ভূতের কষ্ট
হাসান আজিজুল হক
নিমগাছের ডালে বসেছিলো হাভাতে ভূত। ছয় ফ্লাটের বিরাট বাড়িটার একটা জানালার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে চেয়ে ভাবছিলো ঢুকে পড়বে কিনা। এই সময় ঝপ করে জানলা বন্ধ হয়ে গেল। হাভাতে ভূত চেয়ে দেখলো জানলার উপরের দিকের কাচ দিয়ে রান্নাঘরটা দেখা যাচ্ছে। বাসায় ঝি ঝন্ ঝন্ ঠক্ ঠক্ শব্দে হাঁড়ি পাতিল মাজছে। আফসোস্ হলো হাভাতের, এখন সে ভিতরে ঢুকবে কি করে? ঝি বেটিকে বাগে আনার চমৎকার সুযোগ ছিলো। জানলা খোলা থাকতে ঢুকে পড়লেই হতো, এখন তো আর ঢোকা সম্ভব নয়। অনেকের ধারণা, ভূত ইচ্ছে করলেই যেখানে খুশি যেতে পারে—দরজা জানলা বন্ধ থাকলেও তাদের কিছু এসে যায় না। তারা দেয়াল ভেদ করে ঘরে ঢোকে। ভূতদের সম্বন্ধে এই রকম ধারণা ঠিক নয়। হাভাতে যখন ভূত হয়নি তখন তারও এই রকম ধারণা ছিলো। কিন্তু এখন ভূত হবার পরে সে দেখছে যে, তার মূল অসুবিধে হচ্ছে সে বর্তমান নয়, অতীত। সে এখন নেই, কোনো এক সময়ে ছিলো। তার মানে, সে কোথাও ঠিক উপস্থিত নেই। কোথাও উপস্থিত হলে নিজেও যেমন সেটা বিশ্বাস করতে পারে না, অন্যেরাও বিশ্বাস করে না। ভূত হয়ে যাবার পরে হাভাতে এমন সব অসুবিধের মুখোমুখি হবে চিন্তাও করেনি। সে যখন খুশি অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে ঠিকই—বলতে গেলে অদৃশ্য হওয়াটাই তার একমাত্র সুবিধে—এ জন্য তাকে চেষ্টাই করতে হয় না। অদৃশ্য যেন সে হয়েই আছে। খুব কষ্ট করেই সে দৃশ্য হতে পারে। হাত পা মাথামুণ্ডু প্রাণপণ চেষ্টায় এক জায়গায় করে সে দৃশ্যমান হতে চায়, কি রকম বিজ বিজ করে সব আলাদা হয়ে যায়, হাভাতে কিছুতেই ঠেকাতে পারে না। মাটি থেকে পাঁচতলা ছাদটায় লাফ দেওয়া, হুস করে উড়ে যাওয়া এসব সে সহজেই পারে। ইচ্ছেমতো ছোটো বড়োও সে মোটামুটি হতে পারে। কিন্তু দেয়াল ভেদ করে যাওয়া বা জানলা বন্ধ থাকলেও ঘরে ঢুকে পড়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। খোঁজ নিয়ে জেনেছে কোনো ভূতের পক্ষেই তা সম্ভব নয়। দেহের সুবিধে প্রায় কিছুই নেই কিন্তু অসুবিধে সবই আছে।
হাভাতে বরাবরের ভূত নয়। হালে হয়েছে। সে রাতটা তার খুব মনে পড়ে। তিন ছেলেমেয়ে বউ সুদ্ধ উপোস চলছিলো। আর শালার বৃষ্টি পনেরো দিনেও ধরে না। সন্ধে নামলো। অন্ধকারের মধ্যে একটানা বৃষ্টি হতে লাগলো। বিদ্যুৎ চমকানি নেই, মেঘ ডাকাডাকি নেই, বাতাসের আওয়াজ নেই, একঘেয়ে ঝম্ ঝম্ বৃষ্টির শব্দ শুধু। শুনতে শুনতে হাভাতের মনে হলো পৃথিবীর কোথাও কোনো মানুষ বেঁচে নেই, বেঁচে থাকার দরকারও নেই। বৃষ্টি হতে হতে পৃথিবীটাই গলে ধুয়ে উবে যাবে। ওর নিজের এখন একমাত্র কাজ হচ্ছে, গলায় দা দিয়ে এক এক করে ছেলেমেয়ে তিনটে আর বউটাকে সাবাড় করে দেওয়া।
চালের ছ্যাঁদা দিয়ে ঘরের মধ্যে নানা জায়গায় বৃষ্টি পড়ছে। কোণে একটা কালিভরা হারিকেন। আরেকটু পরেই নিভে যাবে। এখন গল গল করে ধোঁয়া ছাড়ছে। এমন তীব্র নেশা এলো হাভাতের যে বউ ছেলেমেয়ে খুন করা পর্যন্ত তার তর হইলো না। ঘরের আড়ায় ছেঁড়া চাদর ছুঁড়ে সে ঝুলে পড়লো। ফট করে ঘাড় ভেঙে সে-ও মরলো, চাদরটাও ছিঁড়ে তাকে নিয়ে মাটিতে নেমে এলো।
মরার কালে হাভাতের শরীরে একটি জিনিসই ছিলো—তীব্র খিদে। বেঁচে থাকার সময় সে শুনেছিলো, মরলে সব জ্বালা যন্ত্রণা জুড়িয়ে যায়। মানুষ খিদেতেষ্টা, রোগযন্ত্রণা, হাগামোতা সব কিছুর উপরে উঠে যায়। মরার পর হাভাতে দেখলো সব ভুল। পেট নেই খিদে আছে। পেট থাকলে খিদের চোটে চোখে অন্ধকার দেখে পেটে কাপড় বাঁধা যায়। কিন্তু পেট না থাকলে সেটা করা যায় না। তবে ভূতদের একটা সুবিধের কথা হচ্ছে, তারা যে যা যন্ত্রণা নিয়ে মরেছিলো ঠিক সেই যন্ত্রণা ছাড়া অন্য আর কোনো কষ্টযন্ত্রণা ভোগ করে না। খিদে নিয়ে হাভাতে মরেছিলো। এখন খিদে ছাড়া তার আর কোনো বোধ নেই। বউটাও তো কদিন পর মরেছে। মাঝে মাঝে দেখাও হয়। জ্যান্ত থেকে সংসার করার সময় বউটাকে মাঝে মাঝে দখল করার জন্যে যে তীব্র খিঁচুনি হতো তার মধ্যে—কই, সে সব তো আর একবারও মনে হয়নি। ও বেটি ছানা তিনটের জন্যে হেদিয়ে মরছে।
যাক, এখন কথা হচ্ছে, রান্নাঘরের জানলা তো বন্ধ হয়ে গেলো। অতোবড়ো বিল্ডিং-এর পিছন দিকের একটা জানলাও খোলা দেখা যাচ্ছে না। তাহলে সে করে কি এখন?
পেট ভরা অথচ পেট রোগা কাউকে তো এখন পাওয়া দরকার। একটা মেয়েমানুষ হলেই ভালো হয়। আঁ আঁ আঁ শব্দ করে চিৎ হয়ে পড়ে। ওর পেটের খাবারটা নিজের যে পেট নেই সেই পেটে নিতে সুবিধে হয়। যে সব ভুঁড়িওয়ালা ভদ্রলোকেরা ঐ বাড়িগুলিতে থাকে, ভরপেটে তারা যখন বিছানায় কাৎ হয়ে শুয়ে পান জাবর কাটে তখন তাদের কাছে যাওয়ার সাহস হাভাতের হয় না। যখন বেঁচে ছিলো তখন তাদের কাছে ঘেঁষতো না, এখনো তেমনি কাছে ঘেঁষতে চায় না।
হাভাতের পক্ষে আর খিদে সহ্য করা সম্ভব হচ্ছে না। এখানকার আশা ছেড়ে দিয়ে সে হঠাৎ হুস করে উড়ে তিনতলা, চারতলা বাড়িগুলির উপর দিয়ে বিকেলের রোদের মধ্যে মাটিতে ছায়ার কোনো চাপ না রেখে নদীপাড়ের গ্রামটিতে চলে এলো। তখন শীতের রোদ ঝিলমিল করছে। মাথা নামিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে নিচের দিকে চেয়ে দেখতে দেখতে হাভাতে উড়ছে। গালে হাত দিয়ে গাঁয়ের মানুষেরা বসে আছে, কেউ মাটির দাওয়ায়, ... কেউ সোঁদা গন্ধভরা অন্ধকার ঘরের স্যাঁতসেঁতে মেঝেয়। মেয়েরা উঠোনে বসে উকুন বেছে দিচ্ছে না বা চুল বাঁধছে না। শুধু এক জায়গায় দেখা গেলো উঠোনের একপাশে বসে এক কিশোরীর চুলের জট্ ছাড়ানো হচ্ছে।
মেয়েটা একবার কি বলতে গুম্ গুম্ করে তার পিঠে তিনটে কিল বসিয়ে দিল তার মা। হাভাতে খুঁজছিল একটি ভারভারন্ত বউ। দুপুরে ভরপেটে ভাত খেয়ে একটি পান মুখে দিয়ে শুয়েছে সে। স্বামী পাশে শুয়েছে। এখন ঘুমিয়ে চোখমুখ ফোলা। পেটটা এখনো ভরাট আছে। পেটে বাচ্চা আছে বলে খাবার হজম হতে অনেকটা সময় লাগে। এই রকম একটা বউ পেলে হাভাতে লাফিয়ে পড়তে পারে। কিন্তু কিছুতেই তেমন কাউকে খুঁজে পেলো না সে। এদিকে সন্ধ্যে হয়ে আসছে। একটু পরেই অন্ধকার নেমে আসবে। আলো বোধ হয় কোনো ঘরেই জ্বলবে না। হাভাতে দেখলো চিমসে শুকনো সব মেয়েরা ঘরে উঠোনে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কি আর করে সে? কলতলায় একটি যুবতীকে পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার উপর সে ভর করলো। কাজ হলো ঠিকই। আঁ আঁ আঁ শব্দ করে মেয়েটা দাঁতকপাটি লাগিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লো। কাজে লেগে গেল হাভাতে। হাঁজোর পাঁজোর করে ওর পুরো পেটটা ঝেড়ে নিল। নিজের তো পেট নেই। আছে ভীষণ খিদে। সেই খিদের আগুনে মেয়েটার পেট থেকে যা পাওয়া গেল সব নিয়ে নিলো হাভাতে। নিয়ে মেয়েটিকে ছেড়ে সে উঠে দাঁড়ালো। না, কিছুই জোটেনি তার। মেয়েটার চোখে মুখে পানি-টানি দেওয়া হচ্ছে। হাভাতে আরেকজনের খোঁজে এগিয়ে গেল হাঁফাতে হাঁফাতে। কেউ তো আর জানে না, একমাত্র ভূতই জানে, কারো উপর ভর করতে কি অসম্ভব পরিশ্রম করতে হয় তাদের। কিন্তু উপায় নেই। পুকুরের ঢালু পাড়ে প্রাকৃতিক কাজ সারছিলো এক প্রৌঢ়া। সে উঠে দাঁড়াতেই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো হাভাতে। বেচারি হাউ মাউ করে ঢালু বেয়ে গড়িয়ে একটা জমির আলে গিয়ে ঠেকলো; দাঁতকপাটি তারও লাগলো। কিন্তু হাভাতের লাভ হলো না কিছুই। শুকনো নাড়িভুঁড়ির গন্ধে ভূত হয়েও তার বমি এলো। অন্যের খাবার কেড়ে নেবার এমন চমৎকার সুবিধে ভূতের রয়েছে। কিন্তু কেউ যদি খাবারই না খায় তাহলে সে তৈরি করবার ক্ষমতা তো তাদের নেই। তিন তিনবার এই রকম ভর করবার ক্লান্তিতে হাভাতে আর একবার মরতে বসেছিলো প্রায়। এ সময় দেখা হয়ে গেলো তার নিজের বউ-এর সঙ্গে। ওকে দেখেই সে বুঝতে পারলো, ভালো-মন্দ ভালোই জমা পড়েছে তার পেটে। যদিও তার পেটই নেই।
রে রে রে করে শব্দহীন বিকট চিৎকারে সে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। হকচকিয়ে গেলেও বউ বুঝলো, এ তার পুরনো কামড়ানো অভ্যেস। সে কোনো রকম আপত্তি করার চেষ্টা করলো না। কিন্তু ভূত হয়ে যাবার পরে তার পক্ষেও কোনো কিছু আর টের পাওয়া সম্ভব নয়। কাজেই সে নিশ্চেষ্ট হয়ে শুয়ে রইল।
হাভাতে ভূত হাঁফাতে হাঁফাতে উঠে পড়ে বউ-এর দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে রইলো। তার খেয়াল হলো, ভূত জ্যান্ত মানুষের খাওয়া তার পেট থেকে খেয়ে নিতে পারে। মানুষ তা টের পায় না কিন্তু ভূত ভূতের খাওয়া লুট করতে পারে না তার পেট থেকে। হাভাতে লজ্জায় দুঃখে মিসমার হয়ে আবার নিমগাছের ডালে গিয়ে বসলো।
১৯৮২
হাসান আজিজুল হক
নিমগাছের ডালে বসেছিলো হাভাতে ভূত। ছয় ফ্লাটের বিরাট বাড়িটার একটা জানালার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে চেয়ে ভাবছিলো ঢুকে পড়বে কিনা। এই সময় ঝপ করে জানলা বন্ধ হয়ে গেল। হাভাতে ভূত চেয়ে দেখলো জানলার উপরের দিকের কাচ দিয়ে রান্নাঘরটা দেখা যাচ্ছে। বাসায় ঝি ঝন্ ঝন্ ঠক্ ঠক্ শব্দে হাঁড়ি পাতিল মাজছে। আফসোস্ হলো হাভাতের, এখন সে ভিতরে ঢুকবে কি করে? ঝি বেটিকে বাগে আনার চমৎকার সুযোগ ছিলো। জানলা খোলা থাকতে ঢুকে পড়লেই হতো, এখন তো আর ঢোকা সম্ভব নয়। অনেকের ধারণা, ভূত ইচ্ছে করলেই যেখানে খুশি যেতে পারে—দরজা জানলা বন্ধ থাকলেও তাদের কিছু এসে যায় না। তারা দেয়াল ভেদ করে ঘরে ঢোকে। ভূতদের সম্বন্ধে এই রকম ধারণা ঠিক নয়। হাভাতে যখন ভূত হয়নি তখন তারও এই রকম ধারণা ছিলো। কিন্তু এখন ভূত হবার পরে সে দেখছে যে, তার মূল অসুবিধে হচ্ছে সে বর্তমান নয়, অতীত। সে এখন নেই, কোনো এক সময়ে ছিলো। তার মানে, সে কোথাও ঠিক উপস্থিত নেই। কোথাও উপস্থিত হলে নিজেও যেমন সেটা বিশ্বাস করতে পারে না, অন্যেরাও বিশ্বাস করে না। ভূত হয়ে যাবার পরে হাভাতে এমন সব অসুবিধের মুখোমুখি হবে চিন্তাও করেনি। সে যখন খুশি অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে ঠিকই—বলতে গেলে অদৃশ্য হওয়াটাই তার একমাত্র সুবিধে—এ জন্য তাকে চেষ্টাই করতে হয় না। অদৃশ্য যেন সে হয়েই আছে। খুব কষ্ট করেই সে দৃশ্য হতে পারে। হাত পা মাথামুণ্ডু প্রাণপণ চেষ্টায় এক জায়গায় করে সে দৃশ্যমান হতে চায়, কি রকম বিজ বিজ করে সব আলাদা হয়ে যায়, হাভাতে কিছুতেই ঠেকাতে পারে না। মাটি থেকে পাঁচতলা ছাদটায় লাফ দেওয়া, হুস করে উড়ে যাওয়া এসব সে সহজেই পারে। ইচ্ছেমতো ছোটো বড়োও সে মোটামুটি হতে পারে। কিন্তু দেয়াল ভেদ করে যাওয়া বা জানলা বন্ধ থাকলেও ঘরে ঢুকে পড়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। খোঁজ নিয়ে জেনেছে কোনো ভূতের পক্ষেই তা সম্ভব নয়। দেহের সুবিধে প্রায় কিছুই নেই কিন্তু অসুবিধে সবই আছে।
হাভাতে বরাবরের ভূত নয়। হালে হয়েছে। সে রাতটা তার খুব মনে পড়ে। তিন ছেলেমেয়ে বউ সুদ্ধ উপোস চলছিলো। আর শালার বৃষ্টি পনেরো দিনেও ধরে না। সন্ধে নামলো। অন্ধকারের মধ্যে একটানা বৃষ্টি হতে লাগলো। বিদ্যুৎ চমকানি নেই, মেঘ ডাকাডাকি নেই, বাতাসের আওয়াজ নেই, একঘেয়ে ঝম্ ঝম্ বৃষ্টির শব্দ শুধু। শুনতে শুনতে হাভাতের মনে হলো পৃথিবীর কোথাও কোনো মানুষ বেঁচে নেই, বেঁচে থাকার দরকারও নেই। বৃষ্টি হতে হতে পৃথিবীটাই গলে ধুয়ে উবে যাবে। ওর নিজের এখন একমাত্র কাজ হচ্ছে, গলায় দা দিয়ে এক এক করে ছেলেমেয়ে তিনটে আর বউটাকে সাবাড় করে দেওয়া।
চালের ছ্যাঁদা দিয়ে ঘরের মধ্যে নানা জায়গায় বৃষ্টি পড়ছে। কোণে একটা কালিভরা হারিকেন। আরেকটু পরেই নিভে যাবে। এখন গল গল করে ধোঁয়া ছাড়ছে। এমন তীব্র নেশা এলো হাভাতের যে বউ ছেলেমেয়ে খুন করা পর্যন্ত তার তর হইলো না। ঘরের আড়ায় ছেঁড়া চাদর ছুঁড়ে সে ঝুলে পড়লো। ফট করে ঘাড় ভেঙে সে-ও মরলো, চাদরটাও ছিঁড়ে তাকে নিয়ে মাটিতে নেমে এলো।
মরার কালে হাভাতের শরীরে একটি জিনিসই ছিলো—তীব্র খিদে। বেঁচে থাকার সময় সে শুনেছিলো, মরলে সব জ্বালা যন্ত্রণা জুড়িয়ে যায়। মানুষ খিদেতেষ্টা, রোগযন্ত্রণা, হাগামোতা সব কিছুর উপরে উঠে যায়। মরার পর হাভাতে দেখলো সব ভুল। পেট নেই খিদে আছে। পেট থাকলে খিদের চোটে চোখে অন্ধকার দেখে পেটে কাপড় বাঁধা যায়। কিন্তু পেট না থাকলে সেটা করা যায় না। তবে ভূতদের একটা সুবিধের কথা হচ্ছে, তারা যে যা যন্ত্রণা নিয়ে মরেছিলো ঠিক সেই যন্ত্রণা ছাড়া অন্য আর কোনো কষ্টযন্ত্রণা ভোগ করে না। খিদে নিয়ে হাভাতে মরেছিলো। এখন খিদে ছাড়া তার আর কোনো বোধ নেই। বউটাও তো কদিন পর মরেছে। মাঝে মাঝে দেখাও হয়। জ্যান্ত থেকে সংসার করার সময় বউটাকে মাঝে মাঝে দখল করার জন্যে যে তীব্র খিঁচুনি হতো তার মধ্যে—কই, সে সব তো আর একবারও মনে হয়নি। ও বেটি ছানা তিনটের জন্যে হেদিয়ে মরছে।
যাক, এখন কথা হচ্ছে, রান্নাঘরের জানলা তো বন্ধ হয়ে গেলো। অতোবড়ো বিল্ডিং-এর পিছন দিকের একটা জানলাও খোলা দেখা যাচ্ছে না। তাহলে সে করে কি এখন?
পেট ভরা অথচ পেট রোগা কাউকে তো এখন পাওয়া দরকার। একটা মেয়েমানুষ হলেই ভালো হয়। আঁ আঁ আঁ শব্দ করে চিৎ হয়ে পড়ে। ওর পেটের খাবারটা নিজের যে পেট নেই সেই পেটে নিতে সুবিধে হয়। যে সব ভুঁড়িওয়ালা ভদ্রলোকেরা ঐ বাড়িগুলিতে থাকে, ভরপেটে তারা যখন বিছানায় কাৎ হয়ে শুয়ে পান জাবর কাটে তখন তাদের কাছে যাওয়ার সাহস হাভাতের হয় না। যখন বেঁচে ছিলো তখন তাদের কাছে ঘেঁষতো না, এখনো তেমনি কাছে ঘেঁষতে চায় না।
হাভাতের পক্ষে আর খিদে সহ্য করা সম্ভব হচ্ছে না। এখানকার আশা ছেড়ে দিয়ে সে হঠাৎ হুস করে উড়ে তিনতলা, চারতলা বাড়িগুলির উপর দিয়ে বিকেলের রোদের মধ্যে মাটিতে ছায়ার কোনো চাপ না রেখে নদীপাড়ের গ্রামটিতে চলে এলো। তখন শীতের রোদ ঝিলমিল করছে। মাথা নামিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে নিচের দিকে চেয়ে দেখতে দেখতে হাভাতে উড়ছে। গালে হাত দিয়ে গাঁয়ের মানুষেরা বসে আছে, কেউ মাটির দাওয়ায়, ... কেউ সোঁদা গন্ধভরা অন্ধকার ঘরের স্যাঁতসেঁতে মেঝেয়। মেয়েরা উঠোনে বসে উকুন বেছে দিচ্ছে না বা চুল বাঁধছে না। শুধু এক জায়গায় দেখা গেলো উঠোনের একপাশে বসে এক কিশোরীর চুলের জট্ ছাড়ানো হচ্ছে।
মেয়েটা একবার কি বলতে গুম্ গুম্ করে তার পিঠে তিনটে কিল বসিয়ে দিল তার মা। হাভাতে খুঁজছিল একটি ভারভারন্ত বউ। দুপুরে ভরপেটে ভাত খেয়ে একটি পান মুখে দিয়ে শুয়েছে সে। স্বামী পাশে শুয়েছে। এখন ঘুমিয়ে চোখমুখ ফোলা। পেটটা এখনো ভরাট আছে। পেটে বাচ্চা আছে বলে খাবার হজম হতে অনেকটা সময় লাগে। এই রকম একটা বউ পেলে হাভাতে লাফিয়ে পড়তে পারে। কিন্তু কিছুতেই তেমন কাউকে খুঁজে পেলো না সে। এদিকে সন্ধ্যে হয়ে আসছে। একটু পরেই অন্ধকার নেমে আসবে। আলো বোধ হয় কোনো ঘরেই জ্বলবে না। হাভাতে দেখলো চিমসে শুকনো সব মেয়েরা ঘরে উঠোনে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কি আর করে সে? কলতলায় একটি যুবতীকে পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার উপর সে ভর করলো। কাজ হলো ঠিকই। আঁ আঁ আঁ শব্দ করে মেয়েটা দাঁতকপাটি লাগিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লো। কাজে লেগে গেল হাভাতে। হাঁজোর পাঁজোর করে ওর পুরো পেটটা ঝেড়ে নিল। নিজের তো পেট নেই। আছে ভীষণ খিদে। সেই খিদের আগুনে মেয়েটার পেট থেকে যা পাওয়া গেল সব নিয়ে নিলো হাভাতে। নিয়ে মেয়েটিকে ছেড়ে সে উঠে দাঁড়ালো। না, কিছুই জোটেনি তার। মেয়েটার চোখে মুখে পানি-টানি দেওয়া হচ্ছে। হাভাতে আরেকজনের খোঁজে এগিয়ে গেল হাঁফাতে হাঁফাতে। কেউ তো আর জানে না, একমাত্র ভূতই জানে, কারো উপর ভর করতে কি অসম্ভব পরিশ্রম করতে হয় তাদের। কিন্তু উপায় নেই। পুকুরের ঢালু পাড়ে প্রাকৃতিক কাজ সারছিলো এক প্রৌঢ়া। সে উঠে দাঁড়াতেই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো হাভাতে। বেচারি হাউ মাউ করে ঢালু বেয়ে গড়িয়ে একটা জমির আলে গিয়ে ঠেকলো; দাঁতকপাটি তারও লাগলো। কিন্তু হাভাতের লাভ হলো না কিছুই। শুকনো নাড়িভুঁড়ির গন্ধে ভূত হয়েও তার বমি এলো। অন্যের খাবার কেড়ে নেবার এমন চমৎকার সুবিধে ভূতের রয়েছে। কিন্তু কেউ যদি খাবারই না খায় তাহলে সে তৈরি করবার ক্ষমতা তো তাদের নেই। তিন তিনবার এই রকম ভর করবার ক্লান্তিতে হাভাতে আর একবার মরতে বসেছিলো প্রায়। এ সময় দেখা হয়ে গেলো তার নিজের বউ-এর সঙ্গে। ওকে দেখেই সে বুঝতে পারলো, ভালো-মন্দ ভালোই জমা পড়েছে তার পেটে। যদিও তার পেটই নেই।
রে রে রে করে শব্দহীন বিকট চিৎকারে সে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। হকচকিয়ে গেলেও বউ বুঝলো, এ তার পুরনো কামড়ানো অভ্যেস। সে কোনো রকম আপত্তি করার চেষ্টা করলো না। কিন্তু ভূত হয়ে যাবার পরে তার পক্ষেও কোনো কিছু আর টের পাওয়া সম্ভব নয়। কাজেই সে নিশ্চেষ্ট হয়ে শুয়ে রইল।
হাভাতে ভূত হাঁফাতে হাঁফাতে উঠে পড়ে বউ-এর দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে রইলো। তার খেয়াল হলো, ভূত জ্যান্ত মানুষের খাওয়া তার পেট থেকে খেয়ে নিতে পারে। মানুষ তা টের পায় না কিন্তু ভূত ভূতের খাওয়া লুট করতে পারে না তার পেট থেকে। হাভাতে লজ্জায় দুঃখে মিসমার হয়ে আবার নিমগাছের ডালে গিয়ে বসলো।
১৯৮২
বই নিয়ে শুধুমাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, বই নিয়ে শুধু মাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, নতুন প্রজন্ম চকঝমকের আকর্ষণে বইয়ের দিক থেকে ঘুরিয়ে নিচ্ছে মুখ। আমাদের এ আয়োজন বইয়ের সাথে মানুষের সম্পর্ককে অনিঃশেষ ও অবিচ্ছিন্ন করে রাখা। আশাকরি আপনাদের সহযোগিতায় আমাদের এই ইচ্ছা আরোও দৃঢ় হবে। দুনিয়ার পাঠক এক হও! বাংলা বই বিশ্বের বিবিধ স্থানে, সকল বাংলাভাষীর কাছে সহজলভ্য হোক!