পানাম নগর-সোনারগাঁও
জাহাঙ্গীর আলম ভূইয়া
বাংলার প্রাচীন রাজধানী সোনারগাঁওয়ের একটি অংশ পানাম নগর। পানামের ভবনগুলো ইউরোপীয় স্থাপত্যরীতি অনুসরণে নির্মিত। জানা যায়, উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় হতে বিশ শতকের শুরুর দিকে পানাম শহরের ভবনগুলো নির্মিত হয়েছিল। ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরবর্তী সময়ে এবং এরই ফলশ্রুতিতে পানাম ইমারতগুচ্ছের সমৃদ্ধি শুরু হয়।
চারদিকে পরিখাবেষ্টিত নগরটির বুক চিরে রয়েছে প্রায় ৫০০ মি. একটি রাস্তা যা পানাম নগরে যাতায়াতের একমাত্র পথ। রাস্তাটিতে তিনটি সূক্ষ্ম ঝুঁকি রয়েছে, পথটি গড়ে ৫ মি. প্রশস্ত। রাস্তার উত্তরপাশে ৩১টি এবং দক্ষিণপাশে ২১টি ইমারত রয়েছে। গুচ্ছ ইমারতের দেওয়াল কমবেশি প্রায় ৫০-৭০ সেমি পুরু।
তথ্যপ্রমাণে জানা যায়, সেন, সাহা, তালুকদার, পোদ্দার, ভুঁইমালী, নিয়োগী প্রভৃতি শ্রেণির হিন্দু ব্যবসায়ীরা জোট বেঁধে পানাম নগর নির্মাণ করেন। Dr. J. Wise পানাম নগর পরিদর্শন করে বলেছেন, পানামে ত্রিশ ঘর ব্রাহ্মণ ( Brahmans ), পঁয়ষট্টি ঘর সাহা (Saos), পাঁচ ঘর ভূঁইমালী (Bhuimalis Landlords) ছিল। পানাম নামটি প্রথম পাওয়া যায়, ১৮৪০ সালে ড. জেমস টেলের লেখায়। জেমস টেলর উল্লেখ করেন, পানামের প্রাচীন নাম ছিল হাবেলী সোনারগাঁও।
বাংলার মসলিন নগরী হিসেবে সোনারগাঁওয়ের খ্যাতি বিশ্বজুড়ে। ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজির বঙ্গ বিজয়ের পর হতে সোনারগাঁয়ের ধারাবাহিক ইতিহাসের সন্ধান পাওয়া যায়। জিয়াউদ্দিন বারানীর 'তারিখ-ই-ফিরোজ শাহী' গ্রন্থে সোনারগাঁওয়ের রাজা ধনুজ মাধব রায়ের খোঁজ পাওয়া যায়। সুলতান ফখরুদ্দীন মোবারক শাহ প্রথম মুসলিম শাসক।
পানাম ভবনসমূহের ইতিহাস একশো থেকে দেড়শো বছরের কিন্তু সোনাগাঁওয়ের ইতিহাস হাজার বছরের। তবে পানামে মোগল স্থাপত্যরীতির কিছু ভবন রয়েছে। অতএব নিঃসন্দেহে প্রমাণিত, পানাম রাজধানী সোনারগাঁওয়ের প্রাচীন অংশ।
মুখবন্ধ
পানাম নগর একটি প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য এবং বাংলাদেশ সরকারের সংরক্ষিত পুরাকীর্তি। সোনারগাঁওয়ের পানাম নগরে অবশিষ্ট রয়েছে ৫২টি প্রাচীন ইমারত। ঈশা খাঁর রাজধানী এবং মসলিন নগরী হিসেবে সোনারগাঁওয়ের পরিচিতি বিশ্বজুড়ে। রাজধানী হওয়ার পূর্বে সোনারগাঁও প্রসিদ্ধ সমুদ্রবন্দর ছিল। মধ্যযুগে বাংলার দ্বিতীয় রাজধানী সোনারগাঁও। সোনারগাঁওয়ের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। দনুজ মাধব নামক রাজার সময়ে প্রথম বিক্রমপুর হতে সোনারগাঁওয়ে রাজধানী স্থানান্তরিত হয়। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষদিকে জিয়াউদ্দিন বারানী রচিত ‘তারিখ- ই-ফিরোজ শাহী' গ্রন্থে সোনারগাঁও নামের উল্লেখ পাওয়া যায় এবং ১৮৪০ সালে ড. জেমস টেলরের ‘টপোগ্রাফি অভ্ ঢাকা' গ্রন্থে পানাম নামের তথ্য রয়েছে। সুবাদার ইসলাম খান রাজমহল থেকে সুবা বাংলার রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তর করে এবং সমগ্র বাংলার রাজধানী ১৬১০ সালে ঢাকায় নিয়ে আসায় সোনারগাঁওয়ের পতন শুরু হয়।
পরবর্তীতে ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি' এ দেশে বাণিজ্য ঘাঁটি গড়ে তোলে। ব্রিটিশ কোম্পানি ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং রাজদ” দখলের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে নবাব সিরাজ-উ- দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়ে যায়। ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিসের ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত' এবং পরবর্তী সময়ে এরই ফলে অর্থনৈতিক ও স্থাপত্যিক যেসমস্ত পরিবর্তন হয়েছিল তারই একটি বাস্তব রূপ আজকের পানাম নগর। পানাম নগরে মোগল বা সুলতানি আমলের স্থাপনা রয়েছে। যথাযথ গবেষণা ও প্রত্নোখননে অজানা তথ্য আবিষ্কৃত হতে পারে।
২০১৫ সালে প্রবেশপত্র চালুর মধ্য দিয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর পানাম নগরের উন্নয়নে বিশেষ নজরদারি করছে। ইতোমধ্যে সুষ্ঠু নিরাপত্তা ও পর্যাপ্ত পর্যটন সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে এবং সংগত কারণে দর্শক সমাগম বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পর্যটকদের চাহিদা অনুভব করে পানাম নগরের মাঠ ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত জনাব জাহাঙ্গীর আলম ভূইয়া “স্থাপত্যিক অবয়ব ও পুথিগত তথ্যের আলোকে পানাম নগর-সোনারগাঁও” শীর্ষক একটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। আলোচ্য গ্রন্থটি গবেষণা বা বিশ্লেষণধর্মী নয়, সংকলিত গ্রন্থ। আশা করা যায়, গ্রন্থটি পানাম নগর নিয়ে আগ্রহী পর্যটকদের প্রাথমিক চাহিদা পূরণে সক্ষম হবে। বইটি রচনায় তার উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। এতে সাধারণ দর্শক ও পাঠক উপকৃত হবে। বইটি প্রণয়নে লেখকের পাশাপাশি যারা সহযোগিতা করেছেন তাঁরাও ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। আশা করি এ ধরনের প্রচেষ্টা ঐতিহ্য ও পুরাকীর্তিপ্রেমী দর্শক-সহ সকল শ্রেণির পাঠকের নিকট সমাদৃত হবে।
(মোঃ হান্নান মিয়া)
মহাপরিচালক (অতিরিক্তি সচিব) প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, ঢাকা।
ভূমিকা ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার
পানাম নগর বাংলার প্রাচীন রাজধানী সোনারগাঁওয়ের (খ্রি. ১২৯৬–১৬০৮) একটি অংশ। বড় নগর (মোগরাপাড়া), খাস নগর (দিঘির পাড় ও ইছা পাড়া, সোনারগাঁও জাদুঘর) ও পানাম নগর হলো সোনারগাঁওয়ের উল্লেখযোগ্য এলাকা। কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন পানামই হলো মোগল আমলের রাজধানীর একটি অংশ। তবে পানামের ইমারতগুচ্ছের বয়স দুশো বছরের বেশি নয়। পানাম ইমারতগুচ্ছের স্থাপত্যরীতি বিশ্লেষণে বলা যায়, পানামের ভবনগুলো ইউরোপীয় স্থাপত্যরীতি অনুসরণে নির্মাণ করা হয়েছে। ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরবর্তী সময়ে এবং এরই ফলশ্রুতিতে পানাম ইমারতগুচ্ছের সমৃদ্ধি শুরু হয়। জানা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত এর অগ্রগতি চলমান থাকে। ১৮৪০ সালে ড. জেমস টেলর সোনারগাঁও এসেছিলেন, তাঁর রচিত গ্রন্থ 'Topography of Dacca'-তেই প্রথম Painam (‘পাইনাম' শব্দটি পরিবর্তিত হয়ে পানাম হয়েছে) নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। জেমস টেলর Painam সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য প্রদান করেন। ১৮৭২ সালে ড. জেমস ওয়াইজ 'Notes on Sunargaon' তে পানামের অধিবাসী, বসতি সম্প্রদায়, পরিবারের সংখ্যা, মন্দির প্রভৃতির বর্ণনা দিয়েছেন। জেমস ওয়াইজের বর্ণনায় পানাম সম্পর্কে তথ্যবহুল ধারণা লাভ করা যায়। ১৭৭৯-৮০ সালে কানিংহাম-এর ‘Survey Report of India' এবং ডাবলিউ. ডাবলিউ. হান্টার-এর লেখায় পানামের বর্ণনা রয়েছে।
‘ঢাকার ইতিহাস' গ্রন্থে মহাশয় শ্রীযতীন্দ্রমোহন রায় বলেন, “সোনারগাঁও ব্রহ্মপুত্রের প্রাচীন প্রবাহ হইতে ২ মাইল দূরে অবস্থিত। অধুনা এই স্থান পানাম নামে পরিচিত। এই স্থানেই পাঠান রাজগণের রাজধানী প্রতিষ্ঠিত ছিল। তাঁহারা ইহাকে হাবেলী সোনারগাঁও বলিয়া অভিহিত করিতেন।” (পৃষ্ঠা— ৪০২) জানা যায়, ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পানামের হিন্দু বণিকরা দেশত্যাগ করে চলে যায়। সোনারগাঁও ভূমি অফিসের জমিজমার রেকর্ডে দেখা যায় পানামের জমির মালিক সেন, সাহা, তালুকদার, পোদ্দার শ্রেণির হিন্দুরা। মাঠ পর্যায়ে কাজ করার সময় পানামের প্রাচীন বংশধরদের কাউকেই খুঁজে পাওয়া যায়নি।
২০০৭ সালে পানাম মোটামুটি সংরক্ষণের আওতায় আসে। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এটি দেখাশোনা করছে। সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মহোদয়গণ এবং তাঁদের অধীনস্থ ছাত্রছাত্রীরা পানাম নগরকে নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করছেন। এসব গবেষণাপত্র প্রায় সবই অপ্রকাশিত। তবে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত ‘Sonargaon- Panam' এবং ড. নাজিমউদ্দিন আহমেদ রচিত ‘Panam Nagar in Sonargaon' গ্রন্থ দুটি খুবই মূল্যবান।
সোনারগাঁও এবং পানাম নগরকে নিয়ে এযাবৎ বহু গবেষণা হয়েছে, গ্রন্থ রচিত হয়েছে। যখনই কোনো তথ্য আবিষ্কৃত হয়েছে, গবেষকগণ তখনই জার্নাল অথবা গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। তাই সোনারগাঁওকে নিয়ে নতুন করে লেখার কিছু নেই। পানাম সোনারগাঁওয়ের ওপর লিখিত গ্রন্থসমূহ সিংহভাগই ইংরেজিতে রচিত এবং দুষ্প্রাপ্য। আবার তথ্যসমূহ বিভিন্ন গ্রন্থে ছড়ানোছিটানো। যে কারণে পানামকে যথাযথ তথ্য দিয়ে সাজানো অনেকটাই কঠিন কাজ। সোনারগাঁওয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন কার্য পরিচালিত হয়েছে, এমন খবর পাওয়া যায়নি। সংগত কারণে নতুন গবেষণার দ্বার প্রায় বন্ধ। তাই বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত তথ্য ও দৃশ্যমান প্রত্নস্থাপনার অবয়ব বিশ্লেষণ করে গ্রন্থকারের সামান্য মতামত উপস্থাপন করে ন্যূনতম পাঠযোগ্য একটি পুস্তিকা প্রণয়নের চেষ্টা করা হয়েছে এবং এ পুস্তিকাটিকে একটি মূল্যবান গ্রন্থ হিসেবে উপস্থাপন করার জন্য প্রাণান্তর চেষ্টা করা হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে জরিপের মাধ্যমে পানামের প্রান্তিক তথ্যসংগ্রহ করা হয়েছে। কর্মকালীন সময়ে পানাম ভ্রমণ করতে আসা দেশি-বিদেশি পর্যটক, লেখক, গবেষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষক, ছাত্র সবার কাছেই পানামের তথ্য জানার জন্য চেষ্টা করেছি।
সোনারগাঁওয়ে সুলতানি আমল, মোগল আমল ও ব্রিটিশ আমল প্রভৃতি সময়ে বহু রাজকীয় স্থাপনা ছিল। কালের বিবর্তনে সবই হারিয়ে গেছে। “মেজর রেনেল তাঁর ‘মেময়েরে’ (১৭৮৫ খ্রি.) সোনারগাঁও গ্রামে পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন এবং ঠিক একইরকমভাবে বুকানন (১৮০৯ খ্রি.) ব্যক্তিগত জরিপের মাধ্যমে সোনারগাঁও নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে বলে সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন।”
পানাম নগর বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যে একটি সম্ভাবনাময় পর্যটন কেন্দ্র। যথাযথ সংরক্ষণের মাধ্যমে এটিকে বিশ্ববাসীর সম্মুখে উপস্থাপন করা সম্ভব। পানামে আগত দর্শনার্থীরা পানাম সম্পর্কে জানতে চায় কিন্তু প্রয়োজনীয় তথ্য অথবা কোনো বইপুস্তক না-থাকায় তাদের অতৃপ্ত হৃদয়ে বাড়ি ফিরতে হয়। এযাবৎ বাংলা ভাষায় পানামের ওপর কোনো গ্রন্থ রচিত হয়নি, ইংরেজিতে লিখিত গ্রন্থগুলোও দুষ্প্রাপ্য। আমার প্রিয় বাঙালি জাতি এবং বিশ্বদরবারে বাংলা ভাষাভাষীর নিকট পানাম নগরের প্রামাণিক তথ্যসমূহ উপস্থাপন এবং আগ্রহী দর্শকের জ্ঞান পিপাসা পূরণের লক্ষ্যেই এ ক্ষুদ্র প্রয়াস।
0 Comments