Ticker

6/recent/ticker-posts

বাঙালির খাদ্যকোষ - মিলন দত্ত

amarboi
বাঙালির খাদ্যকোষ
মিলন দত্ত

ছোটোবেলার এক মাস্টারমশাই কৌতুক করে বলতেন, ‘বঙ্গাল ডুবা খানে পে’। খাওয়া-দাওয়ার বিলাসিতাই যে বাঙালির পতন আর মূর্ছার কারণ এই সিদ্ধান্ত নানাজন নানা ভাবে নিয়েছিলেন। বাঙালি জাতির পতনের কারণ হিসেবে খাওয়া-দাওয়ার প্রতি এই দোষারোপ অন্য অনেক কিছুর মতোই উনিশ শতকে শুরু হয়েছিল— যুক্তি সাজানো হয়েছিল ইতিহাস-ভূগোল মেনেই। বাবু বঙ্কিমচন্দ্র, যিনি নিজেও কিছু কম খাদ্যরসিক ছিলেন না, তিনি বিবিধ প্রবন্ধে বাঙালিদের জানিয়ে দিয়েছিলেন ‘তেজোহানিকর ধান্য’ই উদ্যমী আর্যদের অলস করেছিল, পূর্বাংশে চলে আসা সেই আর্যতান্ত্রিক আলসেমির সন্তানদল আধুনিক বাঙালি নানা ভাবে তার মাশুল দিচ্ছে ইংরেজ উপনিবেশ পর্বে ও তার আগে, এই ছিল বঙ্কিমী সিদ্ধান্ত। গৃহসুখপরায়ণ, উদ্যমহীন ভাতখেকো বাঙালির জীবনে পরাধীনতা যেন অনিবার্য। খাওয়াদাওয়া নিয়ে ধর্মীয় বাছবিচারও কালে-কালে কিছু কম নয়। উনিশ শতকেই আবার নতুন করে কী খাবেন আর কী খাবেন না তার তালিকা নির্মিত হচ্ছে। শুধু ‘বাংলাভাষাজ্ঞানী’ ঈশ্বর গুপ্ত তো পাঁঠা, আন্ডাওয়ালা তপস্যামাছ, আনারস সব কিছু নিয়েই কাব্য করেন, হোটেলের চপ-কাটলেট বাদ যায় না। উদর পূর্তিতে গুপ্তকবির তেমন বাছবিচার নেই। স্বদেশের মানুষকে শক্তিশালী জাতি হিসেবে গড়ে তোলার জন্য অবশ্য সব কিছু খাওয়া চলবে না— স্বাস্থ্যকর, সহজপাচ্য, বলবর্ধক বস্তু খাওয়া চাই। বিবেকানন্দের ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ এই খাবেন-খাবেন না-র সরস তালিকা প্রদান করেছে।

শুধু খেলেই তো হবে না। কী ভাবে খাবেন, কোন পাত্রে খাবেন, কী ভাবে পরিবেশন করবেন তাও জানা চাই। এমনিতে বাঙালির শরীরে ছত্রিশ জাতের রক্ত মিলে মিশে গেছে। রান্নার রকমসকম তাই এক নয়। ঘটি-বাঙাল, হিন্দু-মুসলমান, শাক্ত-বৈষ্ণব কত যে ভেদ-বিভেদ। নানা গোষ্ঠীর নানা রান্না, নানা বাসন, নানা আসন। বিলিতি, দিশি কত ঘাটের জল খেয়ে বাঙালির বেঁচে থাকা। সব মিলিয়ে খাওয়াদাওয়ার জগৎ মোটেই অন্দর থেকে সিংহদুয়ার অবধি মাত্র নয়, সে এক বিস্তৃত পরিসর। আর খাওয়া তো শুধু বাইরের জিনিস নয়, মনেরও জিনিস। খাওয়ার বর্ণনায় যে পাত্রপাত্রীর মনের টানাপড়েন ধরা পড়ে তা কে না জানে। ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসে বিমলা যে সন্দীপকে হঠাৎ খাওয়াতে চাইল আর সন্দীপও যে বিশেষ হামলে পড়ে খেল সে কী আর এমনি-এমনি। মোদ্দা কথা হল ‘বঙ্গাল ডুবা খানে পে’ বলে বাঙালির এই খাওয়া-দাওয়ার বিষয়-আশয়কে খাটো করার উপায় নেই। এ বঙ্গ-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সংস্কৃতি বলতে কী বোঝায় তা নিয়ে নানা সময় বাঙালিদের বিস্তর তর্ক হয়েছে। সেরা তর্ক বোধহয় ‘কালচার’-এর প্রতিশব্দ কী হবে তাই নিয়ে হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ‘সংস্কৃতি’র পক্ষে। তাঁর মতে কালচার ‘অতিরিক্ত’, ‘সারপ্লাস’, প্রত্যেক দিনের বেঁচে থাকার থেকে সে আলাদা। গোপাল হালদারদের মতো মার্ক্সবাদীরা আবার ‘কৃষ্টি’ শব্দের পক্ষপাতী। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু মনে করতেন কৃষ্টির মূলে যে ধাতুটি আছে তার থেকেই কর্ষণ মানে চাষ-বাসের ভাবনার সূত্রপাত। এই প্রাত্যহিকের স্পর্শময় কৃষ্টি শব্দটি দিয়ে তাই অতিরিক্তের সংস্কৃতিকে ছোঁয়া যাবে না। বলার অপেক্ষা রাখে না এ রাবীন্দ্রিক সংস্কার। খাওয়া-দাওয়ার বঙ্গসংস্কৃতি প্রাত্যহিক-অপ্রাত্যহিক, অর্থনৈতিক-অনর্থনৈতিক সব কিছুকেই স্পর্শ করে আছে। আর সেই সংস্কৃতির আয়তন শুধু আধুনিকের পরিসরে সীমিত নয়, প্রাগাধুনিকের চালচিত্তিরটি জানা না-থাকলে আধুনিকের পথ-ঘাট অচেনা থেকে যাবে।

এই বিপুল বিষয় নিয়ে বইপত্র বাংলা ইংরেজিতে এখনও অবশ্য তত বেশি নয়। তবে নয় নয় করে বেশ কিছু আছে। বাংলায় রান্নার রেসিপি নিয়ে নানা বইপত্র, সে বইয়ের মধ্যে প্রাচীনতমটি নিয়ে খোলতাই গদ্য রচেছিলেন শ্রীপান্থ। সুকুমার সেন, বুদ্ধদেব বসু, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত, ওয়াকিল আহমেদ, প্রণব রায়, অরুণ নাগের খাদ্য-বিষয়ক রচনা বিশিষ্ট। তারাপদ সাঁতরা বাসনপত্র নিয়ে চমৎকার নিবন্ধ লিখেছিলেন। কিছুদিন আগে প্রকাশিত হয়েছে ঔপনিবেশিক ভারতের খাদ্য সংস্কৃতি নিয়ে ইংরেজিতে উৎসা রায়ের বই। কলকাতার রাস্তাঘাটের খাওয়াদাওয়া নিয়ে ভাস্কর মুখোপাধ্যায়ের নিবন্ধ আছে, ইংরেজিতে। ইতিহাস আর সংস্কৃতিবিদ্যার গবেষকরা বাঙালির খাওয়াদাওয়া নিয়ে নানা কারণে ইংরেজিতে প্রতর্ক লিখতে ইদানীং উদ্যত। বাঙালির উৎসবের খাওয়াদাওয়া নিয়ে কফি-টেবল বুকও চোখে পড়েছে। রোজকার খবরের কাগজে আজকাল খাওয়া-দাওয়া-বাজার নিয়ে নিয়মিত চোখ টানছে কিছু সরস লেখা। সব মিলিয়ে খাওয়াদাওয়ার আখ্যান এখন ‘ইন থিং’।

এই পর্বেই প্রকাশিত বাঙালির খাদ্যকোষ। মিলন দত্ত ‘পটকথা’য় জানিয়েছেন, তাঁর ‘বইটিতে মৌলিক চিন্তা বা গবেষণার কোনও দাবি নেই। বরং বাঙালির খাদ্য ও খাদ্যাভ্যাসকে সামগ্রিকভাবে দেখার প্রয়াস রয়েছে। রান্নার প্রণালী নেই বরং তার ইতিহাস বা মূল খোঁজার চেষ্টা হয়েছে।’ যে কোনও কোষগ্রন্থই সামগ্রিক পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করে। সে দিক থেকে বইটি কাজের। হাতে নিলে বাঙালির খাদ্য-সংস্কৃতির মোদ্দা-কাঠামোটি নানা কারুকার্য সহ চোখে ভাসে। বিশেষ করে মিলন অনেক দিন ধরেই সচেতন ভাবে জরুরি একটি কাজে নিবেদিত। বাঙালি হিন্দুরা যেন বাঙালি মুসলমানদের চিনতে পারেন এই তাঁর বাসনা। না হলে দুই বাঙালির দূরত্ব গভীর হবে। গল্প সংকলক, চলিত ইসলামি শব্দকোষ প্রণেতা মিলন তাঁর খাদ্যাখাদ্য বিচারের বইতেও মুসলমান বাঙালির ঘর-বাহির, উৎসব-আনন্দকে খাবার-দাবারের সূত্রে আমবাঙালির চোখের সামনে তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশের খাবারের কথা ও বাঙালি ইসলামি সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত খাওয়াদাওয়ার পরিচয় তুলে ধরেছে বইটি। খুসকা যে ঘি দিয়ে রান্না করা ভাত, ক’জন বাঙালি হিন্দু একথা জানেন ! এলোঝেলো পূর্ববঙ্গের উৎসবে ময়দা দিয়ে বানানো ভাজা মিষ্টি এও বোধকরি এদিককার বাঙালির অজানা। প্রাগাধুনিক বাংলা ও বাঙালির কথা এসেছে। কুটনো, তৈজসপত্র, উনুন এসবও বাদ পড়েনি। রান্নার সংস্কৃতির বর্ণ-গন্ধ-স্বাদ বেশ টাটকাই পাওয়া যাবে। বইটি মিতায়তন, ফলে হাতে নিয়ে উল্টে-পালটে দেখতে সুখ। পাঠক খেয়াল করবেন সাম্প্রতিক কালে দে’জ পাবলিশিং বইয়ের নির্মাণে আগের থেকে তুলনায় মনোযোগী হয়েছেন।
এই প্রাপ্তির পাশাপাশি কিছু আক্ষেপ থেকেই যায়। লেখ ও মৌখিক সাহিত্যের নথিখানা ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোষগ্রন্থকার সর্বত্র সমান মনোযোগী নন, কোথাও সাহিত্যের উদাহরণ ব্যবহার করেছেন কোথাও করেননি। যেমন আটকড়াই নিয়ে লোকায়ত ছড়াটি আসতেই পারত। খাদ্য নিয়ে কোষগ্রন্থ রচতে গেলে সাহিত্যের নথিখানা আঁতিপাতি করে দেখা চাই। ইকমিক কুকার নিয়ে একটি এন্ট্রি আছে। ইন্দুমাধব মল্লিকের ইকমিক কুকারের কথা হালের বাঙালি জানেন না। পুরনো সাময়িক পত্রে ইকমিক কুকারের বিজ্ঞাপনী ছবি পাওয়া যায়। তা সন্নিবিষ্ট করা যেত কোষগ্রন্থের শর্ত মেনেই। এই সব অপ্রাপ্তি সংস্করণ ভেদে পরিমার্জনায় মুছে যাবে বলেই মনে হয়।


বই নিয়ে শুধুমাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, বই নিয়ে শুধু মাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, নতুন প্রজন্ম চকঝমকের আকর্ষণে বইয়ের দিক থেকে ঘুরিয়ে নিচ্ছে মুখ। আমাদের এ আয়োজন বইয়ের সাথে মানুষের সম্পর্ককে অনিঃশেষ ও অবিচ্ছিন্ন করে রাখা। আশাকরি আপনাদের সহযোগিতায় আমাদের এই ইচ্ছা আরোও দৃঢ় হবে। দুনিয়ার পাঠক এক হও! বাংলা বই বিশ্বের বিবিধ স্থানে, সকল বাংলাভাষীর কাছে সহজলভ্য হোক!