অরিয়েন্টালিজম - এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদ
এডওয়ার্ড সাঈদ-এর অরিয়েন্টালিজম
ভূমিকা ও ভাষান্তর ফয়েজ আলম
গত শতকের অস্থির, দ্রুত পরিবর্তনমুখী বুদ্ধিবৃত্তিক আবহে এডওয়ার্ড সাঈদ ছিলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টিশীল চিন্তাবিদদের একজন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, বিশেষত ষাট ও সত্তরের দশকে সকল ধরনের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের কাছে আনত অসম্ভব একটা মানব-বিশ্বে সাঈদের আবির্ভাব প্রচণ্ড আলোড়নের মতো, যা নাড়িয়ে দেয় পশ্চিমের সাংস্কৃতিক আধিপত্য ও দমনের দীর্ঘ, স্থিতিশীল আয়োজন-উন্নত বিশ্বের সাংস্কৃতিক প্রভাবনের সূত্রে অর্জিত ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের মূল-ভিত্তির কৃত্রিম গ্রন্থিগুলো খুলে খুলে দেখায় এবং এভাবে অনুন্নত অঞ্চলগুলোর, বিশেষ করে প্রাক্তন উপনিবেশিত দেশসমহের মানুষদের চিন্তাভঙ্গির দীর্ঘকালীন উপনিবেশিক অনবর্তনের মধ্যে সুচিত করে অবমুক্তি ও বিকাশের তীব্র সম্ভাবনা। সাহিত্যের ছাত্র ও অধ্যাপক হয়েও আর্থ-রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সকল কর্তৃত্বকেই তিনি চিহ্নিত করেন, বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে আক্রমণ করেন, তার স্বরূপ উন্মোচন করে দেখান।
সমকালে আধুনিক মনোভাবের ধীর কিন্তু নিশ্চিত বিলুপ্তি এবং নতুন চিন্তাভঙ্গির বিচিত্র উৎসারণে যে প্রশ্নময়তা, সন্দেহ, অবিশ্বাস ও অনিশ্চিত অনুসন্ধান শুরু হয় সাঈদ তার মধ্যে কিছুটা ভিন্ন এক পথে যাত্রা শুরু করেন: সংস্কৃতি-সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতি, আধিপত্য, ক্ষমতা এবং অনুন্নত বিশ্বের মানুষের মনোজগতে তার প্রভাব ও পরিণতি হয়ে ওঠে তার পরীক্ষণ-পর্যবেক্ষণের বিষয়। এভাবেই তিনি চিহ্নিত করেন প্রাচ্যতত্ত্বের গৃঢ়-গোপন সংগঠন যাতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ধর্মযাজকের মন্ত্রপাঠ থেকে শুরু করে রুশোর রাজনৈতিক তত্ত্ব কিংবা জেন অস্টিনের উপন্যাস; এর লক্ষ্য হলো প্রাচ্যের মানুষদের মনোজগৎকে বশে রেখে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা ও তা অক্ষুন্ন রাখতে সহায়তা করা। এ ধরনের আত্মমুখী অন্বেষা আধুনিকতা-উত্তর চিন্তাধারায় সাঈদকে তিষ্ঠিত করে অনন্য অবস্থানে । উপনিবেশিক শক্তিসংঘের জটিল কাঠামো ও তার কর্ম-প্রক্রিয়া উন্মোচন এবং উত্তর-উপনিবেশ কালে উপনিবেশিক যুগের সাংস্কৃতিক প্রভাবন ঝেড়ে ফেলার প্রক্রিয়া সম্পর্কে সাঈদের এই বিশ্লেষণই ক্রমে উত্তর-উপনিবেশবাদ রূপে সুসংঘটিত ও পরিচিত হয় ।
সাঈদের জন্ম ১৯৩৫ সালে, ফিলিস্তিনের জেরুজালেমে এক এপিসকোপ্যালিয়ান খ্রিস্টান পরিবারে। ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর উদ্বাস্তুর নিয়তি মেনে কিশোর বয়সে পরিবারের সাথে মিশরে পাড়ি জমান। কিছুকাল কায়রোর ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। ওখানে মাউন্ট হারমান স্কুল, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি এবং হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে পাঠ শেষে ১৯৬৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। ওখানেই আজীবন ইংরেজি ও তুলনামূলক সাহিত্য পড়িয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইংল্যান্ডের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসরের দায়িত্বও পালন করেন।
ফিলিস্তিনি মুক্তি আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন সাঈদ । ১৯৭৭ সালে প্রবাসী ফিলিস্তিন পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হয়ে প্রায় ১৪ বছর ধরে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সালে ইসরাইল-ফিলিস্তিন চুক্তি সংক্রান্ত মতবিরোধে পদত্যাগ করেন তিনি। এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের পিতা সাঈদ প্রায় এক যুগ ধরে ব্লাড ক্যান্সারে ভুগছিলেন। গত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০০৩খ্রী: আমেরিকার এক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন এই মহান মানুষটি।
অরিয়েন্টালিজম সাঈদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ, সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ১৯৭৮ সালে এ গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ত্রিশটিরও অধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এই একটি মাত্র গ্রন্থের জন্যেও সাঈদ অমর হয়ে থাকতেন। এখন পর্যন্ত এ গ্রন্থটি মানববিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তার গভীরতর প্রভাব অব্যাহত রেখেছে। এ গ্রন্থে সাঈদ অঙ্গীকার করেন মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোয় ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর রাজনৈতিক, সামাজিক, নৃ-তাত্ত্বিক, আর্থিক আধিপত্যের সাংস্কৃতিক প্রস্তুতি ও প্রতিফলন প্রাচ্যের ঐ অঞ্চলের ওপর পশ্চিমের কর্তৃত্ব, কর্তৃত্বের আরোপণ, তার উপায় ও ধরনের ইতিহাস রচনার ।
ঐ কর্তৃত্বের বা আধিপত্যের পেছনে কার্যকর সাংস্কৃতিক মনোভঙ্গি ব্যাখ্যা করার জন্যে সাঈদ ব্যবহার করেন অরিয়েন্টালিজম বা প্রাচ্যতত্ত্ব পরিভাষাটি। প্রাচ্যতত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সাঈদ বলেন, প্রাচ্য হলো পশ্চিমের জ্ঞান জগতের নির্মাণ; পশ্চিমের নিকট প্রাচ্য ছিলো দূর ও অজানা। সেই দূর ও অজানাকে জানার চেষ্টায় প্রাচ্য হয়ে উঠে পশ্চিমের অন্য বা আদার—–পশ্চিমের প্রতিপক্ষ। ফলে পশ্চিম (অর্থাৎ নিজ) হয় ভালো, ‘প্রাচ্য (অন্য) মন্দ। এ ‘প্রাচ্য বাস্তব প্রাচ্য নয়, পশ্চিমের সৃষ্টি মাত্র। পশ্চিম প্রাচ্যে তার উপনিবেশ গড়ার বহু পূর্ব হতেই প্রাচ্যের ইতিহাস, জনগোষ্ঠী, সংস্কৃতি, বিশ্বাস সম্পর্কে অজস্র কাল্পনিক ধারণা সৃষ্টি করেছে, প্রচার করেছে, প্রজন্মক্রমে নিজেরা তা বিশ্বাসও করেছে। সে কল্পনা ও ধারণার মূলে আছে পশ্চিমের শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাচ্যের নিকৃষ্টতার বোধ। আঠারো শতকের শেষ ও উনিশ শতকের শুরুতে এ ধারণায় উদ্বুদ্ধ হয়েই পশ্চিম প্রাচ্যে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালায় ।
পাশ্চাত্যের মানুষেরা উপনিবেশিত প্রাচ্যে এসে বাস্তবতার নিরিখে তাদের সংশোধন না করে বরং তাকেই জোরদার ও পুনরুৎপাদন করে । বাস্তব প্রাচ্যকে তাদের নির্মিত প্রাচ্য' রূপেই দেখে, এমনকি বাস্তবের উপর চাপিয়ে দেয় তাদের কল্পনার প্রাচ্যকে। ফলে এই দূরত্ব আর ঘোচেনি। এভাবে প্রাচ্যকে হেয়করণ, দমন ও শাসন করার সাংস্কৃতিক তৎপরতা ও মনোভাবই হলো প্রাচ্যতত্ত্ব। পশ্চিমা জ্ঞানজগতে ‘প্রাচ্যতত্ত্ব’ নামের এই ডিসকোর্সের পরিশোধিত বক্তব্য হলো (পৃথিবীতে) পশ্চিমের মানুষ আছে, আর আছে প্রাচ্যবাসী। প্রথমোক্তরা আধিপত্য করবে। সেই আধিপত্যের শিকার হতে হবে, অবশ্যই, দ্বিতীয়োক্তদেরকে যা সচরাচর বোঝায় তারা তাদের ভূমি দখল করে নিতে দেবে, তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়সমূহ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে দেবে, তারা তাদের রক্ত ও সম্পদ তুলে দেবে কোনো না কোনো পশ্চিমা শক্তির হাতে। (অরিয়েন্টালিজম, ১৯৯৫, ৩৬)।
প্রাচ্যতত্ত্ব প্রাচ্যকে নিকৃষ্ট মনে করে এবং প্রাচ্যের মানুষদেরকে নিজস্ব শাসনে পরিচালিত হওয়ার অযোগ্য ঘোষণা করে। যেহেতু প্রাচ্য বিনষ্ট, অসভ্য, তাই প্রাচ্যজনকে কথা বলতে দেয়া যায় না। কারণ সে নিজেকেও ভালো করে চেনে না, তাকে যতোটা চেনে পশ্চিমের লোকেরা। তাই প্রাচ্যের পক্ষে কথা বলে সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপ—প্রাচ্য পরিণত হয় নিকৃষ্ট, নির্বাক, নিষ্ক্রিয় উপনিবেশে। আঠারো শতকের শেষ থেকে প্রাচ্যতত্ত্বের সক্রিয় যাত্রা শুরু হয়। এখনো তা অব্যাহত রয়েছে—যাবতীয় প্রভাব-প্রতিপত্তি সমেত, ভিন্নরূপে, নব্য-সাম্রাজ্যবাদের মধ্য দিয়ে।
অরিয়েন্টালিজম-এ বিন্যস্ত চিন্তাভাবনার পেছনে সাঈদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার একটা ভূমিকা আছে। তিনি লিখেছেন এ রচনায় আমার ব্যক্তিগত বিনিয়োগের বেশিরভাগটাই এসেছে দু'টো ব্রিটিশ উপনিবেশে বেড়ে ওঠা শিশু হিসেবে ‘অরিয়েন্টাল’ হয়ে ওঠার সচেতনতা থেকে। ঐ দুই উপনিবেশ ও যুক্তরাষ্ট্রে আমার সকল পড়াশোনা পশ্চিমা ধাঁচের। এ সত্ত্বেও কম বয়সের ঐ সুগভীর সচেতনতা অক্ষয় রয়ে গেছে। আমার এই অধ্যয়ন অনেক দিক থেকে প্রাচ্য বিষয়রূপী আমার ওপর সেই সংস্কৃতির চিহ্নসমূহের তালিকা প্রণয়নের প্রয়াস, যে সংস্কৃতির আধিপত্য সকল প্রাচ্যবাসীর জীবনে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এ কারণে আমার বেলায় মনোযোগের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে ইসলামি প্রাচ্য (অরিয়েন্টালিজম, ১৯৯৫, ২৫)।
অরিয়েন্টালিজম এমন এক রচনা যা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ক চিন্তার প্রেক্ষিত ও অভিমুখ চিরতরে পাল্টে দিয়েছে, অন্যদিকে, তার স্রষ্টাকে পরিণত করেছে কিংবদন্তিতুল্য মানুষে
পশ্চিমের আধিপত্যবাদী জ্ঞান ও সংস্কৃতি যখন সারা পৃথিবীতে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত তখন অরিয়েন্টালিজম এক ধীরগতির বিস্ফোরণ, যা আক্রান্ত করেছে সেই আধিপত্যের মূল প্রক্রিয়া ও কৌশলসমূহকে। ইউরোপ ও আমেরিকান শক্তি প্রাচ্যের ওপর সামরিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য চালানোর সঙ্গে সঙ্গে কিভাবে প্রাচ্যের মানুষের মন, আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি ও সাংস্কৃতিক স্বভাবের ওপরও আধিপত্য করেছে, নিজেদের ইচ্ছেমত রূপান্তরিত, বিকৃত ও পরিবর্তন করেছে তাদের মনোজগৎ ও বাইরের ইমেজকে তা জানার জন্যে। অরিয়েন্টালিজম-এর বিকল্প নেই। সাঈদের দৃঢ় যুক্তিসহ বক্তব্য, তীক্ষ্ণ ও নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ, ক্ষমতা ও সংস্কৃতির সম্পর্ককে যথাযথভাবে শনাক্তকরণের সক্ষমতা অরিয়েন্টালিজম-কে পরিণত করেছে আধিপত্য ও সংস্কৃতির তাত্ত্বিক আলোচনার ‘অনিবার্য আদর্শ’-এ।
বিশ শতকে আধিপত্যের রাজনীতির সর্বগ্রাসী ছায়ায় আড়ষ্ট পৃথিবীতে বহুদিক-গামী বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করেছেন সাঈদ। একাধারে সাহিত্য সমালোচনা, সংস্কৃতি, সমাজতত্ত্ব, সঙ্গীত, রাজনীতি-এ সমস্ত বিষয়েই লিখেছেন। কুড়িটিরও বেশি প্রকাশিত গ্রন্থে অভিব্যক্ত তার ভাবনায় ক্ষমতা ও আধিপত্যের নানা দিকের প্রতিভাস মেলে। তার রচিত গ্রন্থগুলো হলো জোসেফ কনরাড অ্যান্ড দি ফিকশান অব অটোবায়োগ্রাফি; বিগিনিংস: ইনটেনশন অ্যান্ড মেথডস; অরিয়েন্টালিজম; রিএ্যাকশন অ্যান্ড কাউন্টার রেভলিউশন ইন দি কনটেমপরারি আরব ওয়ার্ল্ড দি কোশ্চেন অব প্যালেস্টাইন; লিটারেচার অ্যান্ড দি সোসাইটি, কভারিং ইসলাম; দি ওয়ার্ল্ড, দি টেক্সট অ্যান্ড দি ক্রিটিক; আফটার দি লাস্ট স্কাই; ব্লেইমিং দি ভিকটিমস; স্পারিয়াস স্কলারশিপ অ্যান্ড দি প্যালেস্টাইনিয়ান কোশ্চেন; মিউজিক্যাল ইলাবোরেশনস; কালচার অ্যান্ড ইম্পেরিয়ালিজম; দি পলিটিক্স অব ডিসপজেশন: দি স্ট্রাগল ফর প্যালেস্টাইনিয়ান সেলফ-ডিটারমিনেশন; রিপ্রেজেন্টেশন অব দি ইন্টেলেকচুয়াল; আউট অব প্লেস; পিস অ্যান্ড ইটস ডিসকন্টেন্টস ও ক্রিটিসিজম বিটুইন কালচার অ্যান্ড সিস্টেম; ফ্রম অসলো টু ইরাক অ্যান্ড দি রোড ম্যাপ ইত্যাদি। শেষােক্ত বইটি প্রকাশিত হয়েছে তার মৃত্যুর পর, ২০০৪ সালে।
জোসেফ কনরাড অ্যান্ড দি ফিকশান অব অটোবায়োগ্রাফি, দি ওয়ার্ল্ড, দি টেক্সট অ্যান্ড দি ক্রিটিকএবং মিউজিক্যাল ইলাবোরেশন ক্ষমতার রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্ট নয়। অনেকগুলো গ্রন্থ সরাসরি ইসরাইলি দখলদারিত্ব এবং ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে সম্পর্কযুক্ত। অন্যান্য গ্রন্থ এবং নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারের মূল অভিপ্রায় আধিপত্যবাদী সংস্কৃতি ও রাজনীতির আন্তরবিন্যাস।
প্রচলিত সাহিত্য সমালোচনার কার্যকারিতা এবং টেক্সট-এর পরিপ্রেক্ষিত বিষয়ক প্রশ্নে সাঈদের গুরুত্বপূর্ণ রচনা দি ওয়ার্ল্ড, দি টেক্সট অ্যান্ড দি ক্রিটিক প্রকাশিত হয় ১৯৭৯ সালে। এতে সাহিত্য সমালোচনায় অন্যতর চিন্তাভঙ্গির প্রস্তাবনা পণ্ডিতদের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সাঈদের মতে টেক্সট বা রচনা গণ সংশ্লিষ্ট একটি জিনিস। রচনাকালীন পরিবেশ-পরিস্থিতির ছাপ ধারণ করেও প্রচারের পর তা পাঠ, পাঠের অর্থ ও প্রতিক্রিয়ার সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়। তিনি পশ্চিমের উন্নাসিক টেচুয়াল সমালোচনারীতির বিরোধিতা করে বলেন, এ হলো টেক্সট-এর ভেতরের রাজনীতি, আধিপত্য ও দমননীতির প্রত্যক্ষ প্রভাবকে আলোচনার বাইরে রাখার একটি কৌশল। অতএব, টেক্সটকে পাঠ করতে হবে মানবজীবনের বাস্তবতার সাথে সম্পর্কিত করে। গ্রন্থটিতে সুইফট ও কনরাডের ওপর তার নাতিদীর্ঘ আলোচনা লেখকদ্বয়ের সৃষ্টি ও দৃষ্টিকোণ সম্পর্কে নতুন ধরনের আলোকপাত করেছে। দি ওয়ার্ল্ড, দি টেক্সট অ্যান্ড দি ক্রিটিক প্রচলিত সাহিত্য সমালোচনার রীতিনীতি সম্পর্কে প্রশ্ন তোলে, টেক্সট-এর সাথে মানবজীবনের অবিচ্ছিন্ন বাস্তবতার সম্পর্কের গুরুত্ব অনুধাবনে সহায়তা করে এবং প্রস্তাব করে সমালোচনার অপেক্ষাকৃত পরিপূর্ণ একটি ধরন ।
১৯৮০ সালে প্রকাশিত দি কোশ্চেন অব প্যালেস্টাইন আমাদের সময়ের সবচেয়ে তীব্র, রক্তক্ষয়ী আন্তর্জাতিক সংঘাতের রাজনীতির ওপর আলোকপাত । ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কারণে দেশচ্যুত, রাষ্ট্রচ্যুত ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার জীবন্ত চিত্র এ গ্রন্থটি। লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনি আজ ছড়িয়ে আছে সারা পৃথিবীতে। তাদের দেশ নেই, ভোট নেই, নাগরিক অধিকার নেই। সাঈদ প্রশ্ন রাখেন এসব ফিলিস্তিনির দায় নেবে কে?
আফটার দি লাস্ট স্কাই (১৯৮৬) সাঈদের তীব্র রাজনীতি সচেতন রচনা। মূলভাবগত অর্থে এটা দি কোশ্চেন অব প্যালেস্টাইনেরই বিস্তৃতি। একদিকে ফিলিস্তিন পরিস্থিতি সম্পর্কে তার অনুপম বিশ্লেষণ, অন্যদিকে, ফিলিস্তিনের ওপর ফটোগ্রাফার জঁ মোর-এর গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছবি মিলে আফটার দি লাস্ট স্কাই-কে দিয়েছে সমকালের দালিলিক স্পর্শ। এখানে সাঈদ খুঁজে দেখেছেন সমকালে একজন ফিলিস্তিনি হওয়ার অর্থ কী, একজন ফিলিস্তিনি হিসেবে কী পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় তাকে? সাঈদ বলেন যে, পশ্চিমে এমন একটি দিনও পার হয় না যেদিন ফিলিস্তিনিরা প্রধান প্রধান সংবাদে অন্তর্ভুক্ত থাকে কিন্তু প্রচার মাধ্যম তাদের যে ইমেজ সৃষ্টি করেছে, সাঈদ দেখান, তা খুনী-সন্ত্রাসী-অপহরণকারী অথবা সর্বহারা শরণার্থীর। ফিলিস্তিনিরা আজ পশ্চিমা প্রচার মাধ্যমের ঐ কৃত্রিম, ঘৃণ্য রাজনৈতিক ইমেজে বন্দি।
ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কারণে ফিলিস্তিনিরা কিভাবে তাদের দেশ হারিয়েছে, ঘরবাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে সেই মর্মান্তিক বিবরণ দেন সাঈদ। এবং সাম্প্রতিক ঘটনার আলোকে দেখান ফিলিস্তিনিরা প্রবাসী ও উদ্বাস্তু ইমেজ প্রত্যাখ্যান করে এখন নতুন আত্মপরিচয়ে উদ্বুদ্ধ হতে শুরু করেছে। সে পরিচয় প্রতিরোধের, আত্মত্যাগের, দৃঢ় চৈতন্যের সংগ্রামী এক জাতির যারা ভবিষ্যৎ এক উজ্জ্বল সময়ের স্বপ্ন দেখছে।
দি পলিটিক্স অব ডিসপজিশন দি স্ট্রাগল ফর প্যালেস্টাইনিয়ান সেলফ ডিটারমিনেশন (১৯৯৪) ফিলিস্তিন সমস্যার ওপর লিখিত প্রবন্ধের সংকলন । এতে ১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রক্তাক্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারা বিবরণী তুলে ধরেছেন সাঈদ। ১৯৯৪ সালে ইসরাইলের সাথে সম্পাদিত শান্তিচুক্তিও আলোচনায় এসেছে, যাকে সাঈদ অন্যত্র অভিহিত করেছেন শান্তি প্রচেষ্টার সমাপ্তি হিসেবে।
কভারিং ইসলাম-এর প্রথম প্রকাশ ১৯৮১ সালে। অরিয়েন্টালিজম লিখে সাঈদ প্রাচ্যতাত্ত্বিক বুদ্ধিজীবীবৃত্তে ধ্বস নামিয়েছিলেন, সৃষ্টি করেছিলেন অসংখ্য বুদ্ধিবৃত্তিক শক্র। কভারিং ইসলাম-এ তিনি পশ্চিমা প্রচার মাধ্যমের সাম্রাজ্যবাদী ও সাম্প্রদায়িক রূপটি উন্মোচন করেন। এর ফলে তিনি আর কখনো প্রচার মাধ্যমের সুনজরে আসতে পারেননি। তার ফলাফলও উল্লেখযোগ্য বৈষয়িক ক্ষতির কারণ হয়েছে। আমরা প্রচার মাধ্যমের বদৌলতে প্রায়শই চমস্কি বা দেরিদার বিশাল ছায়ার মুখোমুখি হই, অথচ সাঈদকে অতো ভালো করে জানি না, যদিও আমাদের অর্থাৎ প্রাক্তন উপনিবেশগুলোর মানুষদের জন্যেই নিবেদিত ছিলো সাঈদের সারাজীবনের সৃষ্টিশীল তৎপরতা।
যাহোক, কভারিং ইসলাম-এ সাঈদ প্রতিদিনের সংবাদ পরিবেশন, ফিচার, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার ঘেটে দেখান পশ্চিমের প্রচার মাধ্যম দীর্ঘদিন ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুসলমানদের খুনী, সন্ত্রাসী, অপহরণকারী হিসেবে চিত্রিত করে আসছে। ফিলিস্তিনি মুসলমানদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে অথবা সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের মুখে আত্মরক্ষার জন্যে ইরানের যুদ্ধকৌশলকে ব্যাখ্যা করা হয় সন্ত্রাসী তৎপরতা বলে, কিন্তু আগ্রাসনের নিন্দা করা হয় না । এ হলো প্রচার মাধ্যমের ভাষ্য সৃষ্টির রাজনীতি। সাঈদ আমাদেরকে পশ্চিমা প্রচার মাধ্যমের এ তৎপরতা ও তার ভাষ্যের রাজনীতি সম্পর্কে সতর্ক করেন।
রিপ্রেজেন্টেশন অব দি ইন্টেলেকচুয়াল (১৯৯৪) সাঈদের আরেকটি উল্লেখযোগ্য রচনা। সারা পৃথিবীর জনগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশ যখন তথ্য ব্যবসায় জড়িত অথবা সংশ্লিষ্ট তখন বুদ্ধিজীবী পরিভাষাটি কী অর্থ বহন করে, কারা বুদ্ধিজীবী, কী তার চারিত্র্য, কী তার দায়িত্ব—এসব প্রশ্নের জবাব সন্ধান করা হয়েছে আলোচ্য গ্রন্থে। এ প্রসঙ্গে সাঈদ বুদ্ধিজীবী সম্পর্কে প্রচলিত মতামত তুলে ধরেন। ইতালীয় বামপন্থী এন্টনিও গ্রামসি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, ঋণ-পরামর্শক সকলকেই বুদ্ধিজীবী বলে অভিহিত করেছেন যাদের কাজ হলো ক্ষমতামুখী প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রের পক্ষে বুদ্ধি প্রয়োগ করে নিজস্ব স্বার্থ অর্জন। অন্যদিকে, ফরাসি জুলিয়ান বেন্ডা প্রমুখের সংজ্ঞানুযায়ী বুদ্ধিজীবীদেরকে সমাজের সংখ্যালঘু, মহৎ হৃদয় মানুষ বলে মনে করা হয়, যার দায়িত্ব ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। বুদ্ধিজীবীর পরিচয় প্রসঙ্গে সাঈদ প্রথাগত মতামত এবং বামপন্থী চিন্তাধারার মাঝামাঝি অবস্থান গ্রহণ করেও জুলিয়ান বেভার মতের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। সাঈদের মতে বুদ্ধিজীবীর মেধা, সততা, দায়িত্ববোধ তাকে অন্য মানুষদের থেকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে। বুদ্ধিজীবী তাই নিঃসঙ্গ মানুষ। “বুদ্ধিজীবী পরবাসী, সংখ্যালঘু, অপেশাদার—এমন এক ভাষার অধিকারী, যা ক্ষমতার মুখের ওপর সত্য উচ্চারণ করে” (রিপ্রেজেন্টেশন..., ১৯৯৬, xvii)। সাঈদ মনে করেন পরিচ্ছন্ন মানবিক বোধ, অবিচ্ছিন্ন সততা, চিন্ত র তীব্রতা এবং সজাগ চৈতন্য—এ হলো বুদ্ধিজীবীর আজন্ম সম্বল। রিপ্রেজেন্টেশন অব দি ইন্টেলেকচুয়াল আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন।
তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত সর্বশেষ গ্রন্থ ফ্রম অসলো টু ইরাক অ্যান্ড দি রোড ম্যাপ (২০০৪)-এ সংকলিত ৪৬টি অসাধারণ নিবন্ধে সাঈদ মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে আমেরিকা ও ইসরাইলের তৎপরতা সম্পর্কে এমন সব তথ্য প্রকাশ করেছেন যেগুলো কোনোদিন মার্কিন প্রচার মাধ্যমের মুখ দেখেনি।
এডওয়ার্ড সাঈদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দু'-একটি কাজের একটি হলো কালচার অ্যান্ড ইম্পেরিয়ালিজম (১৯৯৩)। এ গ্রন্থে সাঈদের চিন্তা প্রথা ও চর্চার সীমানা পেরিয়ে পশ্চিমের সংস্কৃতির এমন এক দিক উন্মোচিত করে যার সাথে সম্পর্কিত আধিপত্য, দমন ও ক্ষমতার রাজনীতি। ইউরোপীয় এবং সামগ্রিকভাবে পশ্চিমের সংস্কৃতির ইতিহাসের অনেক পেছনেও আধিপত্যবাদী চিন্তাভাবনার প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়।
সাঈদ পশ্চিমা সংস্কৃতিতে সাম্রাজ্যবাদের বীজ শনাক্ত করার জন্যে বেছে নেন সংস্কৃতির একটি ক্ষেত্র—সাহিত্য। জেন অস্টিন থেকে সালমান রুশদি, ইয়েটস থেকে প্রচার মাধ্যমের তৎপরতাও তার অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণের আওতায় আসে। অরিয়েন্টালিজমে তার পর্যবেক্ষণ সীমিত ছিলো মধ্যপ্রাচ্যে।
কালচার অ্যান্ড ইম্পেরিয়ালিজম-এ তিনি দৃষ্টি প্রসারিত করে দেন পৃথিবীর সকল প্রাক্তন উপনিবেশে, যেখানে উপনিবেশিক শক্তি কখনো না কখনো তাদের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন চালিয়েছিলো। এর মধ্যে আছে আফ্রিকা, পাক-ভারত উপমহাদেশ, দূরপ্রাচ্যের অংশ বিশেষ, অস্ট্রেলিয়া, ক্যারিবীয় অঞ্চলের বিভিন্ন দেশ। এসব দেশে বসে অথবা তার অভিজ্ঞতা নিয়ে সাম্রাজ্যের গর্বিত নাগরিক সমকালীন লেখকগণ যে সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন সাঈদের আলোচনার লক্ষ্য সেই সব সৃষ্টি।
ঐ সব সাহিত্যিক রচনায় দু’টো বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করেন তিনি প্রথমত, ওগুলোয় উপনিবেশিত জনগোষ্ঠীকে দেখা হয়েছে মানসিকতার একক একটি ছাঁচে। যেমন ঐ সব লেখায় পাওয়া যায় ভারতীয় মন’, ‘ক্যারেবীয় নারী। চরিত্র', বা আফ্রিকান স্বভাব’, ‘জ্যামাইকান আচরণ ইত্যাদি পরিভাষা ও ধারণা। এর অর্থ হলো ঐ লেখকের নিকট সকল ভারতীয়’র মন একই রকম, সকল ক্যারিবীয় নারীর চরিত্র এক, আফ্রিকান মানবগোষ্ঠী বুঝি বা যুগ যুগ ধরে বেঁচে আছে স্বভাবের একটি মাত্র আদর্শ নিয়ে ।
দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো, ঐ সব লেখকের প্রত্যেকের রচনায় সাম্রাজ্য বিস্তার, উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছে। নমুনা হিসেবে জোসেফ কনরাডের হার্ট অব ডার্কনেস-এর কথা ধরা যায় (ইয়ুথ অ্যান্ড আদার স্টোরিজ, ১৯০২)। কাহিনী কেন্দ্রে আছে পশ্চিমের ‘সভ্যতার ছোয়াবিহীন আফ্রিকার অন্ধকারাচ্ছন্ন অঞ্চল। বক্তা মালো যদিও মুখে সাম্রাজ্যবাদের সমালোচনা করেন কিন্তু তার মনোভাব ঘুরেফিরে যুক্তির জাল বুনে আফ্রিকার স্বায়ত্তশাসনের বিরুদ্ধেই। সাঈদ তাই মন্তব্য করেন, “কনরাড় আমাদের দেখাতে চান (সাদা মানুষ) কুর্দজের লুটের অভিযান, নদীপথে মালোর ভ্রমণ এবং গোটা কাহিনীটিই কিভাবে এই একটি মাত্র মূলভাব সমর্থন করে যে, ইউরোপীয়রা দক্ষ হাতে সাম্রাজ্যবাদী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে, ভবিষ্যতে আফ্রিকায় তা অব্যাহতও রাখবে” (কালচার অ্যান্ড ইম্পেরিয়ালিজম, ১৯৯৩, ২৫)।
সাঈদ আরো কয়েক যুগ পেছনে গিয়ে চার্লস ডিকেন্সের দুম্বে অ্যান্ড সন্স (১৮৪৮) থেকেও উদাহরণ দেন। ঐ গ্রন্থে দেখা যায়, দুম্বে তার নবজাত সন্তানের জন্যে কামনা করছে পৃথিবীব্যাপী বাণিজ্যিক আধিপত্য, যা আসলে উপনিবেশিক আধিপত্যেরই একটি রূপ (পূর্বোক্ত, ১৩)। একইভাবে সাঈদ উপনিবেশিক আকাঙক্ষা চিহ্নিত করেন জর্জ এলিয়ট, রুডইয়ার্ড কিপলিঙ, জেন অস্টিন, আলবেয়ার কামুসহ অনেকের রচনায় ।
চারটি অধ্যায়ে বিভক্ত কালচার অ্যান্ড ইম্পেরিয়ালিজম-এর তৃতীয় ও চতুর্থ অধ্যায়ে বিশ্লেষিত হয়েছে বিরোধ ও প্রতিরোধাত্মক সংস্কৃতিরউত্থান। বিশ শতকের তৃতীয়-চতুর্থ দশক থেকেই সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতির বিপরীতে প্রতিরোধাত্মক সাহিত্যের সূচনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রায় সকল উপনিবেশ স্বাধীনতা লাভ করে। ক্রমে সাম্রাজ্যবাদী সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রভাব কাটিয়ে ওঠার প্রয়াস দেখা দেয় সাহিত্য, সমাজতত্ত্ব, ইতিহাস, নৃ-তত্ত্বসহ মানব-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায়। সূচনাপর্বে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর লেখকদের মধ্যেও বিপরীত সংস্কৃতির প্রতি ইতিবাচক মনোভাব লক্ষ্য করা যায়। ক্রমে বিকশিত হয় প্রতিরোধের তীব্র ভাষা।
এডওয়ার্ড সাঈদের তীক্ষ-তীব্র চিন্তনভঙ্গি, নিরপেক্ষ ও অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ, ভাষার কৌশল ব্যবহার কালচার অ্যান্ড ইম্পেরিয়ালিজমকে ধ্রুপদ রচনার মর্যাদা এনে দিয়েছে। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী তৎপরতা ও দমননীতির সংস্কৃতির বিশ্লেষণ করতে হলে এখন আর অরিয়েন্টালিজম ও কালচার অ্যান্ড ইম্পেরিয়ালিজমকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।
বিশ শতকের প্রথমার্ধে পশ্চিমের উপনিবেশগুলোর বুদ্ধিবৃত্তি, পশ্চিমের সাংস্কৃতিক প্রভাবনের ফলেই আধুনিকতার নেতিবাদী বৃত্তে ঘুরপাক খেয়েছে। দীর্ঘদিন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে প্যারিসে প্রথমে কাঠামোবাদী আন্দোলন, পরে উত্তর-কাঠামোবাদ নতুন চিন্তাভঙ্গি হিসেবে বিপুল আলোড়ন তোলে। উত্তরাধুনিকতা পাশ্চাত্যের চিন্তাভাবনার ফসল; ওখানেই ষাট, সত্তর ও আশির দশকে এই নতুন চিন্তারীতির বিভিন্ন দিকগামী বিস্তার আমরা লক্ষ্য করি।
এ সময় ফরাসি চিন্তাবিদ মিশেল ফুকো ইউরোপীয় চিন্তার দার্শনিক ভিত্তি সম্পর্কেই প্রশ্ন তোলেন, সন্দেহ প্রকাশ করেন এনলাইটমেন্ট ও পশ্চিমা মানবতাবাদের যাথার্থ বিষয়ে। দেরিদা ভাষায় দোত্যকের খেলার উল্লেখ করে টেক্সটকে প্রায় সকল কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বেচ্ছাচারী অর্থ-সঞ্চারের তত্ত্ব দেন; এর ফলে পারিপার্শ্বের রাজনীতি থেকে টেক্সটকে আলাদা করে ফেলার সুযোগ ও ঝুঁকি সৃষ্টি হয়।
উত্তরাধুনিক চিন্তাভাবনার এই জাগরণকালে পশ্চিমের ঐ সব মত ও পথ এড়িয়ে প্রাচ্যের মানুষ এডওয়ার্ড সাঈদ উপনিবেশিক আধিপত্যের সাংস্কৃতিক রূপটি পরীক্ষণে মনোনিবেশ করে সূচিত করেন উত্তর-উপনিবেশবাদী ভাবনা-প্রক্রিয়ার। আলজেরিয়ায় ফরাসি উপনিবেশের বিরোধিতা করতে গিয়ে ফ্রাঞ্জ ফানো উপনিবেশিক শক্তি ও উনিবেশের সম্পর্কে আলোকপাত করেছিলেন আরো আগে, তবে সাঈদের মাধ্যমেই তা তত্ত্বের সুষম গঠন ও প্রয়োজনীয় কৌশল অর্জন করে। উপনিবেশিত মানবগোষ্ঠীর মনোজগতে দমন ও আধিপত্যের বিশ্লেষণে তিনি শনাক্ত করেন প্রাচ্যতাত্ত্বিক ডিসকোর্সকে। অরিয়েন্টালিজম এবং কালচার অ্যান্ড ইম্পেরিয়ালিজম প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে অনুন্নত বিশ্বের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে যে অভাবনীয় পরিবর্তন সূচিত হয় তাকে প্রায়-পুনর্জাগরণ আখ্যায়িত করা যেতে পারে। আয়ারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা ও ভারতে অরিয়েন্টালিজম-এর চিন্তা সূত্রের অনুসঙ্গে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজও হয়েছে।
এখন প্রাচ্যতত্ত্ব কেবল প্রাচ্যে পশ্চিমা আধিপত্যের ব্যাখ্যা নয়, তা একটি ভাবনাভঙ্গিও, যা প্রয়োগ করা হচ্ছে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের উপনিবেশিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিশ্লেষণে। যে কোনো সাংস্কৃতিক আধিপত্য/প্রভাবন/বিকৃতি সাঈদের তত্ত্বে বিশ্লেষণ করা সম্ভব। প্রাচ্যের প্রাক্তন উপনিবেশগুলোয় উত্তর-উপনিবেশিক চিন্তাধারাই এখন প্রবল, যা আত্মানুসন্ধানী, ঐতিহ্যমুখী, নিজস্ব সাংস্কৃতিক ভিত্তির খোঁজে অবিরাম প্রশ্নমুখর। পশ্চিমের আধিপত্যে সূচিত ও ব্যাখ্যাত উত্তরাধুনিক ভাবনা রীতির অন্যপিঠে এই নতুন দিগন্তের সূচনা সাঈদের এক বিরাট অবদান।
এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদ ছিলেন পণ্ডিত, নন্দনতাত্ত্বিক ও সমালোচকের এক বিরল ও মেধাবী সংশ্লেষ। সাংস্কৃতিক আত্মানুসন্ধানে নিয়ত উনুখ নতুন প্রজন্মের কাছে তিনি প্রেরণা ও আদর্শ। সাঈদ পশ্চিমের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই প্রভাব বিস্তার করে গেছেন।
ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের কাছে তিনি কোনো দায় অনুভব করেননি, তার দায় ছিলো বুদ্ধিবৃত্তিক চৈতন্যের নিকট, যা তিনি নিজেই চিহ্নিত করেছেন (দ্র. রিপ্রেজেন্টেশন অব ইন্টেলেকচুয়াল, ১৯৯৬)। মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামি দেশগুলোর জনগোষ্ঠীর পক্ষে কথা বলার কারণে তাকে কম দুর্ভোগ পোহাতে হয়নি। তবু মানবতা ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার প্রশ্নে তার ছিলো দৃঢ় ও সক্রিয় ভূমিকা। প্রথা ও প্রতিষ্ঠানবিরোধী, ক্ষমতাবিরোধী এমন সৃষ্টিশীল মানুষের জন্যে নোবেল পুরস্কার অপেক্ষা করার কথা নয়। তার প্রয়োজনও ছিলো না। এডওয়ার্ড সাঈদ ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে জাগ্রত করে গেছেন আমাদের চৈতন্যকে, যেমন বলেছেন এ সময়ের আরেক বেপরোয়া, মেধাবী বুদ্ধিজীবী আব্রাম নোয়াম চমস্কি- “তিনি (সাঈদ) আমাদের এটি বুঝতে সহায়তা করেন যে আমরা কে, ক্ষমতার দাস না হয়ে নৈতিক প্রতিনিধি হিসেবে বাঁচার জন্যে আমাদের কী করা উচিৎ”।
এডওয়ার্ড সাঈদ-এর অরিয়েন্টালিজম
ভূমিকা ও ভাষান্তর ফয়েজ আলম
গত শতকের অস্থির, দ্রুত পরিবর্তনমুখী বুদ্ধিবৃত্তিক আবহে এডওয়ার্ড সাঈদ ছিলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টিশীল চিন্তাবিদদের একজন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, বিশেষত ষাট ও সত্তরের দশকে সকল ধরনের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের কাছে আনত অসম্ভব একটা মানব-বিশ্বে সাঈদের আবির্ভাব প্রচণ্ড আলোড়নের মতো, যা নাড়িয়ে দেয় পশ্চিমের সাংস্কৃতিক আধিপত্য ও দমনের দীর্ঘ, স্থিতিশীল আয়োজন-উন্নত বিশ্বের সাংস্কৃতিক প্রভাবনের সূত্রে অর্জিত ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের মূল-ভিত্তির কৃত্রিম গ্রন্থিগুলো খুলে খুলে দেখায় এবং এভাবে অনুন্নত অঞ্চলগুলোর, বিশেষ করে প্রাক্তন উপনিবেশিত দেশসমহের মানুষদের চিন্তাভঙ্গির দীর্ঘকালীন উপনিবেশিক অনবর্তনের মধ্যে সুচিত করে অবমুক্তি ও বিকাশের তীব্র সম্ভাবনা। সাহিত্যের ছাত্র ও অধ্যাপক হয়েও আর্থ-রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সকল কর্তৃত্বকেই তিনি চিহ্নিত করেন, বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে আক্রমণ করেন, তার স্বরূপ উন্মোচন করে দেখান।
সমকালে আধুনিক মনোভাবের ধীর কিন্তু নিশ্চিত বিলুপ্তি এবং নতুন চিন্তাভঙ্গির বিচিত্র উৎসারণে যে প্রশ্নময়তা, সন্দেহ, অবিশ্বাস ও অনিশ্চিত অনুসন্ধান শুরু হয় সাঈদ তার মধ্যে কিছুটা ভিন্ন এক পথে যাত্রা শুরু করেন: সংস্কৃতি-সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতি, আধিপত্য, ক্ষমতা এবং অনুন্নত বিশ্বের মানুষের মনোজগতে তার প্রভাব ও পরিণতি হয়ে ওঠে তার পরীক্ষণ-পর্যবেক্ষণের বিষয়। এভাবেই তিনি চিহ্নিত করেন প্রাচ্যতত্ত্বের গৃঢ়-গোপন সংগঠন যাতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ধর্মযাজকের মন্ত্রপাঠ থেকে শুরু করে রুশোর রাজনৈতিক তত্ত্ব কিংবা জেন অস্টিনের উপন্যাস; এর লক্ষ্য হলো প্রাচ্যের মানুষদের মনোজগৎকে বশে রেখে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা ও তা অক্ষুন্ন রাখতে সহায়তা করা। এ ধরনের আত্মমুখী অন্বেষা আধুনিকতা-উত্তর চিন্তাধারায় সাঈদকে তিষ্ঠিত করে অনন্য অবস্থানে । উপনিবেশিক শক্তিসংঘের জটিল কাঠামো ও তার কর্ম-প্রক্রিয়া উন্মোচন এবং উত্তর-উপনিবেশ কালে উপনিবেশিক যুগের সাংস্কৃতিক প্রভাবন ঝেড়ে ফেলার প্রক্রিয়া সম্পর্কে সাঈদের এই বিশ্লেষণই ক্রমে উত্তর-উপনিবেশবাদ রূপে সুসংঘটিত ও পরিচিত হয় ।
সাঈদের জন্ম ১৯৩৫ সালে, ফিলিস্তিনের জেরুজালেমে এক এপিসকোপ্যালিয়ান খ্রিস্টান পরিবারে। ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর উদ্বাস্তুর নিয়তি মেনে কিশোর বয়সে পরিবারের সাথে মিশরে পাড়ি জমান। কিছুকাল কায়রোর ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। ওখানে মাউন্ট হারমান স্কুল, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি এবং হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে পাঠ শেষে ১৯৬৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। ওখানেই আজীবন ইংরেজি ও তুলনামূলক সাহিত্য পড়িয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইংল্যান্ডের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসরের দায়িত্বও পালন করেন।
ফিলিস্তিনি মুক্তি আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন সাঈদ । ১৯৭৭ সালে প্রবাসী ফিলিস্তিন পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হয়ে প্রায় ১৪ বছর ধরে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সালে ইসরাইল-ফিলিস্তিন চুক্তি সংক্রান্ত মতবিরোধে পদত্যাগ করেন তিনি। এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের পিতা সাঈদ প্রায় এক যুগ ধরে ব্লাড ক্যান্সারে ভুগছিলেন। গত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০০৩খ্রী: আমেরিকার এক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন এই মহান মানুষটি।
অরিয়েন্টালিজম সাঈদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ, সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ১৯৭৮ সালে এ গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ত্রিশটিরও অধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এই একটি মাত্র গ্রন্থের জন্যেও সাঈদ অমর হয়ে থাকতেন। এখন পর্যন্ত এ গ্রন্থটি মানববিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তার গভীরতর প্রভাব অব্যাহত রেখেছে। এ গ্রন্থে সাঈদ অঙ্গীকার করেন মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোয় ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর রাজনৈতিক, সামাজিক, নৃ-তাত্ত্বিক, আর্থিক আধিপত্যের সাংস্কৃতিক প্রস্তুতি ও প্রতিফলন প্রাচ্যের ঐ অঞ্চলের ওপর পশ্চিমের কর্তৃত্ব, কর্তৃত্বের আরোপণ, তার উপায় ও ধরনের ইতিহাস রচনার ।
ঐ কর্তৃত্বের বা আধিপত্যের পেছনে কার্যকর সাংস্কৃতিক মনোভঙ্গি ব্যাখ্যা করার জন্যে সাঈদ ব্যবহার করেন অরিয়েন্টালিজম বা প্রাচ্যতত্ত্ব পরিভাষাটি। প্রাচ্যতত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সাঈদ বলেন, প্রাচ্য হলো পশ্চিমের জ্ঞান জগতের নির্মাণ; পশ্চিমের নিকট প্রাচ্য ছিলো দূর ও অজানা। সেই দূর ও অজানাকে জানার চেষ্টায় প্রাচ্য হয়ে উঠে পশ্চিমের অন্য বা আদার—–পশ্চিমের প্রতিপক্ষ। ফলে পশ্চিম (অর্থাৎ নিজ) হয় ভালো, ‘প্রাচ্য (অন্য) মন্দ। এ ‘প্রাচ্য বাস্তব প্রাচ্য নয়, পশ্চিমের সৃষ্টি মাত্র। পশ্চিম প্রাচ্যে তার উপনিবেশ গড়ার বহু পূর্ব হতেই প্রাচ্যের ইতিহাস, জনগোষ্ঠী, সংস্কৃতি, বিশ্বাস সম্পর্কে অজস্র কাল্পনিক ধারণা সৃষ্টি করেছে, প্রচার করেছে, প্রজন্মক্রমে নিজেরা তা বিশ্বাসও করেছে। সে কল্পনা ও ধারণার মূলে আছে পশ্চিমের শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাচ্যের নিকৃষ্টতার বোধ। আঠারো শতকের শেষ ও উনিশ শতকের শুরুতে এ ধারণায় উদ্বুদ্ধ হয়েই পশ্চিম প্রাচ্যে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালায় ।
পাশ্চাত্যের মানুষেরা উপনিবেশিত প্রাচ্যে এসে বাস্তবতার নিরিখে তাদের সংশোধন না করে বরং তাকেই জোরদার ও পুনরুৎপাদন করে । বাস্তব প্রাচ্যকে তাদের নির্মিত প্রাচ্য' রূপেই দেখে, এমনকি বাস্তবের উপর চাপিয়ে দেয় তাদের কল্পনার প্রাচ্যকে। ফলে এই দূরত্ব আর ঘোচেনি। এভাবে প্রাচ্যকে হেয়করণ, দমন ও শাসন করার সাংস্কৃতিক তৎপরতা ও মনোভাবই হলো প্রাচ্যতত্ত্ব। পশ্চিমা জ্ঞানজগতে ‘প্রাচ্যতত্ত্ব’ নামের এই ডিসকোর্সের পরিশোধিত বক্তব্য হলো (পৃথিবীতে) পশ্চিমের মানুষ আছে, আর আছে প্রাচ্যবাসী। প্রথমোক্তরা আধিপত্য করবে। সেই আধিপত্যের শিকার হতে হবে, অবশ্যই, দ্বিতীয়োক্তদেরকে যা সচরাচর বোঝায় তারা তাদের ভূমি দখল করে নিতে দেবে, তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়সমূহ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে দেবে, তারা তাদের রক্ত ও সম্পদ তুলে দেবে কোনো না কোনো পশ্চিমা শক্তির হাতে। (অরিয়েন্টালিজম, ১৯৯৫, ৩৬)।
প্রাচ্যতত্ত্ব প্রাচ্যকে নিকৃষ্ট মনে করে এবং প্রাচ্যের মানুষদেরকে নিজস্ব শাসনে পরিচালিত হওয়ার অযোগ্য ঘোষণা করে। যেহেতু প্রাচ্য বিনষ্ট, অসভ্য, তাই প্রাচ্যজনকে কথা বলতে দেয়া যায় না। কারণ সে নিজেকেও ভালো করে চেনে না, তাকে যতোটা চেনে পশ্চিমের লোকেরা। তাই প্রাচ্যের পক্ষে কথা বলে সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপ—প্রাচ্য পরিণত হয় নিকৃষ্ট, নির্বাক, নিষ্ক্রিয় উপনিবেশে। আঠারো শতকের শেষ থেকে প্রাচ্যতত্ত্বের সক্রিয় যাত্রা শুরু হয়। এখনো তা অব্যাহত রয়েছে—যাবতীয় প্রভাব-প্রতিপত্তি সমেত, ভিন্নরূপে, নব্য-সাম্রাজ্যবাদের মধ্য দিয়ে।
অরিয়েন্টালিজম-এ বিন্যস্ত চিন্তাভাবনার পেছনে সাঈদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার একটা ভূমিকা আছে। তিনি লিখেছেন এ রচনায় আমার ব্যক্তিগত বিনিয়োগের বেশিরভাগটাই এসেছে দু'টো ব্রিটিশ উপনিবেশে বেড়ে ওঠা শিশু হিসেবে ‘অরিয়েন্টাল’ হয়ে ওঠার সচেতনতা থেকে। ঐ দুই উপনিবেশ ও যুক্তরাষ্ট্রে আমার সকল পড়াশোনা পশ্চিমা ধাঁচের। এ সত্ত্বেও কম বয়সের ঐ সুগভীর সচেতনতা অক্ষয় রয়ে গেছে। আমার এই অধ্যয়ন অনেক দিক থেকে প্রাচ্য বিষয়রূপী আমার ওপর সেই সংস্কৃতির চিহ্নসমূহের তালিকা প্রণয়নের প্রয়াস, যে সংস্কৃতির আধিপত্য সকল প্রাচ্যবাসীর জীবনে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এ কারণে আমার বেলায় মনোযোগের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে ইসলামি প্রাচ্য (অরিয়েন্টালিজম, ১৯৯৫, ২৫)।
অরিয়েন্টালিজম এমন এক রচনা যা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ক চিন্তার প্রেক্ষিত ও অভিমুখ চিরতরে পাল্টে দিয়েছে, অন্যদিকে, তার স্রষ্টাকে পরিণত করেছে কিংবদন্তিতুল্য মানুষে
পশ্চিমের আধিপত্যবাদী জ্ঞান ও সংস্কৃতি যখন সারা পৃথিবীতে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত তখন অরিয়েন্টালিজম এক ধীরগতির বিস্ফোরণ, যা আক্রান্ত করেছে সেই আধিপত্যের মূল প্রক্রিয়া ও কৌশলসমূহকে। ইউরোপ ও আমেরিকান শক্তি প্রাচ্যের ওপর সামরিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য চালানোর সঙ্গে সঙ্গে কিভাবে প্রাচ্যের মানুষের মন, আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি ও সাংস্কৃতিক স্বভাবের ওপরও আধিপত্য করেছে, নিজেদের ইচ্ছেমত রূপান্তরিত, বিকৃত ও পরিবর্তন করেছে তাদের মনোজগৎ ও বাইরের ইমেজকে তা জানার জন্যে। অরিয়েন্টালিজম-এর বিকল্প নেই। সাঈদের দৃঢ় যুক্তিসহ বক্তব্য, তীক্ষ্ণ ও নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ, ক্ষমতা ও সংস্কৃতির সম্পর্ককে যথাযথভাবে শনাক্তকরণের সক্ষমতা অরিয়েন্টালিজম-কে পরিণত করেছে আধিপত্য ও সংস্কৃতির তাত্ত্বিক আলোচনার ‘অনিবার্য আদর্শ’-এ।
বিশ শতকে আধিপত্যের রাজনীতির সর্বগ্রাসী ছায়ায় আড়ষ্ট পৃথিবীতে বহুদিক-গামী বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করেছেন সাঈদ। একাধারে সাহিত্য সমালোচনা, সংস্কৃতি, সমাজতত্ত্ব, সঙ্গীত, রাজনীতি-এ সমস্ত বিষয়েই লিখেছেন। কুড়িটিরও বেশি প্রকাশিত গ্রন্থে অভিব্যক্ত তার ভাবনায় ক্ষমতা ও আধিপত্যের নানা দিকের প্রতিভাস মেলে। তার রচিত গ্রন্থগুলো হলো জোসেফ কনরাড অ্যান্ড দি ফিকশান অব অটোবায়োগ্রাফি; বিগিনিংস: ইনটেনশন অ্যান্ড মেথডস; অরিয়েন্টালিজম; রিএ্যাকশন অ্যান্ড কাউন্টার রেভলিউশন ইন দি কনটেমপরারি আরব ওয়ার্ল্ড দি কোশ্চেন অব প্যালেস্টাইন; লিটারেচার অ্যান্ড দি সোসাইটি, কভারিং ইসলাম; দি ওয়ার্ল্ড, দি টেক্সট অ্যান্ড দি ক্রিটিক; আফটার দি লাস্ট স্কাই; ব্লেইমিং দি ভিকটিমস; স্পারিয়াস স্কলারশিপ অ্যান্ড দি প্যালেস্টাইনিয়ান কোশ্চেন; মিউজিক্যাল ইলাবোরেশনস; কালচার অ্যান্ড ইম্পেরিয়ালিজম; দি পলিটিক্স অব ডিসপজেশন: দি স্ট্রাগল ফর প্যালেস্টাইনিয়ান সেলফ-ডিটারমিনেশন; রিপ্রেজেন্টেশন অব দি ইন্টেলেকচুয়াল; আউট অব প্লেস; পিস অ্যান্ড ইটস ডিসকন্টেন্টস ও ক্রিটিসিজম বিটুইন কালচার অ্যান্ড সিস্টেম; ফ্রম অসলো টু ইরাক অ্যান্ড দি রোড ম্যাপ ইত্যাদি। শেষােক্ত বইটি প্রকাশিত হয়েছে তার মৃত্যুর পর, ২০০৪ সালে।
জোসেফ কনরাড অ্যান্ড দি ফিকশান অব অটোবায়োগ্রাফি, দি ওয়ার্ল্ড, দি টেক্সট অ্যান্ড দি ক্রিটিকএবং মিউজিক্যাল ইলাবোরেশন ক্ষমতার রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্ট নয়। অনেকগুলো গ্রন্থ সরাসরি ইসরাইলি দখলদারিত্ব এবং ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে সম্পর্কযুক্ত। অন্যান্য গ্রন্থ এবং নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারের মূল অভিপ্রায় আধিপত্যবাদী সংস্কৃতি ও রাজনীতির আন্তরবিন্যাস।
প্রচলিত সাহিত্য সমালোচনার কার্যকারিতা এবং টেক্সট-এর পরিপ্রেক্ষিত বিষয়ক প্রশ্নে সাঈদের গুরুত্বপূর্ণ রচনা দি ওয়ার্ল্ড, দি টেক্সট অ্যান্ড দি ক্রিটিক প্রকাশিত হয় ১৯৭৯ সালে। এতে সাহিত্য সমালোচনায় অন্যতর চিন্তাভঙ্গির প্রস্তাবনা পণ্ডিতদের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সাঈদের মতে টেক্সট বা রচনা গণ সংশ্লিষ্ট একটি জিনিস। রচনাকালীন পরিবেশ-পরিস্থিতির ছাপ ধারণ করেও প্রচারের পর তা পাঠ, পাঠের অর্থ ও প্রতিক্রিয়ার সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়। তিনি পশ্চিমের উন্নাসিক টেচুয়াল সমালোচনারীতির বিরোধিতা করে বলেন, এ হলো টেক্সট-এর ভেতরের রাজনীতি, আধিপত্য ও দমননীতির প্রত্যক্ষ প্রভাবকে আলোচনার বাইরে রাখার একটি কৌশল। অতএব, টেক্সটকে পাঠ করতে হবে মানবজীবনের বাস্তবতার সাথে সম্পর্কিত করে। গ্রন্থটিতে সুইফট ও কনরাডের ওপর তার নাতিদীর্ঘ আলোচনা লেখকদ্বয়ের সৃষ্টি ও দৃষ্টিকোণ সম্পর্কে নতুন ধরনের আলোকপাত করেছে। দি ওয়ার্ল্ড, দি টেক্সট অ্যান্ড দি ক্রিটিক প্রচলিত সাহিত্য সমালোচনার রীতিনীতি সম্পর্কে প্রশ্ন তোলে, টেক্সট-এর সাথে মানবজীবনের অবিচ্ছিন্ন বাস্তবতার সম্পর্কের গুরুত্ব অনুধাবনে সহায়তা করে এবং প্রস্তাব করে সমালোচনার অপেক্ষাকৃত পরিপূর্ণ একটি ধরন ।
১৯৮০ সালে প্রকাশিত দি কোশ্চেন অব প্যালেস্টাইন আমাদের সময়ের সবচেয়ে তীব্র, রক্তক্ষয়ী আন্তর্জাতিক সংঘাতের রাজনীতির ওপর আলোকপাত । ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কারণে দেশচ্যুত, রাষ্ট্রচ্যুত ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার জীবন্ত চিত্র এ গ্রন্থটি। লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনি আজ ছড়িয়ে আছে সারা পৃথিবীতে। তাদের দেশ নেই, ভোট নেই, নাগরিক অধিকার নেই। সাঈদ প্রশ্ন রাখেন এসব ফিলিস্তিনির দায় নেবে কে?
আফটার দি লাস্ট স্কাই (১৯৮৬) সাঈদের তীব্র রাজনীতি সচেতন রচনা। মূলভাবগত অর্থে এটা দি কোশ্চেন অব প্যালেস্টাইনেরই বিস্তৃতি। একদিকে ফিলিস্তিন পরিস্থিতি সম্পর্কে তার অনুপম বিশ্লেষণ, অন্যদিকে, ফিলিস্তিনের ওপর ফটোগ্রাফার জঁ মোর-এর গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছবি মিলে আফটার দি লাস্ট স্কাই-কে দিয়েছে সমকালের দালিলিক স্পর্শ। এখানে সাঈদ খুঁজে দেখেছেন সমকালে একজন ফিলিস্তিনি হওয়ার অর্থ কী, একজন ফিলিস্তিনি হিসেবে কী পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় তাকে? সাঈদ বলেন যে, পশ্চিমে এমন একটি দিনও পার হয় না যেদিন ফিলিস্তিনিরা প্রধান প্রধান সংবাদে অন্তর্ভুক্ত থাকে কিন্তু প্রচার মাধ্যম তাদের যে ইমেজ সৃষ্টি করেছে, সাঈদ দেখান, তা খুনী-সন্ত্রাসী-অপহরণকারী অথবা সর্বহারা শরণার্থীর। ফিলিস্তিনিরা আজ পশ্চিমা প্রচার মাধ্যমের ঐ কৃত্রিম, ঘৃণ্য রাজনৈতিক ইমেজে বন্দি।
ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কারণে ফিলিস্তিনিরা কিভাবে তাদের দেশ হারিয়েছে, ঘরবাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে সেই মর্মান্তিক বিবরণ দেন সাঈদ। এবং সাম্প্রতিক ঘটনার আলোকে দেখান ফিলিস্তিনিরা প্রবাসী ও উদ্বাস্তু ইমেজ প্রত্যাখ্যান করে এখন নতুন আত্মপরিচয়ে উদ্বুদ্ধ হতে শুরু করেছে। সে পরিচয় প্রতিরোধের, আত্মত্যাগের, দৃঢ় চৈতন্যের সংগ্রামী এক জাতির যারা ভবিষ্যৎ এক উজ্জ্বল সময়ের স্বপ্ন দেখছে।
দি পলিটিক্স অব ডিসপজিশন দি স্ট্রাগল ফর প্যালেস্টাইনিয়ান সেলফ ডিটারমিনেশন (১৯৯৪) ফিলিস্তিন সমস্যার ওপর লিখিত প্রবন্ধের সংকলন । এতে ১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রক্তাক্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারা বিবরণী তুলে ধরেছেন সাঈদ। ১৯৯৪ সালে ইসরাইলের সাথে সম্পাদিত শান্তিচুক্তিও আলোচনায় এসেছে, যাকে সাঈদ অন্যত্র অভিহিত করেছেন শান্তি প্রচেষ্টার সমাপ্তি হিসেবে।
কভারিং ইসলাম-এর প্রথম প্রকাশ ১৯৮১ সালে। অরিয়েন্টালিজম লিখে সাঈদ প্রাচ্যতাত্ত্বিক বুদ্ধিজীবীবৃত্তে ধ্বস নামিয়েছিলেন, সৃষ্টি করেছিলেন অসংখ্য বুদ্ধিবৃত্তিক শক্র। কভারিং ইসলাম-এ তিনি পশ্চিমা প্রচার মাধ্যমের সাম্রাজ্যবাদী ও সাম্প্রদায়িক রূপটি উন্মোচন করেন। এর ফলে তিনি আর কখনো প্রচার মাধ্যমের সুনজরে আসতে পারেননি। তার ফলাফলও উল্লেখযোগ্য বৈষয়িক ক্ষতির কারণ হয়েছে। আমরা প্রচার মাধ্যমের বদৌলতে প্রায়শই চমস্কি বা দেরিদার বিশাল ছায়ার মুখোমুখি হই, অথচ সাঈদকে অতো ভালো করে জানি না, যদিও আমাদের অর্থাৎ প্রাক্তন উপনিবেশগুলোর মানুষদের জন্যেই নিবেদিত ছিলো সাঈদের সারাজীবনের সৃষ্টিশীল তৎপরতা।
যাহোক, কভারিং ইসলাম-এ সাঈদ প্রতিদিনের সংবাদ পরিবেশন, ফিচার, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার ঘেটে দেখান পশ্চিমের প্রচার মাধ্যম দীর্ঘদিন ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুসলমানদের খুনী, সন্ত্রাসী, অপহরণকারী হিসেবে চিত্রিত করে আসছে। ফিলিস্তিনি মুসলমানদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে অথবা সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের মুখে আত্মরক্ষার জন্যে ইরানের যুদ্ধকৌশলকে ব্যাখ্যা করা হয় সন্ত্রাসী তৎপরতা বলে, কিন্তু আগ্রাসনের নিন্দা করা হয় না । এ হলো প্রচার মাধ্যমের ভাষ্য সৃষ্টির রাজনীতি। সাঈদ আমাদেরকে পশ্চিমা প্রচার মাধ্যমের এ তৎপরতা ও তার ভাষ্যের রাজনীতি সম্পর্কে সতর্ক করেন।
রিপ্রেজেন্টেশন অব দি ইন্টেলেকচুয়াল (১৯৯৪) সাঈদের আরেকটি উল্লেখযোগ্য রচনা। সারা পৃথিবীর জনগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশ যখন তথ্য ব্যবসায় জড়িত অথবা সংশ্লিষ্ট তখন বুদ্ধিজীবী পরিভাষাটি কী অর্থ বহন করে, কারা বুদ্ধিজীবী, কী তার চারিত্র্য, কী তার দায়িত্ব—এসব প্রশ্নের জবাব সন্ধান করা হয়েছে আলোচ্য গ্রন্থে। এ প্রসঙ্গে সাঈদ বুদ্ধিজীবী সম্পর্কে প্রচলিত মতামত তুলে ধরেন। ইতালীয় বামপন্থী এন্টনিও গ্রামসি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, ঋণ-পরামর্শক সকলকেই বুদ্ধিজীবী বলে অভিহিত করেছেন যাদের কাজ হলো ক্ষমতামুখী প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রের পক্ষে বুদ্ধি প্রয়োগ করে নিজস্ব স্বার্থ অর্জন। অন্যদিকে, ফরাসি জুলিয়ান বেন্ডা প্রমুখের সংজ্ঞানুযায়ী বুদ্ধিজীবীদেরকে সমাজের সংখ্যালঘু, মহৎ হৃদয় মানুষ বলে মনে করা হয়, যার দায়িত্ব ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। বুদ্ধিজীবীর পরিচয় প্রসঙ্গে সাঈদ প্রথাগত মতামত এবং বামপন্থী চিন্তাধারার মাঝামাঝি অবস্থান গ্রহণ করেও জুলিয়ান বেভার মতের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। সাঈদের মতে বুদ্ধিজীবীর মেধা, সততা, দায়িত্ববোধ তাকে অন্য মানুষদের থেকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে। বুদ্ধিজীবী তাই নিঃসঙ্গ মানুষ। “বুদ্ধিজীবী পরবাসী, সংখ্যালঘু, অপেশাদার—এমন এক ভাষার অধিকারী, যা ক্ষমতার মুখের ওপর সত্য উচ্চারণ করে” (রিপ্রেজেন্টেশন..., ১৯৯৬, xvii)। সাঈদ মনে করেন পরিচ্ছন্ন মানবিক বোধ, অবিচ্ছিন্ন সততা, চিন্ত র তীব্রতা এবং সজাগ চৈতন্য—এ হলো বুদ্ধিজীবীর আজন্ম সম্বল। রিপ্রেজেন্টেশন অব দি ইন্টেলেকচুয়াল আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন।
তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত সর্বশেষ গ্রন্থ ফ্রম অসলো টু ইরাক অ্যান্ড দি রোড ম্যাপ (২০০৪)-এ সংকলিত ৪৬টি অসাধারণ নিবন্ধে সাঈদ মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে আমেরিকা ও ইসরাইলের তৎপরতা সম্পর্কে এমন সব তথ্য প্রকাশ করেছেন যেগুলো কোনোদিন মার্কিন প্রচার মাধ্যমের মুখ দেখেনি।
এডওয়ার্ড সাঈদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দু'-একটি কাজের একটি হলো কালচার অ্যান্ড ইম্পেরিয়ালিজম (১৯৯৩)। এ গ্রন্থে সাঈদের চিন্তা প্রথা ও চর্চার সীমানা পেরিয়ে পশ্চিমের সংস্কৃতির এমন এক দিক উন্মোচিত করে যার সাথে সম্পর্কিত আধিপত্য, দমন ও ক্ষমতার রাজনীতি। ইউরোপীয় এবং সামগ্রিকভাবে পশ্চিমের সংস্কৃতির ইতিহাসের অনেক পেছনেও আধিপত্যবাদী চিন্তাভাবনার প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়।
সাঈদ পশ্চিমা সংস্কৃতিতে সাম্রাজ্যবাদের বীজ শনাক্ত করার জন্যে বেছে নেন সংস্কৃতির একটি ক্ষেত্র—সাহিত্য। জেন অস্টিন থেকে সালমান রুশদি, ইয়েটস থেকে প্রচার মাধ্যমের তৎপরতাও তার অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণের আওতায় আসে। অরিয়েন্টালিজমে তার পর্যবেক্ষণ সীমিত ছিলো মধ্যপ্রাচ্যে।
কালচার অ্যান্ড ইম্পেরিয়ালিজম-এ তিনি দৃষ্টি প্রসারিত করে দেন পৃথিবীর সকল প্রাক্তন উপনিবেশে, যেখানে উপনিবেশিক শক্তি কখনো না কখনো তাদের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন চালিয়েছিলো। এর মধ্যে আছে আফ্রিকা, পাক-ভারত উপমহাদেশ, দূরপ্রাচ্যের অংশ বিশেষ, অস্ট্রেলিয়া, ক্যারিবীয় অঞ্চলের বিভিন্ন দেশ। এসব দেশে বসে অথবা তার অভিজ্ঞতা নিয়ে সাম্রাজ্যের গর্বিত নাগরিক সমকালীন লেখকগণ যে সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন সাঈদের আলোচনার লক্ষ্য সেই সব সৃষ্টি।
ঐ সব সাহিত্যিক রচনায় দু’টো বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করেন তিনি প্রথমত, ওগুলোয় উপনিবেশিত জনগোষ্ঠীকে দেখা হয়েছে মানসিকতার একক একটি ছাঁচে। যেমন ঐ সব লেখায় পাওয়া যায় ভারতীয় মন’, ‘ক্যারেবীয় নারী। চরিত্র', বা আফ্রিকান স্বভাব’, ‘জ্যামাইকান আচরণ ইত্যাদি পরিভাষা ও ধারণা। এর অর্থ হলো ঐ লেখকের নিকট সকল ভারতীয়’র মন একই রকম, সকল ক্যারিবীয় নারীর চরিত্র এক, আফ্রিকান মানবগোষ্ঠী বুঝি বা যুগ যুগ ধরে বেঁচে আছে স্বভাবের একটি মাত্র আদর্শ নিয়ে ।
দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো, ঐ সব লেখকের প্রত্যেকের রচনায় সাম্রাজ্য বিস্তার, উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছে। নমুনা হিসেবে জোসেফ কনরাডের হার্ট অব ডার্কনেস-এর কথা ধরা যায় (ইয়ুথ অ্যান্ড আদার স্টোরিজ, ১৯০২)। কাহিনী কেন্দ্রে আছে পশ্চিমের ‘সভ্যতার ছোয়াবিহীন আফ্রিকার অন্ধকারাচ্ছন্ন অঞ্চল। বক্তা মালো যদিও মুখে সাম্রাজ্যবাদের সমালোচনা করেন কিন্তু তার মনোভাব ঘুরেফিরে যুক্তির জাল বুনে আফ্রিকার স্বায়ত্তশাসনের বিরুদ্ধেই। সাঈদ তাই মন্তব্য করেন, “কনরাড় আমাদের দেখাতে চান (সাদা মানুষ) কুর্দজের লুটের অভিযান, নদীপথে মালোর ভ্রমণ এবং গোটা কাহিনীটিই কিভাবে এই একটি মাত্র মূলভাব সমর্থন করে যে, ইউরোপীয়রা দক্ষ হাতে সাম্রাজ্যবাদী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে, ভবিষ্যতে আফ্রিকায় তা অব্যাহতও রাখবে” (কালচার অ্যান্ড ইম্পেরিয়ালিজম, ১৯৯৩, ২৫)।
সাঈদ আরো কয়েক যুগ পেছনে গিয়ে চার্লস ডিকেন্সের দুম্বে অ্যান্ড সন্স (১৮৪৮) থেকেও উদাহরণ দেন। ঐ গ্রন্থে দেখা যায়, দুম্বে তার নবজাত সন্তানের জন্যে কামনা করছে পৃথিবীব্যাপী বাণিজ্যিক আধিপত্য, যা আসলে উপনিবেশিক আধিপত্যেরই একটি রূপ (পূর্বোক্ত, ১৩)। একইভাবে সাঈদ উপনিবেশিক আকাঙক্ষা চিহ্নিত করেন জর্জ এলিয়ট, রুডইয়ার্ড কিপলিঙ, জেন অস্টিন, আলবেয়ার কামুসহ অনেকের রচনায় ।
চারটি অধ্যায়ে বিভক্ত কালচার অ্যান্ড ইম্পেরিয়ালিজম-এর তৃতীয় ও চতুর্থ অধ্যায়ে বিশ্লেষিত হয়েছে বিরোধ ও প্রতিরোধাত্মক সংস্কৃতিরউত্থান। বিশ শতকের তৃতীয়-চতুর্থ দশক থেকেই সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতির বিপরীতে প্রতিরোধাত্মক সাহিত্যের সূচনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রায় সকল উপনিবেশ স্বাধীনতা লাভ করে। ক্রমে সাম্রাজ্যবাদী সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রভাব কাটিয়ে ওঠার প্রয়াস দেখা দেয় সাহিত্য, সমাজতত্ত্ব, ইতিহাস, নৃ-তত্ত্বসহ মানব-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায়। সূচনাপর্বে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর লেখকদের মধ্যেও বিপরীত সংস্কৃতির প্রতি ইতিবাচক মনোভাব লক্ষ্য করা যায়। ক্রমে বিকশিত হয় প্রতিরোধের তীব্র ভাষা।
এডওয়ার্ড সাঈদের তীক্ষ-তীব্র চিন্তনভঙ্গি, নিরপেক্ষ ও অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ, ভাষার কৌশল ব্যবহার কালচার অ্যান্ড ইম্পেরিয়ালিজমকে ধ্রুপদ রচনার মর্যাদা এনে দিয়েছে। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী তৎপরতা ও দমননীতির সংস্কৃতির বিশ্লেষণ করতে হলে এখন আর অরিয়েন্টালিজম ও কালচার অ্যান্ড ইম্পেরিয়ালিজমকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।
বিশ শতকের প্রথমার্ধে পশ্চিমের উপনিবেশগুলোর বুদ্ধিবৃত্তি, পশ্চিমের সাংস্কৃতিক প্রভাবনের ফলেই আধুনিকতার নেতিবাদী বৃত্তে ঘুরপাক খেয়েছে। দীর্ঘদিন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে প্যারিসে প্রথমে কাঠামোবাদী আন্দোলন, পরে উত্তর-কাঠামোবাদ নতুন চিন্তাভঙ্গি হিসেবে বিপুল আলোড়ন তোলে। উত্তরাধুনিকতা পাশ্চাত্যের চিন্তাভাবনার ফসল; ওখানেই ষাট, সত্তর ও আশির দশকে এই নতুন চিন্তারীতির বিভিন্ন দিকগামী বিস্তার আমরা লক্ষ্য করি।
এ সময় ফরাসি চিন্তাবিদ মিশেল ফুকো ইউরোপীয় চিন্তার দার্শনিক ভিত্তি সম্পর্কেই প্রশ্ন তোলেন, সন্দেহ প্রকাশ করেন এনলাইটমেন্ট ও পশ্চিমা মানবতাবাদের যাথার্থ বিষয়ে। দেরিদা ভাষায় দোত্যকের খেলার উল্লেখ করে টেক্সটকে প্রায় সকল কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বেচ্ছাচারী অর্থ-সঞ্চারের তত্ত্ব দেন; এর ফলে পারিপার্শ্বের রাজনীতি থেকে টেক্সটকে আলাদা করে ফেলার সুযোগ ও ঝুঁকি সৃষ্টি হয়।
উত্তরাধুনিক চিন্তাভাবনার এই জাগরণকালে পশ্চিমের ঐ সব মত ও পথ এড়িয়ে প্রাচ্যের মানুষ এডওয়ার্ড সাঈদ উপনিবেশিক আধিপত্যের সাংস্কৃতিক রূপটি পরীক্ষণে মনোনিবেশ করে সূচিত করেন উত্তর-উপনিবেশবাদী ভাবনা-প্রক্রিয়ার। আলজেরিয়ায় ফরাসি উপনিবেশের বিরোধিতা করতে গিয়ে ফ্রাঞ্জ ফানো উপনিবেশিক শক্তি ও উনিবেশের সম্পর্কে আলোকপাত করেছিলেন আরো আগে, তবে সাঈদের মাধ্যমেই তা তত্ত্বের সুষম গঠন ও প্রয়োজনীয় কৌশল অর্জন করে। উপনিবেশিত মানবগোষ্ঠীর মনোজগতে দমন ও আধিপত্যের বিশ্লেষণে তিনি শনাক্ত করেন প্রাচ্যতাত্ত্বিক ডিসকোর্সকে। অরিয়েন্টালিজম এবং কালচার অ্যান্ড ইম্পেরিয়ালিজম প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে অনুন্নত বিশ্বের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে যে অভাবনীয় পরিবর্তন সূচিত হয় তাকে প্রায়-পুনর্জাগরণ আখ্যায়িত করা যেতে পারে। আয়ারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা ও ভারতে অরিয়েন্টালিজম-এর চিন্তা সূত্রের অনুসঙ্গে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজও হয়েছে।
এখন প্রাচ্যতত্ত্ব কেবল প্রাচ্যে পশ্চিমা আধিপত্যের ব্যাখ্যা নয়, তা একটি ভাবনাভঙ্গিও, যা প্রয়োগ করা হচ্ছে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের উপনিবেশিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিশ্লেষণে। যে কোনো সাংস্কৃতিক আধিপত্য/প্রভাবন/বিকৃতি সাঈদের তত্ত্বে বিশ্লেষণ করা সম্ভব। প্রাচ্যের প্রাক্তন উপনিবেশগুলোয় উত্তর-উপনিবেশিক চিন্তাধারাই এখন প্রবল, যা আত্মানুসন্ধানী, ঐতিহ্যমুখী, নিজস্ব সাংস্কৃতিক ভিত্তির খোঁজে অবিরাম প্রশ্নমুখর। পশ্চিমের আধিপত্যে সূচিত ও ব্যাখ্যাত উত্তরাধুনিক ভাবনা রীতির অন্যপিঠে এই নতুন দিগন্তের সূচনা সাঈদের এক বিরাট অবদান।
এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদ ছিলেন পণ্ডিত, নন্দনতাত্ত্বিক ও সমালোচকের এক বিরল ও মেধাবী সংশ্লেষ। সাংস্কৃতিক আত্মানুসন্ধানে নিয়ত উনুখ নতুন প্রজন্মের কাছে তিনি প্রেরণা ও আদর্শ। সাঈদ পশ্চিমের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই প্রভাব বিস্তার করে গেছেন।
ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের কাছে তিনি কোনো দায় অনুভব করেননি, তার দায় ছিলো বুদ্ধিবৃত্তিক চৈতন্যের নিকট, যা তিনি নিজেই চিহ্নিত করেছেন (দ্র. রিপ্রেজেন্টেশন অব ইন্টেলেকচুয়াল, ১৯৯৬)। মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামি দেশগুলোর জনগোষ্ঠীর পক্ষে কথা বলার কারণে তাকে কম দুর্ভোগ পোহাতে হয়নি। তবু মানবতা ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার প্রশ্নে তার ছিলো দৃঢ় ও সক্রিয় ভূমিকা। প্রথা ও প্রতিষ্ঠানবিরোধী, ক্ষমতাবিরোধী এমন সৃষ্টিশীল মানুষের জন্যে নোবেল পুরস্কার অপেক্ষা করার কথা নয়। তার প্রয়োজনও ছিলো না। এডওয়ার্ড সাঈদ ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে জাগ্রত করে গেছেন আমাদের চৈতন্যকে, যেমন বলেছেন এ সময়ের আরেক বেপরোয়া, মেধাবী বুদ্ধিজীবী আব্রাম নোয়াম চমস্কি- “তিনি (সাঈদ) আমাদের এটি বুঝতে সহায়তা করেন যে আমরা কে, ক্ষমতার দাস না হয়ে নৈতিক প্রতিনিধি হিসেবে বাঁচার জন্যে আমাদের কী করা উচিৎ”।
বই নিয়ে শুধুমাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, বই নিয়ে শুধু মাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, নতুন প্রজন্ম চকঝমকের আকর্ষণে বইয়ের দিক থেকে ঘুরিয়ে নিচ্ছে মুখ। আমাদের এ আয়োজন বইয়ের সাথে মানুষের সম্পর্ককে অনিঃশেষ ও অবিচ্ছিন্ন করে রাখা। আশাকরি আপনাদের সহযোগিতায় আমাদের এই ইচ্ছা আরোও দৃঢ় হবে। দুনিয়ার পাঠক এক হও! বাংলা বই বিশ্বের বিবিধ স্থানে, সকল বাংলাভাষীর কাছে সহজলভ্য হোক!