Ticker

6/recent/ticker-posts

দেবপাল - কামাল রাহমান

amarboi
দেবপাল - কামাল রাহমান

দেবপাল উপন্যাসটি পূর্বভারতের পাল রাজ্যের সুদীর্ঘ চারশাে বছরের ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। পালরাজবংশের নৃপতিদের মধ্যে দেবপাল দক্ষতা ও নৈপুণ্যগুণে অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে এক অনন্য ইতিহাস গড়ে তুলেছিলেন। সম্রাট অশােকের পর এ ভূখণ্ডে এত বড় সাম্রাজ্য গড়ে তােলা আর কারাে পক্ষে সম্ভব হয়নি। পালরাজ্যটি পূর্বে চীন সীমান্ত ও পশ্চিমে বর্তমান আফগান সীমান্ত প্রায় ছুঁয়েছিল ।

বাংলা-বিহারকে কেন্দ্র করে ভারতবর্ষে এত বড় সাম্রাজ্য কখনােই ছিল না। বলা যায় পালরাজাদের সময়টাই বঙ্গালদের শ্রেষ্ঠ সময়। আমাদের অসামান্য মানসিক কৃতিত্ব যে নিজেদের বীরদের প্রশংসা না করে দূরদেশের প্রভুদের পূজা দিতে বেশি ভালােবাসি আমরা । যে বখতিয়ারের কাছে আমাদের স্বাধীনতা খর্ব হয়েছিল তার বীরত্বগাথা প্রচার করি। অথচ রাজা লক্ষণ সেনের গায়ে পালিয়ে যাওয়ার কলঙ্ক লেপন করতে কুণ্ঠিত হই না।
ইতিহাস বিস্মৃতি জন্ম দেয় ইতিহাস বিকৃতি । সাম্প্রতিক কালেও এর প্রভাব দেখা যায় ।

বঙ্গাল রাজা দেবপাল অসীম কৃতিত্ব ও সাহসিকতার সঙ্গে তাঁর সাম্রাজ্যটা গড়ে তুলেছিলেন। অথচ প্রকৃত উত্তরাধিকারী রেখে যেতে ব্যর্থ হওয়ায় পরবর্তী কয়েকশাে বছরে তা বিলুপ্ত হয়ে যায় । উপন্যাসটির ভেতর ঐ সময়টাকে ধারণ করার চেষ্টা করা হয়েছে।

ত্রিকোণ ভারতবর্ষ প্রকৃতপক্ষে তিনটি বিশাল সাম্রাজ্যের একীভূত রূপ। পূর্বভারত, পশ্চিমভারত ও দক্ষিণভারত প্রকৃত অর্থেই তিনটি দেশ। ঐতিহাসিক কাল থেকে এই তিনটি অঞ্চল পরস্পর ঠোকাঠুকি করে নিজেদের আত্মবিনাশ ডেকে এনেছে। ফলে ভিনদেশীয়রা এখানে এক উগ্র সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল । এসবের যথাসম্ভব বিশেষণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। আশা করি পাঠক পালরাজাদের চারশাে বছরের ইতিহাসের ভেতর কিছু সময়ের জন্য হলেও বাঙালির প্রকৃত বীর, নিজেদের মূল সূত্র ও ভুলে যাওয়া ইতিহাসের কিছুটা সন্ধান পাবেন।

দেবপাল উপন্যাসটি শুরু হয় দারুণ এক খরার দৃশ্য বিবরণের মধ্য দিয়ে। সেখানে পাঠকের সঙ্গে পরিচয় ঘটে অভিনন্দের। এই অভিনন্দের হাত ধরে পাঠকের প্রবেশ ঘটে ইতিহাসের করুণ ও কঠোর এক ভূমিতে। যেখানে মানুষের টিকে থাকা কষ্টের। মর্যাদা নাই, সম্ভ্রম নাই, বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা নাই। সেই নৈরাজ্যের কালে অভিনন্দ তার ঘর ছাড়ে সপরিবারে, একদল মহিষ নিয়ে। নদী পার হয়ে যেখানে যায় সেটা সাঁওতালদের গ্রাম। সাঁওতালে, বাঙালিতে মধুর মানবিক সম্পর্ক উপন্যাসের শুরুতেই পাঠকের মন ভরিয়ে দেবে। কিন্তু অভিনন্দদের মাথার ওপর দুর্যোগের ঘনঘটা। কে ভরসা দেবে, কে আশা দেবে তার হদিস নেই। সে সময়ে অবতারের মতো আবির্ভাব ঘটে গোপাল দেবের। আর তাকে ‘নির্বাচন’ করে বাংলা অঞ্চলের জনগণই। কামাল রাহমান তার উপন্যাসে লিখেছেন, ‘বাংলা থেকে মাৎস্যন্যায়ের অরাজকতা দূর করছিলেন রাজা গোপালদেব। রাজ্যে শান্তি ফিরে এসেছিল। মাৎস্যন্যায়ের অবসান ও গোপালদেবের রাজা মনোনয়ন এ ভূখণ্ডের ইতিহাসে আদি গণতন্ত্রের একটা খুব ভালো উদাহরণ।’

পাল সাম্রাজ্যের মধ্য দিয়ে যে গণতন্ত্রের গোড়াপত্তন করেছিলেন গোপাল তা ধর্মপাল টেনে নিয়ে গেছেন আরো অনেক দূর। তিনি এঁকে দিয়ছেন এক মজবুত ভিত্তি। উপন্যাসে মূলত ধর্মপালের শাসনামলের চিত্র বিশদভাবে বর্ণিত। কিন্তু এর ফাঁকে ফঁকেই আছে এক শিল্পী ধীমান ও তার ধর্ম, সংসার, প্রেম, জাতপাত নিয়ে টানাপড়েন। গণতান্ত্রিক শাসনামলের মধ্যেও সমাজ ক্রমাগত ভাঙার অনেকগুলো শর্ত নিজের মধ্যে ধারণ করে। ধীমানের মধ্য দিয় কমাল রাহমান সেই সংকটকেও ফুটিয়ে তুলেছেন। কিছু তিনি গোপন করেননি।

কামাল রাহমান ইতিহাসের একজন নিবিড় পাঠকই শুধু নন। উপন্যাস লেখায়ও তিনি মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। উপন্যাসে ডিটেইলিং, সংলাপের এক ছন্দবদ্ধতা পাওয়া যায় দেবপাল-এ। বিশেষত ভাষার প্রশ্নে। সাঁওতালি ভাষার একজন খুব পরিচিত লেখক কামাল রাহমান। তিনি শিল্পের একজন সমঝদারও। এই উপন্যাসে পাল তথা বৌদ্ধদের শাসনামলে টেরাকোটা ও মূর্তি শিল্পের বিকাশকে তিনি ভুলে যাননি। একজন শিল্পীর মনকেও তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন ধীমানের মধ্য দিয়ে। ধীমানের অস্থিরতা, তার যন্ত্রণা, ক্রমাগত সীমাবদ্ধতাকে কাটিয়ে ওঠা- রাজনীতি, প্রাকৃতিক পরিবেশ, আবহাওয়া সবকিছু যে শিল্প করার সঙ্গে যুক্ত, তারও একটি তাত্তিক দিক এই উপন্যাসে আছে।

যে কথা না বললেই নয়। আমাদের যে বাংলাদেশ, পূর্ববঙ্গ বলে পরিচিত সেই বাংলায় ধর্মপালের ঘুরতে আসার বিবরণ, মুগ্ধ হওয়ার উল্লেখও এই উপন্যাসে আছে। এখানকার আতিথেয়তা, প্রাকৃতিক সমৃদ্ধি, খাবারের সুমিষ্টতার চিত্তাকর্ষক বর্ণনা পাঠককে বাংলাদেশ সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী ও প্রেমিক করে তুলবে।

উপন্যাসে ধর্মপাল একজন গম্ভীর, সৎ ও উদার মানুষ হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনি শাসন ব্যবস্থায় শৃঙ্খল বজায় রাখতে নিয়ম ও কাঠামো প্রবর্তন করেন। পালরা পূর্ববর্তী গুপ্ত ও শশাংকের শাসনামলের বিভিন্ন ভালো দিকগুলো গ্রহণ করে। এর সঙ্গে নিজেরাও যুক্ত করে প্রজাহিতৈষী ও গণতান্ত্রিক নতুন ব্যবস্থা। নিজেদের সুসংহত করার প্রয়োজনে যুদ্ধ প্রস্তুতিও নিতে হয়েছে পাল রাজাদের। সেই প্রসঙ্গও বাদ রাখেননি কামাল রাহমান। পালদের যুদ্ধ কৌশলগুলোও তিনি উল্লেখ করেছেন। প্রশাসনিক কাঠামো কীভাবে বিন্যস্ত ছিল তার কথাও আছে এভাবে- ‘রাজ্য প্রশাসনের সুবিধার্থে মহামন্ত্রী গার্গ মহাশয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে বিভিন্ন প্রশাসনিক অঞ্চল সৃষ্টি করার আদেশ দেন। প্রতিটা রাজ্যের উচ্চ স্তরের প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে নিম্ন পর্যায়ক্রমে ভুক্তি, বিষয়, মণ্ডল, এই তিন ভাগে বিভক্ত করার নির্দেশ দেন। নি¤œ পর্যায়ের প্রশাসনিক অঞ্চল হিসেবে খণ্ডল, ভাগ, অবৃত্তি, চতুরক ও পাট্টক, এই পাঁচটি ভাগে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। নিম্ন থেকে উচ্চ, পর্যায়ক্রমে প্রতিটা প্রশাসনিক প্রধান উচ্চতর প্রশাসকের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে।’

গণতন্ত্রকে সুসংহত করার যে প্রায়স পাল রাজা দেখিয়েছেন তা বুঝাতে উদ্ধৃতি অংশটুকু উল্লেখ করলাম। আর এই উপন্যাসের আলোচনা শেষ করব একটি বেদনার সুর দিয়ে। যার সাক্ষী দেবপাল। তিনি ধর্মপালের পুত্র। একসময়কার পরাক্রমশালী সাম্রাজ্য, প্রজাদের অন্তরে জায়গা করে নেয়া রাজবংশের শাসনেরও যে পতন আসে তার শুরুটা নিরুপায়ভাবে অবলোকন করেন দেবপাল। নিজের জীবনের সায়াহ্নে এসে বড় অসহায় দিন কাটে তার। কিন্তু তিনি নিরুপায়, পরিস্থিতি ফেরানোর সুযোগ তার হাতে খুব কিছু ছিল না। বাইরের আক্রমণ আর ভেতরের ভাঙনে পাল সম্রাট ছিলেন উপায়ন্তহীন।
অনলাইন (ভোরের কাগজ)



বই নিয়ে শুধুমাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, বই নিয়ে শুধু মাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, নতুন প্রজন্ম চকঝমকের আকর্ষণে বইয়ের দিক থেকে ঘুরিয়ে নিচ্ছে মুখ। আমাদের এ আয়োজন বইয়ের সাথে মানুষের সম্পর্ককে অনিঃশেষ ও অবিচ্ছিন্ন করে রাখা। আশাকরি আপনাদের সহযোগিতায় আমাদের এই ইচ্ছা আরোও দৃঢ় হবে। দুনিয়ার পাঠক এক হও! বাংলা বই বিশ্বের বিবিধ স্থানে, সকল বাংলাভাষীর কাছে সহজলভ্য হোক!