহ্নবী। কী এক তাড়া তালপাতার পুথি। একটা তসবির মালা। যেমন মালা দিয়ে মউলানারা আল্লার নাম জপ করে, সেইরকম। আর ধাতুর তৈরি ছােটো একটা মূর্তি! কী ঠাকুর? লক্ষ্মী না, দুর্গা না, গণেশ না ! তেমন দেবীমুর্তি জাহ্নবী কখনও দেখেনি। বজ্রযােগিনী ইস্কুলে এইট অবধি পড়েছে সে। ঘরে অনেক কাজ, ইস্কুলে যেতে পারে না, তাই পড়া ছেড়ে দেয়। সেইইস্কুলের ইংরেজির মাস্টার দাড়িওলা আবু তাহের বাবার কাছে আসত। বাবা এ অঞ্চলের পুরানাে লােক। সেদিন সন্ধেবেলা বাক্সটা দেখাতেই আবু তাহের বাবাকে বলে কয়ে বাক্সটা নিয়ে যায়। এর দাম নাকি অনেক। কদিন পর এসে বলেছিল। বাবাকে টাকাও দিতে চেয়েছিল। বাবা নেয়নি। তাদের কী কথা হয়েছিল, জাহ্নবী শুনতে পায়নি। হেঁসেলে ছিল সে। চা দিতে গিয়ে শুনল বাবা বলছে, “পণ্ডিতের জিনিস লইয়া আমি কী করুম। ট্যাহাও লমু না। কী মুইল্প, আমি বুঝি না। আমরা চাষাভুসা মানুষ। পণ্ডিতের বাক্স লইয়া ল্যাহাপড়া করুক পুলাপান। ট্যাহা আমি লমু না। মাইয়াডার বিয়াশাদি অইয়া গেলে.” এরপর আর কথা শােনার অপেক্ষা না করে তাড়াতাড়ি গায়ে আঁচল টেনে হেঁসেলে চলে এসেছিল জাহ্নবী।
বিয়ে তার বােধ হয় হবে না কখনও। সে চলে গেলে বাবাকে দেখবে কে? পায়ের নখ দিয়ে সে ঘাটলার মাটি খোঁচায়। বাবাকে তার অসহায় শিশুর মতাে মনে হয় যেন, যা হাত পুড়িয়ে বেঁধে দেয়, তাই খায়। গামছায় করে মুড়ি মুড়কি জলপান বেঁধে দেয়, বাবা মাঠে নিয়ে যায়। সে ছাড়া বাবা বাঁচবে কেমনে?...বাবা শুধু কীসবভাবে আজকাল আকাশ পাতাল! আবু তাহের স্যার কী জানি আরও কী বলেছিল সেদিন বাবাকে। সেই থেকে বাবা জাহ্নবীকে দেখলেই গম্ভীর হয়ে যায়। জাহ্নবী একবুক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
জলের ওপর একটু দূরে ঘাসের মাথায় একটা ফড়িং এসে বসেছে। অন্যমনস্ক হয়ে জাহ্নবী ঘাটের পাশ থেকে খােলামকুচি তুলে নিয়ে ওই দিকে ছুঁডল। পুকুরের মধ্যে গুব করে ঢিলটা ডুবে গেল। লাল সরপড়া জল কাপল, ভারী ঢেউ উঠে গম্ভীরভাবে ওই পাড়ের দিকে ধেয়ে গেল।
আর তখনই বিপরীত পাড়ের দিক থেকে হঠাৎ আরেকটা ঢিল এসে টুপ করে পড়ল জলের মধ্যে। কে? কে রে ওপার থেকে ঢিল ছােড়ে? জাহ্নবী অবাক উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ায়। কোনাে মন্দ লােক নাকি? ওপারের ঘাসজঙ্গল আকন্দঝাড়ের আড়ালে বসে জাহ্নবীকে লুকিয়ে দেখছে? গাছ থেকে একটা ডাল ভেঙে নিয়ে পুকুরের পাড় দিয়ে দেখতে গেল জাহ্নবী। কিন্তু না, কেউ তাে নেই। কিছু নেই। শুনশান করছে। দুপুর। শুধু উদাস করা সুরে সেই পাখিটা অবিরাম ডেকে চলেছে।
পুকুরের বুকে এখনও দুটো টিলের বিপরীতমুখী অভিঘাতে ঢেউগুলাে উঠছে পড়ছে। ভয় পেয়ে জাহ্নবী তাড়াতাড়ি ঘরে যাবার পথে উঠে গেল।
তবু মনের মধ্যে প্রশ্নটা খচখচ করতে লাগল। ওদিক থেকে ঢিলটা আসলে ছুঁড়ল কে?

নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা
অতীশ দীপংকরের পৃথিবী
লেখকঃ সন্মাত্রানন্দ
প্রকাশকঃ ধানসিড়ি
প্রচ্ছদঃ সৌজন্য চক্রবর্তী
দামঃ ৪৫০ টাকা
বইটির কিছু অংশ দেওয়া রইলো, ভালো লাগলে কিনবেন আশাকরি।