যদ্যপি আমার গুরু-পতি
শেখ তাসলিমা মুন
ভূমিকা
লেখাটি লিখি আমি আমার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে। সেলফ থেরাপি বা মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। জীবনের এ গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে জড়িয়ে যাওয়া মানুষগুলো এসেছে এ ডকুমেন্টে। এসেছে শুধু নয়, ওরা ছাড়া জীবনে এ অধ্যায় তৈরিই হতো না। তারা আছে আমার জীবনে। কোনো ধরনের অসম্মান করা আমার এ খণ্ড-আত্মচরিতের উদ্দেশ্য নয় । এ লেখা আমার এ ক্ষুদ্র জীবনের প্রতি আমার নিজের দায়বদ্ধতা । একজন মানুষ, একজন প্যারেন্ট, একজন জীবনসঙ্গী এবং একজন সামান্য চিন্তাশীল চিন্তক হিসেবে।
পাথর ও পাহাড়ের শীতল কঠোরতায় দীর্ঘ হেঁটে যেতে যেতে ওরা আমাকে ঘিরে ধরে। আমাকে প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করে। কর্মব্যস্ততায় সারাক্ষণ পাশে বসে থাকে। ক্লান্ত-শ্রান্ত ঘুমন্ত মধ্যরাতে ধড়ফড় জাগিয়ে তোলে; প্রশ্ন, প্রশ্ন আর প্রশ্ন। কেন? কেন? কেন? অসংখ্য অসহ্য কেন । সিদ্ধান্ত, লিখতে হবে। কষ্ট হবে। কিন্তু সেটাই হয়তো মুক্তির একমাত্র পথ ।
এটি আমার জীবনের একটি পার্ট। কেউ পড়বে সে উদ্দেশ্যে লেখা নয় । কেউ পড়বে বা পড়বে না, কেউ পড়ে ভিন্ন ব্যাখ্যা করবেন, সবটাই সই ৷
এ আমার কথা। আমার জীবনের।
বিনীত
শেখ তাসলিমা মুন
সুইডেন
এক.
আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসাটা বেশ যুদ্ধের ছিল। আমার মা তখন দেশে নেই। ছোট দুবোন এবং বাড়ি দেখার দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। আমার ভাই তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে চলে এসেছিলাম আমি। আমার অবর্তমানে আমার ভাই-ই আমার ভর্তির বাদবাকি রেজিস্ট্রির কাজগুলো করে রাখে। অনেক সাবজেক্টে ভর্তি হবার সুযোগ পাই আমি কিন্তু আমার ভাই আমাকে দুটি সাবজেক্টে ভর্তি করে। আইন এবং সোশ্যাল ওয়ার্ক। আইন পড়ার সিদ্ধান্ত পরে আমিই নিই। যদিও সোশ্যাল ওয়ার্ক আমার খুব একটি প্রিয় সাবজেক্ট ।
বাড়ির কাজ গুছিয়ে আসতে আসতে আমার কিছুটা দেরি হয়ে গেল । ক্লাস তখন শুরু হয়ে গেছে।
আমি পুরোপুরি অর্থে মফস্বলের মেয়ে। মফস্বলের মেয়েটির বাবা অনেক বড়, আর সেই বাবার মতো বড় তার স্বপ্ন। এ স্বপ্নকে ঘিরে তার জীবন আবর্তিত হয়।
ট্রেনের জানালায় রাতের বিশ্ববিদ্যালয় ঝলমল করে চোখের সামনে। মধ্যরাতে আলো ঝলমল স্টেশনে নেমে বুঝি জীবনে প্রথমবারের মতো অচেনা জায়গায় আমার জীবন শুরু হতে যাচ্ছে! এই প্রথম আমি বুঝি ‘আমি’ হতে যাচ্ছি। উত্তেজনা বয়ে যায় শরীরে। ওখানে আমার একটি আলাদা জীবন শুরু হবে। অজানা উত্তেজনায় তিরতির কাঁপছে হৃদয় ।
প্রথম ক্লাস। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার প্রথম ক্লাসে শিক্ষক হিসেবে যিনি প্রবেশ করলেন তিনি আমার গুরু এবং প্রথম ক্লাস নেয়ার আঠারো বছর পরে হয়েছিলেন আমার পতি তিনি। গল্পটি লিখতে বসেছি তারও অনেক পরে।
১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে আমাদের বিয়ে হয় ।
যেহেতু গল্পে আমি নিজে একটি পার্ট, সেখানে নিরাসক্ত নিরপেক্ষ নিয়ে লিখতে পারাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তাতে কতটা সফল হব জানি না, তবে চেষ্টা করব সমস্ত বিষয়টির ওপর যেন সুবিচার করে লিখতে সক্ষম হই। এ লেখা সহজ হবে না আমি নিজেও বুঝতে পারছি। কিন্তু চেষ্টা আমাকে করতেই হবে। এ আমার একমাত্র পথ, বিষয়টি থেকে নিজেকে মুক্ত করার।
ভদ্রলোক তিনি অত্যন্ত মেধাবী। ব্রিলিয়ান্ট। শিক্ষাজীবনের প্রতিটি রেজাল্ট তার গ্লোরিয়াস। বোর্ডে সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম হন সব সময়। বিশ্ববিদ্যালয়ে রেকর্ড নম্বর পাওয়া এবং গোল্ড মেডেল পেয়ে পাস করা ছাত্র। যে ক'জন অত্যন্ত মেধাবী শিক্ষক দেশ পেয়েছে তিনি তাদের একজন। কিন্তু একাডেমিক জীবনে যতটা মেধাবী ব্যক্তিগত জীবনে প্রেম এবং বৈবাহিক জীবনে তিনি ততটাই বিফল। বারবার। কিন্তু তিনি সেসব থেকে বেরোতে পারেননি। উল্টো অসহায় একটি থেকে আরেকটি জটিল অবস্থা তৈরি করে গেছেন একের পর এক, ক্রমাগত। শুধু তা-ই নয়- তিনি এ দুর্বোধ্য অবস্থার ভেতর ঘূর্ণিপাক খেয়েছেন।
জীবনে একমাত্র বই কেনা, বইপড়া এবং লেখা, একমাত্র জগৎ যেখানে সে লুকিয়ে যেতে পারেন নিমেষে। অনেক বছর নির্বাসিত জীবন পার করেছেন। সব কিছু থেকে পালিয়ে বইমুখী হয়ে জীবনযাপন করেও সেসব পুরনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়নি তার পক্ষে। এ তার এমন এক নিয়তি যার সাথে ঘটনাচক্রে আমিও জড়ালাম । ভালো করে জড়ালাম । শুধু জড়ালাম না- মূল্য দিলাম এমন যে নিজের জীবনের থেকেও বড় হলো সে দাম। পরিশোধ করে গেলাম জীবনব্যাপী।
জন্ম ১৯৬৫ সালে, বৃহত্তর যশোরের কালিয়াতে। সুইডেনে বসবাস করছেন '৯০ সাল থেকে। মা প্রয়াত বেগম মনোয়ারা সালাম। শিক্ষক ও সমাজকর্মী। বাবা শহীদ বুদ্ধিজীবী শেখ আব্দুস সালাম। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নিজেই একটি বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন । যুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তান বাহিনী নৃশংসভাবে হত্যা করে তাঁকে।
মুন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স করেন। পরে স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘তুলনামূলক আন্তর্জাতিক আইন’ বিষয়ে মাস্টার্স করেন। পেশা সুইডেনে সরকারি চাকরি। জুরি বোর্ডের সদস্য এবং সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট পার্টির একজন সক্রিয় রাজনীতিক।
প্রথম বই— ‘আমি একটি বাজপাখিকে হত্যা করতে চেয়েছিলাম'। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে একটি ছয় বছরের শিশুকন্যার চোখের সামনে ঘটে যাওয়া, নিজেদের মোকাবেলা করা ব্যক্তিগত উপলব্ধির হৃদয়স্পর্শী স্মৃতিচারণ। দ্বিতীয় বই- 'অর্থ একটি দেবশিশুর নাম'। তৃতীয় বই- উপন্যাস : ‘পাথরনদী কথন'।
চতুর্থ বই— ‘যদ্যপি আমার গুরু-পতি।
0 Comments