ভারতীয় মূলধারা ও ধর্মীয় আধিপত্যবাদ
আমিনুল ইসলাম
ভূমিকা
আর এস এস-পোষিত ঐতিহাসিকরা ভারতবর্ষের ইতিহাসকে বিশুদ্ধ হিন্দু- ইতিহাসে পরিণত করার জন্য সুপ্রাচীন সিন্ধু সত্যতাকেও হিন্দুদের কীর্তি হিসেবে প্রমাণ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। এদের অনুগত কিছু ঐতিহাসিক দেখাতে চেয়েছেন যে, এক সময়ে সরস্বতী নদী সিন্ধুনদের চেয়েও বড় ছিল এবং আর্যরা এর উচ্চ অববাহিকা থেকেই এসেছে। আসলে ঋক বেদে যখন সরস্বতীকে ‘নদীতমা' বলে অভিহিত করা হয়েছে, তখন তা কোনো জাগতিক নদীর কথা ভেবে বলা হয়নি। ‘সরস্বতীকে মহতী নদী' বলে যে শোরগোল তোলা হচ্ছে তা মেকি দেশাত্মবোধের তাড়নায় গড়া আকাশকুসুম কল্পনা। ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্বের অপপ্রয়োগে এটা প্রমাণ করার ব্যর্থ প্রয়াস হয়েছে যে, আর্যদের আদিভূমি ভারতবর্ষ। রোমিলা থাপার ও ডি ডি কোশাম্বীর মত বিশ্ববিখ্যাত ঐতিহাসিকরা তো বটেই, সুনীতি চ্যাটার্জির মত হিন্দু-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ঐতিহাসিকও নির্দ্বিধায় আর্যদের ভারতের আদি বাসিন্দা হিসেবে মেনে নিতে পারেননি।
ভারতের প্রায় অর্ধেক মানুষের (দাক্ষিণাত্যের) যে অনার্য উৎস আছে তা তাঁদের ভাষা দেখে বোঝা যায়। এমনকি উত্তর ভারতের যে সব অঞ্চলের মানুষকে ‘আর্য’ হিসেবে অভিহিত করা হয়, ওইসব অঞ্চলেও বিভিন্ন এলাকা আছে যেখানকার ভাষা অনার্য। রামকৃষ্ণ মিশন প্রকাশিত 'The Cultural Heritage of India' (১ম খণ্ড) গ্রন্থে সংশ্লিষ্ট ঐতিহাসিকমন্ডলী স্পষ্টভাবে মন্তব্য করেছেন, প্রকৃতপক্ষে আর্যত্বের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ইউরোপ ভাষাগত দিক থেকে (ভারতের চেয়ে) অনেক সুদৃঢ়ভাবে আর্য। আর এস এস আরেকটি মিথ্যা ও অমূলক দাবি করে যে, আর্য সংস্কৃতি হচ্ছে মৌলিক সংস্কৃতি এবং এতে কোনো মিশ্রণ ঘটেনি। বহু সাংস্কৃতিক উৎসের লোকজন মিলেমিশেই ভারতীয় সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যের সামগ্রিকতাই ভারতীয় সংস্কৃতির মূল বৈশিষ্ট্য। তাকে অস্বীকার করে আর এস এস বর্তমান রাজনৈতিক প্রয়োজনকে বৈধতা দানের জন্য অবিমিশ্র মৌলিক ভারতীয় সংস্কৃতির উদ্ভট তত্ত্ব উপস্থিত করতে চায়। বিভিন্ন জাতির মানুষের সংমিশ্রণ ও উৎস বিচার করে জানা গেছে, ভারতের বৃহৎ অংশের মানুষই তথাকথিত আর্য নয়। ভারতীয় হিসেবে নানা জাতি এদেশে সহাবস্থান করেছে ও করছে। মৌলবাদীরা কিন্তু এসব বিষয়কে গুরুত্ব না দিয়ে ভারতীয়ত্ব, হিন্দুত্ব ও আর্যত্বকে সমর্থক করে দেয়। একই সঙ্গে অস্বীকার করে ‘নানাভাষা নানা মত নানা পরিধান, বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান'—এই উদারবাণীকে। ভারতীয়ত্বের ধ্বজাধারীরা আসলে জাতীয়তাবাদী নয়। আর এই কারণেই তারা ভারতের ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়ে তার হিন্দুকরণের কাজ করে নানা মিথ্যাচার ও অর্ধসত্য প্রলাপের দ্বারা।
যৌথ সংস্কৃতি হঠাৎ করে আকাশ থেকে ঘসে পড়েনি। গড়ে উঠেছে দীর্ঘদিনের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই। সম্প্রতি ‘ভারতের নৃতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণ'-এর তরফে ভারতের জনসমষ্টি নিয়ে প্রায় এক দশকের গবেষণার বিপুল তথ্য প্ৰকাশ করা হয়েছে। দেশব্যাপী ৫০০ জন বিশেষজ্ঞ গবেষক এই তথ্য জোগাড় করেছেন। কয়েকটি লক্ষ্যণীয় তথ্য হল: ১) জনগণ হিসেবে ভারতীয়রা সমরূপ, সমধর্মী নন। কমপক্ষে ৪৬৩৫টি সম্প্রদায়ের চিহ্নিতযোগ্য বৈচিত্র্য রয়েছে। ২) এদেশে কেউ ‘বিদেশী' নন, খাঁটি ‘আর্যও নন। বেশিরভাগ সম্প্রদায় মিশ্র বংশোদ্ভূত। বিভিন্ন জাতিগত উপাদান এমনভাবে মিশ্রিত যে তাদের বিশুদ্ধ বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া আজ অসম্ভব। ৩) পরিবেশ বসতি, খাদ্যাভাস, বিবাহ পদ্ধতি, পেশা, সংযোগের ধরন, সামাজিক প্রথার মত এমন ৭৭৫টি অভিন্ন বৈশিষ্ট্য আছে যা ধর্মের গন্ডি মানে না। ৪) হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমানদের অভিন্ন বৈশিষ্ট্য ৯৬.৯৭ শতাংশ। বৌদ্ধ ও মুসলিমদের ৯১.১৮ শতাংশ, শিখ ও মুসলমানদের ৮৯.৯৫ শতাংশ।
আর এস এস স্বীকার করে না, ভারত বহু সংস্কৃতির মিলনে মিশ্রণে সমৃদ্ধ। মানতে চায় না, বৈচিত্র্য সত্বেও ঐক্যই ভারতের বৈশিষ্ট্য। ধর্মীয় সত্ত্বা ছাপিয়ে ভারতীয়দের মধ্যে এক সাংস্কৃতিক মিলন আছে—মানতে চায় না তাও। তাদের কাছে যা কিছু অহিন্দু তা ভারতীয় নয়। তাহলে ভারতের সংস্কৃতিতে মুসলিমদের কোনো অবদান নেই? ভারতের সংস্কৃতি মধ্যযুগে তো বটেই বর্তমানেও প্রতিনিয়ত নতুন নতুন মুসলিম সমাজ ও ব্যক্তিগতভাবে মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের অবদানে উন্নত হচ্ছে না? ভারতীয় সংগীত, সাহিত্য, স্থাপত্য, শিল্পকলা, চিত্রকলা, সিনেমা কখনও কি মুসলিমদের বাদ দিয়ে ভাবা যায়? মুসলিম রাজা-বাদশাহরা এসেছে, এখানেই থেকে গিয়েছে এবং ভারতীয় সভ্যতার অঙ্গীভূত হয়েছে—একদিন যেমনটা হয়েছিল আর্য, অনার্য, দ্রাবিড়, চিন, শক, হুন প্রভৃতি জনগোষ্ঠী।
ইউরোপীয়রা ‘মুসলমান' কাকে বলে জানত। কিন্তু তাঁরা ‘হিন্দু’ কথাটার সঙ্গে পরিচিত ছিল না। ফাহিয়েন, হিউয়েন সাঙ, আলবেরুনি, ইবন বতুতা, ম্যানরিক এইসব ভূপর্যটকদের কারও লেখাতেই ‘হিন্দু' কথাটা পাওয়া যাবে না। কারণ অন্য ধর্মগুলি যেভাবে সংগঠিত রূপ নিয়ে গড়ে উঠেছে, সেভাবে হিন্দুধর্ম গড়ে ওঠেনি। প্রথম দিকে ‘হিন্দু’ ছিল একটা ভৌগোলিক সংজ্ঞা, সিন্ধুনদীর পূর্বদিকে যাদের অবস্থান। সিন্ধু থেকে হিন্দু–এ কৃতিত্ব তো বিদেশীদের, আরও স্পষ্ট করে পারসিক বা আরবীয়দেরঙ্গ তাহলে হিন্দু উৎস বলতে কি বোঝাচ্ছে? যা বোঝায় তা হল ভারতীয় উৎস, যা বোঝায় তা হল ভারতীয় সংস্কৃতি। এই ভারত যতটা হিন্দুর, ততটাই মুসলমান, খ্রিস্টান, শিখ ও বৌদ্ধদের, ততটাই দলিত আদিবাসী ও অনগ্রসরদের। একে হিন্দু উৎস বলে না, বলে ভারতীয় ঐতিহ্য। আর এস এস কিন্তু এই ঐতিহ্যকে স্বীকার করে না। তারা হিন্দুত্বকেই ভারতীয়ত্ব বলে জাহির করতে চান। তারা যখন ভারতীয় মূলধারার কথা বলেন তখন প্রকারন্তরে হিন্দুত্বকেই প্রচার করেন। সেই হিন্দুত্বকে গ্রহণীয় করার জন্য নানারকম সূক্ষ্ম ব্যাখ্যার ধুম্রজাল রচনা করেন। হিন্দুত্বের যাবতীয় দার্শনিক ব্যাখ্যা পন্ডিতদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সাধারণ মানুষ সে সব নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায় না। সুতরাং হিন্দুত্বকে ভারতীয়ত্ব বলে চালাতে চাইলে মুসলমান বা খ্রিস্টানদের দ্বারা সেটা কিছুতেই গ্রহণীয় হয় না। অথচ আর এস এস সেটাই চায়—সংখ্যালঘুরা হিন্দুত্ব মেনে নিক।
ভারতে চলমান এই উগ্র রাজনীতির উত্তাল ঘটনাধারা আমাদের প্রভাবিত করছে। এহেন সংকীর্ণ ও ভেদমূলক রাজনীতি সম্পর্কে আমাদের সচেতন হতে হবে। আমার ‘ভারতীয় মূলধারা ও ধর্মীয় আধিপত্যবাদ' গ্রন্থে ৩৩টি প্রবন্ধ-নিবন্ধে বিষয়টির একটা রূপরেখা দেওয়ার প্রয়াস চালানো হয়েছে। বেশিরভাগ রচনা ৩-৪ বছর ধরে দৈনিক পুবের কলম পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। কিছু প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দিনদর্পণ, সাপ্তাহিক নতুন গতি প্রভৃতি পত্রিকায়। রচনাগুলির বেশকিছু পরিমার্জিত, পরিবর্ধিত ও সংশোধিত করে এই গ্রন্থে সংযোজিত করা হয়েছে। গ্রন্থটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক চিন্তাশক্তির বিকাশে সহায়তার পাশাপাশি সামগ্রিক মুক্তিসাধনে সামান্য হলেও গতি আনতে পারলে আমাদের শ্রম সার্থক হবে। দেশের বিদ্বজ্জন এবং শিক্ষক-ছাত্র সকলের প্রত্যাশা পূরণে গ্রন্থটি বিশেষ সহায়ক হবে বলে আমাদের আশা।
কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি সেই সমস্ত স্বনামধন্য লেখক ও গবেষকদের প্রতি, যাঁদের রচনা আমার লেখাকে সমৃদ্ধ হতে বিশেষভাবে সাহায্য করেছে। কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি উপরোক্ত পত্রিকার কর্তৃপক্ষদেরও। গ্রন্থটি প্রকাশের ইচ্ছা বাস্তবে রূপায়িত করার পেছনে যাঁদের প্রেরণা ও সাহায্য আছে তাঁদের সকলকেও আমার কৃতজ্ঞতা জানাই। সবিশেষ ধন্যবাদ জানাই, অগ্রণী প্রকাশক এডুকেশন ফোরাম-এর কর্ণধার আজিজুল হক মহাশয়কে। গ্রন্থটি প্রকাশের ব্যবস্থা করে প্রকৃত মিত্রের কাজ করেছেন।
ঢেকুয়া, হলদিয়া
পূর্ব মেদিনীপুর
পিন- ৭২১৬৫৮।
ধন্যবাদান্তে-
আমিনুল ইসলাম
বই নিয়ে শুধুমাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, বই নিয়ে শুধু মাত্র বই নিয়েই আমাদের এই প্রয়াস। ধ্বংস ও ধসের সামনে বই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। বই আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার শাণিত অস্ত্র। বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে চারিদিকে আশঙ্কা, নতুন প্রজন্ম চকঝমকের আকর্ষণে বইয়ের দিক থেকে ঘুরিয়ে নিচ্ছে মুখ। আমাদের এ আয়োজন বইয়ের সাথে মানুষের সম্পর্ককে অনিঃশেষ ও অবিচ্ছিন্ন করে রাখা। আশাকরি আপনাদের সহযোগিতায় আমাদের এই ইচ্ছা আরোও দৃঢ় হবে। দুনিয়ার পাঠক এক হও! বাংলা বই বিশ্বের বিবিধ স্থানে, সকল বাংলাভাষীর কাছে সহজলভ্য হোক! সাধ্যের মধ্যে থাকলে বইটি কিনবেন এই প্রত্যাশা রইলো।
0 Comments