ফিলিস্তিনিদের পরিচয় সন্ধানে এডওয়ার্ড সাঈদের সঙ্গে সালমান রুশদীর বাক-বিনিময়
সালমান রুশদী : পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে প্রাচ্যের সদর-অন্দরের চিরন্তন দ্বন্দ্ব ও সংঘাত একটি নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে যারা দেখেছিলেন তাদের মধ্যে এডওয়ার্ড সাঈদ একজন বুজুর্গ ব্যক্তি। সাহিত্যভিত্তিক বহু বইয়ের জনক এবং কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরাজি ভাষা ও তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক এডওয়ার্ড সাঈদের এত জগতখ্যাতি যে তিনি বিশ্বের ঘটনাপ্রবাহ এমনভাবে পড়তে (বিশ্লেষণ করতে) পারেন, যেন তা বই পড়ার মতো ৷
তার নতুন বই 'আফটার দ্য লাস্ট স্কাই'-এর আগে লেখা প্রধান ট্রিলজি আমাদের মূল ভাবনার খোরাক। ট্রিলজির প্রথম ভলিউম 'অরিয়েন্টালিজম-এ তিনি ক্ষমতাধর জ্ঞানের ব্যাখ্যা করেছেন। অরিয়েন্টালিজম-এ তিনি দেখিয়েছেন সাম্রাজ্যবাদী শাসনামলে ক্ষমতাঅলা পণ্ডিতরা কিভাবে প্রাচ্যের ভাবমূর্তিকে তুলে ধরেছেন যার শেষ বিচারে সাম্রাজ্যবাদের ভাবাদর্শ প্রতিষ্ঠার সহায়ক। অরিয়েন্টালিজম'র পরের বই 'দ্য কোয়েশ্চেন অব প্যালেস্টাইন', 'দ্য কোয়েশ্চেন অব প্যালেস্টাইন'র মধ্যে সাঈদ পশ্চিমা মতাদর্শ তথা ইসরাইলের ইহুদিবাদী বিশ্বের সঙ্গে আরব ফিলিস্তিনিদের দ্বন্দ্ব- সংঘাতের বয়ান করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় লিখিত হয় কভারিং ইসলাম', সাঈদের মতে, তার উপ-শিরোনাম এই রকম— 'হাউ দ্য মিডিয়া এন্ড এক্সপার্টস ডিটারমাইন হাউ সি দি রেস্ট অব দ্য ওয়ার্ল্ড।' যাতে পশ্চিমা দেশের প্রাচ্য আবিষ্কারের সময় এবং ইসলামী জাগরণের বিষয়ে বিস্তারিত বয়ান করা হয়। 'আফটার দ্য লাস্ট স্কাই' লেখা হয় জ্যঁ মোর নামের এক ফটোগ্রাফারকে কেন্দ্র করে। ইউরোপের শ্রম অভিবাসন সংক্রান্ত, জন বার্জারস্ এর বই- 'এ সেভেনেথ্ ম্যান'-এ জ্যঁ মোরের উল্লেখ আছে। 'আফটার দ্য লাস্ট স্কাই' শিরোনাম নেয়া হয়েছিল ফিলিস্তি নের জাতীয় কবি মাহমুদ দারবিশের বিখ্যাত কবিতা দি আর্থ ইজ ক্লোজিং অন আস' অবলম্বনে- এ কবিতার ভাবার্থ এমন-
'আমাদের দুনিয়া ছোট হয়ে আসছে-দুনিয়া ছুঁড়ে ফেলছে আমাদের তার শেষ সীমানায়আর আমরা কান্দি অবিরামপলায়নপর দুনিয়া আমাদের ক্রমাগত চেপে ধরছেআমার মনে হচ্ছে আমরা এ দুনিয়ায় শস্যদানাতাই যদি মরতে পারি তবে হয়তো আবারবেঁচে উঠতে পারবো।আমার মনে হচ্ছে দুনিয়া আমাদের দাই মাদুনিয়া আমাদের প্রতি দয়াময় হবে -পাহাড়ের ভাঁজের আয়নায় আমরা আমাদের স্বপ্ন খুঁজি -আমাদের মধ্যকার শেষ বিপ্লবীর হাতে যেই সবশ্রেণী শত্রু খতম হবে তাদের মুখগুলো দেখলাম-আমরা তাদের হতভাগা পোলাপানদের জন্যে কাঁদলামযারা আমাদের পোলাপানদের জানালা দিয়েরাস্তায় ছুঁড়ে ফেলেছিল আমরা তাদের মুখেরদিকে চাইলাম। আমাদের সৌভাগ্য নক্ষত্রআয়নায় রবে বন্দী হয়ে-ছুটতে ছুটতে দুনিয়ার শেষ মাথায় যাবার পর আমরা কোথায় যাব?আসমানের সীমানা শেষ হলে পাখিরা উড়বে কোথায়?যেখানে হাওয়ার শেষ আয়ু শেষ হয়ে গেছে—সেখানে শিশু চারাগাছ বেড়ে উঠবে কী করে?লালচে ধোঁয়ার আসমানে আমরা লিখবো আমাদের নামআমরা আমাদের হাড় মাংসের আঘাতে কেটে ফেলবো যত সঙ্গীতের ডানাআমরা এখানে মরবো। দুনিয়ার শেষ মাথায়এসে আমরা মরবো।এদিক-ওদিক ছড়ানো আমাদের তাজারক্ত জন্মদেবে এক অমর অলিভ বৃক্ষ। ''দি আর্থ ইজ ক্লোজিং টু আস'- মাহমুদ দারবিশ
শেষ আসমানের পরে আর কোন আসমান নাই। শেষ সীমানার পরে আর কোন জমি নাই। সাঈদের লেখা 'আফটার দ্য লাস্ট স্কাই'র প্রথম পর্বের নাম তিনি দিয়েছেন ‘স্টেটস্'। ভূমিহীন, দুর্গত, নির্বাসিত ও পরিচয়হীন মানুষের আর্তহাহাকার এ পারার মূল আমল। এ পারায় সাঈদের জিজ্ঞাসা, 'ফিলিস্তিনিরা কোন অর্থে বেঁচে আছে। তিনি বলেছেন, 'আমরা কী বেঁচে আছি? এর পক্ষে আমাদের কোন প্রমাণ আছে? এখন আমরা যে ফিলিস্তিনে আছি তা আগের চেয়ে ভয়াবহ। আমাদের মান-ইজ্জত এখন অনিশ্চিত, আমাদের শৌর্য-বীর্য ধ্বংসোন্মুখ, আমাদের অস্তিত্ব এখন জ্বরাক্রান্ত। আমরা কবে 'নাগরিক' বলে পরিচিত ছিলাম? আমরা কি প্রকৃত নাগরিক হবার উপায় কখনো অনুসরণ করেছি? একে অপরকে, এ প্রশ্নের জবাব আমরা কতটুকু দিয়েছি? আমরা অবিরাম একজন আরেকজনকে পত্র লিখে, শেষ করবার আগে গতানুগতিকভাবে “ফিলিস্তিনি ভালোবাসা', 'ফিলিস্তিনি চুমু' উপহার দিয়ে যাচ্ছি। তাতে কি সত্যিকার ফিলিস্তিনি ভ্রাতৃত্ববোধ বাড়ছে? ইহা কেবলই সৌজন্যমূলক আন্তরিকতার প্রকাশ, ইহা কি লোক দেখানো কোলাকুলি? এই ফিলিস্তিনি শুভেচ্ছা বিনিময়ের আগা-পাশতলায় কি কোন রাজনৈতিক মোটিভেশন নাই, যা বিশেষ একটি জাতি অথবা ব্যক্তির জন্য তাৎপর্যময়?” সাঈদের বইয়ের পরের অধ্যায়, 'মাইনরিটি ইনসাইড এ মাইনরিটি' অর্থাৎ 'সংখ্যালঘুর সংখ্যালঘু' পড়ে আমি তার প্রতি গভীর সহানুভূতি অনুভূব করেছি। সত্যিই তিনি একজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক সংখ্যালঘু প্রতিনিধি। তার এ অনুভূতি এক ধরনের ‘চাইনিজ বাক্স'র সঙ্গে তুলনীয়। সাঈদের ভাষায়, 'সুন্নী মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় গ্রীক বংশোদ্ভূত একটি ছোট খ্রিস্টান প্রোটেস্ট্যান্ট গ্রুপে আমার জন্ম।' এরপর তিনি তার হালের সাহিত্যিক কর্মকাণ্ডে ফিলিস্তিনের সার্বিক অবস্থার বিবরণ দিয়েছেন। তার মধ্যে একটি হল 'ত্রিস্ত্রাম ম্যানডি' যা একজনের গোপন জীবন অবলম্বনে রচিত একটি কমেডি উপন্যাস। এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রকে সাঈদ বলেছেন, ইল- ফেটেড পেসোপটিমিস্ট'। ‘পেসোপটিমিস্ট' বলতে এমন কাউকে বোঝায় যে পৃথিবীর সবকিছু দেখে হতবাক হয়ে বিপদে পড়ে যায়। এর প্রথম অধ্যায়ের এক জায়গায় সাঈদ আগে বলেছেন, 'ইসলাম আবির্ভাবের তথাকথিত অজ্ঞতার যুগে আমাদের আগের জনেরা খেজুর দিয়ে তাদের দেবমূর্তি বানাত এবং যখন প্রয়োজন হতো তখন তারা তা খেয়ে ফেলতো। এখন বলুন দেখি মশাই, অই পরিস্থিতিতে কে বেশি অজ্ঞ? আমি না যারা তাদের দেবতাকে খেয়ে ফেলতো তারা? আপনি হয়তো বলবেন, দেবতা মানুষকে খেয়ে ফেলার আগে মানুষেরই আগে দেবতাদের খেয়ে ফেলা উচিৎ। আমিও জবাবে আপনাকেই সমর্থন করবো এবং বলবো- হ, যেহেতু তাদের দেবতা ভক্ষণযোগ্য খেজুর নির্মিত।
আফটার দ্য লাস্ট স্কাই'তে সাঈদ প্যালেস্টাইনের মানুষের শৈল্পিক অভিজ্ঞতার তাফসীর করেছেন।
এডওয়ার্ডের দৃষ্টিতে, ফিলিস্তিনিদের ভগ্ন অথবা কুসংস্কারাচ্ছন্ন ঐতিহ্য সামাজিক রীতিনীতির ওপর এমনভাবে চেপে বসেছে যা কোনভাবেই সত্যসম্মত সমাজব্যবস্থা হতে পারে না। সুতরাং এখন ফিলিস্তিনিদের এই অস্থির ও শৃঙ্খলাহীন ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই কাজ করে যাওয়া উচিৎ যা তাদের অজ্ঞতাকে শনাক্ত করে। এডওয়ার্ড এ ভাবকেই বইয়ের পরের অংশে বোঝাতে চেয়েছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন, ফিলিস্তিনি আরবদের ইতিহাস ফিলিস্তিনের বাইরের ইতিহাসে পরিণত হচ্ছে। এইভাব চিত্রায়িত হয়েছে একটি ফটোগ্রাফে। অই ফটোগ্রাফে নাজারাতের একটি জায়গার ছবি চিত্রায়িত হয়েছে। অই জায়গা ‘আপার নাজারাত' বলে পরিচিত এবং জায়গাখানি আরব ফিলিস্তি নভূক্ত ছিল না। আরব ফিলিস্তিনকে একটি নব্য আবিষ্কৃত ভূমি হিসেবে দেখা হয়। এবং প্রাচীন ফিলিস্তিনের আভ্যন্তরীণ ঐতিহ্য এখন ছবির মত অকার্যকর হয়ে গেছে। তবু ফিলিস্তিনিরা এখনও আওড়ায়-
'বরং সহজ দূর ছায়াপথ থেকে ভাজা মাছ তুলে খাওয়া-বরং সহজ সাগর চষে ফেলা অথবাকুমিরকে শেখানো কোন সদাচারী নীতিবাক্যতবু একটি ছেড়ে কোথাও যাওয়া অতো সহজ নয়'টুয়েনটি ইম্পসিবলস্- তৌফিক জায়াদ
'আফটার দ্য লাস্ট স্কাই'র দ্বিতীয় অধ্যায় ‘ইনটেরিওরস্'-এ ফিলিস্তিনে বসবাসরত আরবদের সদর-অন্দরের জীবনযাপনের পরিবর্তন দেখানো হয়েছে। এখন পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের মধ্যে হাতে গোনা কিছু লোক ছাড়া বেশির ভাগ ফিলিস্তিনিরা এমনভাবে তাদের ঐতিহ্য ভুলে বসেছে যেন মনে হচ্ছে ইহুদি সংশ্রবে তারা অনেকখানি দূষিত হয়ে গেছে। এখন ফিলিস্তিনের হাল-হকিকত এমন যে সেখানকার কেউ ফিলিস্তিনি সংস্কৃতি আঁকড়ে ধরে থাকলে তাকে এক বিশেষ শ্রদ্ধার চোখে দেখা হয়। ফিলিস্তিনিদের এই অভিজ্ঞতাগুলোই সাঈদ দেখাতে চেয়েছেন। একবার এক মজার ঘটনা ঘটেছিল। এডওয়ার্ডের কাছে এক মুসাফির একটা পত্র নিয়ে আসেন। পত্রদাতার দাবি- তিনি কারাত বিশেষজ্ঞ হয়ে ফিলিস্তিনি পরিচয়কে মহিমান্বিত করেছেন। 'অই পত্রে কী ছিল?'-এর জবাবে এডওয়ার্ড বলেছেন, ‘প্রথমত লোকটি জানিয়েছেন, তিনি ফিলিস্তিনের জন্মগত নাগরিক— এখন থাকেন আমাদের আদি নিবাস জেরুজালেমে। তিনি আমার নাম লিখেছেন ইংরাজিতে। পুরাপত্রে কারাতে তার দক্ষতার কথা এমনভাবে বারবার বলেছেন যেন 'কারাতে দক্ষতাই ফিলিস্তি নিদের সর্বোচ্চ সাফল্য। কারাত মূলত আত্মোন্নয়ন নয় বরং তা কোন বিষয়ের রিপিটেশনের প্রতীক। এরপর সাঈদ ফিলিস্তিনিদের চরিত্র বোঝাতে কয়েকটি পুনরাবৃত্তি ধর্মী চরিত্রকে উদাহরণ স্বরূপ উপস্থাপন করেছেন। বইয়ে তৃতীয় অধ্যায় 'ইমার্জেন্সি' ও চতুর্থ অধ্যায় 'পাস্ট এ্যান্ড ফিউচার'-এ সাঈদের মূল কথা ফিলিস্তিনি কারা এবং ফিলিস্তিনিদের কেমন হওয়া উচিৎ। এখানে আরেক শক্তিকে দেখানো হয়েছে যার দিকে ফিলিস্তিনিরা আলবৎ ঝুকে পড়েছে। তা হল অন্য ভাষার ওপর নির্ভরশীলতা বেড়ে যাওয়া। এমনকি তাদের নামও প্রাচীন হিব্রু ভাষায় বদলানো হচ্ছে। পরিচয়ের মূলে যাবার জন্যে তারা প্রাচীন আরব ইতিহাসে ফিরে যাচ্ছে; তাদের পরিচয়ের আদর্শমডেল হিসেবে তারা ইয়াসির আরাফাত নয়, আবু ওমরকে বেছে নিচ্ছে। বিভিন্ন কারণে নামের অর্থও পাল্টে যাচ্ছে। লেবাননের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরের নাম 'ঈন এল হিলবি'। এই 'হিলবি' বানান লেখা হয় আরবী 'হা' অর্থাৎ 'এইচ' দিয়ে কিন্তু বর্তমানে প্রাচীন হিব্রু বানানরীতি অনুসরণে তার নাম হয়েছে ‘ঈন এল খিলবি'। 'ঈন এল খিলবি' মানে 'মধুর বসন্ত' আর বদলানো নামের অর্থ দাঁড়ায় 'ফাঁকা জায়গার বসন্ত'। সাঈদ এক জায়গায় লিখেছেন, 'আমিও ভেবে দেখেছি ইসরাইলিরা শূন্য বসন্ত দিয়ে ফিলিস্তিনিদের ক্যাম্প শূন্য করে ফেলেছে।' এ বইয়ে তিনি ইহুদিবাদীতার বিষয়েও কথা বলেছেন। তার আগের বই 'দি কোয়েশ্চেন অব প্যালেস্টাইন' সে বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। 'সেমিটিজম' বা ফিনিশীয় আরব জাতীয়তাবাদ থেকে বিচ্ছিন্ন ইহুদিবাদীতার যে কোন ধরনের সমালোচনা করার পেছনে যে জটিলতা তা আগে আমাদের 'নোট' করা দরকার। ঐতিহাসিক ধারায় জিওনিজম বা ইহুদিবাদীতাকে আমাদের বুঝতে হবে। জিওনিজমেরও রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস যা আরব জাতীয়তাবাদ থেকে বিচ্ছিন্ন নয় ৷
বইয়ের একটি জায়গায় তিনি বলেছেন, পশ্চিমা দেশের মানুষ অবরুদ্ধ ভূমি বলতে প্রাথমিক অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের আবাসস্থলকেই বোঝে। কিন্তু সাঈদ অবরুদ্ধভূমিকে এমন একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আবাসস্থল বলে অভিহিত করেছেন যেখানে সম্ভাবনাময় উচ্চমার্গের দর্শন চিন্তা করা যায়। ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে, তার বক্তব্য হল এটা অবরুদ্ধ ভূমি কিন্তু মধ্যবিত্ত চেতনার ভূমি নয়- বরং এখানে বহু উচ্চ ভাবনার বিষয় রয়েছে। সবশেষে সাঈদ ক’গোছা প্রশ্ন করেছেন যা ফিলিস্তিনের মূল অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
'ভূমিহীনদের কী হবে? এ দুনিয়ায় তুমি কোথায় দাঁড়াবে? তুমি কী ত্যাগ করবে?' তার একটা অনুচ্ছেদ আমার খুব দামী মনে হয়েছে- আমি নিজেও বিষয়টি নিয়ে অনেক ভেবেছি। তিনি লিখেছেন, 'আমাদের ক্ষেত্রে সত্য হল- আমরা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গা, এক সংস্কৃতি থেকে অন্য সংস্কৃতির দিকে দৌড়াতে চাই। আমরা যাযাবরের মত, এবং সম্ভবত আমরা শংকর জাতিভূক্ত মানুষ ছাড়া নিজেদের ভাবতে পারি নাই। অবরুদ্ধতাকে আমাদের এই প্রবণতাই আরো বেশি দীর্ঘায়িত করে রেখেছে। এছাড়া নিজেদের সংস্কৃতিকে ছুঁড়ে ফেলে মুক্তির লড়াইয়ে শুধু সহিংসতাকেই বিদ্রোহের ভাষা মনে করার কারণেও সাঈদ ফিলিস্তিনিদের সমালোচনা করেছেন।
নিউইয়র্কে থাকাকালীন প্রফেসর সাঈদকে বহুবার 'জিউস ডিফেন্স লীগ'র কর্মীরা নানা ধরনের হুমকি দিয়েছে। নিউইয়র্কের মত জায়গায় নিজেকে ফিলিস্তিনি বলে পরিচয় দেবার জন্যই তাকে আমাদের শুভেচ্ছা জানানো দরকার, কারণ নিউইয়র্কে ফিলিস্তিনি পরিচয়ে বাস করা কপালের জন্য সুখবর নয়।
একবার আমার এক বোনকে ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকাকালীন তার দোস্তরা জিজ্ঞেস করেছিল, 'তুমি কোত্থেকে এসেছ?' যখন সে বললো, পাকিস্তান; তখন তাদের বেশিরভাগই এমন ভাব করলো যেন 'পাকিস্তান' সম্পর্কে তাদের কোন ধারণাই নাই। একজন আমেরিকান তো বলেই ফেললো 'ও, প্যাকেস্টাইন!'— [যেন সে চিনে ফেলেছে] এবং কিছুক্ষণের মধ্যে সে তার কয়েকজন ইহুদি দোস্তর গল্প শুরু করে দিল। নিজেদের দুনিয়ার বাইরে আমেরিকানদের এহেন মূর্খতার কথা তো আমরা ভাবতেই পারি না। আমি যখন ১৯৮৬ সালে নিউইয়র্কের পেন কংগ্রেসে ছিলাম, তখন সিনথিয়া ওজিক নামের এক লেখিকা অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর ক্রিসকিকে এন্টি-সিমেটি বলে তার বিরুদ্ধে নিন্দা চালিয়েছিল। ক্রিসকি নিজে ছিলেন একজন ইহুদি এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে নির্বাসিত হাজার হাজার ইহুদি শরণার্থীদের অস্ট্রিয়ায় থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। তারপরও তাকে এন্টি-সিমেটি বলা হয়েছিল। তার কারণ ছিল একটাই, তিনি একবার ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে বৈঠক এবং আলাপ আলোচনা করেছিলেন। আশংকার ব্যাপার হল- সিনথিয়ার এই অভিযোগে পেন কংগ্রেসে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয় ৷ কংগ্রেসে সবাই একের পর এক ফিলিস্তিনিদের দোষারোপ করে ভাষণদান করলেন। আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কেউ কোন কথা বলছেন না এবং আমি বলবো বলে মানসিকভাবে তৈরি হচ্ছিলাম। এমন সময় পিয়েরে ট্রডিউ সবার মধ্য থেকে উঠে আসলেন এবং চমৎকার ভাষায় ফিলিস্তিনের পক্ষে তার ভাষণদান শুরু করলেন। কিন্তু পিয়েরের মত ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কথা বলার ঘটনা নিউইয়র্কে কদাচিৎ ঘটে। এটা একেবারেই ব্যতিক্রম ঘটনা। এডওয়ার্ড, অই সম্মেলনে আপনি উপস্থিত ছিলেন। যে পরিস্থিতি তা কি ভালো না খারাপের দিকে গড়াচ্ছে? এ জাতীয় পরিস্থিতিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
এডওয়ার্ড সাঈদ : ভালো কথা। আমার মনে হয় পরিস্থিতি খুব খারাপের দিকেই গড়াচ্ছে। প্রথমত, নিউইয়র্কে বেড়ে ওঠা আমেরিকানদের ফিলিস্তিনিদের সম্পর্কে কোন চাক্ষুস ধারণা নাই। তারা টেলিভিশনে ফিলিস্তিনিদের যেভাবে দেখে সেভাবেই তাদের সম্পর্কে ধারণা নেয়। মার্কিন টেলিভিশনে তাদের ‘বোমাবাজ' 'খুনি' বলে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় 'সন্ত্রাসী' বলে আর তারাও ফিলিস্তিনিদের তাইভাবে। এ কারণেই ফিলিস্তিনিদের সম্পর্কে তাদের কিছু ভিত্তিহীন কু-ধারণা তৈরি হয়েছে। ফলে ফিলিস্তি নিদের পক্ষে কথা বলার কারণে আমার সম্পর্কেও তাদের ধারণা ভালো। তবে তারা যখন আমার সঙ্গে কথা বলে তখন তারা বলে ফেলে, 'তোমাকে দেখে যত খারাপ মনে হয় হয়তো তুমি তত খারাপ নও।' আমি ইংরাজিতে কথা বলি এবং স্বাভাবিক কারণেই ভালভাবেই তা বলতে পারি। ফলে একটা বড় ধরনের জটিলতা সৃষ্টি করে। আমার কথা বলার বাইরে যে বইপত্র লিখেছি, তা যখন পাঠক পড়ে তখন তারা একজন ‘ইংরাজি' সাহিত্যের অধ্যাপকের লেখা হিসেবেই পড়ে। কিন্তু আপনি বুঝতে পারবেন ১৯৮২ সালের পরে আমরা নতুন কিছু সমস্যা, নতুন কিছু সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লাম। অতীত ঐতিহ্যের সঙ্গে তখন আমাদের ভাঙন ধরলো যখন বৈরুত, আমাদের বৈরুত ভেঙে গেল। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ইহুদি ও ইসরাইল সমর্থক এবং আমার মত লোক উভয়ের কাছেই বৈরুত ভেঙে যাওয়া একটি যুগের অবসান বলে চিহ্নিত। আপনি ভাবছেন যে এখানে নিরাপদে সুস্থ এবং স্বাভাবিক জীবন-যাপন করছেন। কিন্তু ভেবে দেখুন এখানেও কিছু নানা ধাচের হুমকির সম্মুখীন হতে হচ্ছে আপনাকেও। আপনি যে এখানে বহিরাগত তা কোন না কোনভাবে ঠিকই এখানকার আশপাশ আপনাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে।
সালমান রুশদী : ফিলিস্তিনি ইস্যুতে ভাষণ রাখতে বা কিছু লিখতে এখানে কোন প্রতিবন্ধকতা টের পাচ্ছেন? মানে আপনার কোন লেখা বা ভাষণে অনিচ্ছাকৃত পরিবর্তন আনতে হচ্ছে?
এডওয়ার্ড সাঈদ : একটু দীর্ঘ জবাব দিতে হবে। আপনি জানেন ফিলিস্তিন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রে দুই ধরনের গ্রুপ তৈরি হয়েছে। একদল বামপন্থী আরেকদল ডানপন্থী। নোয়াম চমস্কি, আলেকজান্দার কোকবার্নের মত কিছু লেখক এখানে উঠে দাঁড়াতে চাচ্ছেন। কিন্তু এখানকার বেশিরভাগ লোকই ভাবে বিরুদ্ধ স্রোতের কিছু না করাই ভাল। তারপরও এখানে কিছু জায়গা আছে যেখানে খুব কম সংখ্যক শ্রোতা-পাঠক আপনি পাবেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, ফিলিস্তিনিদের পক্ষে যাবে এমন কিছু বললে বা লিখলে আপনাকে 'টোকেনাইজ' করা হবে। আপনাকে চিহ্নিত করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের কোথাও অপহরণ, বোমবাজি ইত্যাদি ঘটনা ঘটলে আমাকে বিভিন্ন মিডিয়া থেকে ফোন করা হয় এবং একা এসে সে বিষয়ে মন্তব্য করার জন্য বলা হয়। মিডিয়াগুলোও আমাকে সন্ত্রাসীদের প্রতিনিধি মনে করে- এটা ভাবতেই আমার মধ্যে এক আশ্চর্য অনুভূতি কাজ করে। দুর্ঘটনা ঘটলে তারা ধরেই নেয় যে এটা ফিলিস্তিন সমর্থিত ‘সন্ত্রাসী'দের কাজ। আপনি কোন অনুষ্ঠানে, কোন বৈঠকে যাবেন সেখানেও আপনাকে ‘সন্ত্রাসীদের কূটনৈতিক হিসেবে দেখা হবে। আমার মনে পড়ছে, একবার ইসরাইলি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে একটি টেলিভিশন বিতর্কে যোগ দেবার জন্য আমাকে ডাকা হল। যদিও বিতর্কের বিষয় ছিল আমার যদ্দুর মনে পড়ছে 'এ্যাচিল লাউরোর' ঘটনা সংক্রান্ত। কিন্তু ভদ্রলোক শেষ পর্যন্ত আমার সঙ্গে বিতর্কে যোগ দিতে রাজি হলেন এক শর্তে- তা হল তিনি একই রুমে আমার সঙ্গে কথা তো বলবেনই না। আলোচনা ও বিতর্ক যদি এক বিল্ডিংয়ের মধ্যে হয় তাহলেও তিনি রাজি নন। সরাসরি প্রচারিত অই অনুষ্ঠানের উপস্থাপক তখন দর্শকদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা দিলেন, অধ্যাপক সাঈদ এবং রাষ্ট্রদূত নেতানিয়াহু দু'জনই কথা বলতে অস্বীকার করেছেন। ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত তার সঙ্গে কথা বলবেন না এবং মিস্টার সাঈদ...' কিন্তু আমি তার কথার মধ্যেই বলে উঠলাম 'না-না, আমি কথা বলতে চাই কিন্তু তিনি চান নাই।' মর্ডারেটর তখন বললেন, 'ঠিক আছে আমিই সমাধান করছি; মিস্টার এ্যাম্বাসেডর, আপনি কেন প্রফেসর সাঈদের সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছেন না?' উত্তরে তিনি বললেন, 'কারণ উনি আমাকে হত্যা করতে চান।' মর্ডারেটর তখন একটুও অবাক না হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ও, তাই? তাহলে এ বিষয়ে আপনি দর্শকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।' তখন এ্যাম্বাসেডর মিস্টার নেতানিয়াহু বেশ রসিয়ে রসিয়ে কইতে লাগলেন, কীভাবে ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলিদের হত্যা করার প্ল্যান প্রোগ্রাম করছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। মূল প্রসঙ্গ ফেলে তখন যে আক্রমণাত্মক ভাষণ তিনি দিলেন তাতে 'টোটালি একটি এ্যাবসার্ড সিচুয়েশন' তৈরি হল।
সালমান রুশদী : আপনি মাঝে মাঝে বলেন যে ইহাকে আপনি ফিলিস্তিনি বিদ্বেষ বলতে পছন্দ করেন না। কিন্তু কেন?
এডওয়ার্ড সাঈদ : আমার মনে হয় ইহা অন্য এক ধারণা থেকে জন্ম নিয়েছে। যেমন, জেরুজালেম থেকে একবার এক লোক আমার কাছে একটা পত্র পাঠিয়েছিলেন। তাতে তিনি বলেছিলেন, 'আমরা আরব দুনিয়ার ইহুদি।' আমাদের ক্ষেত্রে কিন্তু ভিন্ন ধরনের চিন্তা-ভাবনা কাজ করে। আমরা ভাবতে পারি না, আমরা আরব দুনিয়ার মুসলমান বা আমরা আরব দুনিয়ার খ্রিস্টান।
হয়তো ইসরাইলিদের অই চিন্তা-ভাবনা আরও বেশি ভালো। ফিলিস্তিনিদের প্রতি তা হয়তো তাদের বিদ্বেষ নয়; হয়তো ইসরাইল কেন্দ্রীক জাতীয়তাবোধ তাদের ফিলিস্তি নিদের সম্পর্কে অন্ধভীতি তৈরি করেছে।
সালমান রুশদী : তাহলে এ ক্ষেত্রে আপনার দর্শন কী? কোন অর্থে ফিলিস্তিনি জাতি টিকে আছে?
এডওয়ার্ড সাঈদ : প্রথমত স্মৃতিচারণ অর্থে। আপনি ফিলিস্তিনের অসংখ্য লোক পাবেন যারা তাদের প্রাচীন ইতিহাসের দিকে তাকাতে ভালোবাসে এবং ঐতিহাসিক আভিজাত্যের বড়াই করে। অনেক আধুনিক প্রজন্মের নবীন ফিলিস্তিনি পণ্ডিতরা ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয় আবিষ্কার করছে যেসব বিষয় ফিলিস্তি নকে আরব বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে।
দ্বিতীয়ত, ফিলিস্তিনিরা রাজনৈতিক খবরা-খবরের দিক থেকে বহুত দূরে অবস্থান করছে। একটা খেয়াল করার মত ব্যাপার হল কিছু কিছু ফিলিস্তিনি ইয়ংস্টাউন অথবা ওহিওতে এসে বসবাস করতে চায়। কিন্তু যদি জিজ্ঞেস করা হয় ইহা কেমন জায়গা, বা সুনির্দিষ্ট ভৌগলিক অবস্থান কোথায় তাহলে তারা বলতে পারবে না। হয়তো তারা বলবে, ইয়ংস্টাউন অথবা ওহিও কোথায় তা জানা নাই। কিন্তু বৈরুতের সর্বশেষ ঘটনার খোঁজ ঠিকই রাখে। পপুলার ফ্রন্ট অথবা আল ফাতাহ্ মুভমেন্টের কোন চুক্তিভঙ্গ হল তার খবর তারা রাখছে- কিন্তু ইয়ংস্টাউনে বসবাসরত এমন ফিলিস্তি নিও পাবেন যে সেখানকার মেয়রের নাম পর্যন্ত জানে না অথবা বলতে পারে না সে কিভাবে নির্বাচিত হল। বোধ হয় তারা ধরে নেয় কোন একজনকে মেয়রের পদে ধরে এনে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
শেষ কথা, জ্যঁ মোরের ছবিতে দেখা যায় ফিলিস্তিনিরা কাঁধে ব্যাগ নিয়ে অনবরত এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ভ্রমণ করছে। এখানে ফিলিস্তিনিদের যাযাবরের মত চিত্রায়িত করা হয়েছে। এসব আমাদের নাগরিক বোধকে স্পর্শ করে। আমাদের পরিচয় বোধকে জাগ্রত করে এবং আমরা চেঁচিয়ে বলতে পারি সে অনুভূতি এখনও মুছে যায় নাই। যেন ফিলিস্তিনিরা তাদের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে। আশা- নিরাশার এক মধ্যবর্তী জায়গায় বাস করছে তারা।
সালমান রুশদী : বিষয়টি আরও করুণভাবে উপস্থাপনের জন্য আপনি সদ্য মরা ছেলের মায়ের গল্প বলেছেন। বিয়ের পর পরই এক ছেলে মারা গেল। তার বিধবা নববধূ যখন কাঁদছে তখন তার শাশুড়ি বলছেন, 'আল্লাকে অসংখ্য ধন্যবাদ যে সে এখন মরলো, নয়তো পরিস্থিতি ঢের খারাপ হতো।' সদ্য বিধবা মেয়ে তখন তার শাশুড়িকে ধমক দিয়ে বললো, “এ আপনি কি বলছেন, আমার স্বামী এখন না মরলে পরিস্থিতি কীভাবে ঢের খারাপ হতো?'
উত্তরে শাশুড়ি বললেন, 'আমার ছেলে যখন বড় হয়ে যেত তখন তুমি পরপুরুষের হাত ধরে চলে যেতে, সেই শোকেই সে মারা যেত। তার চে' এখন মরাই তার জন্য ভালো হয়েছে।
এডওয়ার্ড সাঈদ : আপনি নেগেটিভ দিকগুলো তালাশ করতে বরাবরই ওস্তাদ! সালমান রুশদী : ফিলিস্তিনিদের পরিচয়ের ব্যাপারে তারা আশাবাদী না নৈরাশ্যবাদী তা ঠাহর করা ভারি মুশকিল। সে জন্য একে আমরা নৈরাশ্যপূর্ণ আশাবাদ' বলি। আপনি কি বলবেন ফিলিস্তিন পরিচয় নিয়ে দাঁড়াবার মত তাদের নিজস্ব কোন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে?
এডওয়ার্ড সাঈদ : একটা ঘটনা বলি; তাহলে আপনার কাছে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। আমার খুব ঘনিষ্ট এক দোস্ত একদিন আমার বাসায় এলো এবং সেদিন রাতে আমার বাসায় থাকলো। সকাল বেলায় আমরা নাস্তা খেতে বসলাম। নাস্তার মেন্যুতে ছিল দুধের সর দিয়ে বানানো বিশেষ একটা খাবার। আরব অঞ্চলে এই খাবারকে বলে 'জা'আতার'। ফিলিস্তিন, লেবানন, সিরিয়াসহ আরব দুনিয়ার সবখানে অই খাবার একটি পরিচিত মেন্যু। কিন্তু আমার দোস্ত বললো, 'তোমার বাসায় যে ফিলিস্তিন সংস্কৃতি চর্চা হয় তা বোঝা যাচ্ছে। নাস্তার টেবিলে 'জা'আতার' দেখে।' তারপর কবির মত সে বোঝাচ্ছিল লেবানন বা সিরিয়ার সঙ্গে ফিলিস্তিনের রন্ধন প্রক্রিয়ার কী কী সূক্ষ্ম ফারাক আছে। এবং অন্যান্য অঞ্চলের 'জা'আতার'র সঙ্গে ফিলিস্তিনি 'জা’আতার'র কী কী তফাৎ রয়েছে। এবং অই দিন আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে ফিলিস্তিনের রন্ধন প্রক্রিয়ার মধ্যেও সুস্পষ্ট স্বাতন্ত্র্য রয়েছে।
সালমান রুশদী : তাহলে একজন ফিলিস্তিনি যে কাজ করে সেটাই 'ফিলিস্তিনি' কাজ হয়ে ওঠে। এটা বোঝাতে চাচ্ছেন কী?
এডওয়ার্ড সাঈদ : হাঁ ঠিক তাই। এমনকি তাদের ভাষার মধ্যেও বিশেষ বিশেষ কোড রয়েছে যা আপনাকে বুঝতে সহায়তা করবে যে অমুক লোক কোন ক্যাম্প অথবা গ্রুপ থেকে এসেছে। কথার উচ্চারণ, শব্দের প্রয়োগ শুনেই বুঝতে পারবেন সেকি পপুলার ফ্রন্ট না ফাতাহ্ গ্রুপের সমর্থক। এছাড়াও তাদের ভাষার মধ্যে আঞ্চলিক টান রয়েছে। সবচে' তাজ্জব ব্যাপার, যে শিশুর জন্ম লেবাননের শরণার্থী শিবিরে এবং যে জীবনে কোনদিন ফিলিস্তিনে যায় নাই তার সেই লেবাননীয় আরবী উচ্চারণের মধ্যেও হাইফা, জাফা, গাজার আঞ্চলিক টান রয়েছে।
সালমান রুশদী : প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে একটু অন্যদিকে যাই। প্রসঙ্গটি হল ফিলিস্তি নিদের চরিত্রের মাত্রাতিরিক্ত তার ব্যাপারে। আপনি নিজেও বলে থাকেন যে কোথাও যেতে আপনার মাত্রাতিরিক্ত বড় লাগেজ সঙ্গে নিতে হয়। কিন্তু তার চেয়ে মাত্রাতিরিক্ততার উদাহরণ হিসেবে আমার মনে পড়ছে; ইসরাইল রেডিওতে প্রচারিত এক ফিলিস্তিনি গেরিলার বক্তব্যের কথা। ইসরাইলি সৈন্যদের হাতে ধরা পড়ার পর রেডিওতে এক গেরিলার সঙ্গে ইসরাইলি অফিসারের যে কথোপকথন হয় তা প্রচার করা হয়। আসলে ইহা ছিল একটা অভিনীত সাক্ষাৎকার। ওই সাক্ষাৎকারে দেখা গেল গেরিলা নিজেকে ভয়ঙ্কর ও জঘন্য মানুষ হিসেবে অভিহিত করলো। একই সঙ্গে সে তার সন্ত্রাসী তৎপরতার জন্য সাংঘাতিক অনুশোচনা বোধ করছে বলেও জানালো। এডওয়ার্ড সাঈদ : হ্যাঁ, আমার মনে পড়ছে। সেই ১৯৮২ সালের ঘটনা। ইসরাইল কর্তৃপক্ষ প্রায়ই ফিলিস্তিনিদের বিভ্রান্ত করার জন্য সাজানো কিছু সাক্ষাৎকারভিত্তিক অনুষ্ঠান টেলিভিশনে প্রচার করত। কিন্তু মজার কথা হল ফিলিস্তিনিরা তাতে বিভ্রান্ত তো হয়ই নাই বরং সন্ধ্যায় বিনোদনের জন্য তারা নিজেরা অই ভিডিও টেপ চালিয়ে মজা করতো। সেরকম একটা সাক্ষাৎকারের নমুনা দেই :
ইসরাইলি উপস্থাপক : আপনার নাম?
আটককৃত ফিলিস্তিনি : আহমেদ আব্দুল হামিদ আবু সাঈদ।
ইসরাইলি : আপনার মুভমেন্টের নাম?
ফিলিস্তিনি : আমার মুভমেন্টের নাম আবু লেল। [আবু লেল মানে 'অন্ধকারে পিতা' যা এক আতংক সৃষ্টিকারী নাম। ]
ইসরাইলি : এখন বলুন আপনার সন্ত্রাসী সংগঠনের নাম কী?
ফিলিস্তিনি : আমার সন্ত্রাসী সংগঠনের নাম 'পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন'। ইসরাইলি : কখন আপনি এই সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে জড়ালেন?
ফিলিস্তিনি : যখনই প্রথম আমি সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে সচেতন হলাম ৷
ইসরাইলি : দক্ষিণ লেবাননে আপনার মিশন কী ছিল?
ফিলিস্তিনি : আমার মিশন ছিল সন্ত্রাস সৃষ্টি করা। আমরা স্রেফ গ্রামে ঢুকতাম এবং এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করতাম। শিশু ও নারীসহ সবাইকেই আমরা চরম ভীতির মধ্যে রাখার চেষ্টা করতাম; সোজা কথায় সেখানে আমরা যা করতাম তা সন্ত্রাসী তৎপরতা। ইসরাইলি : আপনি কি কোন আদর্শগত কারণে সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জড়িয়েছিলেন না স্রেফ টাকার জন্য?
ফিলিস্তিনি : না, স্রেফ টাকার জন্য। টাকা ছাড়া এ ব্যাপারে কি আদর্শ থাকতে পারে ?
আসলেই কী কোন আদর্শ আছে? আমরা বহু আগেই আমাদের আদর্শ বেঁচে দিয়েছি। ইসরাইলি : এই সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো কোথায় টাকা পায়?
ফিলিস্তিনি : সন্ত্রাস ছড়ালে যাদের স্বার্থ উদ্ধার হয় তারা দেয়।
ইসরাইলি : সন্ত্রাসী ইয়াসির আরাফাত সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কি?
ফিলিস্তিনি : আমি শপথ করে বলতে পারি আরাফাত হচ্ছে সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী সে আদর্শ বিকিয়ে আমাদের বেঁচে দিয়েছে। আসলে তার পুরো জীবনটাই সন্ত্রাসে ভরা। [একজন ফিলিস্তিনের কাছে মনে হতে পারে সে যা করছে তা আদর্শের জন্য করছে। কিন্তু আসলে তা নয়। সে আসলে টাকার জন্যই তার আদর্শের বুলি আওড়ায়।]
ইসরাইলি : ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনী তাদের সঙ্গে কী রকম আচরণ করে বলে আপনি মনে করেন?
ফিলিস্তিনি : সততার সাথেই বলছি। ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনীকে আমাদের ধন্যবাদ জানানো দরকার কারণ তারা আমাদের সঙ্গে যথার্থ সদয় আচরণ করে। ইসরাইলি : যারা আইডিএফ [ইসরাইলি ডিফেন্স ফোর্স] এর ওপর সন্ত্রাসী হামলা চালাচ্ছে সেই সন্ত্রাসীদের প্রতি আপনার কোন উপদেশ বা পরামর্শ আছে? ফিলিস্তিনি : তাদের প্রতি আমার উপদেশ হল আইডিএফ এর কাছে এখনই তাদের অস্ত্র সমর্পণ করা দরকার। যা তাদের জন্য সব দিক থেকে মঙ্গলজনক হবে। ইসরাইলি : অবশেষে, আপনি কি আপনার পরিবারের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন? ফিলিস্তিনি : আমি আমার পরিবারকে আশ্বস্ত করতে চাই আমি ভাল আছি এবং সুস্থ আছি। আমি ইসরাইলি কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাই কারণ তারা আমার শত্রুপক্ষ হওয়া সত্ত্বেও আমাকে এ কথাগুলো বলার সুযোগ দিয়েছেন।
ইসরাইল : মানে আপনি এই টেলিভিশন চ্যানেল অর্থাৎ 'ভয়েস অব ইসরাইল'র কথা বলছেন?
ফিলিস্তিনি : হ্যাঁ হ্যাঁ স্যার। ধন্যবাদ স্যার! অসংখ্য ধন্যবাদ স্যার! সালমান রুশদী : এভাবে প্রচার করত?
এডওয়ার্ড সাঈদ : একদম এভাবে। বৈরুত থেকে অইরকম বানানো ভিডিও চিত্র তারা গেরিলাদের মানসিক শক্তি ভেঙে দেওবার জন্য প্রচার করত। ভেবে দেখুন কী হাস্যকর, মজার কাহানী বটে?
সালমান রুশদী : এছাড়া আপনি একটা ফ্যাশন ম্যাগাজিনের ফটো আর্টিকেল সম্পর্কে বলেছিলেন। অই আর্টিকেলের শিরোনাম ছিল 'টেরোরিস্ট কালচার'। সে আর্টিকেলে দাবি করা হয় যে ফিলিস্তিনিরা প্রকৃতপক্ষে ফিলিস্তিনি নয়; তারা আদতে আরব সংস্কৃতি ও লেবাস ছিনিয়ে নিয়ে নিজেরা ফিলিস্তিনি বলে দাবি করছে। এডওয়ার্ড সাঈদ : আমরা তো সব সময়ই তাই করি! [ব্যাঙ্গাত্মক হাসি] সালমান রুশদী : অই আর্টিকেলে আরো বলা হয়েছিল, ফিলিস্তিনিরা আরবের সাধারণ মানুষ নয় বরং উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের পোষাকের অনুকরণ করে। অই আর্টিকেলের মার্কিন লেখিকা শ্যারন চার্চারের প্রতি নির্দেশ করে আপনি লিখেছিলেন, ‘গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে অই মহিলা একটি ভাড়াটে ফ্যাশন ম্যাগাজিনের একজন ভাড়াটে লেখিকা।' এরপর আপনি বলেছেন শ্যারন চার্চারের মিথ্যা মন্তব্য ভুল প্রতিপন্ন করতে ফিলিস্তিনের গোড়ার ইতিহাস পর্যালোচনা করতে হবে। তাহলেই বোঝানো যাবে ফিলিস্তিনিরা যে পোশাক পরে তা কতখানি মৌলিক কিন্তু ফিলিস্তিনিদের মৌলিকত্ব নিয়ে বার বার অভিযোগ তোলার পর যদি বার বার অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করতে যান তাহলে ব্যাপারটাকে ক্লান্তিকর মনে হবে না? এডওয়ার্ড সাঈদ : হ্যাঁ তা হবে। কিন্তু তারপরও আমি তা করবো। 'মিডনাইট'স চিলড্রেন' উপন্যাসের আদলে ইহা সবকিছু সৃষ্টির প্রথম মুহূর্ত অনুসন্ধানের মতো। আপনি 'মিডনাইট' সম্পর্কে পরিচিত সে কারণে আপনি অতীতে ফিরে যাবার কথা বুঝতে পারবেন। অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করা খুব কঠিন। কারণ দৈনিক পত্ৰ- পত্রিকাগুলো তাদের ঐতিহ্য সম্পর্কে এত ভুল তথ্য দিয়ে রেখেছে যে অতীতের সঠিক তথ্য পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
সালমান রুশদী : কিন্তু এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তো দীর্ঘদিন থেকেই বলা হচ্ছে। এডওয়ার্ড সাঈদ : আপনি ঠিক বলেছেন। কিন্তু ইসরাইলিরা শক্ত মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে কব্জা করে রাখায় তা হচ্ছে না।
সালমান রুশদী : আপনি ফিলিস্তিনিদের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে সমালোচনা করেছেন। ফিলিস্তিনিদের মিডিয়া অপ্রতিষ্ঠিত হওয়ায় আপনি ফিলিস্তিনিদের সমালোচনা করেছেন।
এডওয়ার্ড সাঈদ : ঠিক তাই। একটা আজব ব্যাপার হল ১৯৪৮ সালের পর থেকে যত ফিলিস্তিনি লেখকের লেখা প্রকাশিত হয়েছে তার বেশির ভাগের মধ্যেই দেখা যায় তারা যেন আশঙ্কা করছেন যে তারা তাদের দেশ হারিয়ে ফেলছেন। তাদের লেখার মধ্যে ফিলিস্তিনের শহরগুলোর এমনভাবে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে যেন ফিলিস্তি নি এক জেলখানা যেখানে এখনই কোন কয়েদিকে জেরা করতে হবে। ফিলিস্তিনিরা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ার পর লক্ষ্যণীয়ভাবে ফিলিস্তিনি সাহিত্যে আকাল পড়ে। অবশ্য পঞ্চাশের দশক থেকে ষাটের দশকে আবার তা জেগে উঠতে শুরু করে। কিন্তু তাদের এই সাফল্যের মধ্যে এমন একটি বই আপনি পাবেন না যাতে ফিলিস্তিনির সঠিক ইতিহাস বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে। অথচ তারা অনেক সময় পেয়েছেন- কিন্তু তারা শুধু তাদের লেখায় প্রতিপক্ষের সমালোচনাই করেছেন। কাজের কাজ কিছুই করেন নাই। এ সুযোগে ইসরাইলিরা তাদের সব তল্পীতল্পা সরিয়ে ফেলেছে। ১৯৮২ সালে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ প্যালেস্টাইন রিসার্চ সেন্টারের সব তল্পীতল্লা তেল আবিবে নিয়ে যায়, যে ঘটনা আমাকে দারুণভাবে মর্মাহত করেছিল। সালমান রুশদী : সাহিত্যের প্রসঙ্গে আপনি বলেছেন ফিলিস্তিনিরা বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়ার কারণে ফিলিস্তিনি লেখকদের লেখায় তাদের জন্মভূমির বিস্তারিত বিবরণ ও ইতিহাস অনুপস্থিত। ইতিহাস লেখার ক্ষেত্রে তা কি খুব বড় বাধা? এডওয়ার্ড সাঈদ : হ্যাঁ। ফিলিস্তিনের বিভিন্ন বিষয় রয়েছে যেগুলোকে ইতিহাসের একটি কোষে সংকলিত করা সম্ভব নয়। ফিলিস্তিনের ইতিহাস লিখতে হলে অবশ্যই লেবাননে অবস্থানরত শরণার্থী ফিলিস্তিনি অথবা সীমানাবর্তী উদ্বাস্তুদের ইতিহাসও লিখতে হবে। এইখানে মূল সমস্যা। কেবল এককভাবে ফিলিস্তিনের বর্ণনা দিলে তা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ফিলিস্তিনের ইতিহাস লিখতে হলে তার অস্থির সময়কে নির্দেশ করতে হবে, ফিলিস্তিনিদের দেশ ছাড়া বা দেশে ফেরা সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। 'মিডনাইটস চিলড্রেন' উপন্যাসে এ দৃষ্টিকোণ থেকে কিছুটা চেষ্টা করা হয়েছে।
সালমান রুশদী : আপনি কিছুক্ষণ আগে 'পেসোপটিমিস্ট' বা 'নৈরাশ্যব্যঞ্জক আশাবাদী' লেখককে এমন এক ফর্মের লেখক বলেছেন যার কোন ফর্ম নাই। এবং যাকে আপনি অস্থিরতাপূর্ণ পরিস্থিতির আয়না বলে চিহ্নিত করেছেন। তাদের বিষয়ে আরেকটু বিস্তারিত কিছু বলবেন কী?
এডওয়ার্ড সাঈদ : এটা উৎকেন্দ্রীক দৃষ্টিকোণ থেকে বলেছি। আমি নিজে ফিলিস্তিনি পণ্ডিত নই এবং আরবী সাহিত্যের তাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞও নই।
কিন্তু কানাফানি'র লেখা উপন্যাস 'মেন ইন দ্য সান' সবাইকে মুগ্ধ করেছে দেখে আমি হতবুদ্ধি হয়ে গেছি। তার উপন্যাসের রচনাশৈলী এবং কাহিনীর মধ্যে সময়ের অনিশ্চয়তাকে নির্দেশ করা হয়েছে। তার উপন্যাসের একটি অংশ 'হাইফায় প্রত্যাবর্তন'-এ একটা পারিবারিক কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে। কাহানীতে দেখানো হয়েছে ১৯৪৮ সালে দেশছাড়া একটি পরিবার রামাল্লায় ফিরে আসে। এর বহুদিন পরে অই পরিবার আবার হাইফায় তাদের পুরানা বাসস্থান দেখার জন্য ফিরে যায় এবং তাদের হারিয়ে যাওয়া পোলাপানদের খোঁজ করে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় অই পরিবার হাইফায় তাদের ছোট ছেলেকে ফেলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় যে পরকালে হাইফায় একটি ইহুদি পরিবারের আশ্রয়ে বেড়ে ওঠে। এ গল্পে কানাফানি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতকে কাহিনীর কেন্দ্রবিন্দু ছাড়াই গুলিয়ে ফেলেছেন। সালমান রুশদী : যাক, এবার আমরা আপনার লেখা আফটার দ্য লাস্ট স্কাই' সম্পর্কে একটু দীর্ঘ আলোচনা করব। ফিলিস্তিনি মহিলাদের অপ্রকাশিত কথা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে আপনার এ বইটিতে। আপনি লিখেছেন ‘এবং আমি লক্ষ্য করলাম ফিলিস্তিনের অসংখ্য মৌলবাদী সমস্যার মধ্যে একটি হল সার্বিক ক্ষেত্রে মহিলাদের অনুপস্থিতি। অল্প কিছু মহিলা ছাড়া ফিলিস্তিনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মহিলাদের অবস্থান দাড়ি, কমা, হাইফেনের মত। যতক্ষণ না আমরা আমাদের সমাজে নারীদের একটি বুদ্ধিবৃত্তিক, সচেতন ও মূল পথে না আনতে পারব ততক্ষণ আমরা আমাদের ক্ষমতাহীনতার বিষয় উপলব্ধি করতে পারব না।' বক্তব্যের তাফসীর হিসেবে আপনি ফিলিস্তিনের তরুণ চিত্র পরিচালক মাইকেল ক্লিফির ছবি দি ফার্টাইল মেমোরি'র কথা উল্লেখ করেছেন। অই ছবিতে দু'জন ফিলিস্তিনি নারীর অভিজ্ঞতাকে চিত্রায়িত করা হয়েছে।
এডওয়ার্ড সাঈদ : হ্যাঁ, অই ছবি আমাকে খুবই আন্দোলিত করেছে। অই ছবির আকর্ষণীয় দৃশ্যগুলোর মধ্যে একটি দৃশ্যে একজন বৃদ্ধার অভিজ্ঞতা দেখানো হয়েছে। অই মহিলা আদতে পরিচালক ক্লিফির চাচী হন। নাজারাতে অই মহিলার একখণ্ড জায়গা আছে। সেখানে একটি ইহুদি পরিবার দীর্ঘদিন ধরে ভাড়া থাকেন। কিন্তু একদিন সেই মহিলার মেয়ে ও জামাই এসে তাকে খবর দিল যে অই ইহুদি পরিবার এখন জায়গাখানি কিনে নিতে চায়। মহিলা সাফ সাফ জানিয়ে দিলেন অই প্রস্তাবে তিনি রাজি নন। কিন্তু তার মেয়ে-জামাই বললো 'আম্মাজান, আপনি কী বলছেন? তারা সেখানে দীর্ঘদিন ধরে আছে অতএব এ জায়গা তাদেরই। বরং তারা দয়া করে আপনাকে জমির দাম দিয়ে ব্যাপারটাকে সহজ করতে চাচ্ছে।' কিন্তু বৃদ্ধা বললেন, 'না আমি কোনভাবেই তাদের প্রস্তাবে রাজি নই।' ছবিতে ক্লিফি তখন অই মহিলার আইনি অজ্ঞতা প্রসূত অসহায়তা দেখিয়েছেন। ছবিতে মহিলা বলেছেন, 'জমিখান এখন আর আমার নাই। কিন্তু কে জানতো এমন হবে? আমরা এক সময় এখানে (নাজারাতে) ছিলাম, তারপর ইহুদিরা এখানে এলো, তাদের পর আরও ইহুদি এলো। আমি এ জমির মালিক ছিলাম, এখন নাই কিন্তু জমি ঠিকই আছে। মানুষ আসে, যায়- কিন্তু জমি আগের জায়গাতেই থেকে যায়।' অই বৃদ্ধা তার পুরানা জমি দেখতে যায়। লেবাননে গিয়ে মরে যাবার আগে ১৯৪৮ সালে বৃদ্ধার স্বামী তাকে এই জমি দিয়ে গিয়েছিল। ক্লিফি চমৎকার ভাবে অই জমির ওপরে বৃদ্ধার অসহায় পায়চারি করার দৃশ্য দেখিয়েছেন। এ সেই জমি যার ওপর অই বৃদ্ধার মধ্যে এক মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন দেখিয়েছেন ক্লিফি। তিনি দেখিয়েছেন, বৃদ্ধা অবশেষে বুঝতে পারলেন তার অজ্ঞতার কারণেই আজ তিনি মালিক হয়েও জমির মালিকানা দাবি করতে পারছেন না। ছবির এ দৃশ্যকে ফিলিস্তিনি নারীদের বাস্তব অবস্থার সচিত্র প্রতিচ্ছবি মনে হয়েছে। ফিলিস্তিনিরা তাদের অজ্ঞতার কথাও স্বীকার করে না। আরব সমাজে নারী বিদ্বেষী মনোভাব তীব্রভাবেই রয়েছে। তারা মহিলাদের সমাজে সম্মানজনক উত্থানকে ভয় পায়। আমার মনে পড়ছে একবার আমি আর আমার এক দোস্ত একটা চিত্র প্রদর্শনীতে গিয়েছিলাম। প্রদর্শনীর একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছিল হাস্যোজ্জ্বল এক নারী বুকে হাত বেধে দাঁড়িয়ে আছে। আমার দোস্ত স্বভাবসুলভ ভাষায় তার পরস্পর মতাদর্শ বিরোধী মন্তব্য করে বললো, 'তিনি একজন ফিলিস্তিনি মহিলা, কুৎসিত প্রগতিবাদী মহিলা। আমার মনে হল জ্যঁ মোরের আঁকা অই ছবি যেন এমন কিছু বলতে চাচ্ছে যা আমরা বুঝতে পারছি না।
সালমান রুশদী : আফটার দ্য লাস্ট স্কাই'র ভেতরে আপনি বলেছেন, দীর্ঘদিন পশ্চিমা সংস্কৃতির মধ্যে বাস করার পর আপনি বুঝতে পেরেছেন একজন অ-ইহুদি ভাবতেই পারে না ইহুদিদের ইহুদিবাদী ক্ষমতা কত। আপনি এই জিওনিজমের ক্ষমতাকে একটি 'স্লো এ্যান্ড স্টেডি প্রসেস' বলে অভিহিত করেছেন যা ইহুদি বিরোধী যে কোন কার্যক্রমের চেয়ে অনেক কার্যকর ও শক্তিশালী।
আপনার ভাষায় প্রধান সমস্যা হল, ইহুদিদের বিরোধিতা করা হলে তার বিরুদ্ধে ফিনিশীয় আরব বিরোধিতার অভিযোগ আনা হচ্ছে। অর্থাৎ কেউ যদি 'এন্টি- জিওনিস্ট' হয় তাকে বলা হচ্ছে 'এন্টি-সেমিটিক'। আপনি আপনার এই বই এবং 'দি কোয়েশ্চেন অব প্যালেস্টাইন' বইয়ে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকেই ইহুদিবাদীতার খোলা সমালোচনা করেছেন। এ বিষয়ে যদি কিছু বলেন- এডওয়ার্ড সাঈদ : আমার দিক থেকে কথা হচ্ছে জিওনিজম' হল এ অঞ্চলের হালের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যাচাইয়ের কষ্টি পাথর। আপনি অনেক লোক পাবেন যারা জাতি বিদ্বেষসহ মধ্য আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রের খবরদারির বিরোধিতা করে, কিন্তু তাদের মধ্যে আপনি এমন কাউকে পাবেন না যে ইহুদিবাদীতার সমালোচনা করে না বলে ইহুদিবাদীতা ফিলিস্তিনিদের জন্য কতটা ক্ষতিকর। আপনি যদি নির্যাতনের শিকার কোন ফিলিস্তিনির পক্ষ নেন তাহলে দেখবেন কোন না কোন ইহুদি অথবা তার সংগঠন আপনাকে এমনভাবে উপস্থাপন করবে যাতে আপনি নিজেই তাদের শিকার হয়ে যাবেন। আপনার কোন উপন্যাসের কমেডি চরিত্রের মত আপনাকে 'ভিকটিম অব দ্য ভিকটিম' বানানো হবে। আর এখন একটি নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। ইসরাইল বিরোধী যে কোন বই অথবা কলামকে তারা ‘এন্টি-সেমিটিজম' বলে নিন্দা করা শুরু করেছে। ‘এন্টি-সেমিটিজম' শব্দটাকে তারা এখন ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। বিশেষ করে আপনি আরব অথবা মুসলিম সমাজের কেউ হয়ে যদি যুক্তরাষ্ট্রে বসে ইসরাইলের কোন কুকীর্তির নিন্দা করেন তাহলে তারা আপনাকে ইউরোপীয় অথবা পশ্চিমা এন্টি-সেমিটিজমের চর বলতে দ্বিধা করবে না। এখন সময় এসেছে সত্যিকার ইতিহাস পর্যালোচনা করবার। সময় এসেছে ইহুদিবাদীতার গোড়াপত্তন এবং ফিলিস্তিনিদের প্রতি তাদের মনোভাব নজরে আনবার। সালমান রুশদী : কিন্তু সমস্যা হল 'ইহুদিবাদ' বিষয়টি এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে এখন তার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা মুশকিল। আপনি কী ভেবে দেখেছেন গেলো বছরগুলোতে ‘জিওনিজম' শব্দটি এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যেন তা যে কোন সমালোচনার ঊর্ধ্বে উঠে গেছে? এডওয়ার্ড সাঈদ : গত ১০ বছরে আমি অনেক ইহুদি'র সঙ্গে কথা বলেছি যারা তাদের সম্পর্কিত অন্যদের ধারণা বদলাতে আগ্রহী এবং ষাটের দশকে ইহুদিদের চরম উত্থান ও ইহুদিবাদ বিষয়ে অস্বস্তিবোধ করে।
সালমান রুশদী : আপনাকে কয়েকটি একান্ত ব্যক্তিগত প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে চাই। আপনি বলেছেন, মুসলিম কালচার থেকেই ফিলিস্তিনি হবার বাসনা জাগ্রত হয়েছে এবং ঘটনাক্রমে আপনি একজন অমুসলিম। এটাকে কি আপনি কোন সমস্যা হিসেবে দেখছেন? এ ক্ষেত্রে কী কোন ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব রয়েছে?
এডওয়ার্ড সাঈদ : আমি আমার ক্ষেত্রে বলতে পারি আমার কোন অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বা সংঘর্ষের অভিজ্ঞতা নাই। আমার ধারণা লেবাননের শরণার্থী ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে আমাদের ব্যাপক তফাৎ রয়েছে সেখানে সুন্নী-শিয়া উদারপন্থী-মৌলবাদীদের মধ্যে প্রায়ই সংঘর্ষ হয়। আমাদের এখানেও হয় সেটা অন্য রাজনৈতিক কারণে ধর্মীয় কারণে নয়। ফিলিস্তিনি জাতীয়তাবোধ আপনাকে এমন একটি স্বতন্ত্র চেতনায় জাগ্রত করবে যা আসলে কোন মুসিবত নয়, বরং উপহার। বিশ শতকে আরব দুনিয়াসহ অনেক জায়গার অনেক জাতি তাদের স্বতন্ত্র পরিচয়কে নিজেরাই ধ্বংস করে ফেলেছে। সালমান রুশদী : আপনি লিখেছেন, 'আমাদের ওপর পতিত দুর্ভাগ্যের শিকার হয়ে আমাদের এক বিশাল অংশের ফিলিস্তিনি জনগণ অতীষ্ট হয়ে পড়েছে। এই দুর্ভাগ্যের জন্য কিছুটা দায়ী আমাদের নিজস্ব ভুল, কিছু অংশ সৃষ্টি করেছে আগ্রাসী শক্তি এবং কিছু অংশ তৈরি হয়েছে আমাদের কৌশলগত ত্রুটির জন্য অর্থাৎ হয় আমরা আমাদের মিত্রদের একত্রিত করতে ব্যর্থ হয়েছি নয়তো আমরা শত্রু দমন করতে ব্যর্থ হয়েছি। এসব কারণেই আমাদের ওপর এত মুসিবত পতিত হয়েছে। ফলে ফিলিস্তিনের অধিকাংশ লোকই এখন উদ্ভ্রান্ত, কিন্তু আশার কথা- আমি একজন ফিলিস্তিনিও পাই নাই যে হতাশায় ভেঙে মুষড়ে পড়েছে।'
এডওয়ার্ড সাঈদ : একদম সত্যি কথা !
সালমান রুশদী : আপনার আগের তিনখানি বইয়ে পশ্চিমা ও প্রাচ্যের সংস্কৃতিগত বাহ্যিক ব্যবধান দেখিয়েছেন কিন্তু 'আফটার দ্য লাস্ট স্কাই'তে ফিলিস্তিনিদের মনস্ত াত্ত্বিক দ্বন্দ্ব দেখানো হয়েছে বলে মনে হয়। আপনি বলেছেন, ফিলিস্তিনিরা বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে কৌতুহল গুটিয়ে নিয়ে এখন তাদের আত্মপরিচয়ের দিকে ঝুঁকছে। কেন? এ সম্পর্কে আপনার নিজের কী ধারণা?
এডওয়ার্ড সাঈদ : ভালো কথা। এখন ফিলিস্তিনিদের মোহমুক্তির পর্যায়। আমার প্রজন্মের অনেক লোকই প্রবল দুঃখের মধ্যে বেড়ে উঠেছেন। কিন্তু ষাটের দশকের শেষে এবং সত্তরের প্রথম দিকে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে নবজাগরণ খেয়াল করা যায়। বাইরের দিকে এই জাগরণ তেমন কোন সুফল বয়ে আনে নাই; এ জাগরণে কোন অধিকৃত জমি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয় নাই। তবে, ফিলিস্তিনি জাগরণকে আরব জাতীয়তাবাদের উত্থান বলে অনেকে অপব্যাখ্যা দিয়েছে। কিন্তু এখন তাদের সেই মোহমুক্তি ফিলিস্তিনিদের মধ্যে প্রশ্নের উদ্রেক করছে, ‘আমি কে? আমরা ফিলিস্তিন ছেড়ে কোথায় যাব?' আমি এই বিষয় নিয়েই 'আফটার দ্য লাস্ট স্কাই' লিখেছি। সালমান রুশদী : আপনার বইয়ের কভারে ছাপা জ্যঁ মোরের তোলা ছবিটি সত্যিই ব্যতিক্রম। ভাঙা চশমা চোখে একজন ফিলিস্তিনি- আপনি বলেছেন লোকটির ডান চোখ গুলিতে নষ্ট হয়ে যায়- কিন্তু সে জেনেছে কিভাবে এক চোখে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয়। গুলিতে আহত ছবির লোকটি এখনও হাসছে।
এডওয়ার্ড সাঈদ : জ্যঁ মোর আমাকে বলেছেন, লোকটি তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ছেলেকে দেখতে যাবার পথে ছবিটি তোলা হয়েছিল।
লেখাটি সালমান রুশদী'র ই হোমল্যান্ড গ্রন্থ থেকে
0 Comments