Ticker

6/recent/ticker-posts

বাঙালী ও ইসলাম - সা’দ উল্লাহ্

amarboi
বাঙালী ও ইসলাম
সা’দ উল্লাহ্

সা’দ উল্লাহ একজন বাঙালি পণ্ডিত ব্যক্তি। ধর্মীয় বিষয়ে মহিমময় এই ব্যক্তির জ্ঞানের গভীরতা এবং ব্যাপকতা, যারাঁই তাঁর সান্নিধ্যে এসেছেন, দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। ধর্মীয় বিষয় মানে শুধু ইসলাম নয়;যে কোন ধর্মীয় বিষয় তিনি একজন পণ্ডিত ছিলেন। তাঁর কন্যা বীণা বিন্তে সৈয়দের কথায়, “বড়দের কাছে শুনেছি,আব্বা আগে বেশ ধর্মকর্ম করতেন! ইসলামের ইতিকথা পড়ে পুরাপুরি সব বিসর্জন দেন,আমৃত্য”।

১৯২৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার কেতুগ্রামে সা’দ উল্লাহর জন্ম। ছয় বছর বয়সে বাবা-মাকে হারিয়ে মামাদের বাসায় তাঁর বেড়ে ওঠা। গ্রামের স্কুল শেষ করে কলকাতায় রিপন কলেজে ভর্তি হন। দেশজুড়ে তখন অস্থির উথালপাতাল সময়, দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ, দেশভাগের টানাপোড়েন পেরিয়ে ১৯৪৮ সালে ঢাকায় চলে আসেন তিনি। দিনে চাকরি, রাতে পড়াশুনা এভাবেই ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে ইসলামের ইতিহাসে মাস্টার্স করেন। প্রায় কুড়ি বছর পর তিনি এল এল বি করেন এবং অবসর নেবার পর ঢাকা লেবারকোর্ট এবং কিছু নাম করা প্রতিষ্ঠানে আইনবিষয়ক উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করেন। কর্মসূত্রে,ইংল্যান্ড, রাশিয়া,জাপানসহ বেশকিছু দেশ ঘুরেছেন। যখনই বিদেশের কোন দেশে যেতেন,সেদেশের ভালো সবকিছু নিজের করে নেবার চেষ্টা করে যেতেন নিরলস ভাবে।

ঘরোয়াআসরে তাঁর গাওয়া রবীন্দ্রসংগীত সুধিজনের প্রশংসা পেয়েছিল! এছাড়া তিনি তবলা আর বেহালাবাদক হিসেবেও খ্যাতি পেয়েছিলেন,বন্ধু মহলে। লেখালেখির শুরু চট্টগ্রামে। দৈনিক আজাদী পত্রিকায় "রং -তুলি- ক্যানভাস" নামে কলাম লিখেছিলেন, দৈনিক পূর্বকোণ পত্রিকায় ও লিখেছিলেন বেশ ক' বছর।

ঢাকায় দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় তাঁর ইসলাম বিষায়ক কলাম লিখে প্রচুর জনপ্রিয়তা পায়।এরপর মৌলবাদের চক্করে পড়ে তাঁকে বাধ্য করা হয় লেখা বন্ধ করতে!এরপর আর কোন পত্রিকায় তাঁকে লিখতে দেওয়া হয়নি। এই লিখতে না পারার ব্যাপারটা তাঁকে বেশ কষ্ট দিতো। আর সেই কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে তিনি শুরু করেন অনুবাদ! যা তাঁকে ব্যস্ত রেখেছিল অবসরজীবনে। সাদ'উল্লাহ আজীবন "সবার উপরে মানুষ সত্য," এই মতবাদের পূজারি ছিলেন। ধর্ম বলতে তিনি বুঝতেন মানবধর্ম,আর কিছু নয়! তিনি এই কথা কেবল বিশ্বাস করতেন,তা নয়,রীতিমত তার চর্চাও করতেন।

১৯শে অক্টোবর, ২০১৭ এ, ক্রমাগত উঠা-নামা সমৃদ্ধ,বর্ণময় দিনগুলোর মোহমায়া কাটিয়ে পরিণত বয়েসে সাদ'উল্লাহ র জীবনাবসান ঘটে।

সূ চি প ত্র
বাঙালী ও জাতীয়তাবাদ ১১
বাংলাদেশে ধর্মের প্রভাব ৪২
পীর-মুরিদী সংবাদ ৭৫
আত্মা ও অধ্যাত্মবাদ ১০৪
বৈরাগ্যবাদ ১২৯

ভূমিকা

এই গ্রন্থে বিধৃত প্রবন্ধগুলাে বিভিন্ন তারিখে দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত। বিষয়ভিত্তিক বিভাজন করে পরিচ্ছেদ আলাদা করা হয়েছে। পরিচ্ছেদের অংশ পাঁচটি- (১) বাঙালী ও জাতীয়তাবাদ (2) বাংলাদেশে ধর্মের প্রভাব (3) পীর-মুরিদী সংবাদ (৪) আত্মা ও অধ্যাত্মবাদ এবং (৫) বৈরাগ্যবাদ। যারা নিয়মিত জনকণ্ঠ পত্রিকায় ইসলাম ও আমরা কলামটি পড়েছেন তাদের স্মরণে প্রত্যেক প্রবন্ধের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠতে পারে। লেখার মধ্যে অনেক কিছু এমন আছে যা পাঠক পড়ে আগে পত্র দিয়েছেন, এখনাে হয়তাে আমার সাথে দ্বিমত প্রকাশ করতে পারেন। তবে, এসব আমার কথা নয়, পণ্ডিত ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের । আমি শুধু তুলে ধরেছি; সিদ্ধান্ত পাঠকের।

আমি বাঙালী। এটাই আমার গর্ব, আমার লজ্জাও। বাঙালী আদৌ কি কোন জাতি? তার ভাষা প্রকৃতই কি ধরনের বাংলা? বাঙালীর বাস্তবিক কোন ইতিহাস আছে কিনা? থাকে যদি তা হলে সে ইতিহাস কবে থেকে শুরু? এই সমস্ত প্রশ্ন অনেক সময় মনে হয়।

প্রাচীন চর্যাগীতিতে ভুসুকুপাদের পদাবলীতে প্রথম বাঙালী শব্দের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। “আজি ভুসু বঙ্গালী ভইলী।/ নিজ ঘরিণী চণ্ডালী লেলীয় ॥ ভুসুকু কথিত বঙ্গালী’ কি আজকের ‘বাঙালী’? তখনকার দিনে ‘বঙ্গাল' বা 'বঙ্গ' নামে অভিহিত জন পদ আজকের বাংলা নয়। বাংলা বলতে এখন যা বােঝায় তখন তার অস্তিত্ব ছিল না। এই দেশ তখন খণ্ড খণ্ডভাবে সূক্ষ্ম, রাঢ়, তাম্রলিপ্তি, বঙ্গাল, সমতট, হরিকেন, পুণ্ড্রবর্ধন (বরেন্দ্র), গৌড় (কর্ণসুবর্ণ) ইত্যাদি নামে পরিচিত ছিল। বঙ্গাল বা বঙ্গ বলতে বর্তমানকালের ঢাকা বিক্রমপুর, সােনারগাঁও সংলগ্ন পূর্ববঙ্গ নির্দেশ করত। পশ্চিমবঙ্গে যাদের বাঙাল’ বলা হয়, ভুসুকুপাদের ‘বঙ্গালী’ সেই বঙ্গাল জনপদের অধিবাসী ছিল। সে যে ভাষা ব্যবহার করত তা বােধ করি মাগধী অপভ্রংশ থেকে উদ্ভূত বাংলা ভাষার কোনও আঞ্চলিক প্রত্নরূপ। সে ভাষা এখনকার বাংলা নয়। তাই বঙ্গালী ভুসুকপাদকে বাঙালী কি বলা যায়? বাঙালী বলতে যে জাতি বোঝায় সে জাতি তখনও দানা বাঁধেনি।

আদিপর্ব নামে তুর্ক অধিকারের প্রাক্কাল পর্যন্ত যে সুপ্রসিদ্ধ বই নীহাররঞ্জন রায় রচনা করেছেন তা বাঙালীর ইতিহাস নয়। তবে যদি ‘আদি’ পর্ব না বলে প্রাক’, ‘পূর্ব’ বা ‘প্রত্ন' পর্ব কথাটি তিনি ব্যবহার করতেন, তবে বাঙালীর ইতিহাস আখ্যা প্রয়ােগের এক প্রকার সার্থকতা অনুভব করা যেত। নীহার রঞ্জন রায়ের আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রমেশচন্দ্র মজুমদার ওই একই সময় নিয়ে অর্থাৎ আদিমকাল থেকে তুর্ক অধিকারের প্রাক্কাল পর্যন্ত দি হিস্ট্রি অব বেঙ্গল সম্পাদন করেছেন, তাও বস্তুতপক্ষে বাংলার ইতিহাস নয়। যে যুগে বাঙালীর অস্তিত্ব ছিল না সে যুগে গবেষণা চলতে পারে, কিন্তু বাংলা ও বাঙালীর ইতিহাস রচনা করা সম্ভব নয়।

মুসলমানদের অধিকারের পূর্বে গােটা দেশটির কোন একটি নাম ছিল না। বাংলা বা বাংগালা নামটি মুসলমান শাসকরাই বঙ্গাল’ নাম থেকে আহরণ করেছিলেন। চর্যাগীতির ভাষার উদ্ভব থেকে আরম্ভ করে গৌড়ের স্বাধীন মুসলমান সুলতানদের উদয় পর্যন্ত (৯৫০-১৩৫০) চারশাে বছর ধরে দেশ, ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে এই রাসায়নিক প্রক্রিয়া চলেছিল এবং এর ফলে যে পদার্থ সৃষ্টি হয় তাই হল বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতি ।

ইতিহাসে এই দেশের সীমানা নির্দেশ করেন আবুল ফজল তাঁর আইনী আকবরীতে। এখন ভূগােল ও ভাষাতত্ত্ব মিলিয়ে পড়লেই কেমন বাঙালীর জন্ম হল তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। হিউয়েং সাং-এর ভ্রমণ বৃত্তান্তে (সপ্তম শতক) প্রমাণ পাওয়া যাবে যে চর্যাগীতিকাগুলাে থেকে যে ভাষার অস্তিত্ব জানা যায়, নিঃসন্দেহে সেই ভাষা পূর্বভারতে এমনকি বঙ্গাল প্রত্যন্তও চালু ছিল। এ ভাষা তুর্কী বিজয়ের পূর্ববর্তী সেই প্রত্নভাষা যা থেকে মগধি, মৈথিলি, ভােজপুরি, বাঙলা, ওড়িয়া ইত্যাদি ভাষা পরবর্তীকালে স্পষ্টত বিশিষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় চর্যাগীতিকে বাংলা পুঁথি হিসাবে গ্রহণ করেছেন বটে, কিন্তু হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতই সুনীতিকুমার চট্টোপাধায়ও বাঙালী চর্যাগীতি বাংলা ভাষা নয়। এ ভাষা প্রাকবাংলা।

বাংলাদেশ’ ও ‘পশ্চিম বঙ্গ’ নামে যে দুটি সরকার শাসিত অঞ্চল এই উপমহাদেশে গঠিত হয়েছে তাদের ভিত্তি আলাদা আলাদা ধর্ম ও সংস্কৃতিমূলক সম্প্রদায়ের দ্বৈত অস্তিত্বের ওপর। আমরা ফার্সি তারিখগুলিতে সর্বপ্রথম বাংগালা নামের ব্যবহার পাচ্ছি। মিনহাজ বংগ বলতেন, বরণী বলছেন বাংগালা। কিন্তু বরণীর লেখা থেকে বােঝা যায় যে, দিয়ার-ই-বাংগালা' নামক অঞ্চলটি তখনও লখনওতি ও সাতগাঁও থেকে আলাদা। আগে এসেছে মুসলমান তারপর এসেছে বাঙালী। ভারতবর্ষে সুপ্রাচীন ইতিহাসে এ দুটিই নেহাত নয়া ঘটনা। কিন্তু দুইটির যথাযথ ঐতিহাসিক পারম্পর্য ভুললে চলবে না। আবার এও মনে রাখা দরকার যে, মুসলমানদের আগমন এবং বাঙালী উদয় আলাদা আলাদা ঘটনা। নানাভাবে এই দুই ঘটনা পরস্পর সম্পৃক্ত হয়ে গেছিল। এ হল বাঙলার ইতিহাসের গােড়ার কথা। ভক্তি ও ইশক বাঙালী হিন্দু ও বাঙালী মুসলমানদের প্রাণের কথা, ভক্ত ও সুফীদের নব দান।

দৈহিক ভাবে বাঙালী প্রেমিক। আধ্যাত্মিকভাবে বাঙালী ভগবদ্ ভাবুক। চতুর্দশ শতকে এ দুয়ের মধ্যে একটা সম্বন্ধ স্থাপিত হয়েছিল। দেহ রসাের্থত প্রেমের সঙ্গে নফস-আত্মক ভগবদ বিরহ মিলে গিয়েছিল। ইসলামী ইশক ও ব্রাহ্মণ্য কামের সংযােগে বাঙালী মানস গঠিতহয়। ইলিয়াস শাহ নব সৃষ্ট বাঙালীর প্রথম ‘শাহ-ই-বাঙালীয়ান।' এ ঘটনা বাহ্যিক। তিনি নিজে বাঙালী ছিলেন না। অবাঙালী প্রভুত্বের দ্বারা চিহ্নিত বাঙালি রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডল একটা বিশেষ মানসিক পরিবেশ সৃষ্টি করে এবং বাঙালীকে ইশক-আকুল ও ভক্তিবাদী করে তােলে। বৌদ্ধদের চর্যাপদের গুপ্ত ফল্গুধারা বৈষ্ণবদের শ্রীকৃষ্ণসন্দৰ্ব্ব-এ খরস্রোতা হয়ে উঠেছে এবং ঐ একই আদিরসের স্রোত বাঙালী মুসলমানদের প্রথম বাংলা কাব্যগ্রন্থ ইউসুফ জোলেখার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। পৌরুষের রৌদরস না হয়ে নারীত্বের মাধুর্যরস কেন হল তার এই উত্তর। জন্মলগ্নে বাঙালী হিন্দু ও বাঙালী মুসলমান ছিল পরাধীন। বহিরাগত ইসলাম ও গৌড় বঙ্গালােত বাংলার পূর্বাপর পারম্পর্য এই ঐতিহাসিক রসায়নকে সম্ভবপর করে তুলে ছিল । এই-ই বাঙালীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। আগ্রহী পাঠক যদি পারেন বাঙালি’ কে, কবে এবং কেন রজতকান্ত রায় রচিত প্রবন্ধটি পড়ে নিবেন- সূত্র দেশ পত্রিকা, ১১ নভেম্বর ২০০০-পৃষ্ঠা ২১।

ভুলত্রুটি থাকবেই। এর জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। পাঠকদের ভাল লাগলে শ্রম সার্থক হবে। সকলে ভাল থাকুন।

ডিসেম্বর ২০০১
উত্তর, ঢাকা

সাদ উল্লাহ
বই নিয়ে শুধুমাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, বই নিয়ে শুধু মাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, নতুন প্রজন্ম চকঝমকের আকর্ষণে বইয়ের দিক থেকে ঘুরিয়ে নিচ্ছে মুখ। আমাদের এ আয়োজন বইয়ের সাথে মানুষের সম্পর্ককে অনিঃশেষ ও অবিচ্ছিন্ন করে রাখা। আশাকরি আপনাদের সহযোগিতায় আমাদের এই ইচ্ছা আরোও দৃঢ় হবে। দুনিয়ার পাঠক এক হও! বাংলা বই বিশ্বের বিবিধ স্থানে, সকল বাংলাভাষীর কাছে সহজলভ্য হোক!