বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম অধ্যায় হলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। আর এই মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল কেমন ভয়াবহ ছিল তা বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময়ে দেশের মধ্যে অবরুদ্ধ জীবন কেমন ভয়াল, বিভীষিকাপূর্ণ ছিল, সেই নারকীয় আতঙ্কের ভুবনের কথা বলতে গিয়ে কবি শামসুর রাহমান এক আলাপচারিতায় জানিয়েছিলেন, ''১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে- পয়লা এপ্রিলে গণহত্যা শুরু হলে ওই দিনই ঢাকা ছেড়ে চলে যাই আমাদের গ্রামের বাড়ি পাড়াতলীতে। তো ওখানে গিয়ে এপ্রিলের ৮-৯ তারিখের দিকে বোধ হয়- এই দুপুরে- একসঙ্গে ঘণ্টা দেড়েকের ব্যবধানে দুটি কবিতা লিখি। একটি হলো 'স্বাধীনতা তুমি', আরেকটি হলো 'তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা'। সারাদিন নয়াবাজার পুড়েছে, দাউ দাউ করে আগুন জ্বলেছে, ওটা দেখেছি। এ যে কী অভিজ্ঞতা, এখন ঠিক আমি বলতে পারছি না- তখনকার মানসিক অবস্থা যে কী রকম ছিল! ... তারপর মে মাসের শেষের দিকে আমরা চলে এলাম ঢাকায়। ঢাকায় এসে যখন নামলাম, রাস্তাগুলো দেখে আমার মনে হলো যেন এ আমার শহর নয়, এ শহর আমার কাছ থেকে কেউ ছিনিয়ে নিয়েছে।''
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কেউ কেউ বিপন্ন দিনের অভিজ্ঞতার কথা লিখে রাখতেন। মুক্তিযুদ্ধকালের এমন একটি দিনপঞ্জি উদ্ধার করা গেছে। ডায়েরিটি একজন মুক্তমনা প্রবীণ শিক্ষাবিদ অধ্যাপক শামসুল হুদার (১৯১০-৮৯), যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে অবরুদ্ধ ছিলেন ঢাকায়। অধ্যাপক শামসুল হুদার এই দুর্লভ ও মূল্যবান ডায়েরিটি সংগ্রহ-সংকলন-সম্পাদনা করেছেন গবেষক ডক্টর আবুল আহসান চৌধুরী। 'অবরুদ্ধ ঢাকা :মুক্তিযুদ্ধকালের অপ্রকাশিত দিনলিপি' শিরোনামে বইটি ঐতিহ্য প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে। অধ্যাপক শামসুল হুদা লিখতেন। মুক্তচিন্তার মানুষ ছিলেন তিনি। যৌবনে ১৯২৬-এ প্রতিষ্ঠিত 'বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনে'র সংগঠন 'মুসলিম সাহিত্য-সমাজে'র অন্যতম সক্রিয় কর্মী ছিলেন।
অধ্যাপক শামসুল হুদা মুক্তিযুদ্ধকালের দিনপঞ্জিতে তার স্মৃতি-শ্রুতি-অভিজ্ঞতার আলোকে সেই ভয়াবহ নারকীয় সময়ের চিত্র তুলে ধরেছেন। ধর্মের নামে, গণতন্ত্রের নামে, দেশরক্ষার নামে খানসেনা আর তাদের দোসর-দালালেরা হত্যা-ধর্ষণ-নির্যাতনের যে কলঙ্কময় ইতিহাস গড়েছিল, এই ডায়েরিতে সেই নিষ্ঠুর অপকর্মের স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে। ডায়েরির লেখক তার অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ও দূরদৃষ্টি থেকে স্পষ্টই উপলব্ধি করেছিলেন, মানবতা ও ন্যায়বিচারহীন সভ্যতাবিরোধী এই রাষ্ট্র কোনোক্রমেই টিকে থাকতে পারে না। সেই কারণে মুক্তিসংগ্রামের বিজয় সম্পর্কেও নিশ্চিত ছিলেন। একজন মানবতাপন্থি বিবেকি মানুষের এই অন্তরঙ্গ পর্যবেক্ষণ ও উপলব্ধি, মুক্তিযুদ্ধের এক মূল্যবান তথ্যদলিল হিসেবে বিবেচিত হবে।
ডায়েরি শুরু হয়েছিল ইংরেজিতে। তবে এপ্রিলের গোড়া থেকে বাংলায় লেখেন। তার আট মাসের ডায়েরি থেকে কিছু অংশ তুলে ধরা হচ্ছে।
[২ এপ্রিল] আজ রাত ৮টা ৪৫ মিনিটে টেলিভিশনে জিঞ্জিরা সম্বন্ধে যা বলা হয়েছে তা সর্বৈব মিথ্যা। দুস্কৃতকারী অথবা শহরে ফেরা লোকজনের প্রতিরোধকারী নয়, জিঞ্জিরায় শরণার্থী হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে নিরীহ মানুষের ওপর ভোর চারটা থেকে সকাল ছয়টা পর্যন্ত মর্টার বর্ষণ করা হয়েছে। সিরাজ (মায়ার পূর্বতন স্বামী) তার মাকে নিয়ে আসতে গিয়ে অন্তত সাত-আট ক্ষেত্রে অগ্নিকাণ্ড দেখে এসেছে। মিথ্যা প্রচারণা দিয়ে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী তাদের দুস্কর্ম ঢাকতে চাচ্ছে। যে কোনো রাষ্ট্রই হোক না কেন, তার প্রধান বাহন যখন হয়ে ওঠে মিথ্যা, সে রাষ্ট্র টিকতে পারে না।
২১/৪ : আজও মাঝে মাঝে পাকসৈন্য ও রেঞ্জারদের দ্বারা নরহত্যা ও লুণ্ঠনের খবর পাওয়া গেছে।
একজন বললেন (আমার বাড়ির সামনে ংযবফ-এর দোকানদার) যে সে স্বচক্ষে দেখে এসেছে, অর্থাৎ তার আত্মীয়া এক ধাত্রীর কাছ থেকে শুনেছে, মিটফোর্ডে সাড়ে তিনশ মেয়ে ধর্ষিত হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছে। তন্মধ্যে বারো বছরের মেয়ের ওপর ১৭ জন সৈনিক পরপর অত্যাচার করেছে। সে মরণাপন্ন।
২৬/৪ : আজ শুনলাম শেখ সাহেবের ওপর অকথ্য অত্যাচার করা হচ্ছে। উদ্দেশ্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার স্বীকৃতি আদায়। তার শরীর নাকি ভেঙে পড়েছে। এ জন্য সকলের দুঃখের অবধি নেই। এ দুঃখ কেউ বাইরে প্রকাশ করতে পারছে না, কিন্তু অন্তরে কারও স্বস্তি নেই।
১০/৯ : আজ রাতে (দিবাগত) শুনলাম, জাহানারা ইমামের বড় ছেলেটিকে ধরে নিয়ে গেছে বা ছেলেটি ধরা পড়েছে। বড় দুঃখের কথা। জাহানারা কী করে সহ্য করছেন? একই সময়ে কাপাসিয়া অঞ্চলে গ্রামের পর গ্রাম ঘেরাও করে নিরীহ গ্রামবাসীদের হত্যা করা হয়েছে, সমানে লুট, নির্যাতন, নারী ধর্ষণ চলেছে। উল্লেখ্য, ও অঞ্চলটায় তাজউদ্দীনের পৈতৃক বাসভূমি, ওর গ্রামের নামটা আমার জানা নেই।
তার আট মাসের ডায়েরি নিঃসন্দেহে মুক্তিযুদ্ধ সময়কালের এক মূল্যবান দলিল হিসেবে বিবেচিত হবে। যা যে কোনো প্রজন্মের কাছেই ঐতিহাসিক স্মারক। এমন নানান জনের ব্যক্তিগত দিনলিপি থেকে একাত্তরের জানা-অজানা নানা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় পাঠকের সামনে আমাদের জন্মযুদ্ধের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতার বয়ান হয়ে ওঠে।
বই নিয়ে শুধু মাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, নতুন প্রজন্ম চকঝমকের আকর্ষণে বইয়ের দিক থেকে ঘুরিয়ে নিচ্ছে মুখ। আমাদের এ আয়োজন বইয়ের সাথে মানুষের সম্পর্ককে অনিঃশেষ ও অবিচ্ছিন্ন করে রাখা। আশাকরি আপনাদের সহযোগিতায় আমাদের এই ইচ্ছা আরোও দৃঢ় হবে। দুনিয়ার পাঠক এক হও! বাংলা বই বিশ্বের বিবিধ স্থানে, সকল বাংলাভাষীর কাছে সহজলভ্য হোক! সাধ্যের মধ্যে থাকলে বইটি কিনবেন এই প্রত্যাশা রইলো।
0 Comments