উৎপলকুমার বসু স্মৃতি পুরস্কার
৩ আগস্ট ২০১৬ প্রথম বর্ষ
সভাপতির অভিভাষণ দেবব্রত চক্রবর্তী
আমার সঙ্গে উৎপলকুমার বসুর পরিচয় হয়েছিল আশির দশকে, সাহিত্য অকাদেমির একটা অনুবাদ কর্মশালায়। তারপর থেকে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে অনেক বার, অনেক জায়গায়, এমন কি একবার দিল্লীতেও। কথা হয়েছে কখনও কফি হাউজে। খুব বেশী কথার মানুষ ছিলেন না তো তিনি! সরাসরি তাকাতেন মাথা তুলে, একটু চোখ বড় করে, সেই সঙ্গে একগাল হাসি। কিছু বলার থাকলে বলতেন, এটুকুই। অল্পেই সারা হয়ে যেত সব। কথা তো আমরাই বলতাম। জার্মান ভাষায় অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের একটা বাংলা কবিতার সঙ্কলন বেরোল, আমি একটা রিভিউ লিখতে গিয়ে তাঁকে ধরলাম, আপনার এই কবিতাটা পাচ্ছি না, এটা গোটা আমার চাই, আমাকে দিন, আমি একটু মেলাব ‘তারপর ঘাসের জঙ্গলে পড়ে আছে তোমার ব্যক্তিগত বসন্তদিনের চটি’। তিনি অসহায়ের মত আমার দিকে চাইলেন, বললেন, ওটা তো আমার কাছে নেই, তবে শঙ্খবাবুর কাছে পাবে। আমার তো সব পাতলা পাতলা বই, ওঁর কাছে আমার সবগুলো বই-ই পাওয়া যায়। শঙ্করনাথের ক্ষেত্রেও ঠিক অমনি হয়েছিল। তাঁর একটি কবিতার বইয়ের কথা একজনকে বলাতে তিনিও আমাকে ওই একই কথা বলেছিলেন, ওঁর বই সব শঙ্খদার কাছে পাওয়া যায়। আমাদের খুব সৌভাগ্য যে সর্বজনমান্য কবি শঙ্খ ঘোষ এইভাবেই কবিদের এক মিলনবিন্দু হয়ে রয়েছেন, আর কি আশ্চর্য, আজও এখানে তার উজ্জ্বল উপস্থিতি।
আজ যখন কবি উৎপলকুমারকে পূর্বিতা দিয়ে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে, তখন তাঁর কবিতার কথাই বারবার এসে পড়ছে আকুল হাওয়ার মত। উৎপলকুমার তো সকলের মত লেখেন না, তাঁর আছে এক ব্যক্তিগত লিখনভঙ্গিমা। আমরা যেমন অর্থের শৃঙ্খলা রেখে লিখি, তার বাঁধুনি অটুট রেখে এগিয়ে যাই চরণের পর চরণ, উৎপলকুমারের কবিতা পড়তে গেলে ওই ধরা বাঁধা গৎ-এর কথা ভুলে যেতে হয়। তাঁর এক একটা বাক্যে কত বিপরীতমুখী স্রোত খেলা করে, অথচ কোনও কোলাহল থাকে না সেখানে, একটা নৈঃশব্দ্য ঘুরে বেড়ায় আনাচে কানাচে, সর্বত্র। রিলকে যেমন রোদ্যাঁ সম্পর্কে বলেছিলেন, তাঁর ভাস্কর্যের মধ্যে শুধু তো একটা কাঠামো থাকে না, থাকে একটা ভাবনা, যার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে লেগে আছে একটা আবহাওয়া, একটা পরিবেশ; ভাবনাটা যেখান থেকে যেভাবে এসেছে, তারই পরিবেশ। উৎপলের কবিতাতেও তাই হয়। তাঁর কবিতায় কোথা থেকে এসে পড়ে একটা নিজস্ব বাতাস, উৎস থেকে ভেসে এসে মিলিয়ে যায় তাঁর কবিতার শব্দ, অর্থ ও ছবি, এই গোটাটার মধ্যে। বড়ই নিরুদ্বিগ্ন, মৌনস্বভাব এই বাতাস। তিনি কথা বলেন যেন স্বগতোক্তির মত, যেন তাঁর কাছে কেউ নেই, তুমি যদি শুনতে পাও তো পেলে, এমনই নিস্পৃহতায়। আবার তিনি চলেনও তেমন দিব্যি, কখনও একটানা খানিকটা, তারপরেই হয়তো আবার টুক করে সরে যান পাশের নিচু জমিতে। কিংবা একটা পাহাড়ী পথে, একে বেঁকে চলছে পথটা, বাঁকের আড়াল থেকে হঠাৎ কোন্ শব্দ বা ছবি ছুটে আসবে কিনা তার কোনও স্থিরতা নেই। একটা ঘর পালটাবার মন, ত্বক বদল করবার অনুষঙ্গ ধ'রে আরেক ভাষায়, আর একটি দ্যোতনায় চলে যাবার সচেতনা। কি অপূর্ব একটা সঙ্গীতের গুঞ্জনধ্বনি তার ছন্দে জানি না, কিন্তু যখন পড়ি তখন মুগ্ধতা আসে।
কত গল্পে নেমে গেছি কত না গাথায়
ভাঙা ধ্বস্ত সিঁড়ি বেয়ে, দু চার ধাপ টপকে গেছি
পড়তে পড়তে বেঁচে যাই ওই ভাবে, বোকার মতো বাঁচি
মহাভারতের মাঠে হোমারের উপকুলে এজিদ কান্তারে, দেখি
যুদ্ধ শুরু হল, শেষ হল, নায়ক নিহত, রাজ্য শ্মশান
প্রতি গল্প বিশ্বরূপ, মাথামুণ্ডু না বুঝেই কাঁদি
হায় অবিদ্যায় ঢাকা থাকল ঋজু পাঠ—যেন তারা
হিমের কুটুম ওই অস্বচ্ছ মানুষজন, গাছপালা রণক্ষেত্র
কেন, এর বেশী, সবটা বুঝিনি?
---ভূমিকা, বক্সীগঞ্জে পদ্মাপারে, কাব্যসমগ্র, পৃ৩০৯
কিন্তু অবিদ্যায় কিছুই ঢাকা পড়ে না। আমরা আপ্লুত হই তাঁর বহুপঠনের পশ্চাৎপট দেখে, তাঁর বহু দেশ দেখবার অভিজ্ঞতার নিরিখে; তাঁর দৃষ্টি যেন যাযাবর পাখিদের বহুদর্শিতার ঝলক ফেলে যায় মূহুর্মুহু। আবার একটা অতীত কখনও পাশে এসে বর্তমানকে জড়িয়ে ধরতে যায়, খুব আন্তরিক, স্বাভাবিক একটা সংলাপের টানে।
দিদি ধন্যবাদ। আমি হালেবীদ মন্দিরের স্ত্রী যক্ষ মূর্তিটিকে হেসে বলি
এসো, আমাদের সামান্য আশ্রয়ে একদিন
থাকো, আতিথ্য গ্রহণ কর, আমাদেরই সংসারের
উত্থান পতনে ভ্রষ্ট হও, জয়ী হও
আমাদের আলনা শেয়ার কর, এই তাকে বই রাখ
কার্তিক সন্ধ্যায় প্রথম শ্যামাপোকা দেখে বিষন্ন হও
আমাদের সংসারের ওপর চিরদিন কালো মেঘ, অনেক ঝড়, অনেক বজ্রপাত
দ্যাখো সেই সৌন্দর্য তোমার চেয়ে কিছু কম বিষাক্ত নয়।
—অগ্রন্থিত কবিতা, কাব্যসমগ্র, সংখ্যা ৩৪ পৃ ২১৩
শঙ্করনাথ চক্রবর্তীর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় তুলনামূলকভাবে অনেক পরে, শূন্য দশকে। কলেজ স্ট্রীটের একটা রেস্তোরাঁর টক ঝাল মিষ্টির আড্ডায় তাঁকে সপ্তাহান্তে নিয়মিত পাওয়া যেত একসময়, যদিও এখন আমরা দুজনেই সেই আড্ডা থেকে স্খলিত হয়েছি। তবে তার আগে একটা দুটো পত্রিকায় তাঁর লেখা আমাকে খুব টেনেছে। যুগ সম্পর্কে একটা উদ্বেগ তাঁর মধ্যে আলোড়িত হত খুব, একটা উত্তেজনা, ঘটনার সঙ্গে অংশীদারিত্বের দায়বদ্ধতা দেখেছি তাঁর কবিতায়, পরে তাঁকে জানলাম একই অনুষঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে। তাঁর কবিতার সঙ্গে আর একটু নিবিড় হয়ে উঠলাম। যদিও তাঁকে সম্পূর্ণ বুঝতে গলদঘর্ম হয়ে গিয়েও লাভ হয়নি কোনও। তবে তাঁকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত সঙ্গ-নিঃসঙ্গতার বার্তাবিনিময় বইটির পৃষ্ঠা থেকে উথিত হয়ে তিনি আমার কাছে যেন কিঞ্চিৎ আলোকিত হলেন। ওই বইয়েরই সূত্র ধরে দেখতে পেলাম উৎপলকুমারের সঙ্গে তাঁর পত্ৰবিনিময়ে (পৃ ২২৫) তাঁর যুগযন্ত্রণার প্রসঙ্গটা বেশ সরব হয়ে উঠেছে। তবে অনুজ এই কবির কাছে উৎপল যে কথাটা লিখেছিলেন, সেটা এখন বেশ কানে বাজে: “তোমাদের প্রতি, অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত কমবয়সীদের প্রতি, আমাদের শুধু এটুকুই বলা যে এই তো পৃথিবী নামক আস্তাকুঁড় আমরা রেখে গেলাম। এর ভালোমন্দ—সবই তোমাদের।”
শঙ্করনাথ এই আস্তাকুঁড়টা খুব ঘেঁটেছেন। উৎপলের সঙ্গে তার তফাতটা বোধ হয় এখানেই খুব উচ্চকিত। উৎপলের নৈঃশব্দ্যটা তার মধ্যে নেই যদিও, তবে বিচ্ছিন্ন শব্দব্যবহারে বা বহুপঠনের উদ্ভাসের কথা চিন্তা করলে দুজনের একটা আপাত মিল খুঁজে পাওয়া খুব অস্বাভাবিক কিছুনয়। কিন্তু শঙ্করনাথের কবিতায় অবচেতন মনের যে উৎক্ষেপন পাই, যে নানান অলিগলি দিয়ে মনের জটিলতাকে দক্ষভাবে চালিত করে দেবার প্রবণতা তাঁর মধ্যে দেখি, যে বিচিত্র তদ্ভব ও তৎসম অথবা তাদের মিশ্রিত জারকে কিছু শব্দ তিনি বিচ্ছুরিত করে দেন তাঁর কবিতায়, কিংবা আচমকা অপশব্দের ভাণ্ড তিনি যেভাবে স্রোতে নামিয়ে দেন, বয়ঃসন্ধির অনুভূতির বীজনে কামগাভীর বীজমেঘ তিনি উড়িয়ে দেন যেভাবে আকাশে এবং সর্বোপরি তাঁর জাদুবাস্তবতা যেভাবে একটি অসম্ভব বলশালী কাব্যগদ্যে স্ফুরিত হতে দেখি, তাতে শিক্ষিত পাঠকেরও নাজেহাল অবস্থা হওয়া কিছু বিচিত্র নয়। বাকপ্রথা ভেঙে ফেলেন, অপ্রতিম জেদে পালটে দেন নিজের সুর ও কথনভঙ্গী, পাঠকের মনেই থাকে না যে মনটিকে ঘুড়ির মত আকাশে ছেড়ে দিয়েও সূত্ৰধার এই কবি হাল ছেড়ে বসে নেই। তিনি ইচ্ছেমাফিক দক্ষতায় সুতো ছেড়ে দেন, টেনে নেন। তাঁর কবিতার পৃথিবী বহুশাখ; সব মিলিয়ে আমার মত সকলের কাছেই তা এক রহস্যে ঘেরা সত্যের রূপ ধারণ করে।
এই যে সত্য সে যে প্রকাণ্ড বাস্তব, সেটা তখনই বুঝি যখন দেখি বহুব্যাপক জীবনের রূপরেখা তাঁর কবিতার মধ্যে মাঝে মাঝেই বিজলীরেখার মত এসে পড়ে। এইখানে রূপরেখা বলতে আমি কোনও বাস্তুতন্ত্রের আকৃতির কথা বলছি না, বলছি মূর্তিমান রূপেরই কথা। বলছি, ঠিক যেমন বৈষ্ণবকবি বলেছেন সেই মর্মেই: “জনম অবধি হাম রূপ নেহারনু নয়ন নু তিরপিত ভেল।“ তাঁর কবিতায় সত্যিই তো আমরা জীবনেরই একটা রূপ দেখি, যে জীবন একই সঙ্গে সরল ও জটিল, একই সঙ্গে গতিময়। সে রূপ দেখে মুগ্ধ হবার যেন শেষ নেই।
যেমন এই কবিতাটিতে দেখবেন:
ঝুলি থেকে লাফ মেরে মেঝেতে নামলো ছানাবেড়াল,
কান তুলে ইতি উতি চেয়েই থাবায় ঘাড় আঁচড়ে নিলো, -
যেন বাইরে ফিটন অপেক্ষারত; হালকা শব্দে চমকে উঠলো
এক দু’বার, তারপর পা পেতে বসে চোখের এমন সব
ভঙ্গী করলো যাতে চৌকাঠে লাফিয়ে বেড়ানো চড়ুই-এর দল
চকিত আলোচনা সেরেই মিলিয়ে গেল পাচিলের বাইরে: পায়ে-পায়ে এগোলো এবার ছানা,
গিন্নীর দেওয়া মাছ খেলো, দুদু খেলা, হাই তুললো আড়মোড়া ভেঙে,
তারপর ঘুমচোখে গিয়ে ঢুকলো হাওয়ায় দুলতে থাকা ঝুলিটির ভেতর
সেই রাতেই ঝড়ে কেঁপে উঠলো বৃত্ত নীহারিকা, জলজ প্রাণীরা
বিরাট হিমবাহে ঢেকে গেল সূর্যের কাঁধ, পর্বতশিরার
মুখ থেকে হীরকরক্তের স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে চললো
অন্ধকারের ফুল পাতা, হিরন্ময় টিলার প্রান্তর, বজ্রবিপণির
বুকে জেগে থাকা শর্করা ও রোমের মুকুট, শুধু তৃতীয় স্বরের
জন্য অগণ্য মহারাত্রি জুড়ে ঈশ্বরের উদ্দেশে রচনা করে গেলো
কুষ্ঠ আর প্রণয়ের গান
-প্রাচ্যবিহঙ্গী, রতিপল্লী, শ্রেষ্ঠ কবিতা, ২০১৩, পৃ. ১৮
ওই রূপের মধ্যে জন্ম জন্মান্তরের অভিজ্ঞতার কলকা কাটা, বিচিত্র সব শাঁখার কাজ, গালার গয়না, শোলার নকশা, ফুলকারি। ট্যাপেস্ট্রির বহুবর্ণরঞ্জিত ঘন বুনোট। আপনারা জানেন উৎপলের মধ্যেও তারা দৃঢ়মূল। টুকরো টুকরো ছবি সমগ্রের সঙ্গে অন্বিত হয়ে একটা গোটা দৃশ্য হয়ে যেতে দেখি আমরা তাঁর কাব্যেও৷ জীবন সম্পর্কে তাঁরও অভিজ্ঞতা কি বিপুল ও নিপুণ আপনারা দেখুন:
সমস্ত জড়িয়ে যায়, যেন লাল-কালো সুতোর কুণ্ডলি, চাকরির
দরখাস্ত, বাবার অসুখ আর মায়ের মানত, ছোটো বোন
শন্না দিয়ে খোলে গিঁট, চেষ্টা করে, সে তো প্রায় অসম্ভব,
সমগ্রে জড়িয়ে থাকে, ট্রামের টিকিট আর লটারীর কুপন,
বাস্তব কাল্পনিক, বিমানবন্দর আর রেলপথ, তৃণমূল কংগ্রেস,
জড়িত বলের মত সব কিছু তালেগোলে অক্লেশে গড়িয়ে চলে
ঢালু দিয়ে, বাজারে ও সংসারে, জামাকাপড়ের স্তুপে, পুরনো
কাগজপত্রে—
শুধু রাত্রির অন্ধকারে, নিজে নিজে, খুলে যায় গ্রহনক্ষত্রের গ্রন্থি,
বাতাস ও সৌরলতা, ধাঙড়পাড়ার গান, মাতালের অট্টহাসি।
-অগ্রন্থিত কবিতা, কাব্যসমগ্র, ২০১৫, পৃ ৩৩১
৩ আগস্ট ২০১৬ প্রথম বর্ষ
সভাপতির অভিভাষণ দেবব্রত চক্রবর্তী
আমার সঙ্গে উৎপলকুমার বসুর পরিচয় হয়েছিল আশির দশকে, সাহিত্য অকাদেমির একটা অনুবাদ কর্মশালায়। তারপর থেকে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে অনেক বার, অনেক জায়গায়, এমন কি একবার দিল্লীতেও। কথা হয়েছে কখনও কফি হাউজে। খুব বেশী কথার মানুষ ছিলেন না তো তিনি! সরাসরি তাকাতেন মাথা তুলে, একটু চোখ বড় করে, সেই সঙ্গে একগাল হাসি। কিছু বলার থাকলে বলতেন, এটুকুই। অল্পেই সারা হয়ে যেত সব। কথা তো আমরাই বলতাম। জার্মান ভাষায় অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের একটা বাংলা কবিতার সঙ্কলন বেরোল, আমি একটা রিভিউ লিখতে গিয়ে তাঁকে ধরলাম, আপনার এই কবিতাটা পাচ্ছি না, এটা গোটা আমার চাই, আমাকে দিন, আমি একটু মেলাব ‘তারপর ঘাসের জঙ্গলে পড়ে আছে তোমার ব্যক্তিগত বসন্তদিনের চটি’। তিনি অসহায়ের মত আমার দিকে চাইলেন, বললেন, ওটা তো আমার কাছে নেই, তবে শঙ্খবাবুর কাছে পাবে। আমার তো সব পাতলা পাতলা বই, ওঁর কাছে আমার সবগুলো বই-ই পাওয়া যায়। শঙ্করনাথের ক্ষেত্রেও ঠিক অমনি হয়েছিল। তাঁর একটি কবিতার বইয়ের কথা একজনকে বলাতে তিনিও আমাকে ওই একই কথা বলেছিলেন, ওঁর বই সব শঙ্খদার কাছে পাওয়া যায়। আমাদের খুব সৌভাগ্য যে সর্বজনমান্য কবি শঙ্খ ঘোষ এইভাবেই কবিদের এক মিলনবিন্দু হয়ে রয়েছেন, আর কি আশ্চর্য, আজও এখানে তার উজ্জ্বল উপস্থিতি।
আজ যখন কবি উৎপলকুমারকে পূর্বিতা দিয়ে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে, তখন তাঁর কবিতার কথাই বারবার এসে পড়ছে আকুল হাওয়ার মত। উৎপলকুমার তো সকলের মত লেখেন না, তাঁর আছে এক ব্যক্তিগত লিখনভঙ্গিমা। আমরা যেমন অর্থের শৃঙ্খলা রেখে লিখি, তার বাঁধুনি অটুট রেখে এগিয়ে যাই চরণের পর চরণ, উৎপলকুমারের কবিতা পড়তে গেলে ওই ধরা বাঁধা গৎ-এর কথা ভুলে যেতে হয়। তাঁর এক একটা বাক্যে কত বিপরীতমুখী স্রোত খেলা করে, অথচ কোনও কোলাহল থাকে না সেখানে, একটা নৈঃশব্দ্য ঘুরে বেড়ায় আনাচে কানাচে, সর্বত্র। রিলকে যেমন রোদ্যাঁ সম্পর্কে বলেছিলেন, তাঁর ভাস্কর্যের মধ্যে শুধু তো একটা কাঠামো থাকে না, থাকে একটা ভাবনা, যার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে লেগে আছে একটা আবহাওয়া, একটা পরিবেশ; ভাবনাটা যেখান থেকে যেভাবে এসেছে, তারই পরিবেশ। উৎপলের কবিতাতেও তাই হয়। তাঁর কবিতায় কোথা থেকে এসে পড়ে একটা নিজস্ব বাতাস, উৎস থেকে ভেসে এসে মিলিয়ে যায় তাঁর কবিতার শব্দ, অর্থ ও ছবি, এই গোটাটার মধ্যে। বড়ই নিরুদ্বিগ্ন, মৌনস্বভাব এই বাতাস। তিনি কথা বলেন যেন স্বগতোক্তির মত, যেন তাঁর কাছে কেউ নেই, তুমি যদি শুনতে পাও তো পেলে, এমনই নিস্পৃহতায়। আবার তিনি চলেনও তেমন দিব্যি, কখনও একটানা খানিকটা, তারপরেই হয়তো আবার টুক করে সরে যান পাশের নিচু জমিতে। কিংবা একটা পাহাড়ী পথে, একে বেঁকে চলছে পথটা, বাঁকের আড়াল থেকে হঠাৎ কোন্ শব্দ বা ছবি ছুটে আসবে কিনা তার কোনও স্থিরতা নেই। একটা ঘর পালটাবার মন, ত্বক বদল করবার অনুষঙ্গ ধ'রে আরেক ভাষায়, আর একটি দ্যোতনায় চলে যাবার সচেতনা। কি অপূর্ব একটা সঙ্গীতের গুঞ্জনধ্বনি তার ছন্দে জানি না, কিন্তু যখন পড়ি তখন মুগ্ধতা আসে।
কত গল্পে নেমে গেছি কত না গাথায়
ভাঙা ধ্বস্ত সিঁড়ি বেয়ে, দু চার ধাপ টপকে গেছি
পড়তে পড়তে বেঁচে যাই ওই ভাবে, বোকার মতো বাঁচি
মহাভারতের মাঠে হোমারের উপকুলে এজিদ কান্তারে, দেখি
যুদ্ধ শুরু হল, শেষ হল, নায়ক নিহত, রাজ্য শ্মশান
প্রতি গল্প বিশ্বরূপ, মাথামুণ্ডু না বুঝেই কাঁদি
হায় অবিদ্যায় ঢাকা থাকল ঋজু পাঠ—যেন তারা
হিমের কুটুম ওই অস্বচ্ছ মানুষজন, গাছপালা রণক্ষেত্র
কেন, এর বেশী, সবটা বুঝিনি?
---ভূমিকা, বক্সীগঞ্জে পদ্মাপারে, কাব্যসমগ্র, পৃ৩০৯
কিন্তু অবিদ্যায় কিছুই ঢাকা পড়ে না। আমরা আপ্লুত হই তাঁর বহুপঠনের পশ্চাৎপট দেখে, তাঁর বহু দেশ দেখবার অভিজ্ঞতার নিরিখে; তাঁর দৃষ্টি যেন যাযাবর পাখিদের বহুদর্শিতার ঝলক ফেলে যায় মূহুর্মুহু। আবার একটা অতীত কখনও পাশে এসে বর্তমানকে জড়িয়ে ধরতে যায়, খুব আন্তরিক, স্বাভাবিক একটা সংলাপের টানে।
দিদি ধন্যবাদ। আমি হালেবীদ মন্দিরের স্ত্রী যক্ষ মূর্তিটিকে হেসে বলি
এসো, আমাদের সামান্য আশ্রয়ে একদিন
থাকো, আতিথ্য গ্রহণ কর, আমাদেরই সংসারের
উত্থান পতনে ভ্রষ্ট হও, জয়ী হও
আমাদের আলনা শেয়ার কর, এই তাকে বই রাখ
কার্তিক সন্ধ্যায় প্রথম শ্যামাপোকা দেখে বিষন্ন হও
আমাদের সংসারের ওপর চিরদিন কালো মেঘ, অনেক ঝড়, অনেক বজ্রপাত
দ্যাখো সেই সৌন্দর্য তোমার চেয়ে কিছু কম বিষাক্ত নয়।
—অগ্রন্থিত কবিতা, কাব্যসমগ্র, সংখ্যা ৩৪ পৃ ২১৩
শঙ্করনাথ চক্রবর্তীর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় তুলনামূলকভাবে অনেক পরে, শূন্য দশকে। কলেজ স্ট্রীটের একটা রেস্তোরাঁর টক ঝাল মিষ্টির আড্ডায় তাঁকে সপ্তাহান্তে নিয়মিত পাওয়া যেত একসময়, যদিও এখন আমরা দুজনেই সেই আড্ডা থেকে স্খলিত হয়েছি। তবে তার আগে একটা দুটো পত্রিকায় তাঁর লেখা আমাকে খুব টেনেছে। যুগ সম্পর্কে একটা উদ্বেগ তাঁর মধ্যে আলোড়িত হত খুব, একটা উত্তেজনা, ঘটনার সঙ্গে অংশীদারিত্বের দায়বদ্ধতা দেখেছি তাঁর কবিতায়, পরে তাঁকে জানলাম একই অনুষঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে। তাঁর কবিতার সঙ্গে আর একটু নিবিড় হয়ে উঠলাম। যদিও তাঁকে সম্পূর্ণ বুঝতে গলদঘর্ম হয়ে গিয়েও লাভ হয়নি কোনও। তবে তাঁকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত সঙ্গ-নিঃসঙ্গতার বার্তাবিনিময় বইটির পৃষ্ঠা থেকে উথিত হয়ে তিনি আমার কাছে যেন কিঞ্চিৎ আলোকিত হলেন। ওই বইয়েরই সূত্র ধরে দেখতে পেলাম উৎপলকুমারের সঙ্গে তাঁর পত্ৰবিনিময়ে (পৃ ২২৫) তাঁর যুগযন্ত্রণার প্রসঙ্গটা বেশ সরব হয়ে উঠেছে। তবে অনুজ এই কবির কাছে উৎপল যে কথাটা লিখেছিলেন, সেটা এখন বেশ কানে বাজে: “তোমাদের প্রতি, অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত কমবয়সীদের প্রতি, আমাদের শুধু এটুকুই বলা যে এই তো পৃথিবী নামক আস্তাকুঁড় আমরা রেখে গেলাম। এর ভালোমন্দ—সবই তোমাদের।”
শঙ্করনাথ এই আস্তাকুঁড়টা খুব ঘেঁটেছেন। উৎপলের সঙ্গে তার তফাতটা বোধ হয় এখানেই খুব উচ্চকিত। উৎপলের নৈঃশব্দ্যটা তার মধ্যে নেই যদিও, তবে বিচ্ছিন্ন শব্দব্যবহারে বা বহুপঠনের উদ্ভাসের কথা চিন্তা করলে দুজনের একটা আপাত মিল খুঁজে পাওয়া খুব অস্বাভাবিক কিছুনয়। কিন্তু শঙ্করনাথের কবিতায় অবচেতন মনের যে উৎক্ষেপন পাই, যে নানান অলিগলি দিয়ে মনের জটিলতাকে দক্ষভাবে চালিত করে দেবার প্রবণতা তাঁর মধ্যে দেখি, যে বিচিত্র তদ্ভব ও তৎসম অথবা তাদের মিশ্রিত জারকে কিছু শব্দ তিনি বিচ্ছুরিত করে দেন তাঁর কবিতায়, কিংবা আচমকা অপশব্দের ভাণ্ড তিনি যেভাবে স্রোতে নামিয়ে দেন, বয়ঃসন্ধির অনুভূতির বীজনে কামগাভীর বীজমেঘ তিনি উড়িয়ে দেন যেভাবে আকাশে এবং সর্বোপরি তাঁর জাদুবাস্তবতা যেভাবে একটি অসম্ভব বলশালী কাব্যগদ্যে স্ফুরিত হতে দেখি, তাতে শিক্ষিত পাঠকেরও নাজেহাল অবস্থা হওয়া কিছু বিচিত্র নয়। বাকপ্রথা ভেঙে ফেলেন, অপ্রতিম জেদে পালটে দেন নিজের সুর ও কথনভঙ্গী, পাঠকের মনেই থাকে না যে মনটিকে ঘুড়ির মত আকাশে ছেড়ে দিয়েও সূত্ৰধার এই কবি হাল ছেড়ে বসে নেই। তিনি ইচ্ছেমাফিক দক্ষতায় সুতো ছেড়ে দেন, টেনে নেন। তাঁর কবিতার পৃথিবী বহুশাখ; সব মিলিয়ে আমার মত সকলের কাছেই তা এক রহস্যে ঘেরা সত্যের রূপ ধারণ করে।
এই যে সত্য সে যে প্রকাণ্ড বাস্তব, সেটা তখনই বুঝি যখন দেখি বহুব্যাপক জীবনের রূপরেখা তাঁর কবিতার মধ্যে মাঝে মাঝেই বিজলীরেখার মত এসে পড়ে। এইখানে রূপরেখা বলতে আমি কোনও বাস্তুতন্ত্রের আকৃতির কথা বলছি না, বলছি মূর্তিমান রূপেরই কথা। বলছি, ঠিক যেমন বৈষ্ণবকবি বলেছেন সেই মর্মেই: “জনম অবধি হাম রূপ নেহারনু নয়ন নু তিরপিত ভেল।“ তাঁর কবিতায় সত্যিই তো আমরা জীবনেরই একটা রূপ দেখি, যে জীবন একই সঙ্গে সরল ও জটিল, একই সঙ্গে গতিময়। সে রূপ দেখে মুগ্ধ হবার যেন শেষ নেই।
যেমন এই কবিতাটিতে দেখবেন:
ঝুলি থেকে লাফ মেরে মেঝেতে নামলো ছানাবেড়াল,
কান তুলে ইতি উতি চেয়েই থাবায় ঘাড় আঁচড়ে নিলো, -
যেন বাইরে ফিটন অপেক্ষারত; হালকা শব্দে চমকে উঠলো
এক দু’বার, তারপর পা পেতে বসে চোখের এমন সব
ভঙ্গী করলো যাতে চৌকাঠে লাফিয়ে বেড়ানো চড়ুই-এর দল
চকিত আলোচনা সেরেই মিলিয়ে গেল পাচিলের বাইরে: পায়ে-পায়ে এগোলো এবার ছানা,
গিন্নীর দেওয়া মাছ খেলো, দুদু খেলা, হাই তুললো আড়মোড়া ভেঙে,
তারপর ঘুমচোখে গিয়ে ঢুকলো হাওয়ায় দুলতে থাকা ঝুলিটির ভেতর
সেই রাতেই ঝড়ে কেঁপে উঠলো বৃত্ত নীহারিকা, জলজ প্রাণীরা
বিরাট হিমবাহে ঢেকে গেল সূর্যের কাঁধ, পর্বতশিরার
মুখ থেকে হীরকরক্তের স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে চললো
অন্ধকারের ফুল পাতা, হিরন্ময় টিলার প্রান্তর, বজ্রবিপণির
বুকে জেগে থাকা শর্করা ও রোমের মুকুট, শুধু তৃতীয় স্বরের
জন্য অগণ্য মহারাত্রি জুড়ে ঈশ্বরের উদ্দেশে রচনা করে গেলো
কুষ্ঠ আর প্রণয়ের গান
-প্রাচ্যবিহঙ্গী, রতিপল্লী, শ্রেষ্ঠ কবিতা, ২০১৩, পৃ. ১৮
ওই রূপের মধ্যে জন্ম জন্মান্তরের অভিজ্ঞতার কলকা কাটা, বিচিত্র সব শাঁখার কাজ, গালার গয়না, শোলার নকশা, ফুলকারি। ট্যাপেস্ট্রির বহুবর্ণরঞ্জিত ঘন বুনোট। আপনারা জানেন উৎপলের মধ্যেও তারা দৃঢ়মূল। টুকরো টুকরো ছবি সমগ্রের সঙ্গে অন্বিত হয়ে একটা গোটা দৃশ্য হয়ে যেতে দেখি আমরা তাঁর কাব্যেও৷ জীবন সম্পর্কে তাঁরও অভিজ্ঞতা কি বিপুল ও নিপুণ আপনারা দেখুন:
সমস্ত জড়িয়ে যায়, যেন লাল-কালো সুতোর কুণ্ডলি, চাকরির
দরখাস্ত, বাবার অসুখ আর মায়ের মানত, ছোটো বোন
শন্না দিয়ে খোলে গিঁট, চেষ্টা করে, সে তো প্রায় অসম্ভব,
সমগ্রে জড়িয়ে থাকে, ট্রামের টিকিট আর লটারীর কুপন,
বাস্তব কাল্পনিক, বিমানবন্দর আর রেলপথ, তৃণমূল কংগ্রেস,
জড়িত বলের মত সব কিছু তালেগোলে অক্লেশে গড়িয়ে চলে
ঢালু দিয়ে, বাজারে ও সংসারে, জামাকাপড়ের স্তুপে, পুরনো
কাগজপত্রে—
শুধু রাত্রির অন্ধকারে, নিজে নিজে, খুলে যায় গ্রহনক্ষত্রের গ্রন্থি,
বাতাস ও সৌরলতা, ধাঙড়পাড়ার গান, মাতালের অট্টহাসি।
-অগ্রন্থিত কবিতা, কাব্যসমগ্র, ২০১৫, পৃ ৩৩১
বই নিয়ে শুধুমাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, বই নিয়ে শুধু মাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, নতুন প্রজন্ম চকঝমকের আকর্ষণে বইয়ের দিক থেকে ঘুরিয়ে নিচ্ছে মুখ। আমাদের এ আয়োজন বইয়ের সাথে মানুষের সম্পর্ককে অনিঃশেষ ও অবিচ্ছিন্ন করে রাখা। আশাকরি আপনাদের সহযোগিতায় আমাদের এই ইচ্ছা আরোও দৃঢ় হবে। দুনিয়ার পাঠক এক হও! বাংলা বই বিশ্বের বিবিধ স্থানে, সকল বাংলাভাষীর কাছে সহজলভ্য হোক!