Ticker

6/recent/ticker-posts

কথা সাহিত্যিক সুরঞ্জন প্রামাণিকের সাক্ষাৎকার

সুরঞ্জন প্রামাণিক
কফিহাউজে বিপ্লবের স্বপ্নদেখা ভাঙাচোরা এক মানুষের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল :সুরঞ্জন প্রামাণিক

সুরঞ্জন প্রমাণিক একজন অসামান্য কথাকার। সুরঞ্জনকে শুধুমাত্র এই অভিধায় চিহ্নিত করে, চেনা ছকবন্দি করে ফেললে, সেটা বড়সড় ভুল হবে। বামপন্থায় আস্থাশীল লেখক মানবাধিকার কর্মী হিসাবেও পরিচিত। ইতিহাস সচেতন, সমাজ সচেতন, আদ্যান্ত মানবিক লেখকের এষণা, নতুন এক মানবিক সমাজ। তার বিভিন্ন প্রবন্ধে নির্মিত হয়েছে নতুন নতুন তত্ত্ব। প্রাবন্ধিক সুরঞ্জন বিদগ্ধ পাঠকের মননে বারংবার উপস্থিত হন সমাজবীক্ষায় প্রাপ্ত নববােধ বিশ্লেষণে। ঘােষিত ভাবে লিটল ম্যাগাজিনের এক লেখকের দৈনন্দিন যাপনচিত্র অনুকরণযােগ্য। বিশ্বজুড়ে চলছে অস্থিরতা, সমসাময়িক কালে বিপন্ন বামপন্থা, ধর্মের নামে ক্ষমতার নামে ধ্বংস হচ্ছে মানবিকতা। আবারও দীর্ঘ হচ্ছে হিটলারের ছায়া। লিটিল ম্যাগাজিন আন্দোলন পথ পালটে ‘প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠার’ আন্দোলনে পর্যবসিত, বাংলা সাহিত্যে গল্প এবং অ্যান্টি গল্প নিয়ে পরীক্ষা-নীরিক্ষা চলছে। এই সব বিষয় নিয়ে সুরঞ্জন প্রামাণিকের সঙ্গে খােলামেলা আলাপচারিতা। - দ্বৈপায়ন থেকে সংগ্রহীত।

অমিতঃ সুরঞ্জনদা, প্রতি সেকেন্ডে প্রতি মিনিটে প্রতি মাসে প্রতি বছরে নানান ভাষায় প্রচুর সাহিত্য রচনা হচ্ছে, আর তাতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলা হচ্ছে মানবিকতার কথা, কিন্তু দেখা যাচ্ছে শেষমেশ সেই মানবিকতার পরাজয় হচ্ছে পৃথিবীর কোণে কোণে। তাহলে কেন সাহিত্য ? কেবল কি তা ক্ষণিকের বিনােদন কিংবা সময়ের পরােক্ষ দলিল? সমাজের উপর কি তার কোনাে ইতিবাচক প্রভাব থাকবে না?

সু: প্রা: তােমার প্রশ্নের পটকথা ও প্রশ্ন তিনটিতে সাহিত্য ও সমাজ বা সমাজ ও সাহিত্য সম্বন্ধে দীর্ঘ আলােচনার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে আছে। বলতে পারাে আমি নিজেই উস্কানি পাচ্ছি। ‘ফাঁদ'-এ পা দেওয়া ঠিক হবে না। বরং তােমার প্রথম প্রশ্ন থেকে তাহলে বাদ দিয়ে যে সাধারণ প্রশ্ন। দাঁড়ায় 'কেন সাহিত্য'- এ-বিষয়ে দু-একটা কথা বলা যেতে পারে।

তার আগে 'সাহিত্য কী?’-- এটা আমাদের মনে রাখতে হবে। প্রচলিত সব ‘ধারণা'-কেই স্বাগত জানাতে আমার আপত্তি নেই। তােমার নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে করছে আমার ভাবনায় সাহিত্য কী! সাহিত্য- শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ-তাৎপর্যকে মান্যতা দিতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে মানুষের স্ব-অধীনতা আকাঙ্ক্ষী ব্যক্তিচিন্তার লিপি রূপ হল সাহিত্য।

অর্থাৎ সাহিত্য এমন এক লিখিত ভাষ্য যার মধ্য থেকে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা নৈতিক সৌন্দর্য বিকিরণ করে!

কেন সাহিত্য- এ প্রশ্নের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ শব্দ, কেবল শব্দ নয়- একটি তত্ত্বও বটে যার বিপরীত তত্ত্ব ‘পরাধীনতা’-- তুমি নিশ্চয়ই জানাে যে, বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে ‘প্রকৃতির অনিবার্যতা’-ই জীব মানুষের চৈতন্যে যে মনােভাবের জন্ম দিয়েছিল তা-ই কোনও এক সময়ে ‘পরাধীন’ শব্দে তার প্রকাশ ঘটেছে। প্রকৃতির অনিবার্যতার বিরুদ্ধে তার লড়াই করে টিকে থাকার সংস্কৃতির মধ্য থেকেই গড়ে উঠেছে স্বাধীনতার ধারণা এবং জানি না আমার সঙ্গে তােমার ভাবনা মিলবে কি না, ভাবনাটা এই যে, মানুষের জৈব বিবর্তন ও সমাজ বিবর্তনের ইতিহাসে যে যে জ্ঞানশাখার উদ্ভব হয়েছে সব শাখাতেই শব্দ দুটির প্রবেশ ঘটেছে।

না মিললেও ক্ষতি নেই। বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতা প্রতিনিয়ত স্বাধীনতা-পরাধীনতা সম্বন্ধে আমাদেরকে ‘ঋদ্ধ করেছে এই অভিজ্ঞতা বিনিময়ের আকাঙ্ক্ষা থেকেই সাহিত্য- 'কেন সাহিত্য'- এর একটা আভাস বােধহয় এতক্ষণে দিতে পারলাম।

আর-একটু স্পষ্ট করার জন্য বলা যায় : 'প্রাকৃতিক অনিবার্যতার নিয়ম হল জীবনসংগ্রামের নিয়ম— তা জেনেটিক বা প্রকৃতিগত, কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে জেনেটিকের পাশাপাশি আর একটি ব্যাপার রয়েছে তা সাংস্কৃতিক-- সাংস্কৃতিক এ-কারণে যে, 'প্রাকৃতিক অনিবার্যতা'র বিরুদ্ধে মানুষের বৌদ্ধিক লড়াই এই মুহূর্তে যা পর মুহূর্তে তা নয়, এর অর্থ এই মুহূর্তে আমার বেঁচে থাকার পক্ষে যে ক্রিয়াকলাপ কার্যকর, পরবর্তী সময়ে তার থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতা কার্যকর নাও হতে পারে, অর্থাৎ বেঁচে থাকা বাঁচিয়ে রাখার অভিজ্ঞতা নানা রকমের হওয়ায় তার সময়কালও ভিন্ন ভিন্ন কোনও বিষয় প্রাকৃতিক হতে গেলে, জেনেটিক হতে গেলে তাকে পুনঃপুন, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ঘটতে হবে— অভিজ্ঞতা— এই নিয়মের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। কিন্তু বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে তার মূল্য রয়েছে, এ কারণে তা জানা ও জানানাের আকাঙ্ক্ষা মানবপ্রজাতির মধ্যে বর্তমান।

এই অনুষঙ্গে, যেমন বললে, '...নানান ভাষায় প্রচুর সাহিত্য রচনা হচ্ছে- এটা স্বাভাবিক। কিন্তু মানবিকতার প্রশ্নে, 'সামগ্রিক হিতার্থে সাহিত্য'— এই তাৎপর্য মনে রেখে আমাদের বলতেই হবে প্রচুর সাহিত্য রচিত হলেও প্রকৃত সাহিত্যের অভাব রয়েছে।

অর্থাৎ- ওই যে তুমি বললে, ‘প্রচুর সাহিত্য রচনা হচ্ছে, আর তাতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলা হচ্ছে মানবিকতার কথা’ -- কিছু মনে কোরাে না, তােমার এই পর্যবেক্ষণে ত্রুটি আছে। অথচ, ‘বিনােদন’ শব্দটা যে ভাবে তুমি ব্যবহার করেছ তাতে কিন্তু ওই ত্রুটি থাকার কথা নয়। যাই হােক বিনােদন রিপুতৃপ্তির সঙ্গে যুক্ত' --’মানবিকতার'র সঙ্গে তার বিরােধ আছে। 'মানবিকতা’ রিপুশাসক শাসক হয়ে উঠতে চায়।

আমার বিশ্বাস প্রচুর সাহিত্য’ যদি মানবিকতা'কে ধারণ করতে পারত তাহলে পৃথিবীর কোণে কোণে মানবিকতার পরাজয় ঘটত না, বা ঘটলেও এমন হতাশাব্যঞ্জক হত না।

বিনােদন সাহিত্য অনেকটা খবরের কাগজের মতাে, খবরের কাগজের যেমন ‘প্রত্নমূল্য আছে, তেমনই সমাজমনস্তত্ত্বকে বােঝার জন্য বিনােদন সাহিত্যের একটা মূল্য অবশ্যই আমরা দেব।

অমিতঃ প্রশ্নে উঠে এসেছিল মানবাধিকারের কথা। আপনি নিজেও এই বিষয়টির সাথে দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত। সভ্যতা এগিয়েছে, আর তার সাথে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে, হচ্ছে দিকে দিকে। আজ পশ্চিম এশিয়ায় যা হচ্ছে তার জন্য নতুন পরিভাষা খুঁজতে হবে। দিল্লিকাণ্ড, কামদুনি, পার্কস্ট্রিট থেকে মেদিনীপুর কিংবা পুরুলিয়া কোথাও বাদ নেই এই লঙ্ঘন। ধর্মের নামে, ক্ষমতার নামে দিকে দিকে ধ্বংস হচ্ছে মানবিকতা। এর শেষ কোথায়? না-এ শেষের শুরু?

সু: প্রা: তুমি যা বললে আর তােমার প্রশ্ন— এর থেকে দুটি শব্দকে আমরা তুলে নেব-- মানবাধিকার ও মানবিকতা— এ দুটিকে বিষয় করে একটু আলােচনা করা দরকার, নইলে সভ্যতার এগােনাে আর মানবাধিকার লঙ্ঘন— একই সঙ্গে দুটিই ঘটছে- এরকম একটি প্রত্যয় আমাদের বােধিমূলে জড়িয়ে আছে, তাকে প্রশ্ন করা যাবে না।

একটু আগে আমরা প্রকৃতির অনিবার্যতার কথা বলছিলাম, তার বিরুদ্ধে মানুষের যে লড়াই-- এখানে মানুষ মানে মানবপ্রজাতি— সেই লড়াইয়ের মধ্য থেকে জন্ম নিয়েছে মানবিকতা। বলা ভালাে অর্জন করেছে এই গুণ। মানুষের নীচে থাকা কোনও প্রজাতি এই গুণ অর্জন করেছে বলে অন্তত আমি জানি না। প্রাকৃতিক নিয়ম’-এ বেঁচে থাকার অন্যতম বিধি একই প্রজাতির মধ্যকার লড়াই— মানবপ্রজাতি এই লড়াই থেকে এখনও রেহাই পায়নি প্রকৃত প্রস্তাবে, এই লড়াই-এর মধ্য থেকেই সে মানবিকতার জন্ম দিয়েছে; এই লড়াইটা জারি আছে বলেই তার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ যুদ্ধ ‘পশ্চিম এশিয়ায় যা হচ্ছে তা তাে এই যুদ্ধই, মনে রাখতে হবে জায়মান মানবিকতা ধ্বংস না-হলে যুদ্ধ হয় না। আর যুদ্ধ একবার শুরু হলে, সাধারণ মানুষ বলতে আমরা যা বুঝি, তাদের যতটুকু প্রাকৃতিক অধিকার— এই যেমন জল-আলাে-হাওয়ার অধিকার তা সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়, উদাহরণ হিসাবে আমাদের জাপানের কথা মনে পড়তে পারে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ভয়ঙ্কর, বীভৎস সব তথ্য-পরিসংখ্যান— আমরা এখানে সে-সব উল্লেখ করছি না। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, মনে রাখতে হবে এ-কারণে যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধই ছড়িয়ে থাকা মানবাধিকার’ ধারণাকে তালিকাবদ্ধ করেছিল ও রাষ্ট্রসংঘ মানবাধিকার সংস্কৃতি গড়ে তােলার যে উদ্যোগ নিয়েছিল এবং আজও যা জারি আছে, তার বিকাশ আশানুরূপ হয়নি। হয়নি বলেই আমরা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ’-এর আবহাওয়ার মধ্যে বাস করছি।

তােমাকে মনে করিয়ে দিই, যুদ্ধের ইতিহাস এই সত্য উন্মােচন করেছে মানবিকতার অবক্ষয় সবচে' বেশি ঘটে যুদ্ধের পরিসরে, আর নারীর প্রতি আক্রমণ ও তীব্র হয়-- নারীর প্রতি অত্যাচারের, একটা বিশেষণ যােগ করা উচিত, বীভৎস তাতেও সবটা বােঝানাে যায় না, অমানবিক বীভৎস অত্যাচারের ভয়ঙ্কর স্মৃতিফলক হয়ে ওঠা যে স্থানগুলাের নাম তুমি করেছ, সেগুলাে বিচ্ছিন্ন কোনও ক্ষেত্র নয়। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসরেই এগুলাে রয়েছে। খুব স্পষ্ট করে বলা যায় : ঘােষিত মানবাধিকার রক্ষার দায় যদি স্বাক্ষরকারী দেশগুলির চৈতন্যে থাকত, তা হলে “বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস’-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করতে হত না। তুমি নিশ্চয়ই জানাে, ১০ ডিসেম্বর

১৯৪৮ মানবাধিকার সনদ' ঘােষিত হয়। তার প্রস্তাবনায় এরকম একটা কথা ছিল, কোট আনকোট বলছি না, ভুল হওয়ার সম্ভাবনা আছে—মানবাধিকার সমূহের অসম্মান আর অবজ্ঞার ফলেই বর্বরােচিত কার্যকলাপ সংঘটিত হতে পেরেছে-- এই 'বর্বরােচিত কার্যকলাপ’ মানে যুদ্ধ... দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ মানুষের বিবেককে আহত করেছে, নিশ্চয়ই সমগ্র মানবপ্রজাতির বিবেককে আহত করেনি, করলে আজও যাঁরা সনদের প্রস্তাব কথামতাে এমন এক পৃথিবীর অভ্যুদয়ের আকাঙ্ক্ষা করেন যেখানে মানুষ উপভােগ করবে বাকস্বাধীনতা, বিশ্বাসের স্বাধীনতা, আর সেখানে ভয় থাকবে না, থাকবে না অভাব— এই স্বপ্ন প্রত্যয় লালন করা মানুষের বিরুদ্ধে বর্বরােচিত ঘটনা ঘটতে পারত না।

এছাড়া এই বিশ্বায়নের যুগে ওই রকম পৃথিবীর স্বপ্ন দেখার ওপর যেন এক অঘােষিত নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে

কেন বলছি এ-কথা— তুমি বােধহয় জানোনা মানবাধিকার’ চেতনায় মানবপ্রজাতিকে উন্নত করার লক্ষ্যে ইউনেসকো ১৯৯৫ থেকে ২০০৪– 'মানবাধিকার শিক্ষা’ দশক ঘােষণা করেছিল, উদ্দেশ্য ছিল 'পাঠক্রম' রচনা সম্বন্ধে উদ্যোগ গ্রহণ, বলাবাহুল্য বিভিন্ন রাষ্ট্রের তরফ থেকে তা নেওয়ার কথা ছিল।

তার ভিত্তিতে মানবাধিকার শিক্ষার জন্য বিশ্বকর্মসূচি গৃহীত হয় এই কর্মসূচির প্রথম পর্যায়, ২০০৫-২০০৯ পর্যন্ত, কার্যকর করার কথা ছিল প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে। দ্বিতীয় পর্যায়ে, ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মানবাধিকার শিক্ষায় শিক্ষিত করা হবে উচ্চশিক্ষায় রত শিক্ষার্থীদের ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আধিকারিক ও কর্মীবৃন্দকে। তৃতীয় পর্যায় চলমান, শেষ হবে ২০১৯-এ, শিক্ষিত করা হবে ‘মিডিয়া প্রফেশনালদের ও সাংবাদিকদের। একটু খোঁজ নিলেই তুমি জানতে পারবে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের কর্মসূচী কতটা ফলপ্রসূ হয়েছে। অথবা ২০০৫ সাল থেকে ২০১৪ পর্যন্ত মানবাধিকার খর্ব করা তথা লঙ্ঘন করার তথ্যানুসন্ধান করলেও ব্যাপারটা অনুমান করা সম্ভব। সার্বিক এই প্রেক্ষাপটে তুমি নতুন পরিভাষা খুঁজতেই পারাে, তাতে আমরা সমৃদ্ধ হব।

‘মানবিকতা' ধ্বংসের ব্যাপারে ‘শেষ কোথায়'— জানি না, শুরুর কথাটা তাে আগেই বলেছি। আর আমার বিশ্বাসটাও জানিয়ে রাখি : মানুষ হয়ে-ওঠার লড়াই-এ ব্যক্তি বারবার হেরেও, আর-একটু মানবিক হয়ে সে উঠবে, উঠবেই। লড়াইটা জরুরি! ভীষণ জরুরী।

অমিতঃ ইদানিং মানুষেরা কি একটু বেশি উন্মাদগামী, না এরকমই ছিল বরাবর? কেউ পরিবারের সবাইকে হত্যা করে নিজ লিঙ্গ কাটছে, কেউ বাইসেক্সুয়ালিটির নাে ম্যানস ল্যান্ডে পড়ে আত্মঘাতী হচ্ছে, এমনকী সমবেত আত্মহত্যার জন্য বেছে নিচ্ছে বহুতল বাড়ির খােলা ছাদ। হত্যার দৃশ্য, প্রকট যৌনতার দৃশ্য ইন্টারনেটে ছেড়ে তামাশা দেখছে। বাঁদর নামছে। বাঁদর দেখছে। মনে হচ্ছে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে উত্তর-আধুনিক বাঁদর। আর তার বাঁদরামি আজ ভাইরাল! হিটলারের ছায়া ক্রমশ বড় হচ্ছে।

সু: প্রা: বরাবর এরকম ছিল কি না বলা মুশকিল। প্রাচীন সাহিত্য যা একটু-আধটু পড়েছি, মনে করতে পারছি না সেখানে এই আত্মহত্যা প্রবণতার কথা ছিল কি না। আত্মহত্যা মূলত ডিপ্রেসিভ ইলনেস বা অবসাদ-এর পরিণাম— আধুনিক সাহিত্যে এর ভুরিভুরি উদাহরণ আছে। ‘সাহিত্য সমাজের দর্পন'— এই তত্ত্বের নিরিখে এটা বলা যায় যে, ডিপ্রেসিভ ইলনেশ সমাজবিচ্ছিন্ন ব্যক্তিমনের অসুখ। কিন্তু এর সঙ্গে 'বাইসেক্সুয়ালিটির ব্যাপারটা মেলানাে যাবে না। মানবপ্রজাতির নারী-পুরুষ ধারণা মূলত দৈহিক গঠনকেন্দ্রিক, এটা প্রচলিত, এর বাইরে মনােগঠনের নিরিখে একজন পুরুষদেহী বা একজন নারীদেহী যে যথাক্রমে নারী বা পুরুষ মনের বাহক হতে পারে -- হতে যে পারে, এটা অশিক্ষিত সমাজ জানে না, জানালেও মানে না, ফলত এরকম মানুষকে সমাজ ঠাই দিতে চায় না— ঠাই পাওয়ার জন্য কেউ কেউ লড়াই করেন, এ লড়াইটার একটা দিক-মন যেমন শরীরটাকে তেমনভাবে রূপান্তরিত করা—এ লড়াইয়ে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান তার পক্ষে, চিকিৎসক তার সহযােদ্ধা যারা এই সুযােগটা পান না তাদের কেউ কেউ আত্মহত্যা করেন- এমনটা অনুমান করা যায়। মনে রাখতে হবে আধুনিক সভ্যতায় ‘যৌনতা' এমন এক পণ্য ও পণ্য-রেসিপি” যা উপভােক্তাকে পণ্যমােহগ্রস্থ করার ক্ষেত্রে অদ্বিতীয় আর ‘হত্যা’ ‘সুপারি কিলার'-এর নিরিখে, বলা যায়, এক অসাধারণ পরিষেবা পণ্য’– অতএব, ইন্টারনেটে এই বিনােদন হত্যার দৃশ্যগুলাে দেখতে দেখতে, নিজের অজান্তেই মানবিক মূল্যবােধগুলির বিরুদ্ধে যুক্তি তৈরি করি, হয়তাে এটাই কোনও অপরাধীর ফাসি চাওয়ার ক্ষেত্রে একটা কারণ হয়ে আমাদের মধ্যে কাজ করে। কিংবা, কোনও সমস্যা যার রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব, তা ভুলে গিয়ে সামরিক সমাধান দাবি করি। আর সাম্প্রতিক সময়ে তাে এমনটাই ঘটছে- তুমি ঠিকই বলেছ, হিটলারের ছায়া ক্ৰমদীর্ঘ!

অমিত: আপনি নিজেকে লিটিল ম্যাগাজিনের লেখক হিসাবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। আজ চারিদিকে পেটমােটা লিটিল ম্যাগাজিন, যা করতে গিয়ে ধার-দেনা করতে হয়। দৈত্যকে মারতে গিয়ে এ-ও দৈত্য হয়ে গেল! বাকিরা পড়ে থাকল পেছনে। ভীষণ পেছনে। তাহলে লিটিল ম্যাগাজিন আন্দোলনটা আর থাকল কি?

সু: প্রা: আমি মূলত ছােটগল্প লেখক। গল্পতত্বে এটি স্বীকৃত বিষয় যে, এক-একটি ছােটগল্পে গল্পকারের ব্যক্তিত্বের এক-একটি দিক অভিব্যক্ত হয় নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়কে অনুসরণ করে কথাটি বললাম, তাে আমার ব্যক্তিত্ব’ এমনই যে, লিটিল ম্যাগাজিন ছাড়া অন্য কোনও ম্যাগাজিন তা ধারণ করতে পারেনি, এমনকি কোনও-কোনও লিটিল ম্যাগাজিন আমার গল্প প্রকাশ করতে আগ্রহ দেখায়নি। এর মধ্যে দিয়ে গল্পকার হিসাবে যে পরিচয় তা তাে লিটিল ম্যাগাজিনই দিয়েছে। বলা বাহুল্য, লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনই আমাকে নির্মাণ করেছে— করে চলেছে এই যে তুমি আমাকে দিয়ে কথা বলাচ্ছ- এর অর্থ— আন্দোলনটা কিন্তু রয়েছে!

অমিত: কেউ কেউ বলেন, লিটিল ম্যাগাজিন সাহিত্য সৃষ্টির প্রকৃত রান্নাঘর। আবার কেউ কেউ বলে থাকেন, অনেকক্ষণ ওঁতােণ্ডতি করার পর বৈঠকখানায় জায়গা না পেয়ে রান্নাঘরকে অনেকে সাহিত্যচর্চার প্রকৃত স্থান বলে মনে করেন। আবার কেউ কেউ আরাে এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেন, কবি-সাহিত্যকরা সর্বদা হা করে থাকে কখন প্রতিষ্ঠান একটু ‘মুতে' দেবে! এই বিষয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া জানতে ইচ্ছে করে।

সু: প্রা: যারা এসব কথা বলেন, আমার মনে হয়, সাহিত্যতত্ত্ব সম্বন্ধে তাদের কোনও ধারণা না থাকার জন্যই বলতে পারেন। আর প্রতিষ্ঠান, সে যত ছােটই হােক না কেন, তার সঙ্গে লেখক কবিদের সম্পর্কের যে কথা তুমি বললে, এর প্রতিক্রিয়া জানানাের মতাে অভিজ্ঞতা আমার নেই। বলতে পারাে এটা আমার ওই ব্যক্তিত্ব’-র দোষ!

অমিত: একজন লেখক এক তরুণ লেখককে বলছেন, পত্রিকার (লিটল কিংবা ব্যবসায়িক) চরিত্র জেনেই লেখা পাঠাবে, তাহলে তারা ছাপবে, আমিও তাই করতাম। এখানে সৃষ্টি বা সততা কতটা থাকল? না, এটাই রেওয়াজ? আর লেখকের ‘পদবী' কি খুব গুরুত্বপূর্ণ?

সু: প্রা: এতক্ষণ আমরা যে-সব কথা বলেছি তার মধ্যে 'সমাজ’ শব্দটা দু-একবার এসেছে, কিন্তু। কোনও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের দাবি নিয়ে আসেনি। এমনকি আমাদের মনেও হয়নি সমাজ শ্রেণিবর্ণে বিভক্ত। ‘পদবী'-সূত্রে কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হচ্ছে সমাজ বর্ণবিভক্ত। এবং শ্রেণিবিভক্ত সমাজে সাহিত্যেরও শ্রেণিচরিত্র থাকবে, এটাই স্বাভাবিক; পত্রিকার চরিত্র মানেই পত্রিকার সম্পাদক প্রকাশকের শ্রেণিচরিত্র বা যদি গােষ্ঠি থেকে থাকে তা হলে গােষ্ঠির চরিত্র, পত্রিকার প্রকাশ জ্ঞাতে অজ্ঞাতে শ্রেণিস্বার্থ রক্ষার জন্য। অতএব, যে লেখা আমার শ্রেণি স্বার্থ রক্ষার পক্ষে কাজ করতে পারে এমন লেখাই “আমরা” ছাপব। শ্রেণিচরিত্রকে আড়াল করে একজন লেখক অন্য শ্রেণির জন্য লিখতে পারেন বলে আমার মনে হয় না। কেননা, ব্যক্তিত্ব তাে আর শ্রেণি নিরপেক্ষ বিষয় নয় !

বর্ণবিভক্ত সমাজে একজন লেখকের ‘পদবী’ অবশ্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

অমিতঃ একজন একটা লেখা পড়ে বলছেন অসাধারণ, আর একজন ফুৎকারে উড়িয়ে দিচ্ছেন, এখন সেই লেখাটির প্রকৃত অবস্থান কী হবে?

সু: প্রা: একটি লেখাকে 'অসাধারণ' বলা বা ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া দুটি ঘটনাই পাঠক ব্যক্তিত্বের প্রকাশ বলাবাহুল্য পাঠকের শ্রেণি অবস্থানই তার ব্যক্তিত্বের নিয়ন্ত্রক। যে শ্রেণির প্রতি লেখক-ব্যক্তিত্বের দরদ প্রকাশ পেয়েছে, সেই শ্রেণি পরিসরেই গল্পটি টিকে থাকবে।

কিন্তু আরও একটি কথা বলার আছে, একজন লেখক, তিনি যত মানবিক মূল্যবােধে ঋদ্ধ হবেন, তার ব্যক্তিত্ব ততই শ্রেণি-বর্ণচিহ্ন বর্জন করে অনেক বেশি মানবিক সৌন্দর্য বিকিরণ করবে।

অমিতঃ আপনি লিটিল ম্যাগাজিনের একজন সফল গদ্যকার। প্রচুর পড়েন। ঠিক কোন অনুপ্রেরণা আপনাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয় ?

সু: প্রা: 'সফল'-এ ব্যাপারে কিছু বলার নেই। আর আমার পড়াশুনাের ব্যাপারে তােমার এই মন্তব্যটা একেবারেই ঠিক নয়। তবে, এই যে 'অনুপ্রেরণার কথা বললে, পড়তে পড়তে কোনও জাগ্রত জিজ্ঞাসার তাগিদে আমাকে লিখতে হয়েছে। যেমন, তােমাকে বলি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পােস্টমাস্টার’ গল্পটা পড়েছ তাে রতন-এর জন্য কেমন একটা মন খারাপ হয়, না? বােট থেকে নদীর কিনারে দাঁড়িয়ে থাকা রতনকে আমি দেখতে পাই, কোনও তত্ত্বকথা মনে পড়ে না, কেবল রতনের চোখদুটো মনে পড়ে, 'ক্লোজআপ’-এ দেখতে পাই, রবীন্দ্রনাথকে বড় নিষ্ঠুর মনে হয় --কবে একদিন এই প্রশ্ন জেগেছিল : সম্পর্ক যেখানে প্রয়ােজনভিত্তিক– তুমি কী করতে? বােধহয় এই প্রশ্নেরই উত্তর লিখেছিলাম ‘জ্যোৎস্নায় হাঁটা’ গল্পে। এছাড়া বাংলা সাহিত্যে দুটি স্মরণীয় গল্প ‘টোপ’ আর ‘রস'— এই নামেই আমার দুটো গল্প আছে এই সূত্রে, এখনই মনে হল, ‘প্রাগমেটিক রিলেশনশিপ’-এর বিপরীতে সম্পর্ক তৈরির পরিসর নির্মাণ-আকাঙ্ক্ষাই আমার ক্ষেত্রে প্রেরণা বলতে পারাে। অমিতঃ আপনার ‘সােনালি ডানার চিল’ পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত একটি উপন্যাস। এই উপন্যাসটা কেন লিখলেন, যেখানে অনেকে বলে থাকেন ভূমেন্দ্র গুহ পড়লেই হয়ে যেত?

সুঃ প্রাঃ এই বিবৃতিতে একটু ভুল আছে। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি আমাকে যে পুরস্কার দিয়েছে তা ‘সােনালি ডানার চিল’-এর জন্য নয়, আমার সামগ্রিক সাহিত্যকৃতির জন্য। তবে, সাইটেশনে ‘সােনালি ডানার চিল’ থেকে উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয়েছিল।

এখন প্রশ্ন : এই উপন্যাসটা কেন লিখলাম? তুমিই প্রথম যে এই প্রশ্নটা করলে তােমাকে ধন্যবাদ! কেন লিখলাম- আমাদের আলােচনার প্রথম দিকে, সমাজ বিচ্ছিন্ন মানুষের ডিপ্রেসিভ ইলনেস-এর কথা এসেছিল— সমাজ থেকে তাে মানুষ, মানে ব্যক্তি এমনি-এমনি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় না, একটা প্রক্রিয়া থাকে, সমাজের দিক থেকে, মানে যাদের সঙ্গে ব্যক্তির মেলামেশা, আর একটা দিক হল ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব— একপক্ষ ব্যক্তিকে ‘সংঘচ্যুত করার প্রক্রিয়া চালায়, মূলত তার উপকরণ উপেক্ষা, তুমি আমাদের কেউ না বানিয়ে তােলা— ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব এক্ষেত্রে ব্যক্তিকে ‘সংঘ’ থেকে সরিয়ে নেয়— এটা ঘটেছিল আমার ক্ষেত্রে; তখন নিজেকে অসফল মনে হত, আত্মবিশ্বাস বলতে যা বােঝায় তা যেন একেবারেই তলানিতে, তখন, আমার প্রতিটি মনােভাবের প্রকাশ জীবনানন্দের কবিতায় আবিষ্কার করতাম— আর একটু একটু করে অসফলতার অন্য মানে আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে— যে মানুষ প্রকৃতির অংশ হিসাবে নিজেকে দেখতে শিখেছে তার প্রেমিক না-হয়ে উপায় নেই, তাকে বিপ্লবী হতেই হবে—আর এ-দুটি ক্ষেত্রে সফলতা সে ‘সুচেতনা'র মতাে সুচেতনা, তুমি এক দূরতর দ্বীপ’– প্রেম মানে আরাে আলাে— মানুষের তরে এক মানুষীর গভীর হৃদয়– জীবনানন্দীয় এই সব অনুভব আমার মাথায় হাত রাখে— এই সময়ে কফিহাউসে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা ভাঙাচোরা এক মানুষের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল, ব্যর্থ মানুষ।

তখন আমার মনে হয়েছিল এই দুজন আপাত অসফল মানুষের যে কোনও একজনের মধ্যে ঢুকে পড়তে পারলে আমি পরিত্রাণ পাব। কিন্তু কার মধ্যে একজন প্রায় আমার জন্মকালে প্রয়াত হয়েছেন আর একজন জীবিত, মুখােমুখি কথা বলার সম্পর্ক তৈরি করা সম্ভব সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য, তখন বছর খানেক আলাপ হয়েছে, আলাপ করিয়েছেন আমার কবিবন্ধু সহকর্মী অরিজিৎ সিংহ— তুলনামূলক সাহিত্যের ছাত্রী, অরিজিতের সহকর্মী, জোনাকি ঘােষ রায়-এর সঙ্গে আমি তাকে ব্যাপারটি বলি। আমি আজও স্পষ্ট মনে করতে পারছি, কয়েক মুহূর্ত তার চেয়ে থাকা... তিনি বললেন, জীবনানন্দ। জানালেন তার কাছে জীবনানন্দ সমগ্র আছে, জীবনানদের জীবনে ঢুকে পড়াটা খুব সহজ-সাবলীল করে দিলেন তিনি— রিপুদাসত্বের বিরুদ্ধে মানবিকতার যে লড়াইয়ের কথা বলেছি, জীবনানন্দের সাহিত্যকৃতি এক অনন্য অভিজ্ঞতা দিয়েছে আমাকে, আমি আমার বিশ্বাসে স্থিত হয়েছি পুনরায় ।

এই উপন্যাস লেখার এটা ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ। সামাজিক প্রেক্ষাপটে, জীবনানন্দকে আমার মনে হয়েছে এই বণিকসভ্যতাভিত্তিক আধুনিক সময়ের বিরুদ্ধে তিনি এক 'শান্ত বিপ্লবী'— আধুনিক সভ্যতা তীব্র আলাের আয়ােজনে যে অন্ধকার সৃষ্টি করেছে, জীবনানন্দের বয়ানে যা ‘অদ্ভুত আঁধার'— তার স্বরূপ উন্মােচনে জীবনানন্দ পথিকৃৎ, যারা অন্ধকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা। করেছেন, যুদ্ধ জারি রেখেছেন, আগামী দিনে যারা সৈনিক হবে- মানবিক সেনা, তাদের সামনে জীবনানন্দের ব্যক্তিগত লড়াই যেমন প্রেরণার বিষয়, তেমনই তার সংঘবাসনার অভিজ্ঞতা থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি তার জীবন আলেখ্য আমাদের অপ্রেমের থেকে প্রেমে গ্লানি থেকে আলােকের মহাজিজ্ঞাসায় নিয়ে যেতে পারে- এরকম সব সম্ভাবনার কথা মনে রেখে জীবনানন্দের ব্যক্তিত্বকে তার সময়কাল সমেত উপন্যস্ত করতে চেয়েছি।

এক-একজন পাঠক এক-এক রকম উদ্দেশ্য নিয়ে জীবনানন্দকে জানতে চাইবেন, ‘ভূমেন্দ্র গুহ পড়লেই’ কারও জীবনানন্দ জিজ্ঞাসার নিরসন হতে পারে, তিনি নিশ্চয়ই ‘সােনার ডানার চিল' পড়বেন না। অথবা পড়তেও পারেন।

অমিতঃ আচ্ছা, ছােটগল্প আপনার কাছে ঠিক কী? গল্প, নি-গল্প, অ্যান্টিগল্প ইত্যাদি নিয়ে আপনার কিছু মতামত জানতে ইচ্ছে করে।

সু: প্রা: ছােটগল্প এক প্রকার ভাষাশিল্প। শিল্প বলতে আমি বুঝি, মানবিক সচেতনতার রূপ, ইংরেজিতে বললে ব্যাপারটা দাঁড়াবে এরকম— Art is a form of humane consciousness, তুমি জানাে, ছােটগল্পের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া সংজ্ঞায় বলা হয়েছে ছােটগল্প usually presenting the crisis of single problem- কীসের সমস্যা বা কার সমস্যা ব্যক্তির সমস্যা— মানে ব্যক্তির সম্পর্কের সমস্যা যে সমস্যা মেটানাে যায়নি বলেই তা সংকট তৈরি করেছে; অর্থাৎ ছােটগল্প কোনও একটি সমস্যাসঞ্জাত সংকটকে কেবলমাত্র তুলে ধরে। সংকটমুক্তির কোনও দায় ছােটগল্পের নেই, মানে হল ছােটগল্পকারের ব্যক্তিত্ব এই দায় নিতে চায় না। আমি অবশ্য ব্যাপারটা অন্যভাবে দেখি, মানে আমার ব্যক্তিত্ব দেখে। আমার ব্যক্তিত্ব মনে করে, যে ঘটনার মাধ্যমে সমস্যাটা প্রকাশ পেল তা না-ঘটে আর কী-কী ঘটতে পারত যা খুব সহজেই সমাধান করা যেত- এমন এক সম্ভাব্য ঘটনার বিবরণকেই আমি গল্প বলে মনে করি, গল্প হল যদি এমন হত বা হয়-এর ন্যারেশান।

এ সূত্রে নি-গল্প মানে কি নেই গল্প? তা যদি হয়, এটা একটা ভেবে-চিন্তে না বলা একটা কথা— মানে কোনও গদ্য রচনাকে এই অভিধা দেওয়া— আমি গল্প লিখব কিন্তু তাতে গল্প থাকবে না তা কখনও হয় বলে আমার মনে হয় না। আর অ্যান্টিগল্প- সে তাে মারাত্মক ব্যাপার গল্পের বিরােধী মানে তাে এই যে তা রূঢ় বাস্তব, সেখানে তাে স্বপ্ন-কল্পনা এসবের কোনও অস্তিত্বই থাকবে না! আর যাই হােক, তাকে ‘গল্প' বলা যাবে না।

অমিতঃ আপনি একজন বামপন্থী। সমগ্র পৃথিবীতে আজ বামপন্থা বিপন্ন। তাহলে কি বামপন্থার দিন শেষ? বামপন্থী সাহিত্যটা ঠিক কী?

সু: প্রা: মানবাধিকার-চর্চা করতে এসে বুঝেছি মানবাধিকার'-এর ধারণা শিক্ষিত-মান্যগণ্য প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের মধ্যেও কত কম! একই রকম অবস্থা মার্কসবাদ ও বামপন্থা বিষয়ে। বামপন্থা সম্বন্ধে নিশ্চয়ই তােমার কোনও ধারণা আছে যার সঙ্গে আমার আচার-আচরণ কথাবার্তার মিল খুঁজে পেয়েছ অথবা আমিই হয়তাে কোথাও ঘােষণা করেছি— 'আমি বামপন্থী। একটি গল্পে, নাম মনে পড়ছে না, আমার এক চরিত্রকে সে যে কমিউনিস্ট নয় এটা প্রতিষ্ঠা দিতে চেয়েছিল তারই একসময়ের বন্ধুরা আর সে তীব্র বিরােধিতার অবস্থান নিয়ে ঘােষণা করেছিল, ‘আমি কমিউনিস্ট'। জানি না, এ গল্পও তুমি পড়ে থাকতে পারাে তার থেকে আমার সম্বন্ধে তােমার এ প্রত্যয় জাগতেই পারে। আমি আপত্তি জানাচ্ছি না।

কিন্তু 'সমগ্র পৃথিবীতে আজ বামপন্থা বিপন্ন’– এই কথাটা নিয়ে একটু আলােচনা দরকার তুমি বােধহয় মার্কসবাদ ও বামপন্থাকে অভিন্ন ভেবেছ। তা-কিন্তু নয়। কোট-আনকোট বামপন্থার আগেও বামপন্থা ছিল— ‘প্রাকৃতিক অনিবার্যতার বিরুদ্ধে আমরা যে লড়াইয়ের কথা বলেছি, তার ধারাবাহিক পরিণাম, তুমি জানাে প্রকৃতির ওপর প্রভুত্ব কায়েম করেছে মানব প্রজাতির একটা অংশ, আর একটা অংশ, বলা যায় কমবেশি ৮০% সদস্য প্রাকৃতিক থেকে গেছে অর্থাৎ এই প্রাকৃতিক মানুষকে বননিধনের মতাে কীভাবে নিধন করেছে তার প্রভু’রা তা ইউরােপ আমেরিকার আধুনিক ইতিহাসের পাঠকমাত্রেই জানেন, এমনকি পরাধীন ভারতবর্ষের ইতিহাসেও তার উদাহরণ মর্মান্তিক সাঁওতাল বিদ্রোহ, বিরসা মুন্ডার বিদ্রোহ নিশ্চয়ই আমাদের মনে পড়বে।

এই যে অধিকার হারানাে মানুষ তাদের দুর্বিসহ বেঁচে থাকার প্রেক্ষাপটকে যারা সহনীয় করে তােলার জন্য, উদ্যোগ নিয়েছিলেন, আমার অনুমান করতে ভালাে লাগে যে, তখন একটা পথ তৈরি হয়েছিল, ফরাসি বিপ্লবের পর সেই পথটারই নাম হয়েছিল বামপন্থা সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারের জন্য, তাদের স্বার্থরক্ষার জন্য যারা আন্দোলন করেন সংহতি জানান সমর্থন করেন তারাই বামপন্থী। ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলন'-এর কথা মনে আছে তােমার? সম্পদ বিষয়ে সেখানে কী-একটা হিসেব ছিল, মনে পড়ছে না, তবে আমি যে ৮০% মানুষের কথা বলেছি তার চেয়ে বেশি মানুষ ওই সম্পদ-হারানাে মানুষ— এই মানুষেরা আজ নিজেরাই আন্দোলন করছেন, করবেন— বামপন্থার বিপন্ন হওয়ার কোনও কারণ ঘটেনি, বরং সম্পন্ন হয়ে উঠছে।

'সমগ্র পৃথিবীতে আজ বামপন্থা বিপন্ন'—একথাটা তুমি বােধ হয় কোট-আনকোট মার্কসবাদী বামপন্থার কথা বলতে চেয়েছ, সমাজতন্ত্রের পতন, বামফ্রন্টের পতন ইত্যাদির কথা মনে রেখে! তা যদি হয়, তুমি ঠিকই বলেছ মার্কসের নাম করে মানে তাকে ‘সাইনবাের্ড’ করে বামপন্থার দিন শেষ।

এবার বামপন্থা সাহিত্য— এটা কী— আমাদের আলােচনার মধ্যে কিন্তু এর উত্তর রয়েছে— একটা গল্পের কথা বলি, হয়তাে স্কুলে তােমারও পাঠ্য ছিল, গুড সামারিটান- বাইবেলের গল্প, এটা বামপন্থী সাহিত্য; একটা জাতকের গল্প মনে পড়ছে, এটাও আমাদের সময় পাঠ্য ছিল, গল্পটার নাম ছিল 'বুড়ির কৌটা'- সেরিবা-সেরিবানের গল্প— এ গল্পও আমার বিচারে বামপন্থী গল্প- এসব গল্পে 'মানবিকতা’ আলাে ছড়িয়েছে, বলাই বাহুল্য- উত্তরটা নিশ্চয় তুমি খুঁজে পাবে।

অমিতঃ লিখতে আসতে গেলে কি পড়াশুনাে করে আসতেই হবে? আপনি কাদের পড়েছিলেন? একজন তরুণকে কী পড়তে বলবেন?

সু: প্রা: না। ছাত্র-অবস্থায় ফাল্গুনী মুখােপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র— সবারই দু-একটা লেখা পড়েছি— রবীন্দ্রনাথ পড়েছি অনেক পরে, আরও পরে জ্যাক লন্ডন, লুসুন, চেকভ, গাের্কি খুব যে নিয়ম করে ধারাবাহিক পড়া হয়েছে তা নয়— পড়াশুনাে আমার খুব কম— প্রসঙ্গ উঠলে আমি খুব সঙ্কোচবােধ করি।

এখন মাঝেমধ্যে মনে হয় আমার ছােটবেলায় যদি জাতকের গল্প পড়ার বা শােনার সুযােগ পেতাম, যদি কেউ বলতেন উপনিষদ পড়, মহাভারত পড়– বুঝলে অমিত, মহাভারতকে আমার মহাউপন্যাস বলে মনে হয়, আমার এখনও ওই ঔপন্যাসিক সমাজবাস্তবের মধ্যেই আছি- লিখছেন যে তরুণ, তার উদ্দেশে ওই বইগুলির কথাই বলব, তার সঙ্গে তােমাকেও বলছি, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র’ পড়বে, অ্যারিস্টটলের ‘রাজনীতি – একজন লেখক তাে সম্পর্ক লেখেন, সম্পর্কের আধার পরিবার পরিবার সমাজ সংলগ্ন অথচ সমাজের মূর্ত কোনও কাঠামাে নেই- তােমার মনে হয়তাে প্রশ্ন জাগছে- সাহিত্য তাে সমাজবিজ্ঞান নয়- ঠিক, কিন্তু সাহিত্য, বিশেষ করে মানবিক অবক্ষয় ঘটার এই যুগে, সমাজ বিজ্ঞানের অবলােকনগুলি ধারণ করতে চাইছে— কেননা, সম্পর্ক এখন কেনা-বেচার বিষয়— পণ্যের নিয়মে সম্পর্ক তৈরি হয়— আমার অনুমান সামগ্রিক হিতার্থে সাহিত্য একদিন সমাজবিজ্ঞানের অংশ হয়ে উঠবে।

অমিতঃ “এরকমই শিয়ালদা স্টেশনে একজনকে পার্থ ভেবে ভুল করেছি। আশ্চর্য ম্যাজিক যেন- এই ছিল। এই নেই! সবটাই কি আমার কারসাজি ? পেছন থেকে যে মানুষটা চেনা। মানুষ বলে মনে হল কোন জাদু বলে সে হয়ে যাচ্ছে অচেনা— এরকম একটা ভাবনা ছিল, সেটাতেও নতুন এক মাত্রা যােগ হল আজ।

আজ আমি মনীষাকে দেখলাম। সামনে থেকে। যত দূরত্ব কমেছে দুজনের মধ্যে ততই মনীষা না-মনীষা হয়ে গেছে।” [শুদ্ধিকরণ]।

নিখিলেশ, পার্থ কিংবা মনীষাদের কথকের জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়াটা কেবলই কি রাজনৈতিক পট-বদলের জন্য, না এ-এক শাশ্বত পথ, যে-পথ দিয়ে অবশেষে সকল প্রিয়জনেরা হারিয়ে যায়, চেনামুখ হয়ে ওঠে ভীষণরকম অচেনা? তারা কি পেছন থেকে কিংবা দূর থেকেই কেবল চেনা থাকবে চিরকাল, আর কাছে আসলে প্রকৃত সারস’ উড়ে যাবে এভাবেই ?

সু: প্রা: রাজনৈতিক পট-বদল বলতে তুমি বােধ হয় সরকার-পরিবর্তনের কথা বলতে চাইছ, আমি অবশ্য এরকম ভেবে গল্পটা লিখিনি। বরং নিখিলেশ-পার্থ-মনীষারা যে সরকারি দলের সঙ্গে থাকা মানুষ— এটা শিল্পসম্মতভাবে বলার চেষ্টা করেছি।

যাই হােক— বিষয়টা হল হারিয়ে যাওয়া তুমি যে শাশ্বত পথ'-এর কথা বলছ, তা যদি মৃত্যু হয়, আমার অন্তত মৃত্যুই মনে হচ্ছে, এক্ষেত্রে নিখিলেশ-পাখ-মনীষাদের কথকের জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া, এক অর্থে মৃত্যুই, কিন্তু এ মৃত্যু স্বাভাবিক নয়, আত্মহত্যা আদর্শকে হত্যা করেছে এরা।

কথকের রাজনৈতিক মানুষ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে এদের ভূমিকা ছিল এদের এই বদলে যাওয়া আসলে আদর্শকে খুন করা অবিশ্বাস্য, ইনক্রেডবল অর্থে, খুন হতে দেখে, তখনও আদর্শ আঁকড়ে থাকা কথকের চৈতন্যে তাদের যে ইমেজ তৈরি হয়েছিল তা ‘ফেড আউট' হয়ে যাওয়ার পর্যায়ে চলে যাওয়ায় ওই বিভ্রম।

আর চেনা মুখের ভীষণ অচেনা হয়ে ওঠার ব্যাপারটা একটু কাব্য করে বলা যাক: অন্তরের যে আলাে ছড়িয়ে আমরা পরস্পরের মুখ দেখেছিলাম, চিনেছিলাম চোখের তারা, দূরনক্ষত্রের দুতি, আমাদের কণ্ঠস্বরে জেগেছিল ইমন, আমরা পরস্পরকে নির্মাণ করেছি তবু! অচেনা? আমি ভেবে দেখেছি কোনও এক পক্ষের আলােয় কালিমা ছড়িয়ে পড়েছে বা অন্ধকার, যা পরিচিত প্রােফাইলকে খাসবাংলায় ঘেঁটে দিয়েছে অথবা তুমি ভাবতে পারাে নির্মাণটাই ছিল বিভ্রমবশত ভেঙে পড়েছে। আমার মনে হয় এসবের জন্য, চেনাটাকে ঠিক চেনা হয়ে ওঠে না বলেই এই ভীষণ অচেনা মনে হওয়া | আর যদি 'বিজ্ঞান'কে মনে রেখে বলি, তা হলে এটা স্বাভাবিক; সংযােগে যা উৎপন্ন অবশ্যই তার ক্ষয় হবে— এ সত্য আমাদের প্রথম জানিয়েছিলেন বুদ্ধদেব এবং যার ক্ষয় অনিবার্য, তার অবক্ষয় ঘটানাে সম্ভব।

তুমি আমাকে উসকে দিয়েছ, আর একটু বলতে দিতে হবে মনুষ্যসমাজে সমস্ত সম্পর্কই কিন্তু সংযােগ-উৎপন্ন, প্রতিটি সম্পর্কের সঙ্গে আর-একটি সম্পর্কের সংযােগ রয়েছে- সম্পর্কের

চালিকাশক্তি— এটাও মনে রাখতে হবে বেঁচে থাকার নিরিখে অর্থনৈতিক কার্যকলাপ যা। রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে আমরা যে অবক্ষয়ের কথা বলছিলাম সম্পর্কের অবক্ষয় ঘটানাে। হয় অর্থনীতির পরিসর থেকে এ-কথাগুলাে বললাম এ-কারণে যে, যে গল্প-অনুষঙ্গে এর কথা— সেই গল্পে যে স্বপ্নকথা বলা হয়েছে তা বৌদ্ধসংঘ-অণুকরণে ও গল্পের কথক-চরিত্রটি মর্যাদাপূর্ণ অর্থনৈতিক কাজকর্মে যুক্ত না-হতে পারা এমন একজন মানুষ যে আদর্শকে আঁকড়ে আছে পরম মমতায়। সে সম্মিলন চায়, কিন্তু কার সাথে, কেবল মনে পড়ে স্মৃতি স্মৃতির। মানুষেরা কেউ-ই আর সত্তায় নেই। একটা বিভ্রম আছে।

তাই, নিখিলেশ-পাৰ্থ-মনীষারা কেউই প্রকৃত সারস'-এর উপমা হতে পারে না।

অমিতঃ “বিয়ে ব্যাপারটা তাে একটা মার্কেটিংয়ের মতাে কিছু। ওপেন মার্কেট আমরা যে কেউ যে কাউকে কিনতে পারি। কিংবা বেচতে পারি।' ইঙ্গিত স্পষ্ট। তবু পৃথা বলেছিল।

ব্যাপারটা কি অতই সহজ?'— বাজারটা বুঝলে সত্যিই সহজ।" [সুবাসকথা)।

দাদা, মাধবের এই ব্যাখ্যা আজকের পরিপ্রেক্ষিতে কতটা বাস্তব? আর এর মুক্তি কি 'বিবাহ' নামক সম্পর্কের বিনির্মান' তত্ত্বেই, যেমনটি মাধব ও পৃথা মনে করে ? যদি 'বিনির্মান বলে মেনে নিই, তাহলে সেটাও কি এক বাজার-কে প্রতিষ্ঠা করে না?

সুঃ প্রাঃ ব্যাখ্যাটি কিন্তু মাধবের নয়। পৃথার এক সহকর্মীর। সে বণিকসভ্যতার মানুষ। যৌনতাকে

সে কেনা-বেচার বিষয় রূপেই দেখে।

যৌনতার বাজার খুব ছড়িয়ে পড়েছে। টায়ারের বিজ্ঞাপনে বুক দেখানাে যুবতী। খবরের কাগজে, টিভিতে ‘জাপানি তেলের বিজ্ঞাপন, ‘বােল্ড রিলেশন'-এর বিজ্ঞাপন- এসব নিশ্চয়ই বাজারের তেজী ভাবকে প্রকাশ করছে ন্যাপকিন, গর্ভনিরােধক, এমনকি সুগন্ধের বিজ্ঞাপন এসব তাে যৌনােদ্দীপক হয়ে আমাদের হাইপােথ্যালামাসকে স্টিমুলেট করে!

করে, কেননা বাইনেচার আমরা নাকি পলিগ্যামী। এটা একটা বদযুক্তি। বহুগামিতাকে নিয়ন্ত্রণ করে, বলতে পারাে দমন করে বা দমিত করার ফলে মানুষ একনিষ্ঠ হয়েছে। সমাজ-অর্থনীতির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এই একনিষ্ঠতার সংস্কৃতির উৎকর্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে গড়ে উঠছে যৌনসুখ উৎপাদনের যন্ত্র হিসাবে দেহকে ভাড়া দেওয়া, ভাড়া নেওয়ার সংস্কৃতি-পরিবার আছে আবার ব্রথেলও আছে— কে একজন বলেছিলেন না বিবাহ ব্যাপারটা আইনি বেশ্যাবৃত্তি খেয়াল করাে "বৃত্তি’—মানে বেঁচে থাকার জন্য মুদ্রা’ উপার্জনের উপায় যৌনতা— এক্ষেত্রে আর প্রাকৃতিক নয়- এর বাইরে মানে বাজারের বাইরে লিভিং টুগেদার বিবাহের বিরুদ্ধে এক রকমের বিদ্রোহ পৃথা-মাধবের বিবাহ-বিনির্মাণের যে ইচ্ছা তার অন্তঃসারে রয়েছে যৌন-স্বাধীনতায় বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা এর অর্থ বাজার থেকে যৌনতার মুক্তি। তাই না! এই মুক্ত যৌনতাই তাে আর কেনা-বেচার বিষয় হয়ে থাকছে না, সেক্ষত্রে বাজার প্রতিষ্ঠা করার প্রশ্নই নেই।

অমিতঃ “থমকে রাজীব পিছন ফিরে বিনতার চলে যাওয়া দেখছিল। কে জানে বিনতাও হয়তাে ফিরে দেখবে আর তাতেই সম্পর্কটার এখনও যে প্রাণ আছে- এই বার্তা ছড়িয়ে পড়বে। এমনও হতে পারে বিনতা হাত তুলে নিজেকে জাহির করবে। হয়তাে রাজীবই প্রথম হাত তুলে বিনতার দিকে এগিয়ে যাবে, এমনও হতে পারে একই সঙ্গে দু'জনেরই হাত উঠল— পরস্পরের দিকে এগিয়ে যাওয়া... রাজীব ভাবছিল, দেখল, বাক পর্যন্ত রাস্তা শুনশান। রাজীব হাঁটছে...” [স্বপ্নভূমি) । শুরুটা এমনই চমৎকার। শেষটাও; 'ডাউন ট্রেন এসে দাঁড়িয়েছে। দু'জনে দাঁড়িয়ে যেন কেউ একজন সি-অফ করতে এসেছে, ঠিক বােঝা যাচ্ছে না কে যাবে— জানলার ধারে বসা দু একজন যাত্রীর চোখ দেখে এমনই মনে হল রাজীবের। ট্রেন ছাড়ার হুইসল দিল। সেই জলসার রাতের মতাে এই ভর দুপুরে রাজীব বিনতার হাত ধরল। জানলার মুখগুলাে কে জানে কী গল্প তৈরি করছে!" অসম্ভব স্মার্টনেস আপনার গদ্যে। একজন গদ্যচর্চাকারী হিসাবে বলতে দ্বিধা নেই যে, এরকম স্মার্টনেস খুব কম সমসাময়িক গদ্যশিল্পীর মধ্যে দেখেছি। কেন মনে হল গল্পের পাশাপাশি গদ্যকেও এতটা স্মার্ট করার প্রয়ােজন, যেখানে একজন প্রখ্যাত গদ্যশিল্পীকে দেখেছি গদ্যের পেছনে সময় দিতে গিয়ে তার আখ্যানে টান পড়েছে? গদ্য নির্মাণে আপনার অনুপ্রেরণা। কারা?

সু: প্রা: এমন নিবিড় পাঠের জন্য ধন্যবাদ! একই সঙ্গে তােমাকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনও করছি! যে অসম্ভব স্মার্টনেস' তুমি আবিষ্কার করেছ, তা কীভাবে সম্ভব হয়েছে, বলতে পারব না ভেবে দেখলাম। বানিয়ে বানিয়েও বলা সম্ভব নয়।

কিন্তু বলতে হবে।

দুটো ঘটনা বলি-- একবার ‘প্রমা' পত্রিকায় একটা গল্প জমা দিয়েছিলাম। কয়েক মাস পর খোঁজ নিতে গিয়ে জানলাম যে, আমার এক অগ্রজ গল্পকার প্রমা’র গল্প দেখেন, তার সঙ্গে কথা বলতে হবে। অসুবিধে নেই— কফি হাউসে একই টেবিলে বসি। তাকে বললাম। একদিন তিনি জানালেন, আমার হাতে নাকি দারুণ ক্রাফটম্যানশিপ রয়েছে, কিন্তু গল্পটা অমনােনীত হয়েছে আমাকে আর একটা লেখা দিতে বললেন। আমার মাথায় তখন ক্রাফটম্যানশিপ’ কথাটা বিধে গেছে, শব্দটা অচেনা, ক্রাফটম্যান জানি, শব্দটার মানে আন্দাজকরে নিলাম, আমার হাতে আছে মানে গল্পেও থাকার কথা, কিন্তু গল্পটা...

অনেক পরে লিখতে লিখতেই বুঝেছি গল্প ছাড়া ক্রাম্যানশিপ হয় না। দ্বিতীয় ঘটনা— আমি তখন সিদ্ধান্ত নিয়েছি জীবনানন্দ দাশের জীবন-অবলম্বনে উপন্যাস লিখব। বই-পত্র সংগ্রহের জন্য দু-একজনকে বলছি। সৌম্যদীপ-- ছেলেটির সঙ্গে বছর দুই হবে, ঠিক মনে নেই, আলাপ হয়েছে, জীবনানন্দকে 'জীবু' নামে ডাকে, তাকে বলতেই সে বলল, ভাষা তৈরি করতে পারবেন?

সে আমার অনুজপ্রতিম, কিন্তু অসম্ভব পড়াশুনাে, তার কথায় আমি ধাক্কা খেলাম— “ভাষা তৈরি'— ভাষা তৈরির ব্যাপারটা আমার অজানা- সে পরক্ষণেই যেন এক স্বপ্নঘােরে বলেছিল, আঁধার নৈঃশব্দ্যের ওপর ঝরে পড়ছে সুপারি ফুল...।

আমি “ভাষা শিখলাম। আমার অগ্রজ গল্পকার, অনুজপ্রতিম বন্ধু- এরা আমার শিক্ষকতুল্য আমার শিল্পতত্বে এদের অবদান রয়েছে। এবার তত্ত্বকথাটি বলি— শিল্পের বিষয়বস্তু তার কাঠামােগত রূপের স্রষ্টা- কনটেন্ট ক্রিয়েটস ইটস ফর্ম অ্যান্ড ফ্রেম— এই ফর্ম ও ফ্রেমই-তাে কারুকৃতির পরিসর, তা যদি চমৎকার হয়, তাহলে ‘গল্প" মানে বিষয়বস্তুই তা করেছে তাহলে গল্পটা বাতিল হয়। কীভাবে?

আসলে সম্পাদকের ব্যক্তিত্বই গল্পটাকে খারিজ করেছিল। আর তুমি যে স্মার্টনেস'-এর কথা বললে আসলে তা তাে ওই ‘কাঠামােগত রূপ’ যা তােমাকে মুগ্ধ করেছে, তার মধ্যেই তাে গল্প ছড়িয়ে আছে— খুব সাদা কথায় শিল্প বলতে আমরা বুঝি ভাবমূর্তি এই ভাব যত সৎ হবে, সম্যক অর্থে, ততই তার প্রকাশক শব্দগুলির যথাযথ চয়ন হবে, গ্রন্থিত হবে— সব মিলিয়ে স্মার্টনেস'।

মনুষ্যত্বের এই অবক্ষয়ের যুগে যারা মানবিক থাকা, মানবিক হয়ে-ওঠার লড়াই করছেন তারাই আমার গদ্যচর্চার অনুপ্রেরণা।

অমিতঃ আপনার প্রায় প্রতিটি গল্পের সমাপ্তি অসামান্য, যেমটটি হওয়া উচিত আর কি!

‘অচমকা পৃথা আবিষ্কার করল টিভিতে নয়, তার মাথার মধ্যে নানা দৃশ্যের জন্ম হচ্ছে...'

[সুবাসকথা] অথবা,

‘এই লেখাটাকে একটা সুইসাইড নােট ভাবতে কোনাে অসুবিধে নেই। সম্ভবত আগামী পরশু আমি খবর হব। শিরােনাম হবে: অবসাদে পার্টি-কর্মীর আত্মহত্যা... সেই খবরে আমাকে নিয়ে একটা গল্প তৈরির চেষ্টা হবে। যে গল্পে শেষ পর্যন্ত আমাকে এক অবসাদগ্রন্ত' বাতিল মানুষ হিসাবে দেখানাে হবে— যদি এরকম হয়, এই লেখাটি আমার হয়ে নিশ্চয়ই কিছু কথা বলবে।

[শুদ্ধিকরণ]। শেষােক্ত অংশে কথক দিবাকর কি কথাসাহিত্যিক সুরঞ্জন প্রামাণিক হয়ে উঠল, আর মিডিয়াকে এভাবে হঠাৎ এক হাত নিলেন কেন?

সু: প্রা: সুবাসকথা ও শুদ্ধিকরণ— গল্প-দুটিতে যে-ভাব ছড়িয়ে আছে, তার উৎস প্রথমটিতে সংবাদপত্রে পাত্র-পাত্রী’র বিজ্ঞাপন, দ্বিতীয়টিতে একটি সংবাদ যার শিরােনাম ছিল : অবসাদে পার্টি অফিসে আত্মহত্যা সিপিএম কর্মীর— সেই যে বলেছিলাম না যদি এমন হয়, এটাই ঘটেছে 'সুবাসকথা'য় বানানাে দৃশ্যের বাইরে বেরিয়ে এসেছে পৃথা, তার মাথার মধ্যে দৃশ্য জন্মাননা আসলে আর এক গল্পের মধ্যে পাঠকের ঢুকে পড়া।

দ্বিতীয়টিতেও তাই অবসাদে পার্টি কর্মীর আত্মহত্যা আদবে একটি খুন একটি অন্য রহস্য গল্পের আরম্ভ।

এরকম মনে হল কেন তােমার— এটা ঠিক লেখক-ব্যক্তিত্বের প্রকাশকে অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু ভেবে দেখাে, দিবাকর যদি সুরঞ্জন প্রামাণিক হয়ে উঠত, তা হলে তাে এ গল্পের ‘প্লট’ই তৈরি হত না!

আর ওই ‘সেলফ এক্সপােজার’-এর দিক থেকে আমি বলতে পারি, সুরঞ্জন প্রামাণিকের দিবাকর হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল।

না অমিত, 'মিডিয়াকে একহাত নিয়েছি’ বলে তােমার মনে হওয়াটা ঠিক নয়, ওটা একেবারেই স্টেটমেন্ট আকারে বলেছি- সেই খবরটা মনে রেখে।

আমাকে দিয়ে এই প্রলাপ বকানাের জন্য তােমাকে ধন্যবাদ!

অমিতঃ ধন্যবাদ দাদা আপনাকেও। তথ্যগত ত্রুটির জন্য একান্ত ক্ষমাপ্রার্থী। আমরা সমৃদ্ধ হলাম। ভালাে থাকবেন।