অগ্রন্থিত গল্প
ঢেউ
জহির রায়হান
জন্ম ১৯ আগস্ট ১৯৩৫, ফেনীতে। বাংলার বিরল সাহিত্যিক, চলচ্চিত্রকার, সংগঠক ও স্বাপ্নিক, যিনি তাঁর বছর সাঁইত্রিশের জীবনে (১৯৩৫-১৯৭২) গণমানুষের মুক্তির জন্য সাহিত্য রচনা করেছেন, পরিচালনা করেছেন একগুচ্ছ সাড়াজাগানো চলচ্চিত্র। অমর একুশের মানস-সন্তান তিনি। তাঁর গল্প-উপন্যাস-চলচ্চিত্রে ভাষা আন্দোলন যেমন অনন্য ব্যঞ্জনায় ভাস্বর, তেমনি তিনি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের একজন বীর যোদ্ধাও। স্বাধীন বাংলাদেশে অগ্রজ শহীদুল্লা কায়সারের হত্যারহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে ১৯৭২-এর ৩০ জানুয়ারি মিরপুরে নিজেই হয়ে যান নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের শিকার তাঁকে নিয়ে প্রথমা প্রকাশিত মতিউর রহমান সম্পাদিত বই জহির রায়হান : অনুসন্ধান ও ভালোবাসা।
জীবনে ঝড় আসে—সে ঝড় মানুষের মনে কখন কী পরিবর্তন আনে, কে জানে। কিন্তু রিজিয়ার এ পরিবর্তন বড়ই বিস্ময়কর ঠেকে সালামের।
বোন সেলিনার বান্ধবী রিজিয়া। সেই সূত্রে রিজিয়ার সঙ্গে পরিচয়। সুন্দরী, সুগঠনা রিজিয়াকে প্রথম সাক্ষাতেই সালাম তার নাম দিয়েছিল সুপ্রিয়া।
‘সুপ্রিয়া? সুপ্রিয়া মানে কী?' পরিচয় হওয়ার পর একদিন সলজ্জ হেসে জিজ্ঞেস করেছে রিজিয়া, ভাঙা ভাঙা বাংলায়। ভালো বাংলা জানত না সে। না জানাটাই স্বাভাবিক। কারণ, বাপ-দাদা সবাই কোয়েটার বাসিন্দা ওরা। দেশবিভাগের বছর কয়েক আগে ওর বাবা চলে আসেন এখানে রেলওয়েতে মোটা চাকরি নিয়ে 1
‘সুপ্রিয়া মানে কী, বললে না তো?' তাড়া খেয়ে বলতে হয়েছে মানেটা, ভাঙা ভাঙা উর্দুতে। সালামের উর্দু বলা শুনে তো ও হেসেই খুন। কথায় বলে—যার কাজ তাকেই সাজে...
‘যেমন তোমার ভাঙা ভাঙা বাংলা বলা আরকি।' তর্কের খাতিরেই হয়তো বলেছে সালাম।
স্বল্প হেসে গম্ভীর হয়ে গেছে রিজিয়া। ‘সে কথা বলছ কেন? বাংলা তো শিখতেই হবে আমাদের। এ দেশের বুকে থেকে, এ দেশের জল- হাওয়ায় মানুষ হয়ে এ দেশের ভাষাকে অবহেলা করব, সে কোন সাহসে?'
এই হলো রিজিয়া। নিৰ্ভীক, স্পষ্টবাদী।
তাই তো ওকে এত ভালো লাগত সালামের। বড্ড বেশি ভালো লাগত হয়তো।
রিজিয়া প্রায়ই আসত ওদের বাসায়। বিকেলে, কলেজ ছুটির পর, সেলিনার সঙ্গে। সেলিনা ওর কাছে উর্দু শিখত। আর ওকে শেখাত বাংলা। দুই বান্ধবীর ভাষাচর্চা দেখে দূর থেকে ফোড়ন কাটত সালাম। ‘কিহে, রান্নাবান্নার চর্চা ফেলে রেখে এ কিসের চর্চা হচ্ছে?’
‘ভাষার।’ ‘
ভাষা?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ ভাষার।’ সেলিনা বলত।
রিজিয়া বলত ‘বাংলা শিখছি।'
‘কিন্তু স্বাস্থ্যবিজ্ঞান ছেড়ে হঠাৎ ভাষা শেখার এই কসরত কেন?'
সেলিনা মুচকি হাসত, ‘আমাদের জব্দ করার জন্য। না রিজিয়া?’ রিজিয়া সায় দিত—'ঠিক।'
চায়ের আসরটা বেশ জমতে থাকলে। যেদিন ও থাকত না, সেদিন কেন যেন ভালো লাগত না সালামের। ইচ্ছে হতো সেলিনাকে শুধু গাল দিতে। ‘এ একটা চা তৈরি করেছ সেলিনা! এ চা মানুষে খায়?’
সেলিনা রাগ করত। ‘চা বানাতে বানাতে বুড়ি হয়ে গেলুম; আর এখন কিনা বানাতে জানিনে আমি। রিজিয়াই শুধু জানে, না?’
ছুটে পালাত সেলিনা। দূরে গিয়ে হাসত আঁচলে মুখ টিপে। বলত ‘রাগ করো না, কাল ঠিক নিয়ে আসব ওকে।'
'হ্যাঁ। ঠিক, ঠিক, ঠিক।' বলে হাতের তিনটে আঙুলকে সালামের দিকে তুলে ধরত সেলিনা। একটা নাগাল না পাওয়া দূরত্বে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসত উভয়েই।
পরদিন, রিজিয়াকে ঠিক নিয়ে আসত সেলিনা। বলত, ‘একটা দিন আসোনি, তাই ভাইটি আমার রেগে দু-দুটো চায়ের পেয়ালা ভেঙে ফেলল আছড়ে।'
‘মিথ্যে বলো না সেলিনা।' ধমকাত সালাম ৷
কাকী লজ্জায় লাল হয়ে উঠত রিজিয়ার ফরসা মুখখানা। ও মাথা নত করত মাটির দিকে
কিন্তু, তখনো কোনো পরিবর্তন আসেনি রিজিয়ার ভেতর। সুন্দরী, সুগঠনা রিজিয়া। রিজিয়া, রিজিয়াই ছিল। কিন্তু — পরিবর্তন এল ওর ভেতর। অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই যেন তা ধরা পড়ল।
সে দিনটা ছিল রোববার। কুয়াশাচ্ছন্ন বিকেল। শহীদ দিবস পালনের প্রস্তুতি চলছে ঘরে ঘরে। রিজিয়া এল বাসায়। বেশ একটা গম্ভীর। চোখের তারা দুটি অচঞ্চল, বিষণ্ণ সন্ধ্যার মতো মধুর মুখ। চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ কেটে গেল নীরবতার মধ্যে। হঠাৎ সে বলল, ‘সত্যি, তোমরা বড় ভাগ্যবান। '
‘ভাগ্যবান মানে?’ বিস্মিত হলো সালাম।
রিজিয়া হাসল, ‘যে দেশের তরুণেরা ভাষার জন্যে প্রাণ দিতে পারে, সে দেশের মানুষকে ভাগ্যবান বলব না তো কী?' স্বপ্নালু চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল রিজিয়ার, ‘তোমাদের কাছ থেকে অনেক কিছুই শেখবার আছে আমাদের।'
‘যথা?’
‘যথা—এই আত্মদান। বাবা কী বলেছিলেন, জানো?”
'কী?'
‘বলেছিলেন, তোমরা নাকি উর্দুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছ।'
‘এ তোমার বাবার একটা মারাত্মক ভুল ধারণা।' সালামের হয়ে বলল সেলিনা। ‘তোমাদের বিরুদ্ধে তো আমাদের সংগ্রাম নয়।'
‘আমাদের বিরুদ্ধে আবার বলছ কেন?' ম্লান হেসে প্রতিবাদ করল রিজিয়া। ‘উর্দু তো আমাদেরও মাতৃভাষা নয়।'
‘তবে?’
‘আমাদেরও মাতৃভাষা আছে একটা।' অদ্ভুত শান্ত গলায় বলল রিজিয়া। ‘অবশ্য তোমাদের বাংলার মতো অত সমৃদ্ধ ভাষা নয়। তবু মাতৃভাষা তো!' একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। ‘তোমরা জিতে গেলে...আর আমাদের হার হলো।'
‘জিতলাম কই।' সেলিনা তাকাল তার দিকে। ‘এখন তো বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতিই দিল না ওরা। আর তুমি বলছ...।'
“হ্যাঁ গো হ্যাঁ। আমি তাই বলছি।' মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল রিজিয়া, ‘ভাষার প্রতি যাদের এত দরদ, তাদের ভাষা কেড়ে নেবে—এ শক্তি কারও নেই এ পৃথিবীতে।’
নিজের অজান্তেই তার দিকে তাকাল সালাম। কাছে থেকেও সে আজ যেন কত দূরে। কী হলো রিজিয়ার।
রিজিয়ার পরিবর্তনের বোধ হয় এখানেই সূচনা।
এরপর কয় দিন কোথায় যেন গুম হয়ে ছিল রিজিয়া। সেলিনার কাছে খোঁজ নিতে ও বলেছে। ‘কী জানি, কী হলো মেয়েটার, কলেজেও তো আসে না আজকাল।
‘আসে না বলে একটু খোঁজও নিতে হয় না, সেলিনা। ছি! তোমার বান্ধবী না ও।' মৃদু তিরস্কার করেছে ওকে সালাম।
সেলিনা হেসেছে মিটিমিটি, ‘আমার বান্ধবী যখন। খোঁজ রাখি না রাখি সেটা আমার ইচ্ছে। তোমার এত দরদ কেন?'
“উঃ! আমি যেন কত দরদ দেখাচ্ছি আরকি!' মুখ ভেংচিয়ে সরে এসেছে সালাম ৷
পরদিন বিকেলে এসে উপস্থিত রিজিয়া।
'কিহে, কোথায় গুম হয়ে ছিলে এত দিন?' প্রশ্নটা সেলিনাই করল। ‘গুম হয়ে থাকব কোথায়? বাড়িতেই ছিলাম। শরীরটা খুব ভালো যাচ্ছিল না কিনা।'
‘অসুখ করেছিল নাকি?' উৎকণ্ঠা দেখাল সালাম।
“না, ঠিক অসুখ নয়। তবে কেমন যেন ভালো লাগছিল না শরীরটা।' হাই তুলেছে রিজিয়া
সেলিনা অনুযোগ করল, ‘তুমিও আসছ না। আমাদের ভাষাচর্চাটাও বন্ধ হয়ে রয়েছে।'
‘থাক বন্ধ হয়ে।’ অনেকটা তাচ্ছিল্যের স্বরে হাসল রিজিয়া, 'কী দরকার এত কষ্ট করে ওসব বিদেশি ভাষা শিখে।'
‘কী ব্যাপার, হঠাৎ উৎসাহে এত ভাটা পড়ল যে।' সালাম পরিহাস করার চেষ্টা করল।
হঠাৎ যেন ম্লান হয়ে গেল রিজিয়া, ‘ভাটা পড়বে কেন। ভাষা তো আর কম শিখিনি। ইংরেজি শিখেছি, উর্দু শিখেছি, শেষ পর্যন্ত তোমাদের বাংলাও শিখছি।' খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বলল, “কিন্তু কী আশ্চর্য দেখো, নিজের মাতৃভাষার খোঁজ নেওয়ার কোনো দিন দরকারও বোধ করিনি।' সালাম কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। রিজিয়ার অনুভূতি যেন তাকেও স্পর্শ করেছে। হঠাৎ একসময় বলল, ‘একটা কবিতা শুনবে তোমরা—রবীন্দ্রনাথের?”
বহু দিন ধ'রে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা, দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে একটি শিশিরবিন্দু।
উর্দুতে কবিতার সারমর্মটা সালামই বুঝিয়ে দিল। রিজিয়া কোনো কথা বলল না। অকস্মাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দেয়ালের কাছে সরে গেল। তিনটি ছবি পরপর টানানো-
‘ইনি কে?’
সেলিনা এগিয়ে এল, ‘রবীন্দ্রনাথ।’
‘ইনি?’
‘শরৎচন্দ্র।’
‘আর ইনি?’
‘নজরুল ইসলাম।'
তিনটি ছবির দিকে একবার আর আকাশের দিকে একবার চোখ তুলে তাকাল রিজিয়া। তারপর মৃদুস্বরে বলল, ‘পরশু একুশে ফেব্রুয়ারি, না?'
পাঁচটাও তখন বাজেনি। সালাম বেরোচ্ছে। দেখল রিজিয়া দাঁড়িয়ে। এতটা বিস্ময় জীবনে কোনো দিন আসেনি সালামের। বিস্ময় দমনের চেষ্টা করল না সে, ‘একি তুমি, রাত না পোহাতেই; সেলিনাকে ডেকে দেব?' রিজিয়া সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল, ‘না। প্রভাতফেরিতে যাচ্ছেন আপনি?'
'হ্যাঁ।'
বুকে নিজ হাতে পরিয়ে দিল সে ব্যাজটা। বলল, ‘কাল তৈরি করেছি। এটা দিতেই এসেছিলাম।’
তেমনি লঘুপদে সে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল।
রাস্তায় নেমে ভোরের কুয়াশামাখা আলোয় চোখে পড়ল সালামের—একটা কালো কাপড়ের টুকরো, তার ওপর সাদা সুতোয় রিজিয়ার আনকোরা শেখা বাংলা হরফে—অপটু হাতে লেখা—শহীদ স্মৃতি অমর হোক। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।
উৎস : সওগাত; চৈত্র : ১৩৬০ বঙ্গাব্দ [১৯৫৩ সাল]
0 Comments