রবীন্দ্রসংগীত প্রসঙ্গে
সুভাষ চৌধুরী: আপনি বলেছেন, ‘রবীন্দ্রসংগীতের একটা স্বকীয় বৈশিষ্ট্য আছে যেটা আগে কোনো ভারতীয় গানে ছিল না।’ সেই বৈশিষ্ট্য কী?
এমন অবস্থা কল্পনা করা খুব কঠিন যখন কোনো রামপ্রসাদী বা কীর্তন গান ছিল না। একজন এসে এইসব গান শুরু করে দিলেন। ওগুলো অবশ্য চিরকালই ছিল বলে আমরা ধরে নিই। কেউ এসে তৈরি করেছেন ভাবতেই অসুবিধা লাগে, অস্বস্তি লাগে, কারণ সেগুলো সকলের চেনা, এত পুরনো এমন সহজ সরল। কিন্তু কম্পোজার বলতে আমাদের যা অভিজ্ঞতা অর্থাৎ ছেলেবেলা থেকে যে সব গান শুনে এসেছি যেমন থিয়েটারের গান, ব্রহ্মসংগীত—তা সবই মোটামুটি রাগাশ্রয়ী, যা শুনলে প্রথমে সেই রাগটার কথা মনে করিয়ে দেয়, কোনো বিশেষ ব্যক্তির কথা অর্থাৎ গীতিকার বা সুরকারের কথা মনে করায় না। কথাটাকে সুরের ছাঁচে ঢেলে ফেলা হয়েছে। থিয়েটারের গান যা শুনেছি—মনে হত এটা বাংলা গান। তবে রাগাশ্রয়ী। ব্যক্তিগত সুরকারের যে খুব একটা বৈশিষ্ট্য সেখানে লক্ষ্য করেছি অর্থাৎ যার থেকে গানের সঙ্গে সঙ্গে সুরকারের নামটাও মনে গেঁথে যায়—আমার মনে পড়ছে না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গানে বারবার আমরা দেখতে পাচ্ছি তাঁর কথার মেজাজ সুরের মেজাজ রাগাশ্রিত হলেও সেখানে আর একটু সহজ করে নেওয়া, মোলায়েম করে নেওয়া। পরের দিকের গানগুলোতে যে রূপ আরও স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়েছে। অর্থাৎ আলাদা করে চিনে নেবার মতো। Composer-কে চিনে নেবার মতো। সারাজীবন ধরে ক্রমান্বয়ে গান রচনা করে গেছেন এমন উদাহরণও তো বিশেষ নেই। শুধুমাত্র Output-এর জোরেই তিনি একটি স্থান করে নিয়েছেন। অবশ্য নানা ধরণের প্রয়োজন নানা অনুপ্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন বলেই তাঁর বৈশিষ্ট্য ক্রমশ ফুটে উঠেছে।
সুভাষ চৌধুরী: আপনি বলেছেন বাংলা রাগ সংগীতে কীর্তন, রামপ্রসাদী, লোকসংগীত বা নিধুবাবুর টপ্পায় যে বাঙালি ভাব এটা (রবীন্দ্রসংগীত) সেভাবে তা নয়। এটা হলো রবীন্দ্রনাথের একান্ত নিজস্ব একটি বিশেষ শ্রেণীর বাঙালিয়ানার সাঙ্গীতিক প্রকাশ—এটা কেন বলছেন?
রবীন্দ্রনাথের পরিবেশ তো নিধুবাবুর পরিবেশ নয়। সেখানে তার মধ্যে তার সংস্কার, তার ঔদার্য, নানা রকমের জিনিসকে নিজের মতো করে নেবার ক্ষমতা—তা দেশী-বিদেশী সব সুরের ক্ষেত্রেই, আর সুরেই নয় তার বাণীতেও তা প্রকাশ পেয়েছে। তার পরিবেশ ছিল অনেক মার্জিত। সেটা হচ্ছে ঠাকুরবাড়িব রবীন্দ্রনাথের গানের মেজাজ। যেটা কথা আর সুর মিলিয়েই আসছে। সেটার সঙ্গে নিধুবাবুর টপ্পার মিল নেই। সেটা শ্রেণী অর্থাৎ সোস্যাল ক্লাস। সেই গানের কথা ও সুর শুনলেই বোঝা যাবে যে নিধুবাবু আর রবীন্দ্রনাথ এক সামাজিক স্তর থেকে আসেনি। এটাই বলবার উদ্দেশ্য।
সুভাষ চৌধুরী: প্রসঙ্গত এই প্রশ্ন কি তাহলে এসে পড়ে, রবীন্দ্রনাথের গান সাধারণের মধ্যে অর্থাৎ জনসাধারণ বলতে আমরা যা বুঝি তার মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে না। এই দীর্ঘ দিনেও প্রায় শহরকেন্দ্রিক হয়ে রইল সে কি কেবল এই কারণেই?
সেটা ঐ কারণেই। কোনো দিনই হবে না। সমাজ যদি কোনোদিন এক হয়ে যায় তবে হবে। কিন্তু গ্রাম সমাজ ও শহর সমাজের মধ্যে প্রচণ্ড একটা তফাৎ তো রয়েই গেছে। গ্রাম সমাজ কিছুটা কিছুটা করে শহরের দিকে এগিয়ে আসছে তা বলে এমন তো হয়নি দুটো প্রায় একাকার হয়ে গেছে। শিক্ষাদীক্ষারও অনেক তফাত রয়ে গেছে। সেইজন্য আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথের গান শিক্ষিতদের গান। কারো বিচ্ছিন্নভাবে একটা সুর ভাল লাগল, তিনি গুনগুনিয়ে গাইলেন সেটা স্বতন্ত্র কথা। কিন্তু যাকে বলে নিজের করে নেয়া, বা নিজের মনে করে গাওয়া, সেটা শিক্ষিত বাঙালির পক্ষেই প্রযোজ্য। আমার সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। অন্তত এতদিন তো তাই দেখছি।
সুভাষ চৌধুরী: আপনি বলেছেন গানই তাঁর একমাত্র সৃষ্টি যার পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে কাব্য, উপন্যাসের তুলনায় বিবর্তনের মাত্রাটা অনেক কম। একথা কি আপনি আজও মনে করেন?
না। বদলেছে, আবার বদলে গিয়ে যা হয়েছে সেটা চেঞ্জও বটে। কিন্তু ইভোল্যুশন যেটাকে বলে—‘নৌকাডুবি’ বা ‘শেষের কবিতা’য় যে পরিমাণ তফাত সেই তফাত গানে নেই। এক্ষেত্রে পরিমাণগত তফাতের কথাই উল্লেখ করতে চেয়েছি।
সুভাষ চৌধুরী: দুশো বছর আগের হিন্দুস্থানী সংগীতের শাস্ত্রসম্মত ও শিল্পগুণসম্পন্ন বিস্তারের যদি স্বরলিপি থাকত, আর আজকের দিনের ওস্তাদ যদি তাকে অবিকলভাবে আসরে পরিবেশন করতেন, তা হলে রবীন্দ্রনাথ কী বলতেন? অর্থাৎ নিজের সুর হুবহু গাইতে হবে?
হ্যাঁ। কম্পোজার বলেই বলেছি যেখানে কম্পোজ করার প্রশ্নটা আসছে সেই ক্ষেত্রে। যাঁরা রাগের রূপটি নির্ণয় করে গেছেন তাঁদের এক রকম কম্পোজার বলতে পারেন। গোড়ার যুগে তানসেন, বৈজু বাওরা যে স্ট্রাকচার কম্পোজ করে গেছেন তারপরে গাওয়ার সময় থিওরির মধ্যেই সে স্বাধীনতা দেওয়া আছে। সেখানে কতকগুলো নিয়ম রক্ষা করে নিজের নিজের মতো বিস্তার করতে হবে। এখানে বিস্তারের প্রশ্ন তো আসছে না। এখানে উনি বিদেশী অর্থে কম্পোজার, যে অর্থটার আগে এখানে খুব বেশি ব্যবহার হয়নি। অর্থাৎ যেভাবে আমি কল্পনা করেছি, যে ভাবে সেটাকে স্বরলিপিবদ্ধ করেছি সে ভাবেই গাইতে হবে। উনিশ-বিশ হয়, কিন্তু বিদেশী সুরকার পিয়ানোর সঙ্গে সংগীত লিখে যান, সেখানে একচুল এদিক ওদিক করবার উপায় নেই। সেখানে কোনোই স্বাধীনতা নেই। ইন্টারপ্রিটেটিভ স্বাধীনতা কেউ একটু সুরের দিক থেকে, কেউ একটু stress এর দিক থেকে নিতে পারে। মেট্রোনমিক লয় হুবহু লয় নির্ধারণের কোনো ব্যবস্থা কোনো পদ্ধতি তো নেই। গায়কের অল্প-বিস্তর স্বাধীনতা সেখানে থাকবেই। অর্কেস্ট্রা বহুল গানেই বলুন সেখানে গায়ক কী করছেন তার বিচার সেটুকুর মধ্যেই। কারণ অর্ধেকের বেশি কাজ করে দিয়ে গেছেন কম্পোজার নিজে। গায়ককে শুধু গেয়ে দেখাতে হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে ততটা আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা নিয়ম নেই কারণ তিনি তো কোনো সঙ্গত-এর নির্দেশ দিয়ে যান নি। তিনি শুধু গান হিসেবেই লিখে গেছেন। যখনই তার সংগত-এর প্রশ্ন উঠবে, যখনই তার একটুখানি বিরতির প্রশ্ন উঠবে, সেখানে খানিকটা তো অদল বদল হয়ে যাবে। শাস্ত্রীয় সংগীতে গায়কের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র আছে কিন্তু সুরকারের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র বলে কিছু নেই। তা থাকতেই পারে না। সেটাই ধর্ম। রীতি মানছি বলে উদ্ধার করছি তা নয়। সেখানেও প্রচণ্ড স্বাধীনতা রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ আপত্তি করেছিলেন একই জিনিস গেয়ে যাবে কেন? আসলে উনি গান হিসেবে ভেবেছেন বলে বলেছেন। হয়তো ছেলেবেলায় তাঁকে আমাদের মত ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে রাগসংগীত শুনতে হয় নি। রবীন্দ্রনাথকে সম্ভবত পারিপাশির্বক চাপে তেমন করে আসরে গিয়ে গান শুনতে হয়েছে, কিন্তু সেটার মধ্যে অনেক তফাত। ঘটনাচক্রে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর ঐভাবে গান শোনার অভ্যাস গড়ে ওঠেনি। কেউ ভালো রাগসংগীত গাইছে বলে আগ্রহ করে তার গান ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে তিনি শুনেছেন বলে জানা নেই। বড়জোর কোনো একজন ভালো গাইয়ে বা বাজিয়ে কে তাঁর কাছে এনে বলা হয়েছে ইনি ভালো গান, এঁর গান শুনুন ইত্যাদি। তাই ঐ অভ্যাস তাঁর গড়ে ওঠেনি। যদুভট্টের গান তিনি শুনেছেন কিন্তু তান বিস্তার সহযোগে খেয়াল গান কি তেমন করে শুনেছেন?
সুভাষ চৌধুরী: ‘রবীন্দ্রনাথ কথার সঙ্গে সুরের অর্ধনারীশ্বর সম্পর্কে’র কথা বলেছেন। ‘সাধারণত সব দেশে সব কালেই গানের কথাকে সুরের বাহন হিসেবে মনে করা হয়। অর্থাৎ সুরই কথাকে চায়।’ রবীন্দ্রনাথের গানের পরিপ্রেক্ষিতে আপনার এই বক্তব্য কতখানি প্রযোজ্য?
আমার কাছে এই জিনিসটা খুব পরিষ্কার। কথা সুর মিলিয়েই তো গান। যেহেতু এটা গান, কবিতা নয়, তাই অবশ্যই সুরের প্রাধান্য বেশি। সুরটা বেরোচ্ছে কথা থেকে। এমন অনেক সময় দেখা যায়, যদি রাগাশ্রয়ী গান হয় তো, দুটো সম্পূর্ণ আলাদা ভাবের গানকে কথার দিক দিয়ে কিন্তু একই রাগের ছাঁচে ঢেলে ফেলা হয়েছে।
সুভাষ চৌধুরী: আপনার নিজের গান রচনার সময় সুর আগে আসেনি?
না। প্রথমত আমার গান রচনা করার ব্যাপারে আমাকে জায়গা খুঁজতে হয়েছে। অর্থাৎ কোনখানে গান আসতে পারে। জায়গা মানে ঘটনা-পরিবেশ, সিচুয়েশন, যখন একটি চরিত্রের মুখে গান দিয়েছি তার পারিপার্শ্বিক ঘটনা থেকে গানটার উদ্ভব হয়েছে। কারণ আমার তো ড্রামাটিক গান। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে তা হয়েছে গীতিনাট্য নৃত্যনাট্যের বেলায়।
সুভাষ চৌধুরী: ‘শুনেছি রবীন্দ্রনাথ সুকণ্ঠ ছিলেন। তিনি নিজেও একথা বলেছেন। তাঁর চল্লিশ বছর বয়সে গাওয়া গ্রামোফোন রেকর্ডের ‘বন্দেমাতরম্’ গানে এর প্রমাণ আছে। কিন্তু এ গান শুনলে এটাও বোঝা যায় যে, তাঁর গলার ‘কাজ’ খুব বেশি ছিল না। অন্তত যে কাজে খেয়ালের তান হয়, তাতো নয়ই।’ আপনার এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা কি বলা যায় এই জন্যই রবীন্দ্রনাথের গানে তানের পরিমাণ অনুল্লেখ্য।
কথাটা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। কেননা তান প্রয়োগ করলেই সেটা যে রাগাশ্রিত হয়ে যাবে বা রাগের অনুকরণ হবে তার তো কোনো মানে নেই। কিন্তু আমার মনে হয়েছে যে গান তাঁর গলায় আসছে এবং যে গান ক্রমে ক্রমে রচিত হয়েছে তা থেকেই কিন্তু রীতিতে দাঁড়িয়ে গিয়েছে যে তানটা কম। তান বলতে যেটা বোঝায় তা দক্ষিণী সুর ভাঙা দু-চারটি গান যা করেছেন। ‘বাজে করুণ সুরে’ সেখানে যেহেতু সুরটাই ঐ রকম ছিল, সেই সুরে কথাটা সংযোগ করে যে গান তিনি রচনা করলেন তাতে তান রয়ে গেল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নিজের থেকে স্বতঃসর্ফূভাবে যে গান রচনা করেছেন তার মধ্যে তান খুবই কম। রবীন্দ্রনাথের নিজের গাওয়া ‘বন্দেমাতরম্’ শুনে আমার এই সিদ্ধান্ত।
সুভাষ চৌধুরী: এই প্রসঙ্গেই আপনি দুটো গানের কথা ‘পথহারা তুমি পথিক যেন গো’ এবং ‘পরবাসী চলে এসো ঘরে’ উল্লেখ করে দ্বিতীয় গানটির সম্পর্কে বলেছেন এ গান রাগ সংগীতের কথা মনে করায় না—এ খাঁটি রবীন্দ্রসংগীত কেন?
ভাল খারাপের প্রশ্ন ছেড়ে দিলে ‘পরবাসী চলে এসো’ টাই রবীন্দ্রসংগীত, কারণ ও-ধরণের গান কেউ আগে লেখেন নি, ওটা উনিই লিখেছেন।
সুভাষ চৌধুরী: ‘রাগের এই অপ্রতিভ চেহারাটা অনেক রবীন্দ্রসংগীতে পাওয়া যায়’— আমার বিশ্বাস এই ‘অপ্রতিভ চেহারা’ আপনি সচেতন ভাবেই ব্যবহার করেছেন। কিন্তু কেন?
রাগের কথা মনে করেই বলেছি? রাগের যা অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা তার কথা মনে করেই বলেছি। রাগ মিশ্রণের প্রশ্ন উঠছে না। সে কথা আমি বলিনি। আমি বলেছি রাগের চেহারা কেমন ন্যাড়া হয়ে যায়। সুরগুলো লাগছে কিন্তু সুরের মধ্যে শ্রুতি লাগছে না। তাই রাগের চেহারা এখানে ম্লান হয়ে যায়।
সুভাষ চৌধুরী: যদি একজন রাগসংগীতে প্রকৃত শিক্ষিত এবং পারঙ্গম শিল্পীকে স্বাধীনতা দেওয়া যায় তাহলে তার প্রবণতা রাগরূপের প্রতি যদি বেশি প্রকাশিত হয় সে ক্ষেত্রে গান হিসেবে রবীন্দ্রসংগীত তাঁর কণ্ঠে উপযুক্ত মর্যাদায় রূপগ্রহণ নাও করতে পারে তো?
সেখানে অনেকখানি গায়কের উপর নির্ভর করতে হবে। বেশ কিছু গান আছে যা এক একজনের গলায় শুনলে আমার মনে হয়, এখানে আর একটু মেজাজ এলে ভালো হয়। গানের কথা যেভাবে গাইলে আরো বেশি খোলে, সুরগুলো যেভাবে লাগাচ্ছেন, তাতে যেন রূপ খুলছে না। উনি যেন ধরেই রেখেছেন ‘আমার গান ঘরে ঘরে গাওয়া হবে’, আর তাই এই দিকটার কথা উল্লেখ করেন নি। তবে উনি তো কম কথা বলতেন, কার গান শুনে কি বলছেন, বললেও, তা কী অর্থে বলেছেন—তা তো সব সময়ে জানা যায় না। ‘বেশ ভালো হয়েছে’ বলেছেন কিন্তু দেখা যাবে তার মধ্যে বেশ খানিকটা ক্ষোভ রয়েছে। তা সত্ত্বেও উনি এই কথা বলছেন, কারণ যখন সমালোচনা করার প্রশ্ন আসছে তখন সেখানে তর্কের বিষয় তলিয়ে দেখার প্রশ্নে এসে যাচ্ছে। উনি সেটি বোধহয় এড়িয়ে গেছেন। অর্থাৎ মোটামুটি সুরে তালে গাইছেন, মিষ্ট কণ্ঠ তাকেই ভালো গাইছে বলেছেন।
সুভাষ চৌধুরী: কোরাস গান সম্পর্কে আপনার কাছে আলাদাভাবে প্রশ্ন রাখছি। কোরাস গানের মান কি আগের চেয়ে উন্নত হয় নি?
আমার গান শোনার অবকাশ আজকাল কমে গেছে। তাই এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহজ নয়। তবে এটুকু বলতে পারি যে, ছোটবেলায় আমার নিজের বাড়িতে আত্মীয়স্বজনদের গলায় গাওয়া যে কোরাস শুনেছি এবং ব্রাহ্মসমাজের মাঘ উৎসবে যে কোরাস শুনেছি তার চেয়ে ভালো কোরাস আজকাল গাওয়া হয় কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ আছে।
সুভাষ চৌধুরী: রবীন্দ্র প্রবর্তিত নতুন তালগুলির প্রসঙ্গে আলোচনায় আপনি বলেছেন ‘কেন এমন অসাংগীতিক তালের উদ্ভব করলেন?’
এই ধরণের গানগুলো কি খুব প্রচলিত হয়েছে? তুলনামূলকভাবে বিচার করলে দেখবেন অন্যান্য গানের মতো ততটা জনপ্রিয়তা পায়নি। এইসব তালে নিবদ্ধ গানগুলোর যতির অভাব, কেবল গাণিতিক দিকটির প্রতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়াই হয়। তাতে কি কোন সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়?
সুভাষ চৌধুরী: ‘সৌভাগবশতঃ ছন্দের এই বিদ্রোহী চেহারাটা খুব কম রবীন্দ্রসংগীতে পাওয়া যাবে। অপেক্ষাকৃত দুর্বল যে সমস্ত গান তার বেশির ভাগেই ছন্দের এই যান্ত্রিক দিকটা দেখা যাবে। কিছুটা হয়তো নৃত্যনাট্যের প্রয়োজনে গানের বক্তব্য আরো বেশি পরিষ্কার করার জন্য তাঁকে এই রীতি অবলম্বন করতে হয়েছিল।’ এ বিষয়ে আপনার সঙ্গে একমত না হলেও তবু জিজ্ঞাসা করি আজও কি আপনি এই মত পোষণ করেন?
না। এ উক্তি হয়তো কিছুটা অসতর্ক হয়ে গেছে। নৃত্যনাট্যের ক্ষেত্রে নতুন তালের কথাটার ওপর অতটা জোর দিতে চাইনি। আমি বলতে চেয়েছিলাম তালের যান্ত্রিক দিকটার কথা। এই ধরণের তালের যে গানগুলো প্রচলিত হয়েছে সে গানগুলোতে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে প্রয়োজনীয় যতির অভাব নেই এবং সেজন্য গাওয়ার দিক থেকেও কোনো অসুবিধা নেই।
সুভাষ চৌধুরী: ‘রবীন্দ্রনাথের গানে এই যে বকুল, পারুল, চাঁপা, টগর, চামেলির সম্ভার, এই যে শরতের আলো, ফাল্গুনের রং, বরষার গুরু গুরু, বসন্তের হাওয়ার হিল্লোল যা মনের দোলায় দেয় দোল, এই যে মনের বীণায় সুরের পরশ, হৃদয়ের তন্ত্রীতে বেদনার ঝংকার—এই যে দূরে যাওয়া, কাছে আসা, আধো চাওয়া আধো হাসা—এও কি ‘কৈসে পনিঘট জাঁউ’ আর ‘পিয়া পিয়া পাপিয়া’ আর ‘ভরু ভরু অঙ্গ আঁখিয়া’র মতোই ফরমুলা নয়, Cliche নয়—এ কথায় বিদ্রোহের ছাপ কোথায়?’ এ কথা আপনি বলেছেন। আপনার সঙ্গে এ বিষয় সম্পূর্ণ ভিন্নমত হয়েই এ প্রশ্ন করছি। রবীন্দ্রনাথের সমস্ত গান সম্পর্কে আপনি কি এখনো এই মত পোষণ করেন?
না। কিন্তু মিডল্ পিরিয়ডের অনেক গানের সুর আগে এসেছে। সেক্ষেত্রে অনেক গান প্রসঙ্গে আমার ব্যক্তব্য জাস্টিফাই করা যায়। তবে সামগ্রিক বিচারে শেষের দিকের গান সার্থক একথা বলা যায় না। এমন দু-একটা মন্তব্য পাবেন, কারণ লেখাটার সময় রবীন্দ্রসংগীতের সামগ্রিক চর্চার সুযোগ বা সময় ছিল না।
সুভাষ চৌধুরী: আপনি রবীন্দ্রনাথের গানের স্বরলিপি প্রসঙ্গে কতকগুলো প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন এবং ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে’ গানটার জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, দিনেন্দ্রনাথ এবং সরলা দেবীর স্বরলিপি পাশাপাশি রেখে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্বরলিপির পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেছেন। সাধারণ গায়কের পক্ষে কি এইভাবে স্বরলিপির এই তফাতটুকু বিচার করা সম্ভব?
আমার মতে বিচার করার প্রশ্নই ওঠা উচিত নয়। স্বরলিপি একটাই থাকা উচিত। অবশ্য যা হয়ে গিয়েছে তা তো রাখতেই হবে।
সুভাষ চৌধুরী: নমুনা হিসেবে ‘মন্দিরে মম কে’ প্রথম ছত্রটিতে কয়েকটি অলংকরণ যোগ করে আপনি স্বরলিপির মধ্যে গায়কীর নমুনা রাখতে চেয়েছেন। তা কি সাধারণ গায়কের সাধ্যাতীত নয়?
রবীন্দ্রনাথের গান মাঝারিদের মধ্যেই থাকছে। অথচ এটা মাঝারিদের কর্ম নয়। দুটো জিনিস একসঙ্গে চাইছি বলেই এই গণ্ডগোল। জিনিসটার খুব বেশি প্রচার যদি চাই তাহলে আসল রূপ প্রকাশিত হবে এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। কাজেই দু-রকমই চলতে থাকবে। এক একজন প্রতিভাধর গায়কের কণ্ঠে এক-একটি গানের আশ্চর্য রূপ দেখতে পাব। আর তারই মোটা সংস্করণ দেখব সাধারণ গায়কদের মধ্যে। এক-একজন প্রতিভাধর গায়কের গলায় আমরা আসল চেহারাটা সুন্দর চেহারাটা বা শ্রেষ্ঠ চেহারাটা পাব, যা অন্যদের ক্ষেত্রে পাব না। আর একটা জিনিস রবীন্দ্রসংগীত এখন যে ঘরে ঘরে চলছে সেই ঘরে ঘরে গাওয়াটাকে তো আমরা প্রামাণ্য বলে ধরতে পারি না।
সুভাষ চৌধুরী: কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে সাধারণ শ্রোতারা তো জনপ্রিয় শিল্পীর কণ্ঠে গান শুনতে চাইছেন। অধিকাংশ জনপ্রিয় শিল্পীর কণ্ঠে কিন্তু সাদামাটা রূপ পাচ্ছি। সেক্ষেত্রে অবস্থা কী দাঁড়াচ্ছে?
আপনি যে প্রশ্ন তুলেছেন তা সব আর্টের একেবারে গোড়ার প্রশ্ন। তার মানে লোয়েস্ট কমন ডিনোমিনেটর-এর কাছে তার কী পছন্দ সেটা তো বাজারে চলবেই। কিন্তু রাগসংগীত যিনি শুনতে যাবেন তিনি তো নির্বাচন করেই যেতে পারবেন। রবীন্দ্রসংগীতের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অন্য কথা। খুব সাধারণ লোকেরা তো জনপ্রিয় গায়কের গানটাই পছন্দ করবে—এটাতো পাশাপাশি থাকবেই। এটার কোনো রাস্তা নেই। কোনো সমাধান আছে বলে তো আমার মনে হয় না। এখন সব স্কুলে যেখানে রবীন্দ্রসংগীত শেখানো হয় সে সব স্কুলে যদি পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয়, এটা পপুলার ভাবে গাওয়া এবং আসল ভাবে গাওয়া—এই ভাবেই গানটা বেশি ফুটবে—এই তফাতটা তারা যদি ধরিয়ে দিতে পারেন—সেখানে তেমন উপযুক্ত শিক্ষক যদি থাকেন, তা ছাড়া আর কী করে হবে।
সুভাষ চৌধুরী: প্রচার মাধ্যমগুলো যদি সাবধান হয় তবে কি কোনো সুবিধা হয় না?
সাবধান হতে হলে একটা পুলিশী ব্যবস্থা থাকতে হবে যে জিনিসটার একটি পাহারা তো চাই। তাহলে তো মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোকের মধ্যে একজনকে রেডিও, একজনকে টেলিভিশন ইত্যাদিতে রাখতে হবে। কিন্তু তেমন লোকই বা কই আর সে ব্যবস্থাটাই বা করছে কে? এটা তো আমাদের সমস্যা।
সুভাষ চৌধুরী: আপনি এরপর উচ্চারণের প্রশ্নটা তুলেছেন। খুবই সঙ্গত প্রশ্ন। কিন্তু আগের কালের তুলনায় এখন কি উচ্চারণ অনেক উন্নত হয়েছে বলে আপনার ধারণা?
তফাৎ হয়েছে বলে মনে হয় না। সকলের উচ্চারণ শুনে আমার মোটেই ভালো মনে হয় না। স্পষ্ট উচ্চারণ অনেকেই করে না। সুচিত্রা মিত্রের মতো খুব অল্প কয়েকজনই স্পষ্ট উচ্চারণ করেন। এমনকি যাঁরা বেশ ভালো গাইয়ে হিসেবে প্রতিষ্ঠিত তাঁদের অনেকের উচ্চারণই খুব স্পষ্ট নয়। আগেকার দিনের উচ্চারণ কিন্তু তুলনায় অনেক ভালো ছিল অর্থাৎ উচ্চারণের মধ্যে এতটা আড়ষ্টতা ছিল না। সাধারণভাবে বাচনভঙ্গির অবনতি ঘটেছে। ফিল্মে অভিনয় করাতেই তো ছেলেমেয়েদের কথার অনেক ত্রুটি পাই। উচ্চারণ সম্পর্কে সচেতনতাই অনেক কমে গেছে। আগে থিয়েটারের শিক্ষায় উচ্চারণ একটা অঙ্গ ছিল যা বর্তমানে সে পরিমাণে নেই যা গানেও রিফ্লেকটেড হচ্ছে।
সুভাষ চৌধুরী: গান এর সংগতের প্রশ্নে আপনি বলেছেন, টানা গানের সঙ্গে যদি টানা যন্ত্রে তার পুনরাবৃত্তি হতে থাকে তাহলে সংগীত টটোলজি দোষে দুষ্ট হয়ে পড়ে। আর সেইজন্য আপনি বলেছেন গানের তাল বুঝে, মেজাজ বুঝে প্রত্যেক গানের জন্য আলাদা সংগত রচনা করা উচিত। এই সংগত প্রসঙ্গে আপনি একটু বিস্তারিতভাবে বলবেন? অর্থাৎ প্রতেক গানের নির্দিষ্ট করে দেওয়া সম্ভব কি?
না, তা আমি জানি না। যদি উপযুক্ত লোককে দিয়েও তা করানো হয় সবাই তা মানবে কেন? ওখানে অনেক প্রশ্ন এসে পড়বে। আসলে উনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে যে সব বাংলা গান রচনা করা হয়েছে তার কোনোটার সঙ্গেই সংগত রচনা করা হয়নি। সেখানে ধরেই নেওয়া হয়েছে কিছু না কিছু বাজবে এর সঙ্গে কোনো তালের যন্ত্র বাজবে। গান তো সংগত ছাড়া হবে না। সেইজন্য রবীন্দ্রনাথের যেমন তেমন সংগতের একটা ট্রাডিশন হয়ে গেছে। সেখানে অন্তত এরকম কতগুলো নিয়ম করে দেওয়া যায়। অর্থাৎ টটোলজি বর্জন প্রথম। অর্থাৎ সংগতের সময় contrast-এর কথা মনে রাখতে হচ্ছে। সাধারণ মিউজিসিয়ানদের পক্ষে তো তা সম্ভব নয়। আমি ‘বাল্মিকী প্রতিভা’ নিয়ে একবার ভেবেছিলাম। কোনোদিনই অবশ্য খুব একটা তলিয়ে ভাবিনি। তবে ইচ্ছেটা যে একেবারে চলে গেছে তাও নয়। তখন ভেবেছিলাম ইন্টারলিউড মিউজিক করে একেবারে অর্কেস্ট্রেট করে করব। তাতে অভিনয়েরও অনেক স্বাধীনতা এসে যাবে। কারণ ইন্টারলিউড অভিনয়কে সাহায্য করে বলে আমার মনে হয়।
সুভাষ চৌধুরী: কিন্তু গ্রামোফোন ডিসক্ তো হতেই পারে।
অবশ্যই পারে।
সুভাষ চৌধুরী: ‘আজকাল যা হচ্ছে তাতে রবীন্দ্রসংগীতকে সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না।’ এখনোও কি আপনি সেই মত পোষণ করেন?
রবীন্দ্রসংগীত তো থাকবেই। আমি বলছি—ঠিক রাখার জন্য যে বিশাল সমস্যা তার সমাধান হওয়া সম্ভব নয়।
সুভাষ চৌধুরী: আপনি একবার একটা ইন্টারভিউ-এ বলেছিলেন যে পারফরমার ইজ নেভার গ্রেটার দ্যান মিউজিক। রবীন্দ্রনাথের গানের ক্ষেত্রে এখন কি তাই হচ্ছে? বরং উল্টোটাই তো দেখছি।
রবীন্দ্রনাথের গানের ক্ষেত্রে তা হচ্ছে না, এইজন্য যে বিদেশে সংগীত পরিবেশনের মান খুবই উঁচু। সেখানে কী বাজছে লোকে সেটাই আগে দেখে। যিনিই বাজান-না কেন তাঁর উৎকর্ষ একটা মোটামুটি থাকবে। রবীন্দ্রনাথের গানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পারফরমার-এ আকাশ পাতাল তফাৎ। কারণ ‘মরি লো মরি’ শুনব যখন অমিয়া ঠাকুরের গলাতেই তা শুনতে চাইব। সেই যে জোঁড়াসাঁকোর বাড়িতে শুনেছি দাঁড়িয়ে গাইতেন, আজও আমার কাছে তা স্মৃতি হয়ে আছে।
সুভাষ চৌধুরী: তবলাতে যে কোনো গানেই যে একই ঠেকা বাজে এবং অধিকাংশ গানেই দ্বিগুণ লয়েই বাজতে থাকবে এর বিহিত কী ভাবে করা যাবে?
খুবই বিপজ্জনক ঠিকই। কিন্তু তবলা সব গানে বাজাবার দরকার কী? বাজলেও খুব সাধারণ ঠেকা, কেবলমাত্র ছন্দ বজায় রাখার জন্য বাজানোই তো যথেষ্ট।
সাক্ষাৎকার: সুভাষ চৌধুরী
আজকাল / ২৯ মার্চ, ১৯৮১
0 Comments