বিদ্যাসাগর কি নাস্তিক ছিলেন?
অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
বিদ্যাসাগরের তিরোধানের প্রায় আশী বৎসর পরে তাঁর ধর্মবিশ্বাস নিয়ে জল্পনার হেতু ও তাঁর যৌক্তিকতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসু ব্যক্তি প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারেন। মানবপ্রেমে আকন্ঠমগ্ন দেশহিতব্রতী বিদ্যাসাগর আজ দেবমূর্তিতে পরিণত হয়েছেন। একাধিক স্থলে তাঁর মর্মর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কিন্তু তাঁর আসল অধিষ্ঠান মানুষের চিত্তলোকে। জ্ঞান, কর্ম, প্রেম পৌরুষের এমন সময় একব্যক্তির মধ্যে প্রায়ই দেখা যায় না। প্রাচীন রক্ষণশীল পরিবারে জন্মগ্রহণ করে, গ্রামীণ সংস্কারবিজড়িত পটভূমিকায় লালিত হয়ে এবং সংস্কৃত কলেজের প্রাচীন ঐতিহানুসারী শিক্ষাদীক্ষার অনুশীলন করে তিনি যে কীভাবে বিশুদ্ধ মানবপ্রেম, লোকহিতৈষণা এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর য়ুরোপীয় মানবতাবাদের অনুরূপ মানুষের কল্যাণচিন্তা নিজের অন্তলোকে স্থাপন করলেন, সে এক বিস্ময়ের ব্যাপার।
সে যুগে বিদ্যাসাগরকে কী দৃষ্টিতে দেখা হত, তার একটি দৃষ্টান্ত দিলেই বোঝা যাবে। তাঁর জীবিতকালেই তাঁর ছবি ছাপিয়ে বিক্রয় করা হত, এবং তা বাঙালীর ঘরে ঘরে স্থানলাভ করেছিল-সে-যুগে আর কোনও বাঙালী জননায়কের এ সৌভাগ্য ঘটেনি। তাঁর অসাধারণ কর্মনৈপুণ্য, করুণাঘন মানবকল্যাণব্রত এবং অনমনীয় পৌরুষ সে যুগেই তাকে বাঙালী ও শেতাঙ্গ সমাজে বিস্ময়কর স্বাতন্ত্র্য দিয়েছিল। তাঁর সম্বন্ধে কত গল্পকাহিনী কিংবদন্তী গড়ে উঠেছে। তাঁর ভক্ত, শিষ্য ও অনুরাগীরা তাঁর সম্বন্ধে পরবর্তীকালে অনেক ছোট বড় স্মৃতিকথা লিখে গেছেন। তা থেকে তাঁর একটি দিক সম্বন্ধে কৌতুহলী পাঠক নতুন দৃষ্টিলাভ করতে পারেন। সেটি হল তাঁর ধর্মমত, ঈশ্বরসত্তা ও পারমার্থিক চেতনা সম্বন্ধে তাঁর জ্ঞান-বিশ্বাস।
তাঁর জীবিতকালে যেমন তাঁর ভক্তসংখ্যার সীমা ছিল না, তেমনি আবার কেউ কেউ অন্তরালে তাঁর সমাজসংস্কার-সংক্রান্ত মতামত নিয়ে কিছু কিছু সমালোচনাও করতেন। হিন্দুর অনেকগুলি সযত্নলালিত সামাজিক আচার-আচরণকে বিদ্যাসাগর মানবপ্রেম ও করুণার দৃষ্টিকোণ থেকেই বিচার-বিশ্লেষণ করেছিলেন এবং বিবাবিবাহ প্রচার ও বহুবিবাহের বিরোধিতা দ্বারা নিজ অন্তরশায়ী অগ্নিগর্ভ পৌরুষের দিব্যালোকে অর্থহীন, মূঢ় ও নির্মম সমাজ-প্রকরণকে অযৌক্তিক, ঘৃণাই ও বিনাশযোগ্য প্রমাণ করেছেন। সংস্কার এমন গভীরভাবে যুগযুগান্ত ধরে আমাদের সত্তাকে আচ্ছন্ন করে থাকে যে, প্রাজ্ঞজনও সেই সমস্ত অভ্যস্ত আচার-আচরণের নাগপাশে জড়িত হয়ে কর্তব্য থেকে ভ্রষ্ট হন। বিদ্যাসাগর তাঁরই বিরুদ্ধে যে-অন্ত ধারণ করেছিলেন, তা শুধু ইয়ং বেঙ্গল বা নব্য শিক্ষিতজনের পশ্চিমঘেঁষা ‘রিফর্মেশন’ নয়। তিনি যুক্তির চেয়ে মানবপ্রেমের দ্বারা অধিকতর প্রভাবিত হয়ে এবং নারীর অশ্রুমোচনের সংকল্পে অটল থেকে মধ্যযুগীয় নাইটদের মতো বীরবিক্রমে অগ্রসর হয়েছেন। প্রেম ও করুণাই তাঁর সমগ্র চেতনাকে অধিকার করেছিল বলে তিনি অতি সহজেই সংস্কার ত্যাগ করে নিরঞ্জন সত্যকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন-যেরকম অনুরাগ ও মমতার সঙ্গে জননী তাঁর সন্তানকে অঙ্গে ধারণ করেন।
তবু প্রশ্ন উঠেছে, সে-যুগেও উঠেছিল-বিদ্যাসাগর কি প্রচলিত হিন্দুমতাদর্শানুসারে ঈশ্বরবিশ্বাসী আস্তিক্যবাদী পুরুষ ছিলেন? বাহ্যতঃ তিনি শীল হিন্দুসমাজের কোন কোন আচার-আচরণ সম্বন্ধে কিছু উদাসীন ছিলেন; উপরন্তু যে-সমস্ত পুরাতন সংস্কারের উপর আঘাত হেনেছিলেন সেগুলি ছিল সনাতনপন্থী হিন্দু-সমাজের প্রাণের সামগ্রী। সুতরাং তাঁর জীবিতকালেই তাঁর ধর্মমত নিয়ে আড়ালে-আবডালে অনেক আলোচনা হত। ছদ্মনামে লেখা তাঁর ‘ব্রজবিলাস'-এ তিনি বলেছেন যে, সেযুগের সমাজপতিরা তাকে গোপনে খ্রীষ্টান অপনাম দিয়ে নিন্দা করতেন। কারণ তিনি হিন্দুর সামাজিক সংস্কারগুলিকে সর্বদা শিরোধার্য করতেন না।
বিদ্যাসাগরকে নাস্তিক বলে প্রথম প্রচার করেন তাঁর শিষ্য ও অনুরাগী আচার্য কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য। বিদ্যাসাগরের তিরোধানের বহুকাল পরে কৃষ্ণকমল বিদ্যাসাগরের ধর্মমত সম্বন্ধে এই মত প্রকাশ করেন: “বিদ্যাসাগর নাস্তিক ছিলেন, এ কথা বোধ হয় তোমরা জান না; যাহারা জানিতেন, তাহারাও কিন্তু সে বিষয় লইয়া তাহার সঙ্গে কখনও বাদানুবাদে প্রবৃত্ত হইতেন না।... পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যের ভাব বন্যায় এদেশের ছাত্রের ধর্মবিশ্বাস টলিল, চিরকাল পোষিত হিন্দুর ভগবান সেই বন্যায় ভাসিয়া গেলেন, বিদ্যাসাগরও নাস্তিক হইবেন, তাহাতে আর বিচিত্র কি?” বিদ্যাসাগর জীবনীকার বিহারীলাল সরকার (বিদ্যাসাগর) এবং সুবলচন্দ্র মিত্র (Iswar Chandra Vidyasagar-Story of his life and works) রক্ষণশীল মনোবৃত্তিবশতঃ তাঁদের গ্রন্থে বিদ্যাসাগরের কোন কোন সমাজসংস্কারেচ্ছার প্রশংসা করতে পারেননি। তাদের ধারণা, বিদ্যাসাগর প্রবৃত্তিমুখী পাশ্চাত্য শিক্ষার সংস্পর্শে এসে হিন্দুর নিবৃত্তিমুখী সনাতন সংস্কারে আস্থা হারিয়ে ফেলেন। বিহারীলাল তো মুক্ত কন্ঠেই বলেছেন, “অধ্যাপকের বংশে জন্ম লইয়া ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের সন্তান হইয়া, হৃদয়ে অসাধারণ দয়া, পরদুঃখকাতরতা প্রবৃত্তি পোষণ করিয়া হিন্দুশাস্ত্রের প্রতি, হিন্দুধর্মের প্রতি তিনি আন্তরিক দৃষ্টি রাখিলেন না কেন?... বিদ্যাসাগর কালের লোক। কালধর্মই তিনি পালন করিয়া গিয়াছেন। ইহাতে হিন্দুর অনিষ্ট হইয়াছে; হিন্দুধর্মে আঘাত লাগিয়াছে। ...নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের বংশধর বিদ্যাসাগর, উপনয়নের পর অভ্যাস করিয়াও ব্রাহ্মণের জীবনসর্বস্ব গায়ত্রী পর্যন্ত ভুলিয়া গিয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর দয়া ও করুণার বশে হিন্দুর সনাতন ধর্মের অনাথাচরণ করেছিলেন, এমনকি উপনয়নের পর সন্ধ্যাবন্দনাদির মন্ত্রও ভুলে গিয়েছিলেন। এর থেকে বিহারীলাল অনুমান করেছেন যে, বালাকাল থেকেই হিন্দুর আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি তাঁর বিশ্বাস কিছু শিথিল হয়ে গিয়েছিল। উত্তরকালে শ্বেতাঙ্গ-সান্নিধ্যে এসে তিনি হিন্দুর নিত্যকর্মের প্রতি কিছু উদাসীন হয়ে পড়েছিলেন, এবং সেজন্য বিহারীলাল অনুযোগ করেছিলেন।
চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বিদ্যাসাগরের জীবনচরিতে ('বিদ্যাসাগর’ ১৮৯৫) এ-বিষয়ে আরও স্পষ্ট করে বলেছেন। তিনি বিদ্যাসাগরের অতিশয় মেহভাজন ছিলেন। সুতরাং তাঁর মতামত তথ্যসঙ্গত বলে গৃহীত হতে পারে। তাঁর মতে “তাহার (বিদ্যাসাগর) আচার-আচরণ হইতে যতদুর বুঝিতে পারা যায়, তাহাতে এইরূপ বোধ হয় যে, তিনি ঈশ্বরবিশ্বাসী লোক ছিলেন। তবে তাহার ধর্মবিশ্বাস, সাধারণ লোকের অনুষ্ঠিত কোন-এক পদ্ধতির অধীন ছিল না। সূক্ষতমরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখিতে গেলে, তাঁহার নিত্য-জীবনের আচার-ব্যবহার, ক্রিয়াকলাপসম্পন্ন আহবান হিন্দুর অনুরূপ ছিল না অপর দিকে নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মের লক্ষণের পরিচয়ও কখনও পাওয়া যায় নাই।” (বিদ্যাসাগর, পৃ ৫২০)। অর্থাৎ চণ্ডীচরণের মতে, বিদ্যাসাগর ধর্মবিশ্বাসের দিক থেকে বোধ হয় সম্প্রদায় চিহ্নহীন মধ্যপথ ধরেছিলেন। নৈষ্ঠিক হিন্দুর আচার-বিচারের প্রতি তাঁর যেমন খুব একটা আস্থা ছিল না; তেমনি অন্যদিকে রিফর্মড হিন্দু অথবা প্রগতিশীল ব্রাহ্মমতের প্রতিও তাঁর বিশেষ কোন আকর্ষণ ছিল না।
স্বল্পকথায় বলতে গেলে বলতে হয়, হিন্দুধর্মের লোকাচারের প্রতি তাঁর বিশেষ কোন আকর্ষণ ছিল না, এমন কি স্মার্ত আচারের প্রতি প্রত্যক্ষতঃ প্রতিকুলতা না করলেও এর যৌক্তিকতা সম্বন্ধে তাঁর পুরো বিশ্বাস ছিল না। মানবপ্রেমিক বিদ্যাসাগরের ধর্মীয় কৃত্যের প্রতি আত্যন্তিক আকর্ষণ না থাকাই স্বাভাবিক। একবার তিনি কৌতুকের বশে ভাটপাড়া-নিবাসী তাঁর কায়স্থবন্ধু অমৃতলাল মিত্রের অন্নের থালা থেকে কাড়াকাড়ি করে মাছের মুড়ো খেয়েছিলেন; এজন্য ভট্টপল্লীর ভট্টাচার্যগণ তাঁর উপর বিরূপ হয়েছিলেন বলে শোনা যায়। এ বিষয়ে দৃষ্টান্ত বাড়িয়ে লাভ নেই। তাঁর সমসাময়িক ব্যক্তিদের স্মৃতিকথা থেকে জানা যাচ্ছে, বিদ্যাসাগর সংস্কৃত ভাষা, সাহিত্য ও স্মৃতিসংহিতার আলোচনার মধ্যে ডুবে থাকলেও দৈনন্দিন আচার-বিচারে ঠিক স্মার্ত পণ্ডিত বা শাস্ত্রজী ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ছিলেন না। ধর্মকর্ম সংস্কার প্রভৃতিকে তিনি মানব কল্যাণের বাতায়ন থেকে দর্শন করতেই অভ্যস্ত ছিলেন। তাই বলে তিনি ডিরোজিওর মন্ত্রশিষ্যগণের মতো হিন্দুধর্ম ও আচারের বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে দাড়াননি। ব্রাহ্মণ সন্তানের যে সমস্ত সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান মানা কর্তব্য, তিনি মনে মনে তাঁর পোষকতা করুন আর নাই করুন, বাইরের দিকে তাঁর অন্যথাচরণ করেননি-জনম-মরণাদি স্মার্ত ক্রিয়াকর্মেরও তিনি যথাবিধি অনুষ্ঠান করতেন; আজীবন উপবীতধারী ব্রাহ্মণই ছিলেন। চিঠিপত্রাদির শিরোদেশে শ্রীহরির নাম স্মরণ করতেন, জনকজননীর দেহান্ত হলে বিদ্যাসাগর নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণসন্তানের মতোই ঔদৈহিক অনুষ্ঠান ও কৃ-শৌচকর্মাদি নির্বাহ করেছিলেন। সুতরাং তিনি যে তৎকালীন ধর্মসংস্কারকদের মতো হিন্দুয়ানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন তা মনে হয় না। অভ্যাস ও সংস্কারের বশে তিনি বাহ্যতঃ হিন্দুর আচার-অনুষ্ঠান মানতেন, কিন্তু লোকাচার দেশাচারের সঙ্গে মানবধর্ম ও হৃদয়ধর্মের বিরোধ বাধলে মানবপ্রেমিক বিদ্যাসাগর স্বচ্ছন্দে-লোকাচারকে নস্যাৎ করতে পারতেন।
তাঁর জীবনীকার ও অনুরাগী অন্তরঙ্গে তাঁর ধর্মবিশ্বাস সম্বন্ধে এমন দু-একটি মন্তব্য করেছেন যে, বাহ্যতঃ তাকে পুরোপুরি ঈশ্বরবাদী বলতে দ্বিধা হয়। তাই কেউ কেউ মনে করেন যে, তাকে নাস্তিক বলা না গেলেও সংশয়বাদী বললে সত্যের অপলাপ হবে না। এ বিষয়ে তিনি স্পষ্টতঃ কোন মতামত প্রকাশ করে যাননি। তাঁর আত্মচরিত অসম্পূর্ণ রচনা। এটি সম্পূর্ণ হলে তাঁর অন্তর্জীবনের ইতিহাস উদ্ঘাটিত হতে পারত। শোনা যায়, এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন যে, ধর্ম, পরলোক, ঈশ্বর প্রভৃতি বিষয়ে তাঁর গঢ় অভিমত তিনি প্রকাশ করতে আগ্রহী নন। একবার শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন। সেই সময়ে এ-বিষয়ে দুজনের মধ্যে কিছু আলাপ ও মতবিনিময় হয়েছিল। শ্রীরামকৃষ্ণ কর্মযোগী ও করুণাময় বিদ্যাসাগরের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎকার জন্য তাঁর বাড়ীতে এসে উপস্থিত হন। উভয়ের সাক্ষাৎকার ও আলাপের কিছু নমুনা ‘শ্রীম শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত” (৩য়) লিপিবদ্ধ করে গেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর সঙ্গে নানা তত্বকথার আলোচনা করে সর্বশেষে একটি গঢ় প্রশ্ন করলেন : (বিদ্যাসাগরের প্রতি সহস্যে) -“আচ্ছা তোমার কি ভাব? বিদ্যাসাগর মৃদু মৃদু হাসিতেছেন। বলিতেছেন, “আচ্ছা সেকথা আপনাকে একলা একদিন বলব।” (হীরামকৃষ্ণ কথামৃত, ৩য়, পৃ ১২, ১৩৭৪ সালের সং) এই উক্তি থেকে মনে হচ্ছে, সকলের সম্মুখে বিদ্যাসাগর নিজের মনোগত গঢ় কথা খুলে বলত চাননি। শ্রীরামকৃষ্ণের প্রশ্নটি অতি সহজ, সরল। তিনি বিদ্যাসাগরের কাছে নিস্কাম কর্মযোগ ব্যাখ্যা করছিলেন : “তুমি যেসব কর্ম করছে এতে তোমার নিজের উপকার। নিস্কামভাবে কর্ম করতে পারলে চিত্তশুদ্ধি হবে, ঈশ্বরের উপর তোমার ভালবাসা আসবে। ভালবাসা এলেই তাকে লাভর করতে পারবে।” (ঐ, পৃ ১৫) তারপর তিনি বিদ্যাসাগরকে উপদেশ দিলেন : “অন্তরে সােনা আছে, এখনও খবর পাও নাই। একটু মাটি চাপা আছে। যদি একবার সন্ধান পাও, অন্য কাজ কমে যাবে। আরো এগিয়ে যাও।” (ঐ, পৃ ১৫)। একথা বলার তাৎপর্য, নিষ্কাম কর্মযোগী বিদ্যাসাগর যেন উপায়কে লক্ষ্য ভেবে থেমে না যান। নিষ্কাম কর্ম হল উপায়, ঈশ্বরলাভই জীবের লক্ষ্য। আধারকে আধেয় ভাবলে সত্যদৃষ্টি স্বচ্ছতা হারিয়ে ফেলে। শ্রীরামকৃষ্ণের মন্তব্য বিদ্যাসাগরকে বোধ হয় ক্ষণকালের জন্য চিকিত করে তুলেছিল। বোধ হয় তিনি নিজের মানসসাগরতলে ক্ষণিকের জন্য ডুব দিয়েছিলেন এবং শ্রীরামকৃষ্ণের কথাটি ভাবতে শুরু করেছিলেন। তাই সকলের সামনে নিজের চিত্তপট মেলে ধরতে চাননি।
আর একবার নিজের গভীর প্রত্যয় সম্বন্ধে প্রশ্ন এইভাবেই এড়িয়ে গিয়েছিলেন। একদা কাশীধামে উপস্থিত হলে কোন এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ তাঁর কাছে এসে বলেন, “ধর্ম সম্বন্ধে কিছু জিজ্ঞাসা করিবার ইচ্ছা ছিল।” তার উত্তরে বিদ্যাসাগর বলেন, “আমার মত কাহাকে কখনও বলি নাই, তবে এই কথা বলি, গঙ্গাজলে যদি আপনার দেহ পবিত্র মনে করেন, শিবপূজায় যদি হৃদয়ের পবিত্রতা লাভ করেন তাহা হইলে তাহাই আপনার ধর্ম। এখানে লক্ষণীয় যে, বিদ্যাসাগর প্রধানতঃ ব্যক্তিগত মানিসকতার উপর জোর দিয়েছেন এবং ব্যক্তিগত প্রবণতার যৌক্তিকতা স্বীকার করেছেন। অর্থাৎ যে যেভাবে খুশি আচার-আচরণ গ্রহণ বা বর্জন করতে পারে। বিশেষ কোন সাম্প্রদায়িক প্রতীকতা বা ঈশ্বর সম্পর্কীয় অনুষ্ঠান ঈশ্বর সান্নিধ্য লাভের জন্য প্রয়োজনীয় নয়-তাঁর উক্ত উপদেশের এই হল তাৎপর্য। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে, ঈশ্বর-সংক্রান্ত তাঁর ব্যক্তিগত ধারণা ও নিজস্ব বিশ্বাস প্রকাশে তিনি বিরত হয়েছেন। বিশুদ্ধভাবে নাস্তিক্যবাদী হলে বা ঈশ্বরচেতনায় তাঁর পুরোপুরি অনীহা থাকলে নিজস্ব ধারণা ও সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করতে কুঠিত ধার পাত্র তিনি ছিলেন না। বস্তুতঃ ঈশ্বরচেতনা ও পারমার্থিকতা সম্বন্ধে তাঁর লেখনী-নিঃসৃত কোন ব্যক্তিগত অভিমত পাওয়া যায় না। এ-বিষয়ে তিনি অন্তরঙ্গদের সঙ্গে মাঝে মাঝে যে সমস্ত আলোচনা করতেন এবং এখানে-সেখানে সেসম্পর্কে যা বলতেন, তা থেকে তাঁর ধর্মবিশ্বাস সম্বন্ধে একটু আভাস পাওয়া যেতে পারে।
তাঁর ‘বোধোদয়’ সম্পর্কে একটা গল্প প্রচলিত আছে। জীবনীকার চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তা প্রচার করেছেন, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মচরিতের পরিশিষ্ট উক্ত গ্রন্থের সম্পাদক তা স্বীকারও করেছেন। ‘বোধোদয়-এর প্রথম সংস্করণে নানা পার্থিব জ্ঞানের পরিচয় থাকলেও ঈশ্বর-সংক্রান্ত কোন কথাই নেই। থাকবার কথাও নয়; এখন যিনি পদার্থবিজ্ঞানে বা অন্য কোন বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ লেখেন, তাতে কি তিনি পরম কারুণিক শ্রীভগবানের জয়ধ্বনি করেন? কিন্তু বোধধাদয়ে ঈশ্বরের উল্লেখ নেই দেখে বিদ্যাসাগরের অনুরাগী বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী প্রশ্ন তুললেন, “মহাশয় ছেলেদের জন্য এমন সুন্দর একখানি পাঠ্যপুস্তক রচনা করিলেন, বালকদের জানিবার সকল কথাই তাহাতে আছে, কেবল ঈশ্বর বিষয়ে কোন কথা নাই কেন?” তাঁর উত্তরে বিদ্যাসাগর বললেন, “যাহারা তোমার কাছে ঐরূপ বলেন, তাহাদিগকে বলিও, এইবার যে ‘বোধোদয়’ ছাপা হইবে, তাহাতে ঈশ্বরের কথা থাকিবেক।”
পরবর্তী সংস্করণে বিদ্যাসাগর ‘‘বোধোদয়” ঈশ্বর-বিষয়ক ক্ষুদ্র নিবন্ধ যোগ করে দেন। হয়তো তিনি বিজয়কৃষ্ণের কথায় মনে করেছিলেন, ঈশ্বর-বিষয়ে তাঁর ব্যক্তিগত অভিমত যাই হোক না কেন, পাঠ্যপুস্তক যথাসম্ভব নিঃস্পৃহভাবে রচনা করা উচিত। সাধারণ বালক বালিকারা যেমন পদার্থজগৎ থেকে জ্ঞান সংগ্রহ করবে, তেমনি ঈশ্বর সম্বন্ধেও তারা কিছু কিছু জানবে, পাঠ্যপুস্তকের সেই রকম লক্ষ্য হওয়া উচিত। এই ভেবেই বোধ হয় তিনি বিজয়কৃষ্ণের মন্তব্যের যৌক্তিকতা স্বীকার করেছিলেন। ঈশ্বর সম্বন্ধে তাঁর কোন অনমনীয় প্রতিকুল ধারণা থাকলে তিনি বিজয়কৃষ্ণের অনুরোধ রক্ষা করে ঈশ্বর-প্রসঙ্গের অবতারণা করতেন না। কারণ যুক্তিবিরোধী বা তাঁর অভিমতের বিরুদ্ধ কোন কথা তিনি কিছুতেই মানতে পারতেন না, অন্তরঙ্গ জনের জন্যও না।
ঈশ্বর সম্বন্ধে তাঁর ধারণা সম্পর্কে অনেকে অনেক কথাই বলেছেন, কিন্তু এককথায় এর মীমাংসা করা দুরূহ। নির্মম দেশাচারের তিনি ঘোর শত্রু ছিলেন। মানুষের দুঃখ দূরীকরণের জন্য তিনি অযৌক্তিক শাস্ত্রবচনকে তুচ্ছ করতে পারতেন, সেরকম দৃঢ় মনোবলের তিনি ছিলেন অমিত অধিকারী। মানবপ্রেম তাকে চিরাচরিত সংস্কারের প্রতি উদাসীন করে তুললে বিস্ময়ের কোন কারণ থাকবে না। নিজের উইলে বিদ্যাসাগর নানা হিতকর কর্মে অর্থ বরাদ্দ করে গেছেন বটে, কিন্তু দেবসেবা, মন্দির প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি পুণ্যকর্যে এক কপর্দকও ব্যয়ের নির্দেশ দেননি। পুরোপুরি ঈশ্বরবাদী হলে এবং এতৎসম্পর্কে প্রথাসিদ্ধ পথের অনুবর্তন করলে, এ বিষয়ে কিছু ইঙ্গিত বা নির্দেশ দিয়ে যেতেন। মাঝে মাঝে তিনি ভক্ত ও অনুচরদের সঙ্গে এ বিষয়ে যা দু'চার কথা আলোচনা করতেন এখানে সংক্ষেপে তার উল্লেখ করা যাচ্ছে : “এ দুনিয়ার একজন মালিক আছেন তা বেশ বুঝি, তবে ঐ পথে না চলিলে, নিশ্চয় তাহার প্রিয়পাত্র হইব, স্বর্গরাজ্য অধিকার করিব এ সকল বুঝিও না, আর লোককে তাহা বুঝাইবার চেষ্টাও করি না। লোককে বুঝিয়ে শেষটা কি ফ্যাসাদে পড়ে যাব? এতে নিজে কতশত অন্যায় কাজ করিয়া নিজের পাপের বোঝা ভারী করিয়া রাখিতেছি, আবার অন্যকে পথ দেখাতে গিয়া, তাহাকে বিপাকে চালাইয়া কি শেষটা পরের জন্য বেত খাইয়া মরিব? নিজের জন্য যাই হোক পরের জন্য বেত খেতে পারবে না বাপু। একার্য আমাকে দিয়ে হবে না। নিজে যেমন বুঝি, সেই পথে চলতে চেষ্টা করি, পীড়াপীড়ি দেখিলে বলিব এর বেশী বুঝিতে পারি নাই।”
এই মন্তব্য থেকে বিদ্যাসাগরের পারমার্থিক তত্ত্ব সম্পর্কে মতামত স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্বন্ধে তাঁর কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু পুরাণাদি শাস্ত্রগ্রন্থে ঈশ্বর সম্বন্ধে যা বলা হয়েছে তাতে তাঁর বিশেষ আস্থা নেই। ঈশ্বরের অস্তিত্ব তিনি বিশ্বাসী, কিন্তু ঈশ্বর বিষয়ক সাম্প্রদায়িক রীতিনীতিতে তাঁর বিশ্বাস নেই। এ বিষয়ে গুরু সেজে প্রচারের বা অপর কাউকে উপদেশ দানে তিনি ঘোর বিরোধী ছিলেন। এদিক থেকে মনে হলে, কীভাবে ঈশ্বর লাভ করা যায়, অথবা আদৌ লাভ করা যায় কি না, সে বিষয়ে তিনি কোনদিনই সংশয়াতীত হতে পারেননি। তিনি যে ধর্ম-সংক্রান্ত প্রচারকর্যের পক্ষপাতী ছিলেন না, তাতে কোন সন্দেহ নেই। বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ভক্তি পথে গিয়ে ধর্ম প্রচারণায় আত্মনিয়োগ করলে বিদ্যাসাগর পরিহাস করে তাকে জিজ্ঞাসা করেন, “তুমি নাকি কী একটা হয়েছ?” কিন্তু এ সব উক্তি থেকে তাকে কোনমতেই নাস্তিক বলা যাবে না। তিনি বিশ্বাস করতেন, ঈশ্বরবিষয়ক তত্ত্বকথা এমনভাবে সংগুপ্ত যে, যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে তার নাগাল পাওয়া যাবে না। অতএব অপরকে উপদেশ দেওয়াও অযৌক্তিক। তিনি যুক্তির আনুগত্যকে সার বলে মেনেছিলেন, তদতিরিক্ত পারমার্থিক চিন্তায় তাঁর আসক্তি ছিল না। বিজয়কৃষ্ণের ধর্ম প্রচারণাকে তিনি পরিহাস করেছিলেন। তার কারণ, তাঁর মতে ঈশ্বর সাধনা একান্তভাবে ব্যক্তিগত ধ্যানধারণার বস্তু, প্রচার বা বিতর্কের বিষয় নয়। হিন্দুদর্শনের তাত্ত্বিক দিকটি তাঁর নখদর্পণে ছিল, কিন্তু তার সাধনার দিক তাকে প্রভাবিত করতে পারেনি। অর্থাৎ ধর্ম ও দর্শনে তিনি নিঃস্পৃহ, বৈজ্ঞানিক ভাবাপন্ন তাত্ত্বিক মাত্র ছিলেন, উক্ত বিষয়কে বুদ্ধির খােলামাঠ থেকে তুলে নিয়ে রহস্যানুগ সাধ্যসাধনার সুড়ঙ্গপথে প্রেরণে বিশেষ উৎসাহী হননি। এ বিষয়ে একবার মহেন্দ্ৰনাথ গুপ্ত (“শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত”-এর সঙ্কলক ‘শ্রীম’) তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “আপনার হিন্দুদর্শন কেমন লাগে?” উত্তরে বিদ্যাসাগর বলেন, “আমার ত বোধ হয়, ওরা যা বুঝাতে গেছে বুঝাতে পারে নাই।” পরে মহেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ঈশ্বর বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি উত্তর দেন, “তাঁকে ত জানবার জো নেই। প্রত্যেকের চেষ্টা করা উচিত, যাতে জগতের মঙ্গল হয়।” এ বিষয়ে বিদ্যাসাগর খুব গভীর চিন্তার কথা স্বল্পক্ষরে বলেছেন। তাঁর মতে ঈশ্বর বাকপথাতীত, বাক্য ও মনের অগোচর। সুতরাং দর্শন গ্রন্থে ও তত্ত্বালোচনায় তাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে? তিনি যদি বাক্য-মনের অগোচর হন, তা হলে জীবের করণীয় কি? তার উত্তরে বিদ্যাসাগর বলবেন, জীবকেই ঈশ্বরজ্ঞানে সেবা করতে হবে, জীবহিতব্রতই মানুষের শ্রেষ্ঠ কর্তব্য। তাই বিদ্যাসাগর নরসেবাকেই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য বলে গ্রহণ করেছিলেন। অবশ্য নরের মধ্য দিয়ে নরোত্তম যাওয়া যায় কিনা, অথবা তার প্রয়োজন আছে কিনা এ বিষয়ে তিনি অতিশয় মিতবাক্।
ভারতীয় দর্শন সম্পর্কে মহেন্দ্রনাথের কাছে বিদ্যাসাগরের মন্তব্য থেকে মনে হচ্ছে, তিনি হিন্দুদর্শনের সীমা সম্বন্ধে অতিশয় সচেতন ছিলেন। দর্শন মূলতঃ বুদ্ধি-আশ্রয়ী। সুতরাং ইরানুভূতি বলে যদি কিছু থাকে, তবে সে বিষয়ে আম্বীক্ষিকী বিদ্যা ও তত্ত্বদর্শন কতটুকু সাহায্য করতে পারে? এই বুদ্ধির দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে তিনি বেদাত্ত ও সাংখ্যকে ভ্রান্তদর্শন বলতেও কুণ্ঠিত হননি।
একবার পুরীর সমুদ্রে ষ্টীমার ডুবির ফলে প্রায় ‘সাত-আটশ' নরনারী বালবৃদ্ধ মারা যায়। এ সংবাদে মুহ্যমান হয়ে তিনি সক্ষোভে মন্তব্য করেছিলেন : “দুনিয়ার মালিক কি আমাদের চেয়ে নিষ্ঠুর যে, নানা দেশের নানা স্থানের অসংখ্য লোককে একত্রে দুবাইলেন! আমি যাহা পারি না, তিনি পরম কারুণিক মঙ্গলময় হইয়া কেমন করিয়া ৭০০-৮০০ লোককে একত্রে ডুবাইয়া ঘরে ঘরে শোকের আগুন জ্বালিয়া দেন। দুনিয়ার মালিকের কি এই কাজ? এই সকল দেখিলে কেহ মালিক আছেন বলিয়া সহসা বোধ হয় না। এখানে দেখা যাচ্ছে যে, তাঁর হৃদয় মানবপ্রেমে এতই পূর্ণ ছিল যে, করুণাময় ঈশ্বরের রাজ্যে ঐ জাতীয় নির্মম ঘটনার কার্যকারণ খুঁজে পেতেন না। প্রত্যক্ষ জীবনবাণী বিদ্যাসাগরের পরে এর অভিমত প্রকাশ করাই স্বাভাবিক। তবে মাঝে মাঝে ঈশ্বর বিষয়ে নানা প্রসঙ্গে তাঁর মনে সংশয় জাগলেও জনক-জননীকে তিনি দেবতা বলে গ্রহণ করেছিলেন, অন্তত কাশীধামে পাখ-পুরোহিতের সঙ্গে বাগবিতণ্ডার সময়ে সেই অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন। তাঁর অভিমত থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, ধর্ম, ঈশ্বর প্রভৃতি তা সয়ে তাঁর ব্যক্তিগত ধারণা সাধারণের নিকট প্রকাশে ইচ্ছুক ছিলেন না, অর্থাৎ তাঁর ধারণা আর সাধারণের প্রচলিত ধারণা সম্ভবতঃ এক ছিল না বলেই তিনি নিজস্ব মতামত সম্বন্ধে তুষ্ণীভাব অবলম্বন করেছিলেন। তবে কি তিনি পারমার্থিকতা সম্পর্কে সংশয়বাদী ছিলেন? এ বিষয়ে স্পষ্ট কোন উত্তর পাওয়া কঠিন। ধর্মসাধনাকে তিনি নিতান্তই ব্যক্তিগত প্রবণতার ব্যাপার বলে দেখেছিলেন, এবং চিত্ত প্রণালীর বাইরে পারমার্থিকতার কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই, এ বিষয়ে তিনি দৃঢ় নিশ্চয় ছিলেন। গঙ্গাস্নান, শিবপূজা প্রভৃতি অনুষ্ঠানে কেউ যদি মনে করেন, এই-ই তাঁর ধর্ম সাধনা, তা হলে তাতেও বিদ্যাসাগরের আপত্তি নেই। ধর্মের সাধারণীকরণ নয়, ‘বিশ্লেষীকরণে’ তিনি বিশ্বাসী ছিলেন।
বিদ্যাসাগর পরলোক ও জন্মান্তর ব্যাপারেও সন্দিহান ছিলেন। ঈশ্বরতত্ত্বের সম্পর্কে তাঁর মনে মাঝে মাঝে সংশয় দেখা দিত, তিনি পরলোকতত্বে যে ঘোর সংশয়ী হবেন তাতে আর সন্দেহ কি? একবার রাধাপ্রসাদ রায়ের (রামপ্রসাদের পুত্র) দৌহিত্র ললিতমোহন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে এ বিষয়ে তাঁর কিছু পরিহাস মিশ্রিত আলোচনা হয়েছিল। ললিতমোহন পরলোকতন্ত্রে বিশেষ আসক্ত ছিলেন তাই নিয়ে বিদ্যাসাগর তাঁর সঙ্গে কৌতুক পরিহাস করতেন। ললিতমোহন যোগমার্গেও অনেকদূর অগ্রসর হয়েছিলেন। একদা বিদ্যাসাগর ললিতমোহনকে সপরিহাসে জিজ্ঞাসা করেন, “হরে ললিত, আমারও পরকাল আছে নাকি?” ললিতমোহন বললেন, “আছে বৈকি, আপনার এত দান, এত দয়া, আপনার পরকাল থাকিবে না ত’ থাকিবে কার?” এই আলাপ থেকে মনে হচ্ছে, লোকান্তর সম্পর্কে তিনি কখনও গভীরভাবে চিন্তাই করেননি, উক্ত ব্যাপার তাঁর কাছে হাসির ব্যাপার বলে মনে হয়েছিল। বাস্তব জীবনের দুঃখবেদনা নিয়ে তিনি এত ব্যস্ত ছিলেন যে, পরলোকের আশ্বাস তাঁর কাছে কোনও সান্ত্বনার বাণী বহন করে আনেনি।
বিধবাবিবাহ প্রচার ও বহুবিবাহের বিরুদ্ধে দাড়িয়ে তাকে পরবর্তীকালে অনেক মানসিক নিগ্রহ ভােগ করতে হয়েছিল। এমন কি এই ব্যাপারে বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়স্বজনও তাঁর বিরুদ্ধাচারণ করেছিলেন। ফলে শেষজীবনে মানসিক আঘাতে তিনি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। দেহে-মনে ক্লান্ত হয়ে তিনি মাঝে মাঝে কার্মাটারে গিয়ে সরলপ্রাণ সঁওতালদের সাহচর্যে কথঞ্চিৎ সান্ত্বনালাভের চেষ্টা করতেন। কারণ শিক্ষিত সভ্যতাভিমানী শহুরে বাঙালীর অকৃতজ্ঞতা এবং নিকট আত্মীয়ের নষ্টামির ফলে তিনি অতিশয় মুহ্যমান হয়ে পড়েন। এমনকি, একসময়ে তিনি সংসার ত্যাগ করে বৈরাগ্য অবলম্বনেও প্রস্তুত হয়েছিলেন এবং সেকথা পিতা, মাতা, ভ্রাতৃগণ ও সহধর্মিণীকে জানিয়ে পত্রযোগে লিখেছিলেন : “নানা কারণ আমার মনে সম্পূর্ণ বৈরাগ্য জন্মিয়াছে, আর আমার ক্ষণকালের জন্যও সাংসারিক কোন বিষয়ে লিপ্ত থাকিতে বা কাহারও সহিত কোন সংষব রাখিতে ইচ্ছা নাই। এজন্য স্থির করিয়াছি, যতদূর পারি নিশ্চিত হইয়া জীবনের অবশিষ্ট ভাগ নিভৃতভাবে অতিবাহিত করিব।” (পিতার নিকট লিখিত পত্র) এখানে লক্ষণীয়-মানসিক বিপর্যয়ের সময়ও ঈশ্বরসান্নিধ্য লাভের জন্য তিনি কোন আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেননি। এই রকম মনের অবস্থায় অনেকে গীতার ‘যথা নিযুক্তোহস্মি’ বাণী অথবা রবীন্দ্রনাথের ‘সংসারেতে ঘটিলে ক্ষতি লভিলে শুধু বঞ্ছনা, নিজের মনে না জানি মানি ক্ষয়”-উক্তি অবলনে জীবন রণাঙ্গনে ক্ষতবিক্ষত হয়ে শান্তি প্রলেপ দিয়ে থাকেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর সাধারণ ধাতুপ্রকৃতির মানুষ ছিলেন না। তাই সে সান্ত্বনাও তাঁর ছিল না। তাঁর এই সময়ের চিঠিপত্রাদি থেকে দেখা যাচ্ছে, তাঁর দেহ ও মন ভেঙে পড়েছিল; পুত্র ও ভ্রাতাদের সঙ্গে মনোমালিন্য তাঁর মনঃকষ্টকে আরও তীব্র করে তুলেছিল। কিন্তু পত্রাদির কোথাও তিনি ঈশ্বরকরুণার উল্লেখ করে মানসিক প্রদাহ নিবৃত্ত করতে চাননি।
সবশেষে একটি কথা বলা প্রয়োজন। এইরূপ মানসিক যন্ত্রণার সময়ে তিনি অখিল-উদ্দিন নামে এক অন্ধ বাউলের দেহতত্ত্ববিষয়ক গান শুনতে ভালবাসতেন। এখানে তার দুএকটি উলেখ করি :
১। কোথায় ভুলে রয়েছ ও নিরঞ্জন করবে রে কে,
তুমি কোনখানে খাও কোথায় থাকো রে মন অটল হয়ে,
কোথায় ভুলে রয়েছে।
২। তুমি আপনি নৌকা, আপনি নদী, আপনি দাঁড়ি,
আপনি মাঝি,
আপনি হও যে করণধারজী, আপনি হও যে নায়ের কাছি,
আপনি হও রে হাইল-বৈঠা।
৩। তুমি আপনি মাতা, আপনি পিতা,
আমার নামটি রাখবো কোথা, সে নাম হৃদয়ে গাঁথা
আমার গোঁসাইচাঁদ বাড়লে বলে, সে নাম ভুলবো না রে
প্রাণ গেলে।
৪। তুমি আপনি অসার, আপনি হও সার,
আপনি হও সে নদীর দু'ধার, আপনি হও নদীর কিনার,
আমি অগাধ জলে ডুব দিতে যাই, সে নাম ভুলবো
নারে প্রাণ গেলে।
৫। আপনি তরো, আপনি আরা, আপনি জরা, আপনি মরা,
আপনি হও যে নদীর পাড়া, আবার আপনি হও সে
শ্মশানকর্তা গো, .
আপনি হও সে জলের মীন, ও নিরঞ্জন, তোর
কোথায় সাকিম গো,
আমি ভেবে চিন্তে হলেম ক্ষীণ।
শেষজীবনে বিদ্যাসাগর সত্যই কি পারের কাণ্ডারী নিরঞ্জনের ডাক শুনতে পেয়েছিলেন? গোঁসাইচাঁদ বাউলের মতো তিনিও কি আকুল আর্তনাদে জীবনের সায়াহ্ন-আকাশতলে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, “ও নিরঞ্জন, তোর কোথায় গো সাকিম।” রামেন্দ্রসুন্দরের কথা উল্লেখ করে বলতে পারি, এ-বিষয়ে চূড়ান্ত “মীমাংসা হইল না” (জিজ্ঞাসা)। বিদ্যাসাগরের অর্ন্তলোকে প্রবেশ করে তাঁর চিত্তধাতুর গঢ় রহস্য সন্ধান করা আমাদের সাধ্যাতীত। তবে এইটুকু বলা যেতে পারে, তাঁর হৃদয় মানবপ্রেমে কানায় কানায় ভরে উঠলে তিনি জীবের দুঃখ দেখে ভাবাবেগের বশে পরম কারুণিক ঈশ্বরের অস্তিত্বে ক্ষণিকের জন্য সন্দিহান হয়ে পড়তেন, হৃদয়ই তখন তাঁর সমস্ত চিত্তপ্রবৃত্তি ও কর্মপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রিত করত। কিন্তু পরে ভাবাবেগ প্রশমিত হলে তিনি শান্তচিন্তে যুক্তির সাহায্যে এ বিষয়ের যাথার্থ্য অনুসন্ধানের চেষ্টা করতেন। কিন্তু আগুয়েস্ত্ কঁতের মতো তিনি নিছক তত্ত্ববাদী ছিলেন না, রামমোহনের মতো তাকে বলা চলবে না- “His cardinal principle was that service of man is the service of God.” মানবসেবাই তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র ছিল কিন্তু তাকেই সােপান করে ঈশ্বর-সান্নিধ্য পৌছাবার সূক্ষতম পন্থা আবিষ্কারে তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল না। কিশোরীচাদ মিত্র রামমোহনকে ‘Theo-philanthropist' বলেছিলেন। কিন্তু বিদ্যাসাগরের Philanthropy-তে কোন theos-এর সম্পর্ক ছিল না। মানুষের দুঃখ দূর করাই তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, তদতিরিক্ত কোন পূণ্যফল তিনি কামনা করতেন না। মানবপ্রেমই ঈশ্বরপ্রেমে উদ্বর্তিত হয়, একথা ভক্তিশাস্ত্র বলে। কিন্তু এ সম্বন্ধে তিনি বিশেষ আগ্রহী বা কৌতুহলী ছিলেন না। তাঁর মতাদর্শ সম্বন্ধে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেণী বলেছেন: “বিদ্যাসাগর সেই শাক্যমুনি-প্রদর্শিত বৈরাগ্য মার্গের ও কর্ম মার্গের পথিক ছিলেন। ... তিনি যে মার্গে চলিতেন, তাহা আর্যসম্মত, মানবসম্মত সনাতন ধর্মমার্গ।” (ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর) বিদ্যাসাগরের পথ বিশেষ কোন শাস্ত্রসম্মত অথবা বৈরাগ্য ধর্মাবলম্বী কিনা তাতে বিশেষ সন্দেহ আছে। মানুষের প্রতি অকুণ্ঠ প্রেম, মানববেদনার প্রতি অগাধ সহানুভূতি এবং মানবদুঃখ দূর করবার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ তাকে বৈরাগ্যধর্মী করেনি, বরং তাঁর মানসশক্তিকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। তিনি নাস্তিক ছিলেন কিনা তার যথার্থ উত্তর দেওয়া দুরূহ। কিন্তু তাকে নিশ্চয় বলা চলবে, “হে নাস্তিক, আস্তিকের গুরু।” মানুষই তাঁর ধর্ম, মানুষই তাঁর সাধনা, মানুষ তাঁর আধার এবং আধেয়। পাশ্চাত্য positivist দার্শনিকের মতো মানবতরের নির্যাস নয়, মানুষের দুঃখদুর্দশাপূর্ণ কবোষ্ণ স্পর্শই তাঁর কাম্য ছিল। নরের মধ্যে নরোত্তম ও নারায়ণকে তিনি দর্শন করেছিলেন কিনা জানি না। কিন্তু নরদেহই তাঁর কাছে দেবমন্দির; নরদুঃখ লাঘবের জন্য সব সমৰ্পণ তাঁর যজ্ঞহবিঃ। বিদ্যাসাগর পরম আস্তিক্যবাদী, কারণ তিনি মানববাদী। মানুষের চেয়ে অধিকতর অস্তিত্ববান আর কে?
অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
বিদ্যাসাগরের তিরোধানের প্রায় আশী বৎসর পরে তাঁর ধর্মবিশ্বাস নিয়ে জল্পনার হেতু ও তাঁর যৌক্তিকতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসু ব্যক্তি প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারেন। মানবপ্রেমে আকন্ঠমগ্ন দেশহিতব্রতী বিদ্যাসাগর আজ দেবমূর্তিতে পরিণত হয়েছেন। একাধিক স্থলে তাঁর মর্মর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কিন্তু তাঁর আসল অধিষ্ঠান মানুষের চিত্তলোকে। জ্ঞান, কর্ম, প্রেম পৌরুষের এমন সময় একব্যক্তির মধ্যে প্রায়ই দেখা যায় না। প্রাচীন রক্ষণশীল পরিবারে জন্মগ্রহণ করে, গ্রামীণ সংস্কারবিজড়িত পটভূমিকায় লালিত হয়ে এবং সংস্কৃত কলেজের প্রাচীন ঐতিহানুসারী শিক্ষাদীক্ষার অনুশীলন করে তিনি যে কীভাবে বিশুদ্ধ মানবপ্রেম, লোকহিতৈষণা এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর য়ুরোপীয় মানবতাবাদের অনুরূপ মানুষের কল্যাণচিন্তা নিজের অন্তলোকে স্থাপন করলেন, সে এক বিস্ময়ের ব্যাপার।
সে যুগে বিদ্যাসাগরকে কী দৃষ্টিতে দেখা হত, তার একটি দৃষ্টান্ত দিলেই বোঝা যাবে। তাঁর জীবিতকালেই তাঁর ছবি ছাপিয়ে বিক্রয় করা হত, এবং তা বাঙালীর ঘরে ঘরে স্থানলাভ করেছিল-সে-যুগে আর কোনও বাঙালী জননায়কের এ সৌভাগ্য ঘটেনি। তাঁর অসাধারণ কর্মনৈপুণ্য, করুণাঘন মানবকল্যাণব্রত এবং অনমনীয় পৌরুষ সে যুগেই তাকে বাঙালী ও শেতাঙ্গ সমাজে বিস্ময়কর স্বাতন্ত্র্য দিয়েছিল। তাঁর সম্বন্ধে কত গল্পকাহিনী কিংবদন্তী গড়ে উঠেছে। তাঁর ভক্ত, শিষ্য ও অনুরাগীরা তাঁর সম্বন্ধে পরবর্তীকালে অনেক ছোট বড় স্মৃতিকথা লিখে গেছেন। তা থেকে তাঁর একটি দিক সম্বন্ধে কৌতুহলী পাঠক নতুন দৃষ্টিলাভ করতে পারেন। সেটি হল তাঁর ধর্মমত, ঈশ্বরসত্তা ও পারমার্থিক চেতনা সম্বন্ধে তাঁর জ্ঞান-বিশ্বাস।
তাঁর জীবিতকালে যেমন তাঁর ভক্তসংখ্যার সীমা ছিল না, তেমনি আবার কেউ কেউ অন্তরালে তাঁর সমাজসংস্কার-সংক্রান্ত মতামত নিয়ে কিছু কিছু সমালোচনাও করতেন। হিন্দুর অনেকগুলি সযত্নলালিত সামাজিক আচার-আচরণকে বিদ্যাসাগর মানবপ্রেম ও করুণার দৃষ্টিকোণ থেকেই বিচার-বিশ্লেষণ করেছিলেন এবং বিবাবিবাহ প্রচার ও বহুবিবাহের বিরোধিতা দ্বারা নিজ অন্তরশায়ী অগ্নিগর্ভ পৌরুষের দিব্যালোকে অর্থহীন, মূঢ় ও নির্মম সমাজ-প্রকরণকে অযৌক্তিক, ঘৃণাই ও বিনাশযোগ্য প্রমাণ করেছেন। সংস্কার এমন গভীরভাবে যুগযুগান্ত ধরে আমাদের সত্তাকে আচ্ছন্ন করে থাকে যে, প্রাজ্ঞজনও সেই সমস্ত অভ্যস্ত আচার-আচরণের নাগপাশে জড়িত হয়ে কর্তব্য থেকে ভ্রষ্ট হন। বিদ্যাসাগর তাঁরই বিরুদ্ধে যে-অন্ত ধারণ করেছিলেন, তা শুধু ইয়ং বেঙ্গল বা নব্য শিক্ষিতজনের পশ্চিমঘেঁষা ‘রিফর্মেশন’ নয়। তিনি যুক্তির চেয়ে মানবপ্রেমের দ্বারা অধিকতর প্রভাবিত হয়ে এবং নারীর অশ্রুমোচনের সংকল্পে অটল থেকে মধ্যযুগীয় নাইটদের মতো বীরবিক্রমে অগ্রসর হয়েছেন। প্রেম ও করুণাই তাঁর সমগ্র চেতনাকে অধিকার করেছিল বলে তিনি অতি সহজেই সংস্কার ত্যাগ করে নিরঞ্জন সত্যকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন-যেরকম অনুরাগ ও মমতার সঙ্গে জননী তাঁর সন্তানকে অঙ্গে ধারণ করেন।
তবু প্রশ্ন উঠেছে, সে-যুগেও উঠেছিল-বিদ্যাসাগর কি প্রচলিত হিন্দুমতাদর্শানুসারে ঈশ্বরবিশ্বাসী আস্তিক্যবাদী পুরুষ ছিলেন? বাহ্যতঃ তিনি শীল হিন্দুসমাজের কোন কোন আচার-আচরণ সম্বন্ধে কিছু উদাসীন ছিলেন; উপরন্তু যে-সমস্ত পুরাতন সংস্কারের উপর আঘাত হেনেছিলেন সেগুলি ছিল সনাতনপন্থী হিন্দু-সমাজের প্রাণের সামগ্রী। সুতরাং তাঁর জীবিতকালেই তাঁর ধর্মমত নিয়ে আড়ালে-আবডালে অনেক আলোচনা হত। ছদ্মনামে লেখা তাঁর ‘ব্রজবিলাস'-এ তিনি বলেছেন যে, সেযুগের সমাজপতিরা তাকে গোপনে খ্রীষ্টান অপনাম দিয়ে নিন্দা করতেন। কারণ তিনি হিন্দুর সামাজিক সংস্কারগুলিকে সর্বদা শিরোধার্য করতেন না।
বিদ্যাসাগরকে নাস্তিক বলে প্রথম প্রচার করেন তাঁর শিষ্য ও অনুরাগী আচার্য কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য। বিদ্যাসাগরের তিরোধানের বহুকাল পরে কৃষ্ণকমল বিদ্যাসাগরের ধর্মমত সম্বন্ধে এই মত প্রকাশ করেন: “বিদ্যাসাগর নাস্তিক ছিলেন, এ কথা বোধ হয় তোমরা জান না; যাহারা জানিতেন, তাহারাও কিন্তু সে বিষয় লইয়া তাহার সঙ্গে কখনও বাদানুবাদে প্রবৃত্ত হইতেন না।... পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যের ভাব বন্যায় এদেশের ছাত্রের ধর্মবিশ্বাস টলিল, চিরকাল পোষিত হিন্দুর ভগবান সেই বন্যায় ভাসিয়া গেলেন, বিদ্যাসাগরও নাস্তিক হইবেন, তাহাতে আর বিচিত্র কি?” বিদ্যাসাগর জীবনীকার বিহারীলাল সরকার (বিদ্যাসাগর) এবং সুবলচন্দ্র মিত্র (Iswar Chandra Vidyasagar-Story of his life and works) রক্ষণশীল মনোবৃত্তিবশতঃ তাঁদের গ্রন্থে বিদ্যাসাগরের কোন কোন সমাজসংস্কারেচ্ছার প্রশংসা করতে পারেননি। তাদের ধারণা, বিদ্যাসাগর প্রবৃত্তিমুখী পাশ্চাত্য শিক্ষার সংস্পর্শে এসে হিন্দুর নিবৃত্তিমুখী সনাতন সংস্কারে আস্থা হারিয়ে ফেলেন। বিহারীলাল তো মুক্ত কন্ঠেই বলেছেন, “অধ্যাপকের বংশে জন্ম লইয়া ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের সন্তান হইয়া, হৃদয়ে অসাধারণ দয়া, পরদুঃখকাতরতা প্রবৃত্তি পোষণ করিয়া হিন্দুশাস্ত্রের প্রতি, হিন্দুধর্মের প্রতি তিনি আন্তরিক দৃষ্টি রাখিলেন না কেন?... বিদ্যাসাগর কালের লোক। কালধর্মই তিনি পালন করিয়া গিয়াছেন। ইহাতে হিন্দুর অনিষ্ট হইয়াছে; হিন্দুধর্মে আঘাত লাগিয়াছে। ...নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের বংশধর বিদ্যাসাগর, উপনয়নের পর অভ্যাস করিয়াও ব্রাহ্মণের জীবনসর্বস্ব গায়ত্রী পর্যন্ত ভুলিয়া গিয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর দয়া ও করুণার বশে হিন্দুর সনাতন ধর্মের অনাথাচরণ করেছিলেন, এমনকি উপনয়নের পর সন্ধ্যাবন্দনাদির মন্ত্রও ভুলে গিয়েছিলেন। এর থেকে বিহারীলাল অনুমান করেছেন যে, বালাকাল থেকেই হিন্দুর আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি তাঁর বিশ্বাস কিছু শিথিল হয়ে গিয়েছিল। উত্তরকালে শ্বেতাঙ্গ-সান্নিধ্যে এসে তিনি হিন্দুর নিত্যকর্মের প্রতি কিছু উদাসীন হয়ে পড়েছিলেন, এবং সেজন্য বিহারীলাল অনুযোগ করেছিলেন।
চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বিদ্যাসাগরের জীবনচরিতে ('বিদ্যাসাগর’ ১৮৯৫) এ-বিষয়ে আরও স্পষ্ট করে বলেছেন। তিনি বিদ্যাসাগরের অতিশয় মেহভাজন ছিলেন। সুতরাং তাঁর মতামত তথ্যসঙ্গত বলে গৃহীত হতে পারে। তাঁর মতে “তাহার (বিদ্যাসাগর) আচার-আচরণ হইতে যতদুর বুঝিতে পারা যায়, তাহাতে এইরূপ বোধ হয় যে, তিনি ঈশ্বরবিশ্বাসী লোক ছিলেন। তবে তাহার ধর্মবিশ্বাস, সাধারণ লোকের অনুষ্ঠিত কোন-এক পদ্ধতির অধীন ছিল না। সূক্ষতমরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখিতে গেলে, তাঁহার নিত্য-জীবনের আচার-ব্যবহার, ক্রিয়াকলাপসম্পন্ন আহবান হিন্দুর অনুরূপ ছিল না অপর দিকে নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মের লক্ষণের পরিচয়ও কখনও পাওয়া যায় নাই।” (বিদ্যাসাগর, পৃ ৫২০)। অর্থাৎ চণ্ডীচরণের মতে, বিদ্যাসাগর ধর্মবিশ্বাসের দিক থেকে বোধ হয় সম্প্রদায় চিহ্নহীন মধ্যপথ ধরেছিলেন। নৈষ্ঠিক হিন্দুর আচার-বিচারের প্রতি তাঁর যেমন খুব একটা আস্থা ছিল না; তেমনি অন্যদিকে রিফর্মড হিন্দু অথবা প্রগতিশীল ব্রাহ্মমতের প্রতিও তাঁর বিশেষ কোন আকর্ষণ ছিল না।
স্বল্পকথায় বলতে গেলে বলতে হয়, হিন্দুধর্মের লোকাচারের প্রতি তাঁর বিশেষ কোন আকর্ষণ ছিল না, এমন কি স্মার্ত আচারের প্রতি প্রত্যক্ষতঃ প্রতিকুলতা না করলেও এর যৌক্তিকতা সম্বন্ধে তাঁর পুরো বিশ্বাস ছিল না। মানবপ্রেমিক বিদ্যাসাগরের ধর্মীয় কৃত্যের প্রতি আত্যন্তিক আকর্ষণ না থাকাই স্বাভাবিক। একবার তিনি কৌতুকের বশে ভাটপাড়া-নিবাসী তাঁর কায়স্থবন্ধু অমৃতলাল মিত্রের অন্নের থালা থেকে কাড়াকাড়ি করে মাছের মুড়ো খেয়েছিলেন; এজন্য ভট্টপল্লীর ভট্টাচার্যগণ তাঁর উপর বিরূপ হয়েছিলেন বলে শোনা যায়। এ বিষয়ে দৃষ্টান্ত বাড়িয়ে লাভ নেই। তাঁর সমসাময়িক ব্যক্তিদের স্মৃতিকথা থেকে জানা যাচ্ছে, বিদ্যাসাগর সংস্কৃত ভাষা, সাহিত্য ও স্মৃতিসংহিতার আলোচনার মধ্যে ডুবে থাকলেও দৈনন্দিন আচার-বিচারে ঠিক স্মার্ত পণ্ডিত বা শাস্ত্রজী ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ছিলেন না। ধর্মকর্ম সংস্কার প্রভৃতিকে তিনি মানব কল্যাণের বাতায়ন থেকে দর্শন করতেই অভ্যস্ত ছিলেন। তাই বলে তিনি ডিরোজিওর মন্ত্রশিষ্যগণের মতো হিন্দুধর্ম ও আচারের বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে দাড়াননি। ব্রাহ্মণ সন্তানের যে সমস্ত সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান মানা কর্তব্য, তিনি মনে মনে তাঁর পোষকতা করুন আর নাই করুন, বাইরের দিকে তাঁর অন্যথাচরণ করেননি-জনম-মরণাদি স্মার্ত ক্রিয়াকর্মেরও তিনি যথাবিধি অনুষ্ঠান করতেন; আজীবন উপবীতধারী ব্রাহ্মণই ছিলেন। চিঠিপত্রাদির শিরোদেশে শ্রীহরির নাম স্মরণ করতেন, জনকজননীর দেহান্ত হলে বিদ্যাসাগর নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণসন্তানের মতোই ঔদৈহিক অনুষ্ঠান ও কৃ-শৌচকর্মাদি নির্বাহ করেছিলেন। সুতরাং তিনি যে তৎকালীন ধর্মসংস্কারকদের মতো হিন্দুয়ানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন তা মনে হয় না। অভ্যাস ও সংস্কারের বশে তিনি বাহ্যতঃ হিন্দুর আচার-অনুষ্ঠান মানতেন, কিন্তু লোকাচার দেশাচারের সঙ্গে মানবধর্ম ও হৃদয়ধর্মের বিরোধ বাধলে মানবপ্রেমিক বিদ্যাসাগর স্বচ্ছন্দে-লোকাচারকে নস্যাৎ করতে পারতেন।
তাঁর জীবনীকার ও অনুরাগী অন্তরঙ্গে তাঁর ধর্মবিশ্বাস সম্বন্ধে এমন দু-একটি মন্তব্য করেছেন যে, বাহ্যতঃ তাকে পুরোপুরি ঈশ্বরবাদী বলতে দ্বিধা হয়। তাই কেউ কেউ মনে করেন যে, তাকে নাস্তিক বলা না গেলেও সংশয়বাদী বললে সত্যের অপলাপ হবে না। এ বিষয়ে তিনি স্পষ্টতঃ কোন মতামত প্রকাশ করে যাননি। তাঁর আত্মচরিত অসম্পূর্ণ রচনা। এটি সম্পূর্ণ হলে তাঁর অন্তর্জীবনের ইতিহাস উদ্ঘাটিত হতে পারত। শোনা যায়, এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন যে, ধর্ম, পরলোক, ঈশ্বর প্রভৃতি বিষয়ে তাঁর গঢ় অভিমত তিনি প্রকাশ করতে আগ্রহী নন। একবার শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন। সেই সময়ে এ-বিষয়ে দুজনের মধ্যে কিছু আলাপ ও মতবিনিময় হয়েছিল। শ্রীরামকৃষ্ণ কর্মযোগী ও করুণাময় বিদ্যাসাগরের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎকার জন্য তাঁর বাড়ীতে এসে উপস্থিত হন। উভয়ের সাক্ষাৎকার ও আলাপের কিছু নমুনা ‘শ্রীম শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত” (৩য়) লিপিবদ্ধ করে গেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর সঙ্গে নানা তত্বকথার আলোচনা করে সর্বশেষে একটি গঢ় প্রশ্ন করলেন : (বিদ্যাসাগরের প্রতি সহস্যে) -“আচ্ছা তোমার কি ভাব? বিদ্যাসাগর মৃদু মৃদু হাসিতেছেন। বলিতেছেন, “আচ্ছা সেকথা আপনাকে একলা একদিন বলব।” (হীরামকৃষ্ণ কথামৃত, ৩য়, পৃ ১২, ১৩৭৪ সালের সং) এই উক্তি থেকে মনে হচ্ছে, সকলের সম্মুখে বিদ্যাসাগর নিজের মনোগত গঢ় কথা খুলে বলত চাননি। শ্রীরামকৃষ্ণের প্রশ্নটি অতি সহজ, সরল। তিনি বিদ্যাসাগরের কাছে নিস্কাম কর্মযোগ ব্যাখ্যা করছিলেন : “তুমি যেসব কর্ম করছে এতে তোমার নিজের উপকার। নিস্কামভাবে কর্ম করতে পারলে চিত্তশুদ্ধি হবে, ঈশ্বরের উপর তোমার ভালবাসা আসবে। ভালবাসা এলেই তাকে লাভর করতে পারবে।” (ঐ, পৃ ১৫) তারপর তিনি বিদ্যাসাগরকে উপদেশ দিলেন : “অন্তরে সােনা আছে, এখনও খবর পাও নাই। একটু মাটি চাপা আছে। যদি একবার সন্ধান পাও, অন্য কাজ কমে যাবে। আরো এগিয়ে যাও।” (ঐ, পৃ ১৫)। একথা বলার তাৎপর্য, নিষ্কাম কর্মযোগী বিদ্যাসাগর যেন উপায়কে লক্ষ্য ভেবে থেমে না যান। নিষ্কাম কর্ম হল উপায়, ঈশ্বরলাভই জীবের লক্ষ্য। আধারকে আধেয় ভাবলে সত্যদৃষ্টি স্বচ্ছতা হারিয়ে ফেলে। শ্রীরামকৃষ্ণের মন্তব্য বিদ্যাসাগরকে বোধ হয় ক্ষণকালের জন্য চিকিত করে তুলেছিল। বোধ হয় তিনি নিজের মানসসাগরতলে ক্ষণিকের জন্য ডুব দিয়েছিলেন এবং শ্রীরামকৃষ্ণের কথাটি ভাবতে শুরু করেছিলেন। তাই সকলের সামনে নিজের চিত্তপট মেলে ধরতে চাননি।
আর একবার নিজের গভীর প্রত্যয় সম্বন্ধে প্রশ্ন এইভাবেই এড়িয়ে গিয়েছিলেন। একদা কাশীধামে উপস্থিত হলে কোন এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ তাঁর কাছে এসে বলেন, “ধর্ম সম্বন্ধে কিছু জিজ্ঞাসা করিবার ইচ্ছা ছিল।” তার উত্তরে বিদ্যাসাগর বলেন, “আমার মত কাহাকে কখনও বলি নাই, তবে এই কথা বলি, গঙ্গাজলে যদি আপনার দেহ পবিত্র মনে করেন, শিবপূজায় যদি হৃদয়ের পবিত্রতা লাভ করেন তাহা হইলে তাহাই আপনার ধর্ম। এখানে লক্ষণীয় যে, বিদ্যাসাগর প্রধানতঃ ব্যক্তিগত মানিসকতার উপর জোর দিয়েছেন এবং ব্যক্তিগত প্রবণতার যৌক্তিকতা স্বীকার করেছেন। অর্থাৎ যে যেভাবে খুশি আচার-আচরণ গ্রহণ বা বর্জন করতে পারে। বিশেষ কোন সাম্প্রদায়িক প্রতীকতা বা ঈশ্বর সম্পর্কীয় অনুষ্ঠান ঈশ্বর সান্নিধ্য লাভের জন্য প্রয়োজনীয় নয়-তাঁর উক্ত উপদেশের এই হল তাৎপর্য। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে, ঈশ্বর-সংক্রান্ত তাঁর ব্যক্তিগত ধারণা ও নিজস্ব বিশ্বাস প্রকাশে তিনি বিরত হয়েছেন। বিশুদ্ধভাবে নাস্তিক্যবাদী হলে বা ঈশ্বরচেতনায় তাঁর পুরোপুরি অনীহা থাকলে নিজস্ব ধারণা ও সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করতে কুঠিত ধার পাত্র তিনি ছিলেন না। বস্তুতঃ ঈশ্বরচেতনা ও পারমার্থিকতা সম্বন্ধে তাঁর লেখনী-নিঃসৃত কোন ব্যক্তিগত অভিমত পাওয়া যায় না। এ-বিষয়ে তিনি অন্তরঙ্গদের সঙ্গে মাঝে মাঝে যে সমস্ত আলোচনা করতেন এবং এখানে-সেখানে সেসম্পর্কে যা বলতেন, তা থেকে তাঁর ধর্মবিশ্বাস সম্বন্ধে একটু আভাস পাওয়া যেতে পারে।
তাঁর ‘বোধোদয়’ সম্পর্কে একটা গল্প প্রচলিত আছে। জীবনীকার চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তা প্রচার করেছেন, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মচরিতের পরিশিষ্ট উক্ত গ্রন্থের সম্পাদক তা স্বীকারও করেছেন। ‘বোধোদয়-এর প্রথম সংস্করণে নানা পার্থিব জ্ঞানের পরিচয় থাকলেও ঈশ্বর-সংক্রান্ত কোন কথাই নেই। থাকবার কথাও নয়; এখন যিনি পদার্থবিজ্ঞানে বা অন্য কোন বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ লেখেন, তাতে কি তিনি পরম কারুণিক শ্রীভগবানের জয়ধ্বনি করেন? কিন্তু বোধধাদয়ে ঈশ্বরের উল্লেখ নেই দেখে বিদ্যাসাগরের অনুরাগী বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী প্রশ্ন তুললেন, “মহাশয় ছেলেদের জন্য এমন সুন্দর একখানি পাঠ্যপুস্তক রচনা করিলেন, বালকদের জানিবার সকল কথাই তাহাতে আছে, কেবল ঈশ্বর বিষয়ে কোন কথা নাই কেন?” তাঁর উত্তরে বিদ্যাসাগর বললেন, “যাহারা তোমার কাছে ঐরূপ বলেন, তাহাদিগকে বলিও, এইবার যে ‘বোধোদয়’ ছাপা হইবে, তাহাতে ঈশ্বরের কথা থাকিবেক।”
পরবর্তী সংস্করণে বিদ্যাসাগর ‘‘বোধোদয়” ঈশ্বর-বিষয়ক ক্ষুদ্র নিবন্ধ যোগ করে দেন। হয়তো তিনি বিজয়কৃষ্ণের কথায় মনে করেছিলেন, ঈশ্বর-বিষয়ে তাঁর ব্যক্তিগত অভিমত যাই হোক না কেন, পাঠ্যপুস্তক যথাসম্ভব নিঃস্পৃহভাবে রচনা করা উচিত। সাধারণ বালক বালিকারা যেমন পদার্থজগৎ থেকে জ্ঞান সংগ্রহ করবে, তেমনি ঈশ্বর সম্বন্ধেও তারা কিছু কিছু জানবে, পাঠ্যপুস্তকের সেই রকম লক্ষ্য হওয়া উচিত। এই ভেবেই বোধ হয় তিনি বিজয়কৃষ্ণের মন্তব্যের যৌক্তিকতা স্বীকার করেছিলেন। ঈশ্বর সম্বন্ধে তাঁর কোন অনমনীয় প্রতিকুল ধারণা থাকলে তিনি বিজয়কৃষ্ণের অনুরোধ রক্ষা করে ঈশ্বর-প্রসঙ্গের অবতারণা করতেন না। কারণ যুক্তিবিরোধী বা তাঁর অভিমতের বিরুদ্ধ কোন কথা তিনি কিছুতেই মানতে পারতেন না, অন্তরঙ্গ জনের জন্যও না।
ঈশ্বর সম্বন্ধে তাঁর ধারণা সম্পর্কে অনেকে অনেক কথাই বলেছেন, কিন্তু এককথায় এর মীমাংসা করা দুরূহ। নির্মম দেশাচারের তিনি ঘোর শত্রু ছিলেন। মানুষের দুঃখ দূরীকরণের জন্য তিনি অযৌক্তিক শাস্ত্রবচনকে তুচ্ছ করতে পারতেন, সেরকম দৃঢ় মনোবলের তিনি ছিলেন অমিত অধিকারী। মানবপ্রেম তাকে চিরাচরিত সংস্কারের প্রতি উদাসীন করে তুললে বিস্ময়ের কোন কারণ থাকবে না। নিজের উইলে বিদ্যাসাগর নানা হিতকর কর্মে অর্থ বরাদ্দ করে গেছেন বটে, কিন্তু দেবসেবা, মন্দির প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি পুণ্যকর্যে এক কপর্দকও ব্যয়ের নির্দেশ দেননি। পুরোপুরি ঈশ্বরবাদী হলে এবং এতৎসম্পর্কে প্রথাসিদ্ধ পথের অনুবর্তন করলে, এ বিষয়ে কিছু ইঙ্গিত বা নির্দেশ দিয়ে যেতেন। মাঝে মাঝে তিনি ভক্ত ও অনুচরদের সঙ্গে এ বিষয়ে যা দু'চার কথা আলোচনা করতেন এখানে সংক্ষেপে তার উল্লেখ করা যাচ্ছে : “এ দুনিয়ার একজন মালিক আছেন তা বেশ বুঝি, তবে ঐ পথে না চলিলে, নিশ্চয় তাহার প্রিয়পাত্র হইব, স্বর্গরাজ্য অধিকার করিব এ সকল বুঝিও না, আর লোককে তাহা বুঝাইবার চেষ্টাও করি না। লোককে বুঝিয়ে শেষটা কি ফ্যাসাদে পড়ে যাব? এতে নিজে কতশত অন্যায় কাজ করিয়া নিজের পাপের বোঝা ভারী করিয়া রাখিতেছি, আবার অন্যকে পথ দেখাতে গিয়া, তাহাকে বিপাকে চালাইয়া কি শেষটা পরের জন্য বেত খাইয়া মরিব? নিজের জন্য যাই হোক পরের জন্য বেত খেতে পারবে না বাপু। একার্য আমাকে দিয়ে হবে না। নিজে যেমন বুঝি, সেই পথে চলতে চেষ্টা করি, পীড়াপীড়ি দেখিলে বলিব এর বেশী বুঝিতে পারি নাই।”
এই মন্তব্য থেকে বিদ্যাসাগরের পারমার্থিক তত্ত্ব সম্পর্কে মতামত স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্বন্ধে তাঁর কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু পুরাণাদি শাস্ত্রগ্রন্থে ঈশ্বর সম্বন্ধে যা বলা হয়েছে তাতে তাঁর বিশেষ আস্থা নেই। ঈশ্বরের অস্তিত্ব তিনি বিশ্বাসী, কিন্তু ঈশ্বর বিষয়ক সাম্প্রদায়িক রীতিনীতিতে তাঁর বিশ্বাস নেই। এ বিষয়ে গুরু সেজে প্রচারের বা অপর কাউকে উপদেশ দানে তিনি ঘোর বিরোধী ছিলেন। এদিক থেকে মনে হলে, কীভাবে ঈশ্বর লাভ করা যায়, অথবা আদৌ লাভ করা যায় কি না, সে বিষয়ে তিনি কোনদিনই সংশয়াতীত হতে পারেননি। তিনি যে ধর্ম-সংক্রান্ত প্রচারকর্যের পক্ষপাতী ছিলেন না, তাতে কোন সন্দেহ নেই। বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ভক্তি পথে গিয়ে ধর্ম প্রচারণায় আত্মনিয়োগ করলে বিদ্যাসাগর পরিহাস করে তাকে জিজ্ঞাসা করেন, “তুমি নাকি কী একটা হয়েছ?” কিন্তু এ সব উক্তি থেকে তাকে কোনমতেই নাস্তিক বলা যাবে না। তিনি বিশ্বাস করতেন, ঈশ্বরবিষয়ক তত্ত্বকথা এমনভাবে সংগুপ্ত যে, যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে তার নাগাল পাওয়া যাবে না। অতএব অপরকে উপদেশ দেওয়াও অযৌক্তিক। তিনি যুক্তির আনুগত্যকে সার বলে মেনেছিলেন, তদতিরিক্ত পারমার্থিক চিন্তায় তাঁর আসক্তি ছিল না। বিজয়কৃষ্ণের ধর্ম প্রচারণাকে তিনি পরিহাস করেছিলেন। তার কারণ, তাঁর মতে ঈশ্বর সাধনা একান্তভাবে ব্যক্তিগত ধ্যানধারণার বস্তু, প্রচার বা বিতর্কের বিষয় নয়। হিন্দুদর্শনের তাত্ত্বিক দিকটি তাঁর নখদর্পণে ছিল, কিন্তু তার সাধনার দিক তাকে প্রভাবিত করতে পারেনি। অর্থাৎ ধর্ম ও দর্শনে তিনি নিঃস্পৃহ, বৈজ্ঞানিক ভাবাপন্ন তাত্ত্বিক মাত্র ছিলেন, উক্ত বিষয়কে বুদ্ধির খােলামাঠ থেকে তুলে নিয়ে রহস্যানুগ সাধ্যসাধনার সুড়ঙ্গপথে প্রেরণে বিশেষ উৎসাহী হননি। এ বিষয়ে একবার মহেন্দ্ৰনাথ গুপ্ত (“শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত”-এর সঙ্কলক ‘শ্রীম’) তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “আপনার হিন্দুদর্শন কেমন লাগে?” উত্তরে বিদ্যাসাগর বলেন, “আমার ত বোধ হয়, ওরা যা বুঝাতে গেছে বুঝাতে পারে নাই।” পরে মহেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ঈশ্বর বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি উত্তর দেন, “তাঁকে ত জানবার জো নেই। প্রত্যেকের চেষ্টা করা উচিত, যাতে জগতের মঙ্গল হয়।” এ বিষয়ে বিদ্যাসাগর খুব গভীর চিন্তার কথা স্বল্পক্ষরে বলেছেন। তাঁর মতে ঈশ্বর বাকপথাতীত, বাক্য ও মনের অগোচর। সুতরাং দর্শন গ্রন্থে ও তত্ত্বালোচনায় তাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে? তিনি যদি বাক্য-মনের অগোচর হন, তা হলে জীবের করণীয় কি? তার উত্তরে বিদ্যাসাগর বলবেন, জীবকেই ঈশ্বরজ্ঞানে সেবা করতে হবে, জীবহিতব্রতই মানুষের শ্রেষ্ঠ কর্তব্য। তাই বিদ্যাসাগর নরসেবাকেই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য বলে গ্রহণ করেছিলেন। অবশ্য নরের মধ্য দিয়ে নরোত্তম যাওয়া যায় কিনা, অথবা তার প্রয়োজন আছে কিনা এ বিষয়ে তিনি অতিশয় মিতবাক্।
ভারতীয় দর্শন সম্পর্কে মহেন্দ্রনাথের কাছে বিদ্যাসাগরের মন্তব্য থেকে মনে হচ্ছে, তিনি হিন্দুদর্শনের সীমা সম্বন্ধে অতিশয় সচেতন ছিলেন। দর্শন মূলতঃ বুদ্ধি-আশ্রয়ী। সুতরাং ইরানুভূতি বলে যদি কিছু থাকে, তবে সে বিষয়ে আম্বীক্ষিকী বিদ্যা ও তত্ত্বদর্শন কতটুকু সাহায্য করতে পারে? এই বুদ্ধির দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে তিনি বেদাত্ত ও সাংখ্যকে ভ্রান্তদর্শন বলতেও কুণ্ঠিত হননি।
একবার পুরীর সমুদ্রে ষ্টীমার ডুবির ফলে প্রায় ‘সাত-আটশ' নরনারী বালবৃদ্ধ মারা যায়। এ সংবাদে মুহ্যমান হয়ে তিনি সক্ষোভে মন্তব্য করেছিলেন : “দুনিয়ার মালিক কি আমাদের চেয়ে নিষ্ঠুর যে, নানা দেশের নানা স্থানের অসংখ্য লোককে একত্রে দুবাইলেন! আমি যাহা পারি না, তিনি পরম কারুণিক মঙ্গলময় হইয়া কেমন করিয়া ৭০০-৮০০ লোককে একত্রে ডুবাইয়া ঘরে ঘরে শোকের আগুন জ্বালিয়া দেন। দুনিয়ার মালিকের কি এই কাজ? এই সকল দেখিলে কেহ মালিক আছেন বলিয়া সহসা বোধ হয় না। এখানে দেখা যাচ্ছে যে, তাঁর হৃদয় মানবপ্রেমে এতই পূর্ণ ছিল যে, করুণাময় ঈশ্বরের রাজ্যে ঐ জাতীয় নির্মম ঘটনার কার্যকারণ খুঁজে পেতেন না। প্রত্যক্ষ জীবনবাণী বিদ্যাসাগরের পরে এর অভিমত প্রকাশ করাই স্বাভাবিক। তবে মাঝে মাঝে ঈশ্বর বিষয়ে নানা প্রসঙ্গে তাঁর মনে সংশয় জাগলেও জনক-জননীকে তিনি দেবতা বলে গ্রহণ করেছিলেন, অন্তত কাশীধামে পাখ-পুরোহিতের সঙ্গে বাগবিতণ্ডার সময়ে সেই অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন। তাঁর অভিমত থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, ধর্ম, ঈশ্বর প্রভৃতি তা সয়ে তাঁর ব্যক্তিগত ধারণা সাধারণের নিকট প্রকাশে ইচ্ছুক ছিলেন না, অর্থাৎ তাঁর ধারণা আর সাধারণের প্রচলিত ধারণা সম্ভবতঃ এক ছিল না বলেই তিনি নিজস্ব মতামত সম্বন্ধে তুষ্ণীভাব অবলম্বন করেছিলেন। তবে কি তিনি পারমার্থিকতা সম্পর্কে সংশয়বাদী ছিলেন? এ বিষয়ে স্পষ্ট কোন উত্তর পাওয়া কঠিন। ধর্মসাধনাকে তিনি নিতান্তই ব্যক্তিগত প্রবণতার ব্যাপার বলে দেখেছিলেন, এবং চিত্ত প্রণালীর বাইরে পারমার্থিকতার কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই, এ বিষয়ে তিনি দৃঢ় নিশ্চয় ছিলেন। গঙ্গাস্নান, শিবপূজা প্রভৃতি অনুষ্ঠানে কেউ যদি মনে করেন, এই-ই তাঁর ধর্ম সাধনা, তা হলে তাতেও বিদ্যাসাগরের আপত্তি নেই। ধর্মের সাধারণীকরণ নয়, ‘বিশ্লেষীকরণে’ তিনি বিশ্বাসী ছিলেন।
বিদ্যাসাগর পরলোক ও জন্মান্তর ব্যাপারেও সন্দিহান ছিলেন। ঈশ্বরতত্ত্বের সম্পর্কে তাঁর মনে মাঝে মাঝে সংশয় দেখা দিত, তিনি পরলোকতত্বে যে ঘোর সংশয়ী হবেন তাতে আর সন্দেহ কি? একবার রাধাপ্রসাদ রায়ের (রামপ্রসাদের পুত্র) দৌহিত্র ললিতমোহন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে এ বিষয়ে তাঁর কিছু পরিহাস মিশ্রিত আলোচনা হয়েছিল। ললিতমোহন পরলোকতন্ত্রে বিশেষ আসক্ত ছিলেন তাই নিয়ে বিদ্যাসাগর তাঁর সঙ্গে কৌতুক পরিহাস করতেন। ললিতমোহন যোগমার্গেও অনেকদূর অগ্রসর হয়েছিলেন। একদা বিদ্যাসাগর ললিতমোহনকে সপরিহাসে জিজ্ঞাসা করেন, “হরে ললিত, আমারও পরকাল আছে নাকি?” ললিতমোহন বললেন, “আছে বৈকি, আপনার এত দান, এত দয়া, আপনার পরকাল থাকিবে না ত’ থাকিবে কার?” এই আলাপ থেকে মনে হচ্ছে, লোকান্তর সম্পর্কে তিনি কখনও গভীরভাবে চিন্তাই করেননি, উক্ত ব্যাপার তাঁর কাছে হাসির ব্যাপার বলে মনে হয়েছিল। বাস্তব জীবনের দুঃখবেদনা নিয়ে তিনি এত ব্যস্ত ছিলেন যে, পরলোকের আশ্বাস তাঁর কাছে কোনও সান্ত্বনার বাণী বহন করে আনেনি।
বিধবাবিবাহ প্রচার ও বহুবিবাহের বিরুদ্ধে দাড়িয়ে তাকে পরবর্তীকালে অনেক মানসিক নিগ্রহ ভােগ করতে হয়েছিল। এমন কি এই ব্যাপারে বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়স্বজনও তাঁর বিরুদ্ধাচারণ করেছিলেন। ফলে শেষজীবনে মানসিক আঘাতে তিনি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। দেহে-মনে ক্লান্ত হয়ে তিনি মাঝে মাঝে কার্মাটারে গিয়ে সরলপ্রাণ সঁওতালদের সাহচর্যে কথঞ্চিৎ সান্ত্বনালাভের চেষ্টা করতেন। কারণ শিক্ষিত সভ্যতাভিমানী শহুরে বাঙালীর অকৃতজ্ঞতা এবং নিকট আত্মীয়ের নষ্টামির ফলে তিনি অতিশয় মুহ্যমান হয়ে পড়েন। এমনকি, একসময়ে তিনি সংসার ত্যাগ করে বৈরাগ্য অবলম্বনেও প্রস্তুত হয়েছিলেন এবং সেকথা পিতা, মাতা, ভ্রাতৃগণ ও সহধর্মিণীকে জানিয়ে পত্রযোগে লিখেছিলেন : “নানা কারণ আমার মনে সম্পূর্ণ বৈরাগ্য জন্মিয়াছে, আর আমার ক্ষণকালের জন্যও সাংসারিক কোন বিষয়ে লিপ্ত থাকিতে বা কাহারও সহিত কোন সংষব রাখিতে ইচ্ছা নাই। এজন্য স্থির করিয়াছি, যতদূর পারি নিশ্চিত হইয়া জীবনের অবশিষ্ট ভাগ নিভৃতভাবে অতিবাহিত করিব।” (পিতার নিকট লিখিত পত্র) এখানে লক্ষণীয়-মানসিক বিপর্যয়ের সময়ও ঈশ্বরসান্নিধ্য লাভের জন্য তিনি কোন আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেননি। এই রকম মনের অবস্থায় অনেকে গীতার ‘যথা নিযুক্তোহস্মি’ বাণী অথবা রবীন্দ্রনাথের ‘সংসারেতে ঘটিলে ক্ষতি লভিলে শুধু বঞ্ছনা, নিজের মনে না জানি মানি ক্ষয়”-উক্তি অবলনে জীবন রণাঙ্গনে ক্ষতবিক্ষত হয়ে শান্তি প্রলেপ দিয়ে থাকেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর সাধারণ ধাতুপ্রকৃতির মানুষ ছিলেন না। তাই সে সান্ত্বনাও তাঁর ছিল না। তাঁর এই সময়ের চিঠিপত্রাদি থেকে দেখা যাচ্ছে, তাঁর দেহ ও মন ভেঙে পড়েছিল; পুত্র ও ভ্রাতাদের সঙ্গে মনোমালিন্য তাঁর মনঃকষ্টকে আরও তীব্র করে তুলেছিল। কিন্তু পত্রাদির কোথাও তিনি ঈশ্বরকরুণার উল্লেখ করে মানসিক প্রদাহ নিবৃত্ত করতে চাননি।
সবশেষে একটি কথা বলা প্রয়োজন। এইরূপ মানসিক যন্ত্রণার সময়ে তিনি অখিল-উদ্দিন নামে এক অন্ধ বাউলের দেহতত্ত্ববিষয়ক গান শুনতে ভালবাসতেন। এখানে তার দুএকটি উলেখ করি :
১। কোথায় ভুলে রয়েছ ও নিরঞ্জন করবে রে কে,
তুমি কোনখানে খাও কোথায় থাকো রে মন অটল হয়ে,
কোথায় ভুলে রয়েছে।
২। তুমি আপনি নৌকা, আপনি নদী, আপনি দাঁড়ি,
আপনি মাঝি,
আপনি হও যে করণধারজী, আপনি হও যে নায়ের কাছি,
আপনি হও রে হাইল-বৈঠা।
৩। তুমি আপনি মাতা, আপনি পিতা,
আমার নামটি রাখবো কোথা, সে নাম হৃদয়ে গাঁথা
আমার গোঁসাইচাঁদ বাড়লে বলে, সে নাম ভুলবো না রে
প্রাণ গেলে।
৪। তুমি আপনি অসার, আপনি হও সার,
আপনি হও সে নদীর দু'ধার, আপনি হও নদীর কিনার,
আমি অগাধ জলে ডুব দিতে যাই, সে নাম ভুলবো
নারে প্রাণ গেলে।
৫। আপনি তরো, আপনি আরা, আপনি জরা, আপনি মরা,
আপনি হও যে নদীর পাড়া, আবার আপনি হও সে
শ্মশানকর্তা গো, .
আপনি হও সে জলের মীন, ও নিরঞ্জন, তোর
কোথায় সাকিম গো,
আমি ভেবে চিন্তে হলেম ক্ষীণ।
শেষজীবনে বিদ্যাসাগর সত্যই কি পারের কাণ্ডারী নিরঞ্জনের ডাক শুনতে পেয়েছিলেন? গোঁসাইচাঁদ বাউলের মতো তিনিও কি আকুল আর্তনাদে জীবনের সায়াহ্ন-আকাশতলে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, “ও নিরঞ্জন, তোর কোথায় গো সাকিম।” রামেন্দ্রসুন্দরের কথা উল্লেখ করে বলতে পারি, এ-বিষয়ে চূড়ান্ত “মীমাংসা হইল না” (জিজ্ঞাসা)। বিদ্যাসাগরের অর্ন্তলোকে প্রবেশ করে তাঁর চিত্তধাতুর গঢ় রহস্য সন্ধান করা আমাদের সাধ্যাতীত। তবে এইটুকু বলা যেতে পারে, তাঁর হৃদয় মানবপ্রেমে কানায় কানায় ভরে উঠলে তিনি জীবের দুঃখ দেখে ভাবাবেগের বশে পরম কারুণিক ঈশ্বরের অস্তিত্বে ক্ষণিকের জন্য সন্দিহান হয়ে পড়তেন, হৃদয়ই তখন তাঁর সমস্ত চিত্তপ্রবৃত্তি ও কর্মপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রিত করত। কিন্তু পরে ভাবাবেগ প্রশমিত হলে তিনি শান্তচিন্তে যুক্তির সাহায্যে এ বিষয়ের যাথার্থ্য অনুসন্ধানের চেষ্টা করতেন। কিন্তু আগুয়েস্ত্ কঁতের মতো তিনি নিছক তত্ত্ববাদী ছিলেন না, রামমোহনের মতো তাকে বলা চলবে না- “His cardinal principle was that service of man is the service of God.” মানবসেবাই তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র ছিল কিন্তু তাকেই সােপান করে ঈশ্বর-সান্নিধ্য পৌছাবার সূক্ষতম পন্থা আবিষ্কারে তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল না। কিশোরীচাদ মিত্র রামমোহনকে ‘Theo-philanthropist' বলেছিলেন। কিন্তু বিদ্যাসাগরের Philanthropy-তে কোন theos-এর সম্পর্ক ছিল না। মানুষের দুঃখ দূর করাই তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, তদতিরিক্ত কোন পূণ্যফল তিনি কামনা করতেন না। মানবপ্রেমই ঈশ্বরপ্রেমে উদ্বর্তিত হয়, একথা ভক্তিশাস্ত্র বলে। কিন্তু এ সম্বন্ধে তিনি বিশেষ আগ্রহী বা কৌতুহলী ছিলেন না। তাঁর মতাদর্শ সম্বন্ধে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেণী বলেছেন: “বিদ্যাসাগর সেই শাক্যমুনি-প্রদর্শিত বৈরাগ্য মার্গের ও কর্ম মার্গের পথিক ছিলেন। ... তিনি যে মার্গে চলিতেন, তাহা আর্যসম্মত, মানবসম্মত সনাতন ধর্মমার্গ।” (ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর) বিদ্যাসাগরের পথ বিশেষ কোন শাস্ত্রসম্মত অথবা বৈরাগ্য ধর্মাবলম্বী কিনা তাতে বিশেষ সন্দেহ আছে। মানুষের প্রতি অকুণ্ঠ প্রেম, মানববেদনার প্রতি অগাধ সহানুভূতি এবং মানবদুঃখ দূর করবার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ তাকে বৈরাগ্যধর্মী করেনি, বরং তাঁর মানসশক্তিকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। তিনি নাস্তিক ছিলেন কিনা তার যথার্থ উত্তর দেওয়া দুরূহ। কিন্তু তাকে নিশ্চয় বলা চলবে, “হে নাস্তিক, আস্তিকের গুরু।” মানুষই তাঁর ধর্ম, মানুষই তাঁর সাধনা, মানুষ তাঁর আধার এবং আধেয়। পাশ্চাত্য positivist দার্শনিকের মতো মানবতরের নির্যাস নয়, মানুষের দুঃখদুর্দশাপূর্ণ কবোষ্ণ স্পর্শই তাঁর কাম্য ছিল। নরের মধ্যে নরোত্তম ও নারায়ণকে তিনি দর্শন করেছিলেন কিনা জানি না। কিন্তু নরদেহই তাঁর কাছে দেবমন্দির; নরদুঃখ লাঘবের জন্য সব সমৰ্পণ তাঁর যজ্ঞহবিঃ। বিদ্যাসাগর পরম আস্তিক্যবাদী, কারণ তিনি মানববাদী। মানুষের চেয়ে অধিকতর অস্তিত্ববান আর কে?
বই নিয়ে শুধুমাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, বই নিয়ে শুধু মাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, নতুন প্রজন্ম চকঝমকের আকর্ষণে বইয়ের দিক থেকে ঘুরিয়ে নিচ্ছে মুখ। আমাদের এ আয়োজন বইয়ের সাথে মানুষের সম্পর্ককে অনিঃশেষ ও অবিচ্ছিন্ন করে রাখা। আশাকরি আপনাদের সহযোগিতায় আমাদের এই ইচ্ছা আরোও দৃঢ় হবে। দুনিয়ার পাঠক এক হও! বাংলা বই বিশ্বের বিবিধ স্থানে, সকল বাংলাভাষীর কাছে সহজলভ্য হোক!