মাঝে মাঝে খেদ কানে আসে যে বাংলার অনুবাদ সাহিত্য রচনায় খানিকটা যেন ভাঁটার টান এসে পড়েছে। কথাটা অর্ধসত্য, কেননা, গত এক-দুই দশকে অনুবাদকর্ম বাংলা ভাষায় কিছু কম হয়নি এবং যোগ্য অনুবাদকেরও তেমন টান পড়েনি। তবে প্রতীচ্যের সাহিত্য বিশেষত কবিতা আর লাতিন আমেরিকার উপন্যাস বাংলা অনুবাদে অনেকটাই পেয়েছি আমরা। তুলনায় ভারতের অন্যান্য ভাষার লেখালেখি সম্পর্কে অনুবাদকরা তেমন তৎপর বা উৎসুক নন। সাম্প্রতিক বঙ্গসন্তানদের ভিন রাজ্যের সাহিত্যপ্রয়াস সম্পর্কে সম্ভবত খানিকটা উদাসীনতা আছে। যদিও নাটক বিষয়ে ততটা অনাগ্রহ নেই, তবে তা ভিন রাজ্যের নাট্যদলের অভিনয় প্রসঙ্গে, সেই নাটক অনুবাদ প্রসঙ্গে নয়। তবে সমস্যাও আছে— নানা ভাষার এই বিচিত্র দেশে কতগুলি ভাষারই বা ঘনিষ্ঠ চর্চা আমরা করতে পারি? তার পরে পণ্ডিতরা তর্ক তোলেন, অনুবাদ কী হবে, আক্ষরিক না ভাবানুবাদ? মূল ভাষা থেকে সরাসরি অনুবাদ না সংযোজক কোনও ভাষা (যেমন ইংরেজি) থেকে অনুবাদ? ট্রানস্লেশন না ট্রান্সক্রিয়েশন? শঙ্খ ঘোষ এ-সব তর্ক ও সমস্যা বিষয়ে সচেতন ও সতর্ক থেকেও সুযোগ-সুবিধামতো অনুবাদের কাজটি বরাবর নীরবে করে যান। তবে তাঁর বহুব্যাপ্ত ব্যস্ত জীবনে অনুবাদকর্মের নিভৃত নির্জন খুঁজে পাওয়া মস্ত সমস্যা। সেই রকম এক সুযোগ আসে তাঁর ১৯৮৭-’৮৮-তে, ডাক পান সমুচ্চ সিমলার প্রাকৃতিকতা বিছানো জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রে, প্রাজ্ঞ বুধমণ্ডলীর সান্নিধ্যে। তাঁর ভাষায়, ‘আলস্য যাপনের জন্য’। সেই নিভৃত ভারহীন আলস্য যাপনের নমুনা হল এক মহাগ্রন্থ ইকবাল থেকে। জানাচ্ছেন, ‘‘সর্বোচ্চ চূড়ার সর্বোচ্চ প্রাসাদ, আরামবিলাসের অন্ত নেই, আর তার সঙ্গে উপচে-পড়া প্রাকৃতিক সম্ভার। সেইখানে বসে, হঠাৎ একবার মিলিয়ে দেখবার ইচ্ছে হলো রবীন্দ্রনাথ আর ইকবালের মতো প্রায়-সমকালীন দুই কবি-প্রতিভাকে। কাজটি কঠিন ছিল, কেননা মধ্যে ছিল ভাষা ও সংস্কৃতির এমনকী ধর্মবোধের ব্যবধান এবং ইকবাল সম্পর্কে শীর্ণ ধারণা ও তথ্যগত জ্ঞানের অপরিসরতা। তবু আরব্ধ কাজটি সম্পন্ন হল, তবে একটানা নয়, থমকে থমকে।” প্রথমার্ধ যদি সিমলায় ঘটে থাকে, তবে অপরার্ধের কর্মটি সম্পন্ন করলেন তিনি ১৯৯৪-এ এক চা-বাগিচার নিরালায় এবং ’৯৫-এ বেতলার জঙ্গলে। তবু ভরিল না চিত্ত, যে হেতু অপরার্ধের রূপান্তর কর্মে মূল ফার্সি বয়ানের সঙ্গে তাঁর কাজটি মিলিয়ে দেখা হয়ে ওঠেনি। ২০০৮-এ সে কাজ শেষ হওয়ার পরেও আরও চার বছর পার করে তবে ২০১২-য় এই বই তাঁর অনুমোদন পেল মুদ্রণের। আমরা পেয়ে গেলাম ইকবালের জাভিদনামা নামের শাশ্বত গানের অপরূপ বঙ্গভাষ্য, যাকে কবি-অনুবাদক সরাসরি মূল নামে উপস্থাপন না করে প্রচ্ছন্ন শিরোনামে বলেছেন ইকবাল থেকে। তাতে আমাদের দুটো লাভ হয়েছে। প্রথমত, ৩৬৪৬টি শ্লোকে বিধৃত মূল কাব্যের বাংলা রূপটি পেয়ে যাই স্বাদু ও স্বচ্ছ ভাষায় বিচিত্র ছন্দে, দ্বিতীয়ত পাই তথ্যবহুল ও বিশ্লেষণময় এক দীর্ঘ ভূমিকা, দু’টি অধ্যায়ে সাজানো। তাতে আমাদের ইকবাল-জিজ্ঞাসার পূর্ণতা ঘটে।
‘ইকবাল’ শব্দের অর্থ মহিমা বা গরিমা এবং এই মহিমময় কবির জন্ম ১৮৭৭ এবং মৃত্যু ১৯৩৮, সেই সঙ্গে রবীন্দ্র-সমকালীন। দু’জনের মধ্যে মননপ্রকর্ষ ও ভাবনার অনেক সমতা দেখা গেলেও এবং দেশধ্যানের স্বপ্নবাদিতা সত্ত্বেও ইকবালের মধ্যে স্বতন্ত্র প্রবণতা ছিল আমূল ইসলাম-প্রেমে। রবীন্দ্রনাথের আগ্রহসীমায় ইকবাল-রচনা পাঠের আততি ছিল এবং তা মিটেছিল যে হেতু ইকবালের কাব্য তত দিনে ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। ইকবালের কাব্য প্রথম দিকে উর্দুতে লেখা হলেও উত্তর পর্বে তিনি ফার্সিতে লিখতেই স্বচ্ছন্দ ছিলেন। জাভিদনামা ফার্সি ভাষাতেই লেখা, ইকবালের প্রয়াণের ছ’বছর আগে ১৯৩২-এ প্রকাশিত।
ইকবাল থেকে বইটির অনুবাদ অংশের ভালমন্দ নির্ধারণ করা আমার অসাধ্য কিন্তু অনুবাদ-ভাষার স্বাচ্ছন্দ্য ও ইকবাল-মানস অনুধাবনের ব্যাপারে তাঁর কবিতাপাঠের মুগ্ধতার কথা বলতে পারি। তবে গভীরতর প্রাপ্তি ৪১ পৃষ্ঠাব্যাপী দীর্ঘ পূর্বালাপে সমৃদ্ধ শঙ্খ ঘোষের গদ্যে লেখা আত্মপক্ষ। যার প্রথম কবুলতি হল ‘কেন ইকবাল’, তারপরে সেই ব্যতিক্রমী স্বয়ম্ভর কবির সানুপুঙ্খ জীবনকথা, বহুবিবাহ ও প্রণয়বার্তা, সমুজ্জ্বল বিদ্যাজীবন ও অধ্যাপনাপর্ব এবং বহুপঠনের বার্তা। তাঁর মানসগঠনে প্রতীচ্যের বেশ কয়েকজন কবির প্রভাব ও বিশেষ ভাবে নিট্সে-র চিন্তাধারার সংক্রাম, রুমি বা হাফিজের কাছে ঋণ ছাড়াও ইকবালের চেতনায় সূর্য, রামাবতার, বিশ্বামিত্র ও গৌতম বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা ও আস্থা ছিল। উপনিষদ ছিল তাঁর প্রিয় পাঠ্য— তার জন্য ইমামের রক্তচক্ষু তাঁকে বিদ্ধ করেছে। মার্ক্সবাদও তাঁর আয়ত্তগম্য ছিল, যদিও চরম আত্মপ্রসাদ ছিল ইসলামের প্রতি দ্বিধাহীন আস্থায়। বিশেষ কোনও দেশখণ্ড বা পাকিস্তান-স্বপ্ন নয়— তাঁর গর্বিত ঘোষণা ‘‘ইসলাম ছাড়া নেই আমাদের জন্মভূমি’’। বইটির পূর্বাপর পাঠ সাঙ্গ করে মনে হল এক জন পরমাশ্চর্য প্রতিভাধরের উপলবন্ধুর জীবনকথা ও আত্মদর্শনের সারমর্ম জেনে নিজেকে কিছুটা শিক্ষিত ও প্রাগ্রসর করা গেল। দেশপ্রেম থেকে ধর্মপ্রেমে পরিবর্তিত তাঁর মতিগতির কথা জানা হল। কিন্তু ইকবাল থেকে বইটির মূল লক্ষ্য ও প্রস্তাবনা জাভিদনামা-র অনুবাদ হলেও অনুবাদকের প্রয়াসের প্রকৃত অভিমুখ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ইকবালকে মিলিয়ে দেখা। পাঠকের সবচেয়ে বড় পারিতোষিক হল বইয়ের সেই সব অংশ, যেখানে দুর্লভ প্রজ্ঞা ও তুলনায়নের আলো ফেলে, নানা উদাহরণ মেলে ধরে, শঙ্খ ঘোষ দু’জনের দীপ্র অথচ স্বতন্ত্র অবস্থান বুঝিয়ে দেন। ইকবাল-মানস বোঝাবার জন্য উদ্ধৃত করেন ‘জাভিদনামা’ থেকে নানা চূর্ণ ও প্রকীর্ণ শ্লোক, আমরা আপ্লুত হই উৎকৃষ্ট কাব্যরস পানে, এবং যুগন্ধর এক কবিসত্তার গভীর নির্জন পর্যটনপথরেখা ধরে এগোতে। চমকপ্রদ তথ্য এটাও যে রবীন্দ্রনাথ ও ইকবালের মধ্যে অনপনেয় মানসদূরত্ব ছিল, সেটা ইকবালের দিক থেকে। ১৯৩৫-এ লাহৌরে দুই কবির দেখা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আসছেন জেনে ইকবাল লাহৌর ত্যাগ করেন। মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের ভাষা: ‘ঈর্ষা বৃহতের ধর্ম। দুই বনস্পতি মধ্যে রাখে ব্যবধান।’ কী নির্মম!
বইটির সম্পদ অসামান্য প্রয়াসে প্রণীত তথ্যপঞ্জি, জীবনপঞ্জি ও গ্রন্থপঞ্জি। এ ছাড়া আছে কয়েকটি দুষ্প্রাপ্য আলোকচিত্র, ইকবালের প্রতিকৃতি এবং ‘সারে জাঁহাসে আচ্ছা’ গানের মূল উর্দু পাণ্ডুলিপি। উপভোগ্য ও শিক্ষণীয় হল বইয়ের অনুষঙ্গে শঙ্খ ঘোষ ও সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের পত্রালাপের পাঠ। প্রচ্ছদে ক্যালিগ্রাফির অভিনবত্ব এবং সমগ্র গ্রন্থসজ্জা অত্যন্ত শোভন ও কৌলীন্যপূর্ণ।
বই নিয়ে শুধুমাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, বই নিয়ে শুধু মাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, নতুন প্রজন্ম চকঝমকের আকর্ষণে বইয়ের দিক থেকে ঘুরিয়ে নিচ্ছে মুখ। আমাদের এ আয়োজন বইয়ের সাথে মানুষের সম্পর্ককে অনিঃশেষ ও অবিচ্ছিন্ন করে রাখা। আশাকরি আপনাদের সহযোগিতায় আমাদের এই ইচ্ছা আরোও দৃঢ় হবে। দুনিয়ার পাঠক এক হও! বাংলা বই বিশ্বের বিবিধ স্থানে, সকল বাংলাভাষীর কাছে সহজলভ্য হোক! সাধ্যের মধ্যে থাকলে বইটি কিনবেন এই প্রত্যাশা রইলো।
0 Comments