Ticker

6/recent/ticker-posts

কথা অমৃতসমান ০২ - নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

amarboi
কথা অমৃতসমান ০২
নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

বড়াে মানুষ গবেষকদের কাছে এটা একটা বড়াে রিডল বটে, বিশেষত যাঁরা মহাভারতের পঙ্কোদ্ধারে নিমগ্ন আছেন, তাঁরা মহাভারতের রঙ্গমঞ্চে কৃষ্ণের প্রবেশটাকে একেবারে নাটকীয়ভাবেই এক নাটকীয় সত্য মনে করেন। মহাভারতের এই সত্যটা তাদের বেশ পছন্দ হয় বলেই কৃষ্ণের পূর্বজীবনের ঘটনা যা কিছুই অন্যত্র বর্ণিত, সেগুলিকে তারা সব সময়েই অসত্য মনে করেন। যদি বা খানিক দয়াপরবশ হয়ে কৃষ্ণের আযৌবন ক্রিয়া কর্মগুলিকে সাহিত্যরসিকতায় তারা মেনেও নেন। তাহলেও মহাভারতের কৃষ্ণের সঙ্গে তার কোনাে সঙ্গতি হয় না বলে তাকে নতুন এক রাখাল, কৃষ্ণ বানিয়ে দিয়েছেন। তারা বলে দিয়েছেন—এটা বৃন্দাবনের কৃষ্ণ, ইনি ‘গােপবেশ বেণুকর, নবকিশাের নটবর’, আর উনি দ্বারকার কৃষ্ণ, মহাভারত সূত্রধার।
আমি দেখেছি, এঁরা খুবই উর্বর-মস্তিষ্কের মানুষ এবং এঁদের ঐকদেশিক গবেষণা-মুখর পাণ্ডিত্যের প্রতি আমার আভূমি দণ্ডবৎ রইল। তবে কিনা আমার এই প্রাণারাম পুরুষটি আমার আরাধ্য বলেই নয় শুধু, আযৌবন সেই ‘বয়ঃ কৈশােরসন্ধি থেকে তার যে লীলায়িত হওয়ার ইতিহাস আছে তাতে যতখানি বিদগ্ধতা ছিল, ততখানিই চতুরতা ছিল, তা নইলে অতগুলি গােপরমণী-তারা প্রত্যেকেই ভেবেছিলেন—কৃষ্ণ আমারই—এই ভাবনার মধ্যে একদিকে যেমন তার আকর্ষণের চরমত্ব প্রকাশ পায়, অন্যদিকে তেমনই প্রক্রিয়াগত দিক থেকে এই বহু-কান্তা-বিলাসের মধ্যে তার চতুর-চাতুরীরও পরিসর তৈরি হয়ে যায়। আমরা তাই বিশ্বাস করি, বৃন্দাবনে যিনি সর্বতােভাবে ‘অখিলরসামৃত মূর্তি’ কৃষ্ণ, সেই রসের চাতুর্যটুকু-মাত্র তাকে ‘মহাভারত সূত্রধার’ বানিয়ে দিয়েছে। লক্ষণীয়, মহাভারতে কৃষ্ণ যতখানি বীর যােদ্ধা, তার চাইতে হাজার গুণ বেশি তিনি ডিপ্লোম্যাট।
কিন্তু উত্তর জীবনের এই বিশাল কূটনীতিকের যে পূর্বজীবন তা, মহাভারতে ধরা নেই। আমরা মনে করি, মহাভারতকে পুরােপুরি বুঝতে হলে, বিশেষত কৃষ্ণ যেখানে মহাভারতের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জড়িয়ে আছেন, সেটা বুঝতে হলে কৃষ্ণের পূর্বজীবনবৃত্তটুকুও ‘রিকনস্ট্রাক্ট করা দরকার মহাভারতের অনুসারী গ্রন্থ থেকে। আমরা মনে করি, কৃষ্ণের পূর্বজীবন-স্মৃতি মহাভারতের মধ্যেই সূত্রাকারে আছে, কিন্তু সেই সূত্র বিশদে আছে মহাভারতেরই পরিশিষ্ট নামে কীর্তিত খিল হরিবংশের মধ্যে এবং অন্যতম প্রাচীন পুরাণ বিষ্ণুপুরাণের মধ্যে। কৃষ্ণের জীবন-ইতিহাস তৈরি করার ক্ষেত্রে এই দুটি উপাদান অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করে এবং আমরা মহাভারতকে পূর্ণরূপে পেতে চাইলে এই দুটি গ্রন্থের প্রতিপূরণী বৃত্তিটাকে গৌণভাবে দেখা যাবে না।
মনে আছে, থিয়ােডর রােজাক তার বিখ্যাত ‘হােয়ার দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড এনডস’ গ্রন্থের এক জায়গায় বলেছিলেন—“মিথ বা পুরাণ হল স্বপ্নের এক মােটিফ’-এর মতাে, সে ন্যায়ের বিরােধগুলিকে একেবারে বিভ্রান্ত করে দেয়, এখানকার ঘটনা সবই ইতিহাসােত্তীর্ণ ঘটনা, সেগুলি কালের ওপর ছাপ ফেলতে পারে না। এই ঘটনাগুলি সম্বন্ধে কেউ এমন প্রশ্ন তােলে না যে, ‘কখন কোথায় এই ঘটনাগুলি ঘটেছিল, কেননা সেই মিথিক্যাল ঘটনাগুলি নিত্য-বর্তমান। মিথের আখ্যানভাগের যে উপরিতল, তা যেমন গৌণ, তেমনই পৌরাণিক সত্য ঘটনাও সেই অর্থে মােটেই তথ্যনির্ভর নয়, বরং তা সময়হীন অন্তদৃষ্টির অপেক্ষা রাখে, সহস্রভাবে তাকে রূপান্তরিত করা যায়। অতএব পৌরাণিক প্রবণতা একের থেকে অন্যকে বিচ্ছিন্ন করে না, বরঞ্চ তা বিভিন্ন ঘটনারাশি একত্রীকরণ এবং আত্মস্থীকরণের দিকে মন দেয় বেশি। ঐতিহাসিকেরা যা পারেন না পৌরাণিকেরা তা পারেন। পৌরাণিকেরা একে অপরকে বলতে পারেন— কাহিনিটা তুমি এইভাবে বলেছাে কিংবা বলাে, কিন্তু আমি এইভাবে এটা বলবাে। কিন্তু দুরকমের বলাই সত্যি— The meaning of myth lies in the vision of life and nature they hold at their core.
মহাভারত এবং হরিবংশ-বিষ্ণুপুরাণের কৃষ্ণ-কাহিনিকেও আমরা একই জীবন এবং প্রকৃতির দুই ভাবে বলা কাহিনির একত্রীকরণ এবং আত্মস্থীকরণ মনে করি এবং রােজাক বলেছেন- fact is not the truth of myth; myth is the truth of fact. আমরা এই দৃষ্টিতেই মহাভারতের কাহিনি তৈরি করছি বলেই কুলীন কেশকৃন্তক গবেষকদের মতাে আদি-মধ্য-অন্ত্য বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে মহাভারতের মৌল আকার তুলে আনার দায় নেই আমাদের। আমাদের পৌরাণিক সংবেদনশীলতা আছে বলেই মহাভারতের কবির হৃদয় বুঝে তারই কালের ভৌগােলিক, সামাজিক, ঐতিহাসিক এবং ব্যবহারিক নিত্য বর্তমানগুলিকে মিশিয়ে দিয়ে মহাভারত পড়ার এবং বােঝার সৌকর্য তৈরি করার চেষ্টা করছি।

নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী