প্যালেস্টাইন এর কবি মাহমুদ দারবিশ-এর কবিতা
তদন্ত
হ্যাঁ, লেখো
আমি একজন আরব
আমার কার্ড নম্বর হল পঞ্চাশ হাজার
আমার আটটি সন্তান
নবমটি পরবর্তী গ্রীষ্মে জন্মাবে,
তুমি কি রাগ করলে?
লেখো
আমি এক আরব
সাথি শ্রমিকের সাথে আমি পাথর ভাঙি
অমানুষিক পরিশ্রমে আমি পাথুরে পাহাড় ভেঙে
নুড়ি করি—
এক টুকরো রুটির জন্যে
আমার আট সন্তানের একখানি বইয়ের জন্যে
কিন্তু আমি দয়া-দক্ষিণা চাই না
আর তোমার কর্তৃত্বের কাছে মাথা নোয়াই না
তুমি কি রাগ করলে?
লেখো, হ্যাঁ লিখে নাও আমিএকজন আরব
আমি উপাধিহীন একটি নাম
উন্মত্ত পৃথিবীতে এখনও স্থির
স্থান ও কালের সীমানা ছাড়িয়ে
আমার শিকড় খুব গভীরে প্রোথিত আমি কৃষকের সন্তান ।
নলখাগড়া ও খড়ের তৈরি কুঁড়েঘরে
আমি বাস করি,
চুল আমার মিশকালো, চোখ : বাদামি
আমার আরবি শিরোভূষণ
কেড়ে নিয়েছে অনুপ্রবেশকারীর হাত,
আমি পছন্দ করি ভোজ্য তেল ও সুগন্ধি লতাগুল্ম
লেখো
এবং সবার উপরে
দয়া ক'রে লিখে রাখো—
আমি কাউকে ঘৃণা করি না
আমি কেড়ে নিইনি কারো সমূহ সম্পদ,
কিন্তু, আমি যখন অনাহারী
আমি নির্দ্বিধায় ছিঁড়ে খাই
আমার সর্বস্ব-লুণ্ঠনকারীর মাংস
অতএব,
সাবধান
আমার ক্ষুধাকে সাবধান
আমার ক্রোধকে সাবধান ।
যারা শুধু ধ্বংস করে
মানুষ খুন করার নেশায় পাগল হয়ে যায়
সেই বর্বরদের বিরুদ্ধেই কেবল আমরা অস্ত্র ধরি ।
পৃথিবীটাই বদলে গেছে,
প্রবল ভূমিকম্পে উপত্যকার পুষ্প ঝ'রে যাক
তীক্ষ্ণ ছুরি সংক্ষিপ্ত করুক পাখির কলগীতি
বারুদের গুঁড়োয় পুড়ে যাক শিশুদের ভ্রূপল্লব—
মানুষের খুলির ওপর, ধ্বংসের ওপর
সর্বনাশা হায়েনার ছোবলে ছেঁড়াখোড়া জঞ্জালের ওপর
স্ফুলিঙ্গের জন্ম হোক
ভয় নেই, প্রতিটি গৃহে তলোয়ারের টোকা পড়বে ।
এসো, তীব্র ঘৃণা এবং ক্রোধের নতুন ঘাম পান করো
এই যুদ্ধ তোমার রক্তে আনুক নতুন জোয়ার
মুখ থেকে তোমার নেকাব খুলে পড়ুক,
আজ তোমার মুখ জ্বলন্ত ফুলের মতো
তোমার বোবা অধর বিজয়ের লাল গোলাপের মতো ।
যদিও তোমার টাটকা জখম থেকে ধোঁয়া উঠছে
আর তার স্বাদ নোনতা
তবু প্যালেস্টাইন, প্যালেস্টাইন আমার, তোমার জয় হোক ।
জয় হোক ।
তুমি নিজেই আজ জানাজার কাফন হয়ে যাও
হয়ে যাও রক্তাক্ত ক্রোধ
হয়ে যাও বীভৎস রোষ
তোমার শিরায়-শিরায় রক্তের বদলে ব’য়ে যাক নীল গরল
ক্ষমাহীন ঘৃণা
আর তীব্র জ্বালা
আরব জনগণের কাছ থেকে হত্যাশা তো কবেই পালিয়েছে
আর আমাদের ধৈর্য এখন টগবগ করে ফুটছে
প্রতিটি বদ্ধমুষ্টি ছিঁড়ে ফেলছে সমস্ত বন্ধন
ঘোর আঁধার ভেঙে উদিত হচ্ছে নতুন দিন
সমবেত আকাঙ্ক্ষা দীর্ঘতর হচ্ছে বিধানের বন্দনায়,
নির্মল সতেজ ডানা জীবন্ত আর সবুজ
অপেক্ষার ধনুক অধৈর্য
শরসন্ধানী উড্ডীন ঈগলের হানার ক্ষুধার্ত দাঁত অপেক্ষমাণ
কত আর অপেক্ষার থাকব?
পাথরের সুউচ্চ পিরামিড অগ্নিবাণে অধৈর্য
কোলাহলমুখর বিমানবন্দর যেন ঘাতকের নাসিকার নাসিকার গর্জন
প্যালেস্টাইন, তোমার প্রতিটি গৃহই এখন দূর্গ
তোমার প্রতিটি কম্যান্ডো-সন্তান
স্বাধীনতা পাওয়ার আনন্দাশ্রু ঝ'রে ঝ'রে
প্যালেস্টাইন,
রণক্ষেত্র থেকে বিজয়ী হয়ে ফিরে আসবে
পড়বে তোমার গাল বেয়ে,
তখনই তোমার গগনফাটা উল্লাস ।
আমার মা
আমার মায়ের দেয়া রুটির জন্যে আমি থাকি কাতর অপেক্ষায়
আমার মায়ের কফি
তার স্পর্শ
শৈশব স্মৃতি, আমার ভেতরে ক্রমে মাথা তুলে দাঁড়ায়
দিনের পর দিন, প্রতিদিন
এই জীবনের মূল্য দিতে হবে আমায়
আমার মৃত্যুর কালে,
আমার মায়ের অশ্রুর দামও
যদি আমি কোনদিন ফিরে আসি
আমাকে করে নিও তোমার দৃষ্টিসীমার পর্দা
আমার হাড়গোড় ঢেকে দিও ঘাসের চাদরে
তোমার পদবিক্ষেপের করুণা দিও
আমাদের একসাথে বেঁধে দিও
তোমার চুলের বাঁধন-তলায় ।
তোমার পোশাকের পেছন থেকে খসে আসা এক টুকরো সুতোয় ।
আমিও হতে পারি অমর
অবিনশ্বর
যদি আজ আমি ছুঁতে পারি তোমার হৃদয় গভীর
যদি আমি ফিরে আসি
আমাকে দহনীয় কাঠের মতো আগুনের খাবার করো
তোমার বাড়ির ছাদে কাপড় শুকোবার রঞ্জু করে
তোমার আশির্বাদ বিনা
আমি উঠে দাঁড়াবারও শক্তিহীন
পাসপোর্ট
ছায়ান্ধকারে তারা আমাকে চিনতে পারেনি
আমার পরিচয়ের রং শুষে নিয়েছে ছায়ান্ধকার
আর তাদের কাছে আমার গভীর জখমই হয়ে উঠেছে দর্শনীয়
পর্যটক যারা ছবি তুলে আনন্দ কুড়ান
তারাও আমাকে পারেনি চিনতে
আহ...আমাকে যেও না ছেড়ে
আমার করতলে কোন সূর্য ছিল না
কেননা-গাছেরা আমাকে চিনে নিয়েছিল
আমাকে অমন ফ্যাকাশে চাঁদের মতো ছেড়ে দিওনা
আমার করতল চিনে অনুগামী পাখিরা
উড়ে গিয়েছিল দূর বিমান বন্দরের দুয়ার অবধি,
সকল যবের ক্ষেতে
সমুদয় কারাগারে
শ্বেতপাথরে গড়া সব সমাধি পাথরের কিনারে
কাঁটাতারে ঘেরা সকল সীমান্তে
হাওয়ায় দোলানো রুমালের কাছে
সকল দৃষ্টি
ছিল আমারি সাথে
কিন্তু ওরা সেসব ছেটে ফেলেছে আমার পাসপোর্ট হতে
আমার নাম ও পরিচয় করেছে ছিন্ন-ভিন্ন?
সেই মাটিতেই যাকে আমি নিজ হাতে আদর বুলাই?
আজ মজুর খাটার আর্তনাদ
আকাশ কাঁপিয়ে বলে :
আমার মতো আর কোন উদাহরণ আর ডেকে এনোনা!
হে সাধুপুরুষ, নবী,
গাছেদের কাছে জানতে চেওনা তাদের নাম
উপত্যকাকে শুধায়ে না কে তাদের মা
আমার কপাল জুড়ে নেমে আসে যে আলোর চাদর
আমার হাত বেয়ে নেমে আসা ঝর্ণাধারার মতো নদীর যে জল
আর সকল মানুষের হৃদয়—আমার পরিচয়
অতএব কেড়ে নিতে পারো আমার পাসপোর্ট!
প্রেয়সী
তার চোখ আর বাহুতে আঁকা উল্কি-ফিলিস্তিনি
তার নাম-ফিলিস্তিনি
তার স্বপ্ন আর কষ্টগুলো—ফিলিস্তিনি
হাওয়ায় ওড়ানো তার রুমাল, যুগল চরণ-আর শরীর-ফিলিস্তিনি
তার মুখরতা আর নিরবতা-ফিলিস্তিনি
তার কণ্ঠস্বর-ফিলিস্তিনি
তার জন্ম আর তার মৃত্যু-ফিলিস্তিনি
0 Comments