ভারত প্রসঙ্গে মার্কস
সুনীতি কুমার ঘোষ
ভারত প্রসঙ্গে মার্কসের মূল্যায়ন নিয়ে মার্কসবাদী এবং অন্যান্য যাঁরা বিস্তৃত অথবা অল্পবিস্তর লিখেছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই দ্বিধাহীনভাবে একমত যে, ১৮৫০ এ ভারত সম্বন্ধে মার্কস যে মূল্যায়ন করেন, বিশেষ করে তাঁর সেই মতামত যাতে তিনি বলেছেন যে, ভারতে বৃটিশ শাসন দ্বৈত ভূমিকা পালন করেছে— একটি হচ্ছে ধ্বংসাত্মক এবং অন্যটি উজ্জীবনীমূলক সেটাই এ বিষয়ে তাঁর চূড়ান্ত মূল্যায়ন। অবশ্য তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ মার্কসের ১৮৫০-এর লেখাগুলোর সাথে একমত এবং কেউ কেউ দ্বিমত পোষণ করে তাঁর সমালোচনা করেন। প্রথমোক্তদের মধ্যে রয়েছেন রজনী পাম দত্ত, এ আর দেশাই, ভিক্টর কির্নান (Victor G. Kiernan), স্লোমো আভিনেরি (Shlomo Avineri) এবং শেষোক্তদের মধ্যে রয়েছেন সমির আমিন এবং মাইকেল ব্যারট ব্রাউন (Michael Barratt Brown )।
এ কথা সত্য যে, ১৮৪০ ও ১৮৫০ এর মধ্যে মার্কস এবং এঙ্গেলস এ ধারণা পোষণ করতেন যে, অবাধ বাণিজ্য ও বিশ্ববাজারের বিকাশের মাধ্যমে সর্বত্রই পুঁজিবাদের বিজয় নিশ্চিত হতে পারে। কিন্তু উপনিবেশবাদ সম্পর্কিত তথ্যপঞ্জিকে সারসংকলন করে— হোরেস ড্যাভিস (Horace Davis) যথার্থই উল্লেখ করেন যে, “উৎক্রমণের উপায় হিসেবে পুঁজিবাদের ভূমিকার প্রতি মার্কসের উৎসাহ পরবর্তীতে অবদমিত হয়ে আসে।” যেমন আমরা দেখি যে, পরবর্তীতে মার্কস ভারতে বৃটিশ পুঁজির উজ্জীবনীমূলক ভূমিকা সম্পর্কে তাঁর প্রারম্ভিক ধারণা পরিত্যাগ করেন। কিন্তু মার্কসের চিন্তার পরিবর্তনের এ দিকটিকে সচরাচর উপেক্ষা করা হয় ৷
১৮৫৩ সালে, New York Daily Tribune পত্রিকার জন্য যখন মার্কস ভারত সম্পর্কে তাঁর লেখাগুলো লিখেছিলেন, তখন ভারতে বৃটিশ শাসনকে তিনি ‘ইতিহাসের অসচেতন হাতিয়ার' হিসেবে স্বাগতঃ জানিয়েছিলেন। তিনি ধারণা করেছিলেন, এটা ‘এশিয়াবাসীর সামাজিক জীবনে একটি মৌলিক বিপ্লব' নিয়ে আসছে, যা এই উপমহাদেশকে সকল যুগের পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত করবে, এই প্রক্রিয়া এর জনগণের জন্য যত বেদনাদায়কই হোক না কেন, তিনি আশা করেছিলেন যে, ইংরেজদের স্টীম ইঞ্জিন ও অবাধ বাণিজ্য ভারতে বৃটিশ শিল্পের সস্তা পণ্যের, বিশেষতঃ ল্যাঙ্কাশায়ারের বস্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে এশিয়ার গ্রামীণ সমাজের ‘স্থবিরতা’ ও ‘নিস্ক্রিয় অস্তিত্বকে’ ভেঙ্গে ফেলবে— যা প্রাচ্য স্বৈরতন্ত্রের (Oriental Despotism) দৃঢ় ভিত্তি নির্মাণ করেছিল। আর কৃষি ও শিল্পের বন্ধনকে বিনষ্ট করে এবং তাদের আত্ম-নির্ভরশীলতা ও বিচ্ছিন্নতাকে ভেঙ্গে দিয়ে বৃটিশ পুঁজি ‘তাদের অর্থনৈতিক বুনিয়াদকে' ধ্বংস করে দেবে। বৃটিশ পুঁজিকে মার্কস ধ্বংসমূলক এবং উজ্জীবনীমূলক-এ ‘দ্বিবিধ কর্তব্য’ পালনকারী হিসেবে মূল্যায়ন করেন। মার্কসের মতে বৃটিশ পুঁজি ‘প্রাচীন এশীয় সমাজকে' ভেঙ্গে দিয়ে ‘এশিয়ায় পাশ্চাত্য সমাজের বস্তুগত ভিত্তি' নির্মাণ করছে। মার্কস মনে করতেন যে, বৃটিশ উপনিবেশিক শাসনের ধ্বংস এবং লুটতরাজ প্রক্রিয়া অত্যন্ত ভয়াবহ হলেও তা ছিল ‘এ পর্যন্ত এশিয়ায় একমাত্র সামাজিক বিপ্লব'-এর জন্য যথার্থ মূল্য।
১৮৫৩ সালে মার্কস ভারতের প্রাক-উপনিবেশিক সমাজের নিম্নোক্ত প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করেন:-
(১) ‘ভূমিতে ব্যক্তিগত মালিকানার অনুপস্থিতি'- ধারণাটি মার্কস এবং এঙ্গেলস বার্নিয়ারের (Francois Bernier)-এর নিকট থেকে নেন।
(২) প্রাচ্যে কৃত্রিম সেচের উপর নির্ভরশীলতাকে এঙ্গেলস ‘কৃষির প্রাথমিক শর্ত হিসেবে দেখেছেন এবং যা ছিল ‘গ্রাম সমাজ, প্রদেশ অথবা কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যাপার।'
(৩) ‘ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিচ্ছিন্ন এবং অপরিবর্তনশীল আত্মনির্ভর' এই গ্রাম গোষ্ঠীগুলোর (Village communities) সমন্বয়ে গঠিত আবহমানকাল থেকে চলে আসা এ সমাজ ব্যবস্থা ছিল ‘অত্যন্ত নিম্ন মাত্রার সুযোগ-সুবিধার উপর নির্ভরশীল। এমনকি গ্রামগুলো ছিল প্রায় পারস্পরিক সংযোগবিহীন এবং সামাজিক অগ্রগতির জন্য আবশ্যকীয় আকাঙ্ক্ষা ও কর্ম প্রচেষ্টা বর্জিত।’
(৪) ‘কৃষি এবং শিল্পোদ্যোগগুলোর ভেতর ঘরোয়া বন্ধন, লাঙ্গল এবং হস্তচালিত তাঁত ও অন্যান্য কুটির শিল্পের কারিগরদের ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি দলখীস্বত্ব ছাড়া হলো আত্মনির্ভর, বিচ্ছিন্ন এ গ্রাম সমাজের ভিত্তি।'
(৫) কৃষি ও শিল্প উৎপাদক এবং সমাজের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে প্রচলিত রীতিতে দ্রব্য সামগ্রী ও সেবাদির বিনিময়, এবং মূলতঃ বাজারের জন্য উৎপাদনের অনুপস্থিতি।
(৬) শহর ও নগরগুলোর অস্তিত্ব মূলতঃ ‘সামরিক শিবির’ হিসেবে ‘বাস্তব অর্থনৈতিক কাঠামোর উপর জোরপূর্বক প্রতিষ্ঠিত'। এবং
(৭) এর পরিবর্তন বিরোধিতা— ‘স্ব বিকশিত' গ্রাম সমাজকে পরিণত করেছে অনড়-অচল প্রাকৃতিক নিয়তিরূপে...।
উপরোল্লিখিত বিষয়ে মার্কস যখন লেখেন তার পূর্ব পর্যন্ত ভারতীয় ইতিহাস, বিশেষ করে মোগল আমলের ভারতীয় ইতিহাস সম্পর্কে যেটুকু গবেষণা হয়েছিল তা নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে যে, মার্কস ১৮৫০ এবং বৃটিশ উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের তথ্যের উপর নির্ভর করে প্রাক-উপনিবেশিক ভারতীয় সমাজের যে চিত্র তুলে ধরেন তা ছিল বাস্তব সত্য থেকে অনেক দূরে।
এ প্রসঙ্গে আমার উল্লেখ করতে পারি, প্রথমতঃ ভূমির দখলীস্বত্ব ও ব্যবহার ছিল ব্যক্তিগত, যৌথ নয়। যতদিন পর্যন্ত একজন কৃষক ভূমি খাজনা পরিশোধ করত ততদিন পর্যন্ত উত্তরাধিকার সূত্রে ঐ ভূমি দখলের অধিকার তার ছিল। ভূমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা সামগ্রিকভাবে অনুপস্থিত ছিল না। যদিও কৃষি জমির হস্তান্তর ছিল প্রায় দুর্লভ।
দ্বিতীয়তঃ গ্রাম গোষ্ঠীগুলো ভূমির স্বত্বাধিকারী ছিল না, এগুলো ছিল প্রশাসনিক একক হিসেবে।
তৃতীয়তঃ এটা সাম্যভিত্তিক সমাজ ছিল না বরং তীব্র শ্রেণী বিভেদ দ্বারা পৃথক ছিল। কৃষকদের নিজেদের মধ্যেই বৈষম্য ছিল, এমনকি কিছু কিছু জায়গায় কৃষি মজুরেরও উদ্ভব হয়েছিল।
চতুর্থতঃ অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বাভাবিক অর্থনীতির প্রাধান্য থাকলে গ্রামগুলো অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন একক ছিল না। ভূমি খাজনা সাধারণতঃ মুদ্রায় পরিশোধ করা হতো, ফলে কৃষি উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশ থেকে অর্ধেক পর্যন্ত পণ্যে রূপান্তরিত হতো। অনেক অঞ্চলে গ্রামীণ কৃষি ও কারিগরি শিল্পের উৎপাদনের একটা অংশ যেমন উচ্চ মানের খাদ্যশস্য, সুতা, রেশম, নীল, তামাক, সৈন্ধক লবণ, বস্ত্র শিল্প ইত্যাদি ছিল বাজারকেন্দ্রিক। শহরাঞ্চলে ক্ষুদ্র পণ্য উৎপাদনই ছিল শিল্প প্রতিষ্ঠানের প্রধান কাঠামো। কারিগর ও অন্যান্যদের মজুরির বিনিময়ে নিয়োগ করা হতো। ব্যবসায়ী পুঁজিপতি কর্তৃক মজুরির বিনিময়ে অনেক শ্রমিককে একই সঙ্গে নিয়োগও কিছু কিছু এলাকায় অসাধারণ ছিল না। কিছু কিছু শিল্পে, যেমন জাহাজ নির্মাণ, খনি, লৌহ ও ইস্পাত, সিল্ক এবং কাপড় ছাপানো, সুতীবস্ত্র, চিনি, রং প্রভৃতি ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী ম্যানুফ্যাকচারিং কাঠামোর আবির্ভাব ঘটে যদিও তা ছিল ভ্রূণাবস্থায়। অনেক শহুরে অধিবাসী এবং বড় ধরনের শহুরে বাজারের উপস্থিতি ছিল। শহরাঞ্চলের সাথে বৈদেশিক বাণিজ্যও ছিল বেশ উল্লেখযোগ্য।
আরও উল্লেখ করা যায় যে, উপনিবেশিক শাসন ভারতীয় সমাজকে উজ্জীবিত করবে মার্কসের এই প্রত্যাশা অনেকাংশে ভুল প্রমাণিত হয়। পরবর্তীতে আরো ব্যাপক অধ্যয়ন অনুসন্ধান করে মার্কস নিজে তাঁর প্রারম্ভিক ধারণা, বিশেষ করে, অবাধ বাণিজ্যের বিপ্লবাত্মক ভূমিকা এবং বৃটিশ উপনিবেশিক শাসনের ‘দ্বৈত ভূমিকার’ থিসিস পরিত্যাগ করেন।
ভারত সম্বন্ধে ১৮৫৩ সালের লেখায় মার্কস ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থাকে এশীয় সমাজ (Asiatic society) অথবা এশীয় ব্যবস্থা (Asiatic system) হিসেবে চিহ্নিত করেন। এশীয় উৎপাদন পদ্ধতির ধারণাটি সম্ভবতঃ মার্কস প্রথম ব্যবহার করেন ১৮৫৭-৫৯ সময়কার তাঁর অর্থনৈতিক পাণ্ডুলিপিতে যা Grundrisse der Kritik der Politischen Ökonomie শিরোনামে দীর্ঘদিন পর প্রকাশিত হয়। Grundrisse-র বিভিন্ন অধ্যায়ে, যা ‘প্রাক-পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক গঠন' শিরোনামে অনূদিত হয়, এবং পুঁজি গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে উপনিবেশিক ভারতীয় সমাজকে মার্কস এশীয় পদ্ধতি (Asiatic mode) হিসেবে বর্ণনা করেন।
এশীয় পদ্ধতির বৈশিষ্টগুলোর মধ্যে মার্কস নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলোর উপর গুরুত্ব আরোপ করেন: ‘গ্রাম গোষ্ঠীর অবস্থিতি, ব্যক্তিগত মালিকানার অনুপস্থিতি এবং গোষ্ঠীগত মালিকানা, সরল পুনরুৎপাদন কৃষি এবং হস্ত শিল্পের ঐক্য।' এ ব্যবস্থায় নগরগুলো ছিল ‘বাস্তব অর্থনৈতিক কাঠামোর উপর জোরপূর্বক প্রতিষ্ঠিত রাজকীয় শিবির' ছাড়া কিছু নয়। মার্কসের সেই মতে, প্রাচ্য স্বৈরাচারের নিশ্চিত ভিত্তি এই এশীয় সমাজ ছিল শ্রেণীহীন সমাজ অথবা অত্যন্ত প্রাথমিক স্তরের শ্রেণীভিত্তিক সমাজ। ন্যূনতম শ্রেণী বৈষম্যমূলক এ সমাজে, আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব যা পরিবর্তনের মূল ভিত্তি, সেটি ছিল অনুপস্থিত অথবা এতটা অপরিণত যে কোন পরিবর্তন অথবা বিপ্লব ঘটাতে এর ক্ষমতা ছিল খুবই কম।
কিন্তু এটি প্রতীয়মান হয় যে, এশীয় উৎপাদন পদ্ধতির ধারণা সম্বন্ধে মার্কস কখনো নিঃসংশয় ছিলেন না। ১৮৫৩ সালে মার্কস ভারত প্রসঙ্গে লেখেন : “ইংরেজ লেখকদের মধ্যে ভারতের মালিকানা বিষয়ক প্রশ্নটি অত্যন্ত বিতর্কিত। কৃষ্ণার দক্ষিণে ভঙ্গুর পার্বত্য ভূমিতে মালিকানার উপস্থিতি প্রতীয়মান হয়।”” এমনকি ১৮৫৩ সালে তিনি ভারতীয় গ্রাম গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ‘আভ্যন্তরীণ দ্বৈততার' উল্লেখ করেন। তিনি লেখেন যে, যদিও ভূমির অধিকার সমগ্র গ্রাম গোষ্ঠীর এবং এদের মধ্যে কিছু গ্রাম গোষ্ঠীতে “গ্রামীণ ভূমি যৌথভাবে চাষ করা হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রত্যেক চাষী তার নিজস্ব ভূমি চাষ করে।” তাছাড়া সেখানে ছিল দাসত্ব ও বর্ণপ্রথা।' পরবর্তীতে ‘ভূমির যৌথ অধিকার সম্পর্কিত' তাঁর প্রারম্ভিক ধারণার আংশিক বিরোধিতা করে মার্কস বলেন যে, “যদিও ভূমির ভোগ দখল ও ভূমির ব্যবহারের উপর ব্যক্তিগত ও যৌথ উভয় অধিকার কার্যকর ছিল তথাপি সেখানে ভূমির উপর কোন ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠিত ছিল না।”
রুশ সমাজকে এশীয় সমাজের সাথে তুলনা করে, রুশ সমাজ সম্বন্ধে মার্কস বলেন: “আমি এখন মূল বিষয়ের অবতারণা করছি। রুশ সমাজের সেকেলে পদ্ধতির বাস্তবতাকে আমরা উপেক্ষা করতে পারি না, এর মধ্যেকার ‘আভ্যন্তরীণ দ্বৈততা' নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক অবস্থায় একে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেতে পারে। জমির মালিকানা যৌথ কিন্তু প্রত্যেক চাষী নিজস্বভাবে নিজের ভূমির ব্যবস্থাপনা ও চাষাবাদ করে, অনেকটা পশ্চিমা ক্ষুদ্র কৃষকদের মতো। সাধারণ মালিকানা কিন্তু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডে চাষাবাদ, এ দুয়ের মধ্যে সমন্বয় যেটি সুদূর অতীতে প্রয়োজনীয় হলেও আমাদের সময়ের জন্য এটি বিপজ্জনক, একদিকে সম্পদের অস্থিতিশীলতা যেটি কৃষিতেও একটি ক্রমবর্ধমন প্রবণতা, এটি সমাজের সদস্যদেরকে ক্রমশঃ সম্পদের বৈষম্যের দিকে পরিচালিত করছে স্বার্থের দ্বন্দ্ব সৃষ্টির সম্ভাবনা তৈরী করে; বিশেষ করে রাষ্ট্রের রাজস্বের উপর চাপের মাধ্যমে।
আবারো, ভেরা জাসুলিচের কাছে তাঁর জবাবের প্রথম খসড়ায় মার্কস ‘গ্রাম গোষ্ঠীর ভূমিতে সহজাত দ্বৈততার' উল্লেখ করেন, – ‘যা সময়ের গতিপথে ভাঙনের কারণ (Source of dis integration) হতে পারে।’১০ এটা স্পষ্ট যে, অন্ততঃ পরবর্তী বছরগুলোতে মার্কস এ ধারণায় অবিচল ছিলেন যে, ‘এশীয় সমাজ আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব মুক্ত ছিল না' যা (আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব) পরিবর্তনের মূল চালিকা শক্তি।
Karl Marx on Colonialism and Modernization গ্রন্থের ভূমিকায় আভিনেরি ভুলভাবে বলন যে, মার্কস মনে করতেন, প্রাচ্য সমাজে ‘পরিবর্তনের আভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া নেই।' (পৃ. ১১) তিনি যে মার্কসের লেখা সম্পর্কে আংশিক এবং ভুল ধারণার বশবর্তী ছিলেন এভাবে তার প্রমাণ দেন।
ভেরা জাসুলিচের জবাবে তাঁর খসড়ায় দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হচ্ছে, মার্কস গ্রাম গোষ্ঠীগুলোকে স্থবির এবং অপরিবর্তনশীল মনে করতেন না বরং আরো উন্নততর সমাজ নির্মাণের ক্ষেত্রে বিকাশমান অথবা ক্রমেই ভেঙ্গে পড়ার প্রক্রিয়া হিসেবে দেখতেন। এমনকি A Contributioin to the Critique of Political Economy গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি লক্ষ্য করেন যে, এশীয় প্রাচীন, সামন্ত এবং বুর্জোয়া উৎপাদন পদ্ধতি ছিল “এক একটি যুগ যা সমাজের অর্থনৈতিক বিকাশের অগ্রগতি ধারা চিহ্নিত করে।” মার্কসের এ পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এ কারণে যে এটাকে মার্কসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদের পূর্ববর্তী সার সংকলন হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায় যেখানে মার্কস সূত্রায়িত করেন যে, উৎপাদন সম্পর্কের সাথে উৎপাদিকা শক্তির একটা অনিবার্য দ্বন্দ্বের উদ্ভব হয় এবং এ স্তরটির পরেই আসে, একটি সামাজিক বিপ্লবের যুগ।
জাসুলিচের নিকট তাঁর জবাবের দ্বিতীয় খসড়ায় মার্কস বন্ধনীর মধ্যে লেখেন : “আমি লক্ষ্য করি যে, রাশিয়ায় (যৌথ) সম্পত্তির সামাজিক মালিকানা কাঠামো প্রাচীন পদ্ধতির অত্যন্ত আধুনিক রূপ, যা বিবর্তনমূলক অনেক পরিবর্তনের স্তর অতিক্রম করে এসেছে।” তিনি আরো বলেন, “সমাজের প্রাচীন গঠন বিভিন্ন রূপ প্রকাশ করে, যেগুলো ভিন্ন ভিন্ন এবং পর্যায়ক্রমিক যুগগুলোকে রূপায়ন করে।” (পৃ. ১৪২) এবং তৃতীয় খসড়ায় তিনি লেখেন : “সকল আদিম সমাজকে একটি নির্দিষ্ট ছাঁদে ফেলা যায় না বরং এগুলো একত্রে পর্যায়ক্রমিক সামাজিক বিভাগের আকার নেয়, রূপ ও সময় উভয় দিক থেকে যেগুলো পরস্পর থেকে ভিন্ন এবং এগুলো বিকাশের পর্যায়ক্রমিক স্তরগুলো চিহ্নিত করে...। সমাজের আদিম গঠনের শেষ স্তর হিসেবে কৃষি সম্প্রদায় একই সাথে দ্বিতীয় পর্যায়ের গঠনে উৎক্রণকালীন স্তর, এবং সেহেতু যৌথমালিকানা ভিত্তিক সমাজ থেকে ব্যক্তিগত মালিকানা ভিত্তিক সমাজে উৎক্রমণশীল” (পৃ. ১৪৪- ৪৫) এবং প্রায় একই সাথে ইস্ট-ইন্ডিজ (ভারতীয়) এর গ্রামীণ সমাজকে তিনি ‘প্রাচীন সমাজের শেষ স্তর বা শেষ কাল' হিসেবে বর্ণনা করেন।
আভিনেরি বলেন যে, মার্কসের মতানুসারে “ঐতিহাসিক বিকাশের দ্বান্দ্বিকতা এশিয়ায় কার্যকর নয়।” এটাকে আপাতত বিরোধিতা (Paradox) হিসেবে আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, “মার্কসের এশীয় সমাজ বিশ্লেষনের যত গভীরে প্রবেশ করা যায় সেখানে (এশীয়ার) ইতিহাস বিশ্লেষণে মার্কসীয় দর্শনের আভ্যন্তরীণ কাঠামোর প্রয়োগে তত অসুবিধার সৃষ্টি হয়।” (পৃ. ১১-১২) উল্লিখিত আপাত বিরোধিতাটি বরং আভিনেরির কল্পনাশ্রিত, এ কারণে যে, সমসাময়িক কিছু লেখার উপর ভিত্তি করে প্রাক- উপনিবেশিক ভারতীয় সমাজের ভুল বিশ্লেষণমূলক মার্কসের প্রাথমিক ধারণাগুলো, পরবর্তীতে দূরীভূত হয়েছিল। মার্কসের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ এবং প্রাচ্য সমাজ মার্কসের শেষ দিকের লেখার মধ্যে কোন বিরোধ নেই।
ড্যানিয়েল থর্নার যথার্থই বলেন, “১৮১৮ সালে মার্কস সরাসরি তাঁর চিন্তা থেকে স্থবির এশীয় সমাজের ধারণাটি ত্যাগ করেন।” ১৮৬৭ সালের পরবর্তীতে মার্কস যে সকল নোট করেন, তার ভিত্তিতে থর্নার লক্ষ্য করেন যে, এ সকল নোটে মার্কস এশীয় উৎপাদন পদ্ধতি সম্বন্ধে নীরব ছিলেন।
এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে, পুঁজি গ্রন্থের ৩য় খণ্ডে মার্কস ইউরোপীয়দের আগমনের পূর্বেকার ভারতীয় এবং চীনের উৎপাদন পদ্ধতিকে এশীয় উৎপাদন পদ্ধতি হিসেবে বিশ্লেষণ না করে বরং “প্রাক-পুঁজিবাদী জাতীয় উৎপাদন পদ্ধতি হিসেবে বিশ্লেষণ করেন।” (পৃ. ৩৩৩) এটি আরো তাৎপর্যপূর্ণ যে, Socialism : Utopian and Scientific গ্রন্থে এঙ্গেলস বলেন, শোষিত শ্রেণী সমূহকে রাষ্ট্র কর্তৃক বলপূর্বক চাপিয়ে দেয়া “উৎপাদন পদ্ধতির (দাসত্ব, ভূমিদাসত্ব, মজুরিশ্রম) সাহায্যেই নির্যাতিত রাখা হচ্ছে”, কিন্তু সেখানে এশীয় উৎপাদন পদ্ধতির কোনো উল্লেখ নেই ৷
তদ্রূপ, মার্কসের মন্তব্যের ভিত্তিতে লিখিত Origin of the Family, Private Property and the State গ্রন্থে এঙ্গেলস এশীয় সমাজের কোন উল্লেখ করেননি; অথচ তিনি “প্রাচীন রাষ্ট্র”, “সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্র”, এবং “আধুনিক প্রতিনিধিত্বমূলক রাষ্ট্রের” কথা বলেন।
এশীয় উৎপাদন ব্যবস্থা প্রসঙ্গে মার্কসের তত্ত্ব, বিশেষ করে অপরিবর্তনীয় এশীয় সমাজ এবং ভারতে বৃটিশ শাসন সম্পর্কে তাঁর আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রাথমিক ধারণা পুরোপুরি পরিবর্তিত হয়েছিল। গভীর অধ্যয়ন ও অনুসন্ধান তাঁকে এ ধারণায় নিয়ে এসেছিল যে, বৈদেশিক পুঁজির শাসন ভারতে অ-শিল্পায়নের (de-industrialization) প্রক্রিয়া শুরু করেছে, ভারতীয় অর্থনীতিকে মেট্রোপলিটান দেশের অর্থনীতির লেজুড়ে রূপান্তরিত করেছে এবং আরো পশ্চাদপদতার পথ নির্দিষ্ট করে দিয়েছে।
তিনি উল্লেখ করেন: “অন্যান্য দেশের হস্তশিল্পের উৎপাদন ধ্বংস করে, যন্ত্ৰ বলপূর্বক তাদেরকে কাঁচামাল সরবরাহকারী ক্ষেত্রে রূপান্তরিত করেছে। এভাবে ইস্ট ইন্ডিয়াকে গ্রেট বৃটেনের জন্য সুতা, পশম, হেম্প, পাট এবং নীল উৎপাদন করতে বাধ্য করা হয়েছে।... নতুন এবং আন্তর্জাতিক শ্রম বিভাগ, যে শ্রম বিভাগ ঘটেছিল এক অংশের আধুনিক শিল্পের প্রধান কেন্দ্রগুলোর দ্রুত বিকাশের প্রয়োজন অনুযায়ী এবং পৃথিবীর অন্য অংশকে রূপান্তরিত করেছিল, প্রধানতঃ শিল্প উৎপাদনের ক্ষেত্র হিসাবে থেকে যাওয়া অংশের প্রয়োজন সরবরাহকারী, কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে।”
১৮৫০-এর দিকে On Colonialism-এ মার্কস রেলওয়ে নির্মাণকে অভিনন্দিত করেছিলেন এবং এটিকে তিনি ভারতের শিল্প বিপ্লবের প্রভাবক হিসেবে দেখেছিলেন। (পৃ. ৮৭-৮৮) কিন্তু মার্কস পরবর্তীতে লেখেন : “সাধারণত রেলওয়ে অবশ্যই বৈদেশিক বাণিজ্য প্রসারে ব্যাপক তাগিদের সৃষ্টি করবে, কিন্তু যে সকল দেশ প্রধানতঃ কাঁচামাল রপ্তানি করে সে সকল দেশের বৈদেশিক বাণিজ্য জনগণের দুঃখ দুর্দশাকে আরো তীব্রতর করে।”
মার্কসের মতে, রেলওয়ে “প্রকৃত উৎপাদকের অত্যন্ত দুঃখের কারণ হয়েছিল' এবং ইরফান হাবিবের ভাষায়, “এটা পুরোপুরি উপনিবেশীকীকরণের প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছিল।” মার্কস লেখেন, “উৎপাদন নিজে, আমি বিশেষ ধরনের পণ্যের কথা বলছি, রূপান্তরিত হয়েছিল, রপ্তানীর জন্য কম বা বেশি খাপ খাচ্ছে কিনা, সেইভাবে.....।”
অর্থাৎ দেশটির উৎপাদিকা শক্তির বৃহত্তর অংশকে ধ্বংস করে দিয়ে অথবা শিল্পায়িত বৃটেনের চাহিদা অনুযায়ী ঢেলে সাজিয়ে এটা ঐ দেশটিকে পুঁজিবাদী বিশ্ব বাণিজ্যের বলয়ে ঢেলে আসে এবং দেশটির অর্থনীতি পরনির্ভরশীল (satellite) চরিত্র ধারণ করে।
বৃটেনে সম্পদের বিপুলে পাচার ভারতের পুঁজিবাদী বিকাশের ভয়ানক অন্তরায় ছিল মার্কস লেখেন : “ইংরেজরা বাৎসরিক খাজনা, মুনাফা, রেলভাড়া হিসেবে তাদের (ভারতীয়দের) কাছ থেকে যা নেয় তা ভারতীয়দের জন্য কোন কাজে আসেনি। উপরন্তু সামরিক ও বেসামরিক কর্মচারীদের অবসরতা, আফগানিস্তানের ও অন্যান্য যুদ্ধ ইত্যাদি ইত্যাদি খাতে যা তারা কোন প্রকার বিনিময় মূল্য ছাড়াই নিয়ে যায় এবং ভারতের অভ্যন্তরে তারা যা আত্মসাৎ করে তা ছাড়াও, শুধুমাত্র পণ্যের মূল্যের আকারে ভারতীয়রা প্রতিবৎসর বিনামূল্যে ইংল্যান্ডে যা পাঠায়, তার পরিমাণ ভারতের ৬০ মিলিয়ন কৃষি ও শিল্প শ্রমিকের আয়ের মোট সমষ্টিরও অধিক।”
এ হচ্ছে একটি হিংসাত্মক রক্তক্ষরণের প্রক্রিয়া।
১৮৫৩ সালে যদিও মার্কস ভূমি বন্দোবস্তের ক্ষেত্রে জমিদারী এবং রায়তওয়ারী প্রথাকে ভূমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা প্রবর্তনের জন্য স্বাগত জানিয়েছিলেন কিন্তু ১৮৫৮ সালেই তিনি “জমিদার ও তালুকদারদের ভূমির একচেটিয়া মালিকানাকে খোদ কৃষক এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি দুঃস্বপ্ন” হিসেবে বর্ণনা করেন।১৯ ১৮৮১ সালে তিনি বলেন, “উদাহরণস্বরূপ ইস্ট ইন্ডিয়ার কথা বললে, স্যার এইচ মাইন এবং তার মতো অন্যান্যরা ছাড়া কারো কাছে এটা অজানা নেই যে, ভূমির গোষ্ঠীগত মালিকানার বিলোপ ছিল ইংরেজদের লুটপাটের কাজ, যা ভারতীয় জনগণকে অগ্রগতির দিকে না নিয়ে পশ্চাতে নিয়ে যায়। ”
এটা স্পষ্ট যে, বৃটিশ উপনিবেশিক শাসনের বিপ্লাত্মক ভূমিকা সম্পর্কে তাঁর প্রাথমিক আশাবাদিতা মার্কস পরবর্তীতে ত্যাগ করেছিলেন। তিনি এ ধারণায় পৌঁছেছিলেন যে, পুঁজিবাদী সমাজের বৈষয়িক ভিত্তি নির্মাণের পরিবর্তে বৃটিশ উপনিবেশিক শাসন বিদ্যমান উৎপাদন শক্তির অধিকাংশের ধ্বংস সাধন করে, নতুন উৎপাদিকা শক্তির বিকাশকে রুদ্ধ করে দেশটিকে পশ্চাদপদতায় নিক্ষেপ করে এবং অনুন্নয়নের ভিত্তি গড়ে তোলে। নতুন উৎপাদিকা শক্তির বিকাশকে ত্বরান্বিত করার পরিবর্তে এটা ভারতকে ‘প্রধানতঃ কৃষি ক্ষেত্র' হিসেবে বিশ্ব বাজারের অঙ্গীভূত করে। আধুনিক শিল্প বিকাশের অগ্রদূত হিসেবে কাজ না করে রেলওয়ে ভারতকে বৃটেনের কৃষি ক্ষেত্রে এবং এর শিল্পজাত পণ্যের বাজারে রূপান্তরিত করার উপায় হিসেবে কাজ করেছিল।
এটি অত্যন্ত দুঃখের বিষয়ে যে, অনেক লেখক ভারতের বৃটিশ শাসনের ‘দ্বিবিধ ভূমিকার' তাঁর প্রাথমিক থিসিসকে এ বিষয়ে মার্কসের চূড়ান্ত মূল্যায়ন বলে মনে করেন। ভারত প্রসঙ্গে মার্কসের রচনাবলীর ভূমিকায় রজনী পাম দত্ত এই (১৮৫০ এর পূর্বেকার) রচনাসমূহকে মার্কসের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ লেখা এবং আলোচিত প্রশ্নের উপর আধুনিক চিন্তার যাত্রারম্ভ হিসেবে চিহ্নিত করেন। এমনকি ১৯৭০ সাল পর্যন্ত তিনি মার্কসের উপরোক্ত পরিত্যক্ত থিসিসকে স্বতঃসিদ্ধ সত্য হিসেবে লালন করে আসছিলেন। তাঁর India Today গ্রন্থের, তাঁর জীবদ্দশায় শেষ সংস্করণে, তিনি উপনিবেশিক যুগের ভারতীয় সমাজ, এর শ্রেণীসমূহ এবং সংগ্রামকে ঐ থিসিসের আলোকে বিশ্লেষণ করেন। বৃটিশ শাসনের প্রগতিশীল এবং বৈপ্লবিক ভূমিকার উচ্চ প্রশংসায় (পৃ. ২৫২-৫৩) তিনি ১৮৫০-এর মার্কসকেও ছাড়িয়ে যান। তিনি অবশ্য সে ক্ষেত্রেও মার্কসকে ছাড়িয়ে যান যখন তিনি ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহকে (মার্কস যাকে ‘জাতীয় বিদ্রোহ’ হিসেবে বর্ণনা করেন) “ক্ষয়িষ্ণু সামন্তবাদী শক্তির প্রতিভু প্রাক্তন শাসকদের বৈদেশিক আধিপত্যর গতিরোধ করবার শেষ প্ৰচেষ্টা হিসেবে ব্যক্ত করেন। তিনি আরো বলেন, “ইতিমধ্যেই যেমন উল্লেখ করা হয়েছে যে, ঐ সময়কার প্রগতিশীল শক্তিসমূহ (ছিঃ), যেমন শিক্ষিত শ্রেণীসমূহ উঠতি পুঁজিপতিদের প্রতিনিধিত্বশীল শ্রেণীসমূহ বিদ্রোহের বিরুদ্ধে বৃটিশ শাসনকে সমর্থন করেছিল।” (পৃ. ৩৫৮)
মার্কসবাদের নামে উপনিবেশবাদের সমর্থনের ক্ষেত্রে স্পষ্ট ভুল যুক্তি দেন আভিনেরি যিনি মার্কসের পরবর্তী লেখাসমূহ এবং উপনিবেশিক শাসনের প্রকৃত ফলাফলকে গুরুত্ব দেননি। যখন ‘মাওবাদীদের' ভারত চীন ও সম্পর্কিত মার্কসের লেখাসমূহ সম্বন্ধে ‘সম্পূর্ণ অজ্ঞ' বলে অভিযুক্ত করেন, তখন দেখা যায় যে, আভিনেরি নিজেই এ বিষয়ে অজ্ঞ যে, মার্কস গভীর অনুসন্ধান ও গবেষণার ফলে বৃটিশ প্রবর্তিত কৃষি ব্যবস্থা এবং রেলওয়ের উজ্জীবনীমূলক চরিত্র সম্বন্ধে তার প্রারম্ভিক ধারণার সংশোধন করেছিলেন।
আভিনেরি মার্কসের ‘সপক্ষে’ নিম্নলিখিত থিসিটি হাজির করেন (পৃ. ১২) : “শিল্পায়নের ভয়াবহতা যেমন সাম্যবাদের সাফল্যের জন্য দ্বান্দ্বিকভাবে প্রয়োজনীয় তেমনি উপনিবেশবাদের ভয়াবহতাও প্রলেতারিয়েতের বিশ্ব বিপ্লবের জন্য দ্বান্দ্বিকভাবে প্রয়োজনীয়, যেহেতু এটা ছাড়া এশিয়ার দেশসমূহ (এবং সম্ভবত আফ্রিকাও) নিজেদেরকে তাদের স্থবির পশ্চাদপদতা থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হবে না।”
আভিনেরি যুক্তি দেন যে, “এর সরাসরি উপধারা হিসেবে যা আসছে তা হলো, ইতিহাসের পাশ্চাত্য কেন্দ্রিক দর্শন এবং এশীয় উৎপাদন পদ্ধতির অ-দ্বান্দ্বিক স্থবির প্রকৃতির মধ্যে বিরোধী এই যে, মার্কস ইউরোপীয়দের অনুপ্রবেশের তীব্রতা অনুপাতে তাকে অভিনন্দন জানাতেন। এশিয়ার যে কোন সমাজে ইউরোপীয় নিয়ন্ত্রণ যত বেশি প্রত্যক্ষ, এর কাঠামোকে ভেঙ্গে ফেলায় এবং বুর্জোয়াদের বিকাশের সুযোগ তত অধিক এবং এ থেকে পরবর্তীতে সমাজতান্ত্রিক সমাজে উত্তরণেরও।” (পৃ. ১৮) আভিনেরি যথেষ্ট কৌতূহলোদ্দীপকভাবে, মার্কস ও এঙ্গেলসের উপর অবাস্তব এ ধারণার (ইতিহাস যা ভুল প্রমাণিত করেছে) দায়িত্ব বর্তান যে, ‘ইউরোপে প্রলেতারীয় বিপ্লবের পূর্বে জাতীয় মুক্তি যুদ্ধের সম্ভাবনা' নেই। তিনি আরো বলেন যে, ১৮৫৭-৫৮ সালে ভারতীয় বিদ্রোহের কারণ এবং বিদ্রোহের অংশগ্রহণকারীদের প্রতি মার্কসের কোন সহানুভূতি ছিল না।
আভিনেরি-র শেষ বক্তব্যকেই প্রথমে দেখা যাক আমরা দেখছি ১৮৫৭ সালে ভারতীয় বিদ্রোহকে মার্কস ‘জাতীয় বিদ্রোহ' হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং এঙ্গেলস এটিকে ‘মহাবিদ্রোহ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
ভারতীয়দের উদাসীনতা, এমনকি বৃটিশ শাসনের প্রতি তাদের সহৃদয়তা সম্বন্ধে বলতে গিয়ে, মার্কস বলেন, ‘এ সবই নিরর্থক' তিনি আরো বলেন, “এ সকল ঘটনার প্রেক্ষিতে, প্রজাদের উপর নির্মম অত্যাচারী বিদেশী শাসকদের বিতাড়িত করার জন্য জনগণের প্রচেষ্টা যুক্তিসঙ্গত কী, যুক্তিসঙ্গতা না নিরাবেগ চিন্তামগ্ন ব্যক্তিরাই হয়তো এ প্রশ্নের অবতারণা করতে পারেন।” বৃটিশ শাসনকে উৎখাত করায় সংগ্রামরত ভারতীয় শক্তিসমূহকে মার্কস ‘বৈপ্লবিক জোট' হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি এবং এঙ্গেলস্ ব্রিটিশ শাসনকে নিন্দা করেন এবং বৃটিশ সৈন্যদের বর্বরতাকে জোরালোভাবে অভিযুক্ত করেন।
মার্কস তাঁর সকল ঘৃণা নিক্ষেপ করেন, বৃটিশদের এদেশীয় মিত্রদের উপর। জীবনের শেষ বছরগুলোতে তিনি লেখেন : 'সিন্ধিয়া (গোয়ালিয়রের শাসক) ইংরেজ কুকুরদের প্রতি যতটা অনুগত, তার সৈন্যবাহিনী ততটা অনুগত নয়। পটিয়ালীর রাজা কি লজ্জাস্করভাবে ইংরেজদের সাহায্যে বিরাট সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করে!” বৃটিশ সমর্থকদের তীব্র কষাঘাত করে তিনি বলেন : “জুন ২, তরুণ সিন্ধিয়া (ইংরেজ কুকুর ) প্রচণ্ড যুদ্ধের পর গোয়ালিয়র থেকে বিতাড়িত হয় এবং জীবন নিয়ে আগ্রায় পলায়ন করে।” (June 2, young Sindhia (English dog man) driven out of Gwalior by his troops after hard fighting, fled for his life to Agra.)` ২৪ বৃটিশের অনুগত, নেপালের রাজাকে তিনি English dog-man উপাধিতে ভূষিত করেন।
যুদ্ধের অগ্রগতির একটা পর্যায়ে মার্কস ভারতীয় জনগণের বিজয়ের আশা করছিলেন। The First India War of Independence- এ তিনি লেখেন : “আমরা আশা করতে পারি যে, কিছুদিনের মধ্যেই আবার আফগানিস্থানে দুর্যোগের পুনরাভিনয় দেখা যাবে।” কাজেই মার্কসের সহানুভূতি কোন দিকে সেটা বোঝা কি আসলে কষ্টকর?
আভিনেরি-র তত্ত্বানুসারে, যা তিনি মার্কসের উপর আরোপ করেন, উপনিবেশ এবং আধা উপনিবেশিক দেশসমূহ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম ইউরোপে প্রলেতালিয়েত বিপ্লবের অবশ্যই আগে নয়, পরে সম্পন্ন হবে। এখানে এটা উল্লেখ করা দরকার যে, ‘ভারতে বৃটিশ শাসনের ভবিষ্যৎ ফলাফল'-এ (১৮৫৩) মার্কস লেখেন যে, ‘সমাজের নতুন উপাদনের ফলাফল' ভারতীয়রা পাবে না যতদিন না বৃটিশ শ্রেণী সমূহ শিল্প- প্রলেতারিয়েত কর্তৃক উৎখাত না হচ্ছে অথবা ভারতীয়রা নিজেরাই “ইংরেজের জোয়াল একেবারে ঝেড়েফেলার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী না হচ্ছে।” কাজেই মার্কস কখনো এ ধারণা পোষণ করতেন না যা আভিনেরি আমাদেরকে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করছেন যে, ইউরোপে প্রলেতারিয়েতে বিপ্লবের সফলতার পূর্ব পর্যন্ত জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকে অপেক্ষা করতে হবে।
বৃটেনের প্রাচীনতম উপনিবেশ আয়ারল্যান্ড সম্বন্ধে বলতে গিয়ে মার্কস ১৮৬৭ সালে লেখেন, “যখনই আয়ারল্যান্ড নিজেকে শিল্পে উন্নত করার পর্যায়ে উঠছে তখনই সে অবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়ে দেশটিকে জোরপূর্বক কৃষি প্রধান দেশে পরিণত করা হয়েছে।” ১৮৬৯ সালে এঙ্গেলস বলেন, “এক জাতি কর্তৃক আর এক জাতির বশীভূত হওয়া যে কত দুর্ভাগ্যজনক আইরিশ ইতিহাস থেকে তা দেখা যায়...।” এবং ১৮৭০ সালে তিনি লেখেন, “বিষয়টির যত গভীর অধ্যয়ন করছি ততই আমার কাছে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে যে, বৃটিশ আক্রমণ আয়ারল্যান্ডের অগ্রগতি বাধাপ্রাপ্ত করেছে এবং দেশটিকে শতাব্দীকাল পিছিয়ে নিয়ে গেছে।'
দীর্ঘদিন যাবত মার্কস বিশ্বাস করতেন যে, “ইরেজ শ্রমজীবী শ্রেণীর ক্ষমতা দখল দ্বারাই আয়ারল্যান্ডে বৃটিশ শাসন উৎখাত সম্ভব হবে।” কিন্তু পরবর্তীতে তিনি চিন্তার পরিবর্তন করেন— “গভীর অধ্যয়ন আমাকে বিপরীত ধারণায় নিয়ে এসেছে। ইংরেজ শ্রমজীবী শ্রেণী কিছুই অর্জন করতে পারবে না, যতদিন না আয়ারল্যান্ডে এর থেকে মুক্ত না হচ্ছে। সুতরাং আয়ারল্যান্ডে মূল শক্তি নিহিত করতে হবে।” তিনি বলেন, “আইরিশদের প্রয়োজন হচ্ছে : (১) নিজস্ব সরকার এবং ইংল্যান্ড থেকে মুক্তি, (২) কৃষি বিপ্লব, (৩) ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সংরক্ষণমূলক শুল্ক।”
মার্কস এ ধারণায় পৌঁছান যে, কেবলমাত্র আয়ারল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ বিকাশই নয়, ইংল্যান্ডে প্রলেতারিয়েত বিপ্লবও আয়ারল্যান্ডের জাতীয় স্বাধীনতার উপর নির্ভলশীল। তিনি লেখেন যে, ইংরেজ শ্রমিক শ্রেণীর জন্য “আয়ারল্যান্ডের জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন বিমূর্ত অথবা মানবহিতৈষী আবেগ নয় বরং তাদের নিজেদের সামাজিক দাসত্ব মোচনের শর্তও বটে।’
প্রথম দিকে মার্কস অবাধ বাণিজ্যিক অভিনন্দন জানিয়েছিলেন এ আশায় যে এটা সামাজিক বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করবে। যদিও ‘বর্তমান সামাজিক অবস্থায়' এর অর্থ হলো ‘পুঁজির স্বাধীনতা’৷৩২ এই বিপ্লবাত্মক অর্থে তিনি অবাধ বাণিজ্য কর্তৃক বৃটেনের কারখানা শিল্পের পণ্যের প্রবেশের মাধ্যমে ভারতীয় গ্রামীণ শিল্পের ধ্বংস এবং এর মাধ্যমে ‘গ্রাম গোষ্ঠীর' বিনাশ সাধনকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি অনুধাবন করেছিলেন যে, অবাধ বাণিজ্য ঐ সব দেশেরই উৎপাদিকা শক্তিসমূহের ধ্বংস সাধন করছে, যেসব নিজেদেরকে রক্ষা করতে অক্ষম। পুঁজি গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে মার্কস উল্লেখ করেন যে, ইউরোপীয় রাষ্ট্রসমূহ “তাদের উপর নির্ভরশীল রাষ্ট্রসমূহের সকল শিল্প কারখানা জোরপূর্বক উচ্ছেদ সাধন করে, যেমন ইংল্যান্ড আইরিশ পশম শিল্পের ধ্বংস সাধন করেছিল।” (পৃ. ৭০৮) মার্কস লক্ষ্য করেন যে, আয়ারল্যান্ডে একমাত্র কফিন তৈরী শিল্পের উন্নতি সাধিত হয়েছিল। এ কারণে তিনি এ ধারণায় পৌঁছেন যে, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সংরক্ষণমূলক শুল্ক ছাড়া আয়ারল্যান্ডে আভ্যন্তরীণ অগ্রগতি সাধন সম্ভব নয়।৺৺ অবাধ বাণিজ্যের বৈপ্লবিক ভূমিকার প্রতি তাঁর প্রারম্ভিক দৃষ্টিভঙ্গির সম্পূর্ণ পরিবর্তন ঘটে এবং পুঁজি গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে তিনি লেখেন, “সংরক্ষণ ব্যবস্থা ম্যানুফ্যাকচারারদের বিকাশের, স্বাধীন এবং মূলধনীকরণের, মধ্যযুগীয় থেকে আধুনিক উৎপাদন পদ্ধতির উত্তরণকালকে বলপূর্বক সংক্ষেপ করার একটা কৃত্রিম উপায়।” (পৃ. ২03)
আভিনেরি-র থিসিস হচ্ছে “এশিয়ার দেশসমূহ (এবং সম্ভবতঃ আফ্রিকাও) তাদের স্থবির পশ্চাপদতা থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করতে পারবে না।” ‘উপনিবেশবাদের ভয়াবহ' অভিজ্ঞতা ছাড়া এবং “এশিয়ার যে কোনো সমাজে, ইউরোপীয় নিয়ন্ত্রণ যত বেশী সরাসরি হবে, উপনিবেশবাদের কাঠামোকে ভেঙ্গে ফেলার সুযোগ তার তত অধিক এবং এর চূড়ান্ত ফল হচ্ছে বুর্জোয়া বিকাশ এবং এর পরবর্তীতে সমাজতান্ত্রিক সমাজে উত্তরণ।” আভিনেরি-র থিসিসকে যুক্তি দিয়ে খণ্ডনের আর অপেক্ষা রাখে না। তথাপি তা যে কত বিস্ময়করভাবে বিকৃত তার প্রমাণে আমরা জাপান, চীন ও ভারতের ঘটনা উল্লেখ করতে পারি। এশিয়া ও আফ্রিকার সকল দেশসমূহের মধ্যে একমাত্র জাপানই উপনিবেশবাদের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পেয়েছিল এবং স্বাধীন পুঁজিবাদী বিকাশের পথ অনুসরণের সুযোগ পেয়েছিল। তাই উপনিবেশিক শাসনের শৃঙ্খলমুক্ত থেকে জাপান তার প্রাক-পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামোকে পরিবর্তিত করেছে, স্থবির পশ্চাদপদতা থেকে নিজেকে মুক্ত করেছে এবং পশ্চিমা পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী দেশসূহের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে অবির্ভূত হয়েছে, এমনকি উৎকর্ষতায় কাউকে কাউকে ছাড়িয়ে গেছে। অন্যদিকে চীন, কতিপয় পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের যেমন রাশিয়া এবং জাপানের আধা উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল যারা সেখানে প্রচুর ভয়াবহতা সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু তাদের অনুপ্রবেশ ততটা প্রচণ্ড ছিল না, চীনের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তাদের নিয়ন্ত্রণ ততটা সরাসরি ছিল না, যতটা ছিল ভারতে বৃটিশের অনুপ্রবেশ এবং নিয়ন্ত্রণ। এ উপাদানটি চীনের উপর প্রভুত্ব বিস্তারের জন্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সমূহের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টি করেছিল, অন্যান্য উপাদান ছাড়াও এ উপাদনাটিকে মাওসেতুং লক্ষ্য করেছিলেন, সাম্রাজ্যবাদ এবং তার দেশীয় মিত্রদের উৎখাত করে চীনকে সমাজতান্ত্রিক পথে নিয়ে যাবার জন্য অনুকূল বিপ্লবী সুযোগ হিসেবে।
কিন্তু ভারতে বৃটিশ অনুপ্রবেশ এবং নিয়ন্ত্রণ ছিল অত্যন্ত তীব্র, সরাসরি এবং দীর্ঘস্থায়ী। এর ফল হচ্ছে এই যে, এমনকি আজও ভারতীয় সমাজকে কদাচিৎ বুর্জোয়া বলা যায়। ভারতীয় অর্থনীতি আজও সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহের অর্থনীতির লেজুড়। অর্থাৎ শাসক শ্রেণীসমূহ সাম্রাজ্যবাদের অধীনস্ত অংশীদারিত্বের ভূমিকা পালন করছে এবং ভারত দরিদ্রতম দেশসূহের একটি যা এখনো পশ্চাদপদ স্থবিরতায় গড়াগড়ি খাচ্ছে।
ঐতিহাসিক ঘটনাপুঞ্জ নির্ভুলভাবে প্রমাণ করে যে, এশিয়া এবং আফ্রিকার (এবং ল্যাটিন আমেরিকা) যে দেশসমূহে সাম্রাজ্যবাদী অনুপ্রবেশ যত বেশী দুর্বল ছিল সেখানে প্রাক-পুঁজিবাদী থেকে পুঁজিবাদী অথবা সমাজতান্ত্রিক সমাজে উত্তরণ হয়েছে তত কম অসুবিধাজনক। অন্যদিকে যেখানে অনুপ্রবেশ এবং সরাসরি নিয়ন্ত্রণের মাত্রা ছিল বেশি সেখানে উত্তরণ প্রক্রিয়া হয়েছে তত বেশি অসুবিধাজনক। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ উপনিবেশের সবচেয়ে পশ্চাদপদ এবং প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণীসমূহের সাথে মিত্রতা করে উপনিবেশিক দেশটিকে অর্থনৈতিকভাবে নিঃস্ব করার জন্য, এবং এর জনগণকে দাসত্বে আবদ্ধ রাখার জন্যে। এবং এটা উপনিবেশের অর্থনীতিকে মেট্রোপলিটন অর্থনীতির মৌলিক পরিপূরক হিসেবে গড়ে তোলে, যে পরিপূরকতা পরবর্তীতে অর্থনীতির বিকৃতি ঘটায়, এটাকে পশ্চাতে নিয়ে যায় এবং অনুন্নয়নের ভিত্তি নির্মাণ করে। কাজেই উপনিবেশবাদের ভয়াবহতার পক্ষে যৌক্তিকতা প্রদর্শনের জন্য আভিনেরি যে যুক্তি দেন তা ঘোর বাস্তব বিরোধী।
মার্কসের পরবর্তী লেখাগুলো স্পষ্টতঃ দেখায় যে মার্কস নিম্নলিখিত ধারণায় পৌঁছেছিলেন
প্রথমতঃ উপনিবেশিক শাসন বৈপ্লবিক ভূমিকা পালনের পরিবর্তে উপনিবেশের জনগণকে অগ্রসরতার বিপরীতে পশ্চাদপতায় নিক্ষেপ করেছে, পরনির্ভর উল্টোমুখীন অর্থনীতির জন্ম দিচ্ছে— যা মেট্রোপলিটান দেশের অর্থনীতির সাথে দাসত্বের বন্ধনে আবদ্ধ ৷
দ্বিতীয়তঃ প্রাচীন আচার ব্যবস্থার ধ্বংস সাধন- যা উজ্জীবনের পূর্বশর্ত, তা করা উচিত আভ্যন্তরীণ শক্তিসমূহের মাধ্যমে, বৈদেশিক শক্তির মাধ্যমে নয়। এরকম ভূমিকা পালন করতে গিয়ে বৈদেশিক পুঁজির প্রবণতা হচ্ছে প্রাচীন সামাজিক কাঠামো সংশোধিত আকারে সংরক্ষণ করা। এগুলোর প্রয়োজনীয় ধ্বংস সাধন অথবা সামাজিক বিপ্লব উপনিবেশের জনগণের নিজেদের উপর নির্ভর করে।
তৃতীয়তঃ অনুরূপ ধ্বংস সাধনের জন্যে, যা ছাড়া কোনো নির্মাণ অথবা উজ্জীবন সম্ভব নয়, উপনিবেশকে প্রথমেই জাতীয় স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে। উপনিবেশ অথবা আধা-উপনিবেশের জনগণের কোনো সত্যিকার অগ্রগতির প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে নিজস্ব সরকার এবং স্বাধীনতা। উপনিবেশিক শৃঙ্খল চূর্ণ-বিচূর্ণ করা ছাড়া কোন উপনিবেশে নয়া জীবন সম্ভব নয়।
0 Comments