রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাপান ভ্রমণে যান ১৯১৬ সালে। তার ‘জাপান যাত্রী’ ভ্রমণ কাহিনীর বই প্রকাশিত হয় ১৯১৯ সালে। অবাক করা কাণ্ড এরও চার বৎসর আগে ১৯১২ সালের ৩ নভেম্বর হরিপ্রভা, বিয়ের পর মল্লিক হরিপ্রভা তাকেদা হয়ে স্বামী উয়েমেন তাকেদার হাত ধরে নারায়ণগঞ্জ ঘাট থেকে গোয়ালন্দগামী জাহাজে ওঠেন। সেই সময়ে বাঙালি মেয়ের সঙ্গে জাপানি বরের বিয়ে এক বিশেষ ঘটনা। বাঙালি সেই মেয়ে বরের হাত ধরে জাপানে শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছে এটাও কি ছোট ঘটনা? বর-কনেকে দেখবে বলে নারায়ণগঞ্জ স্টিমার ঘাটে কৌতুহলি লোকে-লোকারণ্য। বর-কনে ১৩ ডিসেম্বর জাপানের পোর্ট মোজিতে পৌঁছান। জাপানের দুটি সংবাদপত্রে সে খবরও প্রকাশিত হয়।
এখন শুনলে অবিশ্বাস্য মনে হয়, কিন্তু উনিশ শতকের শুরুর দিকে জাপান থেকে যুবকেরা ঢাকায় আসতো কাজের সন্ধানে। হরিপ্রভার স্বামী উয়েমেন তাকেদাও তেমনই একজন। সে ঢাকার বিখ্যাত বুলবুল সোপ ফ্যাক্টরিতে কাজ করতো প্রধান কারিগর হিসাবে। তাদের বিয়ে কেমন করে হলো বলতে গেলে বলতে হবে হরিপ্রভার বাবা শশিভূষণ মল্লিকের কথা। তিনি ছিলেন একজন উদার মনের ভালো মানুষ। একদিন সকালে হাঁটতে যেয়ে রাস্তার পাশে দেখতে পান এক সদ্যজাত শিশু, তাকে কুড়িয়ে নিয়ে আসেন বাড়িতে এবং প্রাণ বাঁচাতে শিশুটিকে লালন-পালন করতে থাকেন। গোঁড়া সমাজ এতে বাধ সাধে এবং শশিভূষণকে সমাজচ্যুত করা হয়।বাধ্য হয়ে তিনি ব্রাহ্ম সমাজে যোগ দেন। রাজা রামমোহন রায় প্রচারিত ব্রাহ্মধর্মের মূল ভিত্তি সনাতন হিন্দু ধর্ম। কিন্তু তারা সেই সময়ের হিন্দু সমাজের প্রচলিত কুসংস্কার ও ধর্মীয় অনাচার মানতো না। ফলে ব্রাহ্মধর্মের অনুসারিরা ছিল অনেক উদার এবং মুক্তমনা।শশিভূষণ ছিলেন একজন উদার মনের ভালো মানুষ। তিনি ব্রাহ্ম সমাজের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। তার মেয়ে হরিপ্রভা পিতার প্রতিষ্ঠিত মাতৃনিকেতনের সাথে জড়িত ছিলেন। উয়েমেন তাকেদা ঢাকায় ছিলেন একা, ব্রাহ্ম সমাজের লোকেরা উদার ও মুক্তমনা কাজেই এই সমাজের সঙ্গে তার পরিচয় হয় এবং মেলামেশা চলে। সেই সূত্রে শশিভূষণের পরিবারের সঙ্গে এবং হরিপ্রভার সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা জন্মে। তারা পরষ্পরকে বিয়ে করতে চাইলে উদার শশিভূষণ পরিবার বাধা না দিয়ে ১৯০৭ সালে ১৭ বছর বয়সী বাঙালি মেয়ে হরিপ্রভা মল্লিকার সঙ্গে জাপানি উয়েমেন তাকেদার বিয়ে সম্পন্ন হয়। হরিপ্রভা তখন ঢাকার ইডেন স্কুলে ক্লাস টেনে পড়তো। সে এনট্রান্স পাস করেছিল কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায় না।
বিয়ের পরে উয়েমেন তাকেদা শ্বশুরের সহায়তায় ইন্দো-জাপানিজ সোপ ফ্যাক্টরি নামে একটি সাবান কারখানা দেন। হরিপ্রভা ও উয়েমেন তাকেদা দ্বিতীয়বার জাপান যান ১৯৪১ সালে, পাকাপাকিভাবে থাকবার জন্য। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হলে জাপান সরকার তার দেশের সকল নাগরিককে দেশে ফিরিয়ে নেয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে এবারের জাপান যাত্রা। যুদ্ধকালীন সময়ে জাপানে অর্থনৈতিক সংকট চলছিল।টোকিও শহরে তাদের কোনো বাসস্থান ছিল না, ছিল না কোন উপার্জনের সংস্থান। তার স্বামীও অসুস্থ হয়ে পড়ে। এই সময়ে তাদের পাশে দাঁঁড়ান ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির প্রতিষ্ঠাতা বিপ্লবী রাসবিহারী বসু। তিনি তখন জাপানে অবস্থান করছিলেন। নেতাজী সুভাসচন্দ্র বোস টোকিওতে এলে রাসবিহারী বসু হরিপ্রভাকে তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। নেতাজী হরিপ্রভাকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেন। রাসবিহারীর মধ্যস্থতায় হরিপ্রভা ১৯৪২ সালে টোকিও রেডিও থেকে আজাদ হিন্দ ফৌজের হয়ে বাংলা সংবাদ পাঠিকার কাজ শুরু করেন। তার আর্থিক দুরবস্থার অবসান ঘটে। সেই সময়ে কাজটি ছিল কঠিন এবং ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ ব্লাক আউটের অন্ধকার রাতে মাথায় হেলমেট দিয়ে একাকী টোকিও রেডিও স্টেশনে যাতায়াত করতেন।মাঝে মাঝেই বোমা বর্ষণ করতো মিত্র বাহিনীর বোমারু বিমান।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হলে হরিপ্রভা দেশে ফিরে আসেন অসুস্থ স্বামী উয়েমন তাকেদাকে নিয়ে। কিন্তু এ কোন দেশ? ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে চলে গেছে। স্বাধীনতা এসেছে দেশ দ্বিখণ্ডিত হয়ে। নিজেদের দেশ ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পাকিস্তানে। তারা চলে যান শিলিগুড়িতে বোনের কাছে। একবছর পর অসুস্থ স্বামী উয়েমন তাকেদা মারা যান। এরপর অনেকদিন বেঁচে ছিলেন হরিপ্রভা। ১৯৭২ সালে কলকাতার পণ্ডিত শশিভূনাথ হাসপাতালে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন হরিপ্রভা মল্লিক বা হরিপ্রভা তাকেদা। আজ থেকে একশ বছর আগে একজন সাধারণ মেয়ে হয়েও বিদেশী তরুণকে ভালবাসা ও তাকে বিয়ে করা, তার হাত ধরে সুদূর জাপান যাত্রা, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে টোকিও রেডিও থেকে সংবাদ পাঠ, যুদ্ধশেষে অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে দেশে ফিরে আসা এবং আমৃত্যু স্বামীকে সাহচর্য দেওয়া অসম্ভব সাহসের পরিচায়ক। একজন আধুনিক মহিলার প্রকৃত প্রতিনিধি হিসাবে তাকে বিবেচনা করা যায়। অথচ তার স্মরণে কোথাও কোন স্মৃতিচিহ্ন নেই।
বই নিয়ে শুধুমাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, বই নিয়ে শুধু মাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, নতুন প্রজন্ম চকঝমকের আকর্ষণে বইয়ের দিক থেকে ঘুরিয়ে নিচ্ছে মুখ। আমাদের এ আয়োজন বইয়ের সাথে মানুষের সম্পর্ককে অনিঃশেষ ও অবিচ্ছিন্ন করে রাখা। আশাকরি আপনাদের সহযোগিতায় আমাদের এই ইচ্ছা আরোও দৃঢ় হবে। দুনিয়ার পাঠক এক হও! বাংলা বই বিশ্বের বিবিধ স্থানে, সকল বাংলাভাষীর কাছে সহজলভ্য হোক! সাধ্যের মধ্যে থাকলে বইটি কিনবেন এই প্রত্যাশা রইলো।
0 Comments