Ticker

6/recent/ticker-posts

রবীন্দ্রনাথের ধর্মচেতনা - সা'দ উল্লাহ

রবীন্দ্রনাথের ধর্মচেতনা

সা'দ উল্লাহ

রবীন্দ্রনাথের ধর্মচেতনা

রবীন্দ্রনাথ তাঁর ধর্মচেতনার স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কবির ধর্ম, রূপকারের ধর্ম, ব্যক্তিত্বের সৃজনধর্ম, স্রষ্টার প্রকাশধর্ম—তথ্যের সঙ্কীর্ণতায় আবদ্ধ না থেকে সত্যের রসলোকে যোগ দেবার ধর্ম বলেছেন। আবার, সংক্ষেপে ‘মানবধর্ম'ও বলেছেন তিনি । সৃষ্টি, মনের মানুষ, সত্য কামনা ও নিষ্কামনা, তপস্যা, ব্যক্তিত্ব, প্রেম, আনন্দ, ধর্ম, ব্রাত্য—এই দশটি বিষয় মনে রাখলে তার এই ধারণাটির নানামুখী গতিপথের কিছু আন্দাজ পাওয়া যায় । তাঁর এসব ভাবনার সূচনা হয় ১৮৮০ দশকের প্রথমদিকে, বরং তার কিছু আগে থেকেই বলা যেতে পারে। তাঁর প্রথম প্রবন্ধের বই ‘বিবিধ প্রসঙ্গ’তে (১৮৮৩) ও তার পর ‘আলোচনা'তে (১৮৮৫) এই রূপ, রস, সত্য, ভালবাসা, ধর্ম, সৌন্দর্য ইত্যাদি প্রসঙ্গ পাওয়া যায়—যেগুলো তলিয়ে দেখলে তাঁর আরও পরিণত পর্বের ভাব-ভাবনার সাথে পরিচয় হওয়া যায় ।

ইংরেজিতে লেখা 'Creative Unity'র প্রবন্ধ 'The Poet's Religion'-এ এই ধর্মবোধ বোঝাতে 'Civility' শব্দটি ব্যবহার করেছেন। বাউল গান—নিজের কবিতা, ওয়ার্ডসওয়ার্থের, শেলী ও কিসের কবিতা থেকে উদাহরণ তুলে তিনি সৌন্দর্যের অমরতার দিকেই বিশেষ সঙ্কেত দেন। বস্তুজগতের নানা বিচ্ছিন্নতায় নয়, ভাবলোকে তাদের সম্পর্কে আমরা আনন্দ বোধ করি । সৌন্দর্য সম্বন্ধে তিনি বলেন, "Beauty is no phantasy, it has the everlasting meaning of reality". এই 'reality'কে তিনি বাংলায় বললেন 'বাস্তব'। বহুত্বের মাঝে নয়, এদের সম্পর্কে যে উপলব্ধি হয়, তাতেই মন খুশিতে ভরে ওঠে। জগৎ গতিময়, গতিশীলতাই তার ধর্মচিন্তার প্রধানতম দিকগুলোর অন্যতম। ধর্ম কোন কাল্পনিক অচলায়তনের ‘নিশ্চল শান্তি' নয় ৷ তার পঞ্চক-চরিত্রটি নিজের আচার্যকে বলে—“আমি আচার অনুষ্ঠান কিছুই জানিনে, আমি আপনাকেই জানি।” আচার্য বলেন—“মানুষের মন মন্ত্রের চেয়ে সত্য, হাজার বছরের অতি প্রাচীন আচারের চেয়ে সত্য ।”

তাঁর ধর্মবোধের সৌন্দর্য, গতিশীলতা, সাঙ্কেতিকতার নৈপুণ্য ইত্যাদি সৃষ্টিক্ষমতার দিকগুলো বিশেষভাবে চিহ্নিত হয় তাঁর এইসব রচনায় ।

ধর্ম বলতে আমাদের স্বভাব ও লক্ষ্য বা আদর্শ বুঝিয়ে থাকে । ইন্দ্রিয়গোচর রূপরসময় জগতের সঙ্গেই আমাদের প্রত্যক্ষ যোগ ৷ যাঁরা জড়বাদী বা Materialist, তাঁরা জড়ের অতিশায়ী অতীন্দ্রিয় কোন শাশ্বত সত্যে বিশ্বাস করেন না৷ যাঁরা অজ্ঞাবাদী বা agnostic, তাঁরা ইন্দ্ৰিয়াতীত ধর্তব্য কোন জ্ঞান যে সম্ভব, এ কথা মানেন না। T. H. Huxley (1825-95 ) ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে 'agnosticism' শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। অজ্ঞাবাদীদের আস্থা 'empiricism' বা প্রত্যক্ষ শ্রেণীতে ধর্তব্য জ্ঞানবাদী বা অজ্ঞাবাদী ছাড়া তৃতীয় শ্রেণীতে ধর্তব্য জ্ঞানবাদী বা 'agnostic'দের প্রসঙ্গ। ধর্ম সম্বন্ধে প্রত্যেক চিন্তাশীল মানুষেরই কোন না কোন রকম ধারণা আছে। উনিশ শতকের শেষদিকে বাংলায় এই রকম একদিকের ধারণা দেখা যেতে পারে।  

রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের সমকালীন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ এবং রামমোহন রায়ের প্রতিও যেমন, নিজের পিতৃদেব দেবেন্দ্রনাথের প্রতিও তেমনি শ্রদ্ধা ছিল তাঁর। ‘ধর্ম' বলতে কি বোঝায়?—এই প্রশ্নের উত্তরে বসুমতি সাহিত্য মন্দির থেকে ১৩৫৭ সালে প্রকাশিত উমাপদ মুখোপাধ্যায় সঙ্কলিত রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ কথার মধ্যে “ঈশ্বর ও ধর্ম’ অংশ থেকে উদ্ধৃতি দেয়া যায় ৷ যেমন—“ধর্ম অনুরাগে, অনুষ্ঠানে নহে। প্রেমেই ধর্ম । ধর্মের অর্থ প্রাণে প্রাণে সত্য উপলব্ধি। ধর্ম অর্থ ঈশ্বরকে সাক্ষাৎভাবে স্পর্শ করা। ধৰ্ম অর্থ প্রাণের অনুভব ৷ সম্প্রদায়ে বা সমাজে ধর্ম থাকিতে পারে না ৷ এইসব মন্তব্যের প্রামাণিকতা অবশ্য বিচার সাপেক্ষ। তবে রবীন্দ্রনাথ সম্প্রদায়গত সঙ্কীর্ণতার নিন্দা করেছেন, কিন্তু সমাজে ধর্ম নেই এ কথা বলেননি। যখন আমরা সমাজধর্ম বলে থাকি, তখন সমাজকে যে যে আচরণ ও আদর্শ ভেঙ্গে পড়তে দেয় না, শ্রেয় রক্ষার দিকে লক্ষ্য রেখে বেঁধে রাখে, সেইসব আচরণের কথাই ভাবি। ঈশ্বরকে সাক্ষাতভাবে স্পর্শ করা হোক বা না হোক, শ্রেয় পালনের লক্ষ্যটি খুবই বন্দনীয় ! জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর'—এই উপলব্ধিতে পৌঁছলে এদিকে আর কোন বিরোধের আশঙ্কা থাকে না। ‘মানুষের ধর্ম' (১৯৩৩) বইটির ভূমিকায় তিনি লেখেন—“স্বার্থ আমাদের যেসব প্রয়াসের দিকে ঠেলে নিয়ে যায় তাঁর মূল প্রেরণা দেখি জীবন প্রকৃতিতে; যা আমাদের ত্যাগের দিকে, তপস্যার দিকে নিয়ে যায় তাকেই বলি মনুষ্যত্ব, মানুষের ধর্ম ।”

রবীন্দ্রনাথ ধর্ম ও ঈশ্বর সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে যেসব শব্দ ব্যবহার করেছেন ও তার অর্থ দিয়েছেন, সেসব তাঁর নিজের অনুভূতির মতো, সে অনুভূতি যাদের নেই, তারা হয়ত বুঝতে পারবে না । তিনি সংস্কৃত ধর্মগ্রন্থ হতে যেসব সুপরিচিত শব্দ ব্যবহার করেছেন তার অর্থও প্রাচীন গৃহীত অর্থ নয়, তাঁর নিজের সৃষ্ট অর্থ । এ বিষয়ে তাঁকে শঙ্করের মতো বলা যেতে পারে। বেদান্ত শ্রুতির ওপরই প্রতিষ্ঠিত এটা প্রমাণ করার জন্য শঙ্কর শ্রুতির ভাষার ইচ্ছামতো অর্থ দিতেন । তবে রবীন্দ্রনাথের অনুভূতি যদি মেনে নেয়া যায়, তা হলে তাঁর এসব অর্থ সম্বন্ধে আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু সেই অনুভূতি ছেড়ে, প্রচলিত ধারণার বশে তাঁর ধর্মসংক্রান্ত কথা শুনতে অনেক সময় হেঁয়ালি মনে হবে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যেতে পারে, তিনি ১৯১২ সালে লিখলেন, “ধর্ম শব্দের গোড়াকার অর্থ, যাহা ধরিয়া রাখে। Religion শব্দের ব্যুৎপত্তি আলোচনা করিলে বুঝা যায়, তাহারও মূল অর্থ যাহা বাঁধিয়া তোলে ।”

শুধু এটুকু ধরলে তাঁর উক্তিতে সংস্কৃত ব্যুৎপত্তি সম্বন্ধে কোন ভুল নেই, কিন্তু ইংরেজি সম্বন্ধে একটু গোল আছে। ‘ধর্ম' শব্দের ব্যুৎপত্তি সত্যই ধৃ-ধাতু হতে—যা ধারণ করে তা-ই ধর্ম। এই ব্যুৎপত্তি অনুযায়ী সংস্কৃত 'ধর্ম' শব্দের অর্থ 'religion' নয়, morality—কারণ moralityই সমাজকে ধরে রাখে। ইংরেজি Religion শব্দ সম্বন্ধে গোল এই যে, এই শব্দটি লাতিন religio হতে আসছে, যার অর্থ মোটেই religion নয়। আবার রবীন্দ্রনাথও যে ব্যুৎপত্তি দিলেন তা প্রথম যুগে রোমান খ্রিস্টধর্ম প্রচারকদের দেয়া, প্রাচীন রোমানদের নয় । টারটুলিয়ান religior ব্যুৎপত্তি করেছিলেন লাতিন ধাতু ligare থেকে। যার অর্থ বাঁধা, পক্ষান্তরে সিসেরো করেছিলেন legare ধাতু হতে, যার অর্থ বিবেকের নিষেধ মানা । অর্থাৎ প্রাচীন রোমান অর্থে religior বিপরীত শব্দ ইংরেজিতে যাকে neglect ও সংস্কৃতে যাকে ‘দোষ’ বলা হয় । রবীন্দ্রনাথ কিন্তু ধর্ম ও religion দুটো শব্দেরই নিজস্ব অর্থ দিলেন। তিনি বললেন—“মানুষ ধর্মকে বন্ধন বলিয়া স্বীকার করিয়াছে। ধর্মই মানুষের চেষ্টার ক্ষেত্রকে সীমাবদ্ধ করিয়া সঙ্কীর্ণ করিয়া তুলিয়াছে।” (ওশো রজনীশও এই কথাই বলেছেন। তিনি বলেছেন— ধার্মিক ব্যক্তিদের কোন নির্দিষ্ট ধর্ম পালন করা উচিত নয়, কারণ তার মনকে সঙ্কীর্ণ করে, সীমাবদ্ধ করে ।—লেখক )

কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এ কথাও বললেন, এই স্বাধীনতার সঙ্কোচ অন্যায় হওয়া দূরে থাকুক ভালই, এই যুক্তিতে—“এই বন্ধনকে স্বীকার করা, এই সীমাকে লাভ করাই মানুষের চরম সাধনা । কেননা সীমাই সৃষ্টি ।”

কিন্তু এখানে 'সীমা' ও ‘অসীমতা' বলতে তিনি যা বুঝলেন, তা সাধারণ অর্থে ‘সীমাবদ্ধ' এবং ‘অসীম' নয়, বুঝলেন পরস্পর যুক্ত তিনটি অর্থে finite এবং infinite, প্রমেয় এবং অপ্রমেয়, গুণবিশিষ্ট এবং গুণাতীত। সুতরাং তাঁর মতে ‘ধর্ম’ মানুষকে অপ্রমেয় করে আয়ত্ত করতে দেয় ।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর ধর্মসঙ্গীতেই প্রমাণ করেছেন যে, তিনি ঈশ্বরভক্ত। কিন্তু এর যুক্তিগোচর সংজ্ঞা দেয়া সম্ভব নয়, এর কারণ তিনি নিজেই দিয়েছেন। ১৯০৪ সালে তিনি লেখেন—“তত্ত্ববিদ্যায় আমার কোন অধিকার নাই। দ্বৈতবাদ-অদ্বৈতবাদের কোন তর্ক উঠিলে আমি নিরুত্তর হইয়া থাকিব ৷ আমি কেবল অনুভবের দিক দিয়া বলিতেছি, আমার মধ্যে আমার অন্তর্দেবতার একটি প্রকাশের আনন্দ রহিয়াছে—সেই আনন্দ, সেই প্রেম আমার সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, আমার বুদ্ধি মন, আমার নিকট প্রত্যক্ষ এই বিশ্বজগৎ, আমার অনাদি অতীত ও অনন্ত ভবিষ্যৎ পরিপুত করিয়া বসিয়া আছে ৷ এ লীলা তো আমি কিছুই বুঝি না, কিন্তু আমার মধ্যে নিয়ত এই এক প্রেমের লীলা ।'

এটা অনুভূতির কথা, ভক্তির কথা, তর্কের কথা নয়—এমনকি বুদ্ধি ও জ্ঞানেরও নয় । রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গান বা গদ্য রচনা হতে ভক্তি সম্বন্ধে তাঁর কোন স্পষ্ট উক্তি পাওয়া যাবে না । তবে যদি যুক্তি বা বুদ্ধির গোচর করতে হয়, তাঁর ঈশ্বরবাদ’ পিতৃদত্ত বলা যেতে পারে । দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের একেশ্বরবাদ যে রবীন্দ্রনাথেরও একেশ্বরবাদ সে বিষয়ে সন্দেহ করা চলে না । তবু উপনিষদের ঈশ্বর রবীন্দ্রনাথের প্রাণের ঈশ্বর নন— সে ঈশ্বর ব্রহ্ম, অপ্রমেয়, অজ্ঞেয়, গুণাতীত, মানুষের ভক্তি বা প্রেম সম্বন্ধে নিরপেক্ষ। ব্রাহ্মধর্মের ঈশ্বর নামে ব্রহ্ম হলেও তিনি ধর্মে ও কর্মে অন্য ঈশ্বর । রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরও তা-ই (সূত্র শারদীয় উল্টোরথ–৩৭ বর্ষ, ১৩৯৫ এবং ‘আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ', নীরদ চৌধুরী মিত্র ও ঘোষ, কলিকাতা ১৯৯২)।



বই নিয়ে শুধুমাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, বই নিয়ে শুধু মাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, নতুন প্রজন্ম চকঝমকের আকর্ষণে বইয়ের দিক থেকে ঘুরিয়ে নিচ্ছে মুখ। আমাদের এ আয়োজন বইয়ের সাথে মানুষের সম্পর্ককে অনিঃশেষ ও অবিচ্ছিন্ন করে রাখা। আশাকরি আপনাদের সহযোগিতায় আমাদের এই ইচ্ছা আরোও দৃঢ় হবে। দুনিয়ার পাঠক এক হও! বাংলা বই বিশ্বের বিবিধ স্থানে, সকল বাংলাভাষীর কাছে সহজলভ্য হোক! সাধ্যের মধ্যে থাকলে বইটি কিনবেন এই প্রত্যাশা রইলো।

Post a Comment

0 Comments