এক হাজারেরও বেশি বছর বয়স্ক বাঙলা ভাষা বর্ণিত-ব্যাখ্যাত-বিশ্লেষিত হ'য়ে আসছে দু-শো চল্লিশ বছর ধ'রে। আঠারোশতকের চল্লিশের দশকে মুদ্রিত হয় বাঙলা ভাষাতত্ত্বের প্রথম পুস্তক—মানোএল দা আস্সুম্পসাঁউর দ্বিভাষিক শব্দকোষ ও খণ্ডিত ব্যাকরণ; এবং তারপর আঠারো-উনিশ-বিশশতকে প্রথাগত, কালানুক্রমিক, সাংগঠনিক ও রূপান্তরমূলক সৃষ্টিশীল ব্যাকরণের তত্ত্ব-কৌশল অবলম্বনে বিশ্লেষিত হয় বাঙলা ভাষার বিভিন্ন স্তর ও এলাকা। এর ফলে উদঘাটিত হয়েছে বাঙলা ভাষার বিচিত্র আভ্যন্তর-বাহ্যিক সূত্র, এবং সৃষ্ট হয়েছে বাঙলা ভাষা বর্ণনা-বিশ্লেষণের—বাঙলা ভাষাতত্ত্বের—এক প্রবাহমান ধারা, যা বিস্তৃত আঠারো থেকে বিশশতক পর্যন্ত। প্রথাগত ব্যাকরণপ্রণেতারা বিশ্লেষণ করেছেন বাঙলা শব্দের গঠনকৌশল, কালানুক্রমিক ভাষাতাত্ত্বিকেরা উদঘাটন করেছেন বাঙলা ভাষার শতাব্দী পরম্পরার ইতিহাস, নবব্যাকরণবিদেরা শনাক্ত করেছেন বাঙলা ভাষার স্বায়ত্তশাসিত-স্বাধীন চারিত্র, বিশশতকের বর্ণনামূলক ভাষাতাত্ত্বিকেরা বর্ণনা করেছেন এর ধ্বনি ও রূপের স্তর। তবুও বাঙলা ভাষার রূপ ও প্রকৃতি আমাদের অনেকটা অজানা। তার চেয়েও অনেক বেশি অজানা বাঙলা ভাষাতত্ত্বের প্রকৃতি-প্রবণতা-ইতিহাস। বাঙলা ভাষা বিভিন্ন সময়ে কি ভাবে বিশ্লেষিত হয়েছে, কোন এলাকার ওপর নিবদ্ধ হয়েছে ভাষাতাত্ত্বিকদের মনোযোগ, কোন তত্ত্ব ও কৌশল প্রয়োগে তাঁরা উদঘাটন করেছেন বাঙলা ভাষার আন্তর-বাহ্যিক সূত্র, সে-সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণায় পৌঁছোনোর জন্যেই উদ্যোগ নেয়া হয় “বাঙলা ভাষা : বাঙলা ভাষাবিষয়ক প্রবন্ধসংকলন [১৭৪৩-১৯৮৩]” প্রকাশের। প্রথম যখন আমি এ-সংকলনের দায়িত্ব নিই, তখন বিষয়টির ব্যাপকতা সম্পর্কে আমার কোনো স্বচ্ছ ধারণা ছিলো না। দু-বছর ধ'রে একটি বিস্তৃত রচনাপঞ্জি প্রস্তুতে সময় অতিবাহিত এবং ক্রমশ বিপুল পরিমাণ বাঙলা ভাষাবিষয়ক রচনার মধ্যে প্রবেশ ক'রে বুঝতে পারি সংকলনটিকে দেয়া দরকার এমন রূপ, যাতে তা হ'য়ে ওঠে বাঙলা ভাষাতত্ত্বের এক প্রামাণ্য গ্রন্থ—যাতে স্থান পাবে বাঙলা ভাষাতত্ত্বের সমস্ত এলাকা। তাই এ-গ্রন্থ প্রধানত প্রবন্ধসংকলন হ'লেও বাঙলা ভাষাতত্ত্বের বিভিন্ন শাখার সম্পূর্ণ সুষ্ঠু পরিচয় দেয়ার জন্যে এ গ্রন্থে আমি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বাঙলা ভাষাতাত্ত্বিক গ্রন্থের অংশবিশেষ সংকলনে দ্বিধা করিনি।
সংকলনটি দু-খণ্ডে সম্পূর্ণ : প্রথম খণ্ডে স্থান পেয়েছে ‘প্রথাগত বাঙলা ব্যাকরণকাঠামো’, ‘ধ্বনিতত্ত্ব’ ‘রূপতত্ত্ব’, ‘বাক্যতত্ত্ব’, ‘বর্ণমালা ও বানান সংস্কার' বিষয়ক প্রবন্ধ ও গ্রন্থাংশ। দ্বিতীয় খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত হবে ‘অভিধানসংকলন’, ‘উপভাষা’, ‘ভাষা-পরিকল্পনা’, ‘পরিভাষা’, ও বিবিধ বিষয়ক প্রবন্ধ ও গ্রন্থাংশ। প্ৰথম খণ্ডে সমগ্র সংকলনের ভূমিকারূপে মুদ্রিত হলো ‘অবতরণিকা : বাঙলা ভাষাতত্ত্ব [১৭৪৩-১৯৮৩]', যা বাঙলা ভাষাতত্ত্বের বিভিন্ন সময়ের চারিত্র ও ইতিহাস সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা দেবে। দ্বিতীয় খণ্ডে মুদ্রিত হবে বাঙলা ভাষাতত্ত্বের একটি বিস্তৃত রচনাপঞ্জি। এ-সংকলনের উভয় খণ্ডেই রয়েছে পাঁচটি ক'রে ভাগ, এবং প্রত্যেক ভাগের রয়েছে পৃথক ভূমিকা। অবতরণিকাটি বাঙলা ভাষাতত্ত্বের সামগ্রিক রূপ-প্রকৃতি অনুধাবনে, এবং প্রত্যেক ভাগের ভূমিকা সংশ্লিষ্ট ভাগের প্রবন্ধগুলো বুঝতে সহায়তা করবে। উল্লিখিত দশটি ভাগে বাঙলা ভাষাতত্ত্বের সম্পূর্ণ পরিচয় পাওয়া যাবে ব'লে আমাদের বিশ্বাস। তবে আরো একটি ভাগ—ভাষা আন্দোলন ও ভাষাবিতর্ক বিষয়ক—থাকা উচিত ছিলো, কিন্তু নানা বিষয় বিবেচনা ক'রে তা না রাখারই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
রচনাসংকলনে আমি গুরুত্বপূর্ণ রচনাকে অগ্রাধিকার দিয়েছি, এবং গৃহীত হয়েছে শুধুই বাঙলা রচনা। বাঙলা ভাষা-অঞ্চল এখন দু-ভাগে বিভক্ত : উনিশশো সাতচল্লিশ-পূর্ব উভয়-অঞ্চলের ভাষাতাত্ত্বিকদের রচনাই গৃহীত হয়েছে এ-সংকলনে, কিন্তু সাতচল্লিশোত্তর কালের শুধু বাঙলাদেশের ভাষাতাত্ত্বিকদের রচনাই সংকলিত হয়েছে। সাতচল্লিশ-পূর্ব বঙ্গীয় সমস্ত কিছুই আমাদের ঐতিহ্য এবং সমস্ত কিছুরই আমরা স্বত্ত্বাধিকারী; কিন্তু সাতচল্লিশোত্তর সমস্ত কিছুই দ্বিধাবিভক্ত। প্রবন্ধ নির্বাচনে ভাষাতাত্ত্বিক মূল্যসম্পন্ন প্রবন্ধমাত্রকেই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে; কিন্তু অনবধানতাবশত কিছু মূল্যবান সংকলনযোগ্য রচনা হয়তো অসংকলিত থেকে গেছে।
প্রথম খণ্ডে একটি অসম্পূর্ণতা রইলো : নবব্যাকরণ-আন্দোলনের প্রথম রচনা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘উপসর্গের অর্থবিচার’ কিছুতেই সংগ্রহ করা যায় নি ব'লে অসংকলিত থেকে গেলো। ওই মূল্যবান রচনাটি দ্বিতীয় খণ্ডে সংকলিত হবে। এ-গ্রন্থে প্রতিটি রচনাই মূল বানানে অর্থাৎ উৎস-পত্রিকা বা গ্রন্থে যে-বানানে মুদ্রিত হয়েছিলো, অবিকল সে-বানানে মুদ্রিত হয়েছে। তবে দু-এক জায়গায় পুরোনো অক্ষর সংগ্রহ করা যায় নি ব'লে নতুন অক্ষর ব্যবহৃত হয়েছে। এ-রকম ঘটেছে বিশেষ ক’রে ‘বর্ণমালা ও বানান সংস্কার' ভাগে। এ-ভাগে কেউকেউ ব্যবহার করেছেন দুষ্প্রাপ্য অক্ষর, কেউকেউ ব্যবহার করেছেন স্বউদ্ভাবিত বর্ণ। অমন স্থলে সমকালীন অক্ষর ব্যবহৃত হয়েছে, বা নির্দিষ্ট স্থানটি শূন্য রাখা হয়েছে। কয়েকটি প্রবন্ধের অপ্রয়োজনীয়- অপ্রাসঙ্গিক অংশ পরিত্যাগ ক'রে সংকলিত হয়েছে শুধু গুরুত্বপূর্ণ অংশ। লেখকদের ভাষার কোনো সংস্কার করা হয় নি—তাঁদের মূল রচনার অসামঞ্জস্য ও বাক্যিক ত্রুটি অবিকল রক্ষা করা হয়েছে। তবে সুস্পষ্ট মুদ্রণত্রুটি সংশোধন করা হয়েছে।
সংকলনে ও সম্পাদনায় সুপরামর্শ দেয়ার জন্যে অশেষ ধন্যবাদ প্রাপ্য সম্পাদনা-পরিষদের সদস্যদের। তাঁদের ধন্যবাদ জানাই; এবং ধন্যবাদ জানাই বাঙলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ ও পাঠ্যপুস্তক বিভাগের কর্মকর্তাদের, যাঁদের উৎসাহে বিস্ময়কর দ্রুততায় প্রকাশিত হ'তে পারলো প্রথম খণ্ডটি। আন্তর অনুপ্রেরণা দিয়েছে যারা, তাদেরও স্মরণ করি-অন্তরঙ্গভাবে।
বাঙলা বিভাগ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
২৭ মাঘ ১৩৯০ : ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪
হু মা য়ু ন আ জা দ
প্রধান সম্পাদক
বই নিয়ে শুধুমাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, বই নিয়ে শুধু মাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, নতুন প্রজন্ম চকঝমকের আকর্ষণে বইয়ের দিক থেকে ঘুরিয়ে নিচ্ছে মুখ। আমাদের এ আয়োজন বইয়ের সাথে মানুষের সম্পর্ককে অনিঃশেষ ও অবিচ্ছিন্ন করে রাখা। আশাকরি আপনাদের সহযোগিতায় আমাদের এই ইচ্ছা আরোও দৃঢ় হবে। দুনিয়ার পাঠক এক হও! বাংলা বই বিশ্বের বিবিধ স্থানে, সকল বাংলাভাষীর কাছে সহজলভ্য হোক! সাধ্যের মধ্যে থাকলে বইটি কিনবেন এই প্রত্যাশা রইলো।
0 Comments