Ticker

6/recent/ticker-posts

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বখতিয়ার খলজি ধ্বংস করেননি

 আমিনুল ইসলাম

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বখতিয়ার খলজি ধ্বংস করেননি

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বখতিয়ার খলজি ধ্বংস করেননি

প্রবন্ধটি প্রকাশের মূল উদ্দেশ্য আলোচনা। কারও ধারনা বা মূল্যবোধকে আঘাত করা নয়। আশাকরি মন্তব্যের ঘরে সুষ্ঠ আলোচনা হবে।

বিহারের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের জন্য বখতিয়ার খলজির নির্মম আক্রমণকে সাধারণত দায়ী করা হয়। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার, এ এল ব্যাসাম, রোমিলা থাপার থেকে শুরু করে ইরফান হাবিবরে মত দিকপাল ঐতিহাসিকও নালন্দা ধ্বংসকারী হিসেবে বখতিয়ার খলজিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। ইরফান হাবিব লিখেছেন, “এই মহাবিহার ১২০০ সালে মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির নালন্দা আক্রমণ ও হত্যালীলা সহ বেশ কিছু রাজনৈতিক ঝড়ঝাপটা সামলে ত্ৰয়োদশ শতক পর্যন্ত টিকেছিল।” ৪ জানুয়ারি ২০১১-এ চেন্নাইয়ে অনুষ্ঠিত ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসের ৯৮ তম অধিবেশনে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের বক্তব্য: ১১৯৩ সালে বখতিয়ার খিলজির আক্রমণে নালন্দা মারাত্মকভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। (হিন্দু, ৮ জানুয়ারি ২০১১)।

এ তথ্য সর্বাংশে সত্য নয়। তবে এই আলোচনায় প্রবেশের পূর্বে আমরা নালন্দার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরতে পারি। বিভিন্ন ঐতিহাসিক উপাদানের ভিত্তি বিশ্লেষণ করে নালন্দার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ-পঞ্চম শতাব্দী থেকে। তখন নালন্দা ছিল একটি সমৃদ্ধ শহর। কিন্তু নালন্দার অবস্থান নিয়ে ঐতিহাসিকেরা সহমত হতে পারেননি। বিভিন্ন তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে পার্শ্ববর্তী অনেক স্থানের সঙ্গে নালন্দাকে সনাক্ত করেছেন ঐতিহাসিকেরা। কিন্তু এইসব তথ্য প্রমাণ থেকে নালন্দার সঠিক সনাক্তকরণ সহজসাধ্য নয়। কারণ অনেক তথ্যই পরস্পর বিরোধী। তবে পালি-বৌদ্ধ সাহিত্য ও জৈন উপাদান থেকে নালন্দার যে বর্ণনা পাওয়া যায়, সে নালন্দা এবং বর্তমান নালন্দা মোটামুটিভাবে একই, যা কিনা বিহার রাজ্যের রাজগীর শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত।

বৌদ্ধ সংঘের সংস্কৃত বা পালি প্রতিশব্দ হল বিহার, যার প্রকৃত অর্থ বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আশ্রয়স্থল। এইসব বিহারের অনেকগুলি পরবর্তীকালে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল, তার মধ্যে কয়েকটি আবার বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়েছিল, যেমন নালন্দা। এই নালন্দার উল্লেখ পাওয়া যায় খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে। কারণ ফা-হিয়েন যখন নালন্দাতে আসেন, তখন সেখানে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। গুপ্তযুগে নালন্দা বিহার থেকে মহাবিহারে রূপান্তরিত হয়েছিল মূলত রাজকীয় অনুদানের দ্বারাই। আর কোনো মহাবিহার নালন্দার মত রাজকীয় অনুদান পায়নি। কারণ নালন্দা ছিল বিশ্বমানের শিক্ষাক্ষেত্র। পাল রাজারাও ছিলেন নালন্দার পৃষ্ঠপোষক। পাল শাসনকালেই নালন্দা খ্যাতির চরম শিখরে পৌঁছেছিল। এই পাল রাজারা ছিলেন মহাযান বৌদ্ধধর্মের অনুসারী আর নালন্দা ছিল তাঁদের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র, যার ফলে তাঁরা মুক্তহস্তে নালন্দাতে দান করছিলেন। সেই সময় নালন্দাতে ভারতের বাইরের বিভিন্ন দেশ থেকেও শিক্ষার্থীরা আসতো, যারা জ্ঞানার্জনের শেষে প্রচুর আর্থিক সাহায্য নালন্দাকে দিয়ে যেত—নালন্দার সমৃদ্ধির এটাও একটা অন্যতম প্রধান কারণ বলা যেতে পারে। এখানে প্রায় ১০,০০০ ছাত্র বসবাস করত ও অধ্যয়ন করত। (নালন্দা উৎখননের ফলে যে বাড়িগুলি আবিষ্কৃত হয়েছে তাতে দশ হাজার ছাত্রের থাকার ব্যবস্থাকে সমর্থন করা যায় না। ৬৭০ সালে ইৎ-সিং নামে অপর এক চীনা পরিব্রাজক নালন্দা পরিদর্শন করেন। তাঁর মতে, এখানে তিন হাজার ভিক্ষু থাকত। ইৎ-সিং এর বক্তব্যই বেশি সমর্থনযোগ্য ও যুক্তিসম্মত বলে মনে করেন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রামশরণ শর্মা। দেখুন- রামশরণ শর্মা, ভারতের প্রাচীন অতীত, ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ, ২০১১, পৃ. ২৬৭)। চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ স্বয়ং নালন্দার অধ্যক্ষ শীলভদ্রের কাছে পড়াশুনো করতেন। তাঁর মতে, ভারতে তখন হাজার হাজার শিক্ষাকেন্দ্র ছিল কিন্তু শিক্ষণীয় বিষয়ের বৈচিত্র্য, শিক্ষা পদ্ধতির উৎকর্ষে ও বিশালত্বে নালন্দার স্থান ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ।

আধুনিক গবেষকদের অনেকেই মনে করেন যে, নালন্দা মহাবিহারকে আর যাই হোক বিশ্ববিদ্যালয় বলে অভিহিত করা যায় না। এখানে একটা বিশাল শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে উঠেছিল, যা প্রায় ৮০০ বছর (পঞ্চম থেকে ত্রয়োদশ শতক) ধরে সমগ্র এশিয়ায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। এখানকার সুবৃহৎ গ্রন্থাগারটিও ছিল বিখ্যাত। এই মহাবিহারে বহু ছাত্র আবাসিক জীবনযাপন করে শিক্ষালাভ করত। এমন সব তথ্যের ভিত্তিতে নালন্দার শিক্ষায়তনটিকে বিশ্ববিদ্যালয় ভেবে ফেলা হয়েছে। টোল-চতুষ্পাঠী জাতীয় বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রাচীন ও মধ্যযুগে ভারতে গড়ে উঠেছিল, একথা সত্যি। মুসলিম বাদশাহদের আমলেও মাদ্রাসা-মক্তব জাতীয় বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু আধুনিক স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির মতো শিক্ষায়তন প্রাচীন ও মধ্যযুগে শুধু ভারতে কেন ইউরোপেও গড়ে উঠেনি, গড়ে উঠবার মত বাস্তব পরিস্থিতিও তখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি। পঞ্চম থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত ভারতে স্মৃতিশাস্ত্র অনুমোদিত জাতিভেদ প্রথা যেভাবে জাঁকিয়ে বসেছিল তাতে এমনিতেই সমাজের তিন-চতুর্থাংশ লোকের বিদ্যাশিক্ষার কোনো অধিকারই ছিল না। ব্রাহ্মণদেরও গরিষ্ঠ অংশ পূজা-পাঠ-পৌরহিত্য-জ্যোতিষচর্চা করেই সন্তুষ্ট ছিল। সত্যি কথা বলতে উনিশ শতকের শেষ কিংবা বিশ শতকের গোড়া পর্যন্তও নালন্দা-তক্ষশীলা-বিক্রমপুরের মত প্রাচীন ‘বিশ্ববিদ্যালয়’গুলির কথা কারোর মাথাতে আসেনি।

যাই হোক, বখতিয়ার খলজি মগধ অঞ্চলে ধ্বংস চালিয়েছিলেন, এর উপর ভিত্তি করে ঐতিহাসিকদের একাংশ ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় তিনিই ধ্বংস ও অগ্নিকাণ্ড ঘটিয়েছিলেন। উদন্তপুরী মহাবিহার ধ্বংসের দৃষ্টান্ত থেকেও বোধহয় নালন্দা ধ্বংসের জন্য বখতিয়ারকে দায়ী করা হয়। অনুমান নির্ভরতা ঐতিহাসিক সত্যের প্রমাণ হতে পারে না। প্রচলিত উপকথা ও জনশ্রুতির বিপরীতে এখানে বলে রাখা ভাল যে, নালন্দা মহাবিহার বখতিয়ারের বিহার অভিযানের সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। নালন্দার ক্ষয়-ক্ষতিগুলো সবই প্রাক-ইসলামীয় যুগের। আর এক্ষেত্রে কয়েকবার যে অগ্নিকাণ্ড ঘটানো হয় তার প্রমাণ পোড়া চাল ও শীলমোহর ধ্বংসাবশেষের মধ্যে পাওয়া যায়। অগ্নিকাণ্ডে বা অন্য কোনো কারণে ধ্বংস হলেও তৎকালীন রাজন্যবর্গ, বিত্তশালী লোক ও ভিক্ষুদের সহায়তায় নালন্দা কয়েকবার পুনর্গঠিত হয়েছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে সৌধগুলির তিনটি থেকে নয়টি পর্যন্ত পুনর্গঠনের স্তর পাওয়া যায়। দেখা যায় প্রতিবারই পূর্বের স্থাপত্যকর্মের ধ্বংসাবশেষের উপরই পুনর্নির্মিত ভবনগুলি গড়ে উঠেছে।

সাম্প্রতিক এমনও তথ্য আমাদের সামনে আসছে যে, বখতিয়ার খলজি নালন্দায় কোনোদিন যাননি। ঐতিহাসিক কে কে কানুনগো ‘জার্নাল অফ দ্য এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল'-এ প্রকাশিত শরৎচন্দ্র দাশের ‘অ্যান্টিকুইটি অফ চিটাগাঁও' প্রবন্ধ থেকে জানাচ্ছেন যে, কাশ্মিরের বৌদ্ধ পণ্ডিত শাক্য শ্রীভদ্র ১২০০ সালে মগধে গিয়ে দেখেছিলেন বিক্রমশীলা ও ওদন্তপুরী বিহার ভয়ঙ্করভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তুর্কিদের ভয়ে শ্রীভদ্র ও ওই বিহার দুটির ভিক্ষুরা বগুড়া জেলার জগদ্দল বিহারে আশ্রয় নেন। কিন্তু শরৎচন্দ্র দাশ তাঁর উক্ত প্রবন্ধে এমন কথা বলেননি যে, ১২০০ সালে বিক্রমশীলা ও ওদন্তপুরী বিহার দুটিকে ধ্বংস করা হয়েছিল। বরং তিনি তাঁর সম্পাদিত তিব্বতীয় শাস্ত্র ‘পাগসাম ইয়ান জাং'-এ বলেছেন, বিহার দুটি ধ্বংস হয়েছিল ১২০২ সালে। ফলে শাক্য শ্রীভদ্র জগদ্দল বিহারে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে, এই ঘটনা বখতিয়ারের বিহার অভিযানের (১২০৩) পূর্বেকার। আর এক্ষেত্রে বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, ক্ষতিগ্রস্ত বিহারগুলির মধ্যে নালন্দার নাম নেই। তাছাড়া মিনহাজ বা অন্য কোনো সূত্রেও নালন্দা ধ্বংসের কথা বলা হয়নি। ১২৩৪-৩৬ সালে অর্থাৎ বখতিয়ারের বিহার জয়ের ৩১ বছর পর তিব্বতী সাধু ধর্মস্বামী মগধে আগমন করেন ও সেখানে অবস্থান করেন। নালন্দা মঠকে তিনি তখন চালু অবস্থায় দেখতে পান। সেখানে মঠাধ্যক্ষ রাহুল শ্রীভদ্রের পরিচালনায় সত্তর জন সাধু অধ্যয়নে নিয়োজিত ছিলেন এবং তিনি নিজে ছ'মাস সেখানে জ্ঞানার্জন করেন। তাহলে বিষয়টা দাঁড়াল এই যে, বখতিয়ারের আক্রমণে নালন্দা সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় বলে যে প্রচারণা ছিল ধর্মস্বামীর বিবরণে তার উল্লেখ নেই। তবে তিনি বিক্রমশীলা মহাবিহারকে সম্পূর্ণ ধ্বংস অবস্থায় ও ওদন্তপুরীকে তুর্কি সামরিক ঘাঁটি রূপে দেখতে পান। (জি রোয়েরিখ সম্পাদিত, বায়োগ্রাফি অফ ধর্মস্বামী, কে পি জয়সওয়াল রিসার্চ ইনস্টিটিউট, পাটনা, ১৯৫৮, পৃ. ৬৪, ৯০-৯৩)।

তাহলে নালন্দা ধ্বংস হল কিভাবে? এটা পূর্বে উল্লেখিত হিন্দু ও বৌদ্ধ সংঘাতের ফলশ্রুতি নয় তো? কিংবদন্তি ও জনশ্রুতিতেও অনেক ঐতিহাসিক সত্য লুকিয়ে থাকে। বুদ্ধগয়া নালন্দা ও রাজগীরে বিখ্যাত তীর্থস্থান অথবা ধ্বংসাবশেষের উপরে লিখিত একটি পরিচিতি পুস্তিকায় এর কিছুটা আঁচ পাওয়া যাবে। যদিও সে বর্ণনায় কিছুটা অলৌকিকত্বের তত্ত্ব ঢোকানো হয়েছে। বখতিয়ার খলজির আক্রমণ তত্ত্বের সাথে কোনও ভনিতা না করে পুস্তিকাটিতে এ তথ্য সংযোজিত হয়েছে: “পঞ্চম শতাব্দীতে ব্রাহ্মণ দার্শনিক এবং প্রচারক কুমার ভট্ট এবং শংকরাচার্যের প্রচেষ্টাতেই বৌদ্ধধর্মের প্রভাব ক্ষয় হয়ে গিয়েছিল। প্রবাদ আছে, তাঁরা সারা ভারতে পরিভ্রমণ করে বৌদ্ধ পন্ডিতকে তর্কযুদ্ধে পরাজিত করে ধর্মান্তরিত করেন।...একদিন ঐ মন্দিরে যখন শাস্ত্র চর্চা চলছিল তখন দুজন কোমল স্বভাবের ব্রাহ্মণ সেখানে উপস্থিত হন। কয়েকটি অল্প বয়স্ক ভিক্ষু তাঁহাদের উপর পরিহাসোচ্ছলে জল ছিটিয়ে দেন। এতে তাঁদের ক্রোধ বেড়ে যায়। বারো বৎসরব্যাপী সূর্যের তপস্যা করে তাঁরা যজ্ঞাগ্নি নিয়ে নালন্দার প্রসিদ্ধ গ্রন্থাগারে এবং বৌদ্ধ বিহারগুলিতে অগ্নিসংযোগ করেন। ফলে নালন্দা অগ্নিসাৎ হয়ে যায়।” (বুদ্ধগয়া গয়া-দর্শন রাজগীর নালন্দা : পর্যটক সহায়ক পুস্তিকা, পৃ. ১৬-১৭, দ্রঃ- অনুষ্টুপ, বিশেষ শীতকালীন সংখ্যা ১৪০৮)। তবে তিব্বতীয় শাস্ত্র ‘পাগসাম ইয়ান জাং’ও ‘উগ্র হিন্দুদের' হাতে নালন্দার গ্রন্থাগার পোড়ানো হয়েছে বলে উল্লেখ করেছে। এ তথ্য বি এন এস যাদব তাঁর ‘সোসাইটি অ্যান্ড কালচার ইন নর্দার্ন ইন্ডিয়া ইন দ্য টুয়েলভথ সেঞ্চুরি' গ্রন্থেও (পৃ. ৩৪৬) উল্লেখ করেছেন।

বিশিষ্ট তাত্ত্বিক লেখক ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত নালন্দা মহাবিহার ধ্বংসের জন্য ব্রাহ্মণ্যবাদীদের আক্রমণকে মান্যতা দিয়েছেন। তিনি তাঁর 'বাঙ্গলার ইতিহাস'-এ লিখেছেন: “নালন্দার লাইব্রেরী কয়েকবার বিধ্বস্ত হয়। Pal. Jor-এর তিব্বতীয় পুস্তকে উল্লিখিত হয়েছে যে ধর্মসগন্ধ অর্থাৎ নালন্দার বৃহৎ লাইব্রেরী তিনটি মন্দিরে রক্ষিত ছিল। তীর্থিক (ব্রাহ্মণ) ভিক্ষুদের দ্বারা অগ্নিসংযোগে তাহা ধ্বংস করা হয় ৷ মগধের রাজমন্ত্রী কুকুতসিদ্ধ নালন্দায় একটি মন্দির নির্মাণ করেন। সেখানে ধর্মোপদেশ প্রদানকালে জনকতক তরুণ ভিক্ষু দু'জন তীর্থিক ভিক্ষুদের গায়ে নোংরা জল নিক্ষেপ করে। তার ফলে তারা ক্রুব্ধ হয়ে ‘রত্নসাগর’, ‘রত্নধনুক’ আর নয় তলাযুক্ত ‘রত্নদধি’ নামক তিনটি মন্দির অগ্নিসংযোগে ধ্বংস করে। উক্ত তিনটি মন্দিরেই সমষ্টিগতভাবে ধর্মগ্রন্থ বা গ্রন্থাগার ছিল।” (চিরায়ত প্ৰকাশন, পৃ. ৮৬; আরও দেখুন - P. al. Jor: History of the Rise, Progress and Downfall of Buddhism in India, Edited by Saratchandra Das, P. 92).

ষষ্ঠ শতকের রাজা মিহিরকুল বৌদ্ধদের সহ্য করতে পারতেন না। তিনি যখন পাটলিপুত্র আক্রমণ করেন তখন সম্ভবত নালন্দা মহাবিহার ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এইচ হিরাস এ বিষয়ে লিখেছেন: 'Nalanda University was not far from the capital, Pataliputra and its fame had also reached Mihirakula's ears. The buildings of Nalanda were then probably destroyed for the first time, and its priests and students dispersed and perhaps killed! (এইচ হিরাস, দ্য রয়েল পেট্রনস্ অফ দ্য ইউনিভার্সিটি অফ নালন্দা, জার্নাল অফ দ্য বিহার অ্যান্ড উড়িষ্যা রিসার্চ সোসাইটি, পার্ট-১, খণ্ড-১৪, ১৯২৮, পৃ. ৮-৯)। এরপর সপ্তম শতকের মাঝামাঝি মগধে সংঘটিত যুদ্ধবিগ্রহের শিকারও হতে পারে নালন্দা। ঐতিহাসিক এস এন সদাশিবন তাঁর 'এ সোস্যাল হিস্টরি অফ ইন্ডিয়া' গ্রন্থে নালন্দা ধ্বংসের জন্য মুসলমান ও ব্রাহ্মণ উভয়কেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন (পৃ.২০৯)। ঐতিহাসিক এ এল ব্যাসাম নালন্দা ধ্বংসের জন্য সরাসরি বখতিয়ারকে দায়ী না করলেও তিনি অবশ্য এটা ধ্বংসের জন্য মুসলিম আক্রমণকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। কোনো প্রমাণ ছাড়াই তিনি লিখেছেন, “গঙ্গার তীরে তীরে মুসলিম অভিযানের তরঙ্গাভিঘাতেই নালন্দা ও বিহারের অন্যান্য বৌদ্ধ মঠ লুণ্ঠিত : ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। গ্রন্থাগারগুলি হয় ভস্মীভূত এবং দলে দলে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয় আক্রমণকারীদের হাতে।”

ধীরাজ সাঙ্কালিয়া অবশ্য তাঁর 'ইউনিভার্সিটি অফ নালন্দা' গ্রন্থে (পৃ. 214) নালন্দায় আগুন লাগানোর ঘটনার সমর্থনে লিখিত সূত্র উল্লেখ করে লিখেছেন, "The tradition cited from Pag-sam-jon zang ahout the final annihilation of Nalanda by fire may be true, for while excavat- ing the Nalanda-site, heaps of ashes and coals are unearthed, even on the topmost levels after the removal of layers of earth which cover up various sites.” কিন্তু এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, একদিকে সাঙ্কালিয়া বলছেন নালন্দা ধ্বংস করেছিলেন বখতিয়ার খলজি, আবার পরে হিন্দুদের দ্বারা নালন্দায় অগ্নি সংযোগের ঘটনাও সত্যি বলছেন। তাহলে এমন পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের উদ্দেশ্যই বা কি? তিনি কি নালন্দা ধ্বংসের বা নালন্দার লাইব্রেরি পোড়ানোর আসল কারণ আড়াল করতে চাইছেন? বুদ্ধ প্রকাশ তাঁর ‘অ্যাসপেক্টস্ অফ ইন্ডিয়ান হিস্টরি অ্যান্ড সিভিলাইজেশন' গ্রন্থে (আগ্রা, ১৯৬৫) নালন্দায় অগ্নি সংযোগের জন্য হিন্দুদেরই দায়ী করেছেন। অথচ এতদিন আমরা নালন্দা মহাবিহার ধ্বংসের জন্য মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজিকেই অভিযুক্ত করে এসেছি।

ঐতিহাসিক ডি আর পাতিল তাঁর 'অ্যান্টিকোয়ারিয়ান রিমেইন্‌স অফ বিহার' গ্রন্থে (বিহার সরকার কর্তৃক প্রকাশিত, এটা নালন্দা ধ্বংসের উপর লিখিত একমাত্র গবেষণাপত্র) বলেছেন যে, শৈবরাই নালন্দা ধ্বংস করেছিল (পৃ. ৩০৪)। তিনি এও লিখেছেন যে, নালন্দা ধ্বংস হয়েছিল বখতিয়ারের বিহার আক্রমণের পূর্বেই। স্কন্দগুপ্তের সময়ে (৪৫৫-৪৬৮) নালন্দা প্রথম আক্রান্ত ও ধ্বংস হয় শৈব রাজা মিহিরকুলের দ্বারা। প্রায় দেড় শতাব্দী পরে গৌড়রাজ শশাঙ্কের সময়ে (৬০৬- ৬৪৭) নালন্দা দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হয়। এটা ছিল রাজা শশাঙ্ক ও কনৌজের রাজা হর্ষবর্ধনের সংঘর্ষের ফলশ্রুতি। এরপর উত্তর বিহারের তিরহূতের রাজা অর্জুনের সময় একদল ব্রাহ্মণ দুর্বৃত্তের হাতে নালন্দা আক্রান্ত হয় ও আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এছাড়াও পালযুগে মহীপালের সময়ে (৯৮১-১০২৯) নালন্দা আগুনে বিনষ্ট হয়। বার বার ধ্বংসপ্রাপ্ত নালন্দার সংস্কারও হয়েছে। শৈবরাই নালন্দা ধ্বংস করেছিল—এই মতের দীর্ঘ আলোচনা করেছেন আর এস শর্মা এবং কে এম শ্রীমালি তাঁদের ‘এ কমপ্রিহেসিভ হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া' গ্রন্থের ৪র্থ খণ্ডের ২য় ভাগে (পৃ. ৭৯-৮২)।

বোঝা যাচ্ছে যে, বখতিয়ার খলজি কর্তৃক নালন্দা ধ্বংসের বিষয়টি খুবই বিতর্কিত—এ নিয়ে কোনো সহজ সিদ্ধান্তে আসা যায় না। বখতিয়ার তৎকালীন বিহারের রাজধানী হিসেবে ১২০৩ সালে আক্রমণ চালিয়েছিলেন উদন্তপুরীতে। কিন্তু তা ধ্বংস করেছেন বলা অতিরঞ্জিত। তিনি ভুলে সামরিক দূর্গ ভেবেই উদন্তপুরীতে হামলা করেছেন। এ প্রসঙ্গে গ্রন্থাগার পোড়ানোর বিষয়টি উল্লেখ করা হলেও তা রটনা মাত্র। অন্যদিকে হামলা তো দূরের কথা বখতিয়ার নালন্দাতেই যাননি। মিনহাজ তা বলেননি। এরপরেও অবশ্য কিছু পণ্ডিত নালন্দা ধ্বংসের জন্য বখতিয়ারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করান। উল্লেখ্য যে, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবলুপ্তির সঙ্গে ভারতবর্ষ থেকে বৌদ্ধধর্মের অন্তর্ধানের একটি সম্পর্ক রয়েছে। সপ্তম শতকে ভারতের বিভিন্ন স্থান পরিদর্শনের সময় হিউয়েন সাঙ লক্ষ্য করেছিলেন যে, এককালের সক্রিয় বৌদ্ধধর্ম ধীরে ধীরে পতনের দিকে এগিয়ে চলেছে। শুধু তাই নয়, তিনি নালন্দার পরিসমাপ্তির দুঃখজনক পূর্বাভাষও পেয়েছিলেন। সেই সময় বৌদ্ধধর্ম দ্রুততার সঙ্গে তার জনপ্রিয়তা হারাচ্ছিল। কেবলমাত্র অধুনা বিহার ও বাংলা অঞ্চলের রাজারাই এই ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করছিলেন। পাল শাসনকালে বৌদ্ধধর্মের প্রথাগত মহাযান ও হীনযান সম্প্রদায়ে গোপন আচার অনুষ্ঠান ও যাদুবিদ্যা সংক্রান্ত তান্ত্রিক কার্যকলাপ অন্তর্ভুক্ত হয়। পাশাপাশি এই ধর্মমতে সহজযান, বজ্রযান প্রভৃতি নানা গোষ্ঠীও তৈরি হয় এবং এই গোষ্ঠীগুলির অন্তর্কলহে বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা ধীরে ধীরে ক্ষয় পেতে শুরু করে। তাছাড়া সংঘে নারীদের প্রবেশের অনুমতি দেওয়ায় এবং ভিক্ষুনীদের সংখ্যা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়াও সংঘগুলিতে অনাচার ও অনৈতিকতা প্রবল হয়ে উঠতে থাকে। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা মদেও আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। ফলে জনমানসে বৌদ্ধভিক্ষুদের সম্পর্কে একটা বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি হতে লাগল। সেইসঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশে বৈষ্ণব ও শৈব দার্শনিক— যেমন উদ্যোতকর, কুমারিল ভট্ট, শংকরাচার্য, উদয়নাচার্য, বাচস্পতি মিশ্ৰ প্রমুখগণের আগ্রাসন, ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকদের চরম বৌদ্ধদ্বেষ নীতি এবং একাদশ শতকে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী পাল রাজবংশের পতনের ঘটনা থেকেই বোঝা যায় যে, সে সময়ে বৌদ্ধধর্মের উপর রাজনৈতিক-দার্শনিক-নৈতিক দিক হতে চরম আঘাত নেমে এসেছিল।

এ সত্বেও ত্রয়োদশ শতকের প্রারম্ভে বখতিয়ার খলজির বিহার আক্রমণই ভারতে বৌদ্ধধর্মের ওপর শেষ আঘাত হেনেছিল বলে মনে করা হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, যাদের গোপন সাহায্যে বখতিয়ার তথা মুসলিমরা বিহার ও বাংলা জয় করলেন তাদের উপর বা তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপর মুসলমানরা চরম আঘাত হানবেন তা মানা সম্ভব নয়। আসল কথা হল, নালন্দা ধ্বংস হয়েছিল ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুদের হাতেই। নালন্দা মহাবিহার ধ্বংসে অর্থনীতির বিষয়টিও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কেননা, আমরা যখন বলি রাজনীতি সর্বদাই অর্থনীতিকে অনুসরণ করে তখন ভিন্ন প্রেক্ষাপটের দিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। ক্ষত্রিয় রাজানুকূল্য নয়, ছিল বিদ্যা শিক্ষাদানের জমজমাট ব্যবসা। এক-একজন ব্রাহ্মণ পরিবারে কম করে হলেও চার-পাঁচশ ছাত্র থাকত। এরা গুরুর কাছে শুধু বিদ্যাশিক্ষাই করত না, গুরুগৃহের যাবতীয় কাজকর্ম ভাগ করে নিত। যার ফলে আরাম-আয়েশের দিক দিয়ে একেকজন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত এক-একজন সামন্তের মতো দিন যাপন করতেন। আচার্যের গ্রাম একটি ছোট্ট সামন্ত রাজের গ্রামের মতোই প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী ছিল যদিও এই আচার্য ছিলেন রাজ-পুরোহিত। আর এখানেই আঘাত হানে বৌদ্ধধর্মীদের বিহার। বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র ছিল বিহারগুলি। শত শত আবাসিক বিহার গড়ে ওঠে সারা ভারতভূমিতে। বিদ্যাশিক্ষার জন্য দলে দলে বিদ্যার্থীরা নাম লেখাতে থাকে নানা বিহারে। তাদের মধ্যে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের সংখ্যাও কম নয়। ইতিমধ্যে তাদের পরিবার বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নিয়ে নেয়। তাছাড়া বিদ্যাদানের ব্যাপারে বিহারগুলিতে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র, চণ্ডাল—এসবের কোনো বৈষম্য ছিল না। সব শ্রেণির মানুষের জন্য বিহারের দরজা ছিল উন্মুক্ত। ফলে টোলের ব্রাহ্মণদের বিদ্যাদানের ভাটার টান ধরে, একদমই মহাভাটা। অতএব, নালন্দা বিহার ধ্বংস করা অর্থনৈতিক কারণেও তাদের জন্য অনিবার্য হয়ে পড়ে।

সুতরাং স্পষ্টতই বলা যায় যে, বখতিয়ার বিহার ও পরবর্তীতে বাংলায় অভিযান চালিয়েছেন সত্য এবং সেটা তিনি করেছেন বৌদ্ধদের আহ্বানে। সেটা করতে গিয়ে তাঁর বাহিনীর হাতে উদন্তপুরী ও বিক্রমশীলা মহাবিহার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং সেই সঙ্গে বহু মানুষও মারা গিয়েছিল। কিন্তু বখতিয়ার ঐতিহাসিক নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের সংগে কোনোভাবেই জড়িত ছিলেন না। বরং বখতিয়ারের সময় ও পরবর্তী মুসলিম শাসনে নালন্দা সহ অনেক বৌদ্ধবিহারে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পূর্বের মতোই জ্ঞানচর্চা চলেছিল। কিন্তু দেশীয় ও বিদেশীয় রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা সত্ত্বেও মূলত অষ্টম শতকের শেষভাগ থেকে নালন্দার গৌরব-সূর্য ধীরে ধীরে অস্তমিত হতে থাকে, বিশেষ করে ৮১০ সালে বিক্রমশীলা মহাবিহার প্রতিষ্ঠার পরই। পাল রাজাদের সময়ে বিক্রমশীলার পরিচালকবৃন্দই নালন্দা পরিচালনা করতেন। তার ওপর তখনকার নানা গোষ্ঠীগত সংঘর্ষ ও আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে দীর্ণ নালন্দা আর মাথা তুলে দাঁড়াতে সক্ষম হয়নি। অথচ নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে সমূলে ধ্বংস করা ও বৌদ্ধধর্মকে তার উৎসস্থল হতে নির্মূল করার জন্য বখতিয়ারের উপর দোষারোপ করা হয়—এটা ঐতিহাসিক সততার চরম ও কদর্য বিকৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়। পক্ষপাতদুষ্ট ঐতিহাসিকগণের এই প্রচেষ্টা তাঁদের বস্তুনিষ্ঠ ঐতিহাসিক জ্ঞানের চরম দীনতা প্রকাশ করে।

Post a Comment

0 Comments