ছোটগল্প
নেপেন দারোগার দায়ভার
সৈয়দ শামসুল হক
নদীর নাম আধকোশা। বর্ষাকালে হিমালয় থেকে ঢল নামে, রাতারাতি নদী ফুলে চারগুণ হয়ে যায়, তাই হয়ত নদীর নাম আধকোশা কেউ রেখে থাকবে। এখন এই চৈত্র মাসে শুকিয়ে সে উপবাসী সাধুর মত।
নদী পেরুলেই গ্রাম, গ্রামের নাম কাঁঠালবাড়ি।
গন্তব্যে প্রায় এসে পড়া গিয়েছে।
ঘোড়ার পিঠে বসেই নেপেন দারোগা নদীর এপার ওপার চোখ চালিয়ে হুংকার দিয়ে উঠে, এ কি র্যা? ঘাটিয়াল কই?
খেয়াঘাটের চালা একবারে শূন্য। বাঁশের মাচা খাঁ খাঁ করছে, পারানির কড়ি নেবার ক্যাশ বাক্সটা রাখা থাকে যে ভাঙা টেবিলের ওপর সেটা পর্যন্ত অনুপস্থিত। ততক্ষণে ক্যাচোর ক্যাচোর করতে করতে গরুর গাড়িটা এসে ঘাটে থেমেছে। গাড়ির দুপাশে বন্দুক হাতে শিউশরণ আর রামদাস। দুজনে, লালপাগড়ি খুলে মাথায় খানিকটা হাওয়া লাগিয়ে নেবে ভাবছিল, হুংকার শুনে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।
হাঁ, কাঁহা গইল বা? এ ঘাটিয়াল? ঘাটিয়াল হো।
দুই সেপাইয়ের গলাছাড়া চিৎকার শুকনো নদীর দুইপাড় মুহূর্তে চক্কর কেটে আসে। বাতাস নিস্তব্ধ। নদী স্থির। জন মানুষের সাড়া নেই।
লাফ দিয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে নামে নেপেন দারোগা। শিউশরণ লাগামটা নেবার জন্যে দৌড়ে কাছে আসে কিন্তু আবার হুংকার শুনে সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।
আরে, হিয়া খাড়া হোকে আওরাতকা মাফিক চিল্লাও মাৎ। তালাশ করকে দেখো। ঘোড়াটা ছাড়া পেয়ে মাটিতে মুখ নামিয়ে কিছু একটা খোঁজে। কিছু একটা যা চিবোনো যায়। কিন্তু ঘাটের কাছে সব ধু ধু বালি। এক ফোঁটা ঘাস নেই।
মানুষগুলোরও সারাদিন কিছু পেটে পড়েনি। সদর থেকে রওয়ানা দেয়া হয়েছে সেই ভোর বেলায়। এখন পড়তি বিকেল বেলা। সারাদিন সঙ্গে একটা মড়া নিয়ে আহার করতে কারো রুচি হয়নি। অশুচি সংস্কার? এ মড়ার জন্যে নেপেন দারোগা বা তার দুই সেপাইয়ের বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা থাকবার কথা নয়।
মড়া মানে, হাজতে থাকাকালীন মৃত কৃষক কর্মী দেবেশ বকশি। এখন গরুর গাড়ির ভেতরে শুয়ে আছে, তার নিজের গ্রাম কাঁঠালবাড়ি থেকে একটি মাত্র নদীর ব্যবধানে। গাড়োয়ান এরই মধ্যে গরুটাকে জোড়ন ছাড়া করে গাড়িটাকে বাঁশের লাঠি ঠেকান দিয়ে গামছার হাওয়া খাচ্ছে।
মড়ার কোনো হাওয়া খাবার দরকার নেই। তবে মুখের ওপর কটা মাছি ভন ভন করছিল খেদিয়ে দিতে পারলে ভালো হয়। কিন্তু গাড়োয়ানের সাহস হয় না। নেপেন জাত দারোগা থেকে নিজেকে সে যথাসম্ভব আড়াল করে রাখে গাড়ির ওপাশে।
ভ্রূ কুঞ্চিত হয়ে ওঠে নেপেন দারোগার। এ জায়গাতো এত বিরান হবার কথা নয়। কি বিশেষত কাঁঠালবাড়িতে আজ হাটবার।
শিউশরণ আর রামদাস এধার ওধার ঘুরে এসে মুখ কাঁচুমাচু করে হাত জোড় করে দাঁড়ায়।
কোই নেহি হ্যায় দেওতা।
আরে তোর দেওতার কিছু করেছি। তোদের দিয়ে কিছু হবে না।
কেবল খিদের জন্যে যে মেজাজ খারাপ তা হয়ত নয়। তারচেয়ে শক্ত এই দায়ভার।
জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বেল সাহেব বলে দিয়েছেন, মড়া গাঁয়ে পৌঁছে দিয়ে চোখের সমুখে দাহ করিয়ে তবে ফিরবে।
ইংরেজের সঙ্গে লড়তে আসে। ছোঃ। বিড়বিড় করে ওঠে নেপেন দারোগা। হাজতে দুটো রামডলা খেয়েই লীলাসাঙ্গ। এখন ঠ্যালা সামলাতে হচ্ছে তাকে।
রাগে সে হাতের ছড়ি নিজের উরুতেই মারতে থাকে। তার চটাস ফটাস শব্দে গাড়োয়ানি চমকে ওঠে বারবার। আতঙ্কের শেষ পর্যায়ে মানুষ হঠাৎ সাহস মঞ্চয় করে ফেলে। গাড়োয়ান ওপাশ থেকেই বলে, হুজুর বড় কর্তা।
কি ও?
কনতো হামরা নাও ঠেলি দিয়া আসি।
দূরে একখানা নৌকা বাঁধা ছিল, আগেই চোখে পড়েছিল, সেদিকে তাকিয়ে পরামর্শটা মনে ধরে নেপেন দারোগার। তার কুঞ্চিত ভ্রূ যুগল স্বাভাবিকতা ফিরে পায়।
সেটা লক্ষ করে গাড়োয়ানের সাহসের মাত্রা বেড়ে যায়। সে এবার গাড়ির ওপাশ থেকে বেরিয়ে এসে বলে, মোক ফির ছাড়ি দিবেন, মুই আর কাঁঠালবাড়ি যাবার নও।
নেপেন দারোগা না জানতে পারে, গাড়োয়ানের কাছে খবর ঠিকই পৌঁছে গ্যাছে। দেবেশ বকশি হাজতে মারা যাবার পর মুহূর্তে গোটা এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। এরই মধ্যে খবর হয়েছে যে, লাশের সঙ্গে ইংরেজ হাকিম একশ গোরা সেপাই পাঠাচ্ছেন গ্রাম জ্বালিয়ে দেবার জন্যে। দাহ করবার সার্টিফিকেটও সে সঙ্গে এনেছে, নদীর পাড়েই দাহ করিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে সদরে ফিরবে, এ রকম ভেবে রেখেছিল। কিন্তু কোথায় কি? তুই ব্যাটা পালাতে চাস?
আমতা আমতা করে গাড়োয়ান। নেপেন দারোগাকে ভয় করে না এমন মানুষ তল্লাটে এখনো জন্মায়নি।
চটাস করে কাঁধে ছড়ির বাড়ি পড়তেই সে হাউ-মাউ করে ওঠে, হামার নাতিনের ব্যারাম, বাবু। বাইচপার নয়, উয়াক দেইখপার যামো।
শিউশরণ আর রামদাস নৌকা খুলে ঘাটের কাছে এখন ঠেলে নিয়ে আসে। ঘাটিয়াল ভাগ গিয়া দেওতা। ইসসে পুছিয়ে।
দেখা যায়, নৌকোর সঙ্গে তারা নেংটিপরা এক ছেলেকেও পাকড়াও করে এনেছে। ছেলেটি লাল পাগড়ি, দারোগার ঘোড়া আর স্বয়ং দারোগার আশুতোষ গোঁফ দেখে প্রস্রাব করে ফ্যালে। কি বলে, তার এক বর্ণ বোঝা যায় না। তার উলঙ্গ দেহ থরথর করে কাঁপতে থাকে।
এই হারামজাদা, নেপেন দারোগা ছেলেটির কাঁধে ছড়ি রেখে হুংকার দিয়ে ওঠে, ঘাটিয়াল কই? লোকজনক কই? গেছে কোথায় সব?
কাইও নাই, কাইও নাই পিনপিন করে বলে চলে ছেলেটি, ভয়ে ভয়ে সে একবার গরুর গাড়ির দিকে তাকায়। লাশের পায়ের ডগা দেখা যায়। সম্মোহিতের মতো ছেলেটি সেদিকে তাকিয়ে বলে চলে, সউগ চলি গেইছে। কাইও নাই। বন্দুক ধরি আইসবে বলি পালাইছে ওমরা।
ফটাস করে পিঠে লাগিয়ে দেয় নেপেন দারোগা। তিড়িং বিড়িং করে ওঠে সে। ভাগো হিয়াসে।
বেশ, সবাই যদি পালিয়ে গিয়েই থাকে, বহুৎ আচ্ছা। সে-ও নেপেন দারোগা। জ্বালিয়ে দেবে গ্রাম। দেওয়ানিদের বেঁধে এনে চাবুক লাগাবে।
কিন্তু হঠাৎ মনে পড়ে যায় আগের কাজ আগে সারতে হবে। লাশ দাহ করিয়ে সদরে ফিরতে হবে। রক্তমুখো বেল সাহেব বাংলোয় অপেক্ষা করবেন রিপোর্ট নেবার জন্যে। থিবী ও মানুষের
জীবনে এ রকম মুশকিলে পড়েনি সে। রাজদ্রোহীর লাশ সঙ্গে, সে লাশ নেবার লোক নেই, যতদূর চোখ যায় কোনো মানুষের চিহ্ন মাত্র নেই, অথচ এক্ষুণি দাহ করতে হবে।
নৌকার ওপরে সেপাই দুজন ধরাধরি করে লাশ ওঠায় দেবেশ বকশির। সর্বাংগ একটা ময়লা চাদর দিয়ে ঢাকা। সন্ধ্যার পাতলা অন্ধকারের ভেতরেও দেখা যায় দুচোখ তার বিস্ফারিত, যেন সন্ধ্যাতারা খুঁজছে।
এই হারামজাদা, বলে নেপেন দারোগা নিজেই ছড়ি দিয়ে লাশের মুখের ওপর চাদর ঢাকা দিয়ে দেয়।
নৌকোটাকে এক ঠেলা দিয়ে গাড়োয়ান ভয়ে ভয়ে তাকায়। জিজ্ঞাসা, এখন কি তার ছুটি? কিন্তু নেপেন দারোগার কাছ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। সে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে অপসৃয়মান নৌকোর দিকে। নৌকোয় লাশের সঙ্গে শিউশরণ
আর রামদাস।
গাড়িটানা গরু দুটো মৃদ স্বরে হাম্বা করে ওঠে। রক্তের ভেতরে তারা হয়ত রাতের আগমন অনুভব করে।
তারপর খালি নৌকো নিয়ে ফিরে আসে শিউশরণ।
চলিয়ে হুজুর।
ঘোড়াটিকে জলে নামিয়ে, লাগাম হাতে ধরে, নৌকোর ওপর উঠে বসে নেপেন দারোগা।
যুঁই এলা যাও, বড় কর্তা?
গাড়োয়ানের গলা পেয়ে সম্বিত ফিরে পায় সে। তাইতো, এতক্ষণ কি সব মাথামুণ্ডু ভাবছিল সে। ঘোর অমাবস্যার রাতে মান্দারবাড়ির কালীর থানে একা নিষ্কম্প বসে থাকতে যে ভয় পায় না, তার এরকম মনে হবে কেন?
ধমকটা যেন নিজের ভয়কেই দিয়ে ওঠে নেপেন দারোগা।
যাবে না তো আমার শ্রাদ্ধ খাবে, হারামজাদা।
গাড়োয়ান আর এক মুহূর্ত দেরি করে না। নৌকো জলে লগির খোঁচা খেয়ে নড়ে ওঠে। ঘোড়া সাবলীলভাবে পাশে পাশে সাঁতার কেটে চলে।
মাঝ নদীতে ঝপ করে অন্ধকার নেমে পড়ে। ক্ষণকালের জন্যে শীতল একটি দমকা হাওয়া বয়ে যায়। শিউরে ওঠে শান্ত নদীর বুক। আবার সব স্থির হয়ে যায়। নৌকো ওপারে গিয়ে লাগে।
সে যাবে বে
মড়া আগলে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়েছিল রামদাস। রাত নেমে আসবার সঙ্গে সঙ্গে সেও অনুভব করেছিল শীতল দমকা হাওয়া। সে বিড়বিড় করে রাম-সীতা স্মরণ করছিল। দারোগা বাবুকে দেখে, বিশেষ করে শিউশরণকে দেখে, সে এখন স্বস্তি ফিরে পায়। মানুষ সম্ভবত সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশা করে সমপর্যায়ের মানুষের কাছে। লাফ দিয়ে পাড়ে নেমে যায় নৈপেন দারোগা। তার সঙ্গে ঘোড়াটাও জলের ভেতরে থেকে বিশাল শুশুকের মতো ভুস করে উঠে দাঁড়ায়। ঘোড়াটা একবার গা ঝাড়া দিয়ে মনিবের পাশে মাথা নিচু করে পা ঝাড়ে। তখন তার গায়ে হাত বুলিয়ে দেয় নেপেন দারোগা।
অন্ধকারে কোনো আলো চোখে পড়ে না কোথাও। বাতাসে কোনো ধ্বনি স্বর ভেসে আসে না। সন্ধ্যার মঙ্গল শাঁখ বাজে না। আজান শোনা যায় না। বুঝতে বাকি থাকে না, ছেলেটির কথাই সত্যি। সকলেই গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছে।
মুহূর্তে কর্তব্য স্থির করে ফেলে নেপেন দারোগা।
তুমলোগ ইহা রহো।
ঘোড়ার পিঠে লাফিয়ে উঠে পড়ে সে। বিনা রেকাবে ঘোড়া চালানো নেপেন দারোগার আরেক অহংকার।
গাঁও ঘুমকে আতা হ্যাঁয়। কোই না কোই শালা চুপকে রাহা হোগা।
অন্ধকারের ভেতরে ঘোড়া মিলিয়ে যায়। বহুদূর পর্যন্ত পায়ের দাপ শোনা যায় তার। সেপাই দুজনের হঠাৎ খেয়াল হয়, লাশের একেবারে কাছে দাঁড়িয়ে আছে। দুজনেই প্রায় এক সঙ্গে লাফ দিয়ে সরে দাঁড়ায়। রাতের অন্ধকারে লাশটিকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখে তারা। বন্দুক আর তাদের ততখানি সাহস দিতে পারে না। মানুষের অনুপস্থিতি, নির্জনতার আর নদী প্রবাহের তরল ধ্বনি লাশটিকে তাদের চোখে প্রেতশক্তি দান করে।
বিড়ি ধরায় দুজন। ছলাৎ করে একটা শব্দ হতেই চমকে ওঠে তারা। আসলে মাছ, কিন্তু মাছ বলে প্রত্যয় হয় না তাদের। বিড়ি হাতে বিস্ফরিত চোখে তারা নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে।
ঘোড়ার পায়ের দাপ নিকটবর্তী হয়।
অচিরেই পাহাড়ের মতো সওয়ারসহ ঘোড়া এসে লাশের কাছে স্থির হয়।
বিড়ি ছুঁড়ে ফেলে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় শিউশরণ আর রামদাস।
নেপেন দারোগার কণ্ঠস্বর অন্ধকারের ভেতর থেকে দৈববাণীর মতো শোনায়। সব শালা ভাগলবা। আওরত মরদ সব ভাগ গিয়া। একঠো কুত্তা ভি হ্যায় নেহি।
ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে আসে সে। নিজের উরুতেই ছড়ির বাড়ি দেয়। তারপর সেপাইদের ভাষাই সে ব্যবহার করে। বোঝে না, ঐ ভাষা ব্যবহার করে সেও সঙ্গ সন্ধান করছে, কারণ সে এখন শীতল নিঃসঙ্গতা হাড়ের ভেতরে অনুভব করে।
শালা আন্দোলন করেগা, চাষিকো সমান ভাগ দেগা, আংরেজ কো, হঠা দেগা, গরিবকা রাজ হোগা, বহৎ দরদ দেখানেওয়ালা থা। আব কাঁহা হ্যাঁয় সব? লাশ তো ওহি আংরেজ কো আভি দাহ করনে পড়েগা। হ্যাঁ।
অন্ধকারে সটান দাঁড়িয়ে থাকে শিউশরণ আর রামদাস।
এই প্রথম একটি ধ্বনি শোনা যায়।
দুরে শেয়াল ডেকে ওঠে।
কিন্তু না, শুধু শেয়াল নয়, সেই সঙ্গে মানুষেরও কণ্ঠস্বর যেন। কিম্বা তাদের কানের ভুল। তবু তিনজনই, সম্ভবত দেবেশ বকশির লাশও, উৎকর্ণ হয়ে থাকে। মৃতরাও জীবিতের অপেক্ষা করে বৈকি।
কোনো মীমাংসা হয় না। সত্যি সত্যি মানুষের কণ্ঠস্বর কিনা, বোঝা যায় না। আবার স্তব্ধতা এসে হামা দিয়ে বসে।
হঠাৎ গা ঝাড়া দিয়ে নেপেন দারোগা হুংকার দেয়।
উল্লুকা মাফিক খাড়া মাৎ রহো। উধার শমসান হ্যায়। হারামীকো “লে চলো, দাহ করনে কা অর্ডার হ্যায়ে। বাপ ভাগ গিয়াতো, শালা ইসকা আংরেজ বাপ দাহ করোগা। উঠাও লাশ।
আধমাইলটাকে দূরে কাঁঠালবাড়ির শ্মশানঘাট, সোজা দক্ষিণহাতি।
আঙুল দিয়ে ইশারা করে নেপেন দারোগা আগেই সেখানে ঘোড়া ছুটিয়ে হাজির হয়। শ্মশান যাত্রীদের চালার খুঁটিতে ঘোড়াটিকে বেঁধে জুৎ করে সে একটা গাছের গুড়ির ওপর বসে। এর আগে সৎকার করতে গিয়ে কেউ হয়ত গাছ ফেড়েছিল, তারই গুঁড়ি কাঁৎ হয়ে জলের কিনারে পড়ে আছে।
শেষ কবে দাহ হয়েছে কে জানে। এখনো বাতাসে চিমসে একটা গন্ধ ভেসে রয়েছে।
হঠাৎ তাঁর মনে পড়ে যায়, বহুদিন আগে এমনি এক শ্মশানঘাটে সে অন্ধকারে বসেছিল, চড়চড় করে চিতার কাঠ পুড়ছিল।
হাঁপানীতে অস্থিশার বাবার চেহারাটা নেপেন দারোগার সমুখে ভেসে ওঠে। অনেকক্ষণ ধরে সে দেখে। অনেকক্ষণ। তারপর হঠাৎ কিসের সঞ্চারমান সাড়া পেয়ে চমকে উঠে দেখে, নদীর জল ঘেঁসে দ্রুত একটা শেয়াল পালিয়ে যাচ্ছে।
ইতস্তত তাকায় নেপেন দারোগা। না, ধারে কে কাছে কেউ নেই যে দেখে ফেলবে তার হঠাৎ এভাবে শিশুর মতো চমকে ওঠা।
উঠে দাঁড়িয়ে বার কয়েক চক্কর দিয়ে আসে সে। নদীর ওপারে, বহুদূরে সদর এখন তার এক পৃথিবী দূরের বলে বোধ হয়। কখন যে ফিরে যেতে পারবে সেখানে?
লাশটাকে এপারে না আনলেই হতো। কিন্তু না এনেও তো উপায় নেই। বেল সাহেবের হুকুম আছে কাঁঠালবাড়ির শ্মশানঘাটে নিজে দাঁড়িয়ে দাহ করিয়ে তবে ফিরবে। নবাবের ব্যাটা দুজন। একটা লাশ নিয়ে এইটুকু পথ আসতে ঘণ্টা লাগিয়ে দিচ্ছেন। অশ্লীল একটা গালি মুখে আসছিল, হঠাৎ আবার মনে হলো, বহুদূর থেকে মানুষের ক্ষীণ একটা বিলাপ যেন ক্ষণকালের জন্যে শোনা গেল।
না। আবার কান পেতে কিছুই শোনা গেল না।
শেয়াল হবে হয়ত।
প্রেতাত্মা?
দূর দূর। নেপেন দারোগা ভূত-প্রেত বিশ্বাস করে না। ওসব চোর ডাকাতের রটনা কারসাজি। ভূতের ভয় তুলে নিজেদের চুরি আর চলাচলের পথ পরিষ্কার রাখে। ও ঢের দেখা আছে নেপেন দারোগার।
চাঁদ এখনো ওঠেনি। আকাশেও বেশি তারা নেই। ঘন গাছপালার গাঁয়ের দিকটা একেবারে নিরেট দেয়াল হয়ে আছে।
তার ইচ্ছে করে একটা দেশলাইয়ের কাঠি খরচ করে জমাট অন্ধকারটাকে মশাল করে তোলে। সব কটা বাড়িঘর একসঙ্গে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে কল্পনায়। হাত নিসপিস করতে থাকে। আক্রোশের চাপে মুখের ভেতরে তার মাড়ি টিসটিস করে। এতক্ষণ দেখা দেয় দুই উল্লুক।
এ শুয়ার কা বাচ্চা, কাঁহা তাড়ি পি রহা থা? এতনা দের কিউ শালে লোগ?
অন্তর্যামী নাকি নেপেন দারোগা? আরে বাপরে বাপ, কিছুটি চোখ এড়িয়ে করবার জো নেই। শিউশরণ কিছুটা পেয়ারের লোক। সে মাথা চুলকোতে গিয়ে লাল পাগড়িতে বাধা পেয়ে ঘাড় চুলকেই লজ্জা প্রকাশ করে বলে, তাড়ি নেহি পিয়া, হুজুর, ডোম পাকড়
লে আওলবা।
হ্যাঁ, আরো একজনকে দেখা যাচ্ছে বটে। তার কাঁধেই দেবেশ বকশির লাশ লগির মতো টান টান বেঁধে ঝুলে আছে।
ঝুপ করে লাশ নামিয়ে মুহূর্তে বাতাসের ভেতর পচা মদের দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পূর্ণিমার মতো শাদা দাঁত সবকটা বের করে লোকটি হাত জোড় করে দাঁড়ায়।
হামি সুখিয়া ডোম আছি লাট বাহাদোর।
আরে ইস্কো কাঁহা মিলা?
নেপেন দারোগার কণ্ঠস্বর এতক্ষণে একটু আবছা সন্তোষ লক্ষ করা যায়।
টালমাটাল শরীরটাকে যথাসম্ভব স্থির রাখবার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলে সুখিয়া।
নেপেন দারোগা ছড়ি তুলে তার পেটে খোঁচা দিয়ে সোজা রাখতে চায়। লোকটি আরো বেশি করে পায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়তে চায়, যেন প্রণাম করবার জন্যে ছটফট করে।
ইয়ে শালা শারাব পিয়া, হুজুর। বলে রামদাস আর শিউশরণ সুখিয়াকে দুদিক থেকে ঘরে খাড়া রাখে।
এ যে একেবারে টেম হয়ে আছে র্যা? নেপেন দারোগা ছড়ি নাচাতে নাচাতে বলে। একে দিয়ে কি হবে?
সুখিয়া নিচের চেষ্টাতেই এবার সোজা হয়ে বুক টান করে দাঁড়ায়। দুহাত ঝাড়া দিয়ে শিউশরণ আর রামদাসকে সরিয়ে দিয়ে বলে, গেরামের সব লোক ভেগে গেল, মহারাজা। ই জাগা মইধে বড় বাবু যো আছেন, সি বললেন, কেউ জান লিয়ে বাঁচনে বা বটে। মনের মইধে হামি চিন্তা করলাম, দেবুদাদা যো আইতে লাগছেন, উয়ার কি হোবে বটে? কে উহার চিতা সাজাইয়া দিবেক? তো হামি রয়ে গেলাম। হামার ভি ডর লাগছিল, দুই বোতল খেয়ে লিলোম, নদীর পাড়ে বসে রইলোম দেবুদাদার লেগে বটে।
বসে রইলাম। দাঁত মুখ খিচুনি দিয়ে ওঠে নেপেন দারোগা। চোপ হারামজাদা। দেবুদাদা তোমার স্বগগে নেবে?
সুখিয়া ধমক খেয়ে দমে না, নেশার ঘোরে অম্লান বদনে সে বলে যায়, আপনি দেখে লিবেন, দেবুদাদার চিতা হামি সাজাইয়া দিবে বটে।
আবার এক ঝলক শীতল বাতাস বয়ে যায়। যেন হাড়ের ভেতরে গিয়ে কাঁপুনি লাগে।
আজ এই কিরে বাপু, চোত মাসে এমন হাওয়া? ভ্রূ কুঁচকে ওঠে নেপেন দারোগার। কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যায় সে। পর মুহূর্তে তার হুংকার শোনা যায়।
এ শালা লোগ, রাত কাবার করে দিবি নাকি? কাঠের জোগাড় দ্যাখ। চঞ্চল হয়ে ওঠে শিউশরণ ও রামদাস।
সুখিয়া বলে, কাঠ ভি জোগাড় করিয়ে রাখছি, লাট বাহাদোর।
যা, গুয়ারটার সঙ্গে হাত দেগে যা। ঝটপট। জলদি, জলদি।
তাড়া খেয়ে শিউশরণ আর রামদাস সুখিয়াকে নিয়ে কাঠ আনতে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। মুহূর্তের ভেতরে অস্বাভাবিক রকমের স্তব্ধতা চেপে বসে।
নদীর তীরে পড়ে আছে দেবেশ বকশির লাশ, দূরে দাঁড়িয়ে আছে ঘোড়াটা, আর সে, নেপেন দারোগা, জীবন্ত একটা মানুষ, মূর্তির মতো স্থির বসে আছে। কুলকুল করে চয়ে চলেছে আধকোশা। মানুষের কণ্ঠস্বরের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে নদী তার নুপুর বাজিয়ে চলেছে।
এরকম কাণ্ড জীবনে দেখেনি নেপেন দারোগা। সারাটা গ্রাম যেন ওলাউঠায় উজাড় হয়ে গেছে।
পিঠের দাঁড়ায় বরফের শীতলতা বোধ করে সে।
গেরস্থর ঝকঝকে উঠোন, পরিষ্কার করে নিকোনো। ঘরগুলোর দরোজা যেন অতল কোনো সুড়ংগের মুখ। পেছনে বাঁশবনে শ্বাপদের চলে যাবার সরসর শব্দ। কোথাও কোনো মানুষ নেই। একের পর এক বাড়ি, কুঁড়েঘর, মন্দির, দোকান যেন পৃথিবী থেকে মানুষ নামের সমস্ত প্রাণী ভোজবাজির মতো মিলিয়ে গেছে।
কি যেন এক পরিত্যক্ত পুরীতে সে একা দাঁড়িয়ে।
অন্ধকারে লাশটার দিকে তাকায় নেপেন দারোগা। অমন যে লাল টকটকে ইংরেজ হাকিম বেল সাহেব, তিনি পর্যন্ত বারবার বলে দিয়েছেন, সাবধান, যেন লাশ নিয়ে মিছিল মিটিং না হয়।
কি আছে ঐ মৃত মানুষটির? কোথাও সেই শক্তির উৎস?
ঠিক তখন, পেছন জংগল দিয়ে তৈরি অন্ধকারের নিরেট দেয়াল ছিড়ে হঠাৎ এক করুণ বিলাপ বেরিয়ে আসে।
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় নেপেন দারোগা।
কে?
লাশটার দিকে দ্রুত একবার তাকিয়ে নেয় সে। কেন তাকায় নিজেও সে বোঝে না। ঘোড়াটার মুখ তুলে কিসের নিঃশ্বাস টানে, তারপর অস্থির হয়ে পা ঝাড়তে থাকে ৷ মানুষ। নতুন মানুষ। নইলে ঘোড়াটা ওরকম করত না।
কোন হ্যায়?
কারো সাড়া পাওয়া যায় না। তিন হারামজাদা কাঠ আনতে কেন এত দেরি করছে, তাও বোঝা যায় না। নেপেন দারোগার মনে হয়, এই মুহূর্তে রওনা হতে পারলে বেঁচে যায় সে। অথচ ঠিক ভয় পেয়েছে, তাও নয়। তার পেটের ভেতরেই কেমন সব ঘুলিয়ে ওঠে, হয়ত সারাদিন পেটে কিছু না পড়বার দরুন, হয়ত অন্য কোনো কারণে।
অচিরেই সেই বিলাপ ধ্বনি নিকটতর হয়, আর সেই সঙ্গে পাতাপত্তরের ওপর দিয়ে হেঁচড়ে কিছু টেনে আনবার শব্দ।
মনে পড়ে যায়, ঘোড়ার পিঠে, ব্যাগের ভেতরে টর্চ আছে।
টর্চের আলো ফেলতেই দেখা যায় কংকালসার লোলচর্ম এক বুড়ি। পাছা ঘষে নদীর পাড় বেয়ে নেমে আসছে। তীব্র আলো ঝলক দিয়ে পড়বার সঙ্গে সঙ্গে বুড়ির বিলাপ ও গতি থেমে যায়। এক হাত তুলে সে চোখ আড়াল করবার চেষ্টা করে কিন্তু থরথর করে তার হাত বারবার কোলের ওপর পড়ে যায়।
বুড়ি তখন সেখানে বসেই আবার বিলাপ শুরু করে।
তুই কোনটে গেলুরে। দেবু, তুই কোনটে গেলু।
টর্চ জ্বালিয়ে রেখে নেপেন দারোগা বুড়ির কাছে এগিয়ে যায়। কিন্তু দারোগা দেখে ভয় পাবার বয়স অনেক দিন আগেই পার হয়ে গেছে তার। এমনকি, চোখও ভালো করে দেখতে পায় কিনা সন্দেহ।
এই, তুই কে?
সারা গ্রাম চক্কর দিয়ে এসেছে নেপেন দারোগা। কোথাও কাউকে চোখে পড়েনি।
এ বুড়ি তাহলে এতক্ষণ ছিল কোথায়?
এবার মনে হয়, অশরীরী কেউ; মনে হয়, চোখের ভুল, কানের ভুল।
টর্চ নিবিয়ে ফেলে সে।
আবার জ্বালায়।
আবার দেখা যায় বুড়িকে। আবার সে চোখ বোঁজে আলোর তীব্রতায়। আর এবার সে চিল্লিয়ে ওঠে, জল্লাদ তোমরা। মনোত দয়ামায়া নাই তোমা? ব্যাটা নাই তোমার? মুখ দিয়া রক্ত উঠি মইরবে তোমার একেক ব্যটা, কয়া দিলোম। হামার দেবুক তোমরা মারি ফেলাইছেন? কোন অপরাধ করছিল সে যে তোমার জানের ওপর দিয়া উঠি গেইলো? কথা কন না যে বড়? ভগবান তোমার রাও কাড়ি নিছে? ভাল কইরছে। ভাল কইরছে। নির্ব্বংশ হন তোমরা। কুষ্ঠ হয়া ভিক্ষা করেন, মুই চোখ মেলি দ্যাখো ৷
নেপেন দারোগার ইচ্ছা হয় লাথি মেরে বুড়িকে ঠাণ্ডা করে দেয়।
কিন্তু আধকোশার জল ছলছল তীরে, অন্ধকারে, নিঃসঙ্গতার নাগপাশের ভেতরে বুড়ির এই বিলাপ হঠাৎ নেপেন দারোগার শক্তি হরণ করে নেয়। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তার মনে পড়ে যায়, বাবা মরে যাবার পর মায়ের সেই বিলাপ, যে বিলাপ শূন্য দালানের কোঠায় কোঠায় অন্ধকারে এমনি মাথা খুঁড়ে মরছিল।
নিজের কানেই নিজের কণ্ঠের অপ্রত্যাশিত কোমলতা ধরা পড়ে কেমন অপ্রতিভ হয়ে যায় সে।
দেবেশ বকশি কে হয় তোমার?
বুড়ির কানে সে প্রশ্ন পশে কিনা বলা যায় না। কোনো উত্তর আসে না। নেপেন দারোগাও দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করে না। ফস করে টর্চ নিবিয়ে ফেলে।
সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়, বুড়ির মতই আরো অনেকে, শত শত হাজার লোক, আশে পাশেই অন্ধকারে লুকিয়ে আছে।
এক্ষুণি তারা বেরিয়ে পড়বে, হৈ চৈ করে ঘিরে ধরবে, টুকরো টুকরো করে ফেলবে নেপেন দারোগাকে।
শালা ইংরাজের দারোগা।
শিউরে ওঠে সে। চকিতে চারদিকে চোখ বুলিয়ে নেয়। আকাশে এখনো চাঁদ ওঠেনি, ভালো করে কিছুই চোখ পড়ে না। সম্ভাবনাটি তখন আরো বেশি বাস্তব বলে বোধ হয়। নিজের অজান্তেই নেপেন দারোগা ঘোড়ার পাশে এসে দাঁড়ায়। ঘোড়ার পিঠে হাত বুলোয় সে, যেন সপ্রাণ কিছু স্পর্শ করে চিত্তের অস্থিরতা বাগে রাখতে চায়। চি-হি-হি ডেকে ওঠে ঘোড়া।
মানুষের সাড়া পাওয়া যায় না। গান গাইতে অন্ধকারের ভেতর এগিয়ে আসছে শিউশরণ আর রামদাস। তাদের সঙ্গে সুখিয়ার বেপরোয়া গলায় ভিন্ন সঙ্গীতও শোনা যায়। শুয়ার লোগ, খাল খিচ লেনা চাহিয়ে।
রামদাস মিনমিন করে উত্তর দেয়, বৃহৎ ভারী বোঝা, দেওতা। মুশকিল সে লায়া। গলা শুনেই বোঝা যায়, দেরিটা কেবল কাঠের জন্যেই নয়, কিছু পেটে দিয়ে এসেছে দুজন।
ডিউটির ভেতর মদ খাওয়ার জন্যে কড়া শাস্তি দিতে পারত নেপেন দারোগা। জনমানুষহীন আধাকোশার তীরে অন্তত মুখ খিস্তি করতে পারত। কিন্তু কিছুই করল না সে। কোনো রকমে এখন এই মড়া পুড়িয়ে এখান থেকে রওনা হতে পারলেই হয়।
তার কেবলই মনে হচ্ছে বুড়ির পেছনে পেছনে এক্ষুণি, এই মুহূর্তে শত শত লোক রে-রে করে বেরিয়ে আসবে হাজার মশাল জ্বালিয়ে। কেড়ে নেবে লাশ। লাশ নিয়ে পিলপিল করে সব ছুটবে সদরের দিকে লাশ নিশান হাতে নিয়ে।
তিনজনের কাঠের বোঝা দড়ি দিয়ে টেনে এনেছে, এনে এখন হতভম্ব দাঁড়িয়ে আছে। কেন দাঁড়িয়ে আছে? ওদের ও কি সন্দেহ হয়েছে, জঙ্গলের নিরেট দেওয়ালের পেছনে লুকিয়ে আছে মানুষগুলো? বুকের ভেতর গুর গুর করে ওঠে নেপেন দারোগার।
নেশা ওদের জবুথবু করে রেখেছে। কিন্তু নেপেন দারোগার সে যুক্তি মনে আসে না। সে চিৎকার করে ওঠে, খাড়া হোকে রাম ভজন হো রহা? হাত লাগাও জলদি।
যে সুখিয়া নেশার ঘোরে প্রথম থেকেই টলছিল, কাজের সময় তাকেই দেখা যায় সবচেয়ে সপ্রতিভ। এর আগেও দেখা গেছে, লাশ কাঁধে দিব্যি হেঁটে এসেছে, কিন্তু যেই লাশ নামিয়ে রেখেছে অমনি আর স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছে না।
এতক্ষণ চুপ করে ছিল বুড়ি। কখন সে চুপ করে গিয়েছিল নেপেন দারোগা লক্ষও করে নি। হঠাৎ তার বিলাপ শুরু হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে পড়ে শিউশরণ আর রামদাস। ভূত ভূত, হুজুর।
হা হা করে হেসে ওঠে সুখিয়া।
শমসান তো ভূতেরই জাগা আছে, মহারাজ। কিন্তু ই ভূত লয়। মা আছে বটে। নেপেন দারোগা চমকে উঠে জিজ্ঞেস করে, দেবেশ বকশির মা?
বুঝলোম নাই।
আরে তোর চৌদ্দগুষ্টির দেবু দাদার মা?
আবার হেসে ওঠে সুখিয়া। চিতার পরে শেষ কাঠ যত্ন করে বিছিয়ে বলে, দেবু দাদার মা লয়, লাঠ বাহাদোর। ই গেরামে বুড়িকে মা বোলায় মানুষে।
তখন কেমন যেন চিন্তিত বোধ করে নেপেন দারোগা।
কত দেরি? আর কত দেরি?
কিছু বলা যায় না, কখন কি ঘটে যাবে। এ ব্যাটার রকম সকমও বেশি সুবিধের মনে হয় না। খামোখা এ রকম জ্বলছে কেন থেকে থেকে?
ব্যাস, সব তৈয়ার বটে।
পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল সব। ঢালু করে কাঠের আড়ে কাঠ বিছিয়ে চিতা তৈরি। এতক্ষণে খেয়াল হয়, জংগলের মাথার ওপর দিয়ে কখন চাঁদ উঠে চুপ করে বসে আছে। পচা রক্তের মতো লাল রঙ তার; দেখে শিরশির করে ওঠে গা।
সুখিয়া বোধ হয় আশা করে সেপাই দুজন তাকে সাহায্য করবে লাশ চিতায় রাখবার জন্যে। কিন্তু কাউকে এগোতে না দেখে নিজেই সে কাঁধে করে ওঠায় দেবেশ বকশিকে। তারপর ঘুমন্ত একটা শিশুর মতো তাকে শুইয়ে দেয় চিতার পরে।
ঘষে ঘষে কাছে এগিয়ে আসে বুড়ি।
মুখ দেখবি মা। চাদরের ঢাকা খুলে দেয় সুখিয়া। জনমের মতো দেখ ল। বলেই হো-হো করে কেঁদে ওঠে সুখিয়া।
রক্তিম গম্ভীর চাঁদের আলোয় বুড়ি কি ভালো করে দেখতে পায় দেবেশ বকশির মুখ?
খানিকক্ষণ হা করে থেকে বুড়ি প্রত্যেকের মুখে দিকে বিহ্বল করে তাকায়। শেষে নেপেন দারোগার মুখের দিকে তার দৃষ্টি স্থির হয়। কিছু একটা বলবার জন্যে দাঁতহীন গহ্বরের ভেতরে তার জিহ্বা নড়তে থাকে। কিন্তু কিছুই উচ্চারিত হয় না।
দূরে শেয়াল ডেকে ওঠে।
বুড়ি ঘষে ঘষে আরো এগিয়ে এসে দেবেশ বকশির মুখে হাত রাখে। কিছু একটা অনুভব করবার চেষ্টা করে কিছুক্ষণ, তারপর হাত সরিয়ে নিয়ে বুড়ি বলে, আবার ঘুরি আসিব, দেবু।
গোল বাধালো সুখিয়া ডোম।
দেবু দাদাকে আগুন দিবেক বটে?
ধমক দিয়ে ওঠে নেপেন দারোগা। আগুন আবার কিসের? ম্যাচ ধরিয়ে দিবি। ব্যাস। সে হবেক নাই।
একেবারে গোঁ ধরে বসল সুখিয়া।
আবারো জলের কাছে গিয়ে দৌড়ে গেল শেয়াল। শ্মশানে এরা জীবিত মানুষকে ভয় করে না। জীবিত মানুষ বরং মৃতকে ভয় করে এখানে। জংগলের ভেতরে অনেক মানুষের নিঃশ্বাসের মতো সরসর ধ্বনি বয়ে যায়।
তাড়াতাড়ি কাজ সেরে ফেলবার জন্যে নেপেন দারোগা তাড়া দেয়। সব শালাতো ভেগেছে। আগুন দেবার জন্যে সবে আছে যে বড়।
বুড়ি হঠাৎ বিলাপ করে ওঠে
নেপেন দারোগা ধমক লাগায় তাকে। চোপ, বুড়ি। এই হারামজাদা, তুই আগুন দে। সঙ্গে সঙ্গে নিজের কান ধরে সুখিয়া। আরে, রাম-রাম। সি হবেক নাই। হামার নরক হবেক বটে। হামি যো ডোম হইলোম।
হাহাকারের মতো শোনায় সুখিয়ার কণ্ঠস্বর।
শিউশরণ আর রামদাসের মুখের দিকে দ্রুত একবার তাকায় নেপেন দারোগা। জঙ্গল ভেদ করে মানুষের পায়ে পায়ে এগিয়ে আসবার শব্দ যেন তাঁর বুকের পাঁজর ভেঙে দিতে চায়। ইতস্তত করে সুখিয়াকে বলে, এ হারামজাদা। আছে তোর কাছে?
কি মহারাজ?
আরো ব্যাটা, বোতল।
ঢকঢক করে বেশ খানিকটা গলায় ঢেলে, জীবনে এই প্রথম বলে ঝাঁঝের মুখে মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে, নেপেন দারোগা বলে, দে শালা, ম্যাচটা দে।
শ্রী নৃপেন্দ্ৰনাথ ভট্টাচার্য দুর্বোধ্য একটা অনুভূতির সঙ্গে লড়াই করবার রসদ সংগ্রহ করে অকম্পিত হাতে দেবেন বকশির মুখাগ্নি করে দেয়।
চিতার আগুনে রক্তিম চাঁদের আলোর দিকে লকলক করে ওঠে।
কাঠ পোড়ার চড়চড় শব্দে শত কণ্ঠের চিৎকার শোনা যায়।
--শেষ--
0 Comments